অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।


পুরানো সাময়িকী ও সংবাদপত্র

অবসর বিশেষ সংখ্যা এপ্রিল ১৪, ২০১৮ (সংযোজন)

 

সবুজ পত্র

দীপক সেনগুপ্ত

সাময়িক পত্র প্রসঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে যে সাহিত্যের আদর্শ অক্ষুণ্ণ রেখে পাঠকের রুচি বোধকে পরিশীলিত করে তুলতে এবং সেই সঙ্গে নতুন লেখক গোষ্ঠি গড়ে তুলে সুস্থ সংস্কৃতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে এজাতীয় পত্রিকার একটি অগ্রণী ভূমিকা রয়েছে। সাহিত্যের আদর্শ ও ধর্ম কি হওয়া উচিত এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে, বিশেষ করে কল্লোল যুগে, অনেক বাদানুবাদ ও লেখনী চালনা হয়েছে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও এই বিতর্কে সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করেছেন। সময়ের সঙ্গে জীবনধারা, মানসিকতা ও রুচি বোধ সব কিছুরই পরিবর্তন হয়। সাহিত্যও এ থেকে বাদ যেতে পারে না। ভাষারীতি, বিষয়বস্তু নির্বাচন, রচনাশৈলী প্রভৃতির পরিবর্তন হলেও একটা মূল লক্ষ্য ও আদর্শবোধের ভিত্তিতে গতিপথ নিয়ন্ত্রিত না হলে সাহিত্য যেখানে গিয়ে পৌঁছতে পারে, সুস্থ সমাজ গড়ে তুলতে সেটা সহায়ক না হয়ে পাঠককূলকে বিভ্রান্ত ও বিপথগামী করতে পারে কি না সেটা এ বিষয়ে বিদগ্ধ জনেরাই বিচার করে দেখবেন।

বর্তমান রচনাটির উদ্দেশ্য সাহিত্যধর্ম আলোচনা নয়, ‘সবুজ পত্র’ নামক্ একটি সাময়িক পত্রের সঙ্গে পাঠকদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া। ‘সবুজ পত্র’ প্রকাশের কৃতিত্ব প্রমথ চৌধুরীর প্রাপ্য। সাহিত্য ক্ষেত্রে এটা তার জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি। অবশ্য রবীন্দ্রনাথের শুভেচ্ছা ও অনুপ্রেরণা তাকে পথ চলতে সাহায্য করেছে, বিরূপ সমালোচনার মুখোমুখি হতে সাহস জুগিয়েছে, নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে প্রত্যয়ী করেছে। রবীন্দ্রনাথের মেজদা সত্যেন্দ্রনাথের কন্যা ইন্দিরা দেবীর স্বামী প্রমথ চৌধুরী ছিলেন বুদ্ধিদীপ্ত মুক্ত মনের মানুষ। তার সাহিত্য প্রতিভা লক্ষ্য করে রবীন্দ্রনাথ তাকে গল্প লিখতে পরামর্শ দেন। সেকালে অধিকাংশ রচনাই রচিত হয়েছে সাধুভাষায়। সাধুভাষায় গাম্ভীর্য ও উদাত্ত ভাব নিহিত থাকলেও দৈনন্দিন জীবনের বা পারিপার্শ্বিক ঘটনা বর্ণনায় সেটা যেন একটু অসচ্ছন্দ বেমানান। চলমান জীবনের বিষয় অকৃত্রিম ভঙ্গীতে মানুষের কাছে পৌঁছে দেবার উপযুক্ত মাধ্যম হিসাবে কথ্য ভাষায় সাহিত্য সৃষ্টির প্রয়াস যে দেখা যায় নি এমন নয়। ১৮৫৪ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত ‘মাসিক পত্রিকা’ নামক সাময়িক পত্রে বা প্যারীচাঁদ মিত্র ( টেকচাঁদ ঠাকুর ) রচিত ‘আলালের ঘরের দুলাল’ ও ‘হুতোম প্যাঁচার নকসা’ (কালীপ্রসন্ন সিংহ ) নামক গ্রন্থে মৌখিক ভাষাই ব্যবহৃত হয়েছে। তবে প্রাবন্ধিক প্রমথনাথ বিশীর কথায় – “আলাল ও হুতোম প্যাঁচার নকশা বিশেষ আঞ্চলিক ভাষায় লিখিত, তাহাদের ভাষাকে মৌখিক ভাষা বলা উচিত নয়। সাহিত্যের মৌখিক ভাষা সাহিত্যের লৈখিক ভাষার মতই দেশব্যাপী পটভূমিতে প্রতিষ্ঠিত হওয়া আবশ্যক। আঞ্চলিক ভাষা সে দাবী করতে পারে না।”

প্রমথ চৌধুরী মৌখিক ভাষাতেই সাহিত্য রচনায় ব্রতী হন। অবশ্য তিনি নিজেই এক সময়ে সাধুভাষা ব্যবহার করেছেন। তার লেখা ‘জয়দেব’ প্রবন্ধটি সাধুভাষায় রচিত। এতে তিনি গীতগোবিন্দ কাব্যের সমালোচনা লিপিবদ্ধ করেছেন। প্রবন্ধটি সম্বন্ধে তিনি লিখেছেন – “এটি আমার প্রথম লেখা। এ প্রবন্ধের পূর্ব্বে আমি বাঙলা ভাষায় গল্প ত দূরের কথা, কখনও দু’ছত্র পদ্যও লিখিনি।” প্রবন্ধটি পরে ‘সবুজ পত্রে’ প্রকাশিত হয়েছে ( আষাঢ়, ১৩২৭ )।

সাহিত্য রচনায় প্রমথ চৌধুরী গতানুগতিকতা বা চিরপ্রচলিত কাঠামোর বাইরে বেরিয়ে যুক্তিবাদ, মুক্তচিন্তা ও স্বাতন্ত্র্যবোধকে পাথেয় করে এগিয়ে যেতে চেয়েছেন। তার মনে হয়েছে, বহুদিনের অভ্যাসজনিত শৃঙ্খলিত মন যেন অনেক কিছুই উন্মুক্ত করতে চাইছে কিন্তু যথাযথ প্রকাশের পথ খুঁজে পাচ্ছে না। এই জন্যই হয় ত প্রমথ চৌধুরী কথ্য বা মৌখিক ভাষাকে লেখার মাধ্যম করতে চেয়েছেন – বাস্তবকে আড়ম্বর ও আভিজাত্যের নিগড় থেকে মুক্ত করে অকৃত্রিম ও স্বাভাবিক ভঙ্গীতে প্রকাশের প্রয়োজনে। দীর্ঘকালের অনুসৃত সাহিত্যরূপের পরিবর্তনে যৌবনের বাঁধভাঙা শক্তি ও স্বাতন্ত্র্যবোধকে অন্যতম হাতিয়ার করে এগোতে চেয়েছেন। এ জন্যই তিনি বলেছেন – “যৌবনে মানুষের বাহ্যেন্দ্রিয়, কর্মেন্দ্রিয় ও অন্তরিন্দ্রিয় সব সজাগ ও সবল হয়ে ওঠে এবং সৃষ্টির মূলে যে প্রেরণা আছে, মানুষ সেই প্রেরণা তার সকল অঙ্গে, সকল মনে অনুভব করে।” এই পথ নির্দেশের জন্যই ‘সবুজ পত্রে’র প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। বঙ্কিমচন্দ্র যেমন একটি বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে ‘বঙ্গদর্শন’ প্রকাশ করেছিলেন; অনেকটা একই ধরণের উদ্দেশ্য নিয়ে ‘সবুজ পত্রে’র প্রকাশ। তবে সময়ের পরিবর্তনে প্রয়োজনের তারতম্য ও ভিন্নতা ত থাকবেই।

‘সবুজ পত্র’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৩২১-এর বৈশাখ মাসে। প্রথম সংখ্যায় ‘মুখপত্র’ শিরোনামে প্রমথ চৌধুরী পত্রিকা প্রকাশের যে উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করেছেন তা অতি দীর্ঘ। সবটা উধৃত করা সম্ভব নয়; শুধু কিছু প্রাসঙ্গিক অংশ এখানে তুলে দিচ্ছি। সাহিত্যের সংজ্ঞা ও সাহিত্য সৃষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণও এখানে কিছুটা নির্দিষ্ট করা হয়েছে।

“...... তা ছাড়া স্বদেশের কিংবা স্বজাতির কোনও একটি অভাব পূরণ করা, কোনও একটি বিশেষ উদ্দেশ্য সাধন করা সাহিত্যের কাজও নয়, ধর্মও নয়; সে হচ্ছে কার্য্যক্ষেত্রের কথা। কোনও বিশেষ উদ্দেশ্যকে অবলম্বন করাতে মনের ভিতরে যে সঙ্কীর্ণতা এসে পড়ে, সাহিত্যের স্ফূর্ত্তির পক্ষে তা অনুকূল নয়। কাজ হচ্ছে দশে মিলে করার জিনিস। দলবদ্ধ হয়ে আমরা সাহিত্য গড়তে পারিনে, গড়তে পারি শুধু সাহিত্য-সম্মিলন। কারণ দশের সাহায্য ও সাহচর্য্যে কোনও কাজ উদ্ধার করতে হলে, নিজের স্বাতন্ত্র্যটি অনেকটা চেপে দিতে হয়। যদি আমাদের দশ জনের মধ্যে মনের চোদ্দ -আনা মিল থাকে, তা হলে প্রতিজনে বাকি দু’আনা বাদ দিয়ে সকলের পক্ষে সমান বাঞ্ছিত কোন ফললাভের চেষ্টা করতে পারি। এক দেশের, এক যুগের, এক সমাজের বহু লোকের ভিতর মনের এই চোদ্দ -আনা মিল থাকলেই সামাজিক কার্য্য সুসম্পন্ন করা সম্ভব হয়, নচেৎ নয়। কিন্তু সাহিত্য হচ্ছে ব্যক্তিত্বের বিকাশ। সুতরাং সাহিত্যের পক্ষে মনের ঐ পড়ে –পাওয়া -চোদ্দআনার চাইতে, ব্যক্তিবিশেষের নিজস্ব দু-আনার মূল্য ঢের বেশী। কেননা ঐ দু-আনা হতেই তার সৃষ্টি এবং স্থিতি, বাকী চোদ্দ -আনা তার লয়। যার সমাজের সঙ্গে ষোল -আনা মনের মিল আছে, তার কিছু বক্তব্য নেই। মন পদার্থটি মিলনের কোলে ঘুমিয়ে পড়ে, আর বিরোধের স্পর্শে জেগে ওঠে। এবং মনের এই জাগ্রত ভাব থেকেই সকল কাব্য, সকল দর্শন, সকল বিজ্ঞানের উৎপত্তি।”
“...... একথা শুনে অনেকে হয়ত বলবেন যে, যে দেশে এত দিকে এত অভাব, সে দেশে যে লেখা তার একটি অভাবও পূরণ করতে না পারে, সে লেখা সাহিত্য নয়, -সখ। ও ত কল্পনার আকাশে রঙীন কাগজের ঘুড়ি ওড়ানো, এবং সে ঘুড়ি যত শীঘ্র কাটা পড়ে’ নিরুদ্দেশ হয়ে যায় ততই ভাল। অবশ্য ঘুড়ি ওড়াবারও একটা সার্থকতা আছে। ঘুড়ি মানুষকে অন্ততঃ উপরের দিকে চেয়ে দেখতে শেখায়। তবুও একথা সত্য যে মানব-জীবনের সঙ্গে যার ঘণিষ্ঠ সম্বন্ধ নেই, তা সাহিত্য নয়, তা শুধু বাকছল। জীবন অবলম্বন করেই সাহিত্য জন্ম ও পুষ্টিলাভ করে, কিন্তু সে জীবন মানুষের দৈনিক জীবন নয়। সাহিত্য হাতে হাতে মানুষের অন্নবস্ত্রের সংস্থান করে দিতে পারে না। কোনও কথায় চিড়ে ভেজে না, কিন্তু কোনও কোনও কথায় মন ভেজে, এবং সেই জাতির কথারই সাধারণ সংজ্ঞা হচ্ছে সাহিত্য।”
“...... মানুষ মাত্রেরই মন কতক সুপ্ত আর কতক জাগ্রত। আমাদের মনের যে অংশটুকু জেগে আছে সেই অংশটুকুকেই আমরা সাধারণ মন বলে ভুল করি, - নিদ্রিত অংশটুকুর অস্তিত্ব আমরা মানিনে, কেন না জানিনে। সাহিত্য মানব-জীবনের প্রধান সহায়, কারণ তার কাজ হচ্ছে মানুষের মনকে ক্রমান্বয় নিদ্রার অধিকার হতে ছিনিয়ে নিয়ে জাগরূক করে তোলা। আমাদের বাঙলা সাহিত্যের ভোরের পাখীরা যদি আমাদের প্রতিষ্ঠিত সবুজপত্র-মণ্ডিত সাহিত্যের নব শাখার উপর এসে অবতীর্ণ হন, তাহলে আমরা বাঙ্গালীজাতির সব চেয়ে যে বড় অভাব তা কতকট দূর করতে পারব। সে অভাব হচ্ছে আমাদের মনের ও চরিত্রের অভাব যে কতটা, তারি জ্ঞান।”
“...... আমরা সকলেই গতিশীল, - কেউ স্থিতিশীল নই। ইউরোপের স্পর্শে আমরা, আর কিছু না হোক, গতিলাভ করেছি, অর্থাৎ মানসিক ও ব্যবহারিক সকল প্রকার জড়তার হাত থেকে কথঞ্চিৎ মুক্তি লাভ করেছি। এই মুক্তির ভিতর যে আনন্দ আছে – সেই আনন্দ হতেই আমাদের নব সাহিত্যের সৃষ্টি। সুন্দরের আগমনে হীরামালিনীর ভাঙ্গা মালঞ্চে যেমন ফুল ফুটে উঠেছিল, ইউরোপের আগমনে আমাদের দেশে তেমনি সাহিত্যের ফুল ফুটে উঠেছে। তার ফল কি হবে সে কথা না বলতে পারলেও, এই ফুলফোটা যে বন্ধ করা উচিত নয় এই হচ্ছে আমাদের দৃঢ় ধারণা, সুতরাং যিনি পারেন তাঁকেই আমরা ফুলের চাষ করবার জন্য উৎসাহ দেব।”
“ইউরোপের কাছে আমরা একটি অপূর্ব্ব জ্ঞান লাভ করেছি, সে হচ্ছে এই যে, ভাবের বীজ যে দেহ থেকেই আননা কেন, দেশের মাটিতে তার চাষ করতে হবে। চিনের টবে তোলা মাটিতে সে বীজ বপন করা পণ্ডশ্রম মাত্র। আমাদের এই নবশিক্ষাই, ভারতবর্ষের অতিবিস্তৃত অতীতের মধ্যে আমাদের এই নবভাবের চর্চ্চার উপযুক্ত ক্ষেত্র চিনে নিতে শিখিয়েছে। ইংরাজি শিক্ষার গুণেই আমরা দেশের লুপ্ত অতীতের পুনরুদ্ধারকল্পে ব্রতী হয়েছি।”
“...... গাছের গোলাপের সঙ্গে কাগজের গোলাপের সাদৃশ্য থাকলেও, জীবিত ও মৃতের মধ্যে যে পার্থক্য – উভয়ের মধ্যে সেই পার্থক্য বিদ্যমান। কিন্তু স্থলের গোলাপ ও জলের পদ্ম উভয়েই এক জাতীয়, কেননা উভয়েই জীবন্ত। সুতরাং আমাদের নব জীবনের নব শিক্ষা, দেশের দিক ও বিদেশের দিক, দুই দিক থেকেই আমাদের সহায়। এই নবজীবন যে লেখায় প্রতিফলিত হয় সেই লেখাই কেবল সাহিত্য, - বাদবাকী লেখা হয় কাজের, নয় বাজে।”
“...... সাহিত্য এদেশে অদ্যাবধি ব্যবসা-বাণিজ্যের অঙ্গ হয়ে ওঠেনি; তার জন্য দোষী লেখক কি পাঠক, বলা কঠিন। ফলে আমরা হচ্ছি সব সাহিত্য-সমাজের সখের কবির দল। অব্যবসায়ীর হাতে পৃথিবীর কোন কাজই যে সর্ব্বাঙ্গসুন্দর হয়ে ওঠে না, একথা সর্ব্বলোক স্বীকৃত। লেখা আমাদের অধিকাংশ লেখকের পক্ষে, কাজও নয় খেলাও নয়, শুধু অকাজ; কারণ খেলার ভিতর যে স্বাস্থ্য ও স্বচ্ছন্দতা আছে, সে লেখায় তা নেই, - অপর দিকে কাজের ভিতর যে যত্ন ও মন আছে, তাও তাতে নেই। আমাদের রচনার মধ্যে অন্যমনস্কতার পরিচয় পদে পদে পাওয়া যায়; কেননা যে অবসর আমাদের নেই, সেই অবসরে আমরা সাহিত্য রচনা করি। আমরা অবলীলাক্রমে সাহিত্য গড়তে চাই বলে, আমাদের নৈসর্গিক প্রতিভার উপর নির্ভর করা ব্যতীত উপায়ন্তর নেই। অথচ এ কথা লেখক মাত্রেরই স্মরণ রাখা উচিত, যে যিনি সরস্বতীর প্রতি অনুগ্রহ করে লেখেন, সরস্বতী চাই কি তার প্রতি অনুগ্রহ নাও করতে পারেন। এই একটি কারণ যার জন্য বঙ্গসাহিত্য পুষ্পিত না হয়ে, পল্লবিত হয়ে উঠেছে। ফুলের চাষ করতে হয়, জঙ্গল আপনি হয়। অতিকায় মাসিক পত্রগুলি সংখ্যাপূরণের জন্য এই আগাছার অঙ্গীকার করতে বাধ্য, এবং সেই কারণে আগাছার বৃদ্ধির প্রশ্রয় দিতেও বাধ্য। এই সব দেখে শুনে, ভয়ে সঙ্কুচিত হয়ে, আমাদের কাগজ ক্ষুদ্র আকার ধারণ করেছে। এই আকারের তারতম্যে; প্রকারেরও কিঞ্চিৎ তারতম্য হওয়া অবশ্যম্ভাবী। আমাদের স্বল্পায়তন পত্রে, অনেক লেখা আমরা অগ্রাহ্য করতে বাধ্য হব।”
“...... আমার শেষ কথা এই যে, যে শিক্ষার গুণে দেশে নূতন প্রাণ এসেছে, মনে সাহিত্য গড়বার প্রবৃত্তি জন্মিয়ে দিয়েছে, সেই শিক্ষার দোষেই সে ইচ্ছা কার্য্যে পরিণত করবার অনুরূপ ক্ষমতা পাই নি। আমরা বর্ত্তমান ইউরোপ ও অতীত ভারতবর্ষ, এ উভয়ের দোটানায় পড়ে’, বাঙ্গলা প্রায় ভুলে গেছি। আমরা শিখি ইংরাজি, লিখি বাঙ্গলা, মধ্যে থাকে সংস্কৃতের ব্যবধান। ইংরাজি শিক্ষার বীজ অতীত ভারতের ক্ষেত্রে প্রথম বপন করলেও, তার চারা তুলে বাঙ্গলার মাটিতে বসাতে হবে, নইলে স্বদেশী সাহিত্যের ফুল ফুটবে না। পশ্চিমের প্রাণবায়ু যে ভাবের বীজ বহন করে আনছে, তা দেশের মাটিতে শিকড় গড়তে পারছে না বলে’, হয় শুকিয়ে যাচ্ছে, নয় পরগাছা হচ্ছে। এই কারণেই “মেঘনাদবধ” কাব্য পরগাছার ফুল। “অর্কিড”-এর মত তার আকারের অপূর্ব্বতা এবং বর্ণের গৌরব থাকলেও, তার সৌরভ নেই। খাঁটি স্বদেশী বলে’ “অন্নদামঙ্গল” স্বল্পপ্রাণ হলেও কাব্য; এবং কোন দেশেরই নয় বলে’ “বৃত্রসংহার” মহাপ্রাণ হলেও মহাকাব্য নয়। ভারতচন্দ্র, ভাষা ও ভাবের একতার গুণে, সংযমের গুণে, তাঁর মনের কথা ফুলের মত সাকার করে’ তুলেছেন, এবং সে ফুলে, যতই ক্ষীণ হোক না কেন, প্রাণও আছে, গন্ধও আছে। দেশের অতীত ও বিদেশের বর্ত্তমান, এই দুটি প্রাণশক্তির বিরোধ নয়, মিলনের উপর আমাদের সাহিত্যের ও সমাজের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। আশা করি বাঙ্গলার পতিত জমি সেই মিলনক্ষেত্র হবে। সেই পতিত জমি আবাদ করলেই তাতে সাহিত্যের ফুল ফুটে উঠবে, তাই ক্রমে জীবনের ফলে পরিণত হবে। তার জন্য আবশ্যক আর্ট, কারণ প্রাণশক্তি একমাত্র আর্টেরই বাধ্য। আমাদের এই ক্ষুদ্র পত্রিকা আশা করি এ বিষয়ে লেখকদের সহায়তা করবে।”

সুদীর্ঘ হলেও প্রমথ চৌধুরী এই বক্তব্যে সাহিত্যের ধর্ম ও সাহিত্য সৃষ্টি সম্বন্ধে তার সুচিন্তিত মতামত ব্যক্ত করেছেন।

‘সবুজ পত্রে’র আগেও প্রমথ চৌধুরী সাহিত্য রচনা করেছেন। তার রচিত ‘জয়দেব’, ‘হালখাতা’, ‘কথার কথা’, ‘আমরা ও তোমরা’, ‘বইয়ের ব্যবসা’, ‘নোবেল প্রাইজ’ ইত্যাদি রচনা ‘সবুজ পত্র’ প্রকাশিত হবার আগেই রচিত। ‘সবুজ পত্রে’ যখন তিনি লিখেছেন, তখনও তার লেখার ষ্টাইল মোটামুটি অপরিবর্তিতই থেকেছে। তবে ‘সবুজ পত্র’ তারই পত্রিকা হওয়াতে তিনি ইচ্ছামত বিষয় বস্তু নির্বাচন ও প্রকাশের স্বাধীনতা পেয়েছেন। তার গদ্য রচনার বিশেষ ধরন বীরবলী যুগের সৃষ্টি করেছে। প্রসঙ্গত ‘বীরবল’ ছিল প্রমথ চৌধুরীর ছদ্মনাম। তার লেখার ধরনের জন্য সেকালের অনেক সাময়িক পত্র তার লেখা প্রকাশ করতে দ্বিধাগ্রস্ত ছিল। কিন্তু ‘সবুজ পত্রে’ তিনি ইচ্ছামত লেখার সুযোগ পেয়েছেন। বস্তুত গল্প লেখক হিসাবে তার প্রতিষ্ঠা ‘সবুজ পত্র’কে আশ্রয় করেই। তার রচিত ‘বড় বাবুর বড়দিন’, ‘আহুতি’’ ( এ দুটি ‘অবসরে’ সঙ্কলিত হয়েছে ), ‘একটি সাদা গল্প’ ‘চার-ইয়ারী কথা’ ইত্যাদি গল্প পাঠকসমাজ আগ্রহের সঙ্গেই গ্রহণ করেছে। যাদের সুযোগ আছে তারা ‘চার-ইয়ারী কথা’ ( চৈত্র ১৩২২ ) পড়ে দেখতে পারেন। সতীশ চন্দ্র ঘটক রচিত ‘চার-ইয়ারী কথা’র একটি মনোগ্রাহী আলোচনা ‘নারায়ণ’ পত্রিকার ১৩২৪-এর আশ্বিন-কার্ত্তিক সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে। প্রমথ চৌধুরী অবশ্য প্রবন্ধ ও উপন্যাসও লিখেছেন, তবে সংখ্যায় কম। সাহিত্যাকাশে প্রমথ চৌধুরীকে দীপ্যমান করার কৃতিত্ব সম্পূর্ণভাবে ‘সবুজ পত্রে’র প্রাপ্য।

‘সবুজ পত্রে’র আলোচনা রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিয়ে করা সম্ভব নয়। প্রকৃতপক্ষে রবীন্দ্রনাথ শুধু উৎসাহ দাতা নন, পত্রিকা প্রকাশের শুরু থেকে পরবর্তী পর্যায়েও সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করেছেন। তিনি ত্রৈমাসিক ‘পরিচয়’ পত্রিকার ১৩৩৮ কার্তিক সংখ্যায় লিখেছেন –

“ বিশিষ্ট সাহিত্যকে অবলম্বন ক’রে একটি মাসিক পত্র প্রকাশের প্রস্তাব নিয়ে একদিন মণিলাল আমার কাছে এসেছিল। আমি জানতুম, এটা কঠিন কাজ, - আমার অন্য কর্ত্তব্যের উপর এটা চাপলে বোঝা দুঃসহ ভারী হবে তাই নিজে এ-দায় নিতে রাজী হলুম না। অথচ অত্যন্ত প্রয়োজন আছে একথা অনেকদিন ভেবেচি – তাই সঙ্কল্পটাকে একেবারে নামঞ্জুর ক’রতে পারলুম না। ...... প্রমথকে সম্পাদক ক’রতে পরামর্শ দিলুম। ...... মণিলালের সঙ্গে প্রথম সর্ত্ত এই হোলো যে, যারা ওজন দরে বা গজের মাপে সাহিত্য-বিচার ক’রে তাদের জন্যে এ-কাগজ হবে না। সব লেখাই পয়লা নম্বরের হওয়া অসম্ভব, দ্বিতীয় শ্রেণীতেও ভিড় হয় না, অতএব আয়তন ছোটো করতেই হবে। ...... ছবি দেওয়া নিষেধ, বিজ্ঞাপনের বোঝাও পরিত্যাজ্য, তা’র মানে মুনাফার লোভ থেকে দৃষ্টি যথাসম্ভব ফিরিয়ে আনা চাই।”

এরপর কবিগুরুই পত্রিকাটির জন্য ব্যস্ত হয়ে ওঠেন এবং প্রমথ চৌধুরীকে লেখেন –

“সেই কাগজটার কথা চিন্তা কোর। যদি সেটা বের করাই ঠিক হয় তাহলে শুধু চিন্তা করলে হবেনা – কিছু লিখতে শুরু কোরো। কাগজটার নাম যদি কণিষ্ঠ হয় তা কি রকম হয়। আকারে ছোট – বয়সেও। শুধু কালের হিসাবে ছোট বয়স নয়, ভারের হিসাবেও।” অবশ্য পত্রিকাটির নাম ‘কণিষ্ঠ’ হয় নি, নাম ঠিক হয় ‘সবুজ পত্র’। রবীন্দ্রনাথ খুশীই হন, লেখেন – “সবুজ পত্র উদ্গমের সময় হয়েছে – বসন্তের হাওয়ায় সে কথা চাপা রইল না – অতএব সংবাদটা ছাপিয়ে দিতে দোষ নেই। আমি একটু ফাঁক পেলেই কিছু লেখার চেষ্টা করব।” তার উৎকণ্ঠা প্রকাশ পেয়েছে যখন তিনি লেখেন – “তোমরা কাগজ ত বের করচ কিন্তু হাতে দু’তিন মাসের সম্বল ত জমাওনি ......।”

‘সবুজ পত্রে’ কি ধরনের লেখা প্রকাশিত হবে সে সম্বন্ধেও তার ভাবনা ছিল –

“অন্যান্য মাসিকে যে সমস্ত আলোচ্য প্রবন্ধ বেরয় তার সম্বন্ধে সম্পাদকের বক্তব্য বের হলে উপকার হবে। প্রথমতঃ, যারা উৎসাহের যোগ্য সেই সব লেখকেরা পুরস্কৃত হবে। দ্বিতীয়তঃ, অন্যের লেখা সম্মুখে রেখে বলবার কথাটাকে পরিষ্কার করে বলবার সুবিধা হয়। তাছাড়া, আধুনিক সাহিত্যে মাঝিগিরি করতে হলে সমালোচনার হাল ধরা চাই। প্রতিমাসে সমালোচনার যোগ্য বই পাবে না; কিন্তু মাসিক পত্রের লেখাগুলির লক্ষ্য করে কিছু-না কিছু বলবার জিনিস পাবে। বিরুদ্ধ কথাও যথোচিত শিষ্টতা রক্ষা করে কিভাবে বলা উচিত তার একটা আদর্শ দেখাবার সময় এসেছে।”

বিষয় বস্তু সম্বন্ধে তার চিন্তার আরও কিছু ছাপ পাওয়া যায় যখন তিনি লেখেন –

“সবুজ পত্রে মাঝে মাঝে কাজের কথা আলোচনা হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি – বিশেষতঃ যে সব কাজের মধ্যে নূতন চিন্তা ও নূতন চেষ্টার হাত আছে। অর্থাৎ সবুজ পত্রে কেবল ফুলের সূচনা মাত্র করে না তাতে ফলেরও আয়োজন আছে এইটে প্রকাশ না হলে জিনিসটা একটু সৌখীন হয়ে দাঁড়াবে। ...সৃষ্টির মধ্যে আরো-ভালোর ডাক কোনদিন থামে নি এবং কোনদিন থামবে না। সবুজ-পত্রের সবুজত্ব এই নিয়ে। যে ডাকঘর দিয়ে এই পত্র আসছে সেই ডাকঘরে তুলট কাগজ চলে না – সেখানে হলদের আমেজ দেখা দিলেই তাকে খসিয়ে দিয়ে সবুজ আপনার জয়পতাকা ওড়ায়। তাই সবুজের প্রেমিক আমার আবেদন এই যে, কাজের ক্ষেত্রে পৃথিবীতে যেখানে নূতন চিন্তা ও নূতন চেষ্টা দেখা দিয়েছে, সেইখানকার বার্ত্তা তোমার কাগজ বহন করে প্রচার করুক।”

‘সবুজ পত্রে’র কথা ভাবতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ অন্য লেখার কাজে সময় দিতে পারেন নি। ভাইজি-জামাই প্রমথ চৌধুরীর ‘সবুজ পত্রে’ লিখতে গিয়ে তিনি রামানন্দর পত্রিকা ‘প্রবাসী’তে লিখতে পারেন নি। ক্ষুব্ধ হন ‘প্রবাসী’ সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়। ১৯১৪ সালের ১৯শে জুন তার ক্ষোভ প্রশমনে শান্তিনিকেতন থেকে কবি চিঠি লেখেন রামানন্দকে –

“প্রবাসীর প্রতি আমার মমতা কিছুই কমে নাই। আমার মুস্কিল এই যে সবুজ পত্রে ঢাকা পড়িয়াছি। ওটা আত্মীয়ের কাগজ বলিয়াই যে কেবল উহাতে আটকা পড়িয়াছি তাহা নহে। ওই কাগজটা আমাদের দেশের বর্তমান কালের একটা উদ্দেশ্য সাধন করিবে বলিয়া আমার ধারনা হইয়াছে।”

‘সবুজ পত্র’কে একটি সার্থক সাহিত্য পত্রিকা হিসাবে প্রতিষ্ঠা দিতে কবিগুরুর চিন্তার অন্ত ছিল না। তিনি চেয়েছিলেন একটা নতুন লেখক গোষ্ঠি গড়ে তুলতে যেটা পত্রিকা প্রকাশের উদ্দেশ্য সফল করতে প্রয়াসী হবে। তিনি প্রমথ চৌধুরীকে লিখেছেন –

“যত পার নতুন লেখক টেনে নাও – লিখতে লিখতে তারা তৈরি হয়ে নেবে। কাগজের আদর্শ সম্বন্ধে অত্যন্ত বেশি কড়া হলে নিষ্ফল হতে হবে। ... সাময়িক সাহিত্য অত্যন্ত বেশি যদি খুঁৎখুঁতে হয় তাহলে তাকে বিলেতের Old maid-এর মত যৌবন ব্যর্থ করে নিঃসন্তান শুকিয়ে মরতে হবে। চির সাময়িক সাহিত্যই অত্যন্ত সতর্ক হয়ে যাচাই ও বাছাই করে – সাময়িক সাহিত্য আমদরবার; খোষদরবার নয়।”

পত্রিকার শুরুতে লেখা তেমন ছিল না। এটা রবীন্দ্রনাথের পছন্দ হয় নি। ১৩২১-এর চৈত্র সংখ্যা ‘সবুজ পত্র’ কেবলমাত্র রবীন্দ্রনাথের লেখা দিয়েই পল্লবিত হয়েছে। প্রকাশিত সংখ্যাটি সম্বন্ধে ‘মানসী’ পত্রিকার মন্তব্য –

“এবারের সবুজ পত্রের নূতনত্ব আছে – লেখক একা রবীন্দ্রনাথ, সম্পাদক মুখপত্রে নামাবশেষ হইয়াই আছেন। সেদিন একজন বন্ধু বলিতেছিলেন, সবুজ পত্রের এমন সম্পাদক আমিও হইতে পারি , কিন্তু মুখপত্রে নামটি ছাপিতে রাজী নই।”

সামগ্রিক ভাবে ‘সবুজ পত্রে’ প্রবন্ধ লিখেছেন – রবীন্দ্রনাথ, প্রমথ চৌধুরী, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, অতুলচন্দ্র গুপ্ত, ব্রজেন্দ্রনাথ শীল, ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, বরদাচরণ গুপ্ত, সতীশ চন্দ্র ঘটক, হৃষিকেশ সেন, সুরেশ চন্দ্র চক্রবর্ত্তী, কিরণশঙ্কর রায়, সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য প্রমুখ। কবিতা রচনা করেছেন – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রমথ চৌধুরী, সুরেশানন্দ ভট্টাচার্য, অমিয় চক্রবর্ত্তী, সুরেশ চন্দ্র চক্রবর্ত্তী, কান্তি চন্দ্র ঘোষ এবং অন্যান্যরা। গল্প লিখেছেন – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রমথ চৌধুরী, সতীশচন্দ্র ঘটক, কিরণশঙ্কর রায়, বীরেশ্বর মজুমদার প্রভৃতি লেখকেরা। এখানে প্রমথ চৌধুরীর বিদূষী বহুভাষাবিদ স্ত্রী ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণীর কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। প্রমথ চৌধুরী স্বয়ং উৎসাহিত না করলে বা রবীন্দ্রনাথের আগ্রহ না থাকলে ইন্দিরা যে সাহিত্য ক্ষেত্রেও সমান পারদর্শী একথা অজ্ঞাতই থাকত। ১৩২৫-এর কার্ত্তিক-অগ্রহায়ণ সংখ্যা ‘সবুজ পত্রে’ প্রকাশিত ইন্দিরা দেবী রচিত ‘গ্রীস ও রোম’ প্রবন্ধ পড়ে রবীন্দ্রনাথ সবিস্ময়ে লিখেছেন –

“বিবির ( ইন্দিরা দেবীর ডাকনাম ) লেখাটা পড়ে আশ্চর্য্য হয়েছিলুম। শেষে ওর নাম পড়বার আগে ওর লেখা বলে মনেও করিনি – প্রবন্ধের বিষয়টির জন্য বলছিনে, ওর ষ্টাইলের জন্য।”

রবীন্দ্রনাথ চাইলেও ‘সবুজ-পত্রে’র লেখক গোষ্ঠি কিন্তু সেভাবে গড়ে ওঠে নি। অনেকে লিখলেও পত্রিকার নিয়মিত ও নিজস্ব লেখক ছিল খুবই কম। রবীন্দ্রনাথ ও প্রমথ চৌধুরীকে বাদ দিলে সুরেশ চন্দ্র চক্রবর্ত্তী, কান্তিচন্দ্র ঘোষ, সতীশচন্দ্র ঘটক, অতুলচন্দ্র গুপ্ত প্রভৃতি কয়েকজন এই শ্রেণীভুক্ত ছিলেন। কিরণশঙ্কর রায়, ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন কম কিন্তু গুণগত মান ছিল প্রশংসনীয়।

রবীন্দ্রনাথের ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাস ‘সবুজ পত্রে’ই প্রথম প্রকাশিত হয়। পত্রিকার প্রকাশ কিন্তু মাঝে মাঝেই অনিয়মিত হয়েছে ; রবীন্দ্রনাথের এটা মনঃপুত ছিল না। তিনি লিখেছেন –

“ফাগুনের সবুজ-পত্র বার করতে আর বেশি দেরি কোরোনা – তারপর চৈত্রের প্রথম সপ্তাহেই তোমার লেখাটি বেরিয়ে যাক। তাহলে বেশি দেরি হবে না। এ মাসের সবুজ-পত্রের কপি কি সব তৈরি হয় নি ? ঘরে-বাইরে ত দিয়েছি – সেটা ফর্মা চারেক হবে। তোমারও কিছু কিছু লেখা নিশ্চয়ই আছে – যদি প্রফুল্ল চক্রবর্ত্তির কিছু থাকে দিয়ে দিয়ো। তার পরেই তোমার গল্পটি ছাপা হতে থাক। তাহলে ১লা চৈত্রই বেরোতে পারবে।”

পত্রিকার অনিয়মিত প্রকাশ সম্বন্ধে সম্পাদক প্রমথ চৌধুরীও যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। ১৩২৪ বৈশাখ সংখ্যায় ‘সম্পাদকের কৈফিয়ৎ’-এ তিনি লিখেছেন –

“...... কিন্তু সবুজ পত্র যে শেষ ছ’মাস ঠিক মাসে মাসে বেরোয় নি, এটাই হয়েছে তার মহাত্রুটি। শ্রীযুক্ত কিরণশঙ্কর রায় তারিখের শাসন না মানবার পক্ষে যে যুক্তি দেখিয়েছেন – সে সব যতই সুযুক্তি হোক না কেন ...... আমরা যে এ ক্ষেত্রে শাসনের নিয়ম লঙ্ঘন করেছি, তার একমাত্র কারণ – সে নিয়ম রক্ষা করা আমাদের পক্ষে সব সময় সম্ভবপর হয় নি।”

‘সবুজ পত্র’ যে কতটা রবীন্দ্র-নির্ভর ছিল সেটা সম্পাদক প্রমথ চৌধুরীর বক্তব্যেই পরিষ্কার ফুটে উঠেছে –

“...... সবুজ পত্রের বিরুদ্ধে নানারূপ বদনাম থাকা সত্ত্বেও তার একটি বিশেষ সুনাম আছে। জনরব যে এ পত্রের সম্পাদক রবীন্দ্রনাথের বেনামদার। এ প্রবাদটি অক্ষরে অক্ষরে সত্য না হলেও, প্রকৃতপক্ষে মিথ্যা নয়। সকলেই জানেন যে প্রথম দু বৎসর রবীন্দ্রনাথের লেখাই ছিল – কি ওজনে, কি পরিমাণে – এ পত্রের প্রধান সম্পদ। সবুজ পত্র বাঙ্গলার পাঠকসমাজে যদি কোনরূপ প্রতিষ্ঠা ও মর্য্যাদালাভ করে থাকে ত সে মুখ্যতঃ তার লেখার গুণে।”
...... “রবীন্দ্রনাথের সাহায্য ব্যতীত আমি যে এ কাগজ চালাতে পারব, এ ভরসা আমার আদপেই ছিল না। আমার ক্ষমতার সীমা আমি জানি। সুতরাং মাসের পর মাস একখানি করে গোটা সবুজ পত্র আমার পক্ষে একহাতে গড়ে তোলা যে অসম্ভব, -এ জ্ঞান আমি কখনই হারাই নি। ...... এ ত গেল লেখার কথা। তারপর আসে পরের লেখার সম্পাদনের কথা; সে বিষয়েও আমার কোন অভিজ্ঞতা ছিল না, কেন না সবুজ পত্রের সম্পাদককে ও কাজের বালাই নিয়ে বড় একটা ভুগতে হয় নি। প্রথমতঃ রবীন্দ্রনাথের লেখার উপর হস্তক্ষেপ করার অধিকার পৃথিবীর কোন দেশের কোন সম্পাদকেরই নেই – দ্বিতীয়তঃ, আমার নিজের লেখার উপর হস্তক্ষেপ করার অধিকার আমার চিরদিনই ছিল, - কিন্তু সে লেখক হিসাবে, সম্পাদক হিসাবে নয়। এই কারণে আমি গত বৎসর সবুজ পত্র বন্ধ করে দেবারি পক্ষপাতী ছিলুম। শেষটা কিন্তু যাঁর অভিপ্রায়মত সবুজ পত্র প্রকাশ করা হয়, তাঁরই ইচ্ছামত ও পত্র বাঁচিয়ে রাখতে আমি প্রতিশ্রুত হই।”

এ সব লক্ষ্য করেই বুদ্ধদেব বসু বলেছিলেন – “Sabujpatra was Rabindranath’s creation no less than Pramath Chaudhuri’s.” এ সম্বন্ধে পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের মন্তব্য – “সবুজ পত্রের রাজা রবীন্দ্রনাথ, সামন্ত প্রমথ চৌধুরী।”

‘সবুজ পত্রে’র আর একটি দোষ ছিল এটির ছাপার ভুল। রবীন্দ্রনাথও মধ্যে মধ্যে এ নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করেছেন। কিন্তু প্রমথ চৌধুরী এটাকে ততটা গুরুত্ব দেন নি। তার মতে – “ছাপার ভুলকে আমি তেমন মারাত্মক দোষ বলে মনে করি নে, - কেননা পাঠকমণ্ডলী ও ভুল নিজগুণেই অনায়াসে সংশোধন করে নিতে পারেন।” পত্রিকাকে সর্বাঙ্গসুন্দর বা আকর্ষণীয় করে তুলতে প্রমথ চৌধুরী কোন চেষ্টা করেন নি, সে ধারণাও হয় ত তার ছিল না। পত্রিকাতে কোন বিজ্ঞাপন বা চিত্র প্রকাশিত হয় নি। তিনি শুধু সাহিত্য রচনায় মন দিয়েছেন। তিনি নিজেই বলেছেন – “কলম চালানো আমার সখ, কাগজ চালানো আমার ব্যবসা নয়।”

পরিশেষে প্রমথ চৌধুরীর গদ্য রচনার ভাষা নিয়ে দু’একটি কথা। তার ব্যবহৃত কথ্য ভাষা ও গদ্যরীতি বাংলা সাহিত্যে বীরবলী ঢং সৃষ্টি করেছে। এমন কি রবীন্দ্রনাথের উপরেও এর প্রভাব কার্যকরী হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। প্রয়াত অধ্যাপক জীবেন্দ্র সিংহ রায় বীরবল তথা প্রমথ চৌধুরীর রচনা ও সাহিত্যপ্রতিভা নিয়ে প্রশংসনীয় গবেষণা করেছেন। তার মতে ...... “রবীন্দ্র প্রতিভা বিচিত্র। তার গদ্য-সাহিত্যও সেই বৈচিত্র্য থেকে বঞ্চিত হয় নি। একটু বিশ্লেষণমূলক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে পরীক্ষা করলেই দেখা যায়, তাঁর গদ্যের ভঙ্গির বারে বারে কম-বেশি বদল হয়েছে। তার মধ্যে ‘সবুজ-পত্রে’র সমকালীন গদ্যরীতির নবরূপ বিস্ময়কর। এই সময়ের রবীন্দ-গদ্য মৌখিক ভাষায় রচিত; তা অনাড়ম্বর সৌন্দর্য্যবিশিষ্ট, epigrammatic,সচল,সবল ও মধুর। শিল্পীসুলভ বৈচিত্র্যপূজারী রবীন্দ্রনাথের এই অভিনব গদ্যরীতির পেছনে আছে ‘সবুজ-পত্রে’র (এবং প্রমথ চৌধুরীর )প্রভাব। এর আগে ‘ছিন্নপত্র’, ‘য়ুরোপ প্রবাসীর পত্র’, ‘য়ুরোপ যাত্রীর ডায়েরী’ ইত্যাদিতে তিনি মৌখিক ভাষা ব্যবহার করলেও মৌখিক ভাষা তাঁর গদ্য রচনার একমাত্র বাহন হয়ে ওঠেনি। কিন্তু ‘সবুজ-পত্র’ প্রকাশের প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তিনি যে সমগ্রভাবে মৌখিক ভাষার আশ্রয় গ্রহণ করলেন – তা আর কোনদিন পরিত্যাগ করেন নি। এটা পত্রিকাটির পক্ষে যথার্থই গর্বের কথা।”

তবে ‘সবুজ পত্র’ রবীন্দ্রনাথের রচনাকে প্রভাবিত করে তার রচনারীতির পরিবর্তন সাধন করেছে, না রবীন্দ্রনাথ সবুজপত্রের মাধ্যমে তার গদ্য রচনার ধরনকে স্থায়ী রূপ দিতে চেয়েছেন সেটা ভেবে দেখার।

‘সবুজ পত্রে’ ব্যবহৃত কথ্য ভাষা কিন্তু ‘মানসী’ পত্রিকার সব সময় মনঃপুত হয় নি। ১৩২২ বঙ্গাব্দের মাঘ সংখ্যা ‘মানসী’তে ‘সবুজ-পত্র’ অগ্রহায়ণ সংখ্যায় প্রকাশিত প্রমথ চৌধুরীর ‘অলঙ্কারের সূত্রপাত’ নামক প্রবন্ধটির একটি সমালোচনা ছাপা হয়। কলেবর বৃদ্ধির ভয়ে বিশদ বিবরণ থেকে বিরত থাকছি। তবে প্রমথ চৌধুরীর ব্যবহৃত কিছু বাক্য যেমন –

“একটু অসতর্ক হলেই অলঙ্কার দর্শনে গড়িয়ে পড়ে এবং ছড়িয়ে যায়” অথবা “অলঙ্কার কাব্যের পিঠ পিঠ আসে এবং উভয়ের ভিতর পিঠে পিঠে ভাইয়ের সম্বন্ধ থাকলেও অলঙ্কার কণিষ্ঠ এবং কাব্য জ্যেষ্ঠ ।”

এখানে বড় হরফে চিহ্নিত (‘মানসী’তেই বড় হরফ ব্যবহৃত হয়েছে ) অতি-কথ্য ভাষা গ্রহণ করতে ‘মানসী’ দ্বিধাগ্রস্ত ।

এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে ‘সবুজ পত্রে’র সমসাময়িক কিন্তু সম্পূর্ণ বিপরীত ধর্মী একটি পত্রিকা ‘নারায়ণ’ ‘সবুজ পত্রে’র আধুনিকতা গ্রহণ না করে রক্ষণশীলতা বজায় রেখেও পাঠকবর্গের সমাদর লাভ করেছিল। ‘সবুজ পত্রে’র প্রথম প্রকাশ ১৩২১ বৈশাখ আর ‘নারায়ণ’ প্রকাশিত হয় ঐ বছরেই অগ্রহায়ণ মাসে। ‘নারায়ণ’ রবীন্দ্র-বিদ্বেষী ছিল বলে যে কথা প্রচলিত আছে,সেটা আক্ষরিক অর্থে ঠিক নয়। কোন কোন বিষয়ে সমালোচনা করলেও অন্ধ-সমালোচনা কখনও হয় নি। ‘নারায়ণ’ ছিল উদার মতাবলম্বী। এই পত্রিকাতেই প্রমথ চৌধুরীর গদ্য রচনা রীতির প্রশংসা করা হয়েছে –

“ বীরবলের লেখার একটা বিশেষ ধর্ম্ম হচ্ছে ঠাট্টা করতে করতে দু’ঠাট্টার মাঝখান দিয়ে কতগুলো সত্য কথা বলে নেওয়া। …… সাহিত্য ও পলিটিক্সের বিচার করতে গিয়ে তিনি বলেছেন – “সাহিত্যের ধর্ম্ম ও পলিটিক্সের ধর্ম্ম এক নয়। কবি দার্শনিক প্রভৃতির কাজ হচ্ছে মানুষের মন গড়ে তোলা আর পলিটিক্সের কাজ লোকের মত গড়ে তোলা। বলা বাহুল্য মন ও মত এক বস্তু নয়। … এবং … যে ক্ষেত্রে প্রথমটির যত অভাব সে ক্ষেত্রে দ্বিতীয়টির তত প্রভাব।” ”

১৩২১-এর বৈশাখ থেকে ১৩২৭-এর চৈত্র পর্যন্ত ‘সবুজ পত্র’ একটানা প্রকাশিত হয়েছে, অবশ্য মাঝে মাঝে দু’মাসের যুগ্ম-সংখ্যাও বেরিয়েছে। ১৩২৮-এর বৈশাখ থেকে আষাঢ় – এই তিন মাস পত্রিকা বেরোয় নি, পরে ১৩৩৪-এর ভাদ্র সংখ্যা অবধি বেরিয়ে ‘সবুজ পত্র’ বন্ধ হয়ে যায়। ১৩২১ বঙ্গাব্দে রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কারের পর তার লেখার চাহিদা আস্বাভাবিক বেড়ে যায়। ‘সুবুজ পত্র’ যে ১৩ বছর সচল ছিল তার পেছনে যে কবিগুরুর অবদান রয়েছে এতে কোন সন্দেহ নেই। রবীন্দ্রনাথ হয়তো ভেবেছিলেন ‘সবুজপত্র’কে কেন্দ্র করে একটা নতুন লেখক গোষ্ঠি তৈরি হয়ে গেলে তিনি খানিকটা ভার মুক্ত হবেন,কিন্তু সেটা ঘটেনি। তিনি লিখেছেন –

“…… যাই হোক ভার কমল না। সাময়িক কাগজের বাঁধা ফরমাস জুগিয়ে চলা সেকেলে ট্রামগাড়ির ঘোড়ার মত দুঃখী জীবের কাজ। মন ছুটি চাইল, ক্লান্ত হ’য়ে শেষকালে জবাব দিলুম। বন্ধ হোলো চিত্রিবিহীন ফর্ম্মাবিরল সবুজ পত্র।”

পত্রিকাটির সহ-সম্পাদক পদে পরে সুরেশ চন্দ্র চক্রবর্ত্তী যোগদান করেছেন এবং প্রকাশিত হয়েছে সবুজ পত্র কার্য্যালয়, ৩নং হেস্টিংস হাউস থেকে। বার্ষিক মূল্য কিন্তু ‘দুই টাকা ছয় আনা’ই ছিল। বঙ্কিমচন্দ্র চার বছর ‘বঙ্গদর্শন’ সম্পাদনার পর বলেছিলেন, যে উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন,সেটা সফল হয়েছে; ‘বঙ্গদর্শন’-এর আর প্রয়োজন নেই। ‘সবুজ পত্র’ সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন –‘ওই কাগজটা আমাদের দেশের বর্তমান কালের একটা উদ্দেশ্য সাধন করিবে বলিয়া আমার ধারনা হইয়াছে’। অন্যত্র লিখেছেন –

“...... ফর্ম্মা গণনা ক’রে সবুজ পত্রের আয়ু নির্ণয় কোরো না। সবুজ পত্র বাংলা ভাষার মোড় ফিরিয়ে দিয়ে গেল। এ-জন্যে যে-সাহস যে-কৃতিত্ব প্রকাশ পেয়েচে তার সম্পূর্ণ গৌরব একা প্রমথনাথের। এর পূর্বে সাহিত্যে চলতি ভাষার প্রবেশ একেবারে ছিল না তা নয় কিন্তু সে ছিল খিড়কির রাস্তায় অন্দর মহলে। ...... ফোর্ট উইলিয়মের পন্ডিতেরা সংস্কৃত বেড়া তুলে দখল ঠেকিয়ে রেখেছিলেন।”

অতএব বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বঙ্গদর্শনে’র মতই রবীন্দ্রনাথ ‘সবুজপত্রে’র উদ্দেশ্য সফল হয়েছিল বলেই মনে করেছেন। ‘সবুজপত্র’ বাংলা রচনায় চলতি ভাষার প্রবেশ ত্বরান্বিত করেছে ; নিঃসন্দেহে এটি একটি উল্লেখযোগ্য অবদান।


 
 

চিত্র ১ ও ২ : পত্রিকার দু’টি প্রচ্ছদপত্র।


লেখক পরিচিতি: বহু বছর বি.ই. কলেজে (এখন ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, শিবপুর (IIEST,shibpur) অধ্যাপনা করেছেন। কিছুদিন হল অবসর নিয়েএখন সেখানে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে আছেন। অ্যাপ্লায়েড মেকানিক্স নিয়ে গবেষণা করলেও একাধিক বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে - জ্যোতিষশাস্ত্র, পুরনো কলকাতার সংস্কৃতি, ইত্যাদি। অবসর সময়ে 'অবসরে'র সঙ্গে সময় কাটান।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.