সবুজ পত্র
দীপক সেনগুপ্ত
সাময়িক পত্র প্রসঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে যে সাহিত্যের আদর্শ অক্ষুণ্ণ রেখে পাঠকের রুচি বোধকে পরিশীলিত করে তুলতে এবং সেই সঙ্গে নতুন লেখক গোষ্ঠি গড়ে তুলে সুস্থ সংস্কৃতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে এজাতীয় পত্রিকার একটি অগ্রণী ভূমিকা রয়েছে। সাহিত্যের আদর্শ ও ধর্ম কি হওয়া উচিত এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে, বিশেষ করে কল্লোল যুগে, অনেক বাদানুবাদ ও লেখনী চালনা হয়েছে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও এই বিতর্কে সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করেছেন। সময়ের সঙ্গে জীবনধারা, মানসিকতা ও রুচি বোধ সব কিছুরই পরিবর্তন হয়। সাহিত্যও এ থেকে বাদ যেতে পারে না। ভাষারীতি, বিষয়বস্তু নির্বাচন, রচনাশৈলী প্রভৃতির পরিবর্তন হলেও একটা মূল লক্ষ্য ও আদর্শবোধের ভিত্তিতে গতিপথ নিয়ন্ত্রিত না হলে সাহিত্য যেখানে গিয়ে পৌঁছতে পারে, সুস্থ সমাজ গড়ে তুলতে সেটা সহায়ক না হয়ে পাঠককূলকে বিভ্রান্ত ও বিপথগামী করতে পারে কি না সেটা এ বিষয়ে বিদগ্ধ জনেরাই বিচার করে দেখবেন।
বর্তমান রচনাটির উদ্দেশ্য সাহিত্যধর্ম আলোচনা নয়, ‘সবুজ পত্র’ নামক্ একটি সাময়িক পত্রের সঙ্গে পাঠকদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া। ‘সবুজ পত্র’ প্রকাশের কৃতিত্ব প্রমথ চৌধুরীর প্রাপ্য। সাহিত্য ক্ষেত্রে এটা তার জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি। অবশ্য রবীন্দ্রনাথের শুভেচ্ছা ও অনুপ্রেরণা তাকে পথ চলতে সাহায্য করেছে, বিরূপ সমালোচনার মুখোমুখি হতে সাহস জুগিয়েছে, নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে প্রত্যয়ী করেছে। রবীন্দ্রনাথের মেজদা সত্যেন্দ্রনাথের কন্যা ইন্দিরা দেবীর স্বামী প্রমথ চৌধুরী ছিলেন বুদ্ধিদীপ্ত মুক্ত মনের মানুষ। তার সাহিত্য প্রতিভা লক্ষ্য করে রবীন্দ্রনাথ তাকে গল্প লিখতে পরামর্শ দেন। সেকালে অধিকাংশ রচনাই রচিত হয়েছে সাধুভাষায়। সাধুভাষায় গাম্ভীর্য ও উদাত্ত ভাব নিহিত থাকলেও দৈনন্দিন জীবনের বা পারিপার্শ্বিক ঘটনা বর্ণনায় সেটা যেন একটু অসচ্ছন্দ বেমানান। চলমান জীবনের বিষয় অকৃত্রিম ভঙ্গীতে মানুষের কাছে পৌঁছে দেবার উপযুক্ত মাধ্যম হিসাবে কথ্য ভাষায় সাহিত্য সৃষ্টির প্রয়াস যে দেখা যায় নি এমন নয়। ১৮৫৪ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত ‘মাসিক পত্রিকা’ নামক সাময়িক পত্রে বা প্যারীচাঁদ মিত্র ( টেকচাঁদ ঠাকুর ) রচিত ‘আলালের ঘরের দুলাল’ ও ‘হুতোম প্যাঁচার নকসা’ (কালীপ্রসন্ন সিংহ ) নামক গ্রন্থে মৌখিক ভাষাই ব্যবহৃত হয়েছে। তবে প্রাবন্ধিক প্রমথনাথ বিশীর কথায় – “আলাল ও হুতোম প্যাঁচার নকশা বিশেষ আঞ্চলিক ভাষায় লিখিত, তাহাদের ভাষাকে মৌখিক ভাষা বলা উচিত নয়। সাহিত্যের মৌখিক ভাষা সাহিত্যের লৈখিক ভাষার মতই দেশব্যাপী পটভূমিতে প্রতিষ্ঠিত হওয়া আবশ্যক। আঞ্চলিক ভাষা সে দাবী করতে পারে না।”
প্রমথ চৌধুরী মৌখিক ভাষাতেই সাহিত্য রচনায় ব্রতী হন। অবশ্য তিনি নিজেই এক সময়ে সাধুভাষা ব্যবহার করেছেন। তার লেখা ‘জয়দেব’ প্রবন্ধটি সাধুভাষায় রচিত। এতে তিনি গীতগোবিন্দ কাব্যের সমালোচনা লিপিবদ্ধ করেছেন। প্রবন্ধটি সম্বন্ধে তিনি লিখেছেন – “এটি আমার প্রথম লেখা। এ প্রবন্ধের পূর্ব্বে আমি বাঙলা ভাষায় গল্প ত দূরের কথা, কখনও দু’ছত্র পদ্যও লিখিনি।” প্রবন্ধটি পরে ‘সবুজ পত্রে’ প্রকাশিত হয়েছে ( আষাঢ়, ১৩২৭ )।
সাহিত্য রচনায় প্রমথ চৌধুরী গতানুগতিকতা বা চিরপ্রচলিত কাঠামোর বাইরে বেরিয়ে যুক্তিবাদ, মুক্তচিন্তা ও স্বাতন্ত্র্যবোধকে পাথেয় করে এগিয়ে যেতে চেয়েছেন। তার মনে হয়েছে, বহুদিনের অভ্যাসজনিত শৃঙ্খলিত মন যেন অনেক কিছুই উন্মুক্ত করতে চাইছে কিন্তু যথাযথ প্রকাশের পথ খুঁজে পাচ্ছে না। এই জন্যই হয় ত প্রমথ চৌধুরী কথ্য বা মৌখিক ভাষাকে লেখার মাধ্যম করতে চেয়েছেন – বাস্তবকে আড়ম্বর ও আভিজাত্যের নিগড় থেকে মুক্ত করে অকৃত্রিম ও স্বাভাবিক ভঙ্গীতে প্রকাশের প্রয়োজনে। দীর্ঘকালের অনুসৃত সাহিত্যরূপের পরিবর্তনে যৌবনের বাঁধভাঙা শক্তি ও স্বাতন্ত্র্যবোধকে অন্যতম হাতিয়ার করে এগোতে চেয়েছেন। এ জন্যই তিনি বলেছেন – “যৌবনে মানুষের বাহ্যেন্দ্রিয়, কর্মেন্দ্রিয় ও অন্তরিন্দ্রিয় সব সজাগ ও সবল হয়ে ওঠে এবং সৃষ্টির মূলে যে প্রেরণা আছে, মানুষ সেই প্রেরণা তার সকল অঙ্গে, সকল মনে অনুভব করে।” এই পথ নির্দেশের জন্যই ‘সবুজ পত্রে’র প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। বঙ্কিমচন্দ্র যেমন একটি বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে ‘বঙ্গদর্শন’ প্রকাশ করেছিলেন; অনেকটা একই ধরণের উদ্দেশ্য নিয়ে ‘সবুজ পত্রে’র প্রকাশ। তবে সময়ের পরিবর্তনে প্রয়োজনের তারতম্য ও ভিন্নতা ত থাকবেই।
‘সবুজ পত্র’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৩২১-এর বৈশাখ মাসে। প্রথম সংখ্যায় ‘মুখপত্র’ শিরোনামে প্রমথ চৌধুরী পত্রিকা প্রকাশের যে উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করেছেন তা অতি দীর্ঘ। সবটা উধৃত করা সম্ভব নয়; শুধু কিছু প্রাসঙ্গিক অংশ এখানে তুলে দিচ্ছি। সাহিত্যের সংজ্ঞা ও সাহিত্য সৃষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণও এখানে কিছুটা নির্দিষ্ট করা হয়েছে।
সুদীর্ঘ হলেও প্রমথ চৌধুরী এই বক্তব্যে সাহিত্যের ধর্ম ও সাহিত্য সৃষ্টি সম্বন্ধে তার সুচিন্তিত মতামত ব্যক্ত করেছেন।
‘সবুজ পত্রে’র আগেও প্রমথ চৌধুরী সাহিত্য রচনা করেছেন। তার রচিত ‘জয়দেব’, ‘হালখাতা’, ‘কথার কথা’, ‘আমরা ও তোমরা’, ‘বইয়ের ব্যবসা’, ‘নোবেল প্রাইজ’ ইত্যাদি রচনা ‘সবুজ পত্র’ প্রকাশিত হবার আগেই রচিত। ‘সবুজ পত্রে’ যখন তিনি লিখেছেন, তখনও তার লেখার ষ্টাইল মোটামুটি অপরিবর্তিতই থেকেছে। তবে ‘সবুজ পত্র’ তারই পত্রিকা হওয়াতে তিনি ইচ্ছামত বিষয় বস্তু নির্বাচন ও প্রকাশের স্বাধীনতা পেয়েছেন। তার গদ্য রচনার বিশেষ ধরন বীরবলী যুগের সৃষ্টি করেছে। প্রসঙ্গত ‘বীরবল’ ছিল প্রমথ চৌধুরীর ছদ্মনাম। তার লেখার ধরনের জন্য সেকালের অনেক সাময়িক পত্র তার লেখা প্রকাশ করতে দ্বিধাগ্রস্ত ছিল। কিন্তু ‘সবুজ পত্রে’ তিনি ইচ্ছামত লেখার সুযোগ পেয়েছেন। বস্তুত গল্প লেখক হিসাবে তার প্রতিষ্ঠা ‘সবুজ পত্র’কে আশ্রয় করেই। তার রচিত ‘বড় বাবুর বড়দিন’, ‘আহুতি’’ ( এ দুটি ‘অবসরে’ সঙ্কলিত হয়েছে ), ‘একটি সাদা গল্প’ ‘চার-ইয়ারী কথা’ ইত্যাদি গল্প পাঠকসমাজ আগ্রহের সঙ্গেই গ্রহণ করেছে। যাদের সুযোগ আছে তারা ‘চার-ইয়ারী কথা’ ( চৈত্র ১৩২২ ) পড়ে দেখতে পারেন। সতীশ চন্দ্র ঘটক রচিত ‘চার-ইয়ারী কথা’র একটি মনোগ্রাহী আলোচনা ‘নারায়ণ’ পত্রিকার ১৩২৪-এর আশ্বিন-কার্ত্তিক সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে। প্রমথ চৌধুরী অবশ্য প্রবন্ধ ও উপন্যাসও লিখেছেন, তবে সংখ্যায় কম। সাহিত্যাকাশে প্রমথ চৌধুরীকে দীপ্যমান করার কৃতিত্ব সম্পূর্ণভাবে ‘সবুজ পত্রে’র প্রাপ্য।
‘সবুজ পত্রে’র আলোচনা রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিয়ে করা সম্ভব নয়। প্রকৃতপক্ষে রবীন্দ্রনাথ শুধু উৎসাহ দাতা নন, পত্রিকা প্রকাশের শুরু থেকে পরবর্তী পর্যায়েও সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করেছেন। তিনি ত্রৈমাসিক ‘পরিচয়’ পত্রিকার ১৩৩৮ কার্তিক সংখ্যায় লিখেছেন –
এরপর কবিগুরুই পত্রিকাটির জন্য ব্যস্ত হয়ে ওঠেন এবং প্রমথ চৌধুরীকে লেখেন –
‘সবুজ পত্রে’ কি ধরনের লেখা প্রকাশিত হবে সে সম্বন্ধেও তার ভাবনা ছিল –
বিষয় বস্তু সম্বন্ধে তার চিন্তার আরও কিছু ছাপ পাওয়া যায় যখন তিনি লেখেন –
‘সবুজ পত্রে’র কথা ভাবতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ অন্য লেখার কাজে সময় দিতে পারেন নি। ভাইজি-জামাই প্রমথ চৌধুরীর ‘সবুজ পত্রে’ লিখতে গিয়ে তিনি রামানন্দর পত্রিকা ‘প্রবাসী’তে লিখতে পারেন নি। ক্ষুব্ধ হন ‘প্রবাসী’ সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়। ১৯১৪ সালের ১৯শে জুন তার ক্ষোভ প্রশমনে শান্তিনিকেতন থেকে কবি চিঠি লেখেন রামানন্দকে –
‘সবুজ পত্র’কে একটি সার্থক সাহিত্য পত্রিকা হিসাবে প্রতিষ্ঠা দিতে কবিগুরুর চিন্তার অন্ত ছিল না। তিনি চেয়েছিলেন একটা নতুন লেখক গোষ্ঠি গড়ে তুলতে যেটা পত্রিকা প্রকাশের উদ্দেশ্য সফল করতে প্রয়াসী হবে। তিনি প্রমথ চৌধুরীকে লিখেছেন –
পত্রিকার শুরুতে লেখা তেমন ছিল না। এটা রবীন্দ্রনাথের পছন্দ হয় নি। ১৩২১-এর চৈত্র সংখ্যা ‘সবুজ পত্র’ কেবলমাত্র রবীন্দ্রনাথের লেখা দিয়েই পল্লবিত হয়েছে। প্রকাশিত সংখ্যাটি সম্বন্ধে ‘মানসী’ পত্রিকার মন্তব্য –
সামগ্রিক ভাবে ‘সবুজ পত্রে’ প্রবন্ধ লিখেছেন – রবীন্দ্রনাথ, প্রমথ চৌধুরী, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, অতুলচন্দ্র গুপ্ত, ব্রজেন্দ্রনাথ শীল, ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, বরদাচরণ গুপ্ত, সতীশ চন্দ্র ঘটক, হৃষিকেশ সেন, সুরেশ চন্দ্র চক্রবর্ত্তী, কিরণশঙ্কর রায়, সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য প্রমুখ। কবিতা রচনা করেছেন – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রমথ চৌধুরী, সুরেশানন্দ ভট্টাচার্য, অমিয় চক্রবর্ত্তী, সুরেশ চন্দ্র চক্রবর্ত্তী, কান্তি চন্দ্র ঘোষ এবং অন্যান্যরা। গল্প লিখেছেন – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রমথ চৌধুরী, সতীশচন্দ্র ঘটক, কিরণশঙ্কর রায়, বীরেশ্বর মজুমদার প্রভৃতি লেখকেরা। এখানে প্রমথ চৌধুরীর বিদূষী বহুভাষাবিদ স্ত্রী ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণীর কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। প্রমথ চৌধুরী স্বয়ং উৎসাহিত না করলে বা রবীন্দ্রনাথের আগ্রহ না থাকলে ইন্দিরা যে সাহিত্য ক্ষেত্রেও সমান পারদর্শী একথা অজ্ঞাতই থাকত। ১৩২৫-এর কার্ত্তিক-অগ্রহায়ণ সংখ্যা ‘সবুজ পত্রে’ প্রকাশিত ইন্দিরা দেবী রচিত ‘গ্রীস ও রোম’ প্রবন্ধ পড়ে রবীন্দ্রনাথ সবিস্ময়ে লিখেছেন –
রবীন্দ্রনাথ চাইলেও ‘সবুজ-পত্রে’র লেখক গোষ্ঠি কিন্তু সেভাবে গড়ে ওঠে নি। অনেকে লিখলেও পত্রিকার নিয়মিত ও নিজস্ব লেখক ছিল খুবই কম। রবীন্দ্রনাথ ও প্রমথ চৌধুরীকে বাদ দিলে সুরেশ চন্দ্র চক্রবর্ত্তী, কান্তিচন্দ্র ঘোষ, সতীশচন্দ্র ঘটক, অতুলচন্দ্র গুপ্ত প্রভৃতি কয়েকজন এই শ্রেণীভুক্ত ছিলেন। কিরণশঙ্কর রায়, ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন কম কিন্তু গুণগত মান ছিল প্রশংসনীয়।
রবীন্দ্রনাথের ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাস ‘সবুজ পত্রে’ই প্রথম প্রকাশিত হয়। পত্রিকার প্রকাশ কিন্তু মাঝে মাঝেই অনিয়মিত হয়েছে ; রবীন্দ্রনাথের এটা মনঃপুত ছিল না। তিনি লিখেছেন –
পত্রিকার অনিয়মিত প্রকাশ সম্বন্ধে সম্পাদক প্রমথ চৌধুরীও যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। ১৩২৪ বৈশাখ সংখ্যায় ‘সম্পাদকের কৈফিয়ৎ’-এ তিনি লিখেছেন –
‘সবুজ পত্র’ যে কতটা রবীন্দ্র-নির্ভর ছিল সেটা সম্পাদক প্রমথ চৌধুরীর বক্তব্যেই পরিষ্কার ফুটে উঠেছে –
এ সব লক্ষ্য করেই বুদ্ধদেব বসু বলেছিলেন – “Sabujpatra was Rabindranath’s creation no less than Pramath Chaudhuri’s.” এ সম্বন্ধে পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের মন্তব্য – “সবুজ পত্রের রাজা রবীন্দ্রনাথ, সামন্ত প্রমথ চৌধুরী।”
‘সবুজ পত্রে’র আর একটি দোষ ছিল এটির ছাপার ভুল। রবীন্দ্রনাথও মধ্যে মধ্যে এ নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করেছেন। কিন্তু প্রমথ চৌধুরী এটাকে ততটা গুরুত্ব দেন নি। তার মতে – “ছাপার ভুলকে আমি তেমন মারাত্মক দোষ বলে মনে করি নে, - কেননা পাঠকমণ্ডলী ও ভুল নিজগুণেই অনায়াসে সংশোধন করে নিতে পারেন।” পত্রিকাকে সর্বাঙ্গসুন্দর বা আকর্ষণীয় করে তুলতে প্রমথ চৌধুরী কোন চেষ্টা করেন নি, সে ধারণাও হয় ত তার ছিল না। পত্রিকাতে কোন বিজ্ঞাপন বা চিত্র প্রকাশিত হয় নি। তিনি শুধু সাহিত্য রচনায় মন দিয়েছেন। তিনি নিজেই বলেছেন – “কলম চালানো আমার সখ, কাগজ চালানো আমার ব্যবসা নয়।”
পরিশেষে প্রমথ চৌধুরীর গদ্য রচনার ভাষা নিয়ে দু’একটি কথা। তার ব্যবহৃত কথ্য ভাষা ও গদ্যরীতি বাংলা সাহিত্যে বীরবলী ঢং সৃষ্টি করেছে। এমন কি রবীন্দ্রনাথের উপরেও এর প্রভাব কার্যকরী হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। প্রয়াত অধ্যাপক জীবেন্দ্র সিংহ রায় বীরবল তথা প্রমথ চৌধুরীর রচনা ও সাহিত্যপ্রতিভা নিয়ে প্রশংসনীয় গবেষণা করেছেন। তার মতে ...... “রবীন্দ্র প্রতিভা বিচিত্র। তার গদ্য-সাহিত্যও সেই বৈচিত্র্য থেকে বঞ্চিত হয় নি। একটু বিশ্লেষণমূলক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে পরীক্ষা করলেই দেখা যায়, তাঁর গদ্যের ভঙ্গির বারে বারে কম-বেশি বদল হয়েছে। তার মধ্যে ‘সবুজ-পত্রে’র সমকালীন গদ্যরীতির নবরূপ বিস্ময়কর। এই সময়ের রবীন্দ-গদ্য মৌখিক ভাষায় রচিত; তা অনাড়ম্বর সৌন্দর্য্যবিশিষ্ট, epigrammatic,সচল,সবল ও মধুর। শিল্পীসুলভ বৈচিত্র্যপূজারী রবীন্দ্রনাথের এই অভিনব গদ্যরীতির পেছনে আছে ‘সবুজ-পত্রে’র (এবং প্রমথ চৌধুরীর )প্রভাব। এর আগে ‘ছিন্নপত্র’, ‘য়ুরোপ প্রবাসীর পত্র’, ‘য়ুরোপ যাত্রীর ডায়েরী’ ইত্যাদিতে তিনি মৌখিক ভাষা ব্যবহার করলেও মৌখিক ভাষা তাঁর গদ্য রচনার একমাত্র বাহন হয়ে ওঠেনি। কিন্তু ‘সবুজ-পত্র’ প্রকাশের প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তিনি যে সমগ্রভাবে মৌখিক ভাষার আশ্রয় গ্রহণ করলেন – তা আর কোনদিন পরিত্যাগ করেন নি। এটা পত্রিকাটির পক্ষে যথার্থই গর্বের কথা।”
তবে ‘সবুজ পত্র’ রবীন্দ্রনাথের রচনাকে প্রভাবিত করে তার রচনারীতির পরিবর্তন সাধন করেছে, না রবীন্দ্রনাথ সবুজপত্রের মাধ্যমে তার গদ্য রচনার ধরনকে স্থায়ী রূপ দিতে চেয়েছেন সেটা ভেবে দেখার।
‘সবুজ পত্রে’ ব্যবহৃত কথ্য ভাষা কিন্তু ‘মানসী’ পত্রিকার সব সময় মনঃপুত হয় নি। ১৩২২ বঙ্গাব্দের মাঘ সংখ্যা ‘মানসী’তে ‘সবুজ-পত্র’ অগ্রহায়ণ সংখ্যায় প্রকাশিত প্রমথ চৌধুরীর ‘অলঙ্কারের সূত্রপাত’ নামক প্রবন্ধটির একটি সমালোচনা ছাপা হয়। কলেবর বৃদ্ধির ভয়ে বিশদ বিবরণ থেকে বিরত থাকছি। তবে প্রমথ চৌধুরীর ব্যবহৃত কিছু বাক্য যেমন –
এখানে বড় হরফে চিহ্নিত (‘মানসী’তেই বড় হরফ ব্যবহৃত হয়েছে ) অতি-কথ্য ভাষা গ্রহণ করতে ‘মানসী’ দ্বিধাগ্রস্ত ।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে ‘সবুজ পত্রে’র সমসাময়িক কিন্তু সম্পূর্ণ বিপরীত ধর্মী একটি পত্রিকা ‘নারায়ণ’ ‘সবুজ পত্রে’র আধুনিকতা গ্রহণ না করে রক্ষণশীলতা বজায় রেখেও পাঠকবর্গের সমাদর লাভ করেছিল। ‘সবুজ পত্রে’র প্রথম প্রকাশ ১৩২১ বৈশাখ আর ‘নারায়ণ’ প্রকাশিত হয় ঐ বছরেই অগ্রহায়ণ মাসে। ‘নারায়ণ’ রবীন্দ্র-বিদ্বেষী ছিল বলে যে কথা প্রচলিত আছে,সেটা আক্ষরিক অর্থে ঠিক নয়। কোন কোন বিষয়ে সমালোচনা করলেও অন্ধ-সমালোচনা কখনও হয় নি। ‘নারায়ণ’ ছিল উদার মতাবলম্বী। এই পত্রিকাতেই প্রমথ চৌধুরীর গদ্য রচনা রীতির প্রশংসা করা হয়েছে –
১৩২১-এর বৈশাখ থেকে ১৩২৭-এর চৈত্র পর্যন্ত ‘সবুজ পত্র’ একটানা প্রকাশিত হয়েছে, অবশ্য মাঝে মাঝে দু’মাসের যুগ্ম-সংখ্যাও বেরিয়েছে। ১৩২৮-এর বৈশাখ থেকে আষাঢ় – এই তিন মাস পত্রিকা বেরোয় নি, পরে ১৩৩৪-এর ভাদ্র সংখ্যা অবধি বেরিয়ে ‘সবুজ পত্র’ বন্ধ হয়ে যায়। ১৩২১ বঙ্গাব্দে রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কারের পর তার লেখার চাহিদা আস্বাভাবিক বেড়ে যায়। ‘সুবুজ পত্র’ যে ১৩ বছর সচল ছিল তার পেছনে যে কবিগুরুর অবদান রয়েছে এতে কোন সন্দেহ নেই। রবীন্দ্রনাথ হয়তো ভেবেছিলেন ‘সবুজপত্র’কে কেন্দ্র করে একটা নতুন লেখক গোষ্ঠি তৈরি হয়ে গেলে তিনি খানিকটা ভার মুক্ত হবেন,কিন্তু সেটা ঘটেনি। তিনি লিখেছেন –
পত্রিকাটির সহ-সম্পাদক পদে পরে সুরেশ চন্দ্র চক্রবর্ত্তী যোগদান করেছেন এবং প্রকাশিত হয়েছে সবুজ পত্র কার্য্যালয়, ৩নং হেস্টিংস হাউস থেকে। বার্ষিক মূল্য কিন্তু ‘দুই টাকা ছয় আনা’ই ছিল। বঙ্কিমচন্দ্র চার বছর ‘বঙ্গদর্শন’ সম্পাদনার পর বলেছিলেন, যে উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন,সেটা সফল হয়েছে; ‘বঙ্গদর্শন’-এর আর প্রয়োজন নেই। ‘সবুজ পত্র’ সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন –‘ওই কাগজটা আমাদের দেশের বর্তমান কালের একটা উদ্দেশ্য সাধন করিবে বলিয়া আমার ধারনা হইয়াছে’। অন্যত্র লিখেছেন –
অতএব বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বঙ্গদর্শনে’র মতই রবীন্দ্রনাথ ‘সবুজপত্রে’র উদ্দেশ্য সফল হয়েছিল বলেই মনে করেছেন। ‘সবুজপত্র’ বাংলা রচনায় চলতি ভাষার প্রবেশ ত্বরান্বিত করেছে ; নিঃসন্দেহে এটি একটি উল্লেখযোগ্য অবদান।
চিত্র ১ ও ২ : পত্রিকার দু’টি প্রচ্ছদপত্র।
লেখক পরিচিতি: বহু বছর বি.ই. কলেজে (এখন ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, শিবপুর (IIEST,shibpur) অধ্যাপনা করেছেন। কিছুদিন হল অবসর নিয়েএখন সেখানে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে আছেন। অ্যাপ্লায়েড মেকানিক্স নিয়ে গবেষণা করলেও একাধিক বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে - জ্যোতিষশাস্ত্র, পুরনো কলকাতার সংস্কৃতি, ইত্যাদি। অবসর সময়ে 'অবসরে'র সঙ্গে সময় কাটান।
(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।
Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.