‘সম্বাদ কৌমুদী’ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে রামমোহন রায় হিন্দুদের
পৌত্তলিকতার সমালোচনা করায় এবং বিশেষ করে সতীদাহ প্রথার
বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করে প্রবন্ধ প্রকাশ করায় পরিচালন সমিতি
থেকে রক্ষণশীল মনোভাবাপন্ন ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় পদত্যাগ
করেন। তিনি দ্রুত কলুটোলায় সমাচার চন্দ্রিকা মুদ্রণ যন্ত্র
স্থাপন ক’রে ২৫নং রামমোহন ঘোষের স্ট্রীট থেকে ‘সামাচার
চন্দ্রিকা’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। প্রথম সংখ্যাটি
বেরোয় ১৮২২ সালের ৫ই মার্চ মঙ্গলবার (২৩শে ফাল্গুন, ১২২৮
বঙ্গাব্দ )। প্রকাশের আগে ‘সমাচার দর্পণ’ পত্রিকায় যে
বিজ্ঞাপনটি বেরিয়েছিল সেটি ছিল – “ কলিকাতার কলুটোলা গ্রাম
নিবাসী শ্রীযুত ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় সকল বিজ্ঞ সদ্বিবেকে
মহাশয়দিগকে বিজ্ঞাপন করিতেছেন যে তিনি সম্বাদ কৌমুদী নামক
সমাচারপত্র প্রথমাবধি ১৩ সংখ্যা পর্য্যন্ত প্রকাশ করিয়াছেন।
সম্প্রতি সমাচার চন্দ্রিকা নামক এক পত্র প্রকাশ করিতেছেন
তাহাতে নানা দিগদেশীয় বিবিধ সমাচার অনায়াসে জানা যায়।
প্রথম পত্র ২৩ ফাল্গুন প্রকাশ করিয়াছেন ...”।
ভবানীচরণ নিজে গোঁড়া ও রক্ষণশীল হিন্দু ছিলেন এবং ‘সমাচার
চন্দ্রিকা’ ছিল রক্ষণশীলদের মুখপত্রস্বরূপ। হিন্দু ধর্মের
পবিত্রতা ও বিশুদ্ধতা রক্ষার্থে ১৮৩০ সালে প্রতিষ্ঠিত
হয় ‘ধর্মসভা’; ‘সমাচার চন্দ্রিকা’ এই ‘ধর্ম্মসভা’রই মুখপত্রে
পরিণত হয়। ‘সম্বাদ কৌমুদী’ ও ‘সমাচার চন্দ্রিকা’-র রেষারেষি
লেগেই থাকত এবং একের অপরের বিরুদ্ধে প্রায় মিয়মিতই লেখালেখি
চালাত। কেদারনাথের ভাষায় “রামমোহন রায়ের ‘কৌমুদী’ এবং
হিন্দু সমাজের ‘চন্দ্রিকা’-র মধ্যে কিছুকাল বেশ দলাদলি
এবং উত্তর প্রত্যুত্তর চলিয়াছিল।” এই বিতর্ক পারস্পরিক
নিন্দা ও অবাঞ্ছিত ভাষায় আক্রমণ ও প্রতি-আক্রমণে পরিণত
হয়েছিল। ১৮২২ সালের ৩০শে মার্চ তারিখের ‘সমাচার দর্পণ’
পত্রিকায় জনৈক পত্রলেখক এই পত্রটি প্রকাশ করেছেন –
“সম্বাদ কৌমুদীকারক মহাশয়েরা পূর্ব্ব এক হইয়া কাগজ প্রকাশ
করিতেছিলেন। পরে ১৪ সংখ্যাতে তাহারা ভিন্ন হইয়া সম্বাদ
কৌমুদী এবং সমাচার চন্দ্রিকা নামক দুই কাগজ প্রকাশ করিতেছেন।
কিন্তু উভয়ে পরস্পর বিবাদজনক অসাধু ভাষাতে পরস্পর নিন্দা
স্ব স্ব কাগজে ছাপাইতেছেন ইহাতে আমার খেদ হইতেছে যেহেতুক
সম্বাদ আর সমাচার নামে খ্যাত কাগজ। নানাদেশীয় নানাবিধ
নূতন নূতন সুশ্রাব্য বিষয়রহিত হইয়া কেবল পরগ্লানিসূচক
হইলে নামের বিপরীত হয়।”
সম্ভবতঃ রক্ষণশীল পন্থীরা সংখ্যায় অনেক বেশি ছিল, কারণ
পত্রিকাটির বিক্রি অনেক বেড়ে যায় এবং সপ্তাহে একদিনের
বদলে দু’দিন প্রকাশিত হতে থাকে। এই মর্মে ১৮৩০ খ্রীষ্টাব্দের
১২ই এপ্রিল পত্রিকাটিতে নীচের বিজ্ঞপ্তিটি প্রচারিত হয়
-
“এই চন্দ্রিকা পত্র ১৭৪৩ শকে সাপ্তাহিক অর্থাৎ প্রতি সোমবার
প্রকাশিত হইত ১৭৫১ শকের বৈশাখাবধি দুইবার অর্থাৎ সোমবার
ও বৃহস্পতিবার প্রকাশমান হইতেছে”। প্রাসঙ্গিক ভাবে উল্লেখ
করা যেতে পারে যে ভবানীচরণই ছিলেন ‘কলিকাতা কমালালয়’ (১৮২৩),
‘নববাবু বিলাস’ (১৮২৫), ‘দূতীবিলাস’ (১৮২৫), ‘নববিবি বিলাস’
(১৮৩১?) প্রভৃতি গ্রন্থের রচয়িতা। ‘নববাবু বিলাসে’ (১৮২৫)
তার ছদ্মনাম ছিল প্রমথনাথ শর্ম্মা।
১৮৪৮ সালের ২০শে ফেব্রুয়ারী ( ১২৫৪ বঙ্গাব্দের ৯ই ফাল্গুন
) ভবানীচরণের মৃত্যুর পর তার ছেলে রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের
পরিচালনা ও সম্পাদনায় ‘সমাচার চন্দ্রিকা’ প্রকাশিত হতে
থাকে। কিন্তু ততদিনে অন্য কয়েকটি পত্রিকা বিশেষ করে ‘সংবাদ
প্রভাকর’-এর আবির্ভাব ঘটায় ‘সমাচার চন্দ্রিকা’-র বিক্রি
কমে আসে এবং পরিশেষে রাজকৃষ্ণ দেউলিয়া হযে পড়েন; পত্রিকাটির
স্বত্ত কিনে নেন ভগবতীচরণ চট্টোপাধ্যায়। নতুন ‘সমাচার
চন্দ্রিকা’ প্রকাশিত হওয়া শুরু হলে ‘সংবাদ প্রভাকর’ (
৭ই মে ১৮৫২ ) খবর ছাপিয়েছে – “শ্রীযুত বাবু ভগবতীচরণ চট্টোপাধ্যায়ের
নূতন চন্দ্রিকা দৃষ্টিপথে বিহার করিয়াছেন, ইঁহার আকার
প্রকার অবিকল পুরাতন পত্রিকার ন্যায়। এবং পূর্ব্বকার সেই
অসংখ্য সংখ্যা ও শ্লোকটিও রহিয়াছে ।” তবে নূতন পত্রিকা
নিয়ে ভগবতীচরণ আইনের জালে জড়িয়ে পড়েন এবং নতুন ও পুরাণো
দুটি চন্দ্রিকাই মাঝে মাঝে প্রকাশিত হতে থাকে। এ প্রসঙ্গে
১৮৫৩ সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারির ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকায়
লেখা হয়েছে –
“ বাবু ভগবতীচরণ চট্টোপাধ্যায় যেমন এসাইনির নিকট হইতে
হেড ক্রয় করত নূতন পত্রিকা প্রকাশ করিলেন তেমনি আবার এ
পক্ষের পুরাতন পত্রিকাখানি একবার জন্ম, একবার মৃত্যু,
একবার মৃত্যু, একবার জন্ম, এইরূপ পাঁচ ছয় আছাড় খাইয়াই
প্রাণত্যাগ করিলেন ”।
‘বিবিধার্থ সঙ্গ্রহ’-এ পরিবেশিত একটি খবর থেকে জানা যায়
যে ১৮৫২ সালের ১৪ই আগষ্ট রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যুর
পরে সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক প্রাণকৃষ্ণ বিদ্যাসাগর পুরানো
‘সমাচার চন্দ্রিকা’ প্রকাশ করেছিলেন।
সব শেষে ‘সমাচার চন্দ্রিকা’য় ব্যবহৃত ভাষার সঙ্গে পরিচিত
হতে প্রকাশিত দুটি সংবাদ তুলে দেওয়া হচ্ছে। প্রথমটি ‘শাস্ত্রপ্রকাশ’
নামে একটি পত্রিকার প্রকাশনা সম্বন্ধে খবর -
“ আমরা পরম প্রীত হইয়া লিখিতেছি এতন্মহানগরে শ্রীযুত লক্ষ্মীনারায়ণ
ন্যায়ালঙ্কার ভট্টাচার্য্যকৃত শাস্ত্রপ্রকাশ নামক পত্র
প্রকাশ হইয়াছে সেই শাস্ত্রপ্রকাশে সর্ব্বশাস্ত্র প্রতিপাদ্য
প্রকাশ করিয়াছেন ইহাতে সর্ব্বদেশীয় সকল হিন্দু জাতীয় ভদ্র
মহাশয়দিগের মহোপকার হইতে পারে যেহেতু সংগ্রাহক ভট্টাচার্য্য
মহাশয় মহামহোপাধ্যায়ের নানা শাস্ত্রে দৃষ্টি আছে পরন্তু
পত্রেও বেদ পুরাণ স্মৃতি সংহিতাদি নানা শাস্ত্রোক্ত বিধি
নিষেধোপাখ্যান করিয়াছেন এ পত্র আমাদের দৃষ্টিগোচর হওয়াতে
সুপ্রশংসনীয় বোধ হইয়াছে ইহার মূল্য প্রতি মাসে এক টাকা
প্রতি বুধবারে যন্ত্রিত হইয়া এক পত্র দিবেন।” এটি প্রকাশিত
হয়েছিল ১৮৩০ সালের ২৪শে জুনের ‘সমাচার চন্দ্রিকা’য়। প্রসঙ্গতঃ
উল্লেখ করা যেতে পারে, ‘শাস্ত্রপ্রকাশ’ সাপ্তাহিক পত্রিকাটি
প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৩০ সালের জুন মাসে, পরিচালক ছিলেন সংস্কৃত
কলেজের গ্রন্থাধ্যক্ষ লক্ষ্মীনারায়ণ ন্যায়ালঙ্কার।
দ্বিতীয়টি একটি বিজ্ঞাপন। প্রকাশিত হয়েছিল ১২৩৭ বঙ্গাব্দের
১লা বৈশাখের পত্রিকায়।
“ সমাচার চন্দ্রিকা পত্র এ
প্রদেশে প্রায় সচিত্র বিখ্যাত হইয়াছে এদন্নগরের প্রায়
যাবদীয় শিষ্ট বর্দ্ধিষ্ণু লোকে গ্রহণ করিয়া থাকেন এবং
কাশী কটক ঢাকা রংপুর মুরশিদাবাদ, যশোহর নদীয়া বর্দ্ধমান
হুগলী প্রভৃতি জেলায় গিয়া থাকে এ পত্রের গ্রাহক এক্ষণে
প্রায় পাঁচশত জন হইয়াছেন যদ্যপি কোন মহাজনাদির কোন বস্তুর
ক্রয় বিক্রয়াদির সংবাদ প্রকাশাবশ্যক হয় চন্দ্রিকা পত্রে
সংবাদ দিলে অনায়াসে এ দেশের সর্ব্বত্র রাষ্ট্র হইতে পারে
এতৎপত্রে কোন বিষয় বিজ্ঞাপন অর্থাৎ ইস্তেহার করিবার ব্যয়
প্রথম বার পঙক্তি চার আনা পরে ঐ বিষয় ক্রমিক যতবার প্রকাশ
হইবেক ঐ চারি আনা লাগিবেক কিন্তু শতকরা দশ টাকা বাদ দেওয়া
যাইবেক। ইতি -”
সংযুক্ত প্রতিলিপির পরিচয় -
চিত্র
১ – ২৭শে বৈশাখ সোমবার ১২৩৮ ( ৯ই মে ১৮৩১)
চিত্র
২ – ৪ঠা ফাল্গুন বুধবার (১৪ই ফেব্রুয়ারি ১৮৭৭) প্রকাশিত
পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠা।
চিত্র ৩ – ৩রা
ফাল্গুন ১২৮৩ ( ১৩ই ফেব্রুয়ারি ১৮৭৭ ) তারিখে প্রকাশিত
‘অমৃতরস’ নামক সর্বরোগহর একটি ওষুধের বিজ্ঞাপন।
চিত্র ৪ – ৪ঠা জ্যৈষ্ঠ ১২৩৮-এ প্রকাশিত সংবাদ
সংবলিত একটি পৃষ্ঠা ।
দীপক
সেনগুপ্ত।
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।