পুরানো সাময়িকী ও সংবাদপত্র
সেপ্টেম্বর ১৫, ২০১৬
সাধনা
দীপক সেনগুপ্ত
পাঠকসমাজকে গড়ে তুলতে এবং সাহিত্য, শিল্প, বিজ্ঞান, ইতিহাস, ধর্ম, রাজনীতি, সমাজ ব্যবস্থা ইত্যাদি বিষয়ে নতুন নতুন তথ্য ও মতামত সম্বন্ধে তাদের অবহিত করতে সাময়িক পত্রের ভূমিকা অনস্বীকার্য। লেখককে পাঠকের কাছে পৌঁছে দিয়ে তাকে গ্রহণযোগ্য করে তুলতেও সাময়িকপত্রের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে রুচিশীল পাঠকশ্রেণী গড়ে তোলার সঙ্গে সঙ্গে নতুন লেখক গোষ্ঠীও তৈরি হয়। সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রকেও 'বঙ্গদর্শন' প্রকাশ করতে হয়েছিল ধর্ম, সাহিত্য প্রভৃতি বিষয়ে তার নিজের মত ও বক্তব্যকে বৃহৎ সংখ্যক পাঠকের কাছে তুলে ধরতে। এর সুফলও তিনি লাভ করেছিলেন। এখনও 'বঙ্গদর্শন'কে অনেকে সর্বকালীন শ্রেষ্ঠ পত্রিকা হিসাবে গণ্য করেন। রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয় নি। সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিভিন্ন বিষয়ে নিজের দৃষ্টিভঙ্গি সামগ্রিকভাবে প্রকাশ করতে সাময়িকপত্রের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন তিনিও। একাধিক সাময়িক পত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্টও ছিলেন তিনি। কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্যের সম্পাদনায় ১২৯৮ বঙ্গাব্দের ১৭ই জ্যৈষ্ঠ (ডিসেম্বর ১৮৯১) প্রকাশিত হয় 'হিতবাদী'। এই পত্রিকার সাহিত্য বিভাগের সম্পাদক ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। খুবই অল্প সময়ের জন্য, মাত্র তিন মাস তিনি এই পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। হয়ত তিনি নিজের মতামত স্বাধীনভাবে ব্যক্ত করতে পারছিলেন না, তাই নিজেই একটি পত্রিকা প্রকাশের সঙ্কল্প করেন। প্রকাশিত হয় ‘সাধনা’, প্রথম সংখ্যার প্রকাশকাল অগ্রহায়ণ ১২৯৮। কাকতালীয়বৎ 'সাধনা'র স্থায়িত্বকালও 'বঙ্গদর্শন'-এর মত চার বছর। প্রথম তিন বছর - ১৩০১ বঙ্গাব্দের কার্তিক মাস পর্যন্ত - সম্পাদক হিসাবে নাম ছিল রবীন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের চতুর্থ পুত্র সুধীন্দ্রনাথের। তখন তার বয়স মাত্র বাইশ বছর, রবীন্দ্রনাথের ত্রিশ।
রবীন্দ্রনাথ যে সব পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন সেগুলি হল -
সাধনা : ১২৯৮ – ১৩০২
ভারতী : ১৩০৫
বঙ্গদর্শন ( নবপর্যায় ) : ১৩০৮ – ১৩১২
ভাণ্ডার : ১৩১২ – ১৩১৪
তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা : ১৩১৮ - ১৩২১
'সাধনা'র আয়ু ছিল চার বছর। প্রথম তিন বছর সুধীন্দ্রনাথ সম্পাদক হিসাবে কাজ করেছেন। চতুর্থ বছরে সম্পাদক হিসাবে রবীন্দ্রনাথের নাম প্রথম মুদ্রিত হয়। সম্পাদক হিসাবে যার নামই থাকুক , মুখ্যত রবীন্দ্রনাথই শুরু থেকে সম্পাদনা ও পরিচালনার কাজ দেখাশোনা করেছেন। একটি পত্রে পদ্মিনীমোহন নিয়োগীকে কবি লিখেছেন -"সাধনা পত্রিকার অধিকাংশ লেখা আমাকেই লিখিতে হইত এবং অন্য লেখকদের রচনাতেও আমার হাত ভুরি পরিমাণে ছিল।" সেজন্য চতুর্থ বৎসরে আনুষ্ঠানিকভাবে তার নাম সম্পাদক হিসাবে মুদ্রিত হলেও তার সম্পাদনাকাল ১২৯৮-১৩০২ দেখান হয়েছে। 'ভারতী' সম্বন্ধে ‘অবসরে’র পাতায় আগেই বলা হয়েছে। এই পত্রিকার মোট আটজন সম্পাদকের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ সম্পাদনা করেছে এক বছর (১৩০৫)।
১৮৯১-এর ডিসেম্বর মাসে 'সাধনা' প্রকাশের আগে যে সব উচ্চাঙ্গের পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল, তার কয়েকটি হল - বিবিধার্থ সংগ্রহ (১৮৫১); সোমপ্রকাশ (১৮৫৮); রহস্য সন্দর্ভ (১৮৬৩); অমৃতবাজার পত্রিকা (১৮৬৮); বঙ্গদর্শন (১৮৭২); জ্ঞানাঙ্কুর (১৮৭২); আর্য্যদর্শন (১৮৭৪); ভারতী (১৮৭৭); বঙ্গবাণী (১৮৮১); নব্যভারত (১৮৮৩); নবজীবন (১৮৮৪); বালক (১৮৮৫); সাহিত্য (১৮৯০) প্রভৃতি। এসব পত্রিকা এবং এতে প্রকাশিত বিবিধ রচনা নিশ্চয়ই রবীন্দ্রনাথ মনোযোগ দিয়ে পড়েছেন। এ থেকেই হয় ত তার মনে স্বাধীনভাবে একটি সাময়িকপত্র প্রকাশের বাসনা জেগে ওঠে। উদ্দেশ্য সাহিত্য দর্শন ধর্ম ইত্যাদি বিষয়ে নিজের বক্তব্য সরাসরি মরমী পাঠকদের কাছে তুলে ধরা। বস্তুত: রবীন্দ্রনাথের বিপুল পরিমাণ সাহিত্য সম্ভারের অধিকাংশই প্রথম মুদ্রিত হয়ে বেরিয়েছে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায়। সরাসরি গ্রন্থিত হয়েছে খুব কম লেখাই। অবশ্য সাময়িক পত্রে প্রকাশিত রচনা পরে যখন গ্রন্থায়িত হয়েছে তখন রবীন্দ্রনাথ অনেক ক্ষেত্রেই অনেক পরিমার্জন করেছেন। বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত দীর্ঘদিন ধরে বিপুল সংখ্যক পাঠক সমাজের কাছে সাময়িক পত্রের মাধ্যমে যে লেখা পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়েছে, প্রথমেই গ্রন্থাকারে মুদ্রিত হলে সেটা কখনই সম্ভব হত না।
রবীন্দ্রনাথের পরিকল্পিত প্রথম সাময়িক পত্রিকা ‘সাধনা’। অতএব কবির ভাবাবেগ ও কল্পনা এই পত্রিকাকে কেন্দ্র করে উদ্বেল হয়ে উঠবে সেটাই স্বাভাবিক। কবির ‘জীবনস্মৃতি’তে ‘ভারতী’ ও ‘বালক’-এর উল্লেখ থাকলেও ‘সাধনা’র কথা সেভাবে লিপিবদ্ধ হয় নি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ‘ছিন্নপত্রাবলী’তে ‘সাধনা’র উল্লেখ রয়েছে একাধিকবার। কয়েকটি উদাহরণ -
“ কাল যে ঝড় সে আর কি বলব। আমার সাধনার নিত্যনৈমিত্তিক লেখা সেরে চা খাবার জন্য উপরে যাচ্ছি, এমন সময় প্রচণ্ড ঝড় এসে উপস্থিত। .....” (শনিবার, ৯ই জ্যৈষ্ঠ, ১২৯৯)।
“ আজকাল কবিতা লেখাটা আমার পক্ষে যেন একটা গোপন নিষিদ্ধ সুখসম্ভোগের মতো হয়ে পড়েছে - এদিকে আগামী মসের সাধনার জন্যে একটি লাইন লেখা হয় নি, ও দিকে মধ্যে মধ্যে সম্পাদকের তাড়া আসছে, অনতিদূরে আশ্বিন কার্তিকের যুগল সাধনা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ভর্ৎসনা করছে, আর আমি আমার কবিতার অন্তঃপুরে পালিয়ে পালিয়ে আশ্রয় নিচ্ছি।......” ( ৩০শে আষাঢ়, ১৩০০ )।
“কাল বিকেলে সাধনার জন্য একটা গল্প লেখা শেষ করে আজ কতকটা নিশ্চিন্ত হয়ে বসেছি। দুপুরবেলাটিও খুব নিস্তব্ধ এবং গরম এবং শান্ত এবং স্থির হয়ে আছে - ....” ( ১৬ ফাল্গুন , ১৩০১ )।
“আজ আমি এক অনামিকা চিঠি পেয়েছি। তার আরম্ভই হচ্ছে -
পরের পায়ে ধরে প্রাণ দান করা
সকল দানের সার।
তারপরে অনেক উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছে। আমাকে সে কখনও দেখে নি, কিন্তু আজকাল আমার ‘সাধনা’র মধ্যে সে আমাকে দেখতে পায়। তাই লিখেছে - তোমার সাধনায় রবিকর পড়িয়াছে, তাই রবি-উপাসক যত ক্ষুদ্র যত দূরে থাকুক তবু তার জন্যেও রবিকর বিকীর্ণ হইতেছে।....” ( ২৮ ফেব্রুয়ারি, ১৮৯৫ )।
কয়েকটি মাত্র উদাহরণ দেওয়া হল। এ রকম বহুসংখ্যক উল্লেখ ‘ছিন্নপত্রাবলী’তে বিক্ষিপ্ত রয়েছে।
‘সাধনায়’ রবীন্দ্রনাথের অজস্র ছোট গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, গান ইত্যাদি স্থান পেয়েছে। ‘সাধনায়’ প্রকাশিত যে সব রচনা পরবর্তী কালে গ্রন্থাকারে মুদ্রিত হয় তার মধ্যে রয়েছে ‘সোনার তরী’, ‘চিত্রা’, ‘কথা ও কাহিনী’, ‘গল্পগুচ্ছ’ প্রভৃতি। গল্প লিখতে রবীন্দ্রনাথের আগ্রহ ছিল সর্বাধিক। পত্রিকার শেষ বর্ষেও তার দশটি গল্প প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৭শে জুন কবি শিলাইদহ থেকে ইন্দিরা দেবীকে লিখেছেন –
“আজকাল মনে হচ্ছে, যদি আমি আর কিছু না করে ছোট ছোট গল্প লিখতে বসি তা হলে কতকটা মনের সুখে থাকি এবং কৃতকার্য বলে বোধ হয়। পাঁচজন পাঠকের সুখের কারণ হওয়া যায়। সাধনায় উচ্চ বিষয়ের প্রবন্ধ লিখে বঙ্গদেশকে উন্নতিপথে লগি ঠেলে নিয়ে যাওয়া খুব মহৎ কাজ সন্দেহ নেই, কিন্তু সম্প্রতি তাতে আমি তেমন সুখ পাচ্ছিনে এবং পেরেও উঠছিনে। গল্প লেখার একটা সুখ এই, যাদের কথা লিখব তারা আমার দিনরাত্রির সমস্ত অবসর একেবারে ভরে রেখে দেবে, আমার একলা মনের সঙ্গী হবে, বর্ষার সময় আমার বদ্ধ ঘরের বিরহ দূর করবে এবং রৌদ্রের মধ্যে পদ্মাতীরের উজ্জ্বল দৃশ্যের মধ্যে আমার চোখের পরে বেড়িয়ে বেড়াবে।”
‘সাধনা’র প্রথম সংখ্যায় কোন কোন বিষয়ে এবং কাদের লেখা বেরিয়েছিল দেখা যাক - সাধনার সূর্যালোক (প্রবন্ধ) - দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর; শকুন্তলা (কবিতা) - ঋতেন্দ্রনাথ ঠাকুর; প্রাণ ও প্রাণী (প্রবন্ধ) - সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর; সার্গম স্বরলিপির ‘আকার মাত্রিক’ নূতন পদ্ধতি (প্রবন্ধ) - জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর; সাময়িক সারসংগ্রহ (নির্দিষ্ট বিভাগের রচনা) - ক. মণিপুরের বর্ণনা-রবীন্দ্রনাথ, খ. আমেরিকার সমাজচিত্র-রবীন্দ্রনাথ, গ. পৌরাণিক মহাপ্লাবন-রবীন্দ্রনাথ, ঘ. মুসলমান মহিলা-রবীন্দ্রনাথ, ঙ. প্রাচ্য সভ্যতার প্রাচীনত্ব-রবীন্দ্রনাথ; সোরাব ও রুস্তম (গল্প) - সুধীন্দ্রনাথ ঠাকুর; স্ত্রী-পুরুষের ভেদাভেদ (প্রবন্ধ) - জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর; জানালার ধারে (প্রবন্ধ) - বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর; বৈজ্ঞানিক সংবাদ (নির্দিষ্ট বিভাগের রচনা) - ক. গতি নির্ণয়ের ইন্দ্রিয়-রবীন্দ্রনাথ, খ. ইচ্ছামৃত্যু-রবীন্দ্রনাথ, গ. মাকড়শা-সমাজে স্ত্রী জাতির গৌরব-রবীন্দ্রনাথ, ঘ. উটপাখির লাথি-রবীন্দ্রনাথ; বাগান (প্রবন্ধ) - রবীন্দ্রনাথ; যাত্রা আরম্ভ (য়ুরোপযাত্রীর ডায়ারী) (প্রবন্ধ) - রবীন্দ্রনাথ; সাময়িক সাহিত্য সমালোচনা (নির্দিষ্ট বিভাগের রচনা) : ক. ভারতী-আশ্বিন ও কার্তিক ১২৯৮, খ. নব্যভারত-আশ্বিন ও কার্তিক ১২৯৮, গ. সাহিত্য-আশ্বিন ও কার্তিক ১২৯৮) - রবীন্দ্রনাথ। স্পষ্টত: অধিকাংশ রচনাই রবীন্দ্রনাথের লেখা।
‘সাধনা’য় প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্পের সংখ্যা ৩৬ টি। প্রকাশের কাল অনুযায়ী সেগুলি হ’ল – ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’, ‘সম্পত্তি সমর্পণ’, ‘দালিয়া’, ‘কঙ্কাল’, ‘মুক্তির উপায়’, ‘ত্যাগ’, ‘একরাত্রি’, ‘একটা আষাঢ়ে গল্প’, ‘জীবিত ও মৃত’, ‘স্বর্ণমৃগ’, ‘রীতিমত নভেল’, ‘জয়পরাজয়’, ‘কাবুলিওয়ালা’, ‘ছুটি’, ‘সুভা’, ‘মহামায়া’, ‘দান প্রতিদান’, ‘সম্পাদক’, ‘মধ্যবর্তিনী’, ‘অসম্ভব কথা’, ‘শাস্তি’, ‘একটি ক্ষুদ্র পুরাতন গল্প’, ‘সমাপ্তি’, ‘সমস্যাপুরণ’, ‘অনধিকার প্রবেশ’, ‘মেঘ ও রৌদ্র’, ‘প্রায়শ্চিত্ত’, ‘বিচারক’, ‘নিশীথে’, ‘আপদ’, ‘দিদি’, ‘মানভঞ্জন’, ‘ঠাকুরদা’, ‘প্রতিহিংসা’, ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ ও ‘অতিথি’। প্রথমটি বেরিয়েছিল ১২৯৮ অগ্রহায়ণে এবং শেষ গল্প ‘অতিথি’র প্রকাশ ১৩০২-এর ভাদ্র-কার্তিক সংখ্যায়।
‘সাধনা’র মূল লেখক ছিলেন রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং। সুধীন্দ্রনাথের নাম সম্পাদক হিসাবে থাকলেও তিনিই সম্পাদনার কাজ পরিচালনা করেছেন। রবীন্দ্রনাথ হয় ত পরে বুঝেছিলেন যে অন্য লেখকের লেখা প্রকাশিত না হলে পত্রিকাটি নিতান্তই “ঠাকুরবাড়ির কাগজ” হয়ে দাঁড়াবে। ঠাকুরবাড়ির লেখকদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিয়ে ছিলেন ইন্দিরা দেবী, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের কন্যা শরৎকুমারী দেবীর জামাতা সুকুমার হালদার, দ্বিজেন্দ্রনাথের জামাতা মোহিনীমোহন চট্টোপাধ্যায়, ছিলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ স্বয়ং। সবচেয়ে বেশি লিখেছেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ও বলেন্দ্রনাথ। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং যার নাম প্রথম তিন বছর সম্পাদক হিসাবে ছিল সেই সুধীন্দ্রনাথ গল্প, কবিতা ও প্রবন্ধ লিখেছেন ঠিকই তবে সংখ্যায় খুব কম। অন্যান্য লেখকদের মধ্যে ছিলেন – অক্ষয়চন্দ্র চৌধুরী, অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায়, ইন্দিরা দেবী, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, উমেশচন্দ্র বটব্যাল, ঋতেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কৃষ্ণবিহারী সেন, ক্ষীরোদচন্দ্র রায়চৌধুরী, চুণিলাল গুপ্ত, জগদানন্দ রায়, দীনেন্দ্রকুমার রায়, দেবেন্দ্রনাথ সেন, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, নারায়ণ দাস বন্দ্যোপাধ্যায়, নীরদচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, যোগেন্দ্রনারায়ণ রায়, রজনীকান্ত গুপ্ত, রমেশচন্দ্র দত্ত, প্রমথনাথ রায়চৌধুরী, প্রভাতচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, প্রতাপচন্দ্র মজুমদার, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, শ্রীশচন্দ্র মজুমদার, রুক্মিণীকান্ত চক্রবর্তী, শরৎকুমারী চৌধুরাণী, শৈলেশচন্দ্র মজুমদার, লোকেন্দ্রনাথ পালিত, সখারাম গণেশ দেউস্কর ও হরিসাধন মুখোপাধ্যায়।
পত্রিকার প্রথম সংখ্যা ১২৯৮-এর অগ্রহায়ণে বেরোলেও রবীন্দ্রনাথের কবিতা কিন্তু প্রথম প্রকাশিত হয়েছে ১২৯৯ বৈশাখ সংখ্যায়। জার্মান কবি হাইনরিখ হাইনের ন’টি কবিতা জার্মান ভাষা থেকে অনুবাদ করেছেন রবীন্দ্রনাথ। জার্মান ভাষা জানা থাকায় অনুবাদে কবির কোন অসুবিধা হয় নি। কবিতার শিরোনামে লেখা ছিল ‘জর্মান হইতে অনুবাদিত’। মূল জার্মান রচনাও অনুবাদের সঙ্গে মুদ্রিত হয়েছে। এখানে নমুনা হিসাবে আট ও নয় নম্বর কবিতা দু’টির শুধু অনুবাদ অংশ তুলে দিচ্ছি।
“ বারেক ভালবেসে যে জন মজে, / দেবতাসম সেই ধন্য, / দ্বিতীয় বার পুন প্রেমে যে পড়ে / মূর্খের অগ্রগণ্য। / আমিও সে দলের মূর্খরাজ / দুবার প্রেমপাশে পড়ি; / তপন শশী তারা হাসিয়া মরে, / আমিও হাসি-আর মরি।”
“ বিশ্বামিত্র, বিচিত্র এ লীলা! / দিবেরাত্রি আহার নিদ্রা ছেড়ে, / তপিস্যে আর লড়াই ক’রে শেষে / বশিষ্টের গাইটি নিলে কেড়ে। / বিশ্বামিত্র তোমার মত গরু / দুটি এমন দেখিনি বিশ্বে! / নইলে একটি গাভী পাবার তরে / এত যুদ্ধ এত তপিস্যে!”
প্রথম বর্ষের একই সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে কবির ‘বিম্বাবতী’ কবিতাটি। সে বছরের অন্যান্য কবিতা – ‘শৈশব সন্ধ্যা’, ‘রাজার ছেলে ও রাজার মেয়ে’, ‘হিং টিং ছট’ ও ‘পরশপাথর’। দ্বিতীয় বর্ষে প্রকাশিত হয়েছে – ‘যেতে নাহি দিব’, ‘তোমরা এবং আমরা’, ‘সভাভঙ্গ’ (‘নামভঙ্গ’), ‘সমুদ্রের প্রতি’ (‘পুরীতে সমুদ্র দেখিয়া’), ‘আকাশের চাঁদ’, ‘সোনার তরী’ (১৩০০ আষাঢ়), ‘হৃদয় যমুনা’, ‘ভরা ভাদরে’ ও ‘সুখ’। তৃতীয় বর্ষে ছিল – ‘তুলনায় সমালোচনা’ (নাম পরিবর্তিত হয়ে প্রথমে হয় ‘কণ্টক ও ফুল’ এবং পরে ‘কণ্টকের কথা’), ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’, ‘বিদায় অভিশাপ’, ‘প্রেমের অভিষেক’, ‘এবার ফিরাও মোরে’, ‘নববর্ষে’, ‘মৃত্যুর পরে’ ও ‘অন্তর্যামী’। চতুর্থ বা শেষ বছরে বেরোয় – ‘সাধনা’, ‘সন্ধ্যা’, ‘ব্রাহ্মণ’, ‘পুরাতন ভৃত্য’, ‘জ্যোৎস্না-রাত্রে’, ‘দুই বিঘা জমি’ এবং ‘শীতে ও বসন্তে’।
প্রকাশিত কবিতার অনেকগুলিই ‘সোনার তরী’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত। এটা এখন আর অজানা নয় যে ‘সোনার তরী’, ‘হিং টিং ছট’ প্রভৃতি কবিতা নিয়ে অনেক বিতর্ক ও বাদানুবাদ নানা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। সে সময়ের অনেক প্রতিষ্ঠিত লেখকের শ্লেষ ও তীক্ষ্ণ সমালোচনাও কবিকে সহ্য করতে হয়েছে। সম্ভব হলে এ বিষয়ে পৃথকভাবে আলোচনা করার ইচ্ছা রইল। তবে ‘সাধনা’য় প্রকাশিত মূল কবিতার সঙ্গে রবীন্দ্ররচনাবলীতে প্রকাশিত কবিতার অনেক ক্ষেত্রেই পাঠভেদ লক্ষ্য করা যায়। কবি অনেক পরিবর্জন ও পরিমার্জনও করেছেন। কবিতা পত্রিকার সব সংখ্যায় প্রকাশিত হয় নি। ‘সাধনা’র শেষ তিন সম্মিলিত সংখ্যাতেও কোন কবিতা নেই। মনে হয় সাহিত্যক্ষেত্রে অনেকেই কবির ভাবসমৃদ্ধ আপাত অস্পষ্ট অর্থবহ কবিতার আবির্ভাব মেনে নিতে পারেন নি ; হয় ত সেজন্যই ‘সাহিত্য’ সম্পাদক সুরেশচন্দ্র সমাজপতির বিবেচনায় কাহিনী-ধর্মী কবিতারই উৎকর্ষ স্বীকৃত হয়েছে। তার মতে – “ রবিবাবুর একশতটি কবিতা বাছিয়া ভাল বলা যাইতে পারে, আর তাহার মধ্যে ‘পুরাতন ভৃত্য’ ও ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতা দুইটি প্রধান।”
রবীন্দ্রনাথের ‘কাব্য’ শিরোনামে সাহিত্যতত্ত্ব বিষয়ক একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় ‘সাধনা’র ১২৯৮ চৈত্র সংখ্যায়। এখানে কবি কাব্যরস সম্বন্ধে বলেছেন –
“...... কবিতা হইতে তত্ত্ব বাহির না করিয়া যাহারা সন্তুষ্ট না হয় তাহাদিগকে বলা যাইতে পারে, তত্ত্ব তুমি দর্শন বিজ্ঞান ইতিহাস প্রভৃতি নানা স্থান হইতে সংগ্রহ করিতে পারো, কিন্তু কাব্যরসই কবিতার বিশেষত্ব। এই কাব্যরস কি তা বলা শক্ত। কারণ তাহা তত্ত্বের ন্যায় প্রমাণযোগ্য নহে, অনুভবযোগ্য। যাহা প্রমাণ করা যায় তাহা প্রতিপন্ন করা সহজ; কিন্তু যাহা অনুভব করা যায় তাহা অনুভূত করাইবার সহজ পথ নাই, কেবলমাত্র তাহার সাহায্যে একটা সংবাদ জ্ঞাপন করা যায় মাত্র। কেবল যদি বলা যায় ‘সুখ হইল’ তবে একটা খবর দেওয়া হয়, সুখ দেওয়া হয় না। ... এমন অনেক পাঠক দেখা গিয়াছে যাহারা ...... কোন বিশেষ কবিতার সৌন্দর্য্য স্বীকার করিয়াও তাহার উপকারিতার অভাব লইয়া অপ্রসন্নতা প্রকাশ করিয়া থাকে। যেমন ব্যবসায়ী লোক আক্ষেপ করে পৃথিবীর সমস্ত ফুলবাগান তাহার মূলার ক্ষেত হইল না কেন। সে স্বীকার করিবে ফুল সুন্দর বটে, কিন্তু কিছুতে বুঝিতে পারিবে না তাহাতে ফল কি আছে।”
‘সাধনা’র চার বছরে বহু ধরণের প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। আলোচিত বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে রয়েছে সাহিত্য, ধর্ম, সমাজতত্ত্ব, রাজনীতি, শিক্ষা, বিজ্ঞান, জীবনী, ভাষাতত্ত্ব প্রভৃতি। এর বিস্তৃত বিবরণ দেওয়া সম্ভব নয়, শুধু কয়েকটির উল্লেখ করা যেতে পারে। প্রথম সংখ্যা থেকে শুরু করে মোট এগারোটি সংখ্যা মুদ্রিত হয়েছে ‘য়ুরোপ যাত্রীর ডায়েরী’। প্রথম দু’টি সংখ্যায় ‘বৈজ্ঞানিক সংবাদ’ বিভাগটি ছিল, পরে এটি বাদ দেওয়া হয়। একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন ছিল ‘সাময়িক সারসংগ্রহ’ নামক বিভাগটি। প্রথম সংখ্যায় এই বিভাগে প্রকাশিত হয়েছে – ‘মণিপুরের বর্ণনা’, ‘আমেরিকার সমাজচিত্র’, ‘পৌরাণিক মহাপ্লাবন’, ‘মুসলমান মহিলা’ এবং ‘প্রাচ্য সভ্যতার প্রাচীনত্ব’। এগুলি নেওয়া হয়েছে ১৮৯১ সালের ‘নাইটিন্থ সেঞ্চুরি’ পত্রিকা থেকে। লেখকরা ছিলেন যথাক্রমে – স্যার জেমস জনস্টন, হ্যামিল্টন আইভে, হাক্সলি, জনৈকা তুরস্কবাসিনী ইংরেজ মহিলা এবং ম্যাক্সমূলার। অবশ্য মূল রচনার সঙ্গে কবির নিজস্ব চিন্তাও যুক্ত হয়েছে।
‘সাহিত্য’ পত্রিকার ১২৯৮-এর অগ্রহায়ণ সংখ্যায় চন্দ্রনাথ বসুর ‘আহার’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। লেখকের বক্তব্য ছিল –
“ ...... ঈর্ষা দ্বেষ ও কামক্রোধাদির বশবর্তী হইয়া রাশি রাশি রকম বিরকম মাংস ভক্ষণ করিলেও দেহরক্ষা হইবে না, দীর্ঘ জীবন লাভ করা যাইবে না। আর কামক্রোধাদি দমন করিয়া চিত্ত শুদ্ধ শান্ত ও সুস্থির এবং দেহ সংক্ষোভশূণ্য করিলে সাদাসিধে সাত্ত্বিক আহারেই প্রচুর স্বাস্থ্য, শারীরিক বল ও দীর্ঘ জীবন লাভ করা যাইবে। ...... ইংরাজিশিক্ষিতদিগের মধ্যে আহারাদিতে যে লুব্ধ ও পাশব ভাব জন্মিয়াছে তাহা উন্মীলিত করিতে না পারিলে তাঁহাদের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতির কোন চেষ্টাই সফল হইবে না। ...... ইত্যাদি।
রবীন্দ্রনাথ এর প্রতিবাদে যে প্রবন্ধ ‘আহার সম্বন্ধে চন্দ্রনাথ বাবুর মত’ লিখলেন ঠিক পরের সংখ্যায় ১২৯৮ পৌষে, তার উপসংহার –
“আমিষ এবং নিরামিষ আহারের তুলনা করা আমার উদ্দেশ্য নহে। আমি কেবল এটুকুই বলিতে চাহি, ‘আহার’ সম্বন্ধে প্রবন্ধ লিখিতে গিয়া একটা ঘরগড়া দৈববাণী রচনা করা আজকালকার দিনে শোভা পায় না। এখনকার কালে যদি কোন দৈবদুর্যোগে কোনো লোকের মনে সহসা একটি অভ্রান্ত সত্যের আবির্ভাব হইয়া পড়ে অথচ সঙ্গে সঙ্গে কোন প্রমাণ দেখা না দেয় তবে তাঁহার একমাত্র কর্তব্য সেটাকে মনে মনে পরিপাক করা। গুরুর ভঙ্গীতে কথা বলা একটা নূতন উপদ্রব বঙ্গসাহিত্যে সম্প্রতি দেখা দিতেছে। এরূপভাবে সত্য কথা বলিলেও সত্যের অপমান করা হয়, কারণ সত্য কোন লেখকের নামে বিকাতেই চাহে না, আপনার যুক্তি দ্বারা সে আপনাকে প্রমাণ করে, লেখক উপলক্ষ মাত্র।”
রবীন্দ্রনাথ এতটা রূঢ় না হলেই পারতেন। চন্দ্রনাথ বসুর সঙ্গে তিনি বারে বারেই বিতর্ক ও বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়েছেন।
প্রথম বর্ষের পত্রিকাতেই কবি ‘আলোচনা / পত্র’ শিরোনামে এক নতুন ধরণের প্রবন্ধ রচনারীতির সূত্রপাত করেন। দু’জন লেখকের মধ্যে যেন পত্রের আদান প্রদান হচ্ছে এবং প্রতিটি পত্রই এক একটি প্রবন্ধ। এই দুই লেখক ছিলেন রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং এবং কবি-বন্ধু লোকেন্দ্রনাথ পালিত। প্রবন্ধগুলি ছিল – ‘আলোচনা (পত্র)’ – রবীন্দ্রনাথ (১২৯৮ ফাল্গুন), ‘সাহিত্যের সত্য (পত্রোত্তর)’ – লোকেন্দ্রনাথ (১২৯৮ চৈত্র), ‘সাহিত্য (পত্রোত্তর) – রবীন্দ্রনাথ (১২৯৯ বৈশাখ), ‘সাহিত্যের উপাদান’ – লোকেন্দ্রনাথ (১২৯৯ জ্যৈষ্ঠ), ‘সাহিত্যের প্রাণ’ – রবীন্দ্রনাথ (১২৯৯ আষাঢ়), ‘সাহিত্যের নিত্যলক্ষণ’ – লোকেন্দ্রনাথ (১২৯৯ শ্রাবণ), ‘মনের প্রকাশ’ – রবীন্দ্রনাথ (১২৯৯ ভাদ্র-আশ্বিন)।
‘সাধনা’র দ্বিতীয় বর্ষে শিক্ষা বিষয়ক কিছু প্রবন্ধ পাওয়া যায়। সেগুলি হল – ‘শিক্ষার হেরফের’-রবীন্দ্রনাথ (১২৯৯ পৌষ), ‘শিক্ষাপ্রণালী’-লোকেন্দ্রনাথ পালিত (১২৯৯ মাঘ), ‘ইংরাজি বনাম বাঙলা’-বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১২৯৯ চৈত্র), ‘প্রসঙ্গ কথা’-রবীন্দ্রনাথ (১২৯৯ চৈত্র), ‘প্রসঙ্গ কথা/শিক্ষা সঙ্কট’-রবীন্দ্রনাথ (১৩০০ আষাঢ়)। পত্রিকার দ্বিতীয় বর্ষেই অর্থাৎ ১২৯৯ অগ্রহায়ণ থেকে ১৩০০ কার্ত্তিক অবধি সময়ে একটি উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধমালার নাম ‘ডায়ারি’। কোনো কোনো সংখ্যায় এই প্রবন্ধকে ‘পঞ্চভূতের ডায়ারি’, ‘পাঞ্চভৌতিক ডায়ারি’ বা ‘পাঞ্চভৌতিক সভা’ নামেও অভিহিত করা হয়েছে। মাঘ ১২৯৯ সংখ্যায় প্রথম শুরু এই ‘ডায়ারি’। তৃতীয় বর্ষে এই ধারাবাহিকে কোনো প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় নি, কিন্তু চতুর্থ বা শেষ বছরে আবার কয়েকটি হয়েছে। এই প্রবন্ধগুলি সংকলিত হয়ে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছে ১৩০৪ বঙ্গাব্দে। ‘রবীন্দ্র রচনাবলী’র জন্মশতবার্ষিকী সংস্করণের চতুর্দশ খণ্ডে ‘পঞ্চভূত’ শীর্ষক প্রবন্ধগুচ্ছের মধ্যে এই রচনাগুলি প্রাপ্য। ‘সাধনা’য় প্রকাশিত প্রথম রচনা ‘ডায়ারি/ভূমিকা’র (গ্রন্থে পরিবর্তিত নাম ‘পরিচয়’) প্রথম অংশটি গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত হয় নি। সেটির শুরুতে ছিল –
“ পাঠকেরা যদি ‘ডায়ারি’ শুনিয়া মনে করেন ইহার মধ্যে লেখকের অনেক আত্মকথা আছে, তবে তাঁহারা ভুল বুঝিবেন। যদি তাঁহাদের এমন আশ্বাস জন্মিয়া থাকে যে, লোকটা নিশ্চয় সহসা মারা গিয়াছে, এখন তাহার দৈনিক জীবনের গোপন সিন্দুক হইতে তাহার প্রতি দিবসের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয়গুলি সর্ব্ব সমক্ষে উদ্ঘাটন করিয়া রীতিমত ফর্দ করা হইবে, তবে তাঁহারা অত্যন্ত নিরাশ হইবেন। কারণ, আমি এখনো বাঁচিয়া আছি। আমার প্রতিদিনের খসড়া হিসাব এখনো আমার চাবির মধ্যেই আছে। ...... রচনার সুবিধার জন্য তাঁহাদের মধ্য হইতে কেবল পাঁচজনকে নেওয়া যাক এবং তাদের পঞ্চভূত নাম দেওয়া যাক। ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম। ... শ্রীমতী অপ (ইঁহাকে আমরা স্রোতস্বিনী বলিব)... শ্রীমতী তেজ (ইঁহাকে দীপ্তি নাম দেওয়া গেল)... শ্রীযুক্ত বায়ু (ইঁহাকে সমীরণ বলা যাক)...।”
এ ধরণের অদ্ভুত লেখার পরিকল্পনা এবং অনুপ্রেরণা কোথা থেকে এলো দেখা যাক।
রবীন্দ্রনাথ তার রাজশাহীবাসী বন্ধু লোকেন্দ্রনাথ পালিতের বাড়িতে ১২৯৯-এর ২৯শে কার্তিক গিয়ে আঠারো দিন কাটান। সেখানে প্রত্যহ অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, শরৎকুমার রায় প্রমুখ সাহিত্যপ্রেমীদের নিয়ে মজলিশ বসত। প্রমথ চৌধুরীর ধারণা কবির মাথায় আইডিয়াটা সে সময়েই ঘুরছিল, কারণ ফিরে এসেই ‘সাধনা’য় ভূমিকা অংশটি ছাপা হয়। সাহিত্যের মজলিশ বা আড্ডা জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতেও বসত। একটা খাতা ছিল, নাম ‘পারিবারিক-স্মৃতিলিপি’। হস্তাক্ষরে লিখিত এই খাতায় মজলিশের বহু কথা সঞ্চিত রয়েছে। মুখ্য লেখক ছিলেন অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ তবে অন্যেরাও কিছু না কিছু লিখতেন। বিতর্কমূলক এই আলোচনায় অনেক সময়ে একই বিষয়ে বিভিন্ন জন বিভিন্ন মতামত লিপিবদ্ধ করেছেন। এদেরই মধ্যে পাঁচজনকে পঞ্চভূত নাম দেওয়া হয়েছে ধরে নেওয়া যায়। রাজশাহীর শরৎকুমার রায়ের মতে –
“ অক্ষয়বাবুর (অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়) মুখে শুনিয়াছি, তিনি এবং নাটোরের মহারাজ (জগদিন্দ্রনাথ রায়) নাকি রবিবাবুর পঞ্চভূতের ডায়ারির দুইটি ভূত ছিলেন।”
কাজী আবদুল ওদুদের ধারণা –
“অনুমান করা যেতে পারে এঁদের মধ্যে দীপ্তি হচ্ছেন কাদম্বরী দেবী আর স্রোতস্বিনী হচ্ছেন ইন্দিরা দেবী। কাদম্বরী অবশ্য এর কয়েক বৎসর পূর্বে লোকান্তরিতা হন। কিন্তু রবীন্দ্র-মানসে তিনি ছিলেন অবিস্মরণীয়। তা’র যেটুকে পরিচয় পাওয়া গেছে তা থেকে বোঝা যায় তেজের অংশ তাঁর চরিত্রে বেশ ছিল। ইন্দিরা দেবীর বয়স এ সময়ে অল্প। তবে এই বয়সেই কবির সাহিত্যিক জীবনে তাঁর স্থান লাভ হয়েছিল। ... পঞ্চভূতের পাঁচ ভূতের মধ্যে শ্রীযুক্ত ব্যোম যে দ্বিজেন্দ্রনাথকে স্মরণ করিয়ে দেয় তা হয়তো অনেকেই স্বীকার করবেন। শ্রীযুক্ত সমীর খুব সম্ভব লোকেন পালিত। প্রমথ চৌধুরীর আদলও যে তাঁতে মাঝে মাঝে না দেখা যায় তা নয়, তবে এ সময়ে চৌধুরী মশায়ের বয়স ছিল অল্প। শ্রীযুক্ত ক্ষিতি যে কে অর্থাৎ কার সঙ্গে তাঁর চরিত্র মেলে, তা অনুমান করা কঠিন। সত্যেন্দ্রনাথ বা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ যে নন তা সহজেই বোঝা যায়, কেন না, ক্ষিতি বাস্তববাদী খুব বেশি – অবশ্য সেই সঙ্গে তীক্ষ্ণ বুদ্ধিও। প্রিয়নাথ সেন, নাটোরের মহারাজা জগদিন্দ্রনাথ রায়, ঐতিহাসিক অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, এঁদের কেউ ক্ষিতির রূপ পেয়েছেন কি না তা ভাবা যেতে পারে।”
বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অবসর প্রাপ্ত অধ্যাপক গবেষক ড: অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য তার ‘সাধনা পত্রিকা ও রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থে যথার্থই মন্তব্য করেছেন – “পারিবারিক-স্মৃতিলিপি-পুস্তকখানি বিশ্বভারতী কর্তৃক মুদ্রিত হলে অদ্যাবধি অপ্রকাশিত বিভিন্ন জনের বহু সংখ্যক রচনা আমাদের সকলের হস্তগত হতে পারত।”
যাই হোক, ‘সাধনা’য় প্রকাশিত ‘ডায়ারি’ শীর্ষক প্রবন্ধের সঙ্গে গ্রন্থায়িত প্রবন্ধের নামের পরিবর্তন ঘটেছে। যেমন : ‘ডায়ারি/ভূমিকা’ (১২৯৯ মাঘ) গ্রন্থে হয়েছে ‘পরিচয়’। একই ভাবে পরিবর্তিত নাম হয়েছে : ‘পঞ্চভূতের ডায়ারি’ (১২৯৯ ফাল্গুন) – ‘গদ্য ও পদ্য’, ‘ডায়ারি’ (১২৯৯ চৈত্র) – ‘নরনারী’, ‘ডায়ারি’ (১৩০০ বৈশাখ) – ‘মনুষ্য’, ‘ডায়ারি’ (১৩০০ জ্যৈষ্ঠ) – ‘মন’, ‘পাঞ্চভৌতিক ডায়ারি’ (১৩০০ শ্রাবণ) – ‘অখণ্ডতা’, ‘পাঞ্চভৌতিক ডায়ারি’ (১৩০০ ভাদ্র) – ‘সৌন্দর্য্যের সম্বন্ধ’, ‘ডায়ারি’ (১৩০০ আশ্বিন-কার্তিক) – ‘পল্লীগ্রামে’। এগুলি সবই দ্বিতীয় বর্ষের পত্রিকায় প্রকাশিত। তৃতীয় বর্ষে এ ধরণের কোনো প্রবন্ধ ছাপা হয় নি, কিন্তু চতুর্থ বা শেষ বছরে আবার কিছু বেরিয়েছে।
প্রবন্ধ নিয়ে আলোচনায় ইতি টানার আগে কয়েকটি বিশেষ রচনার কথা উল্লেখ করা যায়। কয়েকটি ব্যঙ্গ-রচনা ‘সাধনা’য় বেরিয়েছিল; যেমন ‘বিনি পয়সার ভোজ’ (১৩০০ পৌষ), ‘স্বর্গীয় প্রহসন’ (১৩০০ আশ্বিন-কার্তিক) ও ‘অরসিকের স্বর্গপ্রাপ্তি’ (১৩০১ ভাদ্র)। সুকুমার সেন প্রথম ও তৃতীয় রচনাটি উল্লেখযোগ্য বলে মনে করেছেন।
বঙ্কিমচন্দ্র তার ‘বঙ্গদর্শনে’ বেশ কয়েকটি গ্রন্থের সমালোচনা প্রকাশ করেছিলেন। সমালোচনা-প্রবন্ধের নাম ছিল গ্রন্থের নামানুসারেই। রবীন্দ্রনাথও এই ধরণে বঙ্কিমের ‘রাজসিংহ’ গ্রন্থের সমালোচনা প্রকাশ করেছেন একই নামে ১৩০০ চৈত্র সংখ্যায়। তবে বঙ্কিমচন্দ্র তখন মৃত্যু শয্যায়, সমালোচনাটি তিনি সম্ভবত: দেখে যেতে পারেন নি। এ রকম আরও কয়েকটি সমালোচনা-প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে – শ্রীশচন্দ্র মজুমদারের ‘ফুলজানি’ (১৩০১ অগ্রহায়ণ), দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘আর্য্যগাথা’ (১৩০১ অগ্রহায়ণ), ‘সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘পালামৌ’ (১৩০১ পৌষ), বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কৃষ্ণচরিত্র’ (১৩০১ মাঘ ও ফাল্গুন), শিবনাথ শাস্ত্রীর ‘যুগান্তর’ (১৩০১ চৈত্র) ও কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংগৃহীত ‘গুপ্তরত্নোদ্ধার বা প্রাচীন কবি সঙ্গীত সংগ্রহ’ (১৩০২ জ্যৈষ্ঠ)। লেখকের সঙ্গে যথেষ্ট হৃদ্য সম্পর্ক থাকলেও সমালোচনা করার সময়ে কবি ছিলেন নিষ্ঠিত ও অকপট। ভাল মন্দ দুইয়েরই উল্লেখ করেছেন তিনি। যেমন সঞ্জীবচন্দ্রের ‘পালামৌ’ সম্বন্ধে লিখেছেন (পৌষ ১৩০১) –
“ “পালামৌ” সঞ্জীবের একটি রমণীয় ভ্রমণ বৃত্তান্ত। ইহার সৌন্দর্য্য যথেষ্ট আছে, কিন্তু পড়িতে পড়িতে প্রতিপদে মনে হয় লেখক যথোচিত যত্ন-সহকারে লেখেন নাই। ...... তাঁহার রচনা হইতে অনুভব করা যায় তাঁহার প্রতিভার অভাব ছিল না, কিন্তু সেই প্রতিভাকে তিনি প্রতিষ্ঠিত করিয়া যাইতে পারেন নাই...... তাঁহার মধ্যে যে পরিমাণে ক্ষমতা ছিল সে পরিমাণে উদ্যম ছিল না। তাঁহার প্রতিভার ঐশ্বর্য ছিল কিন্তু গৃহিণীপনা ছিল না। ভাল গৃহিণীপনায় স্বল্পকেও যথেষ্ট করিয়া তুলিতে পারে; যতটুকু আছে তাহার যথাযোগ্য বিধান করিতে পারিলে তাহার দ্বারা প্রচুর ফল পাওয়া গিয়া থাকে। কিন্তু অনেক থাকিলেও উপযুক্ত গৃহিণীপনার অভাবে সে ঐশ্বর্য ব্যর্থ হইয়া যায়; সে স্থলে অনেক জিনিস ফেলাছড়া যায়, অথচ অল্প জিনিসই কাজে আসে। তাঁহার অপেক্ষা অল্প ক্ষমতা লইয়া অনেকে যে পরিমাণ সাহিত্যের অভাব মোচন করিয়াছেন তিনি প্রচুর ক্ষমতা সত্ত্বেও তাহা পারেন নাই; তাহার কারণ, সঞ্জীবের প্রতিভা ধনী কিন্তু গৃহিণী নহে।”
রবীন্দ্রনাথ সম্পাদিত পত্রিকায় গান থাকবে না এটা হতে পারে না। পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় কোন গান ছিল না। দ্বিতীয় সংখ্যায় (১২৯৮ পৌষ) ‘মায়ার খেলা’র গান-‘মোরা জলে স্থলে কত ছলে’ ইন্দিরা দেবী কৃত স্বরলিপি দিয়ে শুরু। বিভিন্ন সংখ্যায় ছিল – ‘কি গাব আমি’, ‘সখী ঐ বুঝি বাঁশী বাজে’, ‘এমন দিনে তারে বলা যায়’, ‘কেন নয়ন আপনি ভেসে যায়’, সখি বহে গেল বেলা’ ইত্যাদি গানের কথা ও স্বরলিপি। ‘মায়ার খেলা’ গীতিনাট্যের বহু গান রয়েছে পত্রিকায়, প্রায় সব কটিরই স্বরলিপিকার ইন্দিরা দেবী। রবীন্দ্রসঙ্গীত ছাড়াও রয়েছে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ রচিত বেশ কয়েকটি গান – ‘সবে মিলি গাও রে’, ‘আহা কি চাঁদনী রাত’, ‘কি সুধা ঐ মদির নয়নে’, ‘কোয়েলিয়া মাতোয়ারা’ প্রভৃতি। পৃথকভাবে সঙ্গীত বিষয়ক কিছু প্রবন্ধও প্রকাশিত হয়েছে।
‘সাধনা’ সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের আগ্রহ ও উদ্দীপনা সুতীব্র হয়ে উঠেছিল সম্ভবত প্রকাশনার দ্বিতীয় বর্ষে। কটক থেকে ২৫শে ফেব্রুয়ারি ১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দের চিঠিতে তিনি লিখেছেন -
“..... চৈত্র মাসের সাধনার জন্যে যে ডায়রিটা লিখতে আরম্ভ করেছিলুম এবং যা ভাঙা রাস্তায় বহু ভারগ্রস্ত গরুর গাড়ির মতো কিছুতে এগোতে পারছিল না, আজ সেটা নিশ্চয়ই শেষ করে ফেলব। যখন মন একটু খারাপ থাকে তখনই সাধনাটা অত্যন্ত ভারের মতো বোধ হয়। মন ভালো থাকলে মনে হয়, সমস্ত ভার আমি একলা বহন করতে পারি। তখন মনে হয়, আমি দেশের কাজ করব এবং কৃতকার্য হব। তখন লোকের উৎসাহ এবং অনুকূলতা কিছুই আবশ্যক মনে হয় না, মনে হয় আমার নিজের কাজের পক্ষে আমি নিজেই যথেষ্ট। তখন এক-এক সময়ে আমি নিজেই খুব দূর ভবিষ্যতের যেন ছবি দেখতে পাই - আমি দেখতে পাই, আমি বৃদ্ধ পক্বকেশ হয়ে গেছি, একটি বৃহৎ বিশৃঙ্খল অরণ্যের প্রায় শেষ প্রান্তে পৌঁছেছি অরণ্যের মাঝখান দিয়ে বরাবর সুদীর্ঘ একটি পথ কেটে দিয়ে গেছি এবং অরণ্যের অন্য প্রান্তে আমার পরবর্ত্তী পথিকেরা সেই পথের মুখে কেউ কেউ প্রবেশ করতে আরম্ভ করেছে, গোধূলির আলোকে দুই-এক জনকে মাঝে মাঝে দেখা যাচ্ছে। আমি নিশ্চযই জানি 'আমার সাধনা কভু না নিষ্ফল হবে'। ক্রমে ক্রমে অল্পে অল্পে আমি দেশের মন হরণ করে আনব - নিদেন আমার দু-চারটি কথা তার অন্তরে গিয়ে সঞ্চিত হয়ে থাকবে। এই কথা যখন মনে আসে তখন আবার সাধনার প্রতি আকর্ষণ আমার বেড়ে ওঠে। তখন মনে হয় সাধনা আমার হাতের কুঠারের মতো, আমাদের দেশের বৃহৎ সামাজিক অরণ্য ছেদন করবার জন্যে এ'কে আমি ফেলে রেখে মরচে পড়তে দেব না - এ'কে আমি বরাবর হাতে রেখে দেব। যদি আমি আরো আমার সাহায্যকারী পাই তো ভালোই, না পাই তো কাজেই আমাকে একলা খাটতে হবে।”
যে ‘সাধনা’ রবীন্দ্রনাথের এত সাধনার ধন, তার স্থায়িত্ব মাত্র চার বছর কেন ? এ প্রশ্ন স্বভাবতই উঠবে। প্রথম থেকেই সম্পাদনার কাজ মূলত: দেখাশোনা করলেও তৃতীয় বছরের শেষে সুধীন্দ্রনাথের পরিবর্তে অন্য কাউকে সম্পাদক পদে রবীন্দ্রনাথ হয় ত চেয়েছিলেন। ‘সাধনা’র আর্থিক সঙ্গতিও ক্রমশ: হ্রাস পাচ্ছিল। নতুন সম্পাদক হিসাবে ‘সাহিত্য’ সম্পাদক সুরেশচন্দ্র মজুমদারের নাম রবীন্দ্রনাথ ভেবেছিলেন। ঠাকুরদাস মুখোপাধ্যায়য়ের নামও চিন্তা করা হয়েছিল। এমন কি ‘সাহিত্য’ পত্রিকার সঙ্গে ‘সাধনা’র সম্মিলনের কথাও বিবেচনা করা হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এর কোনটিই ফলপ্রসূ হয় নি। ‘সাহিত্য’ পত্রিকায় প্রকাশিত (কার্তিক ১৩১৩) নিত্যকৃষ্ণ বসুর ‘সাহিত্য-সেবকের ডায়েরী’তে ২৮শে আশ্বিন তারিখের দিনলিপিতে লেখা আছে –
“সাহিত্য ও সাধনার সম্মিলন প্রস্তাবটা কার্য্যে পরিণত হইল না দেখিতেছি। সু-চন্দ্র আজ রবিবাবুকে স্পষ্ট করিয়া বলিয়াছেন, এই ছয় মাস তিনি এ বিষয়ে কিছু করিতে পারিবেন না। আমাদের বলিলেন, ছয় মাস কেন, ও প্রস্তাব আর কখনই বোধ হয় সফল হইবে না। এত পরামর্শ, লোক জানাজানি করিয়া শেষে সব ভাসাইয়া দেওয়াটা আমার মতে ভাল না হইলেও, সম্মেলন না হওয়াতে যে আমি আনন্দিত, তাহা আর না বললেও চলে। আর একখানা “ঠাকুরবাড়ীর কাগজ” বাড়াইয়া কোন ফল নাই।”
‘সাধনা’র সমসাময়িক বহু পত্রিকাতে ‘সাধনা’র সমালোচনা নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছে, সব চেয়ে বেশি হয়েছে ‘সাহিত্য’ পত্রিকায়। সুরেশচন্দ্র সম্পাদিত এই পত্রিকাটিতে ‘সাধনা’র সমালোচনা প্রায় নিয়মিতই বেরিয়েছে। কয়েকটি পত্রিকায় প্রকাশিত সমালোচনা একটু দেখে নেওয়া যাক, এতে রবীন্দ্রনাথের ‘সাধের সাধনা’ সম্বন্ধে তখনকার প্রতিষ্ঠিত সাহিত্য পত্রিকার মনোভাব কিছুটা অনুমান করা যাবে। <
“ আমরা সাদরে ‘সাধনা’র আবাহন করিতেছি। পত্রিকার আকার প্রকার অতি সুন্দর ও বাঙ্গালা সাহিত্যে সম্পূর্ণ নূতন বলা যাইতে পারে। সাধনার প্রথম সংখ্যায়, বিলক্ষণ নূতনত্ব আছে, নানাবিধ প্রবন্ধের সমাবেশে সুখপাঠ্য হইয়াছে। আমরা সর্বান্তকরণে, সাধনার উন্নতি ও সম্পূর্ণ সিদ্ধি কামনা করি। আমরা রবীন্দ্রবাবুর ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’ পড়িতে আরম্ভ করিয়া যেমন আমোদ পাইয়াছি; উপসংহারে তেমনই নিরাশ হইয়াছি। এই গল্পটির আরম্ভভাগ, অতি মনোরম, বেশ স্বাভাবিক। ইহার প্রাঞ্জল ভাষা, সরল প্রণালী ও সহজ অলঙ্কার, গল্পটিকে আরও মনোরম করিয়া তুলিয়াছে। আদুরে খোকার খামখেয়ালী মেজাজ কেমন স্বাভাবিক। কিন্তু যখন রাইচরণ নিজের বুড়া খোকাটিকে, মুন্সেফ বাবুর সেই আদুরে খোকা বলিয়া আনিয়া দিতেছে, তখন আমাদের কেমন অস্বাভাবিক বলিয়া বোধ হয়। মুন্সেফবাবু যেন গল্পটিকে সমাপ্ত করিবার জন্যই, সন্দেহ সংশয়ে জলাঞ্জলি দিয়া, পরের ছেলেটিকে নিজের বলিয়া গ্রহণ করিতেছেন। এজন্য গল্পটি কেমন অঙ্গহীন ও কষ্টকল্পিত বলিয়া বোধ হয়। ..
“...... উৎকৃষ্ট কাগজ, উৎকৃষ্ট ছাপা, এরূপ পরিপাটি পত্রিকা এদেশে আর প্রকাশিত হয় নাই। আমরা যত ভাবি, ততই বুঝি, মহর্ষির বাড়ীর সকলই মধুর, সকলই সুন্দর। বঙ্গের আর কোন পরিবারে এতগুলি বাঙ্গালা ভাষার সাধক দেখিতে পাওয়া যায় না। মাতৃসেবার জন্য এ বাড়ীর সকলেই অল্পাধিক পরিমাণে লালায়িত। যাঁহার যেরূপ শক্তি, তিনি সেইরূপ কৃতিত্ব লাভ করিতেছেন। সাধনার লেখার পারিপাট্য দেখিয়া আমরা মোহিত হইয়াছি। আশা করি পত্রিকাখানির মহর্ষির পরিবারের গৌরব আরো উজ্জ্বল করিতে সমর্থ হইবে।” (‘নব্যভারত’ ১২৯৮ ফাল্গুন)।
“ সাধনা। শ্রীযুক্তবাবু সুধীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পাদিত। প্রথম হইতে দু’-চারি-দশ পৃষ্ঠা পর্যন্ত উলটাইয়াও বুঝিতে পারিলাম না যে, এখানা কি ? ওহো, হঠাৎ মনে পড়িল, বিজ্ঞাপনে যে দেখিয়াছিলাম, - ‘সাধনা’ – মাসিকপত্র! ভাল! ভাল! বা! বেশ কাগজখানি তো! এক এক সংখ্যা যেন এক একখানি পুস্তক! কি সুন্দর ছাপা! কি পুরু পুরু পরিষ্কার কাগজ! লেখকগণ আবার দেখি - সবাই ‘ঠাকুর’! বা! বেশ সারি সারি সাজানো তো! যাই হোক, বাস্তবিকই ‘সাধনা’ কাগজখানি বেশ একখানি ‘সখের জিনিস’ হইয়াছে। ঠাকুরবাড়ির আবালবৃদ্ধ-বনিতা তারাই সকলে এ কাগজখানিতে লেখেন। তাঁদেরই এটি সখের জিনিস। সুন্দরই হইতেছে। প্রবন্ধও – ইস্তক বেদালোচনা নাগাদ সা-রি-গা-মা – শেষ রঙ-তামাসা-চুটকি-মজাদার – সবই রকম আছে। মন্দও আছে, ভালও আছে – এই পাঁচ ফুলের সাজি আর কি ? ফলত: বাঙ্গালা সাহিত্যে এটিকেও একটি পরিপাটি জিনিস বলিতে হয়। বাস্তবিকই এটি লাগেও ভাল। আর, তাই আমরা অন্তরের সহিত ইহার স্থায়িত্ব কামনা করি।” ( ‘অনুসন্ধান’ ১২৯৮ চৈত্র )।
“ সাধনা। শ্রীযুক্তবাবু সুধীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পাদিত। ইহার বয়স এক বৎসর পূর্ণ হইয়াছে। প্রবন্ধের বৈচিত্র্য, ভাষার মাধুর্য, চিন্তার গাম্ভীর্য ও মুদ্রাঙ্কনাদির পারিপাট্য সকল বিষয়েই সাধনা প্রশংসার্হ। এরূপ পত্রিকার দীর্ঘজীবন আমরা প্রার্থনা করি।” (‘বামাবোধিনী পত্রিকা’ ১২৯৯ কার্তিক)।
“ ...... সাধনা সম্বন্ধে কিছু লিখিতে আমরা অনুরুদ্ধ হইয়াছি। ...... আমরা সাধনা সম্বন্ধে খুব উচ্চ আশা হৃদয়ে পোষণ করিয়াছিলাম এবং তাহা নব্যভারতে ব্যক্তও করিয়াছিলাম, কিন্তু সম্বৎসর পরে, ধীরে এবং নিরপেক্ষভাবে সাধনার চালচলতি নিরীক্ষণ করিয়া আমাদিগকে কিছু নিরাশ হইতে হইয়াছে। আমরা একদিন পরম শ্রদ্ধেয়, সাহিত্যক্ষেত্রের সর্ব্বাগ্রজ তীক্ষ্ণ প্রতিভাশালী শ্রীযুক্ত বঙ্কিম বাবুর সহিত সাক্ষাৎ করিতে গিয়াছিলাম। নানা কথার প্রসঙ্গে তিনি বলিয়াছিলেন, “বঙ্গদর্শন, প্রচার ও নবজীবন আমাদের বহু যত্নের ফল, কিন্তু একটানা সুরে সাধা ছিল বলিয়া স্থায়ী হইল না।” সাধনাও একটানা সুরে সাধা। এক ব্যক্তি যতই প্রতিভাশালী হউন না কেন; প্রতিমাসে বহু প্রবন্ধ লিখিলেই, তাঁহাকে একটানা ভাবে চলিতে হইবে। মাসিক কাগজে বিভিন্ন মতাবলম্বী যত বহু লোকের লেখা থাকিবে, ততই সাধারণের আদরের জিনিস হইবে বলিয়া আমাদের বিশ্বাস। সাধনায় একা রবীন্দ্রনাথ লিখিবেন, অর্দ্ধেক কিংবা ততোধিক প্রবন্ধ, ইহাতে যে সাধনা একটানা সুরে সাধা হইবে, আশ্চর্য কি ? পত্রিকাখানি মনোযোগ সহকারে পাঠ করিলে বুঝা যায়, এ যেন এক জনেরই কাগজ। “রবীন্দ্র বাবুর মাসিক প্রবন্ধ ও গল্প” নাম সাধনাকে দিলে যে খুব অন্যায় হয়, আমাদের বোধ হয় না। সাধনার এ দোষ সংশোধিত হয়, আমরা সর্বান্তকরণে প্রার্থনা করি।” ...... (‘নব্যভারত’ ১২৯৯ অগ্রহায়ণ)।
“...... ইহা ঠাকুরদের সখের জিনিস। ইহাতে সর্ব্বসাধারণের প্রয়োজন সিদ্ধ কি পরিমাণে হয়, ঠিক বলা যায় না। সাধনার প্রবর্তক শ্রীমান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথ বাবুর আত্মম্ভরিতার মাত্রার বাড়াবাড়ি না হইলে পত্রিকা সমাজের বিশেষ উপকারিণী হইত। ইহার আবির্ভাবে উপকার হইয়াছে।” (‘নব্যভারত’ ১২৯৯ চৈত্র)।
অবশেষে চতুর্থ বর্ষে সম্পাদক পদে রবীন্দ্রনাথ নিজের নামই প্রকাশ করলেন। এ প্রসঙ্গে ‘সাধনা’র তৃতীয় বর্ষের শেষে মুদ্রিত “বিজ্ঞাপনে” বিদায়ী সম্পাদক সুধীন্দ্রনাথ ঠাকুর “সাধনার তৃতীয় বর্ষ পূর্ণ হইল” শিরোনামে লিখেছেন -
“ আমরা কিয়ৎপরিমাণেও সিদ্ধিলাভ করিয়াছি কি না জানি না। কিন্তু এ কথা গোপন করিবার আবশ্যক দেখি না, যে, যে পরিমাণ জনাদর প্রাপ্ত হইলে বহুব্যয়সাধ্য ‘সাধনা’ স্বচ্ছন্দে স্থায়িত্বলাভ করিতে পারিত তাহা ‘সাধনার’ অদৃষ্টে ঘটে নাই। তাহাতে হয় ত আমাদের অক্ষমতা অথবা দুর্ভাগ্য উভয়েই প্রকাশ পাইতেছে।
“ আমাদের একটি উৎসাহের কারণ এই আছে যে, আমরা অনেক কৃতবিদ্য পাঠক লাভ করিয়াছি এবং সাধনার প্রতি তাঁহাদের যথেষ্ট অনুরাগ আছে। তবু যে, সাধনার আর্থিক অবস্থার অস্বচ্ছলতা ঘটিয়াছে সে কেবল সাধনার অনুষ্ঠাতাগণের বিবেচনার দোষে তাহাতে সন্দেহ নাই। বাঙ্গালা দেশের কোন সাময়িক পত্রের এতাদৃশ ব্যয়বাহুল্য করা উচিত হয় না।
“ পত্রিকার স্থায়িত্বের প্রতি দৃষ্টি রাখিয়া আগামী বৎসর হইতে সাধনার সাইজ রয়াল করা হইবে - এবং কাগজের ভার লাঘব করিয়া যাহাতে দুই পয়সা মাশুল যায় তাহার ব্যবস্থা করা যাইবে। আগামী বৎসর হইতে পত্রিকার মূল্য ডাকমাশুল সমেত তিনটাকা স্থির হইল। এক্ষণে গ্রাহকগণকে ডাকমাশুল সমেত দুই টাকা বার আনা দিতে হইতেছে তাহার উপর কেবল চারি আনা মূল্য বৃদ্ধি হইল।
“ যোগ্যতর হস্তে সম্পাদকীয় কার্য্যভার ন্যস্ত করিয়া আমি অবসর গ্রহন করিলাম - সম্পাদকীয় কর্তব্য সাধনে যে সকল ত্রুটি ঘটিয়াছে তজ্জন্য পাঠকদের নিকট ক্ষমাপ্রার্থণা করি।
ইতি
সুধীন্দ্রনাথ ঠাকুর
১৬ই আশ্বিন, ১৩০১ সাল।”
আনুষ্ঠানিক ভাবে সম্পাদক হবার পর রবীন্দ্রনাথ কি মানসিক ভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন? সাধনার কাজে তিনি কি আর আনন্দ পাচ্ছিলেন না? একটা সময়ে নানা বৈপরীত্যে তিনি হয় ত পীড়িত হয়েছিলেন। ১৮৯৫-এর ১৪ই জানুয়ারির চিঠিতে লিখেছেন -
“অল্প অল্প করে বসন্ত পড়বার উপক্রম করছে। কাল সমস্ত দিন বেশ গরম পড়েছিল - কাজকর্মে মন লাগছিল না, সমস্ত দিনটা একরকম উদভ্রান্তের মধ্যে ঘুরে ঘুরে কাটিয়ে দেওয়া গেছে। .... এত দিন শীত ছিল, কাজের উৎসাহ ছিল - মনে করতুম সারা জীবন সাধনার এডিটরি করে কাটিয়ে দেব। এখন একটু গরম হাওয়া পড়বা মাত্রই মনে হচ্ছে, এডিটরি করার চেয়ে আমি সেই যে কবি ছিলুম সে ছিলুম ভাল। ......”
যতদিন এগিয়েছে, রবীন্দ্রনাথের ‘সাধনা’ চালিয়ে যাবার উৎসাহে ভাঁটা পড়েছে। পত্রিকা চালানো ত শুধু লেখা নয়, অন্যের লেখা পরিমার্জন ও সংশোধন করা, প্রুফ দেখা, চিঠিপত্র লেখা, হিসাবপত্র দেখাশোনা করা ইত্যাদি নিয়ম মাফিক কাজে তিনি যেন হাঁপিয়ে উঠেছিলেন। তার উন্মুক্ত মন ও বাঁধনহীন চিন্তা একটি নির্দিষ্ট কাজের সীমিত গণ্ডীর বদ্ধ প্রাকার থেকে মুক্তি পেতে যেন আকুল হয়ে উঠেছিল। এই ইচ্ছা তার লেখা বিভিন্ন চিঠিপত্রে ফুটে উঠেছে। ১৮৯৪-এর ২৬ শে জুন তিনি লিখেছেন -
“আজকাল আমার নিজের কতবার ইচ্ছে করে যে কোনোমতে নির্জন নিঃশব্দ খ্যাতিহীনতার
অথবা -
“ ..... এখন সাধনার জন্য লিখতে লিখতে অন্যমনস্ক হয়ে যাই, বাইরে যা-কিছু ঘটে তাতেই আমার মনকে আকর্ষণ করে নেয় ....” ( ২৩ ফেব্রুয়ারি, ১৮৯৫)।
১৮৯৫ ৩রা অগাষ্ট কলকাতা থেকে লেখা চিঠির অংশ -
“.... কিন্তু দিন দিন যতই আমার খ্যাতি বাড়ছে ততই একদিকে আমি খুশি হচ্ছি অন্য দিকে সব ছেড়েছুড়ে লোকের ভিড় ঠেলেঠুলে নিজের যথার্থ প্রাইভেট বাসস্থানের নিভৃত কোণে ঢোকবার প্রবল ইচ্ছা বোধ হচ্ছে। সাধনায় প্রতিমাসে লোকচক্ষে নিজের নামটার পুনরাবৃত্তি করতে একেবারে বিরক্ত ধরে গেছে। আমি এটা বেশ বুঝতে পারছি খ্যাতি জিনিসটা ভালো নয়-ওতে অন্তরাত্মার কিছুমাত্র ক্ষুধানিবৃত্তি হয় না, কেবল তৃষ্ণা বেড়ে ওঠে।”
১৩০২ বঙ্গাব্দের ভাদ্র-আশ্বিন-কার্তিক একসঙ্গে প্রকাশিত হয়ে ‘সাধনা’র প্রকাশ বন্ধ হয়ে যায়। ১৮৯৫-এর ৬ই অক্টোবর কবি লিখেছেন –
“এখন প্রায় মাঝে মাঝে মনে করি সাধনা, ত্রৈমাসিক এবং মাসিক, এই পদ্মার জলে ভাসিয়ে দিয়ে যাব।”
এখানে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উল্লেখ করা প্রয়োজন, সেটি হ’ল রবীন্দ্রনাথকে জমিদারীর কাজ দেখাশোনায় অত্যন্ত ব্যস্ত থাকতে হয়েছে। মাঝে মাঝে এই ব্যস্ততা অতিমাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রায়ই তাকে শান্তিনিকেতন ছেড়ে বেরিয়ে যেতে হয়েছে। এতে শারীরিক ও মানসিক দু’দিক দিয়েই তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন।
রবীন্দ্রনাথের সম্পাদনাকালে কার্যাধ্যক্ষ ছিলেন বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি মাঝে মাঝে নিয়মাবলী প্রকাশ করেছেন – “পত্রিকার মূল্য বার্ষিক তিন টাকা। ডাকমাশুল লাগে না, প্রতি মসের ১৫ তারিখ সাধনা বাহির হয়, প্রবন্ধ মনোনীত না হইলে আমরা ফেরত দিতে বাধ্য নহি” ইত্যাদি। কার্যাধ্যক্ষের ঠিকানা – “৬নং দ্বারাকানাথ ঠাকুরের গলি, জোড়াসাঁকো, কলিকাতা। কলিকাতা, আদি ব্রাহ্মসমাজ যন্ত্রে শ্রীকালিদাস চক্রবর্ত্তীর দ্বারা মুদ্রিত ও প্রকাশিত।”
একটি বিষয়ের উল্লেখ করতেই হয়। ‘সাধনা’র প্রতি পৃষ্ঠার উপরে কোন বছর বা মাসের উল্লেখ থাকত না। এর ফলে, কোন কারণে প্রথম পাতাটি বিনষ্ট হয়ে গেলে বাকি পৃষ্ঠাগুলি যে কোন বছরের কোন সংখ্যার তার দিশা পাওয়া শক্ত হত। তখন বেশ কিছু পত্রিকায় এই রীতি দেখা গেলেও রবীন্দ্রনাথের সম্পাদনায় প্রকাশিত পত্রিকায় এটা কি করে ঘটল সেটাই বিস্ময়কর।
১৩২৪-এর বৈশাখে ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকায় ‘সাহিত্য-প্রসঙ্গ’ শীর্ষক প্রবন্ধে ঠাকুরদাস মুখোপাধ্যায়কে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠির একাংশ –
“সাধনার সাইজ ও কাগজ কমানো সম্বন্ধে অনেক হিতৈষী বন্ধু আপত্তি করাতে অবশেষে তাহাদের অনুরোধ পালন করিতে স্বীকার হইয়াছি। ইহা হইতে বুঝিতে হইবে সাধনার কোষ্ঠীতে ব্যয়ের ঘরে এ বৎসরেও শনির দৃষ্টি আছে, আয়ের ঘরে যদি রাহু থাকেন তাহলে মৃত্যু অতি সন্নিকট। যাহা হউক এ বৎসরটা পরীক্ষা করিয়া দেখিয়া যদি আবশ্যক বোধ করি ত আগামী বৎসরে ব্যয়সংক্ষেপের চেষ্টা করিব। পূর্ব্বের ন্যায় ব্যয়বাহুল্য রহিল বলিয়া আপনাকে সাধনার সম্পাদক পদে নিয়মিত নিযুক্ত করিতে সাহস করিলাম না। আপনি প্রবন্ধ-প্রতি কিরূপ মূল্য গ্রহণ করিতে পারেন আমাকে জানাইবেন – অনুগ্রহ পূর্ব্বক কিছুমাত্র সংকোচ করিবেন না। আগামী বৎসর হইতে সাধনায় কোন লেখকের নাম থাকিবে না।”
চতুর্থ বছরে রবীন্দ্রনাথ কেন লেখকদের নাম বাদ দিয়েছেন তার কোন উল্লেখ নেই, হতে পারে ঘুরে ফিরে সেই কয়েক জনের নাম তিনি আর পাঠক সমাজের সামনে আনতে চাইছিলেন না।
‘সাহিত্য’ ১৩০২ কার্ত্তিকে ‘সাধনা’র শেষ সংখ্যা (ভাদ্র-আশ্বিন-কার্ত্তিক সম্মিলিত সংখ্যা) সম্বন্ধে লেখা হয়েছে –
“পাঠকগণ বিজ্ঞাপনে দেখিবেন, ‘সাধনা’ অতঃপর আর প্রকাশিত হইবে না। সাহিত্য সংসারে সুপ্রসিদ্ধ শ্রীযুত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয় সম্পাদক হইয়া সাধনাকে সিদ্ধির পথে আনিয়াছিলেন। তাহার পর ‘সাধনা’ ত্রৈমাসিক হইতেছে শুনিয়া আমরা মনে করিয়াছিলাম যে, বাঙ্গালা সাহিত্যের একটি গুরুতর অভাব পূর্ণ হইবে। কিন্তু সহসা ‘সাধনা’র বিলোপ হইল দেখিয়া আমরা অত্যন্ত দুঃখিত হইয়াছি। ‘সাধনা’ বিলুপ্ত হইল কেন, তাহার কোনো কারণ সাধারণের নিকট প্রকাশ হয় নাই। তথাপি মনে হয় বাঙ্গালী পাঠকের সম্পূর্ণ সহানুভূতি পাইলে ‘সাধনা’ বিলুপ্ত হইত না। যে দেশে সাধনার মত উচ্চ শ্রেণীর মাসিকও বিলুপ্ত হইবার অবকাশ পায়, সে দেশ নিশ্চয়ই অত্যন্ত দুর্ভাগ্য।”
লক্ষণীয় যে, যে ‘সাহিত্য’ পত্রিকা বহু ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের লেখার বিরূপ সমালোচনা প্রকাশ করেছে, সেই সেটাই ‘সাধনা’কে একটি উচ্চাঙ্গের পত্রিকা হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং পত্রিকাটির বিলুপ্তি যে সাহিত্যক্ষেত্রে কাম্য নয় সেটাও দ্বিধাহীন ভাবে উচ্চারিত হয়েছে।
স্বল্প কালের জন্য স্থায়ী হলেও সাময়িক পত্রের ইতিহাসে ‘সাধনা’ অবশ্যই একটি উচ্চাঙ্গের মাসিক পত্রিকা হিসাবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।
প্রতিলিপি পরিচয় –
চিত্র ১ ও ২ : সুধীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ সম্পাদিত ‘সাধনা’র দু’টি আখ্যাপত্র।
চিত্র ৩ : পত্রিকায় প্রকাশিত একটি বিজ্ঞাপন।
চিত্র ১ - সুধীন্দ্রনাথ সম্পাদিত ‘সাধনা’র আখ্যাপত্র।
চিত্র ২ - রবীন্দ্রনাথ সম্পাদিত ‘সাধনা’র আখ্যানপত্র।
চিত্র ৩ : পত্রিকায় প্রকাশিত একটি বিজ্ঞাপন।
লেখক পরিচিতি : বহু বছর বি.ই. কলেজে (এখন ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, শিবপুর ( IIEST,shibpur )) অধ্যাপনা করেছেন। কিছুদিন হল অবসর নিয়েএখন সেখানে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে আছেন। অ্যাপ্লায়েড মেকানিক্স নিয়ে গবেষণা করলেও একাধিক বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে - জ্যোতিষশাস্ত্র, পুরনো কলকাতার সংস্কৃতি, ইত্যাদি। অবসর সময়ে 'অবসরে'র সঙ্গে সময় কাটান।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।