প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

পুরানো সাময়িকী ও সংবাদপত্র

ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০১৬

 

মুকুল

দীপক সেনগুপ্ত


১৩০২ বঙ্গাব্দের আষাঢ় মাসে ‘মুকুল’ সচিত্র মাসিক পত্রিকাটি প্রথম প্রকাশিত হয় শিবনাথ শাস্ত্রীর সম্পাদনায় । শিবনাথ শাস্ত্রীকে সবাই সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের সভ্য ও প্রচারক হিসাবেই চেনেন; তার সাহিত্য কর্মের ততটা খবর রাখেন না । তিনি কিছুদিন ‘সখা’ ও ‘সোমপ্রকাশ’-এর সম্পাদনাও করেছেন ; ‘মদ না গরল’ মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করেছেন; এ ছাড়া কবিতা লেখা ও গ্রন্থ রচনা ত ছিলই। ‘মুকুল’-এর সূচনা কি ভাবে হল ? শিবনাথ শাস্ত্রীর ভাষাতেই শোনা যাক :    

“ যে নীতিবিদ্যালয়টির সহিত আমার সাক্ষাৎ যোগ ছিল, তাহা আমাদের উপাসনা-মন্দিরে বসিল। ইহার প্রধান উদ্যোগকারিণী ও শিক্ষয়িত্রী ছিলেন, আমাদের কয়েকটি কন্যা। গুরুচরণ মহলানবিশ মহাশয়ের কন্যা সরলা, ভগবানচন্দ্র বসু মহাশয়ের কন্যা লাবণ্যপ্রভা, চণ্ডীচরণ সেনের কন্যা কামিনী এবং আমার কন্যা হেমলতা । হেম ইঁহাদের মধ্যে বয়সে সর্বকণিষ্ঠা ছিল। আমি এই নীতিবিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকর্তা ও উৎসাহদাতা ছিলাম । এই কন্যাদের সঙ্গে বসিয়া ধর্মগ্রন্থাদি পাঠ করিতাম, নীতিবিদ্যালয়ের কার্য্যাদি বিষয়ে পরামর্শ করিতাম, ইঁহাদের সকল কাজে সঙ্গে থাকিতাম । কযেক বৎসর পরে ইঁহারা বালকবালিকাদিগের জন্য একখানি মাসিক-পত্রিকা বাহির করিবার সঙ্কল্প করিলেন। তখন আমি তাহার সম্পাদক হইয়া ‘মুকুল’ নাম দিয়া এক মাসিক-পত্রিকা প্রকাশ করিলাম এবং কিছুদিন তাহার সম্পাদকতা করিলাম।”

 ‘মুকুল’ নামকরণ কেন ? প্রথম সংখ্যার প্রস্তাবনা অংশে শিবনাথ লিখেছেন :

     “মুকুল নামটি বেশ। মুকুল বলিলেই অনেকের অনেক কথা মনে হয়। প্রথমে মনে হয়, আশা। যাহা আজ মুকুল আছে, কালি তাহা ফুটিবে। মুকুল আসিয়াছে, পশ্চাতে ফুল ও ফল আসিতেছে। এই জন্যই মুকুল দেখিলেই সকলের আনন্দ; মুকুল দেখিলেই বোঝা যায়, এ বৎসর ফলটা কেমন হইবে। ... চারিদিকে এই দুঃখ শুনিতে পাই, বালকদিগের রীতিনীতির উন্নতি হইতেছে না। অনেকে বলেন, স্কুলে ছেলে পাঠাইতে ভয় হয়, কি শিখিতে কি শিখে। শহরে এই ভয় অতিশয় বাড়িয়াছে । ... তাহা বলিয়া কি বসিয়া থাকিব?  হাত গুটাইয়া বসিয়া কেবল খেদ করা কাপুরুষের কাজ, আশাতে কোমর বাঁধা মানুষের কাজ । অতএব আমরা আশাতে কোমর বাঁধিয়াছি। আশাতে দৃঢ় হইয়া তোমার যাহা করিবার আছে করো, আমার যাহা করিবার আছে করি; ফলাফল ঈশ্বরের হস্তে। তাই মুকুল আশার সংবাদ লইয়া বাহির হইতেছে । ... মানব মুকুলদিগকে ফুটাইবার পক্ষে সাহায্য করাই মুকুলের উদ্দেশ্য । মানুষকে ভালো কথা বলিবার একটা সময় আছে। ভালো কথা সকল কালেই উপাদেয়, কিন্তু শৈশব ইহার অনুকূল সময়।
     “ আমরা মুকুলদিগের হস্তে জ্ঞানের মুকুল দিব, যাহা তাহাদের জীবনে ফুটিয়া ফুল ফলে পরিণত হইবে । ... মুকুল বলিলে দ্বিতীয় কথা মনে পড়ে, সৌরভ। মুকুল যখন ফুটিতে আরম্ভ করে, তখন সুগন্ধে দিক আমোদিত হয়। আমাদের একটা সাধ আছে, আমাদের মুকুলের সুগন্ধও দেশে ছড়াইয়া পড়ুক। ... যাহাতে মুকুল হাতে লইয়াই বালকবালিকার প্রাণ সৌরভে আমোদিত হয়, যাহাতে তাহারা প্রাণ খুলিয়া হাসে, দুই হাত তুলিয়া নৃত্য করে,... বাঃ কি মজার কথা শিখিলাম ভাই বলিয়া আনন্দ করে, সেদিকে আমাদের বিশেষ দৃষ্টি থাকিবে । এই জন্য গল্প, হেঁয়ালি, কবিতা, চিত্র যথেষ্ট পরিমাণে দেওয়া হইবে। যাহা হউক বাক্যে অধিক বলিবার প্রয়োজন নাই। ঈশ্বর আমাদিগকে আশীর্ব্বাদ করুন, পাঠকগণও আশীর্ব্বাদ করুন, যেন আমরা কাজে কিছু করিতে পারি।”  

শিবনাথের উদ্যমের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল প্রবাসী সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় ও বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুর ঐকান্তিক আগ্রহ ও উৎসাহ। ‘মুকুল’-এর পৃষ্ঠা সংখ্যা ছিল সাধারণতঃ ষোল এবং মূল্য ছিল বার্ষিক পাঁচ সিকা ।

১৩০২ বঙ্গাব্দের আষাঢ় মাসে ‘মুকুল’ প্রথম আত্মপ্রকাশ করে। দ্বিতীয় সংখ্যায় শিবনাথ জানাচ্ছেন : “ মুকুল সম্পূর্ণরূপে ছোট শিশুদের জন্য নহে । যাহাদের বয়স ৮/৯ হইতে ১৬/১৭’র মধ্যে ইহা প্রধানত তাহাদের জন্য ।” পত্রিকাটিকে প্রকাশিত উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়িত করতে সম্পাদকেরা চেষ্টার কোন ত্রুটি রাখেন নি। তবে ‘মুকুল’-এ ছবির সংখ্যা কিন্তু ক্রমশঃ কমে এসেছে, কারণ জানা যায় নি। অথচ রঙিন ছবি ছোটদের আকর্ষণ করবে জেনে, ব্লকে ছাপা সাদা-কালো ছবিতে প্রতিটি কপি তিনি আলাদা করে হাতে রঙ করার ব্যবস্থা করেছিলেন। পত্রিকাটি সর্বাঙ্গসুন্দর ও আকর্ষণীয় করে তুলতে শিবনাথের প্রয়াস এর থেকেই অনুমান করা যায়।
যেহেতু প্রথম প্রকাশ আষাঢ় মাসে, অতএব প্রথম বছর পত্রিকাটির ১০টি সংখ্যা প্রকাশিত হয় এবং পরের বছর থেকে ১২টি সংখ্যাই বেরোতে থাকে । তবে ৩য় বছরে অর্থাৎ ১৩০৪ বঙ্গাব্দে আশ্বিন ও কার্তিক মিলে ( ৬ষ্ঠ ও ৭ম সংখ্যা ) একটি সংখ্যাই বেরিযেছিল। এখনকার পাঠকদের কাছে নবকৃষ্ণ ভট্টাচার্য হয় ত সম্পূর্ণ অচেনা একটি নাম।  এখন যারা বয়সে অত্যন্ত প্রবীন তাদের ছোটবেলায় শোনা একটি কবিতা হয় ত মনে পড়তে পারে –

“মৌমাছি মৌমাছি,
কোথা যাও নাচি নাচি
দাঁড়াও না একবার ভাই ...
ঐ ফুল ফোটে বনে,
যাই মধু আহরণে
দাঁড়াবার সময় তো নাই।”

নবকৃষ্ণের লেখা ‘কাজের লোক’ সচিত্র কবিতাটি ‘মুকুলে’র প্রথম সংখ্যাতেই বেরিয়েছিল। এই সংখ্যাতেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ স্বনামধন্য ব্যক্তিদের মাতৃভক্তি সম্বন্ধে ‘মাতৃভক্তি’ শিরোনামে লিখেছেন সম্পাদক শিবনাথ শাস্ত্রী। এছাড়াও লিখেছেন রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, রামব্রহ্ম স্যান্যাল ও শিবনাথ-কন্যা হেমলতা সরকার।  ২য় বর্ষে লিখতে শুরু করেছেন শিশু সাহিত্যিক যোগীন্দ্রনাথ সরকার। তার মজার লেখা ছড়িয়ে আছে ‘মুকুলে’র বহু পাতায়। এই পত্রিকাতেই উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী লিখতে শুরু করেছিলেন ‘ছেলেদের রামায়ণ’। ‘টুনটুনির বই’-এর বহু গল্প বেরিয়েছে  এখানে।

যাদের লেখায় ‘মুকুল’ সমৃদ্ধ হয়েছিল তাদের কয়েক জন হলেন : রবীন্দ্রনাথ, উপেন্দ্রকিশোর, যোগীন্দ্রনাথ সরকার, নবকৃষ্ণ ভট্টাচার্য, দীনেন্দ্রকুমার রায়, সুরেশচন্দ্র সমাজপতি, কামিনী রায়, কুসুমকুমারী দাশ, লাবণ্যপ্রভা বসু, অবলা বসু, প্রিয়ম্বদা দেবী, শরৎকুমারী দেবী, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, জলধর সেন,  হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ, বিপিনচন্দ্র পাল, জগদীশচন্দ্র বসু, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, রামব্রহ্ম সান্যাল, রমেশচন্দ্র দত্ত, অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার,  সখারাম গণেশ দেউস্কর প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ । দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ও অতুলপ্রসাদ সেন একটি করে লিখেছেন। শিবনাথ শাস্ত্রীর সম্পাদনা কালে লেখকের সংখ্যা ছিল ১০৭। যোগীন্দ্রনাথ সরকারের ‘মজার মুল্লুক’ কবিতাটি মনে আছে ? 

“এক যে আছে মজার দেশ
সব রকমে ভালো,
রাত্তিরেতে বেজায় রোদ,
দিনে চাঁদের আলো।” 

এটি বেরিয়েছিল ১৩০৫-এর কার্ত্তিক সংখ্যায়।  এটিই তার পত্রিকায় প্রকাশিত প্রথম কবিতা, এর পরে তিনি অনেক লিখেছেন।  অথবা ১৩০২-এর পৌষ সংখ্যায় প্রকাশিত জীবনানন্দ-জননী কুসুমকুমারী দাশের ‘আদর্শ ছেলে’ কবিতাটি :

“ আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে ?
কথায় না বড় হয়ে;
কাজে বড় হবে।
মুখে হাসি, বুকে বল, তেজে ভরা মন,
‘মানুষ’ হইতে হবে, - এই তার পণ।”

এ কবিতাগুলি ‘মুকুল’-এই সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয়। দ্বিতীয় সংখ্যাতেও লিখেছেন  রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, নবকৃষ্ণ ভট্টাচার্য ও রামব্রহ্ম সান্যাল। এই সংখ্যায় প্রথম লিখেছেন হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ, দীনেন্দ্রকুমার রায় ও রমেশচন্দ্র দত্ত। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর লেখা প্রথম বেরিয়েছে তৃতীয় সংখ্যায়। শিবনাথের অনুরোধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন ‘মুকুলে’। তার ‘কাগজের নৌকা’ কবিতাটি চিত্র সহযোগে বেরিয়েছে ১৩০২-এর আশ্বিন সংখ্যায়।  
রামব্রহ্ম সান্যাল ছিলেন আলিপুর চিড়িয়াখানার রূপকার। জীবজন্তু ও প্রাণি জগৎ নিয়ে তার অনেক লেখা বেরিয়েছে ‘মুকুলে’র পাতায়। বিখ্যাত ব্যক্তিদের সঙ্গে ছোটদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন সম্পাদক শিবনাথ। যেমন ‘অহল্যাবাঈ’ ( ১৩০২, মাঘ ), ‘জেমসেটজি টাটা’ ( ১৩০৫, ফাল্গুন ), ‘মহাত্মা রাজা রামমোহন রায়’ ( ১৩০৭, জ্যৈষ্ঠ )  ইত্যাদি। হান্স এন্ডারসনের রূপকথা গুলি অনুবাদ করেও পরিবেশন করেছেন তিনি। হেঁয়ালি ও ধাঁধা ত ছিলই।

‘মুকুল’-এ ছোটদের লেখাও প্রকাশ করা হত। ১৩০৩ বঙ্গাব্দের জৈষ্ঠ্য সংখ্যায় শ্রীসুকুমার রায় চৌধুরী নামক একটি আট বছর বয়সের বালকের কবিতা ছাপা হয়; কবিতাটির নাম ‘নদী’। সুকুমার রায়কে আবিষ্কার করার কৃতিত্ব সম্ভবত শিবনাথ শাস্ত্রীরই প্রাপ্য।  ইনিই হলেন পরবর্তী কালের ‘আবোল তাবোল’ খ্যাত সুকুমার রায় । বিস্ময়কর প্রতিভার অধিকারী না হলে একটি আট বছরের বালকের পক্ষে এ ধরণের কবিতা রচনা সম্ভব নয়। কবিতাটি একটু দীর্ঘ হলেও এখানে উল্লেখযোগ্য :

“ হে পর্ব্বত যত নদী করি নিরীক্ষণ,
তোমাতেই করে তারা জনম গ্রহণ ।
ছোটবড় ঢেউ সব তাদের উপরে,
কল্‌ কল্‌ শব্দ করি সদা ক্রীড়া করে,
সেই নদী বেঁকে চুরে যায় দেশে দেশে,
সাগরেতে পড়ে গিয়ে সকলের শেষে ।
পথে যেতে যেতে নদী দেখে কত শোভা,
কি সুন্দর সেই সব কিবা মনোলোভা ।
কোথাও কোকিলে দেখে বসি সাথী সনে,
কি সুন্দর কুহু গান গায় নিজ মনে ।
কোথাও ময়ূরে দেখে পাখা প্রসারিয়া
বনধারে দলে দলে আছে দাঁড়াইয়া ।
নদী তীরে কত লোক শ্রান্তি নাশ করে,
কত শত পক্ষী আসি তথায় বিচরে ।
দেখিতে দেখিতে নদী মহাবেগে যায়,
কভুও সে পশ্চাতেতে ফিরে নাহি চায়।” 

পত্রিকার ৩য় বর্ষে রচনা প্রতিযোগিতায় একটি কবিতা লিখে ঋষি অরবিন্দর ভাই বিপ্লবী বারীন ঘোষ পাঁচটাকা পুরস্কার লাভ করেছিলেন। 

শিশু সাহিত্যে  ‘ননসেন্স রাইম’ ( উদ্ভট ছড়া )  প্রথম প্রকাশিত হয় ১৩০৩ বঙ্গাব্দের ‘মুকুল’-এর ফাল্গুন সংখ্যায়। এর প্রবর্তক শিশু সাহিত্যিক যোগীন্দ্রনাথ সরকার।  ‘মুকুল’ পত্রিকাতেই তার ‘কালা হারে কি ধলা হারে’ ( সাদা ও কালো বেড়ালের লড়াই ) এবং ‘পেটুক দামু’ প্রকাশিত হয়। এ দুটি তার ছড়াগ্রন্থ ‘হাসিরাশি’-তে স্থান পেয়েছে ।   সুকুমার রায়ের হাতে ‘ননসেন্স রাইম’ পরে আরও প্রাণবন্ত হয়েছে।
প্রকাশকাল থেকে ১৩০৭-এর চৈত্র সংখ্যা পর্যন্ত ‘মুকুল’ সম্পাদনা করেছেন শিবনাথ শাস্ত্রী । পত্রিকাটি ছোটদের অত্যন্ত প্রিয় ছিল।  ‘মুকুল’ ছোটদের মনে কিরকম উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছিল  সেটি বোঝা যায় ১৩০৩-এর পৌষ সংখ্যায় প্রকাশিত একটি চিঠি থেকে।  চিঠিটি দৌলতপুর থেকে লিখেছেন কালীপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায়, তিনি জানিয়েছেন পত্রিকা পেয়ে তার অসুস্থ ছেলে সুস্থ বোধ করছে।  তিনি লিখেছেন –“যেদিন মুকুল আসে তাহার মুখে সেদিন আর হাসি ধরে না।”  গল্প, কবিতা, ভ্রমণ, জীবনী, ভৌগলিক বিবরণ, ধাঁধা, হেয়ালী নিয়মিত প্রকাশিত হত।  খগেন্দ্রনাথ মিত্রের ভাষায় –“১৮১৮ খ্রিষ্টাব্দে ‘দিগদর্শন’ বাংলার শিশু-সাহিত্য ক্ষেত্রে যে বীজ বপন করে তা সাতাত্তর বৎসরে অঙ্কুরিত হয়ে শাখায় পল্লবে সুশোভিত এবং সুগন্ধি মনোরম কুসুমে কুসুমিত হয়ে ওঠে মাসিক মুকুলে।” ১৩০৩ পৌষ সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে –“আমাদের দেড় হাজারেরও অধিক গ্রাহক আছেন।” সে সময়ের নিরীখে সংখ্যাটা খুব কম নয়। 

শিবনাথ শাস্ত্রীর পরে সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন হেমচন্দ্র সরকার ।  তবে পত্রিকার আদর্শ ধরে রাখতে হেমচন্দ্র সজাগ দৃষ্টি রেখেছেন।  পাঠকদের নৈতিকতা ও মূল্যবোধকে জাগ্রত রাখতে ১৩১৪-এর মাঘ সংখ্যায় প্রকাশিত হয় নফরচন্দ্র কুন্ডুর পরার্থে আত্মদানের কাহিনী : -“ভবানীপুরের একটি রাস্তায় মিউনিসিপালিটির ড্রেন মেরামতকারী দুই জন কুলীকে উদ্ধার করিতে গিয়া নফরচন্দ্র আপন প্রান হারাইয়াছিলেন। ইতিমধ্যে তাহার সেই আত্মদানের স্থানে জনসাধারণের উৎসাহ এবং ব্যয়ে একটি স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপিত হইয়াছে।”   সঙ্গে রয়েছে স্মৃতিস্তম্ভের আলোকচিত্র।  পরের সংখ্যাতেই ‘দুর্ভিক্ষে সাহায্য’ শিরোনামে  বেরিয়েছে একটি বিজ্ঞপ্তি – “মুকুল-এর পাঠক-পাঠিকাদের মধ্যে বোধ হয় সকলেই জানেন যে আজকাল ভারতবর্ষের অনেক স্থানে দারুণ দুর্ভিক্ষ হইয়াছে। অনেক স্থানে অন্নাভাবে বহু সংখ্যক নরনারী ক্লেশ পাইতেছেন। তাহাদেরে সায্যের জন্য অর্থ সংগৃহীত হইতেছে। আমরা আশা করি মুকুলের পাঠক-পাঠিকারাও আপন আপন সাধ্যমত যৎকিঞ্চিৎ সাহায্য করিতে উৎসুক হইবেন। আমাদিগের নিকট অর্থ প্রেরণ করিলে আমরা আনন্দের সহিত যাঁহারা দুর্ভিক্ষপীড়িত লোকদের সেবা করিতেছেন তাঁহাদিগের নিকট পাঠাইয়া দিব। চারি আনা এবং তদুর্দ্ধ দান মুকুলে স্বীকৃত হইবে ”।

শিবনাথের পরবর্তী সম্পাদক হেমচন্দ্রের কাজ খুব সুখের হয় নি । ‘মুকুল’ ক্রমশঃ ঝরে যেতে থাকে।  শিবনাথ শাস্ত্রীর সময়ে যারা লিখেছেন, তারা অনেকেই আর পরে লেখা পাঠান নি।  লেখকের সংখ্যা অনেক কমে এসেছে।  সম্পাদক হেমচন্দ্র ও প্রকাশক অবিনাশ লাহিড়ীকে প্রতি সংখ্যার জন্য অনেক লেখা লিখতে হয়েছে।  এ ছাড়া আর্থিক সংকটও ক্রমশঃ ঘনিয়ে আসে।  ১৩২১-এর পৌষ সংখ্যা থেকে ১৩২২-এর শ্রাবণ পর্যন্ত পত্রিকার প্রকাশ স্থগিত ছিল। ভাদ্র মাস থেকে আবার বেরোতে থাকে, কিন্তু আগের সেই দীপ্তি আর ফিরে আসে নি। তবে ‘মুকুল’ যে অত্যন্ত মনোগ্রাহী ছিল তার প্রমাণ, অসাধারণ বৈচিত্র ও ঔজ্বল্য নিয়ে ‘সন্দেশ’ প্রকাশিত হবার পরেও ‘মুকুল’ আরও ছ’বছর চলেছিল।  ১৩২৫-এর অগ্রহায়ণে ‘মুকুল’-এর শেষ সংখ্যাটি প্রকাশিত হয়। বহুদিন পরে, ১৩৩৫ বঙ্গাব্দে, ‘মুকুল’ পুনরায় প্রকাশিত হয় ‘সঞ্জীবনী’ সম্পাদক কৃষ্ণকুমার মিত্রের কন্যা বাসন্তী চক্রবর্তীর সম্পাদনায় । কিন্তু তা বেশিদিন স্থায়ী হয় নি । এ ভাবেই শেষ হয়ে যায় সে যুগের ছোটদের জন্য রচিত একটি উল্লেখযোগ্য পত্রিকার দীপ্তিময় জীবন ।

পরবর্তী সময়ে ‘মুকুল’ নামে আরও কয়েকটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল। এর মধ্যে একটির  কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ২৫শে ডিসেম্বর ‘মুকুল’ নামে একটি পাক্ষিক পত্রিকা ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। অধুনা বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত হলেও এটি উল্লেখযোগ্য এই কারণে যে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ সৃষ্টির পরে ওপার বাংলা থেকে এই পত্রিকাটিই ছিল ছোটদের জন্য প্রকাশিত প্রথম সাময়িক পত্র। পত্রিকাটির প্রথম সম্পাদক ছিলেন আবদুল্লাহ আল মুতী সরফুদ্দীন, যিনি পরে আবদুল্লাহ আল মুতী নামে বিজ্ঞান বিষয়ক লেখা লিখে প্রখ্যাত হয়েছে এবং সাহিত্য আকাডেমি পুরস্কারও পেয়েছেন।   



লেখক পরিচিতি : বহু বছর বি.ই. কলেজে (এখন ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, শিবপুর ( IIEST,shibpur )) অধ্যাপনা করেছেন। কিছুদিন হল অবসর নিয়েএখন সেখানে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে আছেন। অ্যাপ্লায়েড মেকানিক্স নিয়ে গবেষণা করলেও একাধিক বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে - জ্যোতিষশাস্ত্র, পুরনো কলকাতার সংস্কৃতি, ইত্যাদি। অবসর সময়ে 'অবসরে'র সঙ্গে সময় কাটান।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।