প্রথম পাতা

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

বিবিধ প্রসঙ্গ

জানুয়ারি ৩০, ২০১৬

 

মালবিকা ও মল্লিনাথ

শিবাংশু দে


দূরে বহুদূরে
স্বপ্নলোকে উজ্জয়িনীপুরে
খুঁজিতে গেছিনু কবে শিপ্রানদীপারে
মোর পূর্বজনমের প্রথমা প্রিয়ারে।
মুখে তার লোধ্ররেণু, লীলাপদ্ম হাতে,
কর্ণমূলে কুন্দকলি, কুরুবক মাথে,
তনুদেহে রক্তাম্বর নীবীবন্ধ বাঁধা, চরণে নূপুরখানি বাজে আধা-আধা ।
বসন্তের দিনে
ফিরেছিনু বহুদূরে পথ চিনে চিনে ।।

এই কবিতাটি সেই প্রথম কৈশোর থেকে মজিয়ে রেখেছিলো। তবে শম্ভু মিত্রের কণ্ঠে। তাঁর অননুকরণীয় স্বরে, একটু টেনে, তিনি যখন শুরু করতেন,' দূরে, বহুদূরে.... এক লহমায় মনটা চলে যেতো সেই কালিদাসের উজ্জয়িনীতে, শিপ্রা নদীর তীরে মহাকাল মন্দিরের চাতালের ঘাটে।

১. প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে কয়েকটা বিবাহ সারা দেশের ভবিষ্যত বদলে দিয়েছিলো। তার মধ্যে একটা মধ্য ও উত্তর বঙ্গদেশবাসী কুষান বংশীয় শ্রীগুপ্তের পৌত্র প্রথম চন্দ্রগুপ্তের সঙ্গে লিচ্ছবি রাজকন্যা কুমারদেবীর বিবাহ। এটি আনুমানিক চতুর্থ শতকের প্রথম দশকের ঘটনা। এই বিবাহের উপঢৌকন হিসেবে চন্দ্রগুপ্ত-প্রথম মগধ রাজ্যের অধিকার লাভ করেন, যার রাজধানী ছিলো পাটলিপুত্র। তাঁর জীবৎকালে রাজ্য সম্প্রসারিত হয় মগধের সীমা পেরিয়ে প্রয়াগ ( এলাহাবাদ), সেখান থেকে সাকেত (অযোধ্যা) পর্যন্ত। তাঁর পুত্র সমুদ্রগুপ্তকে ভিনসেন্ট স্মিথ বলেছিলেন ভারতের নেপোলিয়ান। সমুদ্রগুপ্ত অহিছত্র, পদ্মাবতী, মালব,যৌধেয়, মদুর, আভীর ইত্যাদি কুড়িটি উপজাতিদের রাজ্য অশ্বমেধ যাত্রা করে অধিকার করেন। রাজধানী নিয়ে আসেন মালব বা অবন্তী রাজ্যের উজ্জয়িনী নগরে। তাঁর পুত্র চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্যের কাহিনী তো এদেশের সোনালি অতীত। ৩৮০ সাল থেকে ৪১৩ সাল পর্যন্ত প্রায় সমগ্র উত্তরাপথের সম্রাট। তাঁর ছত্রছায়ায় কালিদাস ও আরো অনেকে। অবন্তিকা আর মালবিকারা দখল করে নেয় সব সৃষ্টিশীলতার অন্দরমহল তার পর হাজার বছর। নিজেকে দিয়ে যদি বুঝতে চাই, তবে মনে হয় সেই ট্র্যাডিশন আজও চলেছে। মহাকালেশ্বরের জ্যোতির্লিঙ্গ সাক্ষী হয়ে আছে সেই সুদূর অতীতের মায়াময় সভ্যতার। বাঙালি কবি ধরে রাখেন সেই স্বপ্নময় মদির সৌরভ আর বাঙালি নট আবিষ্ট হয়ে বলে যান,

রজনীর অন্ধকার
উজ্জয়িনী করি দিল লুপ্ত একাকার।
দীপ দ্বারপাশে
কখন নিবিয়া গেল দুরন্ত বাতাসে।
শিপ্রানদীতীরে
আরতি থামিয়া গেল শিবের মন্দিরে ।।

২. পথে পথে ধুলো মেখে বেড়ানোর নেশা আমার অনেক কালের। ভারতবর্ষ নামক যে বিস্ময়কে আমরা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছি, তার সামান্য কয়েকটি প্রান্ত ছাড়া প্রায় সব মাটির ধুলো এই শরীরমনকে ধন্য করে গেছে। মালবিকাদের দেখতে যাবার ইচ্ছে তো বহুকালের, কিন্তু সুযোগ হয়নি। হঠাৎ আদেশ এলো দিল্লি হয়ে ইন্দোর যেতে হবে একটা সরকারি কাজে। সুযোগ একটা হয়েই গেলো। দিন দুয়েক দিল্লিতে, ঠিক দিল্লি নয় গুড়গাওঁ, সরকারি কাজকম্মো সেরে আকাশে ওড়া। দিল্লি তিন নম্বর টার্মিনাল সত্যিই শাইনিং ইন্ডিয়া, হায়দরাবাদকেও হার মানায় আর দিল্লির সন্ধের আকাশ থেকে পৃথিবী একটা অসম্ভব রূপকল্পের ছবি।

ছমছমে আকাশের অন্ধকার থেকে ছোট্টো রাজা ভোজ বন্দর। কোচি আর ম্যাঙ্গালোরের মতো জাহাজ থেকে নেমে হেঁটেই লাউঞ্জে ঢুকে পড়া। বাইরে অপেক্ষমান গাড়িতে যেতে যেতে ইন্দোর শহরের ঝাঁকিদর্শন। মাঝারি শহর, মধ্যপ্রদেশের বাণিজ্যিক রাজধানী। সন্ধেটা ছিলো ধনতেরসের। গাড়িকে পুরোনো বাজারগুলির ভিতর দিয়ে যেতে বললুম। চালক হয়তো একটু অনিচ্ছুক, কিন্তু গেলো শেষপর্যন্ত। নতুন কোনও দৃশ্যের জন্ম হোলোনা। সেই মণিকান্ত জহুরির ছোট্টো দোকানের পাশে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়া মস্তো প্যান্টালুন জাতীয় দোকান। এদেশে বাজারের দরজা একেবারে হাট করে খোলা হচ্ছে। রাশি রাশি ফিটফাট খেলোয়াড়। বয়স্ক ট্র্যাডিশনাল ব্যবসাগুলি মাথায় কলপ লাগিয়ে মাঠে নামার চেষ্টায় ব্যস্ত। শেষপর্যন্ত গোলপোস্টের দখল কে পাবে সেটাই দেখার।

ভোপাল রোডে 'অরণ্য' নামে একটা নতুন গড়ে ওঠা পাড়ায় আমাদের অতিথিশালা। সেখানেই থাকা এবং একই আঙিনায় কর্মক্ষেত্র, তাই অকারণ সময়ের অপব্যয় নেই। হেড আপিসের বড়োবাবু হয়ে যাবার পাপ হচ্ছে প্রচুর লোকের নজরবন্দি হয়ে থাকা এবং যত্ন আত্তির ঘনঘটা বড্ডো বেশি। যেকারণে যাওয়া, সেই দারোগাগিরি করে ফেলা গেলো একদিনেই। একটা দিন হাতে রেখেছিলুম চিরাচরিত ক্যামেরা হাতে বেরিয়ে পড়ার জন্য।

স্থানীয় বন্ধুরা প্রশ্ন করলেন, কোথায় যাবেন? এই প্রশ্নের উত্তরে ইন্দোরে শতকরা নিরানব্বইজন বলেন, উজ্জয়িনী, মহাকালের মন্দিরে পুজো দিতে তো যেতেই হবে। উজ্জয়িনী নিয়ে আমার মনে যে রম্যকল্পনা আছে, আমি জানি আজকের উজ্জয়িন সে রকম জায়গা নয়। আর 'পুজো দেওয়া', এজন্মে তো হলোনা কখনও। তবে কেন দেবতাকে অকারণ কষ্ট দিতে যাওয়া?

আমি বললুম, মান্ডু যাবো। আমার মতো স্বভাবের লোকজনের মন্দিরমসজিদ যদি কোথাও থাকে, তবে ঐদিকেই কোথাও তার ইশারা পাওয়া যেতে পারে। আমার 'মালবিকা' রূপমতীর মতই কেউ হবে হয়তো, কালিদাস যাকে দেখেননি কখনও। আর কবি'র 'স্বপ্নে'ও সে অধরাই রয়ে গেছে। এই আমি খ্যাপা মল্লিনাথ চললুম তাকে খুঁজতে।

মজা হলো, যখন জিগ্যেস করলুম গাড়িতে কতোক্ষণ লাগবে? বিচক্ষণ লোকজনের অনুমানের পরিধি বিচরণ করতে লাগলো দেড় ঘন্টা থেকে চার ঘন্টার মধ্যে। অর্থাৎ পথের দেবতার পুজোর মন্ত্র কতোক্ষণ পড়তে হবে, কেউ নিশ্চিত নয়।

যাকগে, সকাল সাতটা নাগাদ বেরিয়ে পড়া গেলো। আমার চালক জানালো দেড়ঘন্টার মধ্যে পৌঁছে দিতে পারবে। তার সঙ্গে গপ্পো করি। তার পৃথিবী বলতে পশ্চিমে বম্বে, উত্তরে গোয়ালিয়র, পূর্বে রায়পুর আর দক্ষিণে ঔরঙ্গাবাদ। গাড়ি চালাতে চালাতে সে জানাতে থাকে এতো খারাপ রাস্তাঘাট, যা গত বিশ বছরে ভালোভাবে সারানো হয়নি। ঐসময় কংগ্রেসি রাজত্ব ছিলো। শুক্লাভ্রাতারা, দফায় দফায় দুজন 'রাজপুত্র' অর্জুন সিং, দিগ্বিজয় সিং, 'উপজাতিক' অজিত যোগি সবাই মিলে কীভাবে 'সোনার মধ্যপ্রদেশ'কে লুটেপুটে খেয়েছে। গত চার বছরে বিজেপি কিছু করার চেষ্টা হয়তো করেছে, কিন্তু সর্ষের মধ্যে ভূত। রাজ্য বিজেপির নেতারা কেউই কংগ্রেসি দানবদের থেকে কম নয়। ইন্দোরের বিধায়ক সর্বজানিত মাফিয়া নেতা। তার পুণ্যের লিস্টিতে নিজের দলের মুখ্যমন্ত্রীকেও খুন করার হুমকি রয়েছে। ঐ মুখ্যমন্ত্রীটি হিন্দিতে পদ্য লেখেন। পুরোনোদিনের আর এস এস ধরনের 'আদর্শবাদী'। ব্যক্তিগতস্তরে হয়তো পাপ করতে চাননা, কিন্তু ধনুর্ধর সাঙ্গোপাঙ্গোদের জ্বালায় নিজের ঘরেই প্রায় নির্বাসিত। তাও তখনও 'ব্যাপম' আসেনি।

আমি দেশে যেখানেই যাইনা কেন স্থানীয় মানুষজনের সঙ্গে দেশদুনিয়ার হালচাল নিয়ে গপ্পো করি। প্রথমে হয়তো লোকে একটু আড়ষ্ট থাকে। কিন্তু এইসব নেতাজাতীয় জন্তুদের প্রতি রোষ, ক্ষোভ, ঘৃণা, একটু আঁচড়ালেই বেরিয়ে আসে লাভার মতো। আমার চালক যখন অসম্ভব ঘৃণা বিজড়িত উচ্চারণে জানাচ্ছিলো 'ডিগ্গিরাজা'র প্রাসাদ আর ধনসম্পদের কথা, আমার মনের চোখে আমি দেখছিলাম সেই সাদা খাদির বর্মে আবৃত লোকটি কতো পরমান্নময় বাকচাতুর্যে আন্না হাজারে নামক এক ব্যক্তি ও তার সহচরদের 'দুর্নীতি' নিয়ে চব্বিশঘন্টা দেশবাসীদের অবহিত করে যেতো। এই বিপুল দেশের অসংখ্য প্রান্তে ঘুরে বেড়িয়েছি। মানুষের মধ্যে এই মাত্রার আক্ষেপ, ক্রোধ সতত চোখে পড়েছে। হে অন্তরীক্ষের বিধাতা, একদিন তো এই মানুষগুলিকে পরিত্রাণ দাও। নয়তো শুধুই ফাঁকা প্রতিশ্রুতি, ' অভ্যুথ্থানম অধর্মস্য....'ইত্যাদি অনৃতবচন হয়েই থেকে যাবে। তুমিও তো শেষ পর্যন্ত 'নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি'।

ধারের অসম্ভব ভাঙাচোরা রাস্তা এড়াতে গিয়ে গাড়ি পূর্বদিকে মাউকে রেখে তিন নম্বর জাতীয় সড়কের বাইপাস ধরে মানপুরের দিকে চললো। এই বাইপাসের কুড়ি বাইশ কিমি রাস্তা চলাচলের উপযোগী। বাকিটা রাস্তার নামে পরিহাস। মানপুরের পর গুজরি থেকে ইউমোড় নিয়ে ধার যাবার পাহাড়ি সড়কটি বেছে নেওয়া গেলো। কিন্তু পথ তো তথৈবচ। মালোয়ার গ্রামের ভিতর দিয়ে চলে গেছে আঁকাবাঁকা উঁচুনিচু পথ। চক্রবাল জোড়া প্রায় শুকনো খেত খামার। মাঝে মাঝে সবুজের সমারোহ, আবার ইয়েলো অকার মাটি। কেটে ফেলা আখ আর ভুট্টার খেত। ক্রমাগত ওঠানামা করে চলা পাহাড়ি ভাঙা পথঘাট। তিনঘন্টা চলার পরেও পঁচানব্বই কিমি ফুরায় না। হঠাৎ চুলের কাঁটার বাঁকা মোড়ে টোলগেট, একটি তোরণ, তার উপর লেখা রূপমতী-বাজবাহাদুরের শহরে স্বাগতম। আর বারো কিমি বাকি।

৩. মান্ডু, গোয়ালিয়র আর গোলকোন্ডার মধ্যে অনেক মিল রয়েছে। মধ্যযুগের ভারতের ইতিহাসে এইসব ছোটো ছোটো রাজন্যবর্গের গপ্পোগাছা অনেকটা একরকম। রূপকথার রাজাগজা সব। নিজের রাজ্যের পরিধির মধ্যে 'জগদীশ্বরোবা', কিন্তু দিল্লি আগ্রার মহাপরাক্রমীদের থেকে সতত সন্ত্রস্ত, সাবধানী, 'তফাত যাও' ঋষিবাক্যে বিশ্বাসী। একটু উচ্চাভিলাষী হলেই পতন এবং পতন ও অভ্যুদয় বন্ধুর পন্থার ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে নানা উপকথা, শিল্পচর্চা, মানুষী ভালোবাসাকে প্রায় দৈবীমাত্রায় তুলে নিয়ে গিয়ে চিরকালীন প্রেমের উপাখ্যান। কিছুটা হয়তো সত্যি, বাকিটা কল্পনা। তবু মানুষ বিশ্বাস করে, মনে রাখে। এই সব গপ্পের বসন্তবাতাস ঊষর জীবনে কোথাও হয়তো কোকিলকে ডেকে আনে। নিয়ে আসে সোনাঝুরির তীব্র হলুদ রং আর মদির গন্ধ। তা সে রূপমতী-বাজবাহাদুর বা তানসেন-মৃগনয়নী অথবা মহম্মদ কুলি কুতুব শাহ আর নর্তকী ভাগমতী। ভাগমতীর ভালোবাসার নাম হায়দরমহল আর তার নামে শহরটার নাম হয়ে যায় হায়দরাবাদ।

গাড়ি ছুটছে মান্ডুর পথে....

৪. ধারাপুরীর উল্লেখ আমাদের বিভিন্ন পুরোনো শাস্ত্রে বা মহাকাব্যে পাওয়া যায়। মালব রাজ্যের দক্ষিণে গড়ে ওঠা এই বর্ধিষ্ণু জনপদ নানাভাবে আমাদের ইতিহাসে, লোককথায় ঘুরেফিরে এসেছে। সেকালের ধারাপুরী, অর্থাৎ আজকের ধার শহরের কাছে ছিলো 'মন্ডপদুর্গ' নামের রাজপুরী। এখানে পালনপুরে ৫৫৫ সালের ( বিক্রম সম্বৎ- ৬১২)একটি আদিনাথের জৈন মূর্তি পাওয়া গেছে। ফিরিস্তা নামের একজন ঐতিহাসিক লিখেছিলেন, পরভেজ খুসরোর সময় এখানে আনন্দ দেও নামে একজন রাজপুত শাসক রাজত্ব করতেন। পাহাড়ের উপর তারাপুর গ্রামে ছিলো এই পার্বত্য দুর্গ, নাম 'মান্ডপিকা' বা ' মন্ডপদুর্গ'। ষষ্ঠ শতকে মন্ডপের অপভ্রংশ মান্ডবের উল্লেখ বিভিন্ন পারসিক ইতিহাসে পাওয়া যায়। তার পর এই দুর্গটি ছিলো কনৌজের গুর্জর প্রতিহার সাম্রাজ্যের দক্ষিণ সীমা, যার রাজধানী ছিলো উজ্জয়িনীতে।

রূপমতী মহল থেকে মালোয়া

দশম শতকের শেষে পরমার বংশীয় ক্ষত্রিয়রা ছিলো মালব বা মালোয়া রাজ্যের শাসক। তারা ছিলো প্রবল পরাক্রমী আর তাদের সময়ই রাজধানী উজ্জয়িনী থেকে ধার নগরে নিয়ে আসা হয়। তখন থেকেই মান্ডপিকা বা মান্ডু হয়ে ওঠে মালোয়া রাজ্যের কেন্দ্র। এই বংশের প্রবাদপ্রতিম রাজারা হচ্ছেন রাজা মুঞ্জ আর রাজা ভোজ। রাজা ভোজ ছিলেন একমাত্র ভারতীয় রাজা যাকে সুলতান মাহমুদ ঘজনি রেয়াৎ করে চলতেন। রাজা ভোজের নামে যতো জনশ্রুতি রয়েছে তার একমাত্র সমান্তরাল আমরা পাই রাজা চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্যের নামে। অর্থাৎ সমগ্র উত্তরাপথে হর্ষবর্ধন, পৃথ্বীরাজ চৌহান, রাণা প্রতাপ প্রমুখের খ্যাতি ম্লান করে এই দুজন মালবের রাজা মানুষের কল্পলোকে স্থায়ী স্থান করে নিয়ে ছিলেন। একটা কারণ আমি পেলাম। ভাবা যায়, রাজা ভোজের আরাধ্যা ছিলেন দেবী সরস্বতী। মধ্যযুগের ক্ষত্রিয় বংশীয় পরম পরাক্রান্ত নৃপতি ভজনা করতেন বাগদেবীকে। মান্ডু দুর্গে তাঁর আরাধ্যা সরস্বতী মূর্তির সঙ্গে একটি প্রাকৃত মন্ত্র পাওয়া গেছে, যা সম্ভবত রাজা ভোজের রচনা।

১২৫৩ সাল পর্যন্ত মান্ডু দুর্গে শাসন করেছেন নানা হিন্দু রাজা। তার পর দিল্লির সুলতান জলালুদ্দিন খলজি চৌহান রাজা জৈত্রসিংহের সময় মান্ডুদুর্গ লুণ্ঠন করেন। ১৩০৫ সালে আসে চূড়ান্ত আঘাত, জলালুদ্দিনের ছেলে অলাউদ্দিন খলজির সেনাপতি আইনুল মুল্ক পরাক্রান্ত সেনানায়ক কোকাদেবকে পরাজিত করে মান্ডু দুর্গ দিল্লি সলতনতের অধিকারে নিয়ে আসেন। তার সঙ্গেই ধ্বংস করে দেন কাফেরদের দীর্ঘ প্রায় এক হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা হিন্দু পরম্পরার শিল্পকীর্তি, গর্বিত উত্তরাধিকার।

৫. সুলতানি আমলে ধার-মান্ডুর শাসক ছিলেন ঘুরি বংশের দিলাওয়র খান। ইনি ছিলেন মহম্মদ বিন তুঘলকের একজন সেনাপতি। ১৪০১ সালে দিলাওয়ার খান স্বাধীন সুলতান হয়ে যান এবং তাঁর রাজধানী ধার-এ থাকলেও আজকের মান্ডু দুর্গের নির্মান শুরু করেন। ১৪০৫ সালে তাঁর মৃত্যুর পর পুত্র অলপ খান সিংহাসন অধিকার করেন। অলপ খান স্থায়ীভাবে রাজধানী মান্ডুতে নিয়ে আসেন এবং রাজকীয় নাম গ্রহণ করেন, হোসাঙ্গ শাহ। হ্যাঁ, তিনিই মধ্যযুগের সেই বিখ্যাত নরপতি। সাতাশ বছরের রাজত্বে উত্তরে কাল্পি থেকে দক্ষিণে খেরলা পর্যন্ত সাম্রাজ্য বিস্তার করেন। তাঁর সময়ের অতুলনীয় স্থাপত্য, যা এখন মান্ডুতে দেখা যায়, জামি মসজিদ, দিল্লি গেট এবং তাঁর নিজের মর্মর সমাধি মন্দির। মধ্যযুগের ঐতিহাসিকরা তাঁর সামরিক শক্তি ও পরাক্রমের গপ্পো নিয়ে উচ্ছসিত হয়েছিলেন। ১৪৩৫ সালে হোসাঙ্গ শাহের মৃত্যুর পর পুত্র ঘজনি খান সিংহাসন আরোহন করে নাম নেন মাহমুদ শাহ। এই মাহমুদ মাত্র এক বছর রাজত্ব করার পরই প্রাসাদ চক্রান্তের শিকার হন। বিষপ্রয়োগে তাঁকে হত্যা করে ঘনিষ্ঠ সহযোগী মাহমুদ খান মান্ডুর শাসনভার গ্রহণ করেন। মালোয়ায় ঘুরি বংশের দিন শেষ হয়।

খলজি বংশজ মাহমুদ খান ছিলেন যোদ্ধা সুলতান। তেত্রিশ বছর ধরে সর্বদা লড়াই করে বেড়াতেন গুজরাট, দক্কন, জৌনপুর, বিশেষত মেওয়ার রাজ্যের সঙ্গে। এই শাসকটি এতো যুদ্ধবাজ হলেও তাঁর জ্ঞানপিপাসা ছিলো অসীম এবং প্রজারা তাঁকে শ্রদ্ধা করতো মানবিক চেতনার জন্য। তাঁর সময়ের আশরফি মহল, বিজয় স্তম্ভ ও জামি মসজিদের কিছু নির্মান এখনও মান্ডুতে দেখা যায়।

মাহমুদ খানের পুত্র ঘিয়াসুদ্দিন ১৪৬৯ সালে রাজা হন। যুদ্ধবিগ্রহ বিশেষ না করে শান্তিতে একত্রিশ বছর রাজত্ব করেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ, উদার, ন্যায়শীল ও বদান্য শাসক। কখনও মদিরা স্পর্শ করেননি আর মান্ডুর বিখ্যাত জাহাজ মহল তাঁরই কীর্তি। তবে তাঁর পৌরুষের গপ্পো হচ্ছে আল্টিমেট ফ্যান্টাসি। তাঁর হারেম ভরিয়ে রেখেছিলো ছিলো মাত্র পনেরো হাজার রূপসী নারী। এ ছাড়া সশস্ত্র পাঁচশো অতি সুন্দরী তুর্কি ও হাবসি নারী ছিলো হারেমের রক্ষক। তারা রাজাকে সর্বদা চারদিকে ঘিরে থাকতো। মুয়াম্মার গদ্দাফি বোধ হয় এই রাজারই মন্ত্র শিষ্য ছিলো।

নিজের কানে কানে বলি 'ধর্মপ্রাণ' হবার এরকম সুযোগ পাবার জন্য 'খলজি' হয়ে জন্মাতে হতো। ভেতো বাঙালির ছেলে হয়ে একটা জন্ম একেবারে বৃথা গেলো। 'ধর্মপ্রাণ' আর হওয়া হলোনা।

বাজবাহাদুরের প্রাসাদ

ঘিয়াসুদ্দিনের মৃত্যু হয় পুত্র নসিরুদ্দিনের দেওয়া বিষে। তা নসিরুদ্দিনও বেশিদিন টেকেন না। তাঁর পুত্র মাহমুদ -২ রাজপুত সেনাপতি মেদিনি রায়ের দৌলতে কিছুদিন রাজত্ব করেন। কিন্তু মেদিনি রায়ের পরাক্রম তাঁকে সন্দিগ্ধ করে তোলে। তার পর মঞ্চে আসেন গুজরাটের সুলতান মুজফ্ফর শা-২ য়ের পুত্র বহাদুর শাহ। এই বহাদুর শাহ ১৫২৬ সালে মাহমুদ শা-২ কে গ্রেফতার করে মান্ডুর দখল নিয়ে নেন। তার পর শোভাযাত্রা করে মান্ডুর নতুন নতুন দখলদারেরা আসতে থাকে। প্রথমে স্বয়ং হুমায়ুঁ, তার পর শের শা, শের শার সেনাপতি শুজাত খান এবং শেষে শুজাত খানের পুত্র মালিক বায়জিদ।

বাজবাহাদুর প্রাসাদ থেকে রূপমতী মহল

মালিক বায়জিদ ১৫৫৬ সালে মান্ডুর শাসনভার হাতে নিয়ে নাম নেন 'বাজবহাদুর'। প্রথম প্রথম তিনি যুদ্ধবিগ্রহে বেশ আগ্রহী ছিলেন, কিন্তু চন্দেল বংশীয় রানী দুর্গাবতীর হাতে পরাজয় তাঁকে নিরুৎসাহ করে দেয়। তিনি আশ্রয় নেন সুরসঙ্গীতের। এই সময়ই রূপমতী নাম্নী সেই স্বপ্নের রমণী তাঁর অনুগতা হয়ে পড়েন। তাঁদের নিয়ে নতুন কিম্বদন্তী আর লোককথার পরম্পরা গড়ে ওঠে। এই সময় দিল্লির সিংহাসনে স্বয়ং মির্জা জলালুদ্দিন শাহ আকবর। মুঘল সেনাপতি আধম খান মান্ডু অবরোধ করেন, বাজবহাদুর নিখোঁজ হয়ে যান আর রূপমতী বন্দী হয়ে আত্মঘাতী হন।

রূপমতী মহল

তার পর থেকে একদা গৌরবশালী মালোয়া রাজ্য তার গরিমা হারিয়ে মুঘল অধিকৃত এক পরগনা হয়ে পড়ে। তবে এই জায়গাটির সৌন্দর্য বিলাসী মুঘল সম্রাটদের, বিশেষত জাহাঙ্গির ও শাহজহানকে আকৃষ্ট করতো। তাঁরা মাঝে মাঝেই মান্ডু আসতেন, জাহাজ মহলে থাকতেন আর মান্ডুর গুণগান করতেন। তাজমহল নির্মাণের আগে মুখ্য স্থপতি উস্তাদ হামিদকে শাহজহান মান্ডু পাঠিয়েছিলেন হোসাঙ্গশাহের সমাধিসৌধের থেকে প্রেরণা নিতে।

আসলে বাজবহাদুরের পতন থেকেই মান্ডুর গরিমা শেষ হয়ে যায়। মুঘল যুগের শেষদিকে মরাঠা মল্হার রাও হোলকার ১৭৩২ সালে তৎকালীন মুঘল শাসক দিয়াবহাদুরকে তির্লার যুদ্ধে পরাজিত করে মান্ডুকে ধারের মরাঠা রাজত্বের মধ্যে নিয়ে চলে আসেন।

বাজবাহাদুরের প্রাসাদ - স্নানের জায়গা

ইতিহাসের গপ্পো অনেকের ভালো লাগেনা। তা সেতো অনেক মানুষ আছেন যাঁদের আমীর খানের মারোয়া আর রবিশংকরের নটভৈরবও ভালো লাগেনা। ইতিহাসের নিজস্ব রাগ-তাল-স্বরলিপি রয়েছে। বুঝ লোক যে জানো সন্ধান। আমি যখন ইতিহাস বিজড়িত এই সব প্রাসাদ-প্রাকার-মন্দির-মসজিদ-গির্জায় বিমুগ্ধ পায়ে হেঁটে বেড়াই, সেই সমস্ত বাদশা থেকে কেরানির দল অশরীরী স্পর্শ নিয়ে আমার চারপাশে ঘিরে থাকে। জীবনানন্দ বারবার মনে পড়ে যায়। 'হাজার বছর পথ হাঁটিতেছি আমি'। বৈঠকখানার আরামকেদারায় নাকে চশমা এঁটে পড়া শুকনো প্যাপিরাস পাতা দমকা হাওয়ায় কোথায় উড়ে চলে যায়, রক্তমাংসের প্রবল জীবন্ত মানুষগুলি এসে হাত ধরে। তার রোমাঞ্চের কাছে অনেক সময়ই ম্লান হয়ে যায় প্রিয় মদিরার মধুস্বাদ, প্রিয় নারীর ঊষ্ণ স্পর্শসুখ। নিজেকে এইভাবে খুঁজে নেওয়া, এই ভাবে তার থেকে বিলীন হর্ষবোধ, দুনিয়ায় আর কী আছে? এই যে 'আমি' তো তাদেরই উত্তরাধিকার। এই 'আমি'ও তো একদিন ইতিহাস হয়ে যাবো। আরও হাজার বছর হেঁটে যাওয়া পৃথিবীর পথে।

(পরের সংখ্যায় সমাপ্য)


লেখক পরিচিতি - শিবাংশু দে'র লেখনী অনায়াসে ছুঁয়ে যায় সঙ্গীত কাব্য ইতিহাস কিংবা উত্তরভারতীয় শিল্পশহরের ধুলোবালি। সূক্ষ্ম নরম অক্ষরে জাগান তুলোট কাগজে লুকিয়ে থাকা ছবি যার পরতে পরতে অপেক্ষা করে পাঠকের নবতর বিস্ময়। ব্যক্তি জীবনে শিবাংশু বিখ্যাত তাঁর সুভদ্র পাণ্ডিত্যের জন্যে। অতিব্যস্ত পেশাগত জীবনের খতিয়ান হয়তো লেখক পরিচয়ে তত প্রাসঙ্গিক নয়, যদি না তজ্জনিত আসমুদ্রহিমাচল ভ্রমণ ও বহু মানুষ দেখাজনিত অভিজ্ঞতা স্মরণ করা হয়।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।