বিবিধ প্রসঙ্গ
অগাস্ট ১৫, ২০১৫
একটি প্রবন্ধ, ব্যঙ্গ-চিত্র ও তার প্রতিক্রিয়া
দীপক সেনগুপ্ত
সাহিত্যে লঘু স্বাদের রচনা বা নির্দোষ ও মার্জিত হাস্যরসের পরিবেশন এখন অপেক্ষাকৃত কম বলে মনে হয়। অথচ জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ বজায় রাখতে বা অনাবশ্যক জটিলতা পরিহার করতে এ ধরণের বিষয়বস্তুর প্রয়োজন রয়েছে। একটা সময়ে ‘লাফিং ক্লাব’ নামক একটি সমিতি সুস্থ জীবন যাপনের উপায় হিসাবে মাঝে মাঝে হাসি-ঠাট্টা করার উপদেশ দিত। এরই ফলশ্রুতি কি না জানি না, আমি কয়েক বছর আগেও যে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বাস করতাম সেখানের ছাত্রদের কেউ কেউ রাত ১০টা ১১টা নাগাদ হো হো করে হেসে উঠত এবং সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য ছাত্রাবাস থেকে হি হি, হা হা ইত্যাদি নানা শব্দতরঙ্গ ভেসে আসত। খবর নিয়ে জেনেছিলাম এরা সব লাফিং ক্লাবের দায়িত্বশীল সদস্য, অন্যদের উদ্বুদ্ধ করার কাজে ব্রতী।
প্রেসিডেন্সি কলেজের ফুটপাতে, যা এক সময়ে দুস্প্রাপ্য ও পুরাণো বইয়ের প্রাপ্তিস্থান বলে স্বীকৃত ছিল, খোঁজ করতে গিয়ে বিক্রেতাদের কাছে শুনলাম –“ও সব এখন আর পাবেন না। বিক্রি নেই, পড়বে কে ?” পরিবর্তে সাজিয়ে রাখা হয়েছে নানা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার উপদেশ সম্বলিত স্তুপীকৃত বই। এই পড়ার অভ্যাসটাই আমাদের বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এখন ছোটবেলা থেকেই নানা প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে হয়। পাঠ্যপুস্তক ও পাঠ্য বিষয়ের বোঝা বয়ে স্কুল, তারপর কোচিং সেন্টার এবং সেখান থেকে ফাস্ট-ফুড সেন্টার – এ সব করতেই সময় চলে যায়, অন্য দিকে মন দেবার সুযোগ নেই। বাঁধা-ধরা ছকে চলতে চলতে মনটা কখন যেন যন্ত্রে পরিণত হয়। শরীর যন্ত্রের সঙ্গে যান্ত্রিক মনটাকে বয়ে বেড়াতে হয় সারা জীবন। নির্দিষ্ট পাঠক্রমের বাইরে অন্য কোন লেখা পড়ার মানসিকতাই তৈরি হয় না, সে পরিসরও থাকে না। আমরা এদের সুস্থতর কোনও পথের সন্ধান দিতে পারি নি। পাঠকের সংখ্যা কম হ’লে লেখকরাও উৎসাহিত হন না, ক্রমশঃ লেখকের সংখ্যাও কমে আসে। উইট, হিউমার ও হাস্যরসের জগতটা তাই সঙ্কুচিত হয়ে আসে। এখন রাজশেখর বসুর রচনার রসাস্বাদন করার লোক কম। দু’দিন বাদে তার পরিচয় জানতে হয় ত সাহিত্যাভিধান খুলতে হবে। ফেলে আসা দিনকে ফিরে পেতে মাঝে মাঝে তাই পুরাণো সাময়িক পত্রের পাতা ওল্টাতে ইচ্ছে করে। অবশ্য ‘ফিল-আপ-দি-গ্যাপ’ করার জন্য সঞ্জীবনী সুধার আকর রবীন্দ্রনাথ ত আছেনই।
আগে অনেক সংবাদপত্রের প্রথম পাতাতেই ছোট ছোট ব্যঙ্গ চিত্র বা কার্টুন ছাপা হত। সমসাময়িক ঘটনা বা কোন লঘু বিষয়কে উপজীব্য ক’রে এ ধরণের ছবি ও সংশ্লিষ্ট মন্তব্য যথেষ্ট মনোরঞ্জক ছিল। অনেকে সকাল বেলা সংবাদপত্র হাতে পেয়েই আগে কার্টুনে চোখ বুলিয়ে নিত। এ রকম তিনটি ব্যঙ্গ চিত্রের চিত্র বাদ দিয়ে শুধু বিষয়বস্তুটি স্মৃতি থেকে তুলে ধরছি; সঙ্গে ছবি থাকলে অবশ্যই অনেক উপভোগ্য হত। যতদূর মনে পড়ে এগুলি অধুনালুপ্ত ‘দৈনিক যুগান্তর’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।
প্রথম কার্টুন –
শ্যামবাজারের পাঁচ রাস্তার মোড়ে অশ্বপৃষ্ঠে উপবিষ্ট নেতাজী সুভাষচন্দ্রের মূর্তি সদ্য স্থাপিত হয়েছে। ধাবমান অশ্বের পুচ্ছটি রাস্তার সঙ্গে সমান্তরালভাবে অবস্থিত। পত্র-পত্রিকায় সমালোচনার ঢেউ বয়ে যায়; বক্তব্য - ছুটন্ত ঘোড়ার লেজ কখনও ওরকম খাড়া হয়ে থাকে না। এ বিষয় নিয়ে মুদ্রিত কার্টুনটি ছিল –এক ভদ্রমহিলা কাজ সেরে বাড়ি ফিরে এসেছে। তার বেণীটি খাড়া হয়ে শরীরের সঙ্গে লম্বভাবে বর্তমান। বাড়ির লোক জিজ্ঞাসা করছে –“চুলের এ কি অবস্থা ?” সংক্ষিপ্ত জবাব – “শ্যামবাজারে গিয়েছিলাম।”
দ্বিতীয় কার্টুন –
কর্পোরেশনের কোনও মিটিং যথারীতি তর্কাতর্কি, হাতাহাতি দিয়ে শুরু ক’রে চেয়ার ও টুল ছোড়াছুড়িতে শেষ হয়েছে। কার্টুন আঁকা হয়েছে – কোনও এক বাড়িতে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা একে অন্যের দিকে চেয়ার ও টুল ছুঁড়ে মারছে। বাবা এসে জিজ্ঞাসা করলেন –“এ সব কি হচ্ছে ?” বাচ্চাদের জবাব – “বাবা, আমরা মারামারি করছি না তো, কর্পোরেশন কর্পোরেশন খেলছি।”
তৃতীয় কার্টুন –
একটা গাছে বাঁদর দম্পতি গম্ভীর হয়ে বসে আছে। পাশেই তাদের সন্তানটি হাসি হাসি মুখে তার লেজটি গাছের ডালে কয়েক পাক জড়িয়ে মহানন্দে দোল খাচ্ছে। দম্পতির একটির সখেদ মন্তব্য – “ছেলেটা দিন দিন বাঁদর হয়ে যাচ্ছে।”
এ সবের আজ খুব অভাব। এখন অনেক সংবাদপত্রের প্রথম পাতার আধখানা বিজ্ঞাপন দিয়ে ভর্তি। সেখানে রয়েছে বহু চটকদার জিনিস ও বিবিধ পণ্য সম্ভারের পরিচিতি অথবা জীবনের নানা সমস্যা কাটিয়ে ওঠার অব্যর্থ নিদান। ফিরে দেখলে, সেকালের কিছু ব্যঙ্গ রসাশ্রিত পত্রিকার সন্ধান মেলে। ১৮৭০ সালে প্রকাশিত হয়েছিল ‘বিদূষক’; ‘আলালের ঘরের দুলালের’ অনুকরণে লেখা। চার বছর পর ১৮৭৪-এর ৩১শে জানুয়ারি প্রকাশিত হয় ‘বসন্তক’, প্রকাশক হরি সিং। বছর দু-এক আগে ‘বসন্তক’ পুনর্মুদ্রিত হয়ে বাজারে আসে। পত্রিকাটি দ্রুত নিঃশেষিত হওয়ায় বোঝা যায় যে, এক শ্রেণীর পাঠকের কাছে এসব পত্রিকার চাহিদা এখনও রয়েছে। ১৩০৩ বঙ্গাব্দের ভাদ্র মাসে বের হয় ‘কোৎকা’; প্রকাশক চারুচন্দ্র রায়। সম্পাদক, প্রকাশক বা প্রকাশের কাল-বিহীন ‘ভূত’ নামক স্বল্পস্থায়ী একটি পত্রিকার একটি মাত্র কপি ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে’ আছে বলে জানা যায়। এ ধরণের অন্য কয়েকটি পত্রিকার উল্লেখ করা যায়, যেমন – ‘মজলিস’ (ব্রজবল্লভ রায় ও জ্ঞানেন্দ্রনাথ কুমার, ১৩২৯ ); ‘বেপরোয়া’ ( ডাঃ বনবিহারী মুখোপাধ্যায়, ১৯২৩ ); ‘শনিবারের চিঠি’ ( যোগানন্দ দাস / সজনীকান্ত দাস, ১৩৩১ ); ‘রবিবারের লাঠি’ ( কেশবচন্দ্র সেন, ১৩৩৫); ‘অবতার’ ( গজপতি বিদ্যাদিগগজ ( অমূল্যচরণ সেন ), ১৩৩৫ ); ‘সচিত্র ভারত’ ( প্রবোধ কুমার সমাদ্দার / পরিমল গোস্বামী, ১৯৩৬) ; ‘অচলপত্র’ ( দীপ্তেন্দ্রকুমার সান্যাল, ১৯৪৮ ); ‘যষ্টিমধু’ ( কুমারেশ ঘোষ, ১৯৫১ ); ‘ব্যঙ্গমা’ ( অজিতকৃষ্ণ বসু ? , ১৯৮০ ) প্রভৃতি। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায়, ‘বেপরোয়া’ পত্রিকার সম্পাদক ডাঃ বনবিহারী মুখোপাধ্যায়ের জীবন অবলম্বনে ‘বনফুল’-এর ( ডাঃ বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় ) রচনা ‘অগ্নীশ্বর’ গল্পটি চলচিত্রায়িত হয়েছে। অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায় এবং হেমন্ত মুখার্জির সুর-সংযোজনায় উত্তমকুমার অভিনীত ছায়াছবিটি যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়েছিল।
কার্টুন বা ব্যঙ্গচিত্র মুদ্রণের যাত্রা শুরু সম্ভবতঃ ১৮৩২ সালের ১ লা ডিসেম্বর প্যারিস থেকে প্রকাশিত ‘le Charivari’ পত্রিকার হাত ধরে। ১৮৩৫ সালে সরকার রাজনৈতিক কার্টুন প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা জারি করায় দিক পরিবর্তন ক’রে দৈনন্দিন জীবনের ঘটনা নিয়ে ব্যঙ্গ-চিত্র প্রকাশ করতে থাকে পত্রিকাটি। তবে এ বিষয়ে যে পত্রিকাটি বিখ্যাত হয়েছিল সেটি হ’ল হেনরী মেহিউ প্রতিষ্ঠিত ‘Punch ( or the London Charivari )’ ; প্রথম প্রকাশ ১৮৪১। এই ‘পাঞ্চ’ ম্যাগাজিনের অনুসরণেই আমাদের দেশে এই ধরণের নানা পত্রিকা প্রকাশিত হতে থাকে। কিছুদিন আগে পশ্চিমবঙ্গে একটি কার্টুনকে কেন্দ্র করে যথেষ্ট বিতর্ক তৈরি হয়েছিল।
ব্যঙ্গ-পত্রিকা,কার্টুন,ব্যঙ্গ-চিত্র নিয়ে অনেক কথা বলা হল। এবার যে লেখাটি দেওয়া হচ্ছে সেটিও একটি ব্যঙ্গ-চিত্রকে কেন্দ্র করে রচনা। ‘পশ্বাদির নিরাকার উপাসনা’ নামে এই প্রবন্ধটি চিত্র সহ ‘অনুসন্ধান’ নামক পাক্ষিক পত্রিকার ১২৯৭ (১৮৯০ খ্রিঃ) বঙ্গাব্দের ১৫ ই অগ্রহায়ণ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। প্রবন্ধটি পড়ে সে সময়ে এক শ্রেণীর মানুষের মধ্যে যথেষ্ট ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল। নানা ধরণের প্রতিবাদও সংগঠিত হয়েছিল। প্রায় ১২৫ বছর আগে প্রকাশিত চিত্র সহ প্রবন্ধটি, সম্পাদকের ব্যাখ্যা এবং পত্রিকায় প্রকাশিত দু’টি প্রতিবাদপত্র তুলে দেওয়া হল।
পশ্বাদির নিরাকার উপাসনা
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগ। সভ্যতার আলোক চারিদিকেই ফুটিয়া বাহির হইতেছে। সিটি, টাউন, নগর, উপনগর, গ্রাম, উপগ্রাম – ক্রমে ক্রমে সর্ব্বত্রই সভ্যতার ছড়াছড়ি, হুড়োহুড়ি, মেশামেশি, পাশাপাশি ! কৃষক – সেও লাঙ্গল ফেলিয়া মাঠে দাঁড়াইয়া সভ্যতাব্যঞ্জক স্ত্রী-স্বাধীনতা সাম্যবাদ প্রভৃতির ‘বক্তৃমা’ ঝাঁড়িতেছে; চূড়োমণি ভটচায্যি মহাশয়ও পাঁজি-পুঁথি ফেলিয়া –আস্তেন গুটাইয়া –নিরাকার ব্রহ্মের ‘রাঙা চরণ দুখানি’ ধরিয়া টানিতেছেন। পাঠশালের ছেলে, ঘরের বৌ-ঝি – সকলেই ‘সুরুচি ও সুনীতির’ ধ্বজা ধরিয়া নগর-কীর্ত্তনে বাহির হইতে আরম্ভ করিয়াছে; ‘ফিমেল-এডুকেশন’, ‘ইমান-ছিপেসান’ প্রভৃতির বোলে গগন ফাটিয়া ফুটিফাটা হইতেছে।
এহেন সভ্যতার পূর্ণসময়ে বনের পশ্বাদিই বা ফাঁক যায় কি করিয়া ? তাই এ পূজার ছুটিতে তাহারাও চতুরঙ্গে মাতিয়াছে। এতদিনও অবশ্য তাহাদের উদ্যোগ-আয়োজন চলিতেছিল, তাহারাও ‘শ্রদ্ধয়া দেয়ং’ ইত্যাকার এক একটা টিনের বাক্সের উপর লিখিয়া , তালপুকুর, ডোমপুকুর, আজানপুকুর প্রভৃতি তাহাদের বড় বড় সহরের আসসেওড়া, নটের শাক প্রভৃতি বড় বড় গাছের থামের উপর দড়ি দিয়া টানাইয়া রাখিয়াছিল; এতদিন হইতে তাহারাও তাহাদের সমাজ-গৃহ, বিলাত হইতে তাহাদের বিলাতী কারিগর বন্ধুদিগকে আনাইয়া, প্রস্তুত করাইয়া লইতেছিল; সুতরাং এখন, এবারকার এ পূজার ছুটিতে, তাহারাই বা চুপ করিয়া যায় কি করিয়া ? সকলেই স্বাধীন ও সভ্য হইতে চলিল; এহেন সাম্যবাদের দিনে কেবল তাহারাই বা কেন অসভ্য বর্ব্বর হইয়া থাকিবে ? তাই এ পূজার ছুটিতে তাহারাও সমাজ-গৃহে উপস্থিত। তাহাদের সকলেরও ইচ্ছা, উপাসনা করে, - ‘নিরাকার পরব্রহ্মের।’
পাঠক ! উপরের চিত্রে দেখুন, তাহাদের সেই সমাজ গৃহের উপাসনার ‘ফটোগ্রাফ’। এ ‘ফটোগ্রাফ’ অনেক কষ্টে সংগ্রহ করিয়া আর্টিস্ট প্রেসকে দিয়া পয়সা খরচ করিয়া কাটাইয়া, তবে আপনাদের উপহার দিতে সক্ষম হইতেছি। এখন, উহার দিকে একবার অনুগ্রহ করিয়া তাকাইয়া দেখুন, - ঐ শ্রীমান হনুমানচন্দ্র জামা-জোড়া পরিয়া, নাকে চশমা গুঁজিয়া, বেদীর উপরে উপবিষ্ট। আর দেখুন, - তন্নিম্নে চেহার-বেঞ্চির উপর শ্রীশৃগালচন্দ্র, শ্রীমান মহিষচন্দ্র, শ্রীমান গর্দভচন্দ্র, শ্রীমান ষাঁড়চন্দ্র, শ্রীমান বিড়ালচন্দ্র প্রভৃতি বড় বড় মহাত্মারা সকলেই বিশিষ্টরূপ পোষাক-পরিচ্ছদে অঙ্গ আবৃত করিয়া, একমনে একধ্যানে উপাসনায় মত্ত। তারপর, আরও দেখুন, তাঁহাদের পাশে পাশে গায়ে গায়ে ঠেসাঠেসি ঘেঁসাঘেসি মেশামেশি করিয়া শ্রীমতী বাঁদরী মনি, শ্রীমতী মহিষিণী, শ্রীমতী গর্দভানি, শ্রীমতী ষাঁড়িণী, শ্রীমতী বিড়াল-মিনি সকলেই আহ্লাদে আটখানা – সভ্যতার চরমসীমায় উপনীত ! তা’ছাড়া, আরও দেখুন, উহাদেরও অনেকের নাকে চশমা আছে; এমন কি, উহারা স্ত্রীর দলকেও সে অধিকারে বঞ্চিত করে নাই। তা’রপর, আপনারা ঐ যে সকলের মাথার উপর দেখিতেছেন, ঐ যে দু’খানি পায়ের উপর ভর দিয়া একটি মস্তক দাঁড়াইয়া রহিয়াছেন, উনিই উহাদের ‘নিরাকার ঈশ্বর।’ অর্থাৎ মানুষ-নিরাকার-উপাসকগণও যেমন কেবল “মায়ের রাঙা চরণ” ও জগৎ-পিতার “মুখ-কমল” মাত্র দেখিয়াই পরিতৃপ্ত হয়েন, পশু মহাশয়গণও এক্ষেত্রে তাহাতেই সন্তুষ্ট হইতেছেন। নিরাকারবাদির ন্যায় ইঁহারাও মায়ের “রাঙাচরণে পুষ্পাঞ্জলী” দিতেছেন; জগৎ-পিতার “মুখ-কমল” নির্গত স্বর্গীয় বাণীতে দেশ-উদ্ধার প্রভৃতি ‘নিষ্কাম-ব্রত’ গ্রহণ করিতেছেন। “রাঙা চরণ দু’খানি” আর “মুখ-কমলটুকু” ব্যতীত নিরাকার ঈশ্বরের আর সমস্তই কুরুচির ব্যঞ্জক বলিয়া সভ্যদেশ কর্ত্তৃক পরিবর্জ্জিত হইয়াছে। সুতরাং উহারাও সেই ‘কুরুচির’ ভাবটুকু সমস্তই ত্যাগ করিয়া, ঈশ্বরের সমস্ত অঙ্গেই সুরুচি মাখাইয়া শুদ্ধ করিয়া লইয়াছে।
প্রবন্ধটি পাঠ করে বেশ কিছু প্রতিবাদপত্র সম্পাদককে পাঠানো হয়। সম্পাদকের বক্তব্য সহ দু’টি চিঠি এখানে তুলে দেওয়া হল।
পশ্বাদির নিরাকার উপাসনা
এই নাম দিয়া পূজার পূর্ব্বের ষষ্ঠ সংখ্যক ‘অনুসন্ধানে’ একটি ‘পঞ্চ-চিত্র’ বাহির হইয়াছিল। সেটি দেখিয়া, কি জানি কেন, এক সম্প্রদায়ের লোক আমাদের উপর বড়ই চটিয়াছেন। শুধু মুখের চটা নহে; এমন কি, তাঁহারা আমাদের কার্য্যাধ্যক্ষ ও সম্পাদক প্রভৃতিকে সুবিধায় পাইলে, ঘাকতক উত্তম-মধ্যম প্রহার দিতেও নাকি প্রস্তুত আছেন। জানি না, শুধু এই মতলবেই কি না, একদিন কতকগুলি লোক আমাদের আপিসে পর্য্যন্তও আসিয়াছিলেন। কিন্তু, সম্ভবতঃ আমাদের যোগাড়-যন্ত্রের ত্রুটি না থাকায়, তাঁহাদিগকে সে যাত্রা বিফল-মনোরথ হইয়া ফিরিতে হয়। এবং ‘অনুসন্ধান’ সম্পাদক-ভ্রমে অপর একজন ভদ্রলোককে লইয়া টানাটানি করায়, শেষে ‘থোঁতা মুখ আরও ভোঁতা’ করিয়া গৃহে ফিরিতে হয়। যাইহোক, তাহাতেও নিবৃত্তি নাই; শুনিতেছি এখন আবার একদল লোক আমাদের বিপক্ষ কোন জুয়াচোর দলের সহিত যোগ দিয়াও নাকি আমাদের নানা অনিষ্ট চেষ্টা করিতেছে।
তা’ ইহাতে আমাদের তত আসে-যায় না। যাহাদের প্রবৃত্তি এতদূর কলুষিত, তাহাদের নাম পর্য্যন্তও উল্লেখ করিতে আমরা ঘৃণা করি। তবে যাঁহাদিগকে আমরা শিক্ষিত ও পদস্থ ব্যক্তি বলিয়া জানি, তাঁহাদিগকে কিন্তু এই কলুষিত কাণ্ডে হস্তার্পণ করিতে দেখিলে বাস্তবিকই ক্ষুব্ধ হইতে হয়। বিশেষতঃ আমাদের যে ‘চিত্র-প্রবন্ধে’ কোন সম্প্রদায় বা লোকবিশেষের নাম করা হয় নাই বা কেবল একমাত্র কাহাকেও লক্ষ্য করা হয় নাই। তখন গায়ে পড়িয়া উহা লইলে চলিবে কেন ? “ঠাকুর ঘরে কে, না আমি তো কলা খাই নাই” একি কথা ? আমরা বলিলাম, এক; আর তাহার প্রকৃত মর্ম্ম গ্রহণ না করিয়া তাঁহারা মনে করিলেন আরেক, বাস্তবিকই এটা বড় ক্ষোভের বিষয়। যাইহোক, এবার আমরা এ সম্বন্ধে যে কয়খানি পত্র পাইয়াছি, তাহারই দুইখানি মাত্র নিম্নে ছাপাইয়া উপসংহার করিতেছি। বারান্তরে এ সম্বন্ধে আমরা উত্তর দিব। পত্র দুইখানি পদস্থ লোকের লেখা। একখানি পত্রের লেখকের নাম দেখিলেই সাধারণে তাঁহাকে চিনিবেন; কিন্তু অপরখানির লেখক নাম গোপন রাখিতে বলিয়াছেন, সুতরাং তাহা আর এবার প্রকাশ করিলাম না। পত্র দুইখানি সারাংশ এই, -
প্রথম পত্র
“মাননীয় শ্রীযুক্ত ‘অনুসন্ধান’-সম্পাদক মহাশয় সমীপেঃ
মাননীয় মহাশয়, প্রথম হইতেই আমি আপনার “অনুসন্ধান” পড়িয়া আসিতেছি। সকল বিষয়ে আপনার সহিত আমার মত না মিলিলেও অনুসন্ধানের উদ্দেশ্যের সহিত আমার আন্তরিক সহানুভূতি রহিয়াছে, এবং ইহার লেখার ও পরিচালন-শৃঙ্খলার জন্যও ইহাকে আমি বরাবরই বড় আদর করিয়া থাকি। কিন্তু আপনার পূজার সময়ের সংখ্যা দেখিয়া আমি কি যে দুঃখিত এবং মর্ম্মাহত হইয়াছি, তাহা বলিতে পারি না। আপনি হিন্দুধর্ম্মের গৌরব ঘোষণা করুন, ব্রাহ্মধর্ম্মের দোষ প্রকাশ করুন, তাহাতে আপনার বিরুদ্ধে কিছুই আমার অভিযোগ নাই। আপনার ধর্ম্ম-বিশ্বাস-অনুসারে সরলভাবে যাহা লিখিবেন, তাহাতে আপনার বিরুদ্ধে কাহার কি বলিবার অধিকার থাকিতে পারে ? আপনি ব্রাহ্মদের যে কুকুর বাঁদর সাজাইয়া ছবি আঁকিয়াছেন, তাহা একটু ভদ্র রুচি বিরুদ্ধ হইলেও, তাহার জন্য আপনাকে অধিক দোষ দিতে চাই না। * * * আমি তাই আপনার উপরোক্ত সংখ্যা কাগজ পাইয়াই সেই প্রবন্ধের পাতাখানা টুকরো টুকরো করিয়া ছিঁড়িয়া ফেলিয়াছিলাম; এবং এক্ষণে অনুরোধ করি, যদি আপনার দোষের জন্য অনুতাপ না করেন, আর আমাকে অনুসন্ধান পাঠাইবেন না।
অনুগত ( শ্রী ) প্রিয়নাথ মল্লিক।
“গ্রামবাসী” সম্পাদক।”
দ্বিতীয় পত্র।
২৪এ নভেম্বর, ১৮৯০।
শ্রীযুক্ত “অনুসন্ধান” সম্পাদক মহাশয় মান্যবরেষু।
মহাশয়, আপনার “অনুসন্ধান” নামক পত্রিকায় “পশ্বাদির নিরাকার উপাসনা” পাঠ করিয়া একান্ত মর্ম্মাহত হইয়াছি। আমি মনে করিয়াছিলাম, আপনি শিক্ষিত লোক; ব্রাহ্মসম্প্রদায় ভুক্ত না হইলেও তাঁহাদের অন্ততঃ বিরোধী নহেন, কিন্তু উক্ত প্রবন্ধটি পাঠ করিয়া আমার সে বিশ্বাস দূরীভূত হিয়াছে।
ঈশ্বর সাকার কি নিরাকার, এবিষয় লইয়া আপনার সঙ্গে আমি তর্ক বিতর্ক করিতে ইচ্ছা করি না। আপনি যে ধর্ম্মাবলম্বী কেন না হন, আপনি ঈশ্বরকে নিরাকার স্বীকার করিবেনই; আপনি না করেন আপনার ধর্ম্মশাস্ত্র করিবেন। কয়েকজন গোড়া পৌত্তলিক ভিন্ন এ কথা কেহই বলিবেন না যে, ঈশ্বর সাকার। অতএব সেই নিরাকার-বাদী, জিতেন্দ্রিয়, সত্যবাদী পণ্ডিত ব্রাহ্মদিগকে এবং মহামাননীয়া ব্রাহ্মিকাদিগকে আপনি বানর, ভল্লুক প্রভৃতি পশুদিগের মধ্যে গণ্য করিয়া নিতান্ত অপদার্থের কাজ করিয়াছেন।
আপনি অবশ্যই অবগত নহেন যে, বর্ত্তমান ব্রাহ্মসমাজে সত্যযুগের উৎপত্তি আরম্ভ হইয়াছে। ভ্রাতা ও ভগিনীদের ভাব মনে হইলে আনন্দাশ্রু বিসর্জ্জন না করিয়া কোন পাপিষ্ঠ থাকিতে পারে ? ভ্রাতা ও ভগিনীদের একত্রে একমনে উপাসনা করায় যে কি প্রেম জন্মে, তাহা ধারণা করার শক্তি আপনার নাই; আপনি ঐ ঘটনাকে ‘ঘেঁসাঘেঁসি মেসামিসি’ বলিয়া মহা-বেল্লিকের ন্যায় আপনার পত্রিকাকে কলঙ্কিত করিয়াছেন। আপনি কি জানেন না যে, ব্রাহ্মসমাজের এক একটি রমণীর দ্বারা ঐ সমাজের এবং আপনাদের সমাজেরও কত লোকের কত রকমের উপকার হইয়াছে ?
আপনার ধরণের অন্য একখানা কাগজে প্রকাশ পাইয়াছে যে, কয়েকটি ব্রাহ্ম-বন্ধু ঐ প্রবন্ধ দেখিয়া ‘অনুসন্ধান’ সম্পাদক-জ্ঞানে অন্য একটি বাবুর সঙ্গে হাতাহাতি করিয়াছিলেন। সে বিষয়ে আমি কিছু অবগত নহি। কিন্তু অনুসন্ধান’ সম্পাদককেও এজন্য কিছু উত্তম মধ্যম দিলে আমরা অসন্তুষ্ট হইতাম না।
পুঃ – মহাশয়, আমি ভরসা করি এই বিষয়টি আপনার পত্রিকায় স্থান দান করতঃ বাধিত করিবেন। কারণ আপনার লেখার প্রতিবাদ আপনার পত্রিকাতেই প্রকাশ হওয়া উচিত। যদি আপনি ইহা প্রকাশ না করেন, তবে আপনাকে কাপুরুষ মনে করিব। আর আমার নামটি পত্রিকায় প্রকাশ করিবেন না।
একজন ব্রহ্মজ্ঞানী।”
লেখক পরিচিতি : বহু বছর বি.ই. কলেজে (এখন ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, শিবপুর ( IIEST,shibpur )) অধ্যাপনা করেছেন। কিছুদিন হল অবসর নিয়েএখন সেখানে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে আছেন। অ্যাপ্লায়েড মেকানিক্স নিয়ে গবেষণা করলেও একাধিক বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে - জ্যোতিষশাস্ত্র, পুরনো কলকাতার সংস্কৃতি, ইত্যাদি। অবসর সময়ে 'অবসরে'র সঙ্গে সময় কাটান।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।