পুরানো সাময়িকী ও সংবাদপত্র
নভেম্বর ১৫, ২০১৪
সম্বাদ ভাস্কর
দীপক সেনগুপ্ত
সেকালের সব পত্রিকাই যে মানুষকে নীতিকথা শিক্ষাদান বা জ্ঞান বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রকাশিত হত তা নয়। বহু ক্ষেত্রে পারস্পরিক বিতর্ক, সমালোচনা, ব্যঙ্গ বিদ্রূপ ইত্যাদি বিষয়ও ছিল প্রধান উপজীব্য । “ পাথুরিয়াঘাটার বাবুদিগের অর্থে ‘সংবাদ প্রভাকর’ বাহির হইলে শোভাবাজারের বাবুরাও ‘সম্বাদ ভাস্কর’ নামে একখানি পত্রিকা বাহির করেন।” ‘সম্বাদ ভাস্কর’ প্রকাশিত হয় ১৮৩৯ সালের মার্চ (চৈত্র ১২৪৫ ) মাসে । সম্পাদক ছিলেন শ্রীনাথ রায়। তখন অনেক ক্ষেত্রেই একজনকে সম্পাদক দাঁড় করিয়ে অন্য একজন অপ্রকাশ্যে কাজ করতেন। এখানেও আসল পরিচালক ছিলেন গৌরীশঙ্কর তর্কবাগীশ (গুড়গুড়ে ভটচায ) । প্রভাকর এবং ভাস্করের মধ্যে বাদ বিসংবাদ লেগেই থাকত । যাই হোক, আঁদুল-নিবাসী শ্রীনাথ মল্লিক ‘সম্বাদ ভাস্কর’-এর মূল পৃষ্ঠপোষক ছিলেন এবং অর্থ সাহায্য করতেন।
১৮৪৮ সালের ১৪ই জানুয়ারী থেকে ‘সম্বাদ ভাস্কর’ অর্ধ-সাপ্তাহিক এবং এক বছর পরে বারত্রয়িক রূপে প্রকাশিত হতে থাকে। প্রতি মঙ্গলবার, বৃহস্পতিবার ও শনিবার এটি প্রকাশিত হত। ১৮৫৯ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারী (২৪শে মাঘ ১২৬৫ বঙ্গাব্দ ) গৌরীশঙ্কর তর্কবাগীশের মৃত্যু হয় এবং তার কোন পুত্র না থাকায় পালিত পুত্র ক্ষেত্রমোহন ভট্টাচার্য্য ‘সম্বাদ ভাস্কর’-এর সম্পাদকের পদ গ্রহণ করেন।
পত্রিকা প্রকাশিত হয় ১৮৩৯-এর মার্চ মাসে। এক বছর পূর্ণ হবার আগেই সম্পাদক শ্রীনাথ রায় একটি অপ্রীতিকর ঘটনায় জড়িয়ে পড়েন। ঐ বছরের ডিসেম্বর মাসে ‘সম্বাদ ভাস্করে’ আন্দুলের রাজা রাজনারায়ণ রায় সম্বন্ধে একটি সংবাদ প্রকাশকে কেন্দ্র করে রাজনারায়ণ রুষ্ট হন। ১৮৪০ খ্রীষ্টাব্দের ৯ই (১৩ই ? ) জানুয়ারি সকালবেলা পটলডাঙ্গার চৌমাথায় শ্রীনাথ যখন গাড়িতে উঠতে যাচ্ছেন, তখন আন্দুল-রাজার কুড়ি-পঁচিশ জন সশস্ত্র প্রহরী তাকে প্রচণ্ড অপমান ও মারধর করে এবং আন্দুলে ধরে নিয়ে যায়। রাজার নামে পরোয়ানা জাহির করা হলে শ্রীনাথকে আন্দুল থেকে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সম্পাদককে খুঁজে না পাওয়ায় রাজা হাজত বাস করতে শুরু করেন এবং পরে সম্পাদককে হাজির করা হলে রাজা হাজার টাকা জরিমানা দিয়ে নিস্কৃতি লাভ করেন। এ বিষয়ে ১৮৪০-এর ১৮ই জানুয়ারি ‘সমাচার দর্পণ’ পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের কিয়দংশ উধৃত করা যেতে পরে। এ থেকে তখনকার সংবাদ পরিবেশনার ভাষা ও ধরণ কিছুটা আঁচ করা যায়। প্রকাশিত সংবাদটি এ রকম :
“ রাজা রাজনারায়ণের অত্যাশ্চর্য্য কীর্ত্তি:-ভাস্কর সম্পাদকের প্রতি রাজা রাজনারায়ণ রায় যে আইনবিরুদ্ধ ও আশ্চর্য্য ব্যাপার করিয়াছেন তাহাতে সর্ব্বসাধারণ লোকেরই দৃকপাত হইয়াছে এবং বোধ হয় ঐ মোকদ্দমা অতি শীঘ্র আদালতে আনীত হইবেক।
“ দৃষ্ট হইতেছে যে ভাস্কর সম্পাদকের নিকটে এক পত্র প্রেরিত হইয়াছিল তাহাতে এই লেখে যে উক্ত রাজা দুই জন ব্রাহ্মণকে ধর্ম্মসভা হইতে বহিষ্কৃত করিয়াছেন এবং আন্দুল নিবাসি এক জন ব্রাহ্মণের বৈষ্ণবের কন্যার সহিত বিবাহ দেওনোপলক্ষে অন্যান্য ব্রাহ্মণের প্রতি বল প্রকাশ করিয়াছেন ঐ পত্রের মধ্যে আরো রাজবংশীয়েরদের কুকর্ম্মের বিষয় উল্লিখিত ছিল তাহা প্রায় সকল লোকেরই সুবিদিত আছে কিন্তু ঐ সম্পাদক মহাশয় ঐ পত্র প্রকাশ না করিয়া কেবল এই মাত্র প্রকাশ করিয়াছিলেন যে রাজার এইরূপ কর্ম করা অনুচিত কিন্তু রাজা ইহাতেই উষ্মাণ্বিত হইয়া দিবাভাগে কলিকাতা শহরের রাস্তার মধ্যেই ঐ সম্পাদক মহাশয়কে প্রহার পূর্ব্বক ধৃত করণার্থে কএক জন অস্ত্রধারি লোক পাঠাইলেন তাহাতে ঐ সকল লোক অতি নির্দয়তা রূপে তাঁহাকে মারপিট করিয়া লইয়া যায় কথিত আছে যে আন্দুল পর্য্যন্ত লইয়া গিয়াছে। এবং তৎপরে শুনা গেল যে তাঁহাকে ঐ স্থান হইতে দুই ক্রোশ অন্তরিত এক গ্রামের মধ্যে বন্ধ রাখিয়াছে।”
রাজার নামে সুপ্রিম কোর্টে অভিযোগ করা হলে রাজা কিছুদিন আত্মগোপন করে থাকেন। তাকে ধরিয়ে দেবার জন্য শ্রীনাথ রায়ের সহযোগী গৌরীশঙ্কর তর্কবাগীশ পাঁচশ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে সংবাদ পত্রে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন।
এই ঘটনার পর শ্রীনাথ বেশী দিন বাঁচেন নি । ১৮৪০-এর অক্টোবরে তার মৃত্যু হয়। এর পর গৌরীশঙ্কর তর্কবাগীশই সম্পাদক পদে বৃত হন। সাপ্তাহিক পত্রিকাটি ১৪ই জানুয়ারি ১৮৪৮ থেকে সপ্তাহে দু’দিন, মঙ্গলবার ও শুক্রবার, প্রকাশিত হতে থাকে। ১৮৪৯-এর ১২ই এপ্রিল থেকে শুরু করে মঙ্গল, বৃহস্পতি ও শনি এই তিন দিন অর্থাৎ বারত্রয়িক রূপে প্রকাশিত হয়। গৌরীশঙ্কর ছিলেন উদার মতাবলম্বী এবং তার দক্ষ সম্পাদনায় পত্রিকাটি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করেছিল। ১৮৫৯-এর ৫ই ফেব্রুয়ারি গৌরীশঙ্করের মৃত্যু হলে তার পালিত পুত্র ক্ষেত্রমোহন ভট্টাচার্য পত্রিকাটি প্রকাশ করতে থাকেন। প্রথমে সুরুচি সম্পন্ন হলেও পরে ‘সম্বাদ ভাস্করে’ অপাঠ্য ও অশ্লীল লেখা প্রকাশিত হতে থাকে এবং অনেকেই পত্রিকাটিকে আর পাঠযোগ্য বলে মনে করেন নি। পত্রিকাটি ঠিক কবে অবধি চালু ছিল সেটা জানা যায় নি, তবে অন্তত ৩০ বছর এটির স্থায়িত্ব ছিল তাতে সন্দেহ নেই।
‘সম্বাদ ভাস্কর’-এর প্রসঙ্গ শেষ করার আগে পত্রিকাটিতে প্রকাশিত একটি কৌতূককর প্রশ্নোত্তর সম্বলিত সংবাদের উল্লেখ করা যেতে পারে। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তর মৃত্যু হয় ১৮৫৯ সালের ২৩শে জানুয়ারী এবং গৌরীশঙ্করের প্রয়াণ ঘটে ঐ বছরের ৫ই ফেব্রুয়ারী । ঈশ্বরচন্দ্র যখন পরলোক গমন করেন তখন গৌরীশঙ্কর রোগশয্যায় শায়িত, নিরাময়ের কোন আশা নেই। মৃত্যুর আগে তিনি নিম্নলিখিত ভাবে বন্ধু ঈশ্বরচন্দ্রের মৃত্যু সংবাদ ‘সম্বাদ ভাস্কর’-এ প্রকাশ করেন :
প্রশ্ন -প্রভাকর সম্পাদক ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত
কোথায় ?
উত্তর – স্বর্গে ।
প্রশ্ন - কবে গেলেন ?
উত্তর - গত শনিবারে গঙ্গাযাত্রা করিয়াছিলেন,
রাত্রি দুই প্রহর এক ঘন্টা কালে স্বর্গে গমন করিয়াছেন ।
প্রশ্ন - তাঁহার গঙ্গাযাত্রা ও মৃত্যু শোকের
বিষয় শনিবাসরীয় ‘ভাস্করে’ প্রকাশ হয় নাই কেন ?
উত্তর -কে লিখিবে ? গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য
শয্যাগত ।
প্রশ্ন - কত দিন ?
উত্তর -এক মাস কুড়ি দিন । তিনি-ঈশ্বরচন্দ্র
গুপ্ত গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য এই দুই নাম দক্ষিণ হস্তে লইয়া বক্ষস্থলে
রাখিয়া দিয়াছেন । যদি মৃত্যুমুখ হইতে রক্ষা পান তবে আপনার পীড়ার
বিষয় ও প্রভাকর সম্পাদকের মৃত্যুশোক, স্বহস্তে লিখিবেন । আর যদি
প্রভাকর সম্পাদকের অনুগমন করিতে হয়, তবে উভয় সম্পাদকের জীবন
বিবরণ ও মৃত্যু শোক প্রকাশ জগতে অপ্রকাশ রহিল।”
চিত্র ১ – ১২৫৫ বঙ্গাব্দ ৩০ শে পৌষ শুক্রবারে ( ১৮৪১ খ্রিষ্টাব্দ ১২ই জানুয়ারি ) প্রকাশিত একটি পৃষ্ঠার প্রতিলিপি।
চিত্র ২ – ১২৬০ বঙ্গাব্দ ৫ই মাঘ সংখ্যায় প্রকাশিত ওলাউঠার ‘অব্যর্থ’ প্রতিষেধকের বিজ্ঞাপন।
চিত্র ৩ – ১৮৫৪ খ্রিষ্টাব্দ ২১শে জানুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত একটি খবর।
( কোন প্রতিলিপি বড় করে দেখতে হলে ctrl টিপে রেখে + টিপুন। যত + টিপবেন তত বড় হবে। )
লেখক পরিচিতি : বহু বছর বি.ই. কলেজে (এখন ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, শিবপুর ( IIEST,shibpur )) অধ্যাপনা করেছেন। কিছুদিন হল অবসর নিয়েএখন সেখানে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে আছেন। অ্যাপ্লায়েড মেকানিক্স নিয়ে গবেষণা করলেও একাধিক বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে - জ্যোতিষশাস্ত্র, পুরনো কলকাতার সংস্কৃতি, ইত্যাদি। অবসর সময়ে 'অবসরে'র সঙ্গে সময় কাটান।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।