প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

পুরানো সাময়িকী ও সংবাদপত্র

মার্চ ১৫, ২০১৬

 

নবজীবন

দীপক সেনগুপ্ত


বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বঙ্গদর্শন’ প্রকাশিত হয়েছিল ১২৭৯ বঙ্গাব্দের বৈশাখে। চার বছর সম্পাদনার পর এক বছর পত্রিকা বন্ধ থাকে; পরে অগ্রজ সঞ্জীবচন্দ্রের সম্পাদনায় ৫ম ও ৬ষ্ঠ খণ্ড ১২৮৪-৮৫ তে এবং ৭ম থেকে ৯ম খণ্ড ১২৮৭ থেকে ১২৮৯ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত হয়। এর পর শ্রীশচন্দ্র মজুমদারের সম্পাদনায় ১২৯০-এর কার্ত্তিক থেকে মাঘ-এই চারটি সংখ্যা বের হবার পর ‘বঙ্গদর্শন’ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়।

‘নবজীবন’ মাসিক পত্রিকার প্রকাশনা শুরু হয় ১২৯১ বঙ্গাব্দের শ্রাবণ মাসে অক্ষয়চন্দ্র সরকারের সম্পাদনায়। এর পনের দিন পরেই ‘প্রচার’ নামক মাসিকের আত্মপ্রকাশ। এ দুটি পত্রিকার সম্পাদক যারাই হন, মূল প্রেরণা ছিল বঙ্কিমচন্দ্রের। উদ্দেশ্য ছিল একটাই, সে সময়ে যে ধর্মমত এবং তত্ত্ব প্রচারের চেষ্টা ছিল এবং এ সম্বন্ধে বিভিন্ন পত্রিকায় যে সব নিবন্ধ প্রকাশিত হত তার যুক্তিপূর্ণ সমালোচনা এবং সে বিষয়ে মতামত তুলে ধরা। ধর্ম বিষয়ক প্রবন্ধমালার সঙ্গে অন্যান্য গল্প বা কিছু কবিতা প্রকাশিত হলেও মূল বিষয় ছিল ধর্মের ইতিহাস বিশ্লেষণ করে এর প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা এবং পত্রিকার লেখকদের যেটা আদর্শ ধর্মমত বলে মনে হত সেটা যথাযথ প্রকাশ করা।

‘নবজীবন’ ও ‘প্রচার’ প্রায় একই সময়ে প্রকাশিত হয়, উদ্দেশ্যও একই। দুটি পত্রিকারই প্রাণপুরুষ বঙ্কিমচন্দ্র। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ব্রাহ্মসমাজের সদস্য এবং একজন উৎসাহী সমর্থক। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তার সহায়তায় যে সব ধর্মতত্ত্ব প্রচারিত হত, বঙ্কিমচন্দ্র তার সঙ্গে সব সময়ে সহমত পোষণ করতেন না। তার নিজের মনোভাব ব্যক্ত করার জন্য তার নিয়ন্ত্রণে থাকা পত্রিকার প্রয়োজন সিদ্ধ করতেই এই দুটি সাময়িক পত্রের জন্ম। ‘নবজীবন’-এর সূচনায় উদ্দেশ্য সম্বন্ধে যা লেখা হয়েছে, কিছুটা বিস্তৃতভাবে সেটা এখানে উদ্ধৃত হল, না হলে ঠিক কেন এই পত্রিকার প্রয়োজন হয়েছিল সেটা স্পষ্ট হবে না। বলা হয়েছে -

“আর একখানি উচ্চ-অঙ্গের সাময়িক পত্রের প্রয়োজন আছে বটে, কিন্তু এতদিন ধরিয়া যে ভাবে সাময়িক পত্র সকল চলিতেছিল, সেইরূপ পত্রেই কি বর্ত্তমান বাঙ্গালির অভাব পূরণ এবং মানসিক তৃপ্তিসাধন হইবে? আমাদের তাহা বোধ হয় না। বাঙ্গালির হৃৎক্ষেত্রে যুগান্তর উপস্থিত। যখন তত্ত্ববোধিনী প্রকাশিত হয়, সেই এক যুগ; বিবিধার্থ সংগ্রহ আর এক যুগ; বঙ্গদর্শন প্রভৃতির আবির্ভাব তৃতীয় যুগ; এখন আবার যুগান্তর উপস্থিত। ....

“ভারতবাসী চিরদিনই ধর্ম্মব্রত। পাশ্চাত্ত্য সভ্যতার আলোকের প্রতিবিম্ব পাইয়া প্রথমে ভারতবাসী ধর্ম্মের নাম লইয়া গাত্রোত্থান করিল। ধর্ম্মের কথাই কহিতে লাগিল। খ্রীষ্টানের একেশ্বরবাদের কথা শুনিয়া আপনাদের প্রাচীন বৈদান্তিক এবং তান্ত্রিক একেশ্বরবাদ গৌরবে প্রচার করিল। মহাত্মা রামমোহন রায় অবতীর্ণ হইলেন। দেশীয় ও বিলাতীয় একেশ্বরবাদে ঘোরতর বিতর্ক চলিতে লাগিল; ইংরাজি ও বাঙ্গালায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ধর্ম্মপুস্তিকা প্রচলিত হইল। আন্দোলনে বাঙ্গালা মাতাইয়া মহাত্মা স্বর্গারোহণ করিলেন; ঝঞ্ঝাবাত্যা থামিল, তরঙ্গ কমিয়া আসিল; কিন্তু স্রোত চলিতেছে। সেই স্রোতের বাহিনী তত্ত্ববোধিনী। সুতরাং প্রথম প্রথম তত্ত্ববোধিনী কেবল ধর্ম্মকথাতেই পরিপূরিতা। আমাদের দেশে কিন্তু প্রত্নতত্ত্ব একটু না বুঝিলে ধর্ম্মতত্ত্ব বুঝা কঠিন; কাজেই তাহাতে প্রত্নতত্ত্ব আসিল; ক্রমে দেহতত্ত্ব, প্রাণীতত্ত্ব, জড়তত্ত্ব আসিয়া পড়িল; চারুপাঠের ভ্রূণ তত্ত্ববোধিনী-গর্ভে বর্দ্ধিত হইতে লাগিল; যুগ হইতে যুগান্তর এইরূপই হয়। য়ুরোপীয় ধর্ম্মহীন বিজ্ঞান ক্রমেই দেশে আধিপত্য বিস্তার লাভ করিতে লাগিল; ধর্ম্মের স্রোত মন্দা হইল, তত্ত্ববোধিনীর তত্ত্বকথা আর কেহ পাঠ করিল না। তত্ত্ববোধিনীতে যে সকল প্রাণীতত্ত্ব, জড়তত্ত্ব প্রকাশিত হয়, তাহাই সাধারণে পাঠ করেন।

“পদার্থতত্ত্ব প্রবেশ করিতে করিতে বঙ্গবাসীর ভূগোল ইতিহাসের বুভুক্ষা হইল; এই বুভুক্ষা নিবারণের জন্যই বিবিধার্থ সংগ্রহের অবতারণা। .... বাঙ্গালি মগধ, কাশ্মীরের ইতিহাস শুনিল, রাজপুতগণের কীর্তিকলাপ শ্রবণ করিল; বহুকালের পতিত ক্ষেত্র স্থানে স্থানে কর্ষিত হইল; জাতি-ভক্তি বীজের এখানে সেখানে অঙ্কুর দেখা দিল। বাঙ্গালি তখন অল্প অল্প জ্ঞান লাভ করিয়া উপদেশ লাভের জন্য ব্যস্ত হইল।

“বঙ্গদর্শন এই উপদেষ্টা বন্ধুভাবে জন্মগ্রহণ করিলেন। বঙ্গদর্শন, বান্ধব, আর্য্যদর্শন, ভারতী উচ্চ শ্রেণীর শিক্ষক; ইহাঁদিগকে কানে-কলম-দেওয়া পাখীর কথা বলিতে হয় নাই; জল জমিলে বরফ হয় বুঝাইতে হয় নাই; ভারতচন্দ্রের জীবনী বা রত্নাবলীর কেবল গল্পভাগ বাঙ্গালিকে শিখাইতে হয় নাই। বঙ্গদর্শন প্রভৃতি উচ্চশ্রেণীর ছাত্র পাইয়া উচ্চতর উপদেশ প্রদান করিতে লাগিলেন।

“ .... চিন্তাশীল বাঙ্গালি দেখিতে দেখিতে এই অন্তস্তরের আভাস পাইয়াছেন। একটু একটু বুঝিতেছেন, যে, সেই মূলীভূত মূলীভূত সারস্তরের কথা উপেক্ষা করিয়া সাম্যবাদ বা বৈষম্যবাদ, বিতর্কবাদ বা স্থিতিবাদ, কিছুই বুঝিতে পারা যায় না। সেই বিশাল মহান আশ্রয়-স্তরের নাম - ধর্ম। নবযুগের অভ্যুত্থানের সঙ্গে সঙ্গে বাঙ্গালি একটু একটু বুঝিতেছেন, যে, ধর্ম্মে উপেক্ষা করিলে আমরা কোন তত্ত্বই বুঝিব না, আমাদের কোন উন্নতিই হইবে না।

“এতদিন পরে এই ভাবের আভাস পাইয়াছি মাত্র; ধর্ম্মের বিশ্বোদর ভাব যে আমরা সম্যক উপলব্ধি করিতে পারিয়াছি, সে ভ্রম বা স্পর্দ্ধা আমাদের নাই। নিয়মিত রূপে সাময়িপত্রে এই বিষয়ের চর্চ্চা করিয়া, আমরা আপনারাও বুঝিব,, এবং সাধারণকে বুঝাইব এ আশা আমাদের হৃদয়ে আছে। ... সিদ্ধি মানবের সাধ্যায়ত্ত্ব নহে। তবে এই সাধনা করিতে আমরা পারি বটে। সকলে বলুন, এই সাধনায় যেন আমাদের জ্ঞানকৃত ত্রুটি না হয়।”

উদ্ধৃতিটি কিছুটা দীর্ঘ, কিন্তু এর মাধ্যমে শুধু পত্রিকা প্রকাশের উদ্দেশ্যই নয় সমসাময়িক পরিস্থিতিতে ধর্ম বিষয়ক আলোচনার প্রয়োজনীয়তা এবং এ বিষয়ে সর্ব্বসাধারণকে শিক্ষিত ও সচেতন করে তুলতে দায়িত্বশীল লেখক হিসাবে বঙ্কিমচন্দ্রের নিজস্ব চিন্তাধারা ও তার ভবিষ্যৎ কর্মসূচীও সুন্দরভাবে পরিস্ফুট হয়েছে।
পত্রিকায় ধর্ম সম্বন্ধে অনেক প্রবন্ধ বঙ্কিমচন্দ্র নিজেই লিখেছেন। লেখকদের মধ্যে ছিলেন - বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, নবীনচন্দ্র সেন, তারাপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দীনেশচন্দ্র সেন, চন্দ্রনাথ বসু, তিনকড়ি মুখোপাধ্যায়, তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, হরিসাধন মুখোপাধ্যায়, শ্যামাসুন্দরী দেবী, ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, চন্দ্রশেখর বসু, চিরঞ্জীব শর্ম্মা প্রমুখ।

‘নবজীবন’ পত্রিকা “৫১নং মৃজাপুর ষ্ট্রীট, সাধারণী প্রেসে শ্রীউমাচরণ চক্রবর্ত্তী দ্বারা মুদ্রিত ও প্রকাশিত” হত। মূল্য ছিল বার্ষিক তিন টাকা। প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত রচনা ছিল - সূচনা, ধর্ম জিজ্ঞাসা (বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়), সিংহল যাত্রা (তারাপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায), সমাজ-শরীর, হরগৌরী সম্বাদে সর্ষপ মাহাত্ম্য কথন, নবজীবনের গান (কবিতা), কুঞ্জ সরকার, ভানুসিংহ ঠাকুরের জীবনী, মদন পূজা ( কবিতা )। আচার্য্য রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর প্রথম রচনা ‘মহাশক্তি’ পত্রিকাটির ১ম বর্ষের পৌষ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। ‘নবজীবন’ স্থায়ী হয়েছিল পাঁচ বছর।
সংযুক্ত প্রতিলিপি :





চিত্র – ১ : পত্রিকার একটি সংখ্যার প্রথম পৃষ্ঠা।



চিত্র – ২ : ১২৯২ সালে প্রকাশিত প্রথম বছরের লেখক সূচী।




লেখক পরিচিতি : বহু বছর বি.ই. কলেজে (এখন ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, শিবপুর ( IIEST,shibpur )) অধ্যাপনা করেছেন। কিছুদিন হল অবসর নিয়েএখন সেখানে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে আছেন। অ্যাপ্লায়েড মেকানিক্স নিয়ে গবেষণা করলেও একাধিক বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে - জ্যোতিষশাস্ত্র, পুরনো কলকাতার সংস্কৃতি, ইত্যাদি। অবসর সময়ে 'অবসরে'র সঙ্গে সময় কাটান।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।