পুরানো সাময়িকী ও সংবাদপত্র
নভেম্বর ৩০, ২০১৪
তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা
দীপক সেনগুপ্ত
সাময়িক পত্রিকার ইতিহাসে ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’ একটি উল্লেখযোগ্য স্থান অধিকার করে রয়েছে। ১৮৩৯ সালের ৬ই অক্টোবর মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর 'তত্ত্ববোধিনী সভা' প্রতিষ্ঠা করেন। এই সভার উদ্দেশ্য ছিল : “ব্রাহ্ম সমাজ যাহাতে স্থানে স্থানে স্থাপিত হয়, এবং যে রূপেতে সর্ব্বোৎকৃষ্ট পরম ধর্ম্ম বেদান্ত প্রতিপাদ্য ব্রহ্মবিদ্যার প্রচার হয়, তাহার সাধন।” চার বছর পর ১৭৬৫ শকাব্দের ১লা ভাদ্র (১৮৪৩ খৃষ্টাব্দের ১৬ই আগষ্ট) ঐ সভার তথা ব্রাহ্ম সমাজের মুখপত্র হিসাবে ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’ প্রকাশিত হয়। হিন্দুধর্মের পৌত্তলিক প্রথা , অবতার তত্ত্ব ও ভাবাবেগকে নিন্দা করে ব্রাহ্মধর্মের মূল আদর্শ তুলে ধরা এবং অবশ্যই সেই সঙ্গে বিজ্ঞান এবং স্ত্রীশিক্ষা বিষয়ক বিবিধ রচনা প্রকাশ পত্রিকাটির মূল উদ্দেশ্য ছিল।
সে সময়ে ‘সম্বাদ রসরাজ’(১৮৩৯), ‘সংবাদ সুজনরঞ্জন’ (১৮৪০) ইত্যাদি যে সব পত্রিকা চালু ছিল সেগুলি অধিকাংশই পারস্পরিক বিবাদ ও বিতর্কে লিপ্ত ছিল এবং প্রায়ই কুরুচিকর ভাষা ব্যবহৃত হত। ১৮৪২ খ্রীষ্টাব্দের জুন মাসে অক্ষয়কুমার দত্ত ও টাকির প্রসন্নকুমার ঘোষের উদ্যোগে ‘বিদ্যাদর্শন’ নামে একটি মাসিক পত্র প্রকাশিত হয়েছিল। পত্রিকাটি ছিল উচ্চ মানের কিন্তু মাত্র ছয় সংখ্যার পর এটি বন্ধ হয়ে যায়। এ দেখেই হয় ত মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মনে একটি আদর্শ পত্রিকা প্রকাশ করার ইচ্ছা জেগে ওঠে এবং এর ফলেই ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’র জন্ম। পত্রিকাটির প্রথম সম্পাদক ছিলেন অক্ষয় কুমার দত্ত ১৮৪৩ থেকে ১৮৫৫ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত। মহর্ষি অবশ্য চাইছিলেন পত্রিকাটিতে শুধু ধর্ম বিষয়ক প্রবন্ধই প্রকাশিত হোক ; কিন্তু সম্পাদক অক্ষয় কুমার দত্ত বিজ্ঞান বিষয়েও লেখা প্রকাশ করেন। প্রথমে তার পারিশ্রমিক ছিল ৩৯ টাকা; কিন্তু তার দক্ষ পরিচালনার জন্য সেটা বেড়ে ৪৫ টাকা এবং পরে ৬০ টাকা হয়েছিল। পত্রিকাটির উদ্দেশ্য অক্ষয়কুমার প্রথম সংখ্যায় বিশদ ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তার কয়েকটি হল :
“তত্ত্ববোধিনী সভার অনেক সভ্য পরস্পর দূর দূর স্থায়ী প্রযুক্ত সভার সমুদয় উপস্থিত কার্য্য সর্ব্বদা জ্ঞাত হইতে পারেন না, সুতরাং ব্রহ্মজ্ঞানের অনুশীলনা এবং উন্নতি কি প্রকার হইবেক ? অতএব তাহারদিগের এ সকল বিষয়ের অবগতি জন্য এই পত্রিকাতে সভার প্রচলিত কার্য্য বিষয়ক বিবরণ প্রচার হইবেক।
“.... পরব্রহ্মের উপাসনার প্রকার এবং তাঁহার স্বরূপ লক্ষণ জ্ঞাপনার্থে এবং সর্ব্বোপাসনা হইতে পরব্রহ্মের উপাসনা সর্ব্বোৎকৃষ্ট হইয়াছে ইহা জানাইবার নিমিত্তে আমারদিগের শাস্ত্রের সারমর্ম্ম সংগৃহীত হইবেক। বিচিত্র শক্তির মহিমা জ্ঞাপনার্থে সৃষ্ট বস্তুর বর্ণনা এবং অনন্ত বিশ্বের আশ্চর্য্য কৌশল প্রকাশিত হইবেক।
“কুকর্ম্ম হইতে নিবৃত্ত হইবার চেষ্টা না থাকিলে ব্রহ্মজ্ঞানে প্রবৃত্তি হয় না অতএব যাহাতে লোকের কুকর্ম্ম হইতে নিবৃত্তি থাকিবার চেষ্টা হয় এবং মন পরিশুদ্ধ হয় এমত সকল উপদেশ প্রদত্ত হইবেক।”
এ ছাড়া মিশনারীদের ক্রমাগত হিন্দু ধর্মের বিরুদ্ধে অপপ্রচার রুখতে জনমত গঠন করা এবং খৃষ্টধর্ম গ্রহণের জন্য মানুষকে প্ররোচিত করার অপচেষ্টাকে প্রতিহত করাও ছিল পত্রিকাটির অপর একটি লক্ষ্য। বলপূর্ব্বক ধর্ম পরিবর্তন এবং সে বিষয়ে ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’র ভূমিকার একটি সংবাদ মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আত্মজীবনী’ থেকে জানা যায়। মহর্ষি লিখেছেন :
“ ১৭৬৭ শকের বৈশাখ মসের একদিন প্রাতঃকালে সংবাদপত্র দেখিতেছি এমন সময় আমাদের হাউসের সরকার রাজেন্দ্রনাথ সরকার আমার নিকট কাঁদিয়া আসিয়া উপস্থিত হিল। বলিল যে গত রবিবার আমার স্ত্রী ও আমার কণিষ্ঠ ভ্রাতা উমেশচন্দ্রের স্ত্রী, দুইজনে একখানা গাড়িতে চড়িয়া নিমন্ত্রণে যাইতেছিলেন; এমন সময় উমেশচন্দ্র আসিয়া তাহার স্ত্রীকে গাড়ি হইতে জোর করিয়া নামাইয়া লয়, এবং উভয়ে খ্রীষ্টান হইবার জন্য ডফ সাহেবের বাড়ীতে চলিয়া যায়। আমার পিতা অনেক চেষ্টা করিয়া তাহাদিগকে সেখান হইতে ফিরিয়া আনিতে না পারিয়া, অবশেষে সুপ্রীমে কোর্টে নালিশ করেন। নালিশে সে-বার আমাদের হার হয়। কিন্তু আমি ডফ সাহেবের নিকটে গিয়া অনুনয় বিনয় করিয়া বলিলাম যে, আমরা আবার কোর্টে নালিশ আনিব। দ্বিতীয়বার বিচারের নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত আমার ভ্রাতা ও ভ্রাতৃবধূকে খ্রীষ্টান করিবেন না। কিন্তু তিনি তাহা না শুনিয়া গত কল্যই সন্ধ্যার সময় তাহাদিগকে খ্রীষ্টান করিয়া ফেলিয়াছেন।”
এই বলিয়া রাজেন্দ্রনাথ কাঁদিতে লাগিল। এর পর রাজেন্দ্রনাথের অনুরোধে অক্ষয়কুমার দত্তকে অনুরোধ করেন একটি জোরালো প্রতিবাদ তুলে ধরার জন্য। দেবেন্দ্রনাথের ভাষায –“
আমি অক্ষয়কুমারের লেখনীকে চালাইলাম এবং একটি তেজস্বী প্রবন্ধ তত্ত্ববোধিনী পত্রিকাতে প্রকাশ হইল।” অত:পর বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে একটি সভা সংগঠিত হয় এবং সিদ্ধান্ত হয় যে মিশনারি স্কুলে ছেলেদের পড়াশোনা বন্ধ করতে বিনা বেতনে পড়বার জন্য একটি দেশী বিদ্যালয় স্থাপন করা হবে। চল্লিশ হাজার টাকা অনুদান সংগৃহীত হয়। মহর্ষি জানিয়েছেন –“এই অবৈতনিক বিদ্যালয়ের প্রথম শিক্ষক শ্রীযুক্ত ভূদেব মুখোপাধ্যায় নিযুক্ত হন। সেই অবধি খ্রীষ্টান হইবার স্রোত মন্দীভূত হিল, একেবারে মিশনরিদিগের মস্তকে কুঠারাঘাত পড়িল।”
অক্ষয়কুমার দত্তের পর পর্যায়ক্রমে ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮৫৬); নবীনকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৫৭); সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৫৯-৬০); তারকনাথ দত্ত (১৮৬১); আনন্দচন্দ্র বেদান্তবাগীশ ( ১৮৬২ ); প্রতাপ চন্দ্র মজুমদার (১৮৬৩); অযোধ্যানাথ পাকড়াশী (১৮৬৪-৬৬, ১৮৬৯,১৮৭২-৭৭ ); হেমচন্দ্র বিদ্যারত্ন (১৮৬৭-৬৮, ১৮৭৮-৮৩, ১৯০২); দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৭০,১৮৮৪-১৯০১,১৯০৬); অযোধ্যানাথ পাকড়াশী ও আনন্দচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৭১) ; দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও হেমচন্দ্র বিদ্যারত্ন (১৯০৩-০৫); দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও চিন্তামনি চট্টোপাধ্যায় (১৯০৯-১০); রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৯১১-১৪); সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৯১৫-২১); ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৯২২-২৫ ,১৯৩১); ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বনোয়ারী লাল চৌধুরী ও ক্ষেমেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৯২৬-২৯); ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বনোয়ারী লাল চৌধুরী (১৯৩০) সম্পাদনার কাজ করেছেন।
পত্রিকার সম্পাদক নির্বাচনের জন্য রীতিমত পরীক্ষা নেওয়া হয়। মহর্ষি ইচ্ছুক প্রার্থীদের ‘বেদান্ত ধর্ম্মানুযায়ী সন্ন্যাস ধর্ম্মের এবং সন্ন্যাসীদের প্রশংসাবাদ’ বিষয়ে একটি প্রবন্ধ রচনার আহ্বান করেন। অক্ষয়কুমার দত্ত, ভবানীচরণ সেন প্রমুখ ব্যক্তিরা রচনা পাঠান। এদের মধ্যে অক্ষয়কুমারের রচনাই উৎকৃষ্ট বিবেচিত হওয়ায় তিনিই সম্পাদক পদে মনোনীত হন। পরে বহু বিষয়ে মহর্ষির সঙ্গে অক্ষয়কুমারের মতবিরোধ ঘটলে, মহর্ষি অক্ষয়কুমারের মতই গ্রহন করেন এবং পরিশেষে অক্ষয়কুমারের গুণগ্রাহী হয়ে ওঠেন।
মুলতঃ সাধুভাষায় লিখিত পত্রিকার রচনাগুলি ভাষার প্রেক্ষিতে পরবর্তী অনেকের কাছেই গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়েছিল। তবে সে সময়ে ব্যবহৃত ‘তোমারদিগের’, ‘আমারদিগের’, ‘করিবেক’, ‘যাইবেক’ প্রভৃতি শব্দগুলি অক্ষয়কুমার পরিবর্তন করেন।
“তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা”র উৎকর্ষ ও বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করতে কেদারনাথ মজুমদারের লেখা থেকে উধৃতি দেওয়া যাক :
“তত্ত্ববোধিনীর প্রচার হইতেই প্রকৃত প্রস্তাবে বাঙ্গালা দেশে প্রকৃত বাঙ্গালা সাহিত্যের আলোচনা আরম্ভ হয়। তত্ত্ববোধিনীর পূর্ব্বে যে সমস্ত পত্র-পত্রিকায় সাহিত্যালোচনা হইত, প্রকৃতপক্ষে তাহাতে শিক্ষণীয় বিষয় কিছুই থাকিত না। বাদ-প্রতিবাদ, ছড়া-কবিতা এবং হাসি-ঠাট্টাই সে গুলির আলোচ্য বিষয় ছিল। ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’ বাঙ্গালা সাহিত্যের আসরে গুরুগম্ভীর আসন লইয়া উচ্চ দর্শন বিজ্ঞান ও নৈতিক আলোচনার সূত্রপাত করিলেন। অক্ষয়কুমারের সংগৃহীত প্রাচ্য ও প্রতীচ্য ভাবসমূহ তাঁহার তেজস্বিনী ও হৃদয়গ্রাহিণী ভাষায় প্রচারিত হইতে লাগিল। অক্ষয়কুমারের সহিত বিদ্যাসাগর মিলিত হইলেন। ঈশ্বরচন্দ্রের মধুর লেখনীনিঃসৃত মহাভারতের অমৃত সমান কথা তত্ত্ববোধিনীর অঙ্গে সোনায় সোহাগার কার্য করিল। তারপর রামমোহন রায়ের অপ্রকাশিত গ্রন্থসমূহ, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের উপনিষদের অনুবাদ ও ব্রাহ্মধর্ম্ম সম্বন্ধীয় প্রবন্ধাবলী, রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশের ব্রাহ্মধর্ম্ম ব্যাখ্যান ও রাজনারায়ন বসুর বক্তৃতা এবং তত্ত্বকথা তত্ত্ববোধিনীকে সহজেই সম্মানের আসনে প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হইল।”
অন্যান্য পত্রিকা থেকে ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’র রুচিবোধ যে পৃথক ছিল সেটা তুলে ধরতে একটি ঘটনার উল্লেখ করা যেতে পরে। নিরামিষ ভোজনের শ্রেষ্ঠতা বিষয়ে ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’য় প্রবন্ধ প্রকাশিত হলে অনেক তরুণ যুবক আমিষ ত্যাগ করে নিরামিষ খেতে শুরু করেন এবং এ বিষয়ে প্রচার কার্য চালান। এমন কি ‘নিরামিষভোজী পত্রিকা’ নামেও একখানি পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল। সমাজ জীবনে পত্রিকাটি এতটাই প্রভাব বিস্তার করেছিল যে, মদ্যপানের বিরুদ্ধে অক্ষয়কুমার প্রবন্ধ প্রকাশ করলে অনেক উচ্চপদস্থ ব্যক্তিও মদ্যপান ত্যাগ করেন। যাই হোক, কোন কারণে পত্রিকা সম্পাদক অক্ষয়কুমার দত্ত সে সময়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার অসুস্থতার কারণ নিরামিষ ভোজন ধরে নিয়ে ‘সংবাদ প্রভাকর’-সম্পাদক ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত যথারীতি একটি দীর্ঘ ব্যঙ্গ-কবিতা রচনা করে ছাপালেন। কবিতাটির শুরুর কয়েকটি পংক্তি হল -
“আমিষ অবিধি বলে যে করেছে গোল।
সে এখন নিত্য খায় শামুকের খোল।।
নোদে শান্তিপুর ফিরে,ফিরিয়া হুগলি।
শেষ করিয়াছে যত দেশের গুগলি।।
নিরামিষ আহারেতে ঠেকেছেন শিখে।
ঘুরিতেছে মাথা মুণ্ড,মাথা মুণ্ড লিখে ।।” ... ইত্যাদি।
পত্রিকাতে প্রকাশের উপযুক্ত প্রবন্ধ নির্বাচনের জন্য বিদ্বজ্জনদের নিয়ে একটি নির্বাচক মণ্ডলী তৈরী হয়েছিল। এতে ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রাজনারায়ন বসু , রামমোহন রায়ের পুত্র রাধাপ্রসাদ রায়, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর , আনন্দকৃষ্ণ বসু প্রমুখ বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ। বিদ্যাসাগর তার মহাভারতের উপক্রমণিকা এই পত্রিকায় প্রকাশ করেছিলেন। অক্ষয়কুমারের সম্পাদনাকালে তত্ত্ববোধিনীর গ্রাহক সংখ্যা হয়েছিল ৭০০। অক্ষয়কুমারের পাণ্ডিত্যে মুগ্ধ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তাকে স্কুল সমূহের সহকারী পরিদর্শকের পদ গ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ করেন; কিন্তু পত্রিকার সম্পাদনায় তিনি তখন এতই নিবেদিত যে দেড়’শ টাকা পারিশ্রমিকের পদ তিনি অনায়াসেই প্রত্যাখান করেন। কিন্তু এটা ছিল নিতান্তই সাময়িক। ১৮৫৪ সালে কলকাতায় নর্ম্যাল স্কুল স্থাপিত হলে শিক্ষাবিভাগের নির্দেশক ইয়াং সাহেবের আবেদনে সাড়া দিয়ে তিনি স্কুলের প্রধান শিক্ষকের পদ গ্রহণ করেন। সম্পাদকের পদ থেকে অক্ষয়কুমারের বিদায় গ্রহণের পরেই তত্ত্ববোধিনীর চাহিদা ক্রমশঃ কমতে থাকে। ব্রাহ্মধর্ম প্রচারের ক্ষেত্রে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। এই পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধ পড়ে ব্রজসুন্দর মিত্র ব্রাহ্মধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং ঢাকায় ব্রাহ্মধর্ম প্রচারে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেন।
ফুলস্কেপ কাগজের আকারে প্রকাশিত ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’র পৃষ্ঠা সংখ্যা ছিল আট থেকে বার। তত্ত্ববোধিনী সভার সভ্যদের জন্য মূল্য ছিল বার্ষিক তিন টাকা। পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যায় ছিল - (১) ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’ প্রকাশের ভূমিকা। (২) শ্রীযুক্ত রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ ভট্টাচার্য্য কর্ত্তৃক ব্রাহ্মসমাজের ব্যাখ্যান। (৩) বংশবাটি গ্রামে তত্ত্ববোধিনী পাঠশালা স্থাপন বিষয়ে প্রথম বক্তৃতা। (৪) ‘বেদান্ত শাস্ত্রের উপদেশ গ্রহন করা গৃহস্থ ব্যক্তির অত্যাবশ্যক’ এই মর্মে একটি উপদেশবাণী। (৫) ‘মহত্মা শ্রীযুক্ত রাজা রামমোহন রায় কর্ত্তৃক বাজসনেয় সংহিতোপনিষদের ভাষ্য বিবরণের ভূমিকার চূর্ণক’।
পরিশেষে রয়েছে একটি বিজ্ঞপ্তি – “শ্রীযুক্ত তারকনাথ বসু এবং শ্রীযুক্ত অভয়চরণ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়েরা দ্বাদশ মাসের স্বীয় স্বীয় দাতব্য প্রদান না করাতে প্রচলিত নিয়মানুসারে এই সভার সভ্য শ্রেণী হইতে রহিত হইলেন।”
চলার পথে পত্রিকাটির অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। যেমন, বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়েছে; শকাব্দর পরিবর্তে বঙ্গাব্দ দিয়ে সংখ্যা চিহ্নিত হয়েছে; সূচীপত্র সংযোজিত হয়েছে; পুস্তক সমালোচনার একটি বিভাগ যুক্ত হয়েছে ইত্যাদি। ১৯৩১ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত পত্রিকাটি চলেছিল। ক্ষিতীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর এটির প্রকাশ বন্ধ হয়। দীর্ঘ প্রায় ৯০ বছর ধরে চলার একটি কারণ, পত্রিকাটি ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে যুক্ত ছিল বলে বহু গণ্য মান্য ব্যক্তির সমর্থন ছিল এটির পিছনে এবং অর্থের সে রকম অভাব ঘটে নি।
চিত্র ১ ও ২ – পত্রিকার আখ্যাপত্রের দু’টি প্রতিলিপি।
চিত্র ৩ – ১৮২৫ শকাব্দে প্রকাশিত একটি হিসাব ও বিজ্ঞাপন।
চিত্র ৪ – ১৮৪৯ শকাব্দে প্রকাশিত একটি মিষ্টান্ন ভান্ডারের বিজ্ঞাপন।
চিত্র ৫ - ১৩৩৮ বঙ্গাব্দ বৈশাখে প্রকাশিত বিখ্যাত ডি. গুপ্ত ও সাধনা ঔষধালয়ের বিজ্ঞাপন।
( কোন প্রতিলিপি বড় করে দেখতে হলে ctrl টিপে রেখে + টিপুন। যত + টিপবেন তত বড় হবে। )
লেখক পরিচিতি : বহু বছর বি.ই. কলেজে (এখন ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, শিবপুর ( IIEST,shibpur )) অধ্যাপনা করেছেন। কিছুদিন হল অবসর নিয়েএখন সেখানে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে আছেন। অ্যাপ্লায়েড মেকানিক্স নিয়ে গবেষণা করলেও একাধিক বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে - জ্যোতিষশাস্ত্র, পুরনো কলকাতার সংস্কৃতি, ইত্যাদি। অবসর সময়ে 'অবসরে'র সঙ্গে সময় কাটান।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।