প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

পুরানো সাময়িকী ও সংবাদপত্র

মার্চ ৩০, ২০১৫

 

সোমপ্রকাশ

দীপক সেনগুপ্ত


   
      ১৮৫৮ সালের ১৫ই নভেম্বর ( ১লা অগ্রহায়ণ ১২৬৫ বঙ্গাব্দ ) প্রথমে কোলকাতার চাঁপাতলা প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক ‘সোমপ্রকাশ’| সম্পাদক ছিলেন কলকাতা সংস্কৃত কলেজের সাহিত্যের অধ্যাপক দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ| ‘সোমপ্রকাশ’ ছিল মূলতঃ সংবাদপত্র এবং এতে সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়ে বিভিন্ন লেখা প্রকাশিত হত| প্রকৃতপক্ষে রাজনৈতিক আলোচনা প্রথমে এই পত্রিকাতেই শুরু হয়| পত্রিকাটির প্রকাশনায় পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সহায়তা ও সমর্থন ছিল| ১৮৬২ সালের এপ্রিল মাসে দ্বারকানাথের নিজের গ্রাম চাংড়িপোতায় ছাপাখানা সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়| শিবনাথ শাস্ত্রী তার ‘আত্মচরিত’ গ্রন্থে লিখেছেন – “ইহার কিছুদিন পরেই আমার পিতা আমাদের গ্রামের স্কুলের হেড পণ্ডিতের কর্ম পাইয়া কলিকাতা বাঙ্গালা পাঠশালার কর্ম হইতে বদলি হইয়া বাড়ীতে যান| তখন আমাকে আমার জেষ্ঠ্য মাতুল দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ মহাশয়ের বাসাতে রাখিয়া যান| এখানে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সর্বদা আসিতেন; এবং আমার মাতুলের সহিত কি পরামর্শ করিতেন| পরে শুনিলাম ‘সোমপ্রকাশ’ নামে একখানি সাপ্তাহিক কাগজ বাহির হইতেছে তাহার পরামর্শ চলিতেছে| .... ইহার কিছুদিন পরেই মাতলা রেলওয়ে খুলিল এবং সোমপ্রকাশ যন্ত্র চাঙ্গড়িপোতা গ্রামে মাতুলের বাসভবনে উঠিয়া গেল|”
     একটি বিজ্ঞপ্তিতে জানা যায় –“এই পত্র কলিকাতার দক্ষিণ-পূর্ব, মাতলা রেলওয়ের সোনাপুর ষ্টেসনের দক্ষিণ চাংড়িপোতা গ্রামে শ্রীযুক্ত দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণের বাটীতে প্রতি সোমবার প্রাতে প্রকাশিত হয়|”
     পত্রিকার শিরোদেশে যে শ্লোকটি মুদ্রিত হত সেটি হল :
     “প্রবর্ত্ততাং প্রকৃতিহিতায় পার্থিবঃ, সরস্বতী শ্রুতিমহতী ন হি হীয়তাং|”
     ১৮৬৫ সালের ২রা জানুয়ারী তারিখের ‘সোমপ্রকাশ’-এ প্রকাশিত বিজ্ঞাপন থেকে জানা যায় যে অন্যান্য কাজের চাপে দ্বারকানাথ সম্পাদনার দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ান| বিজ্ঞাপনটি ছিল এই রকম :      

  “আমি ক্রমে ক্রমে নানা কার্য্যে ব্যাপৃত হইয়া পড়িয়াছি| তন্নিবন্ধন, সোমপ্রকাশে যথোচিত মনোযোগ দেওয়া আমার পক্ষে কঠিন হইয়া উঠিয়াছে| অতএব আমি আজি অবধি ইহার সম্পাদকতা ভার অন্য হস্তে সমর্পণ করিলাম| কিন্তু সোমপ্রকাশ আমার প্রতিষ্ঠিত, ইহার প্রতি আমার সবিশেষ যত্ন আছে, অন্য অন্য অবশ্য কর্ত্তব্য কার্য্যের অবিরোধে যতদূর সাধ্য সাহায্য দান দ্বারা ইহার উন্নতি সাধন চেষ্টায় কখন পরাঙমুখ হইব না| শ্রীদ্বারকানাথ শর্ম্মা|”
   

নতুন সম্পাদক হন মোহনলাল বিদ্যাবাগীশ| তবে ব্রজেন্দ্রনাথের লেখা থেকে জানা যায় যে ১৮৭৪ সালে দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ স্বাস্থ্য লাভের উদ্দেশ্যে কাশী গেলে তার ভাগ্নে শিবনাথ শাস্ত্রী পত্রিকাটি পরিচালনা করেছিলেন| কাশী থেকে ফিরে এসে ২৭শে জুলাই থেকে বিদ্যাভূষণ আবার সম্পাদনার ভার গ্রহণ করেন| শিবনাথ শাস্ত্রীও তার ‘আত্মচরিত’-এ এ কথা লিখে গেছেন|     
        স্বদেশপ্রেম ও দেশাত্মবোধ উদ্দীপ্ত করে রচনা প্রকাশের জন্য ‘প্রেস রেগুলেশন অ্যাক্ট’ অনুযায়ী (Press Regulation Act) ১৮৭৯ সালের মার্চ মাসে পত্রিকাটির প্রকাশ বন্ধ করে দেওয়া হয়| এক বছর পরে ১৮৮০ সালের ১৯শে এপ্রিল (৮ই বৈশাখ ১২৮৭) থেকে এটি আবার প্রকাশিত হতে থাকে| এই মর্মে উক্ত সংখ্যায় যে বিজ্ঞাপনটি প্রকাশিত হয়েছিল, সেটি ছিল -   

  “সোমপ্রকাশ সংক্রান্ত বিজ্ঞাপন
     সোমপ্রকাশ নব কলেবর ধারণ করিয়া নূতন স্থানে ও নূতন যন্ত্রে প্রকাশিত হইতে আরম্ভ হইয়াছে| সোমপ্রকাশ কলিকাতা মৃজাপুর দপ্তরিপাড়া কল্পদ্রুম যন্ত্রে মুদ্রিত হইয়া প্রতি সোমবার প্রকাশিত হইবে| বার্ষিক অগ্রিম মূল্য ডাকমাশুল সমেত ১০ টাকা ও ষাণ্মাসিক সাড়ে পাঁচ টাকা [সংখ্যায় মুদ্রিত]| অসমর্থ পক্ষে ডাকমাশুল সহ ৭ টাকা| অসমর্থ পক্ষে মাসিক, ষাণ্মাসিক, বা ত্রৈমাসিক মূল্যের নিয়ম নাই| অগ্রিম মূল্য না পাইলে মফস্বলে সোমপ্রকাশ প্রেরিত হয় না| যাঁহারা সোমপ্রকাশ গ্রহনে ইচ্ছা করেন, তাঁহারা কার্য্যসম্পাদক শ্রীযুক্ত উপেন্দ্র কুমার চক্রবর্ত্তীর নামে পত্র লিখিবেন|”

     মহেন্দ্রনাথ বিদ্যানিধি প্রথম দিকের সাময়িকপত্রের ইতিহাস অনেকটাই লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন| তার অধিকাংশ রচনাই সাময়িক পত্রেই প্রকাশিত হয়েছে, গ্রন্থবদ্ধ না হওয়ায় সেভাবে প্রচারিত হয় নি| ‘জন্মভূমি’ পত্রিকায় তার ‘বাঙ্গালা-সংবাদ-পত্রের ইতিহাস’ নামক প্রবন্ধে ‘সোমপ্রকাশ’ সম্বন্ধে যা লিপিবদ্ধ হয়েছে, সেটা থেকে কিছু প্রাসঙ্গিক অংশ উদ্ধৃত করা হল:
 

    “যাহার আবির্ভাবে ও প্রভাবে সংবাদপত্র-মহলে হুলস্থূল পড়ে, তাহাই ‘সোমপ্রকাশ’| ‘সোমের’ ‘প্রকাশে’ - বিধুর আবির্ভাবে - অন্ধকার দূরীভূত হয়, সেই হেতুই ঐ সাপ্তাহিক সমাচার পত্র, ‘সোমপ্রকাশ’ আখ্যায় আখ্যাত| ইহার অপর অর্থও, না আছে, - এমন নয়| প্রতি সপ্তাহের ‘সোমবারে’ যে সংবাদপত্র, প্রচারিত হইত, তাহা ‘সোমপ্রকাশ’ সংজ্ঞায় অভিহিত হইত ও এখনও হয়| .... 
     “ইংরাজি ১৮৪৩ সাল হইতে ১৮৫৮ সাল পর্য্যন্ত এই একাদশ বৎসরের [?] মধ্যে নানা সংবাদপত্র, প্রকাশিত হয়| ইহার মধ্যে অনেকগুলি জঘন্য| এই সময় ‘আক্কেল গুড়ুম’ নামে একখানি সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়| ইহার লিখন-ভঙ্গী দেখিয়া, লোকের ‘আক্কেল’ যথার্থই ‘গুড়ুম’ হইত| ‘সোমপ্রকাশ’-প্রকাশের পূর্ব্বের সংবাদপত্র-সকল, অশ্লীলতা-দোষে অত্যন্ত দূষিত ছিল| ‘প্রভাকর’ ও ‘রসরাজে’ যখন ঝগড়া হইত, তখন রাস্তায় ময়লা-পরিষ্কারকারক-জাতীয় লোক ঝগড়া করিয়া পরস্পরের হণ্ডিকাস্থিত ময়লা লইয়া, পরস্পরের গাত্রে নিক্ষেপ করিলে, যেরূপ জঘন্য দৃশ্য হয়, সেইরূপ জঘন্য দৃশ্য হইত| শ্রীযুক্ত স্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ, বাঙ্গালা সম্বাদপত্রকে প্রথম এই দুরবস্থা হইতে উদ্ধার করেন|
     “সংস্কৃত কলেজের একজন কৃতবিদ্য ছাত্র (সারদাপ্রসাদ ভট্টাচার্য্য নামে এক বধির ব্যক্তি ) ‘সোমপ্রকাশ’-নামক এক সংবাদপত্র-প্রচারের বাসনায় সমুদায় উদ্যোগ করিয়াছিলেন| নানা কারণ বশতঃ তিনি তাহাতে হস্তক্ষেপ করিতে না পারায়, ১৭৮০ শাকের অগ্রহায়ণ (খৃঃ ১৮৫৮ অব্দের নবেম্বর) হইতে পণ্ডিত দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ এই পত্রিকার সম্পাদকতা গ্রহণ করিয়া সাপ্তাহিক-রূপে উহা প্রচার করিতে আরম্ভ করেন| সেই অবধি তাঁহার জীবনকাল পর্য্যন্ত তাঁহা কর্ত্তৃকই ঐ পত্রিকা প্রচারিত হইয়াছিল| ....
     “সম্পাদক মহোদয়, কলিকাতার অধিবাসী না হইলেও, কলিকাতার প্রবাসী বটেন| কিন্তু ‘সোমপ্রকাশের’ জন্মভূমি - কলিকাতা-চাঁপাতলার ‘বাঙ্গালা যন্ত্র’| ১৮৫৮ হইতে ১৮৭২ খৃষ্টাব্দ পর্য্যন্ত তিনি ঐ জন্মস্থানেই পুষ্ট ও প্রবর্দ্ধিত হইতেন|
     “১৮৬২ খৃষ্টাব্দে (১২৬৯ সালে) বিদ্যাভূষণ মহাশয়ের নিজ-ভবনে উহার কার্য্যালয় ও যন্ত্রালয়, স্থানান্তরিত হয়| কেননা, তখনই ‘মাতলার রেলওয়ে লাইন’ খোলা হইয়াছে| যে ‘চাঙ্গরিপোঁতা’ বিদ্যাভূষণের জন্মভূমি বলিয়া আসিয়াছি, সেই গ্রামে গমনাগমনের পক্ষে ঐ লাইনই সুবিধাজনক| ঐ ‘রেলওয়ে’ কি উপায়ে খোলা হইতে পারে-খোলা হইলে, রেলওয়ে কোম্পানিদেরও কি সুযোগ ঘটিবে, তাহার জন্য যথেষ্ট চেষ্টা চলিয়াছিল| এখানে কিয়ৎকাল মুদ্রাযন্ত্র, বেশ সতেজ চলিয়াছিল|
     “তাহার উপর ইং ১৮৭৪ সালে উহাকে ‘ভবানীপুরে’ আনিতে হয়| তাহাতে কার্য্যের অধিকতর সুবিধা-সংঘটনের প্রত্যাশাতেই ঐ ব্যবস্থার অনুষ্ঠান করিতে হইয়াছিল| এইখানেই ভবানীপুর-নিবাসী শ্রীযুক্ত কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায় (ইনি এই ঘটনার কিছু পর হইতে ‘কাব্যবিশারদ’ উপাধিবিশিষ্ট হইযাছেন) ও রায়না-নিবাসী শ্রীযুক্ত ব্রজেন্দ্রনাথ দত্ত, বিদ্যাভূষণ মহাশয়ের সহকারিতায় নিযুক্ত হন| শেষোক্ত ব্যক্তি, মাসিক বিশ মুদ্রা বেতনে কর্ম্ম করিতেন|”

     উপরে প্রদত্ত মহেন্দ্রনাথ বিদ্যানিধির লিখিত রচনার অংশ থেকে ‘সোমপ্রকাশ’ সম্বন্ধে আর একটু বিশদ ভাবে জানার সুযোগ ঘটে|
     ১৮৮৬ সালের ২৩শে আগস্ট দ্বারকানাথের মৃত্যু হয়| এর পরে পত্রিকার প্রকাশ বন্ধ হয়ে যায়|
     ‘সোমপ্রকাশ’ দ্বারকানাথের একটি অবিস্মরণীয় কীর্তি| অসাধারন পাণ্ডিত্য থাকা সত্বেও অত্যন্ত সহজ ও প্রাঞ্জল ভাষায় তিনি রচনা প্রকাশ করতেন| তার আর একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল তিনি কোন কলুষতা বা দলাদলিকে প্রশ্রয় দিতেন না এবং যেটা তখন অনেক পত্রিকারই প্রধান উপজীব্য ছিল, সেসব কুরুচিপূর্ণ বিষয় বর্জন করে ‘সোমপ্রকাশ’-কে একটি শুদ্ধ চরিত্র উচ্চমানের পত্রিকা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করে জনচিত্ত জয় করতে বিদ্যাভূষণ সমর্থ হয়েছিলেন| 

সংযুক্ত প্রতিলিপি -
১২৮৭ বঙ্গাব্দের ২২শে বৈশাখ (১৮৮০ ৩রা মে) তারিখে প্রকাশিত পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠা ।

চিত্র ১


লেখক পরিচিতি : বহু বছর বি.ই. কলেজে (এখন ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, শিবপুর ( IIEST,shibpur )) অধ্যাপনা করেছেন। কিছুদিন হল অবসর নিয়েএখন সেখানে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে আছেন। অ্যাপ্লায়েড মেকানিক্স নিয়ে গবেষণা করলেও একাধিক বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে - জ্যোতিষশাস্ত্র, পুরনো কলকাতার সংস্কৃতি, ইত্যাদি। অবসর সময়ে 'অবসরে'র সঙ্গে সময় কাটান।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।