পুরানো সাময়িকী ও সংবাদপত্র
মার্চ ৩০, ২০১৬
প্রচার
দীপক সেনগুপ্ত
১২৯১ বঙ্গাব্দের শ্রাবণ মাসে (১৮৮৪ সালে ) বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উৎসাহে মাসিকপত্র ‘প্রচার’ প্রকাশিত হয়। বঙ্কিমচন্দ্র নিজেই জানিয়েছেন – “নবজীবনের পনের দিন পরে,প্রচারের প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হইল। প্রচার,আমার সাহায্যে ও আমার উৎসাহে প্রকাশিত হয়।” পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় ‘সূচনা’ শিরোনামে তিনি জানিয়েছেন :
“আমাদের এই মাসিক পত্রখানি অতি ক্ষুদ্র। এত ক্ষুদ্র পত্রের একটি বিস্তারিত মুখবন্ধ লেখা কতকটা অসঙ্গত বোধ হয়। বড় বড় এবং ভাল ভাল এত মাসিক পত্র থাকিতে আবার একখানি এমন ক্ষুদ্র পত্র কেন? সেই কথা বলিবার জন্যই এই সূচনাটুকু আমরা লিখিলাম।
“... পৃথিবীতে হিমালয়ও আছে,বল্মীকও আছে। সমুদ্রে জাহাজও আছে,ডিঙ্গীও আছে। তবে ডিঙ্গীর এই গুণ,জাহাজ সব স্থানে চলে না,ডিঙ্গী সব স্থানে চলে। যেখানে জাহাজ চলে না,আমরা সেইখানে ডিঙ্গী চালাইব। চড়ায় ঠেকিয়া বঙ্গদর্শন-জাহাজ বানচাল হইয়া গেল - প্রচার ডিঙ্গী,এ হাঁটু জলেও নির্বিঘ্নে ভাসিয়া যাইবে ভরসা আছে।
“দেখ,ইউরোপীয় এক একখানি সাময়িক পত্র,আমাদের দেশের এক একখানি পুরাণ বা উপপুরাণের তুল্য আকার; -দৈর্ঘ্যে, প্রস্থে, গভীরতা এবং গাম্ভীর্য্য কল্পান্তজীবী মার্কণ্ডেয় বা অষ্টাদশ পুরাণ-প্রণেতা বেদব্যাসেরই আয়ত্ত বলিয়া বোধ হয়। .... যাহাদিগকে শারীরিক বা মানসিক পরিশ্রম করিয়া দিনপাত করিতে হয়,অর্থচিন্তায় এবং সংসারের জ্বালায় শশব্যস্ত,মহাজনের তাড়নায় বিব্রত,- একমাসে চার ফর্ম্মা পড়া তাঁহারা বিড়ম্বনা মনে করেন। তাঁহাদের মধ্যে অনেকেই টাকা দিয়া বা না দিয়া ছয় ফর্ম্মার মাসিক পত্রিকা লইয়া দুই একবার চক্ষু বুলাইয়া তক্তপোষের উপর ফেলিয়া রাখেন। তারপর সেই জ্ঞানবুদ্ধিবিদ্যারসপরিপূর্ণ মাসিক পত্রখণ্ড ক্রমে ক্রমে গড়াইতে গড়াইতে তক্তপোষের নীচে পড়িয়া যায়। স্রুয়মান দীপতৈল তাকে নিষিক্ত করিতে থাকে। বুভুক্ষু পিপীলিকা জাতি তদুপরি বিহার করিতে থাকে। এবং পরিশেষে বালকেরা তাহা অধিকৃত করিয়া কাটিয়া ছাঁটিয়া,ল্যাজ বাঁধিয়া দিয়া,ঘুড়ী করিয়া উড়াইয়া দেয়; হেম বাবু,রবীন্দ্রবাবু,নবীন বাবুর কবিতা,দ্বিজেন্দ্র বাবু,যোগেন্দ্র বাবুর দর্শনশাস্ত্র; বঙ্কিম বাবুর উপন্যাস,চন্দ্র বাবুর সমালোচন,কালীপ্রসন্ন বাবুর চিন্তা সূত্রবদ্ধ হইয়া পবনপথে উত্থানপূর্ব্বক বালকমণ্ডলীর নয়নান্দ বর্দ্ধন করিতে থাকে। আর যে খণ্ড সৌভাগ্যশালী হইয়া অন্তঃপুরমধ্যে প্রবেশ করিল,তাহার ত কথাই নাই। উনন ধরান,মশলা বাঁধা,মোছা,মাজা,ঘষা প্রভৃতি নানাবিধ সাংসারিক কার্য্যে নিযুক্ত হইয়া,সে পত্র নিজ সাময়িক জীবন চরিতার্থ করে। .....
“তারপর টাকার কথা। বৎসরে তিন টাকা অতি অল্প টাকা অথচ সাময়িক পত্রের অধিকারী ও কার্য্যধ্যক্ষগণের নিকট শুনিতে পাই যে তাহাও আদায় হয় না। ... যাঁহারা তিন টাকা দিতে পারেন না,তাঁহারা দেড় টাকা দিতে পারিবেন এমত বিবেচনা করিয়া আমরা এই নূতন সাময়িক পত্র প্রকাশ করিলাম। ....
“অনেকে জিজ্ঞাসা করিতে পারেন যে,যদি লোক পড়েই না,টাকাই দেয় না,তবে এত ভস্মরাশির উপর আবার এ নূতন ছাইমুঠা ঢালিবার প্রয়োজন কি? সাময়িক সাহিত্য যদি আমরা ছাই ভস্মের মধ্যে গণনা করিতাম,তাহা হইলে অবশ্য আমরা এ কার্য্যে হাত দিতাম না। আমাদের বিবেচনায় সভ্যতা-বৃদ্ধির এবং জ্ঞানবিস্তারের সাময়িক সাহিত্য একটি প্রধান উপায়। তাহা না থাকিলে লেখক ও ভাবুকদিগকে প্রত্যেকে এক এক খানি নূতন গ্রন্থ প্রকাশ করিতে হয়। বহু সংখ্যক গ্রন্থ সাধারণ পাঠক কর্ত্তৃক সংগৃহীত ও অধীত হইবার সম্ভাবনা নাই। অতএব সাময়িক পত্রই প্রাচীন জ্ঞান ও নূতন ভাব উভয় প্রচারপক্ষেই সর্ব্বোৎকৃষ্ট উপায়। এই জন্যই আমরা সর্ব্বসাধারণের সুলভ সাময়িক পত্রের প্রচারে ব্রতী হইয়াছি। আমাদের অত্যন্ত সৌভাগ্যের বিষয় এই যে,এই সময়ে, ‘নবজীবন’ নামে অত্যুৎকৃষ্ট উচ্চদরের সাময়িক পত্রের প্রকাশ আরম্ভ হইয়াছে। আমরা সেই মহদ্দৃষ্টান্তের অনুগামী হইয়া এই ব্রত পালন করিতে যত্ন করিব। ‘সত্য’,’ধর্ম’ এবং ‘আনন্দের’ প্রচারের জন্যই আমরা এই সুলভ পত্র প্রচার করিলাম এবং সেই জন্যি ইহার নাম দিলাম ‘প্রচার’।
“ যখন সর্ব্বসাধারণের জন্য আমরা পত্র প্রচার করিতেছি,তখন ইহা অবশ্য আমাদিগের উদ্দেশ্য যে,প্রচারের প্রবন্ধগুলি সর্ব্বসাধারণের বোধগম্য হয়। আমাদিগের পূর্ব্ববর্ত্তী সম্পাদকেরা এ বিষয়ে কতদূর মনোযোগী হইয়াছিলেন,তাহা বলিতে পারি না - আমাদের এ বিষয়ে মনোযোগ থাকিবে ইহা বলিতে পারি। কাজটি কঠিন,কৃতকার্য্য হইতে পারিব,এমন ভরসা অতি অল্প। তবে সর্ব্বসাধারণ পাঠ্য বলিয়া আমরা বালকপাঠ্য প্রবন্ধ ইহাতে সন্নিবেশিত করিব না। ....
“এ শিক্ষা শিখাইবে কে ? এ পত্রের শিরোভাগে ত সম্পাদকের নাম নাই। থাকিবার কোন প্রয়োজন দেখি না। সম্পাদক কে,পাঠকের জানিবার কোন প্রয়োজন নাই; কেন না পাঠকেরা প্রবন্ধ পড়িবেন,সম্পাদককে পড়িবেন না। সম্পাদকের এমন কোন দাবি দাওয়া নাই যে,তিনি আত্মপরিচয় দিয়া পাঠকদিগের সম্মুখীন হইতে পারেন। তাঁহার কাজ,যাঁহারা বিদ্বান,ভাবুক,রসজ্ঞ,লোকহিতৈষী এবং সুলেখক,তাঁহাদের লিখিত প্রবন্ধ সকল সংগ্রহ করিয়া পাঠকদিগকে উপহার প্রদান করেন। এ কাজ তিনি পারিবেন,এমন ভরসা করেন। আমরা মনুষ্যের নিকট সাহায্যের ভরসা পাইয়াছি। এক্ষণে যিনি মানুষের জ্ঞানাতীত,যাঁহার নিকট মনুষ্যশ্রেষ্ঠও কীটানুমাত্র,তাঁহার সাহায্যের প্রার্থনা করি। সকল সিদ্ধিই তাঁহার প্রসাদমাত্র এবং সকল অসিদ্ধি তাঁহার কৃত নিয়ম লঙ্ঘনেরই ফল ।”
পত্রিকায় সম্পাদকের নাম প্রকাশিত না হলেও জানা যায় প্রথম সম্পাদক ছিলেন উমাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। পরে প্রকাশক হিসাবে তার নাম মুদ্রিত হয়েছে। ১২৯৩ থেকে ১২৯৫ বঙ্গাব্দ পর্যন্ত সম্পাদনা করেছেন বঙ্কিম-জামাতা রাখালচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। সম্ভবতঃ এর পরে পত্রিকাটির প্রকাশ বন্ধ হয়ে যায় । তবে সম্পাদক যিনিই থাকুন বঙ্কিমচন্দ্রই অন্তরালে সব দেখাশোনা করতেন। প্রসঙ্গান্তর হলেও উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ইতিহাসবিদ হরিসাধন মুখোপাধ্যায়ের প্রথম রচনা ‘প্রাচীন কলকাতা’ ‘নবজীবন’ পত্রিকায় প্রকাশিত হলে, সেটি বঙ্কিমচন্দ্রের নজরে পড়ে এবং তিনি জামাতা ও ‘প্রচার’-সম্পাদক রাখালচন্দ্রকে দিয়ে হরিসাধনকে ডেকে পাঠান এবং উৎসাহিত করেন। রাখালচন্দ্র ছিলেন হরিসাধনের বন্ধু।
বাইরে প্রকাশিত কারণ যাই হোক,বঙ্কিমচন্দ্রের প্রকাশিত কিছু বিশেষ ধর্মতত্ত্ব এবং নির্দিষ্ট কিছু নীতিবোধ ও আদর্শ নিয়ে রবীন্দ্রনাথের যে সমালোচনা ছাপা হয় তারই যথাযথ উত্তর ও বিতর্কের জবাব দেবার জন্যই মনে হয় ‘প্রচার’-এর প্রয়োজন হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে ‘প্রচার’-এর ১২৯১ অগ্রহায়ণ সংখ্যায় বঙ্কিমচন্দ্র ‘আদি ব্রাহ্মসমাজ ও নব হিন্দু সম্প্রদায়’ নামক একটি প্রবন্ধে যা লিখেছেন তার কিছুটা অংশ এখানে তুলে ধরা যেতে পারে :
“বাবু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্প্রতি একটি বক্তৃতা করেন। তাহা অগ্রহায়ণের ভারতীতে প্রকাশিত হইয়াছে। প্রস্তাবটির শিরোনাম ‘একটি পুরাতন কথা’। বক্তৃতাটি শুনি নাই,মুদ্রিত প্রবন্ধটি দেখিয়াছি। নিম্নস্বাক্ষরকারী লেখক তাহার লক্ষ্য।
“ইহা আমার পক্ষে কিছুই নূতন নহে। রবীন্দ্র বাবু যখন ক,খ,শিখেন নাই,তাহার পূর্ব্ব হইতে এরূপ সুখ দুঃখ আমার কপালে অনেক ঘটিয়াছে। আমার বিরুদ্ধে কেহ কখন কোন কথা লিখিলে বা বক্তৃতায় বলিলে এ পর্য্যন্ত কোন উত্তর করি নাই। কখন উত্তর করিবার প্রয়োজন হয় নাই। এবার উত্তর করিবার একটু প্রয়োজন পড়িয়াছে। না করিলে যাহারা আমার কথায় বিশ্বাস করে,( এমন কেহ থাকিলে থাকিতে পারে ) তাহাদের অনিষ্ট ঘটিবে।
“ কিন্তু সে প্রয়োজনীয় উত্তর দুই ছত্রে দেওয়া যাইতে পারে। রবীন্দ্র বাবুর কথার উত্তরে ইহার বেশী প্রয়োজন নাই। রবীন্দ্র বাবু প্রতিভাশালী,সুশিক্ষিত,সুলেখক,মহৎস্বভাব,এবং আমাদের বিশেষ প্রীতি,যত্ন এবং প্রশংসার পাত্র। বিশেষত তিনি তরুণবয়স্ক। যদি তিনি দুই একটি কথা বেশী বলিয়া থাকেন,তাহা শুনাই নীরবে আমার কর্ত্তব্য।
“ তবে যে কয় পাতা লিখিলাম,তাহার কারণ,এই রবির পিছনে একটা বড় ছায়া দেখিতেছি। রবীন্দ্র বাবু আদি ব্রাহ্ম সমাজের সম্পাদক। সম্পাদক না হইলেও আদি ব্রাহ্ম সমাজের সঙ্গে তাঁহার সম্বন্ধ বিশেষ ঘনিষ্ঠ,তাহা বলা বাহুল্য। বক্তৃতাটি শুনিয়া আমার আদি ব্রাহ্ম সমাজের সম্বন্ধে কতকগুলি কথা মনে পড়িল। আদি ব্রাহ্ম সমাজের লেখকদিগের নিকট আমার কিছু নিবেদন আছে। সেই জন্যই লিখিতেছি। ......।”
এ রকম সমালোচনা ও তার প্রত্যুৎত্তর যথেষ্ট চলেছিল। মূল বিষয় ছিল ধর্মমত নিয়ে চিন্তার পার্থক্য। ধর্ম বিষয়ক প্রবন্ধ প্রকাশকে যে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে ‘প্রচার’-এর ১২৯১ জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায় ‘আগামী বৎসরে প্রচার যেরূপ হইবে’ শীর্ষক প্রবন্ধে সেটি পরিষ্কার বলা হয়েছে। প্রবন্ধটিতে বলা হয়েছে -
>
“.... যখন প্রচার প্রথম প্রকাশ হয় তখন আমাদের এমন অভিপ্রায় ছিল না,যে প্রচার কেবল ধর্ম্মবিষয়ক পত্র হইবে। কিন্তু প্রচারের লেখকদিগের রুচির গতিকে,বিশেষতঃ প্রধান লেখকের অভিপ্রায় অনুসারে,ইহাতে এখন ধর্ম্মবিষয়ক প্রবন্ধ ভিন্ন আর কিছু থাকে না।
“ইহাতে প্রচারের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হইবার সম্ভাবনা নাই। জ্ঞানের মধ্যে ধর্ম্মজ্ঞানই সর্ব্বশ্রেষ্ঠ বটে,কিন্তু অন্যান্য জ্ঞান ভিন্ন ধর্ম্মজ্ঞানের সম্যক স্ফূর্ত্তি হয় না....
“ ধর্ম্মবিষয়ক প্রবন্ধ যেরূপ প্রকাশিত হইতেছে সেইরূপ হইতে থাকিবে। এখন যাঁহারা তাহা লিখিতেছেন, তাঁহারাই তাহা লিখিবেন।”....
ধর্ম্মবিষয়ক প্রবন্ধের মুখ্য লেখক ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র স্বয়ং। বঙ্কিম রচনাবলীর সম্পাদকমণ্ডলী জানিয়েছেন – ‘দেবতত্ত্ব ও হিন্দুধর্ম্ম’ বঙ্কিমচন্দ্রের একটি অসম্পূর্ণ রচনা – ‘প্রচার’-এর প্রথম দুই বৎসরের কয়েকটি সংখ্যায় প্রবন্ধগুলি প্রকাশিত হয়। বঙ্কিমের মৃত্যুর প্রায় পয়তাল্লিশ বৎসর পরে পর্যন্ত প্রবন্ধগুলি বাঙালী পাঠকসমাজের অগোচরে থেকে গিয়েছিল; বঙ্গাব্দ ১৩৪৫ সনে সজনীকান্ত দাস মহাশয় এগুলির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। পরে এগুলি পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়।
বঙ্কিমচন্দ্রের ‘সীতারাম’ ‘প্রচার’-এর প্রথম সংখ্যা (শ্রাবণ ১২৯১) থেকে ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়; মাঝে বন্ধ থেকে আবার শ্রাবণ ১২৯৩ থেকে বের হয়ে ১২৯৩-এর মাঘে সমাপ্ত হয়। গীতার ব্যাখ্যা সম্বলিত বঙ্কিমচন্দ্রের ‘শ্রীমদ্ভবদ্গীতা’ গ্রন্থটি লেখক সম্পূর্ণ করে যেতে পারেন নি। তবে ১২৯৩ বঙ্গাব্দের শ্রাবণ সংখ্যা থেকে ১২৯৫-এর ফাল্গুন সংখ্যার ‘প্রচার’-এ গীতার ২য় অধ্যায় অবধি ব্যাখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল।
তবে ‘সীতারাম’ প্রকাশ সম্বন্ধে সম্পাদকের বক্তব্য প্রথম বর্ষের ২৯২ পৃষ্ঠায় “সম্পাদকীয় উক্তি” শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে। সেটি এখানে তুলে দিচ্ছি –
“কোন কর্ম্মে প্রবৃত্ত হইবার সময়ে যে যেরূপ সঙ্কল্প করা যায়, কর্ম্ম সম্পাদন কালে সেরূপ দাঁড়ায় না। প্রচারের প্রথম সংখ্যা প্রকাশ কালে আমাদের স্থির বিশ্বাস ছিল যে, প্রচারে উপন্যাস থাকার কোন আপত্তি হইতে পারে না। কিন্তু এখন বিশেষ আপত্তি দেখিতেছি। প্রচারের আকার ক্ষুদ্র, কিন্তু উদ্দেশ্য গুরুতর। ইহাতে উপন্যাস দিতে গেলে একবারে এক পরিচ্ছেদের বেশী দিবার স্থান হয় না। কিন্তু উপন্যাস অত একটু একটু করিয়া প্রকাশিত হইতে থাকিলে, তাহাতে কোন রস থাকে না। পাঠকের তাহা রুচিকর হউক বা না হউক, উপন্যাস লেখকের তাহাতে বিশেষ আপত্তি। লেখক বলিতে পারেন, এবং “সীতারাম” লেখক বলিয়া থাকেন, যে ইহাতে উপন্যাসের মর্য্যাদা থাকে না।
“অতএব আমরা এ সংখ্যায় সীতারাম প্রকাশ করিলাম না। এবং ভবিষ্যতে করিবারও ইচ্ছা নাই। তবে, পাঠকদের নকট স্বীকৃত আছি যে, তাঁহাদিগকে “সীতারাম” উপহার দিব। আমরা সে অঙ্গীকার যতদূর পারি রক্ষা করিব। সীতারাম সম্পূর্ণ হইয়া শীঘ্র পুনর্মুদ্রিত হইবে। পুনর্মুদ্রিত হইলে, প্রচারের পাঠকদিগকে অর্দ্ধেক মূল্যে পুস্তক দিবেন, গ্রন্থকারের এমন অভিপ্রায় আছে।”
যে কারণেই হোক “সীতারাম” কিন্তু প্রকাশিত হয়েছিল।
পত্রিকার অপর এক উদ্দেশ্য স্পষ্ট করা হয়েছে। বলা হয়েছে – “ ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের কবিতাগুলি পুনর্মুদ্রিত হইবে। সেইগুলি সাধারণে পরিচিত হয়,ইহা প্রচারকদিগের উদ্দেশ্য। অন্যান্য পত্রে,সকল কবিতার নমুনা বাহির হইয়াছে। আমরা অন্য রকমের একটা উদাহরণ দিলাম।” এই মন্তব্য সহ ‘সব হ্যায় ফাক’ শিরোনামে একটি কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। কবিতার কয়েকটি পংক্তি –
“ দুনিয়ার মাঝে বাবা সব হ্যায় ফাক বাবা সব হ্যায় ফাক।
ধনের গৌরব কেন মিছা কর জাঁক,বাবা মিছা কর জাঁক।।
পেয়েছ যে কলেবর,দৃশ্য বটে মনোহর,
মরণ হইলে পর,পুড়ে হবে খাক।
আমি আমি অহঙ্কার,আমার এ পরিবার,
কোথায় রহিবে আর,আমি আমি বাক।।
দুনিয়ার মাঝে বাবা সব হ্যায় ফাক।...” ইত্যাদি।
প্রথম বর্ষের ২৫২ পৃষ্ঠায় “নব্য লেখকদের প্রতি নিবেদন” শিরোনামে নতুন লেখকদের জন্য মোট ১২ টি উপদেশ দেওয়া হয়েছে। এখানে মাত্র দুটির উল্লেখ করা হল – (১) যশের জন্য লিখিবেন না। তাহা হইলে যশও হইবে না, লেখাও ভাল হইবে না। লেখা ভাল হইলে যশ আপনিই আসিবে। (২) টাকার জন্য লিখিবেন না।
ইউরোপে এখন্ন অনেক লোক টাকার জন্যই লেখে, এবং লেখাও ভাল হয়। কিন্তু আমাদের এখনও সে দিন হয় নাই। এখন অর্থের উদ্দেশ্যে লিখিতে গেলে, লোক-রঞ্জন-প্রবৃত্তি প্রবল হইয়া পড়ে। এখন, আমাদিগের দেশের সাধারণ পাঠকের রুচি ও শিক্ষা বিবেচনা করিয়া লোক-রঞ্জন করিতে গেলে, রচনা বিকৃত ও অনিষ্টকর হইয়া উঠে। ইত্যাদি। রচনাটির শেষে লেখকের নাম না থকলেও খুব সম্ভবত এটি বঙ্কিমচন্দ্রেরই লেখা।
রবীন্দ্রনাথ ‘প্রচার’ পত্রিকা প্রসঙ্গে বলেছেন –
“ বঙ্কিমবাবু তখন বঙ্গদর্শনের পালা শেষ করিয়া ধর্মালোচনায় প্রবৃত্ত হইয়াছেন । ‘প্রচার’ বাহির হইতেছে । আমিও তখন প্রচারে একটি গান ও কোনো বৈষ্ণব-পদ অবলম্বন করিয়া একটি গদ্য-ভাবোচ্ছ্বাস প্রকাশ করিয়াছি ।
.....এই সময়ে কলিকাতায় শশধর তর্কচূড়ামণি মহাশয়ের অভ্যুত্থান ঘটে ।
.....সেইসময় হঠাৎ হিন্দুধর্ম পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের সাক্ষ্য দিয়া আপনার কৌলীন্য প্রমাণ করিবার যে অদ্ভুত চেষ্টা করিয়াছিল তাহা দেখিতে দেখিতে চারি দিকে ছড়াইয়া পড়িল । ...... কিন্তু বঙ্কিমবাবু যে ইহার সঙ্গে সম্পূর্ণ যোগ দিতে পারিয়াছিলেন তাহা নহে । তাঁহার ‘প্রচার’ পত্রে তিনি যে-ধর্মব্যাখ্যা করিতেছিলেন তাহার উপরে তর্কচূড়ামণির ছায়া পড়ে নাই ,কারণ তাহা একেবারেই অসম্ভব ছিল।”
‘প্রচার’ পত্রিকাটি চার বছর (১২৯৫ বঙ্গাব্দ ) চলে বন্ধ হযে যায়।
এখানে পত্রিকার আখ্যাপত্র সহ কয়েকটি পৃষ্ঠার প্রতিলিপি দেওয়া হল।
চিত্র – ১ : পত্রিকার একটি সংখ্যার প্রথম পৃষ্ঠা।
চিত্র – ২
চিত্র – ৩
লেখক পরিচিতি : বহু বছর বি.ই. কলেজে (এখন ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, শিবপুর ( IIEST,shibpur )) অধ্যাপনা করেছেন। কিছুদিন হল অবসর নিয়েএখন সেখানে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে আছেন। অ্যাপ্লায়েড মেকানিক্স নিয়ে গবেষণা করলেও একাধিক বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে - জ্যোতিষশাস্ত্র, পুরনো কলকাতার সংস্কৃতি, ইত্যাদি। অবসর সময়ে 'অবসরে'র সঙ্গে সময় কাটান।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।