শারদ অর্ঘ্য
সেপ্টেম্বর ৩০, ২০১৬
মেয়ে চলেছে মহাস্নানে
ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়
পুবের নরম আলো পড়ছিল তার গায়ে। গা আবার কোথায় তার? সে তো রোদ লাগবে বলে ঢাকা। আর ' 'তার' বলতে কার? কার আবার, আমাদের আদরের কন্যে দুর্গার গায়। দুর্গা স্নানে যাবে বলে কথা! সব্বোমটি মাড়িয়ে, ঢাক ঢোল পিটিয়ে, শাঁখ বাজিয়ে, উলু দিয়ে, মেয়ে যাবে পাইক বরকন্দাজের কোলে চেপে। কেউ আবার পালকিতে নিয়ে যায়। কেউ আবার দোলায়। কেউ মাথার ওপর ছাতা ধরে তার। পাছে মেয়েটার কষ্ট হয়। পরিপাটি করে লাল পাড় কোরা শাড়িতে মেয়ের উথলে ওঠা রূপলাবণ্য ঢেকে দিয়েছে বাড়ির বড়োরা। লজ্জা মেয়ের ভূষণ কিনা। লাজে অবনত মেয়ে ঘোমটার আড়ালে মুচকি হাসে।
ভাবে, এইদিনটা পুরুষগুলোর খুব উত্সাহ। সারাটা বছর দানাপানি দেয়না কেউ। মহাসপ্তমীর ভোরে মেয়ের মহাস্নানের জন্য সব পুরুষের দরদ যেন উথলে ওঠে।
অবগুন্ঠনা মেয়ে মনে মনে বলে ওঠে,
" আজি নূতনে রতনে, ভূষণে যতনে প্রকৃতি সতীরে সাজিয়ে দাও। আমি তো নিমিত্ত মাত্র। ঘরের মেয়েটাকে যত্ন করো তোমরা? তাকে নিয়ে বছরে একটা দিন এমনি আদিখ্যেতা করলেও তো পারো। আর প্রকৃতি সতী? যে সারাটা বছর তোমাদের ভালোয় মন্দে মাথায় ছাতা ধরে রয়েছে? তোমাদের অসুখ থেকে মুক্তি দিচ্ছে সেই ওষধিরা? তাদেরো হেলাফেলা কোরোনি বাপু! ওরাও মানুষের জীবনদায়ী। এই গ্রীষ্মপ্রধান দেশে মানুষের এত রোগভোগ। আমাদের এ দেশটায় আবার চাষাবাদ সর্বস্বতা! চাষ করেই কত মানুষ খেয়ে পরে বেঁচে থাকে। কৃষিকাজ তাদের রুজি রোজগার। তাই মহাসপ্তমীর ভোরে এই সবুজের অভিযান। সবুজের স্নান। আমি থাকি সবকিছুর অলখ্যে, সকলের আড়ালে। নেপথের নায়িকা হয়ে। আবারো বলি আমি তো নিমিত্ত মাত্র '
"ওঁ কদলীতরুসংস্থাসি বিষ্ণুবক্ষঃ স্থলাশ্রয়ে।
নমস্যতে পত্রি ত্বং নমস্তে চন্ডনায়িকে।।
ওঁ হ্রীং রম্ভাধিষ্ঠাত্র্যে ব্রহ্মাণ্যৈ নমঃ। "
ছোটবেলায় জ্ঞান হবার পর থেকে আমরা সকলেই দুর্গাপুজোর সপ্তমীর ভোরে মহা সমারোহে ঢাকের বাদ্যির সাথে সাথে গঙ্গায় বা নদীতে “কলা-বৌ” স্নান করানোর আয়োজন দেখি। স্নান করিয়ে সেই কলাবৌটিকে নতুন লালপাড় শাড়ি পরিয়ে মাদুর্গার পাশে রাখা হয় এবং পুজোর পাঁচটাদিন পুজো করা হয় ঐ কলাবৌটিকে। বিসর্জনের দিন প্রতিমার সাথে তাকেও বিসর্জন দেওয়া হয়। ছোটবেলায় প্রশ্ন করলে বলা হত ওটি গণেশের কলা-বৌ। আদতে গণেশ কিন্তু বিয়েই করেন নি। মা দুর্গাকেই ঐ রূপে পুজো করা হয়। আমাদের কৃষিপ্রধান দেশে এই কলাবৌটির পুজো এই প্রসঙ্গে যথেষ্ট তাতপর্যপূর্ণ।
বেদে আছে ভূমি হল মাতা, মৃত্শক্তি যা ধারণ করে জীবনদায়িনী উদ্ভিদকে। আযুর্বেদের ঐতিহ্যবাহী ভারতবর্ষে রোগভোগের প্রাদুর্ভাবও কিছু কম নয়। এবং মা দুর্গার চিন্ময়ীরূপটি এই কলা-বৌয়ের অবগুন্ঠনেই যে প্রতিস্থাপন করা হয় সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এই কলাবৌকে বলা হয় নবপত্রিকা। নয়টি প্রাকৃতিক সবুজ শক্তির সঙ্গে আধ্যাত্মিক চেতনশক্তির মিলন হয় দেবীবন্দনায়। সম্বচ্ছর যাতে দেশবাসীর রোগ ভোগ কম থাকে এবং দেশ যেন সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা হয়ে ওঠে সেই বাসনায় এই নবপত্রিকাকে দুর্গারূপে পুজো করা হয়। ন’টি উদ্ভিদের প্রত্যেকটির গুরুত্ব আছে। প্রত্যেকটি উদ্ভিদই দুর্গার এক একটি রূপ এবং তার কারিকাশক্তির অর্থ বহন করে। এরা সমষ্টিগত ভাবে মাদুর্গা বা মহাশক্তির প্রতিনিধি। যদিও পত্রিকা শব্দটির অর্থ হল পাতা কিন্তু নবপত্রিকায় নয়টি চারাগাছ থাকে। আবক্ষ অবগুন্ঠনের আড়ালে নববধূর একটি প্রতিমূর্তি কল্পনা করা হয়। বসন্তকালে বাসন্তী এবং শরতকালে দুর্গার আরাধনায় নবপত্রিকা অর্চনার নিয়ম আছে। যে ক’টি চারাগাছের সমষ্টিকে একত্রিত করে অপরাজিতার রজ্জু দিয়ে বেঁধে নবপত্রিকা তৈরী করা হয় সেই নয়টি উদ্ভিদের নাম শ্লোকাকারে লেখা আছে আর এই ন’টি গাছের প্রত্যেকের আবার অধিষ্ঠাত্রী দেবী আছেন।
রম্ভা, কচ্বী, হরিদ্রা চ জয়ন্তী বিল্বদাড়িমৌ। অশোক মানকশ্চৈব ধান্যঞ্চ নবপত্রিকা।।
এঁরাই আবার নবদুর্গা রূপে পূজিতা হ’ন। তাই দুর্গাপূজার মন্ত্রে পাই
“ওঁ পত্রিকে নবদুর্গে ত্বং মহাদেব-মনোরমে”
এই মন্ত্রে দেবীকে সম্বোধন করে নবপত্রিকাকে দেবীজ্ঞান করা হয়। শস্যোত্পাদনকারিণি দেবী দুর্গা স্বয়ং কুলবৃক্ষদের প্রধান অধিষ্ঠাত্রীদেবতা ও যোগিনীরা দেবীর সহচরী। স্নানান্তে নতুন শাড়ি পরিয়ে তিনটি মঙ্গলঘটে আমপাতা, সিঁদুর স্বস্তিকা এঁকে জল ভরে একসাথে ঢাকের বাদ্য, শঙ্খ, ঘন্টা এবং উলুধ্বনি দিয়ে বরণ করে, মন্ডপে মায়ের মৃন্ময়ীমূর্তির সাথে স্থাপন করা হয়। এই তিনটি ঘটের একটি মাদুর্গার ঘট, একটি গণেশের এবং তৃতীয়টি শান্তির ঘট। নবপত্রিকার পূজা একাধারে কৃষিপ্রধান ভারতবর্ষের বৃক্ষপূজা অন্যদিকে রোগব্যাধি বিনাশকারী বনৌষধির পূজা। মহাসপ্তমীর ভোরে বিল্ববৃক্ষের পূজা, নবপত্রিকা এবং জলপূর্ণ ঘটস্থাপন এর দ্বারাই দেবীপূজার সূচনালগ্ন ঘোষিত হয়। ত্রিনয়নী ত্রিভুবনতারিণী তিনটি স্থানে আবির্ভূতা হন দুর্গাপুজোর সময়। ঘটে, নবপত্রিকায় এবং মৃন্ময়ী প্রতিমায়।
“ওঁং চন্ডিকে চল চল চালয় চালয় শীঘ্রং ত্বমন্বিকে পূজালয়ং প্রবিশ।
ওঁং উত্তিষ্ঠ পত্রিকে দেবী অস্মাকং হিতকারিণি”
নবপত্রিকাকে জনপদে মঙ্গলের দৃষ্টি দিয়ে বিচার করে পূজা করা হয়। একাধারে এটি কৃষিপ্রধান দেশের চিরাচরিত কৃষিলক্ষ্মী যা প্রাক্-আর্যসভ্যতার নিদর্শন অন্যাধারে জীবজগতের কল্যাণকর এই উভিদগুলির রোগনিরাময়ক গুণাবলীর জন্য বনৌষধিও বটে। তাই কলা, কালো কচু, হলুদ, জয়ন্তী,বেল, অশোক, ডালিম, মানকচু আর ধান...এই ন’টি গাছকে অপরাজিতা লতা দিয়ে বেঁধে দেওয়ার অর্থ হল জনকল্যাণকর এই উদ্ভিদগুলি যেন রোগ-ব্যাধির হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করে বা মানুষ যেন এই পুজোর মাধ্যমে রোগ ব্যাধিকে জয় করতে পারে।
অবগুন্ঠনা আবার হাসতে হাসতে বলে,
" সবের মধ্যেই আমি, আবার কিছুর মধ্যেই নেই। মানুষ যন্ত্র, আমি যন্ত্রী।"
শ্রীশ্রীচন্ডীর একাদশ অধ্যায়েই তো আছে অনাবৃষ্টির সঙ্কটে পৃথিবী যখন দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে তখন ঋষিদের স্তবে তুষ্ট হয়ে শক্তিময়ী দেবী নিজের দেহ থেকে উত্পন্ন শাকসব্জীর দ্বারা বিশ্ববাসীর প্রতিপালনে সচেষ্ট হন। সেই শাক ভক্ষণ করে মানুষ প্রাণ ফিরে পায়। মহামায়া দুর্গা প্রকৃতিতে এসব শস্য হয়ে মানুষের ক্ষুধারূপ দুঃখ দূর করেন তাই ইনিই দেবী শাকম্ভরী। যতদিন না পর্যন্ত বৃষ্টি হয় ততদিন সমগ্র বিশ্বের মানুষকে দেবী নয় রকম শাক খাইয়ে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। তাই দেবী দুর্গার সঙ্গে এই সবুজ গাছপালা বা শাকপাতার একটি নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে।
"এবার বুঝলে তো আমিই সেই শাকম্ভরী ।
কলাগাছ আমার শক্তিদাত্রী ব্রহ্মাণী রূপ। এই কলাগাছের কত গুণ ! পাতা থেকে ফুল থেকে ফল কিছুই যায়না ফেলা। অতিসার রোগের ওষুধ কাঁচাকলা আবার রক্তাল্পতার জন্য থোড়, মোচা, দাস্ত পরিষ্কারের জন্য পাকা কলা। কালো কচুতে আমি স্বয়ং দীর্ঘায়ু দাত্রী কালিকা আর মানকচুতে আমি স্বয়ং সম্পদ দায়ী ইন্দ্রাণী । দুই প্রকার কচুই টক্সিন মুক্ত করে দেহের রক্ত পরিষ্কার করে । অশোক গাছ আমার সর্ব শোকরহিতা দুর্গা রূপ। অশোক কুঁড়ি মেয়েরা খেলে স্ত্রীরোগ ভাল হয়, বাধকের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পায়। হলুদ গাছ হল আমার বিঘ্ননাশিনী ঊমার স্বরূপ । কাঁচা হলুদ যকৃতের আদর্শ ওষুধ এবং দীর্ঘদিন সেবনে কর্কট রোগের মত মারণ ব্যাধি থেকে মুক্তি মেলে । ত্বকের ব্যাধিতে, চুলকুনিতে ও কাজ দেয় হলুদ। বেল আমার বড্ড প্রিয় ফল। বেলের মধ্যে নিহিত আমার লোকপ্রিয়া শিবানী মূর্তি। বেল অমৃত ফল। কাঁচা বেল পুড়িয়ে খেলে আমাশা সারে। পাকা বেল কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। জয়ন্তী নামক উদ্ভিদে আমি জয়দাত্রী কার্তিকী স্বরূপা। জয়ন্তী রোগ প্রতিষেধক, বাতজ বেদনা দূর করে। ডালিম চারা চণ্ডীর রক্তবীজনাশিনী, শক্তিদাত্রী রূপ। ভিটামিনে ভরপুর ডালিমে এতটাই আয়রন আছে যে রক্তাল্পতায় খুব কাজ দেয়। যকৃত ভাল করে। আর ধান তো প্রাণদায়িনী মহালক্ষ্মী। সমগ্র দেশবাসীর প্রধান আহার্য শস্যদানা । তাকে তো ভুলে গেলে চলবেনা কৃষিপ্রধান দেশের মানুষকে। ধানের উত্পাদনের ওপর নির্ভরশীল কত রাজ্য আমাদের। আর শ্বেত অপরাজিতা লতা দিয়ে এই ন'টি উদ্ভিদকে বাঁধা হয় । এই শ্বেত অপরাজিতা হল স্মৃতি নিরাময়ক।
তোমাদের ভালোর জন্যেই আমি। আর তাই আমার এই ন'টি রূপই আবার নবদুর্গা রূপে পূজ্য।"
দুর্গাপূজার মন্ত্রে পাই
“ওঁ পত্রিকে নবদুর্গে ত্বং মহাদেব-মনোরমে”
ভবিষ্যপুরাণে পাওয়া যায়..
"অথ সপ্তম্যং পত্রিকাপ্রবেশন বিধিঃ"
কৃত্তিবাসী রামায়ণে আছে,
"অথ সপ্তম্যং পত্রিকাপ্রবেশন বিধিঃ"
কিন্তু বাল্মীকির রামায়ণে নবপত্রিকা পুজোর কোনো উল্লেখ নেই।
সম্ভবতঃ শবরজাতিরা নবরাত্রিতে এই নয়টি উদ্ভিদকে নবদুর্গা জ্ঞানে দুর্গাপূজা করতেন। সেই থেকেই এই নবপত্রিকার পূজা দুর্গাপূজায় স্থান পেয়েছে।
নবপত্রিকাকে জনপদে মঙ্গলের দৃষ্টি দিয়ে বিচার করে পূজা করা হয় । একাধারে এটি কৃষিপ্রধান দেশের চিরাচরিত কৃষিলক্ষ্মী যা প্রাক্-আর্যসভ্যতার নিদর্শন অন্যাধারে জীবজগতের কল্যাণকর এই উভিদগুলির রোগনিরাময়ক গুণাবলীর জন্য বনৌষধিও বটে । তাই এই ন’টি গাছকে অপরাজিতা লতা দিয়ে বেঁধে দেওয়ার অর্থ হল জনকল্যাণকর এই উদ্ভিদগুলি যেন রোগ-ব্যাধির হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করে বা মানুষ যেন এই পুজার মাধ্যমে রোগ ব্যাধিকে জয় করতে পারে ।
এরপর সেই মহাস্নানের মাহেন্দ্রক্ষণ এগিয়ে আসে। আশ্বিনের নরম রোদ গরম হতে থাকে বেলা বাড়ার সাথে সাথে। কন্যে তখন ঘেমে নেয়ে একসা। ততক্ষণে তার ত্বকের প্রতিটি রোমকূপ উন্মুক্ত। এবার তার সৌন্দর্য্য চর্চায় ব্রতী হবার পালা। এ যেন আমাদের আধুনিকার সনা বাথ নিয়ে গায়ে বেশ করে সরষের তেল, কাঁচাহলুদ বাটা মাখা হল। তারপর সুবাসিত তিলতেল মেখে রোদ লাগানো। পরের পর্যায়ে তাঁর ফেস এবং বডিপ্যাক নেবার পালা। এখন বিউটিশিয়ানরা মুলতানি মাটি, গঙ্গামাটি মাখতে বলেন! মা সেই কবে থেকে মেখে আসছেন তা! গজদন্ত মৃত্তিকা বা হাতির গজদাঁত লেগেছে এমন মৃত্তিকা, বৃষশৃঙ্গ মৃত্তিকা বা ষাঁড়ের শিঙের স্পর্শে ধন্য মাটি, নদীর উভয়কুলের মৃত্তিকা, বেশ্যাদ্বারের মাটি, রাজদ্বারের মাটি, চতুষ্পথ মৃত্তিকা অর্থাত চৌরাস্তার মোড়ের মাটি আর সর্বতীর্থের মাটি মেখে মা বসে থাকবেন নদীপারে কিছুসময়। নদীতীরের দৃশ্য দেখতে দেখতে এবার তিনি দন্ত মার্জনা করবেন বেলকাঠের দাঁতন দিয়ে। তাঁর মুখ ধোয়ার জন্য যে দাঁতন কাঠি ব্যাবহৃত হয় তা আট আঙুল পরিমিত বিল্বকাঠের।
এবার আসল স্নানের পালা। পঞ্চগব্য বা গোমূত্র, গোময়, দধি, ঘৃত এবং দুধ, নারকেলের জল, আখের রস, মধু, পুষ্পোদক, ত্রিফলা বা হরিতকী, আমলকী ও বহেড়া ভেজানো জল, মেথি ইত্যাদি পঞ্চকষায় যুক্ত জল দিয়ে স্নানের পর নদীর জল, সাত সাগরের জল, শিশিরের জল, শুদ্ধজল, পাণিশঙ্খের জল, কবোষ্ণ জল, গঙ্গোদক, সহস্রধারার জল, কুশ ঘাসের দ্বারা ছেটানো জল, নির্ঝরিণীর জল এবং তীর্থবারি এমন কত কত জল ঢেলে মেয়ের অবাক জলস্নান হল! তারপর ফ্রুট ফেসিয়াল ফলোদক দিয়ে, পঞ্চরত্ন সমন্বিত জল দিয়ে গোল্ড ফেসিয়াল, তারপর অগরু চন্দন দিয়ে আ্যরোমা থেরাপি হল। সবশেষে আবার গাত্রমার্জণার পর ম্যাসাজ হল তিলতেল, বিষ্ণুতেল, সর্বোষধি আর মহৌষধির জল দিয়ে। সব শেষে অষ্টকলসের পূর্ত জল দিয়ে একে একে বিশেষ স্নান হল। পবিত্র হল সে। কিন্তু প্রশ্ন হল যুগে যুগে কি কন্যেরা এমন অপবিত্র থাকে? তাকে কি পুজো করার জন্য আগে শুদ্ধিকরণ করে নিতে হবে? মহাস্নান কি তবে বিশেষ শুদ্ধিকরণ?
আটটি ঘটিতে বন্দী আটরকমের জল। গঙ্গারজল, বৃষ্টির জল, সরস্বতীর জল, সাগরের জল, পদ্মরেণুমিশ্রিত জল, নির্ঝরোদক, সর্বতীর্থম্বু, ও শুদ্ধজল নিয়ে পদ্ম পাপড়ি ছড়িয়ে স্নান করে সিন্দুর পরে নতুন শাড়ি জড়িয়ে চললেন তিনি মন্ডপে।
আর এই অষ্টকলসের জল আক্ষরিক অর্থেই আটটি কলসের মন্ত্রপূত জল। দেবগণ, মরুত্গণ্, লোকপালগণ, নাগগণ, পর্বতসকল, সপ্তঋষিগণ, অষ্টবসুগণ সকলেই মহা উত্সাহে দেবীকে বাদ্য সমারোহে স্নান করানোয় ব্রতী হয়েছেন। তাই এই মহাস্নান রাজকীয় যজ্ঞ স্বরূপ।
আর এই অষ্টকলসের স্নানের সময় যে মন্ত্র পাঠ হয় তা সঙ্গীতশাস্ত্রসম্মত স্বরলিপি অনুসারে রচিত আটটি
রাগ সঙ্গীত। প্রত্যেকটি একটি রাগরাগিণীর আশ্রয়ে রচিত। অষ্টকলসের মন্ত্রপূত জল দিয়ে দেবীর স্নানাভিষেকের সময় এই গানগুলি সেযুগেও ব্যাবহৃত হত এবং এখনো হয়। কালিকাপুরাণেই এর উল্লেখ রয়েছে।
প্রথমে "মালবরাগং বিজয়বাদ্যং কৃত্বা গঙ্গাজলপূরিতঘটেন " এই মন্ত্র বলে গঙ্গাজল পূর্ণ ঘট দ্বারা অভিষেক হয়। তখন বিজয়বাদ্য বা কাঁসা-পিতল দ্বারা নির্মিত বাদ্য যন্ত্র অর্থাত কাঁসরঘন্টা সহযোগে গাওয়া হয় মালব রাগে এবং চৌতালে ।|
এরপর "ললিতরাগং দুন্দুভিবাদ্যং কৃত্বা বৃষ্টিজলপূরিতঘটেন " এই মন্ত্র বলে বৃষ্টিরজল পূর্ণ ঘট দিয়ে অভিষেক কালে দুন্দুভির সাথে গাওয়া হয় ললিত রাগে এবং চৌতালে ।
এবার "বিভাসরাগং দুন্দুভিবাদ্যং কৃত্ব সরস্বতী-জলপূরিতঘটেন" এই মন্ত্র বলে সরস্বতী নদীর জলপূর্ণ ঘট দিয়ে স্নানাভিষেক হয় বিভাস রাগে এবং চৌতালে গীত হয় সংগীতের মধ্য দিয়ে আর দামামা জাতীয় রণ দুন্দুভি বাজে।
এরপর "ভৈরবরাগং ভীমবাদ্যং কৃত্বা সাগরোদকেন" এই মন্ত্র বলে ভীম বাদ্য বা ভেরী বা চামড়ার তৈরী ঢাকের আওয়াজের সাথে সাগরের জল দ্বারা স্নানের সময় ভৈরবী রাগে চৌতালে গান গাওয়া হয় ।
এবার "কেদাররাগং ইন্দ্রাভিষেকং বাদ্যং কৃত্বা পদ্মরজমিশ্রিতজলেন" এই মন্ত্র বলে পদ্মরজ বা পদ্মফুলের রেণু মিশ্রিত জল দিয়ে, বীণার সাহায্যে উৎপন্ন ধ্বনিতে কেদাররাগে চৌতালে স্নানাভিষেকের সঙ্গীত গাওয়া হয়।
তারপর "বরাড়ীরাগং শঙ্খবাদ্যং কৃত্বা নির্ঝরোদকপূরিতঘটেন" এই মন্ত্র বলে, শঙ্খধ্বনি, তূর্য, বাঁশী, সানাই ইত্যাদির সাথে ঝর্ণার জল দিয়ে স্নান এবং সঙ্গীত বৈরাটি রাগে ও চৌতালে ।
এবার "বসন্তরাগং পঞ্চশব্দবাদ্যং কৃত্বা সর্বতীর্থাম্বুপূর্ণেন ঘটেন" এই মন্ত্র বলে পাঁচ রকমের ধ্বনি, মানুষের সম্মিলিত ঐক্যতানের সঙ্গে সর্বতীর্থের জল দিয়ে স্নান হয় বসন্তরাগে ও চৌতালে ।
সবশেষে "ধানশ্রীরাগং বিজয়বাদ্যং কৃত্বা শুদ্ধ জলপূরিত ঘটেন" এই মন্ত্র বলে শীতল ও শুদ্ধ জল পূর্ণ ঘটের জল দিয়ে স্নানের সময় গান হয় ধানশ্রী রাগে ও চৌতালে আর বাজানো হয় বিজয়বাদ্য।
অর্থাৎ কাঁসরঘণ্টা দিয়ে শুরু ও শেষ হয় এই মহাস্নান।
কিন্তু কেন এত মাটি আর কেনই বা এতস্থানের জল দিয়ে তাঁর স্নানের আয়োজন? এ যেমন তেমন স্নান নয়। এ হল মহাস্নান যার অর্থ হল মহত বা বিরাট স্নান। স্নানের নানাবিধ বিপুল আয়োজন, দ্রব্যাদির অনুষঙ্গ, ষোড়শ উপাচার স্মরণ করিয়ে দেয় তাঁর মহত্বকে। স্মরণ করায় সৃষ্টির আদিমতম রহস্যকে। যখন ধরিত্রীতে এসে মিশেছিল সর্বপ্রকার বারিধারা। সব স্থানের মৃত্তিকা। প্রথম আদি তব শক্তি। তোমার জন্যেই আমাদের পায়ের নীচে আজ শক্ত মাটি। তোমার জন্যই আমাদের নিত্য প্রয়োজনীয় এই জল। তাই তোমার মহাস্নানেই সেই জল আর মাটি আমরা নিষ্ঠার সঙ্গে যোগাড় করে তোমাকেই নিবেদন করি। অতএব গঙ্গাজলেই গঙ্গাপুজো করে বলি "তদীয় বস্তু তুভ্যমেব সমর্পয়ে" !
পাঠঋণ
চিরঞ্জিবী বনৌষধিঃ শিবকালী ভট্টাচার্য
দুর্গা রূপে রূপান্তরেঃ পূর্বা সেনগুপ্ত
মহিষাসুরমর্দ্দিণি দুর্গাঃ স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ
লেখক পরিচিতি - বেথুন কলেজ ও পরে রাজাবাজার
সায়েন্স কলেজ থেকে অর্গ্যানিক কেমিস্ট্রিতে স্নাতকোত্তর। লেখালেখিতে
ঝোঁক বহুদিনের। ২০০৭ থেকে বাংলায় ব্লগ লেখার শুরু। ২০১১ তে দেশ
পত্রিকায় প্রথম গল্প প্রকাশ। তারপর আনন্দমেলা, এবেলায় ছোটগল্প
এবং আনন্দবাজার পত্রিকায় অনেক ভ্রমণকাহিনী প্রকাশিত। আনন্দবাজার
ইন্টারনেটের শুরু থেকেই লিখে চলেছেন পাঠক কলমে ও হাওয়াবদলে। প্রথম
উপন্যাস "কলাবতী কথা" সানন্দা পুজোসংখ্যায় ( ২০১৫ )
প্রকাশিত। এছাড়াও বহু প্রিন্ট পত্রিকা ও ওয়েব পত্রিকার নিয়মিত
লেখক। এযাবত প্রকাশিত বই চারটি।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।