পুরানো সাময়িকী ও সংবাদপত্র
ডিসেম্বর ১৫, ২০১৪
সত্যপ্রদীপ
দীপক সেনগুপ্ত
‘সত্যপ্রদীপ’ নামে দুটি পত্রিকা ছিল। প্রথমটি ছিল একটি সাপ্তাহিক সংবাদপত্র। শ্রীরামপুর থেকে প্রতি শনিবার শ্রীমেরিডিথ টৌসেণ্ড এটি প্রকাশ করতেন। প্রথম প্রকাশিত হয ১৮৫০ সালের ৪ঠা মে (২৩শে বৈশাখ ১২৫৭ )। পত্রিকাটির শেষ সংখ্যার প্রকাশকাল ২৬শে এপ্রিল, ১৮৫১। এর পরিবর্তে ১৮৫১ খ্রীষ্টাব্দের ৩রা মে শনিবার শ্রীরামপুর থেকে বন্ধ হয়ে যাওয়া ‘সমাচার দর্পণ’ নবপর্যায়ে প্রকাশিত হয়েছিল। পত্রিকার শেষ সংখ্যায় প্রকাশিত “পাঠক মহাশয়বর্গের প্রতি সত্যপ্রদীপের বিনীতপূর্ব্বক প্রণতি” শিরোনামে জানান হয়েছে – “মদীয় বর্ত্তমান আকৃতি প্রকৃতি সমুচিত বচনাদি দর্শন পঠন বোধনার্থ আর মহাশয়েরদের সমীপস্থ হইবে না। ... আগামী সপ্তাহে সমাচার দর্পণ সুবেশে মহামহিম পাঠকগণের সুচারু করকমলগত হইবেক। তাহাতে প্রদীপের প্রতিবিম্বও দর্পণে সংলগ্ন হইয়া দ্বিগুণ দীপ্তি প্রদর্শক হইবেক ”।
দ্বিতীয় ‘সত্যপ্রদীপ’ প্রকাশিত হয় সচিত্র মাসিক পত্র হিসাবে ১৮৬০ সালের জানুয়ারী মাসে; প্রকাশক ছিল খৃষ্টান ভার্নাকুলার এডুকেশন সোসাইটির বঙ্গীয় শাখা এবং সম্পাদক ছিলেন পাদ্রি স্ট্যাবো। এটিকে বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম শিশুপাঠ্য পত্রিকা হিসাবে চিহ্ণিত করা হয়েছে। লণ্ডনে প্রতিষ্ঠিত খৃষ্টান ভার্নাকুলার এডুকেশন সোসাইটি ভারতের বিভিন্ন স্থানে তার কার্যালয় স্থাপন করে কাজ শুরু করেন। রেভারেণ্ড জন মার্ডাক ( Rev. John Mardoch ) বাংলাদেশে এসে বিভিন্ন পুস্তক রচনার পরিকল্পনা করেন। শিশুদের দিকে দৃষ্টি দেবার মূল উদ্দেশ্য ছিল অল্প বয়স থেকেই তাদের সামনে খুব সহজ সরল ভাষায গল্পের মাধ্যমে খৃষ্টধর্মের সারমর্ম তুলে ধরা এবং এই ধর্ম পালনে অনুপ্রাণিত করা। তবে এগুলির মধ্যে বেশ কিছু নীতিকথা ও উপদেশ যে তাদের চরিত্র গঠনেরও সহায়ক ছিল তাতে সন্দেহ নেই। ‘সত্যপ্রদীপ’-এর কোন সংখ্যাতে প্রকাশনার বছর বা পত্রিকার সংখ্যা উল্লেখ করা থাকত না।
পুস্তকের “ভূমিকা”য় বলা হয়েছে –
“হে প্রিয় বালক ও বালিকাগণ; তোমাদের নিমিত্তেই এই পত্রিকা প্রস্তুত হইতেছে। ইহা অল্প মূল্যে বিক্রীত হইবে। সুতরাং তোমরা দরিদ্র হইলেও অনায়াসে এই পত্রিকা ক্রয় করিতে পারিবা। এবং তোমরা যেন বুঝিতে পার এই জন্যে সরল বাক্য প্রয়োগ করিব ও মনোরম্য পাঠে ইহা পরিপূরিত থাকিবে। ইহাতে সুন্দর ২ গল্প লিখা যাইবে। পৃথিবীর যে ২ স্থলে আশ্চর্য্য ঘটনা বা চমৎকার কাণ্ড হইয়া থাকে, সেই ২ স্থানের বিবরণ পড়িতে পাইবা। আর যে সকল বৃত্তান্ত আজ পর্য্যন্ত উত্তম রূপে বুঝিতে পার নাই, অর্থাৎ বাষ্পীয় পৌত, বৈদ্যুৎ যন্ত্র, বারুদ, পশুজাতির বার্ত্তা, মহাশয় লোকদের জীবন চরিত, ইত্যাদি যত প্রকার উপদেশ দ্বারা তোমাদের জ্ঞান জন্মাইবার সম্ভাবনা, ও উত্তর কালে তোমরা সৎ মনুষ্য ও সতী নারী হইতে পার, সকলি লিখিব। প্রত্যেক পত্রিকায় দুই একটি সুদৃশ্য ছবি থাকিবে, এবং সত্য ধর্ম্ম, অর্থাৎ প্রভু যীশুর বৃত্তান্তও তোমরা মধ্যে ২ শুনিতে পাইবা।
“অতএব তোমরা মনোযোগ পূর্ব্বক পাঠ করিও। কেবল তোমরা পাঠ করিবা তাহা নয়। তোমাদের পিতামাতা ও ভ্রাতা ভগিনীকেও শ্রবণ করাইও। প্রতি মাসে এই পত্রিকা মুদ্রাঙ্কিত হইবেক। মূল্য এক পয়সা মাত্র। যদি সাবধান পূর্ব্বক রাখ, তবে প্রতি বৎসর তবে প্রতি বৎসর এক ২ খানি উত্তম পুস্তক হইবে। তোমরা যতনপূর্ব্বক পাঠ করিলে, আমাদের শ্রম সফল জ্ঞান করিব। ইতি”।
এই পত্রিকাটিতে নীতিকথা ছাড়াও ভূগোল,পশুপক্ষীর বর্ণনা,সাধারণ জ্ঞান,ছোট ছোট গল্পের মাধ্যমে কিছু উপদেশ দান করা হয়েছে। একদিকে যেমন ছোটদের বিজ্ঞান মনস্ক করে তোলার চেষ্টা হয়েছে তেমনি যিশুখৃষ্টের জীবন কাহিনী ও খৃষ্ট ধর্ম সম্বন্ধে যে সব কথা বলা হয়েছে তাতে যুক্তিহীনতা ও কুসংস্কারকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে বলে অনেকে মনে করতে পারেন। ধর্ম সম্বন্ধে খৃষ্টধর্ম প্রচার ও গোঁড়ামিকেও স্থান দেওয়া হয়েছে; যেমন পত্রিকার একটি সংখ্যায় ‘খ্রীষ্ট দত্ত শেষ আজ্ঞা’ শিরোনামে বলা হয়েছে :
“ তোমরা পৃথিবীর সমস্ত দেশে যাইয়া আমার সুসমাচার ঘোষণা কর। যে কেহ আমাকে বিশ্বাস করত বাপ্তাইজিত হইবে সে পরিত্রাণ পাইবে ; কিন্তু যে কেহ বিশ্বাস করিবে না সে বিনষ্ট হইবে।”
প্রকাশিত রচনার কিছু নমুনা দেওয়া যাক। সেই পরিচিত শেয়াল ও আঙুর ফলের গল্প পত্রিকাটিতে ‘এক শৃগাল ও দ্রাক্ষাফলের বৃত্তান্ত’ শিরোনামে এইভাবে প্রকাশিত হয়েছে :
“এক ক্ষুধার্ত্ত শৃগাল একটা দ্রাক্ষাক্ষেত্র দিয়া গমন করিতেছিল। তথায় দ্রাক্ষাফল সুপক্ক হওয়াতে শৃগালের তাহার প্রতি লোভ জন্মিল। কিন্তু প্রাচীরের উচ্চভাগে সংলগ্ন থাকাতে ফল প্রাপ্ত হইতে পারিল না; তথাপি শৃগাল অতিশয় লোভ প্রযুক্ত অনেক লম্ফ দিতে লাগিল। অবশেষে হতাশ ও ক্লান্ত হওত দ্রাক্ষা ফলের ও আপনার প্রতি বিরক্ত হইয়া উঠিল, এবং “দ্রাক্ষা ফল বড় টক ” ইহা বলিতে ২ গমন করিল।
“
পাঠক উপরোক্ত গল্পের তাৎপর্য্য এই, মানুষ যখন অভিলষিত বস্তু না পায় তখন প্রায় ক্রোধের অধীন হইয়া থাকে,এবং তদ্বিরুদ্ধে কথা বলে; কিন্তু এ প্রকার করা অনুচিত।”
আবার সাধারণ উপদেশাবলীও লিপিবদ্ধ হযেছে; যেমন :
“ অনেক ঊর্দ্ধ্বে উঠিও না, কি জানি মহৎ পতন হইবেক।
স্বীকৃত দোষের অর্দ্ধেক দুষ্যতা হ্রাস পায়।
জিহ্বা দমন কর, নতুবা সে তোমায় দমন করিবে।
বৃহৎ জাহাজও ক্ষুদ্র ছিদ্র দ্বারা জলমগ্ন হইতে পারে।”
ইত্যাদি।
পত্রিকাটিতে আমেরিকায় প্রচলিত ক্রীতদাস প্রথা যে একটি কু-প্রথা এবং এতে যে ঐ সব লোকদের প্রতি অত্যন্ত নিষ্ঠুর ব্যবহার করা হয় সেটাও কিন্তু স্পষ্ট তুলে ধরা হয়েছে :
“আফ্রিকা দেশ হইতে নাবিকেরা বলপূর্ব্বক কিম্বা ক্রয় করিয়া লোকদিগকে আনয়ন করত এই দেশে বিক্রয় করে এবং বিক্রীত হইবার পরে তাহারা যে দুঃখ পায় ও ঐ দেশস্থ লোকেরা তাহারা তাহাদিগকে যে দুঃখ দেয় তাহাই সেই দেশের কুরীতি। ...... কিন্তু ক্ষণেক কালের নিমিত্তে তোমরা চিন্তা করিযা দেখ ঐ দাসদের কত বড় ক্লেশ। প্রাতঃকাল অবধি সন্ধ্যাকাল পর্য্যন্ত ক্রমশঃ তাহাদের কর্ম্ম করিতে হয়। যখন তাহাদের কেহ ক্লান্তি প্রযুক্ত ক্ষণেকের নিমিত্তে বিশ্রাম লয়, তখন তাহাদের কর্ত্তা ঐ বৃত্তান্ত জ্ঞাত হইলে তাহাদিগকে নির্দ্দয় পূর্ব্বক প্রহার করে। ..... তোমরা দাসদিগের প্রতি এমত কঠিনাচার না কর।”
ক্রীতদাস প্রথা যে একটি কুপ্রথা সেটি এবং ক্রীতদাসদের প্রতি অমানুষিক অত্যাচারের চিত্র শিশুদের কাছে তুলে ধরা অবশ্যই প্রশংসনীয়। অনেকে ‘সত্যপ্রদীপ,’কে প্রথম শিশুপাঠ্য পত্রিকা হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। তবে প্রকাশিত অনেক রচনার ভাষা শিশুদের উপযোগী নয়। ইংরেজরা বাংলা শিখে যদি এগুলি লিখে থাকেন তবে তাদের ভাষা জ্ঞানের অভাবই এর জন্য দায়ী বলে মনে হয়। আক্ষরিক অনুবাদ করতে গিয়ে ভাষা সুপ্রযুক্ত হয় নি; যেমন বলা হয়েছে –
“যে জন প্রতিহিংসা অনুসন্ধান করে, সে প্রাপ্ত অপমান কদাচ বিস্মৃত হয় না”
অথবা
“সত্য প্রদীপ পাঠকারি বালক বালিকারা কি পিতা মাতার বশতাপন্ন হইতে , ও ভ্রাতা ভগিনীদিগকে প্রেম করিতে ...... যত্ন পাইতেছে ?”
পত্রিকাটি ১৮৬৪ সাল অবধি চলেছিল ।
হারিয়ে যাওয়া ‘সত্যপ্রদীপ’ আংশিক পুনরোদ্ধার করে গবেষক সাহিত্যিক স্বপন বসু একটি অসাধারণ কাজ করেছেন। তিনি জানিয়েছেন এদেশের কোন পাঠাগারেই ‘সত্যপ্রদীপে’র সন্ধান পাওয়া যায় না। ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দের ১২টি সংখ্যা থাকলেও তা সাধারণের নাগালের বাইরে। বিশিষ্ট ব্যাবহারজীবী অমিত রায়ের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে কয়েকটি সংখ্যা উদ্ধার করেছেন তিনি। পারুল প্রকাশনী সম্প্রতি বইটি প্রকাশ করেছেন। এদের সবারই ধন্যবাদ প্রাপ্য।
লেখক পরিচিতি : বহু বছর বি.ই. কলেজে (এখন ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, শিবপুর ( IIEST,shibpur )) অধ্যাপনা করেছেন। কিছুদিন হল অবসর নিয়েএখন সেখানে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে আছেন। অ্যাপ্লায়েড মেকানিক্স নিয়ে গবেষণা করলেও একাধিক বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে - জ্যোতিষশাস্ত্র, পুরনো কলকাতার সংস্কৃতি, ইত্যাদি। অবসর সময়ে 'অবসরে'র সঙ্গে সময় কাটান।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।