পুরানো সাময়িকী ও সংবাদপত্র
নভেম্বর ৩০, ২০১৪
সম্বাদ রসরাজ ও পাষণ্ড পীড়ন
দীপক সেনগুপ্ত
ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্য ভাগে কিছু বিদ্বজ্জন ও পণ্ডিতের কথা বাদ দিলে সাধারণের শিক্ষা ও রুচির মান খুব নিম্ন স্তরে ছিল। কবির লড়াই,অশ্লীল কথাবার্তা ও রচনা,টপ্পা,খেউর ইত্যাদি অধিকাংশের কাছেই তৃপ্তিকর ছিল। শহরে হয় ত কিছু শিক্ষায়তন প্রতিষ্ঠিত হত ও শিক্ষানুরাগীর দেখা মিলত কিন্তু দূরবর্তী স্থানে শিক্ষার আলো গিয়ে তখনও পৌঁছয় নি। এই অবস্থায় যে সব পত্র পত্রিকা প্রকাশিত হত,ব্যবসায়িক স্বার্থ দেখতে গিয়ে অনেক সময়েই তাতে নিম্ন মানের লেখা প্রকাশ করা হত। অনেকেই এ ধরণের লেখা পড়তে পত্রিকা প্রকাশিত হবার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করত। পাথুরেঘাটা বাবুদের টাকায় ‘সংবাদ প্রভাকর’ বেরিয়েছিল ; সেই দেখে শোভাবাজারের বাবুরা ‘সংবাদ ভাস্কর’ নামক পত্রিকা প্রকাশ করেন এবং ‘সংবাদ রসরাজ’-এর ঝগড়াটে সম্পাদক গৌরীশঙ্কর তর্কবাগীশকে সম্পাদক হিসাবে নিযুক্ত করেন। মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে প্রকাশিত হলেও এক সময়ে ‘সংবাদ প্রভাকর’,‘সম্বাদ ভাস্কর’,‘সম্বাদ রসরাজ’ ইত্যাদি পত্রিকাও নিম্ন রুচির লেখা প্রকাশ করত এবং পারস্পরিক দোষারোপ ও বাক-বিতণ্ডায় গা ভাসিয়েছিল। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত ‘সংবাদ প্রভাকর’-কে নিম্ন মানের রচনা প্রকাশ থেকে মুক্ত রাখতে অথচ ‘ভাস্কর’ ও ‘রসরাজ’-এর উত্তর দিতে ‘পাষণ্ড পীড়ন’ নামে একটি পৃথক পত্রিকা প্রকাশ করেন। কেদারনাথের বই থেকে জানা যায়,‘রসরাজ’ ও ‘পাষণ্ড পীড়নে’ যে ধরণের বাক-বিতণ্ডা চলত সেটা সম্বন্ধে একজন সুধী পাঠক লিখেছিলেন – “সে অভদ্র অশ্লীল ব্রীড়াজনক উক্তি প্রত্যুক্তির বিষয় স্মরণ করিলে এখনও লজ্জা হয়। ইহাতে বঙ্গসাহিত্যজগতে এরূপ অশ্লীলতার স্রোত বহিয়াছিল যাহার অনুরূপ নিকৃষ্ট রুচি কোনোও দেশের ইতিবৃত্তে দেখা যায় না।” তখনকার কালের একজন পাঠকের এ ধরণের মতামত খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও প্রণিধানযোগ্য।
‘সম্বাদ রসরাজ’ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৩৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৯শে নভেম্বর ( ১৫ই অগ্রহায়ণ ১২৪৬ )। এটি প্রথমে সাপ্তাহিক ছিল এবং সপ্তাহে প্রতি শুক্রবার প্রকাশিত হত। পরে সপ্তাহে দু’দিন - মঙ্গল ও শুক্রবার বের হত। পরিচালক হিসাবে কালীকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে গঙ্গাধর ভট্টাচার্যের নাম মুদ্রিত হলেও প্রকৃত পরিচালক ছিলেন ‘সম্বাদ ভাস্কর’এর সম্পাদক গৌরীশঙ্কর তর্কবাগীশ ( গুড়গুড়ে ভট্টাচার্য নামেই পরিচিত ছিলেন )। অবশ্য পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়েছিল “পাপের দমন ও ধর্ম্মানুষ্ঠানে প্রবৃত্তি দিবার জন্য” ; কিন্তু পরিবেশিত হত অকথ্য গালিগালাজ ও অশ্লীল লেখা। এ ধরণের লেখা প্রকাশিত হত বলেই, এর গ্রাহক সংখ্যা ছিল অন্যান্য সংবাদপত্রের চেয়ে অনেক বেশী। পত্রিকাটি সম্বন্ধে মহেন্দ্রনাথ বিদ্যানিধি ব্যঙ্গ করে লিখেছেন – “ইহা নামের অন্বর্থতা করিয়াছিল। ‘রসরাজ’ সত্যই ‘রসরাজ’; এত রস পত্রিকায় থাকিত যে, সপ্তাহে সপ্তাহে বিতরিত হইয়াও, উহা নীরস হয় নাই-বরং বরাবর সরসই হইয়া উঠিয়াছিল। শেষে রসের ছড়াছড়িতে দেশ উন্মত্তপ্রায় হয়।” ‘রসরাজ’ কাউকেই রেহাই দেয় নি। কাশিমবাজারের রাজা কৃষ্ণনাথ রায় ও রাণী স্বর্ণময়ী সম্বন্ধে কুৎসা প্রচার করায় তারা মানহানির মামলা করেন এবং ১৮৪৩ সালের ১৭ই জানুয়ারি গৌরীশঙ্কর সুপ্রিম কোর্টে দোষী সাব্যস্ত হন। জামিনের টাকা ছাড়াও তার ছ’মাস কারাদণ্ড ও পাঁচ’শ টাকা জরিমানা হয়। এই ঘটনার পরেই ‘রসরাজে’র উপর সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হন এবং পত্রিকাটির অন্তিম কাল ঘনিয়ে আসে। তবে ‘রসরাজে’র কিছু কিছু দৃষ্টিভঙ্গি প্রশংসিতও হয়েছে। বিধবা বিবাহের যথার্থতা, বাল্যবিবাহের কুফল এবং স্ত্রী-শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা পত্রিকাটি খুব জোরালো ভাবে তুলে ধরেছিল। অনেকে মনে করেন, বিধবাবিবাহ প্রসঙ্গে রক্ষণশীলদের নিন্দা করায় রাজা রাধাকান্ত, রাজা কমলকৃষ্ণ প্রমুখ ব্যক্তিদের সমর্থন হারিয়ে ১৮৫৭-এর ফেব্রুয়ারি মাসে গৌরীশঙ্কর পত্রিকাটি বন্ধ করে দিতে মনস্থ করেন। ১৮৫৯ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি গৌরীশঙ্করের মৃত্যুর পর তার পালিত পুত্র ক্ষেত্রমোহন ভট্টাচার্য পত্রিকাটি পুনঃপ্রকাশ করেন, কিন্তু ‘রসরাজ’ তার পূর্ব স্বভাব ছাড়তে পারে নি।
যাই হোক ঈশ্বরচন্দ্র ‘পাষণ্ড পীড়ন’ প্রকাশ করেন ১৮৪৬ সালের ২০শে জুন (১২৫৩ বঙ্গাব্দের ৭ই আষাঢ় )। পত্রিকাটি প্রভাকর যন্ত্রে মুদ্রিত হত এবং সম্পাদক ছিলেন সীতারাম ঘোষ নামে এক ব্যক্তি। কিন্তু ১২৫৪ বঙ্গাব্দের ভাদ্র মাসে,‘রসরাজ’ ও ‘পাষণ্ড পীড়নে’র বিতণ্ডা যখন তুঙ্গে, সীতারাম ঘোষ ‘পাষণ্ড পীড়ন’-এর “হেডিং”টি নিয়ে পালিয়ে যান এবং পত্রিকাটির প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে ঈশ্বরচন্দ্র ১২৫৯ ১লা বৈশাখের ‘সংবাদ প্রভাকর’-এ জানিয়েছেন : “১২৫৩ সালের আষাঢ় মাসের সপ্তম দিবসে প্রভাকর যন্ত্রে পাষণ্ড পীড়নের জন্ম হইল। ইহাতে পূর্ব্বে কেবল সর্ব্বজন-মনোরঞ্জন প্রকৃষ্ট প্রবন্ধপুঞ্জ প্রকটিত হইত,পরে ৫৪ সালে কোন বিশেষ হেতুতে পাষণ্ড পীড়ন,পাষণ্ডপীড়ন করিয়া,আপনিই পাষণ্ড হস্তে পীড়িত হইলেন। অর্থাৎ সীতারাম ঘোষ নামক জনেক কৃতঘ্ন ব্যক্তি যাহার নামে এই পত্র প্রচারিত হয়,সেই অধার্ম্মিক ঘোষ বিপক্ষের সহিত যোগদান করতঃ ঐ সালের ভাদ্র মাসে পাষণ্ডপীড়নের হেড চুরি করিয়া পলায়ন করিল, সুতরাং আমাদিগের বন্ধুগণ তৎপ্রকাশে বঞ্চিত হইলেন। ঐ ঘোষ উক্ত পত্র ভাস্করের করে দিয়া পাতরে আছড়াইয়া নষ্ট করিল।” অবশ্য ‘হেড’ চুরি করলে পত্রিকা প্রকাশ বন্ধ করে দেবার মত সিদ্ধান্ত কেন নিতে হয়েছিল, বোঝা শক্ত। অনায়াসেই নতুন একটি ‘হেড’ তৈরি করে নেওয়া যেত। এই প্রশ্নই তুলেছেন মহেন্দ্রনাথ বিদ্যানিধি। তিনি মন্তব্য করেছেন – “যে কারণে ‘পাষণ্ড-পীড়ন’ মরণ ক্লেশ সহ্য করিল, তাহা অতি অকিঞ্চিৎকর । পুনরায় হেড প্রস্তুত করিয়া পত্রিকা ছাপান কি এতই গুরুতর হইয়া উঠিয়াছিল যে, তাহা কার্য্যে পরিণত করা একান্ত অসাধ্য কাণ্ড, না অঘটন-ঘটনা ?”
‘পাষণ্ড পীড়ন’ বন্ধ হয়ে গেলে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত ‘সংবাদ সাধুরঞ্জন’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। প্রতি সোমবার এটি প্রকাশিত হত এবং এর সঙ্গে ‘সংবাদ প্রভাকর’-এর কোন যোগ ছিল না। ১২৬৬ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাস পর্যন্ত পত্রিকাটি চলেছিল।
লেখক পরিচিতি : বহু বছর বি.ই. কলেজে (এখন ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, শিবপুর ( IIEST,shibpur )) অধ্যাপনা করেছেন। কিছুদিন হল অবসর নিয়েএখন সেখানে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে আছেন। অ্যাপ্লায়েড মেকানিক্স নিয়ে গবেষণা করলেও একাধিক বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে - জ্যোতিষশাস্ত্র, পুরনো কলকাতার সংস্কৃতি, ইত্যাদি। অবসর সময়ে 'অবসরে'র সঙ্গে সময় কাটান।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।