প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

পুরানো সাময়িকী ও সংবাদপত্র

জুন ১৫, ২০১৫

 

জ্যোতিরিঙ্গণ

দীপক সেনগুপ্ত


এদেশে খ্রীষ্টান ধর্ম প্রচারকদের উদ্দেশ্য ছিল নানা ভাবে খ্রীষ্টধর্মের মহত্ব তুলে ধরা এবং অন্য ধর্মের আদর্শকে খর্ব করা। এই উদ্দেশ্যে বেশ কয়েকটি পত্রিকা উনবিংশ শতাব্দিতে প্রকাশিত হয়েছে। এদের মধ্যে ছিল - 'গসপেল ম্যাগজিন'(১৮১৯); 'খ্রীষ্টের রাজ্যবৃদ্ধি'(১৮২২); মঙ্গলোপাখ্যান পত্র'(১৮৪৩); 'উপদেশক'(১৮৪৭); 'সত্যার্ণব'(১৮৫০); ‘তত্ত্ববিকাশিনী' (১৮৬৭); 'বঙ্গমিহির'(১৮৭৩); 'খ্রীষ্টীয় বান্ধব'(১৮৭৯); 'খ্রীষ্টীয় শক্তি'(১৮৯৭) ইত্যাদি। অন্য ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ ও কুৎসা রটনা কতটা তীব্র ছিল সেটার কিছুটা পরিচয় পাওয়া যায় ১৮৪৩ খ্রীষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে প্রকাশিত 'মঙ্গলোপাখ্যান পত্র' নামক পত্রিকায় মুদ্রিত একটি লেখা থেকে (স্বপন বসুর রচনা থেকে সংগৃহীত ।  এর কয়েকটি পংক্তি -

"হিন্দুরা প্রায় সকল প্রকার পাপ করে বিশেষতঃ তাহারা দেবপূজারূপ মহাপাপে দোষী আছে ঘৃণ্য দেবপূজাকারী হিন্দুরা কি ধার্ম্মিক।  তাহা নহে। ... হিন্দুরা ও মুসলমানেরা মরণ সময়ে কি করিবে তাহারা নরকে গমন করিবে। ... হিন্দুরদের তাবৎ পূজা মিথ্যা পাপ শেষে তাহারা দেখিবে যে এবং ঐ পাপের নিমিত্ত পরকালে দুঃখ ভোগ করিতে হইবেক মহম্মদীয়েরা ভরসা করে যে পরণের পর তাহারা ফারদিশে গমন করিবে কিন্তু মুসলমানেরা ফারদিশে গমন করিতে পারিবে না মহম্মদ প্রবঞ্চক ছিল ও কোরাণ মিথ্যা .... "

‘জ্যোতিরিঙ্গণ’ পত্রিকাটির প্রকাশনা শুরু হয়েছিল ১৮৬৯ খ্রীষ্টাব্দের জুলাই মাসে। প্রথম পৃষ্ঠায় পত্রিকার নামের নীচে লেখা থাকত – “ স্ত্রীলোক ও বালকদিগের নিমিত্ত ” এবং তার নীচে থাকত -

ভবানীপুর
কলিকাতা ট্রাক্ট সোসাইটির যত্নে সাপ্তাহিক সংবাদ যন্ত্রে
শ্রীব্রজমাধব বসুর দ্বারা দ্বিতীয়বার মুদ্রিত।
১৮৭০

"দ্বিতীয়বার মুদ্রিত ” লেখা থেকে বোঝা যায় পত্রিকাটির প্রথম কিছু সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল এবং সম্ভবত তা নিঃশেষিত হওয়ায় দ্বিতীয়বার মুদ্রণের প্রয়োজনীয়তা হয়েছিল। ‘জ্যোতিরিঙ্গণ’ খ্রীষ্টধর্ম প্রচারার্থে প্রকাশিত হলেও এর বিদ্বেষভাব ছিল অনেক স্তিমিত; বরং অহল্যা,মৈত্রেয়ী,গার্গী,সীতা,সাবিত্রী প্রভৃতি পুরাকালের স্বনামধন্যা মহিলাদের চরিত্র চিত্রণে যথেষ্ট শ্রদ্ধার ভাব ফুটে উঠেছে। একই সঙ্গে সেকালে সমাজে অনুসৃত কিছু সামাজিক রীতি ও প্রথা যে কল্যাণকর ছিল না পাশাপাশি সেটাও তুলে ধরা হয়েছে। যেমন মৈত্রেয়ী প্রসঙ্গে বলা হয়েছে – “উক্ত বিবরণ পাঠ করিয়া কে না স্বীকার করিবে যে মৈত্রেয়ী উচ্চমনা এবং ধার্ম্মিক ও সুপণ্ডিত স্বামীর সুযোগ্যা ভার্য্যা ছিলেন। অধিকন্তু উক্ত বিবরণ দ্বারা ইহাও সপ্রমান হইতেছে যে পুরাকালের জনগণ আপনাপন স্ত্রীদিগকে যথেষ্ট সম্মান করিতেন,এবং গুরুতর বিষয়ে তাঁহাদের অমতে হস্তক্ষেপ করিতেন না,ও তাঁদিগের সাংসারিক ও পরমার্থিক উভয় সম্বন্ধেই মঙ্গল চেষ্টা করিতেন । কিন্তু আক্ষেপের বিষয় এই,বহুবিবাহরূপ কদর্য রীতি তৎকালেও প্রচলিত ছিল। সুপণ্ডিত যাজ্ঞ্যবল্কের সুযোগ্যা মৈত্রেয়ীর যে কালে সপত্নী ছিল,অপরাপর ভামিনীগণের যে ছিল না,এ কথা কে বলিতে পারে ? এই নিষ্ঠুর পদ্ধতি নিবন্ধন আমাদের দেশের যে কতদূর পর্য্যন্ত অবনতি হইয়াছে,তাহার সমুচিত বর্ণনা করা দুঃসাধ্য। ”

সেকালের অনেক পত্রিকার মতই ‘জ্যোতিরিঙ্গণে’ লেখকের নাম থাকত না। মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘পুরুলিয়া’ (কবিতা ) ৩য় বর্ষে প্রকাশিত হয়েছিল কিন্তু লেখকের নামের পরিবর্তে পাদটীকায় মন্তব্য করা হয়েছে –“একজন বিখ্যাত কবি পুরুলিয়ার খ্রীষ্ট-মণ্ডলীদের লক্ষ্য করিয়া এই কবিতা লিখিয়াছেন। ” তবে ৪র্থ বর্ষে ১৮৭২ খ্রীষ্টাব্দের নভেম্বর সংখ্যায় মাইকেলের ‘কবির ধর্ম্মপুত্র’ কবিতায় কবির নাম “কবিবর শ্রীযুক্ত মাইকেল মধুসূদন দত্ত প্রণীত” ছাপা হয়েছে।

পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় ‘ভূমিকা’ শিরোনামে পত্রিকার উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করা হয়েছে – “আমোদ ও নীতিশিক্ষা একত্র করিবার নিমিত্ত অনেকেই চেষ্টা করিয়া থাকেন,কিন্তু কৃতকার্য্য হওয়া সকলের পক্ষে সমান নহে।  এই অভিপ্রায় সাধোনোদ্দেশে অনেকে যে সকল উপায় অবলম্বন করিয়াছেন,সাময়িক পত্রিকা তৎসমুদয়ের অন্যতর। আমরা এই উপায় অবলম্বন করিয়া বালকবালিকা ও স্ত্রীগণের এককালীন আমোদ ও নীতিশিক্ষার নিমিত্ত যেরূপ সরল ভাষায় সুন্দর চিত্র সম্বলিত নানাবিধ নীতিগর্ভ উপাখ্যান ও ইতিহাসাদিপূর্ণ পত্রিকা প্রচার হইয়া থাকে,ভারতবর্ষে সেরূপ কিছুই নাই। ভারতবর্ষীয় পিতামাতারা সন্তানদিগকে বিদ্যালয়ে নিযুক্ত করিয়া পিতৃকর্ত্তব্য সম্পন্ন হইল,ভাবিয়া নিশ্চিন্ত হন,সন্তানগণের নীতিশিক্ষার নিমিত্ত অন্য কোন প্রকার চেষ্টা করেন না। সন্তানেরাও বিদ্যালয়ে খ্যাতি প্রতিপত্তি লাভ করিতে পারিলেই,আপনাদিগকে চরিতার্থ বোধ করেন। ভারতবর্ষীয় গবর্ণমেণ্টও এ পর্য্যন্ত এ বিষয়ে ঔদাসীন্য অবলম্বন করিয়া আছেন। যাহা হউক,কোন কোন সদাশয় ব্যক্তি কিয়ৎ পরিমাণে এই অভাব দূর করিবার নিমিত্ত এই পত্রখানি প্রচার করতে উদ্যোগী হইয়াছেন। ....

“আমরা যুদ্ধবিগ্রহ ও রাজনীতি প্রভৃতি বিষয় লইয়া আমাদের সুকুমারমতি পাঠকবর্গের মনোরঞ্জন করিব না।  এই পত্রেতে বিবিধ উপাখ্যান,ইতিহাস ও বিজ্ঞানাদি নানাপ্রকার বিসয় থাকিবে।  আমোদসহকৃত নীতিশিক্ষাই ইহার প্রধান উদ্দেশ্য। ....  আমরা আমাদের কোমলমতি পাঠকবর্গের হস্তে সুন্দর সুন্দর ছবি,সরলভাষা,নীতিগর্ভ মিষ্টামিষ্ট গল্প,বিজ্ঞান ও ইতিহাসাদিপূর্ণ প্রবন্ধ প্রদান করিব .....”

প্রথম বছরে যে সমস্ত রচনা প্রকাশিত হয়েছিল তার কয়েকটি হল – ‘ঈগলপক্ষী’,‘সিংহ’, ‘কাণ্ডারীর শরণাগত হও’,‘সন্তানের প্রতি মাতার কর্ত্তব্য’,‘মযূর’,‘স্বর্ণচাঁপা’,‘মহেন্দ্র ও মন্দাকিনী’,‘শকুন্তলা’ ইত্যাদি।
‘জ্যোতিরিঙ্গণ’ খ্রীষ্টধর্মের প্রশংসা করলেও তার সুর ছিল খুব নরম; যেমন ১৮৭০-এর জুন সংখ্যায় ‘মৃত্যুকালে মায়ের নিকট কন্যার বিদায় গ্রহণ’ নামক কবিতার কয়েকটি চরণ -

“অবশেষে করি মাগো এই নিবেদন;
সংসার বাসনা ত্যজি ঐকান্তিক মনে।
যিশু পদচিহ্ণে সদা করহ গমন,
মরিলে হইবে দেখা তথা মম সনে। ” 

অথবা ‘আমার গোপাল’ নামক কবিতায় কোলের শিশু গোপালের মৃত্যুতে মায়ের শোক বিলাপ -

“এক আশা আছে মনে এখনও আমার,-
দেখিব গোপালে আমি তথা পুনর্ব্বার,
বিরাজেন যথা যিশু আপন গৌরবে,
যখন যাইব আমি সে পবিত্র ভবে। ”

পত্রিকাটিতে একরঙা ছবি ছাপা হত। খগেন্দ্রনাথ মিত্র জানিয়েছেন – “ চিত্রের শিল্পী ছিলেন ইংরেজ। কাঠ খোদাই করে বিলাতির অনুকরণে চিত্রগুলি তৈরি করে ছাপা হত।” এখানে পত্রিকা থেকে একটি ছবি সংযোজন করা হয়েছে। কাঠ খোদাই করে এরকম সূক্ষ্ম কাজ কি করে ফুটিয়ে তোলা হত ভাবলে বিস্মিত হতে হয়। পত্রিকাটির পরিচালক ছিলেন রেভারেণ্ড এস. সি. ঘোষ। আকার ছিল ফুলস্কেপ ১৬ পৃষ্ঠা। পত্রিকার ভাষা ছিল ঝরঝরে এবং যতিচিহ্ণের ব্যবহারও ছিল যথাযথ, যেটা সে সময়ের অনেক পত্রিকাতেই দেখা যায় নি। পত্রিকাটির ১২০০ কপি মুদ্রিত হত। এটি ঠিক কতদিন সচল ছিল সে সম্বন্ধে সঠিক তথ্য না থাকলেও, অন্তত ন’বছর চলেছিল বলে জানা যায়।  শিক্ষণীয় রচনা সম্ভারে সমৃদ্ধ ছোটদের একটি উপযুক্ত পত্রিকা ছিল ‘জ্যোতিরিঙ্গণ’।  

সংযুক্ত প্রতিলিপি পরিচয় –



চিত্র ১ :  ১২৭৮ বঙ্গাব্দ ১লা জ্যৈষ্ঠ (রবিবার) তারিখের পত্রিকার প্রারম্ভিক পৃষ্ঠা।





চিত্র ২ :  ১৮৬৯ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর সংখ্যার পত্রিকার দু’টি পৃষ্ঠা।



চিত্র ৩ :  পত্রিকায় মুদ্রিত একটি ছবি।  এটা থেকে সে সময়ের মুদ্রিত ছবি সম্বন্ধে একটা ধারণা করা যায়। কাঠে খোদাই  করা ছবিতে যে কত সুন্দর ভাবে বিষয়বস্তুকে ফুটিয়ে তোলা যেত, এটা তারই একটা উদাহরণ।  


লেখক পরিচিতি : বহু বছর বি.ই. কলেজে (এখন ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, শিবপুর ( IIEST,shibpur )) অধ্যাপনা করেছেন। কিছুদিন হল অবসর নিয়েএখন সেখানে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে আছেন। অ্যাপ্লায়েড মেকানিক্স নিয়ে গবেষণা করলেও একাধিক বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে - জ্যোতিষশাস্ত্র, পুরনো কলকাতার সংস্কৃতি, ইত্যাদি। অবসর সময়ে 'অবসরে'র সঙ্গে সময় কাটান।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।