পুরানো সাময়িকী ও সংবাদপত্র
মার্চ ১, ২০১৬
সখা
দীপক সেনগুপ্ত
ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই ছোট ছেলেমেয়েদের জ্ঞানবৃদ্ধি ও নীতিনিষ্ঠ করে তুলতে বেশ কয়েকটি পত্রিকার প্রকাশ ঘটে| এদের মধ্যে রয়েছে ‘দিগ্দর্শন’ (১৮১৮), ‘পশ্বাবলী’ (১৮২২), ‘জ্ঞানোদয়’ (১৮৩১), ‘বিদ্যাদর্পণ’ (১৮৫৩), ‘সত্যপ্রদীপ’ (১৮৬০), ‘অবোধবন্ধু’ (১৮৬৩), ‘জ্যোতিরিঙ্গণ’ (১৮৬৯), ‘বালকবন্ধু’; (১৮৭৮) প্রভৃতি| এসব পত্রিকায় বালক-বালিকাদের উপযুক্ত লেখা প্রকাশিত হলেও মাঝে মাঝে প্রাপ্তবয়স্কদের উপযোগী রচনাও স্থান পেত| গুরু গম্ভীর ভাষাও সব সময়ে ছোটদের কতটা আকৃষ্ট করত বলা শক্ত| এসব ঘাটতি কাটিয়ে উঠে ১৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দের ১লা জানুয়ারি প্রমদাচরণ সেনের সম্পাদনায় আত্মপ্রকাশ করে ছোটদের পূর্ণাঙ্গ মাসিক পত্রিকা ‘সখা’| ছোটদের উপযোগী একটি পত্রিকা প্রকাশের ইচ্ছা প্রমদাচরণের বহুদিন থেকেই ছিল। এর জন্য তিনি প্রাণপাত করেছেন। পত্রিকার প্রাণপুরুষ প্রমদাচরণের সঙ্গে একটু পরিচিত হওয়া যাক। ১৮৫৯ সালের ১৮ই মে কলকাতার এন্টালীতে তার জন্ম। বাবা ছিলেন এন্টালী থানার দারোগা। যশোহর জেলার সেনহাটি গ্রামের পাঠশালায় শিক্ষা জীবনের শুরু। পড়াশোনায় মন তেমন ছিল না। অত্যন্ত দুরন্ত ও ডানপিটে ধরণের হওয়ায় প্রায়ই শিক্ষক ও গুরুজনদের শাসনের মুখে পড়তে হয়েছে। মাত্র সাত বছর বয়সে মাতৃহারা হয়ে প্রমদাচরণ চিরদিনের জন্য মাতৃসুখ থেকে বঞ্চিত হন। ১৮৭২ সালে কলকাতায় এসে হেয়ার স্কুলে ভর্তি হন প্রমদাচরণ। তিনি শিক্ষক শিবনাথ শাস্ত্রীর খুব প্রিয় ছিলেন। শিবনাথ তার ‘আত্মচরিত’ গ্রন্থে লিখেছেন –
“প্রমদা হেয়ার স্কুলে আমার কাছে পড়িত এবং সে সময়ে আমি ছাত্রদিগকে লইয়া যে সমস্ত সভা-সমিতি করিতাম তাহাতে উপস্থিত থাকিত। সেই সময় হইতে সে আমাকে পিতার ন্যায় ভালবাসিত এবং সর্ব্ববিষয়ে আমার অনুসরণ করিত। ধর্ম্মপুত্র কথাটি যদি কাহারও প্রতি খাটা উচিত হয়, তাহা হইলে বলা যায় যে প্রমদা আমার ধর্ম্মপুত্র ছিল।”
দুর্ভিক্ষ নিপীড়িত মানুষের সাহায্যার্থে শিবনাথের আদেশে প্রমদাচরণ একবার চার’শ টাকা চাঁদা তুলে দিয়েছিলেন। তার গঠন মূলক শক্তির এ থেকেই পরিচয় মেলে। প্রমদাচরণ ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হওয়ায় পিতা ত্যাজ্যপুত্র করে কলেজে পড়ার খরচ বন্ধ করে দিলেন। এ সময়ে ব্রাহ্মসমাজের গগনচন্দ্র হোম, উপেন্দ্রকিশোর রায়, কালীপ্রসন্ন দাস প্রমুখ ব্যক্তির সঙ্গে তিনি পরিচিত হন। ইচ্ছা ছিল ইউরোপে গিয়ে উচ্চশিক্ষা লাভ করেন, কিন্তু তার সে ইচ্ছা ফলপ্রসূ হয় নি। নানা কারণে বি.এ. পরীক্ষা দেওয়া হয় নি। এর পর তিনি সিটি কলেজিয়েট স্কুলে অতিরিক্ত শিক্ষকের পদ গ্রহণ করেন। বিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে তার ছিল অত্যন্ত স্নেহের সম্পর্ক। শোনা যায় একজন খ্যাতনামা শিরোস্তত্ত্ববিদ প্রমদাচরণের মস্তক পরীক্ষা করে বলেছিলেন যে তিনি শিশুদের প্রতি অত্যন্ত স্নেহপ্রবণ হবেন। তার সেই বাৎসল্য রসই ‘সখা’ সৃষ্টির প্রেরণা। ছোটদের নিয়ে এক শিক্ষামূলক ভ্রমণে গিয়ে বরানগরের এক বাগান বাড়িতে প্রমদাচরণ পত্রিকা প্রকাশের ইচ্ছা ব্যক্ত করেন।
‘সখা’ বের করার পরিকল্পনা ত হ’ল, কিন্তু পত্রিকা প্রকাশ করতে অর্থের প্রয়োজন। ধনী বন্ধুদের কাছে অর্থ প্রার্থনা করে প্রত্যাখ্যাত হলেও তিনি নিরাশ হন নি। নিজের সামান্য রোজগার থেকে কিছু অর্থ জমিয়ে রেখে, কিছু ঋণ করে পত্রিকা প্রকাশের লক্ষ্যে অবিচল থাকেন। তার স্বপ্ন সফল হয় ১৮৮৩ সালের ১লা জানুয়ারি। এ দিনই তিনি ‘সখা’র প্রথম সংখ্যা ছোটদের হাতে তুলে দেন। কিন্তু তার আনন্দ বেশি দিন স্থায়ী হয় নি। টাকার সংস্থান করতে অর্ধাহারে অনাহারে এবং কঠিন পরিশ্রমে তার শরীর ক্রমশ: রুগ্ন হয়ে পড়ে এবং শেষে সেকালের প্রাণঘাতী রোগ যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে ১৮৮৫ সালের ২১শে জুন মাত্র ছাব্বিশ বছর বয়সে খুলনায় দাদার বাড়িতে প্রমদাচরণ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। অধ্যবসায়ী পরিশ্রমী আত্ম বিষয়ে উদাসীন এক শিশুবৎসল যুবকের জীবন এ ভাবেই অকালে ঝরে পড়ে। মৃত্যুর পর শিবনাথ শাস্ত্রী (পত্রিকার পরবর্তী সম্পাদক) তার প্রিয় ছাত্র অকালপ্রয়াত প্রমদাচরণের স্মৃতিচারণ করে ১৮৮৫-র জুলাই সংখ্যায় লিখেছেন –
“এই ‘সখা’র জন্য তিনি কত খাটিয়াছিলেন, আমরা স্বচক্ষে দেখিয়াছি। না খাইয়াও ইহার জন্য টাকা জমান, রাত্রি জাগিয়া পড়া, ইহার ছবি যোগাড় করিবার জন্য ঘুরিয়া বেড়ান, এই করিতে করিতে তাঁহার শরীর শীর্ণ হইয়া গিয়াছিল। এই ‘সখা’ তিনি যখন বাহির করিলেন তখন অনেকে তাঁহাকে বলিয়াছিলেন যে, এ কাগজ টেকিবে না, ইহা চালাইলে ক্ষতি হইবে, এ কাগজ ভাল হইবে না, এমন কি তাঁহার অনেক বন্ধু বান্ধবে তাঁহাকে নিরাশ করিয়াছিলেন; কিন্তু তিনি যে কাজ ভাল বলিয়া বুঝিতেন তাহা সহজে ছাড়িতেন না। তিনি কাহারও কথায় ভয় না পাইয়া ইহার উন্নতির জন্য মন প্রাণ সমর্পণ করিলেন এবং অবশেষে উন্নতি করিয়া তুলিলেন।”
তবে সৃষ্টিকর্তা স্বল্পজীবী হলেও প্রমদাচরণের ‘সখা’ কিন্তু ছোটদের জন্য প্রকাশিত প্রথম সর্বাঙ্গসুন্দর ও আদর্শ পত্রিকা হিসাবে চিরকাল সাহিত্যাকাশে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। ‘সন্দেশ’ পত্রিকার রূপকার উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীকে প্রমদাচরণই আবিষ্কার করেন এবং তাঁকে লিখতে উৎসাহিত করেন। তার বহু লেখা ‘সখা’য় প্রকাশিত হয়েছে। তার প্রথম লেখা ‘মাছি’ ‘অবসরে’ নির্বাচিত রচনা সংগ্রহে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
‘সখা’ যখন প্রকাশিত হয়, সরলাদেবী চৌধুরাণী তখন নিতান্তই বালিকা। পরবর্তী কালে তিনি ‘জীবনের ঝরাপাতা’ গ্রন্থে স্মৃতি রোমন্থন করেছেন –
“সে সময় ‘সখা’ নামে বালকবালিকাদের জন্যে মাসিক পত্রিকার একটি কবিতা প্রতিযোগিতা ঘোষিত হল। মা উৎসাহ দেওয়ায় আমি সেই প্রতিযোগিতার জন্যে দাঁড়ালুম। নির্দিষ্ট বিষয়ে কবিতা রচনা করে সখা-অফিসে পাঠিয়ে দিলুম। ফার্স্ট আমিই হলুম, প্রাইজ পেলুম একখানা ইংরেজি ‘ক্লাসিকাল ডিকশনারি’, যত প্রাচীন গ্রীক ও রোমান মাইথলজির। প্রকাশ্যে রচনায় এই আমার হাতে খড়ি। ...... ‘সখা’ আমাদের সত্যিকার সখা ছিল তখন। দুপুরবেলা ঘরের ভিতর বিশ্রাম করতে করতে তার সব রচনা পড়ে পড়ে আমায় রচনা চাপল। দুতিন দিন ধরে অন্যদের লুকিয়ে দু-একটা ছোট গল্প লিখলুম।”
‘সখা’ হয় ত এরকম আরও অনেককে লিখতে প্রবুদ্ধ করেছে।
‘সখা’র বার্ষিক মূল্য ধার্য হয়েছিল একটাকা; প্রকাশিত হত ৫০ সীতারাম ঘোষ স্ট্রিট থেকে| মুদ্রণ কার্য সম্পন্ন হত ব্রাহ্মসমাজ যন্ত্রে, ৮১ নং বারাণসী ঘোষ স্ট্রীটে| ছোটদের উচ্চ আদর্শ বোধে উদ্দীপ্ত করার লক্ষ্যে প্রমোদাচরণ ‘সখা’ প্রকাশ করার পরিকল্পনা করেছিলেন| প্রথম ভাগ ( প্রথম বর্ষ ) প্রথম সংখ্যার শুরুতেই ‘প্রস্তাবনা’ অংশে প্রমদাচরণ ‘সখা’ প্রকাশের উদ্দেশ্য স্পষ্ট করেছেন :
“এতদিন পরে ‘সখা’ প্রকাশিত হইতে চলিল| এইরূপ পত্রিকা আমাদের দেশে নাই বলিয়াই আমরা এই পত্রিকাখানি প্রকাশ করিবার ইচ্ছা করিয়াছিলাম| আমাদিগের হতভাগ্য দেশে বালকবালিকাদিগের জ্ঞানের ও চরিত্রের উন্নতির জন্য অধিক লোক চিন্তা করেন না; অথবা করিবার অবকাশ হয় না, এই জন্যই ‘সখা’র জন্ম হইল| ‘সখা’ পিতামাতার উপদেশ ও শিক্ষকদের শিক্ষা দুইই প্রদান করিবে| যাহাতে বালকবালিকারা বাস্তবিক মানুষ হইতে পারেন, তজ্জন্য ‘সখা’র লেখক ও লেখিকাগণ প্রাণপণে চেষ্টা করিবেন - ফলত: যাহাতে পত্রিকাখানির ‘সখা’ এইনাম সার্থক হয়, সে দিকে সকলেরই দৃষ্টি থাকিবে।”
উদ্দেশ্য খুবই স্পষ্ট; এবং সখা পড়ার পর যদি কারো মনে কোনো প্রশ্ন দেখা দেয়, তার উত্তর দেবার চেষ্টাও সম্পাদক করেছেন| কোন বিষয় নিয়ে মতামত লিখবার ব্যবস্থাও ছিল| ‘প্রস্তাবনা’ অংশে এ প্রসঙ্গে লেখা হয়েছে :
“বালকবালিকাদিগের নিকটেও আমাদের একটি নিবেদন আছে; তাঁহারা যদি তাঁহাদের যখন যে কোন বিষয় জানিবার ইচ্ছা হয়, আমাদিগকে জিজ্ঞাসা করিতে পারেন, তাহা হইলে আমরা প্রত্যেক বিষয়ে যতদূর সম্ভব সদুত্তর দিতে চেষ্টা করিব| ইহাতে বালকবালিকাদিগের উপকার হইবার সম্ভাবনা| তাঁহাদের নিকট আরও একটি কথা এই যে, তাঁহাদের রচনাশক্তি এবং চিন্তাশক্তি বাড়াইবার জন্য আগামী মাস হইতে এই পত্রিকার মধ্যে খানিকটা স্থান নির্দ্দিষ্ট থাকিবে; তাঁহারা ইচ্ছা করিলে যে কোন বিষয়ে আলোচনা করিতে পারিবেন।”
লেখা বা ধাঁধার উত্তরদানের উপর নির্ভর করে পুরস্কারের ব্যবস্থাও করা হয়েছিল| এ বিষয়ে সরলা দেবী চৌধুরাণীর কথা আগেই বলা হয়েছে।
‘সন্দেশ’ খ্যাত উপেন্দ্রকিশোরের সাহিত্যিক হিসাবে গড়ে উঠতে প্রমোদাচরণ ও তার ‘সখা’র অবদান অনেকখানি| ‘সখা’য় ধাঁধা ও সংক্ষিপ্ত গ্রন্থ সমালোচনাও ছাপা হত| ধাঁধার উত্তরও দিয়ে দেওয়া হত| অনেক গল্প ও কবিতার মধ্য দিয়ে অনেক নীতিকথা ও শিক্ষণীয় বিষয়গুলি মনের মধ্যে গেঁথে দেবার চেষ্টা করা হত| উপেন্দ্রকিশোর ছাড়া কবি কামিনী রায় (পূর্বে কামিনী সেন), বিপিন চন্দ্র পাল, মন্মথনাথ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ লেখকেরা নিয়মিত লিখতেন| ‘সখা’র বার্ষিক মূল্য ছিল এক টাকা; মফঃস্বলে স্বতন্ত্র ডাকমাশুল লাগবেনা বলে জানান হয়েছে| প্রথম সংখ্যায় লেখা বেরিয়েছিল – ‘প্রস্তাবনা’ (সম্পাদক প্রমদাচরণ সেন), ‘ভীমের কপাল’ (প্রমদাচরণ সেন), ‘আঃ ছেড়ে দাও না!’ (কবিতা সচিত্র, প্রমদাচরণ সেন), ‘সতীশ এবং তাহার সঙ্গী’ (প্রমদাচরণ সেন), ‘ঊষা’ (কবিতা, প্রমদাচরণ সেন), ‘ক্রীষ্টাল প্যালেস বা স্ফটিক প্রাসাদ পরিদর্শন’ (কুমারী টিশিমেকার), ‘মহাত্মা হেয়ার সাহেব’ (প্রমদাচরণ সেন), ‘মেয়েরা আমাদের কে?’ (প্রমদাচরণ সেন), ‘বৃষ্টি’ (প্রমদাচরণ সেন), ‘ধাঁধা’, ‘সখা সংক্রান্ত নিয়মাবলী’| হয় ত প্রথম সংখ্যার জন্য যথেষ্ট লেখা যোগাড় করা যায় নি বলে অনেক লেখা সম্পাদক নিজেই লিখেছেন| অনেকে লিখেছেন যে ‘সখা’ পত্রিকাতেই সর্ব প্রথম ‘Drop Letter’ পদ্ধতি চালু হয়; কিন্তু এটা ঠিক নয়। ১৮৫১ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত ‘বিবিধার্থ সংগ্রহ’ পত্রিকাতেও এই রীতি ব্যবহৃত হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে ‘বিবিধার্থ সংগ্রহে’ লেখা হয়েছে।
সেকালের অনেক পত্রিকার মতই রচনার শেষে লেখকের নাম দেওয়া হত না, তবে সূচীপত্রে কিন্তু নাম থাকত। লেখার শেষে লেখকের নাম না থাকার কারণ ব্যাখ্যা করা হয়েছে ১৮৮৩-র এপ্রিল সংখ্যায় ‘পত্রপ্রেরকদের প্রতি’ বিভাগে ধুলজুরি থেকে প্রেরিত জনৈক তারাপ্রসন্ন বসুর চিঠির উত্তর দিতে গিয়ে। বলা হয়েছে – “আপনার উৎসাহ পূর্ণ পত্রের জন্য ধন্যবাদ। সখার লেখকদিগের মধ্যে অনেকেই সুপরিচিত নহেন, কাজেই নাম প্রকাশ করা হয় নাই; যাহা হউক, যদি জানিতে ইচ্ছা করেন, সখার আগামী কোন সংখ্যায় তাহাদের নাম প্রকাশ করা যাইতে পারে।” সম্ভবত: একই কারণে অনেক পত্রিকাতেই রচনার শেষে লেখকের নাম থাকত না। সূচীপত্রে যাদের নাম প্রকাশিত হয়েছে, সেকালের রীতি মেনেই তাদের অনেকের নামের পাশে শিক্ষাগত যোগ্যতাও মুদ্রিত হয়েছে।
প্রথম বছরের জুন সংখ্যা থেকেই ‘শিশু-স্বাস্থ্যরক্ষা’ শীর্ষক একটি ধারাবাহিক প্রকাশিত হতে থাকে, লেখক প্যারীশঙ্কর দাস গুপ্ত এল.এম.এস.। ছোটদের স্বাস্থ্য সচেতন করে তুলতে এ প্রচেষ্টা অবশ্যই অভিনন্দন যোগ্য। প্রথম কিস্তিতে ‘উপক্রমণিকা’ অংশে লেখক লিখেছেন – “বালক বালিকাগণ! শরীররক্ষা ও বিদ্যাশিক্ষাই তোমাদিগের প্রধান কর্ত্তব্য কর্ম্ম। এই দুয়ের মধ্যে যেটিকে অবহেলা করিবে, তজ্জন্যই ইহার পর ক্লেশ পাইতে হইবে।......।” জুন সংখ্যাতেই স্বয়ং প্রমদাচরণ ‘বালিকাদিগের বিশেষ পৃষ্ঠা’ শিরোনামে মেয়েদের ‘পোষাক’ নিয়ে লিখেছেন –
“বালিকাদিগের কিরূপ পোষাক হওয়া উচিত এই বিষয়ে আমাদিগকে কেহ কেহ ‘সখা’য় লিখিতে বলিয়াছেন। আমরা এই সম্বন্ধে আমাদের যাহা বলিবার আছে বলিব।
“অনেক স্থানে দেখিয়াছি মেয়েরা এমন পোষাক পরেন যে সমস্ত শরীর দেখা যায়, কিন্তু তবুও তাঁহাদের লজ্জা হয় না, কেননা এইরূপ সরু কাপড়ের দাম অনেক, এবং কাজেই এই সকল কাপড় পরিয়া নিমন্ত্রণে যাওয়া উচিত! পাতলা কাপড় পরিলে যে ভদ্রসমাজে লোকে লজ্জায় মুখ ফিরায় তাহা এই সকল মেয়েদের মনে থাকে না। তাঁহাদিগকে এই কথা বলিলে, তাঁহারা মুখে হাত দিয়া বলেন “ওমা! পোষাকী কাপড় পরিব, তায় আবার লজ্জা কি!” আমরা এরূপ কথার উত্তর দিতে পারি না। আমাদিগের বিবেচনায় পোষাকী কাপড় পাতলা হইলে, তাহা শক্ত করিয়া দুফের দিয়া পরা উচিত, এবং পরিবার কাপড় পাতলাই হউক আর পুরুই হউক, দশজনের কাছে যাইতে হইলে সর্ব্বদা একটি জামা গায়ে থাকা উচিত। যদি সুবিধা হয় তাহা হইলে হাটুর নীচে পর্য্যন্ত লম্বা, এবং হাতকাটা (কুনই পর্য্যন্ত) একটা জামা পরিয়া তাহার উপরে কাপড় পরিলে বড়ই ভাল হয়।”
পোষাক নিয়ে এখনও যে মাঝে মাঝে বাদানুবাদ হয়, সে প্রেক্ষিতে আজ থেকে প্রায় একশ ত্রিশ বছর আগে সম্পাদকের এই বীক্ষণ ও মতামত প্রণিধানযোগ্য।
‘সখা’র প্রথম সংখ্যার আখ্যাপত্রের যে প্রতিলিপি এই লেখার শেষে দেওয়া হয়েছে, তাতে লেখা রয়েছে ‘দ্বিতীয় সংস্করণ’ এবং বছর লেখা হয়েছে ১৮৮৪, যদিও পত্রিকার প্রকাশ ১৮৮৩ সালের জানুয়ারি মাসে। সহজেই অনুমেয়, ‘সখা’ প্রকাশের কিছু পরেই সব কপি নিঃশেষিত হয়ে যায় এবং দ্বিতীয় বার মুদ্রণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। পত্রিকাটি যে পাঠক মনে কি অভূতপূর্ব সাড়া তুলেছিল এটাই তার প্রমাণ। শুধু ছোটরা নয়, বড়রাও এগিয়ে এসেছে সহযোগিতা করতে। প্রথম বছরেই মে মাসে ‘নূতন বৎসরের সুখবর’ নামক একটি বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়। সেটি ছিল –
“সখার পাঠক পাঠিকাগণ শুনিয়া সুখী হইবেন যে আমাদিগের কোন বন্ধুর স্ত্রী ইচ্ছা করিয়াছেন সখার পাঠক পাঠিকাদিগের উৎসাহের জন্য কিছু পুরস্কার দিবেন। তিনি এ সম্বন্ধে আমাদের যে পত্র লিখিয়াছেন তাহা প্রকাশ করা গেল:- “শিশুদিগের উৎসাহের জন্য আমি ইচ্ছা করিয়াছি দ্বাদশ বৎসরের ন্যূনবয়স্ক যে বালক কিম্বা বালিকা আপনার পত্রে মুদ্রিত ধাঁধা সকলের সর্ব্বাপেক্ষা অধিক উত্তর দিতে সক্ষম হইবে, তাহাকে বৎসরান্তে ৫ পাঁচ টাকা পারিতোষিক দিব। আশা করি আপনি আমার প্রস্তাবে সম্মত হইবেন।
শুভাকাঙ্ক্ষিণী
অলকাসুন্দরী রায় ।”
‘সখা’ ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের লিখতে এবং রচনা প্রকাশ করতে অনুপ্রাণিত করেছে। এর জন্য আলাদা একটি বিভাগ ছিল। একই ভাবে দৈনন্দিন জীবনে বদ অভ্যাস দূর করতেও ‘সখা’র ভূমিকা প্রশংসনীয়। প্রথম বছরের মার্চ সংখ্যায় ‘ধূমপান’ শীর্ষক একটি রচনা প্রকাশিত হয়। উপেন্দ্রকিশোর রায় ও সম্পাদকের এই রচনাটি পাঠ করে অনেকেই হয় ত প্রভাবিত হয়ে তাদের ধূমপানের অভ্যাস ত্যাগ করেছেন। এরকম একটি চিঠি ‘সখা’য় প্রকাশিত হয়েছে এপ্রিল সংখ্যায়। ‘একটি আশার কথা’ নাম দিয়ে সম্পাদক লিখেছেন –
“আমরা অত্যন্ত আহ্লাদের সহিত আমাদিগের পাঠকগণকে জানাইতেছি যে আমাদিগের মফঃস্বলের কোন পাঠক গতবারের ধূমপান বিষয়ক প্রস্তাবটি পাঠ করিয়া তামাক খাওয়া একেবারে ছাড়িয়া দিয়াছেন। তিনি এ সম্বন্ধে আমাদিগকে যাহা লিখিয়াছেন, তাহা নিম্নে প্রকাশিত হইল। নাম প্রকাশ লজ্জার কারণ হইতে পারে বলিয়া প্রকাশ করা গেল না।
“মহাশয়।
আমি পূর্ব্ব হইতে তামাক খাইতাম; কিন্তু ‘সখা’র একটি প্রবন্ধ পাঠ করিয়া অদ্য হইতে তামাক খাওয়া চিরদিনের মত পরিত্যাগ করিলাম। ইতি, তারিখ ১০ই চৈত্র ১২৮৯ সাল ।”
যে কোনও পত্রিকার পাঠকগোষ্ঠির মধ্যে রুচি ও মতের পার্থক্য থাকে। তাদের কারো কারো বিরূপ সমালোচনা সম্পাদককে মাঝে মাঝে সহ্য করতে হয়। সেটাই স্বাভাবিক। ১৮৮৫ সালের জানুয়ারী সংখ্যায় সম্পাদকীয়তে এমনই কিছু সমালোচনার কথা প্রমদাচরণ প্রকাশ করেছেন। একজন পাঠক লিখেছেন –
“আমি আর আপনার কাগজের গ্রাহক থাকিতে ইচ্ছা করি না। আপনাদের পত্রিকা যেমন ব্রাহ্মভাবপূর্ণ, তাহাতে আর্য্যসন্ততিগণের তাহা পাঠ করা বা গ্রহণ করিয়া উৎসাহ দেওয়া উচিত নহে।”
প্রমদাচরণ ব্রাহ্মধর্মাবলম্বী ছিলেন ঠিকই, কিন্তু তার লেখাতে সে বিষ্যের কোন ছাপ পড়েছে বলে মনে হয় না। পাঠকটির চিঠির উত্তরে প্রমদাচরণ লিখেছেন –
“আমরা ‘সখা’তে এতদিন যে সকল বিষয় লিখিয়া আসিতেছি, তাহাতে – সত্যবাদী হও, পশুর প্রতি দয়া কর, পিতামাতাকে মান্য কর, চেষ্টা করিয়া কেশবচন্দ্র সেন, শ্যামাচরণ বিশ্বাস বা কৃষ্ণদাস পালের মত বড়লোক হও, পরমেশ্বরকে ভক্তি কর, শারীরিক শ্রম করিয়া খুব জোরাল হও, দেশের উপকার কর, গরিবের প্রতি দয়া কর ইত্যাদি অনেক কথা বলিয়াছি। এখন কথা এই, এগুলিই যদি “ব্রাহ্মভাব” হয়, তবে বোধ করি ইহার উল্টো যেগুলি তাহাই “আর্য্যভাব”? ছি! ছি! ছি! এমন লোকের সঙ্গে তর্কও করিতে হয়! ‘সখা’ হিন্দু সমাজেরও কাগজ নয়, ব্রাহ্মসমাজেরও কাগজ নয়; কেবল বালক বালিকাদিগের যাহাতে উপকার হয়, তাহাই করিতে ইহার জন্ম, ‘সখা’ চিরকাল তাহাই করিবে।”
প্রথম দিকে লেখকের অপ্রতুলতা হেতু প্রমদাচরণকেই বহু লেখা লিখতে হয়েছে, কিন্তু ধীরে ধীরে বহু লেখক তাদের রচনা নিয়ে এগিয়ে এসেছেন। প্রথম বর্ষে সম্পাদক প্রমদাচরণের সঙ্গে ছিলেন উপেন্দ্রকিশোর রায়, হেমলতা দেবী, প্যারীশঙ্কর দাস গুপ্ত, মন্মথনাথ মুখোপাধ্যায়, হিরণ্ময়ী দেবী প্রভৃতি। দ্বিতীয় বর্ষ থেকে অনেক নামী অনামী লেখক পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। এদের মধ্যে রয়েছেন শিবনাথ শাস্ত্রী, বিপিনচন্দ্র পাল, বিপিনবিহারী সেন, ফণীভূষণ মুখোপাধ্যায়, খেলাতচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, সুবর্ণপ্রভা বসু, ভুবনমোহন রায়, কুঞ্জবিহারী ঘোষ, শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তী, অন্নদাচরণ সেন, চিরঞ্জীব শর্ম্মা প্রমুখ। বেশ কিছু রচনা লেখক বা লেখিকার নাম প্রকাশিত হয় নি, ‘জনৈক বঙ্গমহিলা’ বা ‘কুমারী * দেবী’ নামের আড়ালে যারা ছিলেন, তারা চিরকাল অজ্ঞাতই রয়ে গিয়েছেন, এখন আর তাদের পরিচয় জানার কোনো উপায় নেই।
দ্বিতীয় বর্ষের মার্চ সংখ্যায় বিপিনচন্দ্র পাল একটি বিদেশী গল্প অবলম্বনে ‘পাহারা ওয়ালার ভেল্কী’ নামে একটি ধাঁধাযুক্ত মজার গল্প লিখেছেন। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের চিন্তাশক্তি জোরাল করে তুলতে এ ধরণের লেখা খুবই সহায়ক। পাঠক পাঠিকারা কত মন দিয়ে গুরুত্ব সহকারে ‘সখা’র লেখা পড়ত তার একটি নমুনা পাওয়া যায় একজন খুদে পাঠিকার কাজ দেখে। বিপিনচন্দ্র দ্বিতীয় বর্ষের এপ্রিল সংখ্যায় ‘এলাইচ’ নামক একটি প্রবন্ধে এলাইচ সম্বন্ধে বেশ কিছু জ্ঞাতব্য তথ্য পরিবেশন করেন। সেখানে তিনি লিখেছিলেন –
“আদার পাতায় আদার গন্ধ পাওয়া যায়, হলুদের পাতায় হলুদের গন্ধ পাওয়া যায়, শুঁটের পাতা হাতে রগড়াইলে তাহা হইতে ঠিক শুঁটের গন্ধ বাহির হয়। এলাইচের পাতাতেও কি ঠিক এলাইচের গন্ধ পাওয়া যায় ? না। ...... এলাইচের পাতা রগড়াইলে তাহা হইতে কেমন এক প্রকার বুনো গন্ধ বাহির হয়, এ যে এলাইচের পাতা তাহা ঠিক করা অসাধ্য। এলাইচের গন্ধ কেবল তার আপনার ভিতরেই বন্ধ থাকে, পাতা বা ফুলে সে গন্ধ পাওয়া যায় না।”
কিন্তু বিপিনচন্দ্রের এই মত একজন খুদে পাঠিকা মেনে নিতে পারে নি। তার বক্তব্যের উত্তর জুন সংখ্যায় ‘পত্র প্রেরকের প্রতি’ শিরোনামে প্রকাশ করা হয়েছে। সেটি ছিল এ রকম –
“আমরা ইতিপূর্ব্বে এলাইচের সম্বন্ধে লিখিয়াছিলাম যে, এলাইচের পাতায় গন্ধ নাই; আমাদের একজন বালিকা পাঠিকা, এই কথা তুলে, ইহা দেখাইবার জন্য কতকগুলি এলাইচের ফুল ও পাতা পাঠাইয়া দিয়াছেন। আমরা দেখিলাম এ পাতার বেশ গন্ধ আছে, ফুলগুলির গন্ধ আরও চমৎকার। এ সম্বন্ধে আমাদের বক্তব্য এই যে, “এলাইচ” প্রবন্ধের লেখক মান্দ্রাজ অঞ্চলে যে পাতা দেখিয়াছিলেন, তাহাতে গন্ধ ছিল না; বাঙ্গালা দেশে এলাইচের গাছে ফল হয় না, এই জন্যই হয় ত পাতায় ফলের গন্ধ পাওয়া যায়।” ইত্যাদি।
‘সখা’তে জ্ঞান ও নীতিশিক্ষা বিষয়ক রচনা প্রচুর পরিমাণে পরিবেশিত হয়েছে। বিশেষত: পাঠক পাঠিকাদের বিজ্ঞান সচেতন করে তুলতে চেষ্টার কোন ত্রুটি ছিল না। বিখ্যাত লোকদের জীবনীও প্রায় নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছে, এদের মধ্যে ছিলেন অক্ষয়কুমার দত্ত, রামতনু লাহিড়ী, তারকনাথ প্রামানিক, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, কেশবচন্দ্র সেন, কুইন ভিক্টোরিয়া, এব্রাহাম লিঙ্কন, রামমোহন রায়, জর্জ স্টিফেনশন, টমাস আলভা এডিসন, স্বারকানাথ বিদ্যাভুষণ, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রভৃতি স্বনামধন্য ব্যক্তিবর্গ। খ্যাতনামা ব্যক্তিদের মৃত্যু সংবাদও দেওয়া হত। পত্রিকার একটি বড় আকর্ষণ ছিল ধাঁধা, আগের সংখ্যার ধাঁধার উত্তর সহ নতুন ধাঁধা প্রায় প্রতি সংখ্যাতেই ছাপা হয়েছে। মাঝে মাঝে চিঠির উত্তর দেওয়া হয়েছে ‘পত্র প্রেরকের প্রতি’ বিভাগে।
‘সখা’য় ’ড্রপ লেটার’ (Drop letter) ব্যবহৃত হয়েছে| এই রীতি অনুসারে প্রতিটি রচনার আদ্যক্ষরটি বড় আকারের এবং অলঙ্কৃত থাকে এবং পরবর্তী অক্ষরগুলি সাধারণ নিয়মে মুদ্রিত হয়| ‘সখা’তে প্রথম অক্ষরটি কাঠ খোদাই ব্লকে তৈরি হত এবং অন্যান্য অক্ষর সাধারণ আকারের ধাতু নির্মিত থাকত| ভিক্টোরীয় যুগে প্রচলিত এই ‘ড্রপ লেটার’ পদ্ধতি প্রমাদাচরণ সুচিন্তিত ভাবে ব্যবহার করেছেন ছোটদের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য|
প্রমোদাচরণের মৃত্যুর পর তাঁর শিক্ষক শিবনাথ শাস্ত্রী ‘সখা’কে বাঁচাতে পত্রিকাটির সম্পাদনার ভার নেন| ১৮৮৫ সালের জুলাই মাস থেকেই ‘সখা’ শিবনাথের সম্পাদনায় প্রকাশিত হতে থাকে। ১৮৮৬ সাল অবধি তিনি এই কাজ করেছেন| ১৮৮৬ সালের জানুয়ারি সংখ্যায় ‘চতুর্থ বর্ষ’ নাম দিয়ে যে সম্পাদকীয় প্রকাশ করেছেন তার অংশ বিশেষ –
“আজ “সখা”র জন্মদিন। ছেলেমেয়েদের জন্মদিনে বাড়ীতে সকলেই আনন্দ করে। কিন্তু আজ আমরা “সখা”কে বাহিরে যাইবার জন্য কাপড় পরাইতেছি, আর প্রমদাচরণের জন্য চোখের জল ফেলিতেছি। “সখা”র একটু আদর দেখিলে যে প্রমদাচরণ স্বর্গের চাঁদ হাতে পাইত, সেই প্রমদাচরণ আজ নাই। এখন যদি আমরা “সখা”কে ভাল করিয়া মানুষ করিতে পারি তবেই সে শোক নিবারণ হয়। অতএব পাঠক পাঠিকা তোমরা নূতন বছরে “সখা”কে সকলে আশীর্ব্বাদ কর, যেন “সখা” প্রমদাচরণের উদ্দেশ্য সিদ্ধ করিতে পারে।”
এরপর প্রমদাচরণের ভাই অন্নদাচরণ সেন সম্পাদক ছিলেন ১৮৮৭ সাল থেকে ১৮৯২ সাল অবধি| পরবর্তী সম্পাদক ছিলেন শিশুসাহিত্যিক নবকৃষ্ণ ভট্টাচার্য্য ১৮৯৪ সাল পর্যন্ত| ‘সখা’য় বিজ্ঞান ও ইতিহাস বিষয়ক প্রবন্ধকে খুব গুরুত্ব দেওয়া হত| বিদ্যাসাগরের বেশ কিছু অপ্রকাশিত রচনা প্রকাশের প্রতিশ্রুতি থাকলেও তার দুটি লেখাই মাত্র ছাপা হয়েছিল - ১৮৯৩ সালের এপ্রিল সংখ্যায় ‘মাতৃভক্তি’ এবং ১৮৯৪ সালের জানুয়ারি সংখ্যায় ‘ছাগলের বুদ্ধি’| প্রমদাচরণের অকাল মৃত্যুর পরেও তার শুভানুধ্যায়ীরা তাকে মনে রেখেছেন, মৃত্যুর পরেও তার লেখা ‘সখা’ প্রকাশিত হয়েছে| ‘সখা’র শেষ সংখ্যা বেরোয় ১৮৯৪ সালের মার্চ মাসে| ১৮৮৩-র জানুয়ারিতে ‘সখা’র যাত্রা শুরু; অর্থাৎ ‘সখা’র আয়ুষ্কাল ছিল ১১ বছর ৩ মাস| এর পর ‘সখা’ ভুবনমোহন রায়ের ‘সাথী’র সঙ্গে যুক্ত হয়ে ‘সখা ও সাথী’ নামে প্রকাশিত হয়েছে। বিশদ ভাবে ‘সখা ও সাথী’ প্রসঙ্গে লেখা হবে।
প্রমদাচরণ মৃত্যুর পূর্বে ‘সখা’ সম্পাদনা করেছেন মাত্র আড়াই বছর; কিন্তু ব্যক্তি জীবনের সমস্ত ব্যথা বেদনাকে সরিয়ে রেখে ‘সখা’কে ছোটদের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলতে তার নিরলস প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয় নি। শিশু সাহিত্যের ইতিহাসে ‘সখা’ ও প্রমদাচরণ চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
চিত্র ১ : প্রথম বর্ষ প্রথম সংখ্যার পুনর্মুদ্রিত দ্বিতীয় সংস্করণের আখ্যাপত্র।
চিত্র ২ : ১৮৮৪ সেপ্টেম্বর সংখ্যায় মুদ্রিত একটি বিজ্ঞাপন।
চিত্র ৩ : ১৮৮৯ মার্চ সংখ্যার বেলুন বিষয়ক একটি প্রবন্ধের সঙ্গে মুদ্রিত একটি চিত্র – “ভূমিতে অবতরণ সময়ে”।
চিত্র ৪ : ‘সখা’য় প্রতি রচনার আদ্যক্ষরে drop letter ব্যবহার।
লেখক পরিচিতি : বহু বছর বি.ই. কলেজে (এখন ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, শিবপুর ( IIEST,shibpur )) অধ্যাপনা করেছেন। কিছুদিন হল অবসর নিয়েএখন সেখানে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে আছেন। অ্যাপ্লায়েড মেকানিক্স নিয়ে গবেষণা করলেও একাধিক বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে - জ্যোতিষশাস্ত্র, পুরনো কলকাতার সংস্কৃতি, ইত্যাদি। অবসর সময়ে 'অবসরে'র সঙ্গে সময় কাটান।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।