মূলতঃ
মিশনারিদের দ্বারা পরিচালিত ‘সমাচার দর্পণ’-এ বিবিধ বিষয়
নিয়ে আলোচনা হলেও অনেক সময়েই তাতে হিন্দু ধর্মের যুক্তিহীনতা
এবং খৃষ্ট ধর্মের মহত্ব প্রতিপন্ন করে অনেক লেখা, বিশেষ
করে চিঠিপত্র প্রকাশিত হত। এর যথাযথ প্রত্যুত্তর দেবার
জন্য বাঙালীদের দ্বারা পরিচালিত একটি পত্রিকার অভাব অনুভব
করা যাচ্ছিল। এই উদ্দেশ্যে কলুটোলার দেওয়ান তারাচাঁদ দত্ত
ও ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় একসঙ্গে ‘সম্বাদ কৌমুদী’ নামে
এক সাপ্তাহিক পত্র প্রকাশ করেন; প্রথম সংখ্যাটি বের হয়
১৮২১ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর (১২২৮ বঙ্গাব্দের ২০শে অগ্রহায়ণ)।
ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় লেখক হিসাবে ছিলেন পরিচিত ব্যক্তিত্ব;
তার রচিত ‘কলিকাতা কমলালয়’ ও ‘নববাবুবিলাস’ গদ্যসাহিত্যে
উল্লেখযোগ্য সংযোজন। রামমোহন রায় প্রকাশ্যে না হলেও পত্রিকাটি
পরিচালনায় একটি শক্তিশালী ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। এটি
ছাপা হত ‘সংস্কৃত প্রেসে’; এটি সম্বন্ধে মহেন্দ্রনাথ বিদ্যানিধি
জানিয়েছেন – “এই সংস্কৃত প্রেস কাহার মুদ্রাযন্ত্র জানিবার
যো নাই”। ‘সম্বাদ কৌমুদী’-র শির্ষভাগে নিম্নলিখিত দুটি
শ্লোক ছাপা হত :
“দর্পণে বদনং ভীতি দীপেন নিকটস্থিতং
।
রবিনা ভুবনং তপ্তং কৌমুদ্যা শীতলং
জগৎ ।।“
১৩০৪ বঙ্গাব্দের বৈশাখে ‘নব্যভারত’ মাসিক পত্রিকায় মহেন্দ্রনাথ
বিদ্যানিধি রচিত প্রবন্ধে (এর উল্লেখ ‘বেঙ্গল গেজেট’ প্রসঙ্গে
আগেই করা হয়েছে ) শ্লোকটি সম্বন্ধে তথ্য জানানো হয়েছে।
শ্লোকটির অর্থ : “মুকুরে মুখের প্রতিবিম্ব প্রতিফলিত হয়।
প্রদীপে সমীপবর্ত্তী বস্তুর সন্দর্শন লাভ ঘটে। দিবাকর-করে
মহী-মণ্ডলের উত্তপ্ত অবস্থা ঘটিয়া থাকে। কিন্তু চন্দ্র
কিরণে (কৌমুদীতে ) পৃথ্বীতল, সুশীতল ভাব ধারণ করে।”
লেখক আরও জানিয়েছেন – “প্রথম সংবাদপত্র ‘বেঙ্গল গেজেটের’
ঊর্ধ্বভাগে কোন কার্য্য-নিয়ামক শ্লোক বিরাজমান ছিল কি
না, জানি না। কিন্তু ‘সংবাদ কৌমুদীর’ শিরোদেশে যে কবিতা
শোভা পাইত, তাহার সন্ধান পাইয়াছি। বঙ্গীয় প্রাচীন সংবাদ-পত্রের
এরূপ সংবাদ পাওয়া, অতুল আনন্দের বিষয়।” শ্লোকটির সন্ধান
মহেন্দ্রনাথের “পিতৃদেব গোপীনাথ-দাস চূড়ামণি মহাশয় হিন্দু
কালেজের বাঙ্গালার তদানীন্তন অধ্যাপক রামচন্দ্র মিত্রজ
মহাশয়ের ভবনে রক্ষিত মূল ‘কৌমুদীতে’ দেখিয়াছিলেন।”
একটা বিষয় পরিষ্কার যে আজ থেকে ১২৫ বছর আগেও প্রাচীন সংবাদপত্র
বা সাময়িক পত্র সম্বন্ধে অনুসন্ধিৎসার অভাব ছিল না। সম্ভবত
‘সম্বাদ কৌমুদীর’ শিরোভাগে মুদ্রিত শ্লোক উত্তরকালের সাময়িকপত্র
প্রকাশকদের অনেককে পত্রিকার শীর্ষদেশে কোন শ্লোক বা কবিতার
পংক্তি সংযোজনে উদ্বুদ্ধ করেছে। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য
যে, ‘সম্বাদ কৌমুদী’র কোন সংখ্যার হদিস এখনো পর্যন্ত কোথাও
পাওয়া যায় নি। মহেন্দ্রনাথ বিদ্যানিধি লিখেছেন – “মূল
সংবাদ-কৌমুদীর সঙ্গ পাইলে প্রাণ মন স্নিগ্ধ হইত; কিন্তু
তার সম্ভাবনা কোথায় ? ” ব্রজেন্দ্রনাথেরও একই বক্তব্য
– “ ‘সম্বাদ কৌমুদি’র কোন সংখ্যা এখনও আবিষ্কৃত হয় নাই
।”
পত্রিকাটিতে
বিজ্ঞান, ইতিহাস, রাজনীতি, সমাজনীতি, সংবাদ ইত্যাদি বিবিধ
বিষয় নিয়ে লেখা প্রকাশিত হত। এতে স্ত্রী-শিক্ষার প্রয়োজনীয়তাও
তুলে ধরা হয়েছে এবং উন্নত চিকিৎসা পদ্ধতির সমর্থনে মত
প্রকাশ করা হয়েছে। রামমোহন রায় হিন্দুদের পৌত্তলিকতার
বিরুদ্ধে একেশ্বরবাদ নিয়ে প্রবন্ধ রচনা করতে থাকেন। এটা
রক্ষণশীল হিন্দুসমাজ ভালভাবে গ্রহণ করেন নি। আট পৃষ্ঠার
‘সম্বাদ কৌমুদী’ প্রথমে প্রতি মঙ্গলবার প্রকাশিত হত এবং
পরে ১৮২২ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারী থেকে মঙ্গলবারের পরিবর্তে
বেরোত প্রতি শনিবার। তারাচাঁদ ও ভবানীচরণ ছাড়াও তারাচাঁদ
দত্তের পুত্র হরিহর দত্ত পরিচালনা ও সম্পাদনার কাজে যুক্ত
হয়েছিলেন।
রামমোহন রায় ছিলেন মুক্ত মনের মানুষ। তিনি সতীদাহ প্রথা
সমর্থন করতেন না। এর বিরুদ্ধে প্রবন্ধ প্রকাশের মাধ্যমে
মত প্রকাশ করায় তার বন্ধু ও পরিচালক ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়
‘সম্বাদ কৌমুদি’-র সঙ্গে সংস্রব ত্যাগ করেন এবং একটি পৃথক
সংবাদ পত্র প্রকাশ করার পরিকল্পনা করেন। কারণ, ভবানীচরণ
ছিলেন রক্ষণশীল দলের লোক। সহমরণ নিয়ে মতানৈক্যের পরিণামে
ভবানীচরণ এবং আর্থিক বিষয়ে হতাশ হয়ে হরিহর দত্তও পত্রিকার
পরিচালনার দায়িত্ব পরিত্যাগ করলে মিলিটারি বোর্ড অফিসের
কেরাণী গোবিন্দচন্দ্র কোঙার পত্রিকার পরিচালনার ভার গ্রহণ
করেন। তবে ভবানীচরণ পদত্যাগ করে ‘সমাচার চন্দ্রিকা’ প্রকাশ
করায় এবং সহমরণকে কেন্দ্র করে রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের
বিরোধিতার ফলে ‘সম্বাদ কৌমুদী’-র বিক্রি অনেক কমে গেলেও
পত্রিকাটি একেবারে বন্ধ হয়ে যায় নি। ১৮২৩ সালের ৭ই আগষ্ট
থেকে আনন্দচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় ‘সম্বাদ কৌমুদী’
প্রকাশিত হতে থাকে, প্রকাশক ও মুদ্রাকর ছিলেন গোবিদচন্দ্র
কোঙার। ১৮৩০ সালে পত্রিকাটি সপ্তাহে দু’বার প্রকাশিত হত।
কিছুকাল হলধর বসু সম্পাদনার কাজ করেছিলেন এবং শেষ পর্যায়ে
সম্পাদক ছিলেন রামমোহন রায়ের বড় ছেলে রাধাপ্রসাদ রায়।
‘সম্বাদ কৌমুদী’ সম্ভবতঃ ১৮৩৩ সাল পর্যন্ত চলেছিল।
প্রসঙ্গত উদারপন্থী রামমোহন সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধাচারণ
করলেও এই কুপ্রথার সমর্থনকারীদের সংখ্যাও কিছু কম ছিল
না। ‘সম্বাদ তিমিরনাশকে’ প্রকাশিত সংবাদ উধৃত করে ১৮৩২
খ্রীষ্টাব্দের ২১শে জানুয়ারি ‘সমাচার দর্পণে’ নীচের কটাক্ষদুষ্ট
সংবাদটি পরিবেশিত হয়েছিল –
“এক্ষণে শ্রীযুত বাবু রামমোহন রায়ের পুত্র শ্রীযুত বাবু
রাধাপ্রসাদ রায় কৌমুদী নামে কাগজ করিতেছেন ঐ কাগজের গ্রাহক
কেবল সতীদ্বেষী কএক মহাশয়েরা আছেন শুনিয়াছি তাহার ব্যয়নিমিত্ত
শ্রীযুত বাবু কালানাথ মুন্সি ১৬ টাকা আর শ্রীযুত বাবু
দ্বারিকানাথ ঠাকুর ১৬ টাকা দেন ইহাতেই তাহার জীবনোপায়
হইয়াছে নচেৎ কৌমুদী এত দিনে কোন স্থানে মিলাইয়া যাইতেন
....।”
কেমন ছিল ‘সংবাদ কৌমুদী’তে প্রকাশিত খবরের ধরণ এবাং রচনা
শৈলী ? নমুনা হিসাবে পত্রিকার ৮ম সংখ্যা থেকে একটি খবর
উধৃত করা যাক –
“বেলুনের বিবরণ।
তাবৎদেশের গল্পে লিখিত আছে যে, লোকেরা আকাশপথে গমন করিয়াছেন,
কিন্তু এই অসম্ভব বিষয় যে সত্য হইবে, সে কেবল এই কালের
কারণ। পূর্ব্বকালে যে বিষয় অদ্ভুত ও অবিশ্বসনীয়ত্বরূপে
গণিত ছিল, সে বিষয় এতৎকালীন বিদ্যা প্রকাশ দ্বারা সত্য
ও বিশ্বসনীয় হইয়াছে। যে যন্ত্র দ্বারা এই আশ্চর্য্য আকাশযাত্রা
হয়, তাহার নাম বেলুন।
“সন ১৭৬৬ সতর শত ছেষট্টি সালে কাবেণ্ডিস সাহেব নিশ্চয়
করিলেন যে, আগ্নেয় আকাশ সামান্য আকাশ হইতে শতগুণ লঘু।
ইহার পর আর এক সাহেবের মনে হইল যে, এক পিত্তল থৈলী আগ্নেয়
আকাশে পূর্ণ করিলে সে অবশ্য উপরে উঠিবে, কিন্তু পরীক্ষাতে
সে উত্তীর্ণ হইল না।
“ইংলণ্ডদেশে এই নূতন সৃষ্টি সমাপ্ত হইবার প্রত্যাশা করিতে
করিতে হঠাৎ শুনা গেল যে, ফ্রান্সদেশে সমাপ্ত হইয়াছে। ১৭৮২
সালে স্তিফন ও জন-মঙ্গলফ্যে নামে দুই ভ্রাতা এই বিষয় সিদ্ধ
করিতে অতিশয় মনোযোগ করিলেন।
“ধূম ও মেঘ এই উভয়ের আকাশে গমন দেখিয়া বেলুনের কথা তাঁহাদের
মনে আইল ও তাঁহারা এই ভাবিলেন যে, এক থৈলী ধূমে পরিপূর্ণ
করিয়া তাহাকে আকাশে উঠাইব। তাঁহারা অক্টোবর মাসে এক রেশমের
থৈলী দ্বারা এইরূপ পরীক্ষা প্রথম করিলেন, সে থৈলীর নীচে
ছিদ্র করিয়া তাহার নীচে কাগজ লাগাইলেন, তাহাতে থৈলীর মধ্যস্থিত
আকাশ পাতলা হইল এবাং ঐ থৈলী উঠিয়া গৃহের ছাদে ঠেকিল।“
অন্য একটি কৌতুকপূর্ণ খবর বেরিয়েছিল পত্রিকাটিতে। সেটি
এইরকম –
“ শ্রীরামপুরে এক ব্রাহ্মণ,
লোকের ভাগ্য-গণনার জন্য সমাগত হন। তিনি গুপ্ত রত্নোদ্ধারে
সমর্থ, ইহাও বলেন। এতদর্থে তাঁহাকে বিংশতি পুরস্কার দিতে
হইয়াছিল। তিনি কার্য্যান্তরে ব্যাপৃত হইয়া স্থানান্তরে
গমন করিলে, ব্রাহ্মণ পিতলের একখানি রেকাব মাটির ভিতর পুতিয়া
ফেলিলেন। তথায় সাহেবরাও সমাগত হইয়াছিলেন। গণক দ্বিজ, সাহেবকে
ঐ পিত্তলের রেকাবটিই গুপ্তধন নির্দ্দেশ করিলেন। অন্যেরা
কিন্তু তাহার চাতুরী ধরিয়া ফেলিলেন। অর্থাৎ তিনি স্বয়ংই
নিমেষে পূর্ব্বে উহা মাটিতে পুতিয়াছিলেন। তাহা প্রচারিত
হইয়া পড়িল। সকলে মিলিয়া ব্রাহ্মণকে হাতে পায়ে বাঁধিয়া
পথে ফেলিয়া দিল।”
দীপক
সেনগুপ্ত।
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।