প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

পুরানো সাময়িকী ও সংবাদপত্র

ফেব্রুয়ারি ১, ২০১৫

 

মাসিক পত্রিকা

দীপক সেনগুপ্ত


‘মাসিক পত্রিকা’ নাম নিয়ে একটি পত্রিকার আত্মপ্রকাশ ঘটে ১৮৫৪ সালের ১৬ই আগষ্ট (১২৬১ বঙ্গাব্দের ১লা ভাদ্র) থেকে। এই মাসিক পত্রিকাটি মূলতঃ মহিলাদের জন্যই উদ্দিষ্ট ছিল। পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যায় বিজ্ঞাপিত হযেছিল :

 “এই পত্রিকা সাধারণের বিশেষতঃ স্ত্রীলোকের জন্য ছাপা হইতেছে, যে ভাষায় আমাদিগের সচরাচর কথাবার্ত্তা হয়, তাহাতেই প্রস্তাব সকল আনা হইবেক। বিজ্ঞ পণ্ডিতেরা পড়িতে চান, পড়িবেন, কিন্তু তাহাদিগের নিমিত্তে এই পত্রিকা লিখিত হয় নাই। প্রতি মাসে এক এক নম্বর প্রকাশ হইবেক, তাহার মূল্য এক আনা মাত্র।”

‘মাসিক পত্রিকা’-র সম্পাদক ছিলেন সেকালের দুই নাম করা ব্যক্তি, হিন্দু কলেজের কৃতবিদ্য ছাত্র ও ডিরোজিওর ছাত্র-শিষ্য, প্যারীচাঁদ মিত্র ও রাধানাথ শিকদার। প্যারীচাঁদের (টেকচাঁদ ঠাকুর) বিখ্যাত গ্রন্থ ‘আলালের ঘরের দুলাল’ ১২৬১ সালের ফাল্গুন (এই পত্রিকার ৭ম সংখ্যা) থেকে ধারাবাহিকভাবে শেষ সংখ্যা (১২৬০ সালের শ্রাবণ) পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছিল। পরে আরও তিনটি অধ্যায় যোগ করে গল্পটি পুস্তকাকারে বেরিয়েছিল। কলকাতা জোড়াসাঁকো শিকদার পাড়ার রাধানাথ শিকদার অনেক বেশি পরিচিত সে সময়ের গণিতজ্ঞ হিসাবে। এভারেস্ট শৃঙ্গের উচ্চতা নির্ণয় করে বিখ্যাত হয়েছিলেন তিনি। সেকালে প্রকাশিত স্বল্পস্থায়ী বহু পত্রিকার মতই ‘মাসিক পত্রিকা’র মাত্র ১৬টি সংখ্যা বের হবার পরেই উঠে যায়। পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত ‘মদ খাওয়া বড় বাড়িতেছে’ শীর্ষক প্রবন্ধটি খুবই কৌতূকপ্রদ। কেদারনাথ মজুমদারের বই থেকে সংগৃহীত কিছু অংশের নমুনা দেওয়া যাক :

“মদের অদ্ভুত শক্তি। যে ব্যক্তি পান করে সে দুধকে জল বলে ও জলকে দুধ বলে। কলিকাতার কোন বুনিয়াদ মাতালের বাড়িতে তাঁহার চাকর প্রস্রাব করিতেছিল, মাতাল বাবুর মস্তকে পড়িলে তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন আমার মাথায় কি পড়িল? পরে শুনিলেন প্রস্রাব। তখন উত্তর করিলেন, তবে ভাল; আমি বোধ করিয়াছিলাম জল।”

“কথিত আছে যে অন্য কোন এক বুনিয়াদ মাতাল বাবু মদে মত্ত হইয়া দশমীর দিবস প্রতিমা বিসর্জ্জনকালীন নৌকা হইতে রোদন করিয়া বলিলেন, “ওরে মা চললেন রে - মার সঙ্গে কেহ কি যাবে না? আমরা সকলে ব্যস্ত, আরে ব্যাটা ঢাকি তুই যা এই বলিয়া ঢাকিকে ধাক্কা দিয়া জলে ফেলিয়া দিলেন।” 
“আর শুনা আছে যে কোন মাতাল ভোজন করিতে বসিয়াছিলেন, তাঁহার পার্শ্বে জলের ঘটি ছিল না, একটি বিড়াল বসিয়াছিল। মাতাল জলের ঘটি মনে করিয়া বিড়ালকে ধরিলেন। বিড়াল মেউ মেউ করিতে আরম্ভ করিল। মাতাল বলিলেন “শালা জলের ঘটি তুই মেউ মেউ কাঁদিয়া কি বাঁচবি, তোকে অগ্রে খাবুই।” পরে বিড়ালকে মুখের কাছে তুলিলে বিড়াল আঁচড় কামড় করিয়া পলায়ন করিল।”

“আর এক ভক্ত মাতালের কথা শুনা আছে, তাহাও বলা যাইতেছে। ঐ মাতালের নাম সিংহ। আপন বাটিতে পূজা হইবে, ষষ্ঠির রাত্রে উঠিয়া প্রতিমার নিকট যাইয়া কোপেতে পরিপূর্ণ হইলেন; সিংহকে বলিলেন, “আরে বেটা সিংহ, তুই নকল সিংহ, আমি আসল সিংহ, তুই বেটা মার পদতলে কেন?” এই বলিয়া সিংহকে ভাঙ্গিয়া আপনি চাদর মুড়ি দিয়া সিংহ হইলেন। প্রাতঃকালে পুরোহিত আসিয়া দেখিলেন বাটির কর্ত্তা সিংহ হইয়া রহিয়াছেন। তিনি আস্তে আস্তে বলিলেন “মহাশয় ওখানে কেন - মহাশয় ওখানে কেন?” কর্ত্তার নেশা ছুটিয়াছিল, সেখান হইতে আস্তে আস্তে উঠিয়া অধোমুখে বৈঠকখানায় গিয়া বসিলেন, গুরু পুরোহিত সকলে বলিতে লাগিলেন “কর্ত্তা বড় ভক্ত, না হবে কেন, সিদ্ধবংশ!”  ইত্যাদি।

পত্রিকাটিতে প্রকাশিত প্রবন্ধাদির ভাষা ছিল অত্যন্ত সহজ ও সরল। কয়েক দশকের মধ্যে ভাষার বিবর্তন অবশ্যই লক্ষ্যণীয়। তবে এই ধরণের লেখা ছাপা হলে, পত্রিকাটি কেন প্রধানতঃ মহিলাদের কথা মনে রেখেই প্রকাশিত হয়েছিল বোঝা গেল না।

পত্রিকাটি সম্বন্ধে একজন সমালোচকের মন্তব্য : “তখনকার সময়ে সংস্কৃতবহুল গুরুগম্ভীর ভাষার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়াস্বরূপ সরস ও সতেজ কথ্য ভাষা সাহিত্যে প্রথম প্রবর্ত্তন করার জন্য এই পত্রিকার নাম বঙ্গসাহিত্যের ইতিহাসে চিরপরিচিত থাকিবে। আবার তৎকালের ‘রসরাজ’ প্রভৃতি অশ্লীলভাষী সংবাদ পত্রাদির কথা উল্লেখ না করিয়াও ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত পরিচালিত ‘সংবাদ প্রভাকরে’ ও ‘গুড়গুড়ে’ ভট্টাচার্য্যের ‘সংবাদ ভাস্করে’ সময়ে সময়ে এমত পূতিগন্ধময় প্রবন্ধ প্রকাশিত হইত যাহা যে কোন শিক্ষিত ব্যক্তি পাঠ করতে লজ্জিত হইতেন। অচিরকালের মধ্যে দেশে একটা নিন্দার বাণী উত্থিত হইল। সকলেই বলিতে লাগিল, এই বর্ব্বরজনোচিত কবির লড়াই যত শীঘ্র বন্ধ হয় ততই ভাল। এজন্য যখন ‘মাসিক পত্রিকা’ প্রকাশিত হইল তখন সকলেই আল্হাদিত হইলেন। এমন কি প্রাচ্যদলের অগ্রণী রাজা রাধাকান্ত দেব বাহাদুর ও প্রসন্নকুমার ঠাকুর প্রভৃতি সকলেই বাঙ্গালা ভাষার স্রোত ফিরাইয়া দিয়াছিল বলিয়া এই পত্রিকার প্রশংসা করিতেন।”   

আজ থেকে প্রায় ৯০ বছর আগে (১৩৩৩ বঙ্গাব্দ) একটি মাসিক পত্রিকার সম্পাদক মন্তব্য করেছেন –“মাসিক পত্রিকাও এক্ষণে দুষ্প্রাপ্য; কদাচ কোন প্রাচীন গ্রন্থাগারে কিম্বা কোন সাহিত্যসেবীর নিকট বহু অনুসন্ধানে দুই এক খণ্ড সংগ্রহ করা যাইলেও যাইতে পরে।” অতএব বর্তমানে এই পত্রিকাটি কতটা দুর্লভ তা সহজেই অনুমেয়।

১২৬১ বঙ্গাব্দের ১লা ভাদ্র প্রকাশিত ‘মাসিক পত্রিকা’র একটি পৃষ্ঠার প্রতিলিপি দেওয়া হল।


লেখক পরিচিতি : বহু বছর বি.ই. কলেজে (এখন ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, শিবপুর ( IIEST,shibpur )) অধ্যাপনা করেছেন। কিছুদিন হল অবসর নিয়েএখন সেখানে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে আছেন। অ্যাপ্লায়েড মেকানিক্স নিয়ে গবেষণা করলেও একাধিক বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে - জ্যোতিষশাস্ত্র, পুরনো কলকাতার সংস্কৃতি, ইত্যাদি। অবসর সময়ে 'অবসরে'র সঙ্গে সময় কাটান।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।