পুরানো সাময়িকী ও সংবাদপত্র
মার্চ ৩০, ২০১৫
রহস্য সন্দর্ভ
দীপক সেনগুপ্ত
‘বিবিধার্থ-সঙ্গ্রহ’-এর আলোচনা প্রসঙ্গে বলা হযেছে কি পরিপ্রেক্ষিতে পত্রিকাটির প্রকাশ বন্ধ হয়ে যায়। ১৮৫১ সালে কলকাতায় যে ভার্নাকুলার লিটারেচার সোসাইটি বা বঙ্গভাষানুবাদক সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয় সেখান থেকেই প্রকাশিত হয়েছিল ‘বিবিধার্থ-সঙ্গ্রহ’। বিবিধ বিষয়ে বঙ্গানুবাদ প্রকাশের মাধ্যমে জনসাধারণকে শিক্ষিত করে তোলাই ছিল উদ্দেশ্য। পত্রিকা ইংরাজি ও বাংলা দুই ভাষাতেই প্রকাশিত হত। সেটি ছিল ১৮৬১ সাল। ‘বিবিধার্থ-সঙ্গ্রহ’ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পত্রিকাটির অভাব পাঠকমহলে যথেষ্টই অনুভূত হয়েছিল। ১৮৬২ সালে স্কুল বুক সোসাইটি ও ভার্নাকুলার সোসাইটি মিশে যায় ; এই যুক্ত কমিটিই ১৮৬৩ সালের জানুয়ারী মাসে আবার রাজেন্দ্রলালের সম্পাদনায় ‘বিবিধার্থ সংগ্রহে’-র নাম পরিবর্তন করে ‘রহস্য সন্দর্ভ’ নামে প্রকাশ করতে থাকে। এইজন্যই বলা হয়েছে “ ‘বিবিধার্থ সংগ্রহ’-এর চিতাভস্ম হইতেই ১৮৬২ অব্দে ‘রহস্য সন্দর্ভ’ উদ্ভুত হয়।” পত্রিকার বিষয়বস্তু ও মূল উদ্দেশ্য অপরিবর্তিত ছিল।
পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় লেখা থাকত :
“ রহস্য সন্দর্ভ
নাম
পদার্থ-সমালোচক মাসিক পত্র
ব্যাপ্তিস্ত মিশন যন্ত্রে মুদ্রিত ”
‘রহস্য সন্দর্ভ’র প্রথম সংখ্যায় ভূমিকা হিসাবে যে লেখাটি প্রকাশিত হয় তার কিছু অংশ ছিল :
“ সর্ব্বনিয়ন্তার অনুকম্পায় আমরা অদ্য এই ‘রহস্য-সন্দর্ভের’ প্রথম পৃষ্ঠা প্রকটিত করিলাম। ইহাতে আমাদের কি উদ্দেশ্য তাহা গ্রাহকমণ্ডলী অবশ্য জানিতে প্রয়াস করিবেন কিন্তু সাময়িকপত্রের সম্পাদক মহাশয়েরা প্রায়ই পত্রপ্রারম্ভে নানাবিধ সঙ্কল্প করিয়া পরে “বহ্বারম্ভে লঘু ক্রিয়া ”র আস্পদ হইয়া থাকেন, পাছে আমরাও অভিপ্রেতের বিহিত সমাধানে অশক্ত হইয়া সেইরূপে উপহসিত হই এই আশঙ্কায় তাহার বিস্তার বর্ণনে বিমুখ হইলাম। অভিনব পত্রের অভিপ্রেত কি তাহার কিয়দংশ ইহার নামদ্বারাই অনুভব হইবে। অধিকন্তু এইমাত্র বক্তব্য যে পূর্ব্বে ‘বিবিধার্থ-সঙ্গ্রহ’ নামক মাসিক পত্র যে উদ্দেশে বহুল পাঠকবৃন্দের মনোরঞ্জন করিত ইহাও সেই অভিপ্রায়ে প্রতিষ্ঠিত এবং তাহারই পদাঙ্কানুসরণার্থে সঙ্কল্পিত হইয়াছে; ফলে উক্ত পত্রের গুণিগণাগ্রগণ্য সম্পাদক মহোদয় কোন অনুরোধে তাহার রহিত করাতে তাহার স্থানীভূত করিতেই এই পত্রের বিকাশ হইল - তাহার রহিত না হইলে ইহার অনুষ্ঠান হইত না। এইরূপ পত্র সম্প্রতি আর প্রচলিত নাই; অথচ এতাদৃশ কেবলমাত্র-বিদ্যানুরাগী সাময়িক পত্র যে জনসমাজের হিতকর ও আদরাস্পদ বটে তাহা বিবিধার্থ-সঙ্গ্রহের সিদ্ধসঙ্কল্পতায় নিশ্চয় বোধ হইতেছে। পুরাবৃত্তের আলোচনা, প্রসিদ্ধ মহাত্মাদিগের উপাখ্যান, প্রাচীন তীর্থাদির বৃত্তন্ত, স্বভাবসিদ্ধ রহস্য-ব্যাপার ও জীবসংস্থার বিবরণ, খাদ্যদ্রব্যের প্রয়োজন, বাণিজ্য-দ্রব্যের উৎপাদন, নীতি-গর্ভ উপন্যাস, রহস্যব্যঞ্জক আখ্যান, নূতন গ্রন্থের সমালোচন, প্রভৃতি নানাবিধ বিষয়ের আলোচনায় উক্ত পত্র অতি অল্পকালে সঙ্খ্যাতিরিক্ত ব্যক্তির প্রেমাস্পদ হইয়াছিল; এই মাসিক পত্র তদনুকরণদ্বারা তাহার পুরস্কার প্রার্থনা করে। ......অধিকন্তু চিত্রপট যে মনের সংস্কারক তাহা নব্য তত্ত্বানুসন্ধায়িরা স্থির করিয়াছেন; অতএব সময়ে সময়ে উত্তম চিত্রদ্বারা চিত্তানুরঞ্জন করাও ইহার উদ্দেশ্য; তদর্থে এই পত্রের প্ররোচক বঙ্গানুবাদক দমাজের আদেশে বহু শত ছবি বিলাত হইতে আনীত হইয়াছে, তাহার প্রকাশে বোধ হয় অনেকেই পরিতৃপ্ত হইবেন।”
পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় যে প্রবন্ধগুলি ছিল সেগুলি হল :
‘ভূমিকা’ ; ‘ক্ষুধা কি’ ? ; ‘কস্তুরিকা’ (চিত্র সহ);’কাঞ্চে শব্দের বুৎপত্তি’ ; ‘নূতন গ্রন্থের সমালোচন’ । মাঝে মাঝে কোন কোন সংখ্যায় ‘কৌতুককণা’ নামে হাস্যরসযুক্ত ‘চুটকি’ পরিবেশিত হয়েছে।
রাজেন্দ্রলাল মিত্র যথেষ্ট কৃতিত্বের সঙ্গে পত্রিকা পরিচালনা করলেও তার শারীরিক অসুস্থতার জন্য ৬ষ্ঠ পর্বের ৬ষ্ঠ সংখ্যা (মোট ৬৬ খণ্ড ) অবধি সম্পাদনা করেছিলেন। এর পর সম্পাদক হন প্রাণনাথ দত্ত। ১২৭৯ বঙ্গাব্দে ৭ম পর্ব অবধি যথারীতি পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল।
১২৮০-র বৈশাখ থেকে শুরু হয ‘রহস্য-সন্দর্ভ’-এর ‘নবপর্ব্বাবলী’। নতুন সম্পাদক প্রাণনাথ দত্তের ভাষায : “ আমরা যৎকালে রহস্য সন্দর্ভের ভার স্কুলবুক সোসাইটির হাত হইতে গ্রহণ করি তৎকালে মনে করিয়াছিলাম রহস্য সন্দর্ভকে নিঃসহায় দেখিয়া অনেকে সাহায্য করিবেন। রহস্য সন্দর্ভের ৭০০ শত গ্রাহক হইয়াছিল কিন্তু এখন বৎসর শেষে খতিয়ান করিয়া দেখিতেছি শত ব্যক্তিও মূল্য দেন নাই।” এর পর নিশ্চয়ই পরিচালক ও সম্পাদক পত্রিকাটির প্রকাশ চালিয়ে যাওয়া সমীচীন মনে করেন নি।
সম্ভবতঃ ১৮৭৪ সাল অবধি পত্রিকাটি চলেছিল ; কারণ ১৮৭৫ সালের গেজেটে প্রকাশিত পত্রিকা তালিকায় ‘রহস্য সন্দর্ভে’র নাম নেই বলেই জানা গিয়েছে।
প্রতিলিপি পরিচয় :
চিত্র -১ ও ২ : পত্রিকার আখ্যাপত্রের দু’টি প্রতিলিপি ।
চিত্র – ৩ : ইংরাজি সংস্করণের একটি আখ্যাপত্র ।
চিত্র – ৪ : পত্রিকার প্রথম পর্ব্ব প্রথম খণ্ডের প্রথম রচনাটির শুরুর অংশ ।
চিত্র – ৫ : ‘ইংরাজী স্ত্রীদিগের কেশসজ্জা’ – প্রথম খণ্ড থেকে ।
দীপক সেনগুপ্ত।
চিত্র ১
চিত্র ২
চিত্র ৩
চিত্র ৪
চিত্র ৫
লেখক পরিচিতি : বহু বছর বি.ই. কলেজে (এখন ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, শিবপুর ( IIEST,shibpur )) অধ্যাপনা করেছেন। কিছুদিন হল অবসর নিয়েএখন সেখানে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে আছেন। অ্যাপ্লায়েড মেকানিক্স নিয়ে গবেষণা করলেও একাধিক বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে - জ্যোতিষশাস্ত্র, পুরনো কলকাতার সংস্কৃতি, ইত্যাদি। অবসর সময়ে 'অবসরে'র সঙ্গে সময় কাটান।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।