মূল রচনাঃ জগদানন্দ রায়
ই-বুক সম্পাদনাঃ সুজন দাশগুপ্ত
প্রকাশকঃ অবসর.নেট ২০১৫
© অবসর.নেট
বাংলার পাখী বিভাগের প্রত্যেকটি রচনাই জগদানন্দ রায়ের 'বাংলার পাখী' বইটি থেকে নেওয়া।তবে বইয়ের সাধুভাষাকে আমরা বর্জন করেছি। প্রয়োজন মত লেখাগুলিকে সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে - কিছু পরিমার্জনাও করা হয়েছে। এক কালের বিখ্যাত বিজ্ঞান শিক্ষক ও লেখক জগদানন্দ রায়ের সঙ্গে এখন আর অনেকে তত পরিচিত নন। জগদানন্দ রায় জন্মেছিলেন এক জমিদার পরিবারে ১৮ ই সেপ্টেম্বর ১৮৬৯ খৃষ্টাব্দে। স্কুল পাশ করে এফ.এ. পড়ার সময়ে তাঁর এক সহপাঠী লেখক দীনেন্দ্র কুমার রায়ের সংস্পর্শে এসে তিনি বাংলায় বিজ্ঞান রচনার ব্যাপারে অনুপ্রাণিত হন। জগদানন্দের প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় ভারতী-তে। ওঁর লেখক হবার পেছনে ভারতীর সম্পাদিকাদের অবদান তিনি কৃতজ্ঞচিত্তে পরে স্মরণ করেছেন। ১৮৯০ সালে তিনি যখন বি.এ. পাঠরত তখন কৃষ্ণনগরের মহারাজা ক্ষিতীশচন্দ্র রায় বাহাদুরের সঙ্গে ওঁর যোগাযোগ হয় এবং রাজবাড়ির পরীক্ষাগারে বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি দেখার ও ব্যবহারের সুযোগ পান। এই সময়েই ওঁর বিয়ে হয় শরৎ কুমারী দেবীর সঙ্গে । ১৮৯২ সালে তিনি বি.এ. পরীক্ষা দিলেন, কিন্তু কৃতকার্য হতে পারলেন না। এর কিছুদিন পরে সাধনা পত্রিকায় লেখালেখির ব্যাপারে সাধনা-র তত্কালীন সম্পাদক রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ওঁর যোগাযোগ হয়। রবীন্দ্রনাথ জগদানন্দের স্বচ্ছ বাংলায় লেখা বিজ্ঞান রচনা দেখে এত মুগ্ধ হন যে বহু বছর পরেও একথা তিনি বলতেন। জগদানন্দ কিছুদিন রবীন্দ্রনাথকে জমিদারির কাজে সাহায্য করেছিলেন, পরে রবীন্দ্রনাথ ওঁকে শান্তিনিকেতনে আসতে আহবান জানান। সেখানেই জগদানন্দ ওঁর প্রথম লেখা বই 'প্রকৃতি পরিচয়'। তিনি মূলত ছিলেন বিজ্ঞানের লেখক, তবে গল্প ও কবিতাও তাঁকে এক আধ সময় লিখতে দেখা যায়। প্রকৃতি পরিচয়-এর পরে 'জগদীশচন্দ্রের আবিষ্কার', 'বৈজ্ঞানিকী', 'প্রাকৃতিকী' ইত্যাদি বইগুলি লিখেছেন। ছোটদের উদ্দেশ্যেই বিজ্ঞানের বইগুলি তিনি লিখেছেন। ওঁর একটি অপূর্ব বই হল 'বাংলার পাখী'। এ ছাড়াও 'গ্রহ-নক্ষত্র', 'পোকা-মাকড়', 'গাছপালা' ইত্যাদি বইগুলি তিনি লিখেছিলেন। ১৯৩৩ সালের ২৫ শে জুন এই কর্মযোগীর মৃত্যু হয়।
এ যুগের কিশোর কিশোরীদের কথা মনে রেখে 'বাংলার পাখী' বইটির ই-বুক সংস্করণ প্রকাশ করা হল।যখনই সম্ভব হয়েছে পাখীর রচনার সঙ্গে সেই পাখীর একটি করে ছবি দেওয়া হয়েছে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, বাংলার পাখীদের একটি সুন্দর ওয়েবসাইট হল 'বার্ডস অফ কলকাতা' (Birds of Kolkata)। বহু পাখীর ছবি, তাদের বৈজ্ঞানিক নাম, ইত্যাদি পাওয়া যাবে এই ইংরেজি সাইটে।
অবসর-এ প্রকাশিত ই-বুক বিনা মূল্যে বিতরণ করা হয়। কিন্তু বইগুলো কপিরাইট সংরক্ষিত। এগুলি পাঠকদের নিজেদের ব্যবহারের জন্যে - অন্যান্য ওয়েবসাইটে তুলে বিতরণের জন্যে নয়।
সুজন দাশগুপ্ত
এই পাখীদের তোমরা দেখেছো কিনা জানি না। অনেক এদের তালচোঁচ জাতীয় পাখী বলে মনে করেন। কিন্তু অবাবিল ও তালচোঁচ পৃথক জাতের পাখী। আবাবিলের পায়ের নোখ, চেহারা, এবং বাসা তালচোঁচের তুলনায় সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। তালচোঁচরা গাছের ডালে বসতে পারে না, কিন্তু আববাবিলেরা ডালে বসে ও দরকার হলে মাটিতে হেঁটে বেড়ায়।
আমরা সচরাচর যে সব আবাবিল দেখতে পাই, তাদের পিঠের পালকের রঙ কালো, কিন্তু বুক ও পেটের রঙ সাদাটে - লেজেও সাদা ফুটকি আছে। মুখ ও গলা আবার কিছুটা খয়েরি রঙের পালকে ঢাকা থাকে। এদের বাসাগুলি অতি সুন্দর। কোথা থেকে কাদা বয়ে এনে এরা পেয়ালার আকারে কাদার বাসা তৈরি করে এবং কাদার ওপর ঝরা পালক লাগিয়ে দেয়। কখনো কখনো বাড়ির কড়ি-বরগার ফাঁকে ও কার্নিসে এই রকম বাসা অনেক দেখা যায়। এরাও দল বেঁধে থাকতে ভালোবাসে এবং এক জায়গায় বাসা তৈরি করে।
আবাবিলরা স্ফূর্তিবাজ পাখী। এদের একদণ্ডও স্থির থাকতে দেখা যায় না - ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে বাসার কাছে চিত্কার করে এবং সঙ্গে সঙ্গে পোকা-মাকড় ধরে খায়। অন্য পাখীদের মত এরা লতায়পাতায় বা ঘাসের মধ্যে পোকা খুঁজে বেড়ায় না। উড়তে উড়তে এবং ডাকতে ডাকতে পোকা শিকার করা, বৃষ্টির সময়ে উড়তে উড়তে স্নান করা ও জল খাওয়াই এদের স্বভাব। আবাবিলরা বেশি শীত সহ্য করতে পারে না। তাই যে সব দেশে বেশি শীত, সেখান থেকে শীতকালে গরম দেশে পালিয়ে যায়, তারপর গ্রীষ্মকাল এলে স্বদেশে ফিরে যায়।
আবাবিলদের ডিম বড় মজার। এরা সাদা ও লালচে - দুই রকমেরই ডিম পাড়ে। ডিমের ওপর কখনো কখনো গাঢ় লালের ছিটেফোঁটাও দেখা যায়।
আমরা এখানে কেবল এক রকমের আবাবিলের কথা বললাম। ভারতবর্ষে প্রায় কুড়ি জাতের আবাবিল দেখা যায়। নকুটি নমে এক রকম ছোট আবাবিল নদীর ধারে প্রায়ই ঘুরে বেড়ায়। এরা আকারে চড়ুই পাখীদের থেকেও ছোট। রঙ খয়েরি। এদের লোকের বাড়িতে এসে বাসা করতে দেখা যায় না। তোমরা বোধ করি এই পাখীদের দেখ নি। উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে বেড়াতে গিয়ে আমরা নদীর ধারে নকুটি পাখী অনেক দেখেছি।
আবাবিলের ইংরেজি নাম: Barn swallow; বৈজ্ঞানিক নাম:Hirundo rustica; গড় দৈর্ঘ্য: ১৮ সে.মি। আবাবিলের ছবিটি শ্রী সুমিত সেন-এর সৌজন্যে পাওয়া)
আমাদের বাংলা দেশে যত কাক দেখা যায়, বোধহয় আর কোথাও তত দেখা যায় না। খুব ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এই লক্ষ্মীছাড়া পাখীর উত্পাতে অস্থির হতে হয়। কুচকুচে কালো। ঠোঁটগুলো কিন্তু ভারি বিশ্রী। কাকের ডাক যদি কোকিলের মত মিষ্টি হত, তাহলে বোধ করি লোকে কাকগুলোকে খাঁচায় রেখে পুষতো।
কাকেরা যত উত্পাতই করুক, তাদের কাছে থেকে আমরা কোন উপকার পাই না, একথা বলা যায় না। মরা ইঁদুর, বিড়াল এবং পচা খাবার বাড়ির বাইরে ফেলে দিলেই কাকেরা তাকে ঠোঁটে করে দূরে নিয়ে যায় এবং সেগুলো খেয়ে হজম করে ফেলে। তা ছাড়া আরও নোংরা জিনিস এরা খায়। তাই সেগুলো মাঠে ঘাটে পচতে পারে না।
কাকেরা বছরের বেশির ভাগ সময়েই গাছের ডালে বসে হিমে-শীতে রাত কাটায় এবং বৃষ্টিতে ভেজে। একটু নির্জন কোন জায়গায় এদের এক একটা করে গাছ ঠিক করা থাকে। সন্ধ্যা হলেই নানান জায়গা থেকে কাকেরা উড়ে এসে তাদের নিজেদের গাছের ডালে বসে। সেই গাছে ছাড়া অন্য গাছে তারা রাত কাটাতে চায় না। শুধু কাকেরা নয় শালিক ও অন্যান্য পাখীরাও অনেক সময়ে একই গাছে রাত কাটায়। ভোরের আলো চোখে পড়লে কাকরা আর ঘুমোতে পারে না। চিত্কার শুরু করে।
কাকদের গায়ে কি রকম দুর্গন্ধ তা বোধহয় তোমরা জানো না। যেমন নোংরা জিনিস খায়, তেমনি দুর্গন্ধ - কাছে দাঁড়ানো যায় না। কিন্তু কোনদিন এদের স্নান বাদ যায় না। তোমরা কাকের স্নান দেখো নি কি? আমরা যেমন সমস্ত দিন খেটেখুটে কখনো কখনো সন্ধ্যার সময়ে গা, হাত, পা ধুই ও স্নান করি, কাকেরও ঠিক ঠিক তাই করে। বাসায় ফেরার আগে নদী বা পুকুরের জলে নেমে ঠোঁট দিয়ে গায়ে জল ছড়ায় এবং দুই ডানা মেলে ফটফট শব্দ করে। কাকদের এই স্নান দেখা বড় মজার। সমস্ত গা এরা কখনোই ভেজায় না - তাই গায়ের গন্ধ যায় না।
কাকদের বাসাগুলো বড় বিশ্রি। চালাক-চতুর পাখী হলে কি হয়, বাসা তৈরী করতে ওরা একেবারেই বুদ্ধি খরচ করতে পারে না। শুকনো সরু ডাল, ঘাস, খড়, কাগজের কুচো আরও কত ছাইভস্ম দিয়ে তারা বাসা বানায়। কখনো লোহার টিনের টুকরোও তাদের বাসায় পাওয়া যায়। কোনও রকমে সেগুলো ডালে আটকিয়ে তার ওপর কাকেরা পাঁচ ছায়টা করে ফিকে নীল রঙের ডিম পাড়ে। কাকেরা বাচ্চা খুব ভালোবাসে। কোকিলরা লুকিয়ে লুকিয়ে কাকের বাসায় ডিম পেড়ে আসে। কাকেরা ডিমগুলো নিজদের ডিম ভেবে তাতে তা দেয় এবং বাচ্চা হবার পর সেগুলোকে আদর করে বড়ও করে। কোকিলের ডিম কাকের ডিমের থেকে ছোট এবং রঙটাও কতকটা সবুজ - তার ওপর হলুদের পোঁচও থাকে। তাও কেন কাকেরা সেগুলোকে নিজেদের ডিম ভাবে বোঝা শক্ত। ফিঙে, প্যাঁচা, চরুই, চিল এরা সব চেষ্টা করে কাকেদের ডিমগুলোকে নষ্ট করতে, কিন্তু কাকেরা ঘুরে ঘুরে নিজেদের বাড়ি পাহারা দেয় এবং ডিম ও বাচ্চাদের রক্ষা করে।
(কাকের ইংরেজি নাম: House Crow; বৈজ্ঞানিক নাম:Corvus splenden; গড় দৈর্ঘ্য: ৪৩ সে.মি। কাকের ছবিটি টোনি কোটসওয়ার্থ-এর সৌজন্যে পাওয়া।)
কাঠঠোকরা পাখীদের একটু চেষ্টা করলেই তোমরা বাগানে দেখতে পাবে। এরা গাছের গায়ে নখ আটকিয়ে ঠোকর মারে। এইজন্যেই এদের নাম কাঠঠোক্রা। অনেক কাঠঠোকরার মাথায় ঝুঁটি থাকে। এদের ঠোঁট খুব লম্বা ও পায়ের নখ বেশ ধারালো হয়। গাছের শুকনো পচা ডালপালার ভিতরে যে সব পোকা-মাকড় থাকে , তাই এদের প্রধান আহার। সেইজন্য ওরা গাছের গায়ে পা ও লেজ লাগিয়ে কাঠে ঠোকর দেয় যাতে পচা ও শুকনো কাঠের নিচে যে সব পোকা-মাকড় থাকে - সেগুলো বার হয়ে পড়ে। কাঠঠোক্রার জিভ খুব লম্বা আর জিভের আগায় সুঁচের মত কাঁটা এবং এক রকমের আঠা লাগানো থাকে। সেই কাঁটায় বিঁধিয়ে ও আঠায় জড়িয়ে এরা পোকাদের মুখে পোরে।
আমাদের দেশে শুধু দুই ধরণের কাঠঠোকরা দেখা যায়, কিন্তু সমস্ত ভারতবর্ষে ছাপ্পান্ন উপজাতির কাঠঠোক্রা আছে। গা সাদা ও কালো পালকে ঢাকা এবং মাথায় লাল ঝুঁটিওয়ালা কাঠঠোকরাা সাধারণত আমাদের নজরে পড়ে। একটু ভালো করে লক্ষ্য করলে তোমরা এদের মাথার পালকগুলিতে হলদে ও পেটের কয়েকটি জায়গায় লাল দেখতে পাবে। লাল ঝুঁটি কিন্তু পুরুষ কাঠঠোকরাদেরই থাকে। কাঠঠোকরা ভালো উড়তে পারে না। এদের ওড়ার ভঙ্গি কতকটা ঢেউয়ের মত। এগুলি ছাড়া যে কাঠঠোকরা দেখা যায়, তাদের গায়ের রঙ খয়েরি।
অন্য পাখীরা যেমন খড়কুটো ও লতাপাতা দিয়ে বাসা তৈরি করে, কাঠঠোকরা তা করে না। তারা বাটালির মত ধারালো লম্বা ঠোঁট দিয়ে গাছের গুঁড়ি কুরে গর্ত করে - এই গর্তই তাদের বাসা। পাখীদের বাসা সাধারণত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়, তাতে কোনোময়লা জিনিস থাকে না। কিন্তু কাঠঠোকরার বাসায় ঠিক তার উল্টো। এদের কোটরগুলি বিষ্টা, গায়ের খসা পালক এবং পোকা-মাকড়ের শরীরের খোলায় ভর্তি থাকে। এইসব জিনিস পচলে বাসাগুলিতে দুর্গন্ধও হয়। কাঠঠোকরার ডিমগুলি ফুটফুটে সাদা। এরা স্ত্রী পুরুষ দুইয়ে মিলে বাচ্চাদের বড় করে এবং যখন গাছের গুঁড়ি কুরে বাসা তৈরি করতে হয়, তখনও স্ত্রী-পুরুষে মিলে পরিশ্রম করে - কেউ কাউকে ফাঁকি দিতে চায় না। এগুলি সব ভালো, কিন্তু এদের গলার স্বর একটুও ভালো নয়। এদের গলায় ক্যাচক্যাচ শব্দে যেন কান জ্বালা করে।
(ছবিতে যে কাঠঠোকরা দেখানো হয়েছে, সেটি সোনালী কাঠঠোকরা - তার ইংরেজি নাম: Golden-backed Woodpecker; বৈজ্ঞানিক নাম: Dinopium benghalense; গড় দৈর্ঘ্য: ২৬ - ২৯ সে.মি.। সোনালী কাঠঠোকরার ছবিটি শ্রী আর এস সুরেশ-এর সৌজন্যে পাওয়া।)
ইংরেজিতে এই পাখীদের নাম স্নাইপ। এদের মাংস খেতে নাকি খুব সুস্বাদু, তাই সে দেশের লোকরা বন্দুক দিয়ে এদের গণ্ডায় গণ্ডায় মেরে ফেলে। এইজন্য স্নাইপ প্রায় শহরের কাছে দেখাই যায় না। যাইহোক, ইংরেজদের স্নাইপ আমাদের কাদাখোঁচা। এদের আবার কেউ কেউ চাহা পাখীও বলে। কাদাখোঁচা বারোমাস আমাদের দেশে থাকে না। বর্ষার শেষে আসে, এসে সমস্থ শীতকালটা আমাদের দেশে কাটিয়ে দেয়। তারপর একটু গরম পড়লেই ঠাণ্ডা জায়গায় চলে যায়। তোমরা গ্রামের বাইরে জলাশয়ে খোঁজ করলে শীতকালে এদের দুয়েকটাকে হয়তো দেখতে পাবে। কাদাখোঁচারা জলের মধ্যে থেকে ঠোঁট দিয়ে পোকা-মাকড় ধরে খায়। এই জন্যেই বোধকরি এদের নাম কাদাখোঁচা হয়েছে।
সাধারণ কাদাখোঁচাদের মাথার দুইপাশে সাদা, গলা ও পিঠ খয়েরি। কিন্তু পা দুখানি সবুজ এবং ঠোঁট বেশ লম্বা। যখন খাল ও বিলের ধারে কাদার মধ্যে পোকা-মাকড়ের সন্ধান করে বেড়ায়, তখন দূর থেকে এদের বেশ দেখায়।
(কাদাখোঁচার ইংরেজি নাম: Common Snipe; বৈজ্ঞানিক নাম Gallinago Gallinago; গড় দৈর্ঘ্য: ২৬ সে.মি। কাদাখোঁচার ছবিটি শ্রী কোজি ট্যাগি-র সৌজন্যে পাওয়া।)
কুকো পাখী তোমরা হয়তো পল্লীগ্রামে দেখে থাকবে। এরা লম্বা লেজওয়ালা বেশ বড় পাখী। জঙ্গলের মধ্যে ছোট ছোট গাছে ও বাঁশঝাড়ে এদের প্রায়ই দেখা যায়। বাগানের ফাঁকা জায়গায় বা গৃহস্থের বাড়িতে এরা কখনো আসে না। ডানা খুব লম্বা নয়, তাই অনেক দূরে উড়ে বেড়াবার শক্তি এদের থাকে না।
কুকোদের ডানাগুলো খয়েরি। তাছাড়া শরীরের অন্য সব জায়গার পালকের রঙ কালো। ঠোঁট ও পায়ের রঙও কালো। কিন্তু চোখ দুটো সুন্দর লাল। কুকোরা কোকিল জাতির পাখী হলেও কোকিল বা পাপিয়াদের মত এরা পরের বাসায় ডিম পাড়ে না। কুকোদের বাসা বোধ করি তোমরা দেখ নি। নিরিবিলি ঘন জঙ্গল বা বাঁশঝাড়ের মধ্যে এরা বাসা বাঁধে। কুকোদের বাসা কাক বা শালিকের বাসার মত নয় - এদের বাসায় ছাদ থাকে এবং ভিতরে যাবার জন্য একটা দরজাও থাকে। দূর থেকে দেখলে অবশ্য বাসাগুলোকে এক একটা লতা পাতার পিণ্ড বলে মনে হবে।
কুকোরা কি রকম শব্দ করে ডাকে তা বোধ হয় তোমরা শুনেছো। খুব ভোরে যখন কাক কোকিলেরাও ঘুমোয়, তখন কুকোরা উঃ উঃ উঃ শব্দে গম্ভীরভাবে ডাক জুড়ে দেয়। এই ডাক অনেক দূর থেকে শোনা যায়। বিছানায় শুয়ে শুয়ে শুনতে সেটা মন্দ লাগে না। কুকোদের ডাক শুনলে বোঝা যায়, ভোর হয়ে আসছে, কারণ কোকিল ও পাপিয়াদের মত এরা কখনোই রাত্রে ঘুমের ঘোরে ডাকে না।
(কুকোর ইংরেজি নাম: Greater Coucal (Crow Pheasant); বৈজ্ঞানিক নামCentropus sinensis; গড় দৈর্ঘ্য:৪৮ সে.মি।)
কোকিলের ডাক তোমরা অনেকেই শুনেছো। ওদের চেহারা ভালো করে দেখেছো কিনা জানি না। কোকিলের স্ত্রী ও পুরুষদের চেহারা সম্পূর্ণ পৃথক। পুরুষ কোকিলের গায়ের সব পালকের রঙ চকচকে কালো। চোখ দুটি আবার সুন্দর লাল। কিন্তু ঠোঁটের রঙ যেন কতকটা সবুজ রকমের। এরাই ফাল্গুন থেকে বৈশাখ মাস পর্যন্ত কেবল কু-উ কু-উ করে ডাকে। এদের গলার স্বর খুব মিষ্টি। কিন্তু বারো মাস এই রকম স্বরে ডাকতে পারে না। আষাঢ় মাস থেকে কুহু কুহু কুক কুক শব্দ ছাড়া অন্য সুর তাদের গলা থেকে বার হয় না।
স্ত্রী কোকিলদের গায়ের রং খানিকটা খয়েরি। তারই ওপর আবার সাদা ডোরা ও ছিটেফোঁটা থাকে। লোকে এদের তিলে কোকিল বলে। আমরা ছেলেবেলায় ভাবতাম তিলে কোকিলরা অন্য জাতের কোকিল। কিন্তু তা নয়, এরা স্ত্রী কোকিল। স্ত্রী কোকিলরা কু-উ কু-উ ডাকতে পারে না। এদের গলার স্বর কি রকম যেন ভাঙা ভাঙা, বিশ্রী। অনেকের ধারণা কোকিলরা বর্ষাকালে আমাদের দেশ ছেড়ে পালায় - তারপর ফাল্গুন মাসে আবার ফিরে আসে। বোধহয় কোকিলদের ডাক শুনতে না পেয়ে তারা এটা ভাবে। কিন্তু সেটা ভুল, কোকিলরা বারোমাসই আমাদের দেশে থাকে। আষাঢ় মাস পরলেই তাদের গলার স্বর বন্ধ হয়ে যায় আর তাদের স্ফুর্তিও কমে যায়। এই কয়েকটা মাস তারা গাছের পাতার আড়ালে লুকিয়ে অশথ, বট প্রভৃতি গাছের ফল ও পোকা-মাকড় খেয়ে থাকে। তারপর ফাল্গুন মাসে দখিন হাওয়া গায়ে লাগলেই গলা ছেড়ে গান শুরু করে।
যাইহোক, কোকিল বড় লক্ষ্মীছাড়া পাখী। ফাল্গুন চৈত্র মাসে যখন অধিকাংশ পাখী ডিম পাড়বার জন্য ব্যস্ত হয়ে খড়কুটো কুড়িয়ে দিন কাটায়, তখন কোকিলরা গানেই মত্ত থাকে - ঘর-সংসারের দিকে একটুও তাকায় না। কোকিলদের বাসা তোমরা দেখেছো কি? এরা জন্মেও বাসা বাঁধে না। বাসা বাঁধতে হয় জানে না, বা চায় না। ডিম পাড়ার সময় হলে কাকের বাসায় গিয়ে ডিম পেড়ে আসে। ডিমে তা দেওয়া, ছানাদের যত্ন করা প্রভৃতি কাজ কি করে করতে হয় - কোকিললরা জানেই না। কাকেরা কোকিলের ডিমে আদর করে তা দেয়, ডিম ফুটলে কোকিলের বাচ্চাদের নিজেদের বাচ্চা ভেবে যত্ন করে পালন করে। পরে বাচ্চারা একটু বড় হলে যখন কোকিলের বাচ্চা বলে চিনতে পারে, তখন তাদের দূর দূর করে তাদের তাড়িয়ে দেয়। কিন্তু তাতে ক্ষতি হয় না। কোকিলের বাচ্চারা তখন নিজেরাই উড়ে উড়ে নিজেদের খাবার জোগার করে নিতে পারে।
তোমরা হয়তো ভাবছো যখন কাকেরা বাসায় থাকে না, তখন স্ত্রী কোকিল লুকিয়ে কাকের বাসায় ডিম পেড়ে আসে। কিন্তু তা নয়। যে রকম ফন্দি করে কোকিলরা কাকের বাসায় ডিম পারে - সেটা বড় মজার। ডিম পাড়ার সময় হলে স্ত্রী কোকিলকে পাতার আড়ালে বসিয়ে পুরুষ কোকিল কাকের বাসার কাছে ডালে বসে কু-উ কু-উ বলে গান জুড়ে দেয়। নিজেদের বাসার কাছে কোকিলদের গাইতে দেখে কাকেরা আর স্থির থাকতে পারে না। বাসার বইরে এসে কা - কা করে কোকিলকে তাড়া করে। কিন্তু কোকিল চালাক পাখী, কাকের তাড়ায় ভোলে না। কিক-কিক-কুক-কুক শব্দ করতে করতে পালাবার ভান করে এবং কাকেরা বাসা ছেড়ে কোকিলের পেছন পেছন ছুটে চলে। এই রকম কাকেরা যখন বাসা ছেড়ে কোকিলকে তাড়াবার জন্য খুব দূরে যায়, তখন স্ত্রী কোকিল পাতার আড়াল থেকে বার হয়ে এসে কাকের বাসায় ডিম পাড়ে। কেবল তাই নয়, যদি বাসা কাকের ডিমে ভরা থাকে, তবে স্ত্রী কোকিলরা দু-চারটে ডিম মাটিতে ফেলে দিয়ে সেই শূন্য জায়গায় নিজেদের ডিম পাড়ে।
(কোকিলের ইংরেজি নাম: Asian Koel; বৈজ্ঞানিক নাম:Eudynamys scolopacea; গড় দৈর্ঘ্য: ৪৩ সে.মি। কোকিলের ছবিটি শ্রী সুমিত সেন-এর সৌজন্যে পাওয়া)
খঞ্জন জাতির সব পাখী বারো মাস আমাদের দেশে থাকে না। শীত পড়লে এরা বাংলা মুলুকে চরতে আসে, আর গরম পড়লেই দেশ ছেড়ে চলে যায়। কিন্তু যে জাতের পাখীকে আমরা খঞ্জন বলি, তারা বারো মাসই আমাদের দেশে থাকে। খঞ্জন জাতের পাখীর উড়ার ভঙ্গিটা বড় মজার। তারা কাক বা শালিক প্রভৃতি পাখীদের মত সোজাসুজি উড়তে পারে না। লক্ষ্য করলে দেখবে, যেন ঢেউয়ের গতিতে উঁচু নিচু হয়ে এরা উড়ে বেড়াচ্ছে। তাছাড়া লেজ নাড়া এদের একটা অভ্যাস। আমাদের মধ্যে যেমন অনেকে চেয়ার বা বেঞ্চে বসে ক্রমাগত পা নাড়ায়, খঞ্জন জাতির পাখীরা সেই রকম অবিরাম লেজ নাড়ায়। এইজন্য ইংরেজিতে এদের বলে 'লেজ-নাড়া' পাখী এবং হিন্দুস্থানীরা এদের বলে 'ধোবিন'। ধোবারা যেমন কাপড় আছড়ায়, এই পাখীরা সেই রকম লেজগুলো উঁচু নিচু করে নাচায় বলে তাদের এই নাম হয়েছে।
খঞ্জন জাতির পাখীদের আমরা ফলমূল খেতে দেখি নি। বোধ করি এরা ফলমূল খায় না, তাই সাধারণত গাছের ডালে বসে না। পোকা-মাকড়ই এদের প্রিয় খাদ্য। এই জন্য মাঠে মাটির উপরে লেজ নাড়তে নাড়তে এরা চরে বেড়ায় - তারা দিলে কিচ কিচ করে ডেকে উঠে উড়ে যায়। এই সব লক্ষণ দেখে তোমরা বোধ করি খঞ্জন জাতির পাখীদের চিনে নিতে পারবে।
আমরা যাদের খঞ্জন বলি, সেগুলি লেজনাড়া ধোবিন পাখীদের চেয়ে আকারে বড়। এদের বুক ও শরীরের নিচেকার পালকের রঙ সাদা। ডানায় একটা করে মোটা সাদা ডোরা আছে।লেজের পালকের রঙ ও ভুরুর রঙ সুন্দর সাদা। খঞ্জনেরা গাছের উপরে বাসা বাঁধে না। বাড়ির নালার ভিতরে বা ফাটলে এদের বাসা করতে দেখেছি। এই বাসার উপরেই এরা ফিকে সবুজ রঙের ডিম পাড়ে। খঞ্জনদের গলার স্বর খুব মিষ্টি। কিন্তু সব সময়ে এরা গান গায় না। পোকা খেয়ে পেট ভরে গেলে এদের গানের শখ চাপে। তখন টেলিফোনের তারের উপরে বা কোন নিরিবিলি জায়গায় বসে গান জুড়ে দেয়।
(খঞ্জনের ইংরেজি নাম:Wagtail; বৈজ্ঞানিক নাম:Motacilla; দৈর্ঘ্য: ১৮ - ১৯ সে.মি.। খঞ্জনের যে ছবিটি দেখানো হয়েছে সেটি হল হলদে খঞ্জন। এর ইংরেজি নাম Yellow Wagtail; বৈজ্ঞানিক নাম:Motacilla flava । ছবিটি সাফারিক্যামলাইভ.কম-এর Motacilla flava সৌজন্যে পাওয়া।)
গাংশালিক তোমরা হয়তো দেখেছো। এদের দেখতে অনেকটা সাধারণ শালিকের মত, তবে গায়ের রং খয়েরি নয়, কতকটা ধূসর এবং ঠোঁট ও চোখের গোড়ার রঙ লালচে। গাংশালিকদের পুষলে টিয়া ও ময়নার মত কথা বলতে শেখানো যায়। তবে খাঁচায় বন্দি না করে এদের বাইরে চরতে দেওয়াই ভালো। এদের তোমরা গৃহস্থের বাড়িতে বা বাগানে চরতে দেখবে না। নদীর ভাঙনের গায়ে গর্ত খুঁড়ে এবং তাতে খড়কুটো জমা করে চৈত্র বৈশাখ মাসে বাসা করে তাতেই এরা ডিম পাড়ে। নদীর ধারে বেড়াতে গেলে তোমরা এদের ঝাঁকে ঝাঁকে কিচিমিচি চিত্কার করতে করতে চরতে দেখবে। সাধারণ শালিকদের ডিমের মত গাংশালিকদের ডিমের রঙও নীল। বাচ্চা গাংশালিকদের চোখের গোড়ায় লাল রঙ দেখা যায় না - বড় হলে ঐ জায়গায় চামড়ার রঙ লাল হয়ে দাঁড়ায়।
আমরা যখন ছেলেবেলায় নৌকোয় করে গঙ্গাস্নানে যেতাম, তখন নদীর ভাঙনের গায়ে শত শত গাংশালিকের গর্ত দেখতে পেতাম। তোমরাও নদীর ধারে বেড়াতে গেলে গাংশালিকের বাসা দেখতে পাবে।
(গাংশালিকের ইংরেজি নাম: Bank Mynঅ; বৈজ্ঞানিক নাম:Acridotheres ginginianus; গড় দৈর্ঘ্য::২৩ সে.মি। গাংশালিকের ছবিটি শ্রী সুমিত সেন-এর সৌজন্যে পাওয়া)
ঘুঘুরা পায়রা জাতের পাখী। পূর্ববঙ্গের (এখনকার বাংলাদেশ) লোকেরা ঘুঘুদের 'ঢুপি' পাখী বলে ডাকে। ভারতবর্ষে বেশ কয়েক রকমের ঘুঘু আছে। কিন্তু সচরাচর আমরা দু-ধরণের ঘুঘু দেখতে পাই। তিলে ঘুঘু তোমরা দেখেছো কি? এই ঘুঘুই কিন্তু আমরা বাগানে ঘাটে-মাঠে বেশি দেখতে পাই। এদের গায়ের রং যেন কতকটা লাল্চে। ঘাড়ের ওপরে ও গলায় সাদা ফোটা আছে। লেজের পালক কতকটা কালো, কিন্তু সেগুলির শেষে সাদা ছোপ লাগানো। গায়ে সাদা সাদা ফোঁটা আছে বলেই বোধহয় এদের তিলে ঘুঘু নাম দেওয়া হয়েছে। তিলে ঘুঘুদের ডাক বেশ মজার। ক্রুকু ক্রু ক্রু ক্রু ক্রু - এই রকম শব্দ করে এরা সকালে দুপুরে ক্রমাগত ডাকে। ক্রু ক্রু শব্দটা কখনো কখনো তাদের গলা থেকে সাত আটবার পর্যন্ত বার হয়।
গলার ওপরে কণ্ঠীওয়ালা আর এক ধরণের ঘুঘু তোমরা খোঁজ করলে বাগানে দেখতে পাবে। এরা তিলে ঘুঘুদের মত বারবার ক্রু ক্রু শব্দ গলা থেকে বার করে না, কু কু কুঃ - কেবল এই শব্দেই ডাকে। কখনো কখনো রাতেও এদের ডাক শোনা যায়। এই দুরকমের ঘুঘু ছাড়া শ্যাম ঘুঘু, রাম ঘুঘু ইত্যাদি নামের ঘুঘু কখনো কখনো দেখা যায়। রাম ঘুঘুরা জঙ্গলের পাখী। বনেই সাধারণত থাকে আর বনের ফল খায়। তাছাড়া এক ধরণের লাল ঘুঘুও মাঝে মাঝে দেখা যায়। এদের ডানা বেশ লম্বা ও গোলাপী রঙের। কিন্তু মাথাটা ধূসর। এই ঘুঘুরা সাধারণত ঝাঁকে ঝাঁকে চরে বেড়ায়।
ঘুঘুদের বারো মাসই ডিম হয়। তাই বাসা বাঁধার জন্য বারো মাসই ওরা ব্যস্ত থাকে। কোনোমতে কতগুলো খড়কুটো একত্র করে তার ওপর ওরা সাদা রঙের দু-তিনটে করে ডিম পাড়ে। কাক, কোকিল, হাঁড়িচাচারা অন্য পাখীদের ডিম চুরি করে খায়। ঘুঘুরা সেটা জানে বলে বাসার কাছে এদের কাউকে দেখলেই কোঁ কোঁ শব্দ করে তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।
(ঘুঘুর ইংরেজি নাম: Spotted Dove ; বৈজ্ঞানিক নাম: Streptopelia chinesi; গড় দৈর্ঘ্য: ৩০ সে.মি। ঘুঘুর ছবিটি শ্রী সুমিত সেন-এর (শমেতে খ. শএন) সৌজন্যে পাওয়া।)
সমস্ত দিনই তোমরা চড়ুইদের দেখতে পাও এবং চিত্কার শুনতে পাও, তাই এদের সম্পর্কে বেশি কিছু বলা প্রয়োজন হবে না। পুরুষ ও স্ত্রী-চড়ুইদের চেহারা ঠিক এক রকমের নয় - এটা তোমরা লক্ষ্য করেছো কি? পুরুষ পাখীদের দুই গাল ও ঘাড়ের দুই দিক সাদা। কিন্তু গলা কালো মাথার ও পিছনের পালক ছাই রঙের। ডানা ও লেজের রঙ যেন কতকটা বাদামী। চোখের উপরের এবং ঘাড়ের পালক আবার পেয়ালা রঙের। স্ত্রী চড়ুইদের গায়ের রঙে কিন্তু এত বাহার নেই। এদের গায়ের উপরকার পালকের রঙ বাদামী ও সাদায় মেশানো। কিন্তু পেটের তলা প্রায় সাদা। উড়বার সময় স্ত্রী ও পুরুষ দুই পাখীরই ডানার নিচে সাদা পালক দেখা যায়।
চড়ুইরা মাটিতে বেড়াবার সময় লাফিয়ে চলে। এমনিতে এরা বেশ দল বেঁধে চরতে বার হয়। কিন্তু ডিম পাড়বার আগে যখন নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করে, তখন কেউ কাউকে ক্ষমা করে না। পায়ে পা বাঁধিয়ে চিত্কার করতে করতে মাটিতে গড়াগড়ি দেয়।
ঘাসের বীজ ও অন্য শস্যই চড়ুইদের প্রধান খাদ্য। তবে পোকা-মাকড় সামনে পেলে তাও খায়। মাটি থেকে শস্য খুঁটে খেতে হয় বলে, এদের ঠোঁটগুলো বেশ মোটা ও সক্ত। চড়ুইদের স্নান দেখেছো কি? অন্য পাখীরা স্নান করে জল দিয়ে। চড়ুইরা স্নান করে ধুলো দিয়ে। দুটো তিনটে চড়ুই কিছুক্ষণ ধূলোতে লুটোপুটি খেয়ে গা ঝেড়ে চলে গেল - এটা প্রায়ই দেখা যায়। বোধকরি গায়ে পোকা হলে ওরা এরকম ধূলো মাখে।
যাইহোক, চড়ুই পাখী ছোট হলেও বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে বাসা বাঁধবার সময় বড্ড জ্বালাতন করে। এরা জঙ্গলের বা বাগানের গাছের ডালে বাসা বাঁধে না। খরকুটো শুকনো ঘাস ঠোঁটে নিয়ে ঘরের কড়িকাঠের ফাঁকে বা কার্নিশে জমা করে। কিন্তু যা কষ্ট করে বয়ে আনে তার প্রায় সবটাই মাটিতে পড়ে যায়। তাই বারবার ঘর ঝাঁট দিয়েও পরিষ্কার রাখা যায় না। যদি চুপ করে এক মনে বাসা বাঁধে তাহলে কোনো হাঙ্গামা থাকে না। কিন্তু চড়ুইরা চুপ করে থাকতে পারে না। একগাছি খড় ঠোঁটে করে এনে স্ত্রী-পুরুষে মিলে চরচর শব্দ করতে করতে বাসার চারদিকে উড়ো-উড়ি আরম্ভ করে। একই ঘরে যদি দুই জোড়া চড়ুই বাসা করে, তাহলে সর্বনাশ। দিনের মধ্যে দশবার ওদের মধ্যে ঝগড়া হবে।
চড়ুই জাতিরই আর একটা পাখী হল তুতী পাখী। শীতকালে এই পাখীরা আমাদের দেশে বেড়াতে আসে। চৈত্র মাস পড়লেই অন্যদেশে চলে যায়। তুত ফল খেতে ভালোবাসে বলে এদের তুতী বলা হয়। পাখীগুলি দেখতে খুব সুন্দর। এদের পিঠের রং খয়েরি, কিন্তু বুক, গলা, মাথার রঙ গোলাপী। এটা পুরুষ পাখীদের গায়ের রঙ। স্ত্রী পাখীদের পালকে রঙের এত বাহার নেই। তবে চড়ুইদের মত এরা গৃহস্থের বাড়িতে বাসা বাঁধে না। বাগানে বেড়াবার সময় খোঁজ করলে হয়তো দু-একটা নজরে পড়বে।
(চড়ুই-এর ইংরেজি নাম: House Sparrow; বৈজ্ঞানিক নাম: House Sparrow গড় দৈর্ঘ্য:১৫ সে.মি.। পুরুষ চড়ুই-এর ছবিটি শ্রী আর এস সুরেশ-এর সৌজন্যে পাওয়া।)
শিকারী পাখীদের কথা বলতে গেলে চিলের কথাই আগে মনে পড়ে যায়। এদের চেহারা তোমরা সবাই দেখেছো। সাধারণ চিলেরা কখনো কখনো এক হাতের বেশি লম্বা হয়। আবার স্ত্রী-চিলদের পুরুষের চেয়ে যেন আকারে বড় দেখায়। তোমরা বোধ করি চিলের গায়ের পালকের রঙ ভাল করে লক্ষ্য কর নি। রঙ খুব চকচকে এবং জমকালো নয়, অথচ দেখতে মন্দ লাগে না। দূর থেকে চিলকে দেখলে মনে হয় যেন তার গায়ের রঙ খয়েরি। কিন্তু গায়ের পালকের সব জায়গার রঙ একই রকমের খয়েরি নয়।
চিলদের উড়া তোমরা লক্ষ্য করেছো কি? কাক, শালিক, পায়রা যেমন ডানা নেড়ে উড়ে বেড়ায়, এরা সাধারণত সে রকম করে উড়ে না। ডানা দু'খানিকে মেলে স্থির রেখে উড়াই এদের স্বভাব। তাছাড়া উড়বার ভঙ্গিটাও বড় সুন্দর। চিলেরা যখন কোন শিকারের উপরে ছোঁ মারতে যায়, তখন ডানা স্থির রেখে প্রায়ই আকাশে চক্রাকারে কয়েকবার ঘুরপাক দেয়, তারপরে ফস করে শিকারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।
শিকারী পাখীদের চোখের জোর খুব বেশি। মাঠে একটা ছোট ইঁদুর চলে বেড়ালেও তা তারা বহু উঁচু থেকে দেখতে পায়। চিলেরা এই রকম অনেক উপরে উড়তে উড়তে মাঠে-ঘাটে কোথায় কোন খাবার আছে দেখে নিয়ে ছোঁ মারে। কিন্তু দেখো, চিলেরা ঠোঁটে করে কোনো খাবারের জিনিস ধরে না। ছোঁ মেরে পায়ের ধারালো নখ দিয়ে খাবার ধরে। তারপর কোন গাছের মাথায় নিয়ে গিয়ে সেই বাঁকানো ও ধারাল ঠোঁট দিয়ে ছিঁড়ে খায়। পায়ে খাবার নিয়ে উড়ে চলে বলে অনেক সময়ে কাকের দল সেটা কেড়ে নেবার জন্য চিলের পেছন পেছন উড়ছে এবং শেষে তা কেড়ে নিচ্ছে - তা আমরা অনেক দেখেছি। ঠোঁটে খাবার রাখলে বোধ করি কাকেরা এরকম খাবার কেড়ে নিতে পারতো না।
চিলের ডাক তোমরা শুনেছি কি? এরা 'চি-ই-ল, হি-হি', এই রকম একটা মিহি সুর গলা থেকে বার করে চিত্কার করে। আবার ছানারা ডাকে অনেকটা বিড়ালের মত 'মিউ মিউ' শব্দে। চিলেরা গৃহস্থ বাড়িতে সাধারণত চরতে আসে না। বাড়িতে কোন ক্রিয়াকর্ম আছে জানলে কাকেদের মত দু চারটে চিলকেও ছাদের উপর বসে থাকতে দেখা যায়। তারপর সুবিধা পেলেই তারা ছোঁ মেরে কিছু খাবার জিনিস পায়ে নিয়ে দূরে পালিয়ে যায়। তবে মাছ ও মাংস ছাড়া এরা অন্য কিছু খেতে ভালবাসে না, অন্য জিনিস নিয়ে গেলে ফেলে দেয়।
চিলেরা গাছের উঁচু ডালে বর্ষার শেষে শুকনো ডালপালা দিয়ে বাসা তৈরি করে। এদের বছরে দুবার করে ডিম হয়। এই জন্য বর্ষার শেষ থেকে বৈশাখ মাস পর্যন্ত এরা বাসার তদ্বির করে। চিলের ডিম বড় সুন্দর। ডিমগুলো দেখতে সাদা, কিন্তু সেই সাদার উপরে যে খয়েরি ছোপ থাকে - সেটাই দেখতে সুন্দর।
(চিলের ইংরেজি নাম:Black Kite; বৈজ্ঞানিক নাম:Milvus migran; গড় দৈর্ঘ্য:৫৫-৬৮ সে.মি.। চিলের ছবিটি শ্রী সুমিত সেন-এর সৌজন্যে পাওয়া।)
ছাতারে পাখী বোধ করি তোমারা সবাই দেখেছো। এদের ডানা ছোট। তাই উঁচু গাছে উঠতে পারে না - উড়ে যে দশ হাত দূরে গিয়ে বসবে, তাও পারে না। পাখীদের মধ্যে যাদের ডানার জোর থাকে না, তাদের পায়ের জোর বেশি দেখা যায়। ছাতারে পাখীদের পায়ের জোর খুব বেশি। তাড়া করলে কতকটা উড়ে, কতকটা দৌড়ে তাদের পালাতে দেখা যায়। শালিক বা বকেরা যেমন আমাদের মত একে একে পা ফেলে চলে, ছাতারেরা সেরকম ভাবে চলতে পারে না। জোড়া পায়ে লাফিয়ে চলাই এদের স্বভাব।
কোন পাখীদের আমরা ছাতারে বলছি তোমরা বুঝতে পারছো কি? এদের কেউ কেউ 'সাত ভাই' পাখীও বলে। এরা পাঁচ সাতটা মিলে ভয়ানক কেঁচর কেঁচর শব্দ করতে করতে আতা, লেবু প্রভৃতি ছোট গাছের তলায় বেড়ায়। এই রকম একসঙ্গে অনেকগুলি চরে বেড়ায় বলেই বোধহয় ছতারেদের সাত ভাই নাম দেওয়া হয়েছে। যাই বল, এই পাখীদের দেখতে কিন্তু ভারি বিশ্রি। এদের গায়ের রঙ মাটির মত, চোখ, পা, ঠোঁট সবই সাদা। দেখলে মনে হয় সদ্য অসুখে ভুগে উঠেছে - তাই গায়ে রক্ত নেই। কিন্তু চোখ দেখলেই বোঝা যায়, পাখীগুলো ভয়ানক দুষ্টু।
ছাতারে পাখীদের বাসা বোধকরি তোমরা দেখো নি। গাছের খুব উপর ডালে এরা উঠতে পারে না। তাই ঝোপ-জঙ্গলের ছোট গাছের পাতার আড়ালে বাসা বেঁধে এরা ডিম পাড়ে। ঘাস ও খড় দিয়ে বাসাগুলো এরা পয়ালার আকার দিয়ে তৈরি করে। কোকিলরা যেমন কাকেদের বাসায় ডিম পেড়ে আসে, পাপিয়ারা তেমনি সুবিধা পেলেই ছাতারের বাসায় ডিম পারে। পাপিয়াদের ডিম ছাতারের ডিমের মতই উজ্জ্বল নীল রঙের, কিন্তু আকারে একটু বড়। ছাতারেরা সেগুলোকে নিজের ডিম মনে করে তা দিয়ে ডিম ফোটায়। ছাতারের বাচ্চা আর পাপিয়ার বাচ্চা দেখতে প্রায় একই রকমের। তাই ছাতারেরা বুঝতে পারে না কোনটে নিজের কোনটে পরের। পাপিয়ার ছানারা ভয়ানক রাক্ষুসে - দিবারাত্রি খাই খাই করে। তাই পরের ছানাদের পেট ভরাতে ছাতারেদের সর্বদাই ব্যস্ত থাকতে হয়।
ফটিক জল পাখী তোমরা কখনো দেখেছো কিনা জানি না। বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ মাসে এদের ডাক কিন্তু প্রায়ই শোনা যায়। এরাও ছাতারে জাতিরই পাখী - আকারে চড়ুইয়ের থেকেও ছোট। কিন্তু গায়ে সবুজ রঙের পালক থাকে। বটগাছের ঘন পাতার আড়ালে বসে এরা শিস দিয়ে ফ-টি-ই-ই-ই-ই-ক জল - এই রকম শব্দ করে। দুপুরবেলা ঝাঁ ঝাঁ রৌদ্রের মধ্যে যখন সব নিস্তব্ধ, তখন এই ডাক শুনতে বেশ মিষ্টি লাগে।
(ছাতারের ইংরেজি নাম: Jungle Babbler; বৈজ্ঞানিক নাম:Turdoides striatus; গড় দৈর্ঘ্য:২৫ সে.মি। ছাতারের ছবিটি টোনি কোটসওয়ার্থ-এর সৌজন্যে পাওয়া।ফটিক জলের ইংরেজি নাম: Common Iora; বৈজ্ঞানিক নাম: Aegithina tiphia; গড় দৈর্ঘ্য:১৪ সে.মি। ফটিক জলের ছবিটি শ্রী আর এস সুরেশ-এর সৌজন্যে পাওয়া।)
জলপিপি তোমরা হয়তো দেখেছো। গ্রামের ভেতরের পুকুরে সাধারণত এদের দেখা যায় না। গ্রামের বাইরে পানা ও শেওলায় ঢাকা নির্জন খালে ও বিলে এদের তোমরা চরতে দেখবে। বর্ষার শেষে আমাদের দেশের জলাশয়গুলো যখন পদ্ম, শালুক ও টোপা পানায় ঢেকে যায়, তখন জলপিপিরা পানা ও পদ্মপাতার উপর দিয়ে হেঁটে বেড়ায়। অন্য কোন পাখী সাধারণত জলের এই লতাপাতার উপর দিয়ে হেঁটে যেতে পারে না। জলপিপিদের ডাক বড় মজার। গলা থেকে এক "পি-পি-পি" শব্দ ছাড়া আর কোন আওয়াজই বার হয় না। সেইজন্যেই নিশ্চয় এদের নাম হয়েছে জলপিপি।
জলপিপির বুক, গলা ও মাথা চকচকে কালো পালকে ঢাকা থাকে, কিন্তু পেছনের ও লেজের পালকের রঙ খয়েরি। ডানার রঙ কালচে সবুজ। এদের লেজ লম্বা হয় না, কিন্তু পাগুলো হয় বেজায় লম্বা। পায়ের আঙুলগুলো আবার আরও লম্বা। এই লম্বা আঙুল আছে বলেই জলপিপিরা পদ্ম ও শালুকের পাতার উপর দিয়ে চলে বেড়াতে পারে। আমরা জলপিপিদের কখনো মাটির উপর দিয়ে হাঁটতে দেখি নি। যেসব পাখী জলের ধারে চরে বেড়ায়, তাদের অনেকেই গাছে বাসা বাঁধে এবং সেখানে ডিম পাড়ে। কিন্তু জলপিপিরা তা করে না। জলের উপর যে খড়কুটো বা শুকনো লতাপাতা একসঙ্গে হয়ে ভেলার মত ভেসে বেড়ায়, তারই উপরে এরা ডিম পাড়ে। তাই দূর থেকে দেখলেমনে হয়, ডিমগুলো যেন জলের উপর ভেসে বেড়াচ্ছে। জলপিপিদের ডিম দেখতে নাকি বড় অদ্ভুত। ডিমের খোলার খয়েরি রঙের উপর কতগুলো কালো আঁচড় কাটা থাকে। হঠাত্ দেখলে মনে হয় ডিমগুলোর উপরে কেউ পার্সী অক্ষর লিখে রেখেছে!
(জলপিপির ইংরেজি নাম: Bronze - Winged Jacana; বৈজ্ঞানিক নাম: Metopidius indicus; দৈর্ঘ্য: ২৮ - ৩১ সে.মি। জলপিপির ছবিটি পোরপোল নোণ্টাপা-র সৌজন্যে পাওয়া।)
টিয়া বড় সুন্দর পাখী। এদের ঠোঁট খুবই ধারাল - আবার উপরকার ঠোঁটটা সুন্দর বাঁকা। কিন্তু জিভ বড় ছোট। টিয়াদের ডানা ও লেজ দেখেছো কি? এদের ডানা ও লেজ দুই-ই খুব লম্বা। সাধারণ টিয়াদের ঠোঁট লাল, গায়ের পালক সবুজ। তাই টিয়ার দল যখন গাছে বসে থাকে, তখন সবুজ পাতার সঙ্গে তাদের গায়ের রং এমন মিলে যায় যে, তাদের চেনাই যায় না। সাধারণ টিয়াদের চোখ সাদা। আবার পুরুষ টিয়াদের গলায় কণ্ঠী (কাঁঠি) থাকে। এই কণ্ঠীর রঙ বড় সুন্দর। এর গলার উপরকার অংশের রঙ গোলাপী এবং নিচের রঙ কালো। দেখলে মনে হয় কেউ যেন তুলি দিয়ে গলার ওপরে এই কণ্ঠীটা এঁকে দিয়েছে। স্ত্রী-টিয়ার গলায় কিন্তু এই কণ্ঠী থাকে না।
টিয়া পাখী শালিকদের মত বাড়ির ফাটলে এবং কখনো বা গাছের কোটরে বাসা করে। বড় পাখীদের দেখতে সুন্দর হলেও, টিয়ার বাচ্চাদের দেখতে কিন্তু খুব বিশ্রী। তখন তাদের গায়ে সেরকম পালক থাকে না এবং যে পালক থাকে তাতে কোন রঙের বাহার দেখা যায় না। ছানা অবস্থায় পুরুষ-টিয়ার গলায় কণ্ঠী থাকে না। তাই ছানাদের মধ্যে কোনটা স্ত্রী কোনটা পুরুষ, তা প্রথমে বোঝা যায় না। টিয়াদের চোখের রংও বাচ্চা অবস্থায় কালো থাকে - পরে সাদা হয়।
চন্দনা টিয়া জাতিরই পাখী, কিন্তু টিয়ার চেয়ে আকারে বড়। এদের ডানার পালকের উপরে এক একটা লাল ছোপ থাকে। তাই এরা সাধারণ টিয়ার থেকে দেখতে অনেক সুন্দর। এগুলি ছাড়া মদনা, কাজলা, ইত্যাদি আরও কয়েক রকমের টিয়া আছে। মদনাদের বুক লাল। আবার পুরুষ মদনাদের মাথায় নীল রঙের পালক থাকে। কিন্তু ছোটবেলায় মদনাদের গায়ের পালকের রঙ সাধারণ টিয়াদের মতই সবুজ থাকে। কাজলাদের পালকের রঙ আবার অন্য রকম। এদের লেজের শেষের রঙ হলদে আবার মাথার রঙ কতকটা মেটে ধরণের।
লটাকানো পাখী তোমরা দেখেছো কি? এরাও টিয়া জাতীয়। কিন্তু ভারি মজার পাখী। খাঁচায় থাকলে এরা অনেক সময়ে খাঁচার দাঁড়ে পা লাগিয়ে বাদুরের মত ঝোলে। আবার দুষ্টিমিও এদের যথেষ্ঠ আছে। পরস্পর ঝগরাঝাটি করা এবং অন্য ছোট পাখীদের বাসায় গিয়ে ডিম চুরি করে খাওয়া এদের ভারি বদভ্যাস। টিয়া পাখী পোকা-মাকড় খায় না। গাছের ফল, কুঁড়ি এবং ফুলই এদের প্রধান খাদ্য। তাছাড়া ছোলা, মোটর, ধান, গম, যব, প্রভৃতি শস্যও এরা খায়। তাই যেখানে বেশি টিয়া পাখী থাকে, সেখানকার বাগানের গাছে ফল,বা ফুল ধরলে ঝাঁকে ঝাঁকে টিয়া এসে সেগুলিকে খায় বা নষ্ট করে। ভুট্টা ও জোয়ারের ক্ষেতে ফুল দেখা দিলেই, টিয়ারা সেখানে দলে দলে আনাগোনা শুরু করে এবং ফুলে ফলে ভরা বড় বড় শিষ কেটে মাটিতে ফেলে দেয়। তাই যেখানে টিয়ার উপদ্রব বেশি সেখানে সমস্ত দিনই ক্ষেতে পাহারা দিতে হয়।
(টিয়ার ইংরেজি নাম: Rose-Ringed Parakeet; বৈজ্ঞানিক নাম: Pisttacula krameri; গড় দৈর্ঘ্য:৪২ সে.মি। চন্দনার ইংরেজি নাম Alexadrina Parakeet; বৈজ্ঞানিক নাম: Pisttacula eupatria; গড় দৈর্ঘ্য:৫৩ সে.মি.। চন্দনার ছবিটি থাইল্যাণ্ডের একটি স্ট্যাম্প থেকে নেওয়া হয়েছে। টিয়া,চন্দনা ও মদনার ছবি 'বার্ডস অফ কলকাতা' নামে ইংরেজি ওয়েবসাইটে পাবে।)
ইংরেজিতে টুনটুনি পাখীদের দরজী পাখী বলা হয়। কেন, তা বোধকরি তোমরা জানো। এরা গাছের পাতা ঠোঙার মত মুড়ে তার পাশ সুতো বা গাছের অাঁশ দিয়ে সুন্দর করে সেলাই করে এবং সেই ঠোঙার মধ্যে পালক বা তুলো বিছিয়ে ডিম পাড়ে। দরজীর মত পাতা সেলাই করে বলে এদের দরজী পাখী বলা হয়। কাপড় সেলাই করতে হলে আমাদের ছুঁচ সুতো ইত্যাদির দরকার হয়, কিন্তু টুনটুনিদের সে সব কিছু জোগাড় করতে হয় না। ওদের ঠোঁট ছুঁচের কাজ করে এবং গাছের ছালের আঁশ জোগাড় করে ওরা সুতোর কাজ চালায়। এই পাখীরা কেমন করে সেলাই করার বিদ্যা শিখলো - তা ভাবতে অবাক হতে হয়।
টুনটুনি পাখীদের তোমরা নিশ্চয় দেখেছো। আকারে এরা চড়াই পাখীদের চেয়েও ছোট নয় কি? এদের পিঠের রঙ যেন কিছুটা খয়েরি, কিন্তু মাথা সাধারণত ধূসর। পেটের তলার পালক সাদাটে। লেজ সাধারণতঃ খুব লম্বা নয়, কিন্তু ডিম পাড়ার সময়ে পুরুষ পাখীদের লেজের মাঝের দুটি পালক হঠাত্ লম্বা হয়ে পড়ে। তাই সেই সময়ে পুরুষ পাখীদের লেজ লম্বা দেখা যায়। বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ থেকে শুরু করে শ্রাবণ ভাদ্র পর্যন্ত টুইজ টুইজ শব্দ করে এরা ঝোপ-জঙ্গলের উপরে ক্রমাগত লাফালাফি করে। পাখীগুলি ছোট, কিন্তু এদের গলার স্বর নিতান্ত ছোট নয়। যখন টুনটুনিরা গাছের ডালে লাফালাফি করে ডাকতে থাকে, তখন তা অনেক দূর থেকে শোনা যায়।
টুনটুনি পাখীদের তোমরা যদি কেউ আজও না দেখে থাকো, খোঁজ করে দেখে নিও। বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ মাসে তোমাদের বাগানে খোঁজ করলেই এদের দেখতে পাবে। এরা বড় চঞ্চল পাখী, একটু দূরে দাঁড়িয়ে দেখলে এদের চাল-চলন জানতে পারবে। টুনটুনিদের বাসার কথাতো আগেই বলেছি। সেই পাতার ঠোঙার মত বাসায় তুলো বিছিয়ে টুনটুনিরা তিন চারটে করে ডিম পাড়ে। ডিমগুলি দেখতে সাদা, কিন্তু ভালো করে দেখলে বোঝা যায়, সাদার ওপর লালের ছিটেফোঁটা আছে।
(টুনটুনির ইংরেজি নাম: Common Tailorbird; বৈজ্ঞানিক নাম: Orthotommus sutoriu; গড় দৈর্ঘ্য: ১৩ সে.মি। টুনটুনির ছবিটি শ্রী সুমিত সেন-এর সৌজন্যে পাওয়া)
ডাহুক তোমরা দেখেছো। এরা নিতান্ত ছোট নয়, আকারে একটা ছোট মুরগির মত। বকদের মত এরাও পুকুর, খাল বা বিলের ধার ছাড়া থাকে না। এদের বুক, গলা ও মাথা সাদা। কিন্তু ঠোঁট কতকটা সবুজ। তাছাড়া শরীরের আর সব অংশ ছেয়ে ও কালো রঙের পালকে ঢাকা থাকে। তাই দূর থেকে এদের কালো পাখী বলেই মনে হয়। জলের ধারে ঝোপ-জঙ্গলের কাছে চরতে চরতে ডাহুকরা 'কক কক কোওয়া কোওয়া' এবং 'কুক' বলে ভয়ানক চিত্কার করে। ডাহুকরা তাদের লেজ ঝুলিয়ে রাখে না, খঞ্জনদের মত খাড়া করে রাখে। লেজের নিচে পালকের রঙ লাল্চে। যখন লেজ উঁচু করে ডাহুকরা জলের ধারে চরতে চরতে পরস্পরকে ডাকাডাকি করে, তখন তাদের মন্দ লাগে না। কিন্তু গলার স্বর শুনতে একটুও ভালো লাগে না। সকাল ও সন্ধ্যায় যখন তারা সেই কর্কশ স্বরে চিত্কার জুড়ে দেয়, তখন বাস্তবিকই ভারি বিরক্ত লাগে।
অন্য কূলেচর পাখীরা চরবার সময় জলের ধারে আসে, তারপর সন্ধ্যায় আপন আপন গাছে ফিরে গিয়ে রাত্রি কাটায়। কিন্তু ডাহুকরা তা করে না। জলের ধারের ঝোপ-জঙ্গলেই তারা রাত্রি কাটায় এবং সেখানেই বাসা বাঁধে। এরা ভালো উড়তে পারে না। তাই বাসা বেঁধে বাস করার জন্য দূরে যেতে চায় না। ডাহুকরা বড় সতর্ক পাখী। তাড়া পাওয়ামাত্র ছুটে জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে পড়ে। কিন্তু তা বলে এদের ভিতু মনে কোর না। আমাদের পুষ্করিণীর ধারে কয়েকটা ডাহুক থাকত। আমরা যখন সাঁতার কাটতাম, তারা আপন মনে জলের ধারে কলমি লতার মধ্যে চরে বেড়াত, এবং কখনো কখনো পরস্পরকে ডাকা ডাকি করত, একটুও ভয় পেত না।
অন্য পাখীদের মত ডাহুকরাও বৈশাখ মাস থেকে বাসা বাঁধার আয়োজন করে। তারপর ডিম পেড়ে বাচ্চাদের পালন করতে করতে আষাঢ় মাস পর্যন্ত কেটে যায়। কিন্তু বাচ্চাদের পালন করতে হয় বলে এদের চিত্কার থামে না। বরং বর্ষাকালে এদের গলা বেশি করে শোনা যায়। ডাহুকদের ডিম বোধকরি তোমারা দেখো নি। ডিমের রং পাঁশুটে, কিন্তু তার উপরে খয়েরি রঙের ছিটেফোঁটা থাকে। ডিম থেকে বাচ্চারা যখন বার হয়, তখন তাদের দেখে কালো হাঁসের বাচ্চা বলে ভুল হয়। ডিম থেকে বার হয়েই তারা মুরগির বাচ্চাদের মত ছুটোছুটি শুরু করে দেয়। কেবল তাই নয়, এই বাচ্চা অবস্থাতেই তাদের ডুব দিতে ও সাঁতার দিতেও দেখা যায়। আষাঢ় মাসের শেষে খোঁজ করলে কোন গ্রামের পুষ্করিণীর ধারে তোমরাও হয়তো ডাহুকদের বাচ্ছাদের খেলা করতে দেখবে।
(ডাহুকের ইংরেজি নাম: White-Beasted Waterhen; বৈজ্ঞানিক নাম: Amaurornis phoenicurus; গড় দৈর্ঘ্য:৩২ সে.মি। ডাহুকের ছবিটি পোরপোল নোণ্টাপা-র সৌজন্যে পাওয়া।)
তালচোঁচেরা ঘরের কড়ি-বরগার ফাঁকে ও কার্নিসের গায়ে বাসা করে। তাই এদের দেখার জন্য কষ্ট পেতে হয় না। আকারে এরা চড়াইয়ের থেকে একটু বড়। কিন্তু রঙ কালচে। পিঠে ও গলায় সাদা পালক থাকে।
তালচোঁচের পায়ের আঙুলগুলি বড় মজার। সাধারণ পাখীদের পায়ের তিনটে আঙুল যেমন সামনে এবং একটা পেছনে থাকে, এদের পায়ের আঙুলগুলো সেরকম হয় না। আমাদের হাত পায়ের আঙুলের মত এদের চারটে আঙুলই সামনে ছড়ানো থাকে। তাই এরা কখনোই গাছের ডালে বসতে পারে না। আমরা তালচোঁচ পাখীদের মাটিতে ছেড়ে দিয়ে দেখেছি, এরা নানা ভঙ্গিতে ব্যাঙের মত থপ থপ করে লাফিয়ে পালাতে চায়। কিন্তু তাদের নখগুলো খুব ছুঁচলো। নখে একবার কাপড় আটকে গেলে, সেটা ছাড়ানো মুশকিল।
তালচোঁচরা একা থাকতে ভালো বাসে না। এক এক জায়গায় দল বেঁধে বাসা করে। যখন উড়ে বেড়ায় তখন ঝাঁক বেঁধে উড়ে। ঝাঁকে ঝাঁকে উড়তে উড়তেই পোকা-মাকড় সামনে যা পায় তাই খায়। তালচোঁচের ডাক তোমরা হয়তো শেনেছো - ঠিক যেন হুইসিল বাঁশির শব্দের মত। শুনতে কানে বেশ বাজে।
তালচোঁচের বাসা তোমরা দেখেছো কি? বাড়ির দালানে, গ্রামের শিবমন্দির বা মসজিদে খোঁজ করলে এদের বাসা দেখতে পাবে। তালচোঁচের মুখের লালা ঠিক জিউলির আঠার মত চটচটে। সেই লালা ও গায়ের খসা পালক দিয়ে এরা বাসা তৈরি করে। পালকগুলো লালায় জড়িয়ে শুকোলে খুব শক্ত হয়। তাই এদের বাসাগুলো বেশ জমাট হয়। তালচোঁচের বছরে দু'বার করে ডিম হয়। ডিমগুলি দেখতে সাদা ও লম্বাটে ধরণের। একবারে এরা দুটো বা তিনটের বেশি ডিম পাড়ে না।
(তালচোঁচের (এদের বাতাসী পাখীও বলা হয়) ইংরেজি নাম:House Swift; বৈজ্ঞানিক নাম:Apus nipalensis;গড় দৈর্ঘ্য:১৫ সে.মি.।)
তিতির পাখীদের তোমরা বাগানে বা মাঠে-ঘাটে দেখতে পাবে না। এরা জঙ্গলের পাখী, মানুষের কাছে আসতে চায় না - লোকের বাড়িতে চরতেও আসে না। আমাদের দেশে সাধারণত দুই ধরণের তিতির দেখা যায়। একটিকে বলা হয় 'গৌর তিতির'। এই তিতিরের পালকের রঙ কিছুটা ছেয়ে। তার উপর আবার সাদা ছিটেফোঁটা থাকে। আর এক জাতির তিতির হল 'কালো তিতির'। এদের পেট গলা বুক ও মাথার কতকটা রঙ কালো। কালো তিতির আমাদের দেশে বেশি দেখা যায় না। তিতিররা খুব স্ফূর্তিবাজ পাখী। গ্রামের কাছে জঙ্গলে কয়েকটা তিতির থাকলে, তাদের উঁচু গলার শব্দে বন পরিপূর্ণ হয়ে উঠে। কিন্তু মানুষের অত্যাচারে তাদের সব সময়ে ভয়ে ভয়ে থাকতে হয়। তিতিরের মাংস নাকি সুস্বাদু। সেই লোভে শিকারীর দল বন্দুক হাতে বনে যায় এবং তাদের মেরে ফেলে।
বটের পাখী তোমরা দেখেছো কিনা জানি না। এরা কিন্তু বারোমাস আমাদের দেশে থাকে না - শীতকালে চরতে আসে। ছোট জঙ্গলে ও ঘাসের মধ্যে কিংবা গম ও যবের ক্ষেতে এরা লুকিয়ে খাবারের খোঁজ করে। বটের পাখীরা আকারে শালিকের চেয়ে বড় হয় না। ঠোঁটগুলো ছোটো - বেশ সরু। গায়ের পালক কিছুটা খয়েরি রঙের, কিন্তু পিঠে সাদা ডোরা থাকে। খেয়াল করলে তোমরা শীতকালে মাঠে বেড়াবার সময়ে লম্বা ঘাসের ভিতর থেকে এই পাখীদের বাইরে আসতে দেখবে। কিন্তু মানুষে পায়ের শব্দ পেলেই এরা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় গিয়ে লুকোয়। এরা বড় ভীতু পাখী। কিন্তু এত লুকোচুরি করেও অনেক সময়েই মানুষের হাত থেকে এরা উদ্ধার পায় না। পায়রা জাতের অন্য পাখীদের মত বটেরের মাংসও নাকি খেতে ভালো। তাই শিকারীরা শীতকালে খুঁজে খুঁজে এদের বধ করে!
(তিতিরের ইংরেজি নাম:Partridges; বৈজ্ঞানিক নাম:Francolinus francolinus; দৈর্ঘ্য কমবেশি ৩৪ সে.মি সে.মি)
দাঁড়কাক পাতি কাকের চেয়ে আকারে বড় এবং গড়ন যেন কতকটা লম্বাটে ধরণের। এদের সমস্ত শরীরটা মিশমিশে কালো। দাঁড়কাক পাতিকাকের মত ছেলেমানুষি বা দুষ্টুমি করে না, এদের মেজাজ খুব গম্ভীর। তাছাড়া সাধারণ কাকেদের মত এরা একগাছে রাত্রি কাটায় না। খুব নিরিবিলি জায়গায় এরা থাকে। এদের স্বর বড় কর্কশ। দুপুর বেলায় নিমগাছের মাথায় চেপে যখন 'কোয়াও কোয়াও' শব্দে চিত্কার করে, তখন এদের মারতে ইচ্ছে হয়! এরাও পাতিকাকদেরই মত নোংরা জিনিস খেতে ভালোবাসে। নদীর শ্রোতে মরা গরু-বাছুর ভেসে যাচ্ছে, দু-তিনটে দাঁড়কাক তার ওপর চড়ে পচা মাংস ছিঁড়ে খাচ্ছে - এটা আমরা অনেকে দেখেছি।
সাধারণ কাকেরা খুব দুষ্টু ও সাহসী হয়। চিলের মত ভয়ানক পাখীকেও ভয় পায় না। বিনা কারণে কাকেরা চিলের পিছু গিয়ে তাদের লেজ ধরে টানাটানি করছে - তাও আমরা দেখেছি। কিন্তু দাঁড়কাকের কাছে তারা খুব জব্দ থাকে। দাঁড়কাকের গায়ে খোঁচা মারছে বা লেজ ধরে টানছে - এটা আমরা কখনো দেখি নি।
(দাঁড়কাকের ইংরেজি নাম: Large billed Crow; বৈজ্ঞানিক নাম: Corvus macrorhynchos (levaillantii); গড় দৈর্ঘ্য ৪৬-৫৯ সে.মি। দাঁড়কাকের ছবিটি জে.এম. গর্গের তোলা - উইকিপেডিয়া থেকে নেওয়া।
ছোট পাখীদের মধ্যে দোয়েল দেখতে যেমন সুন্দর বোধ করি কোন পাখী সেরকম নয়। গায়ে কতগুলি রঙিন পালক থাকলেই পাখীরা সুন্দর হয় না। চালচলন ওড়বার ভঙ্গি পাখীদের সুন্দর করে। দোয়েলের সবই সুন্দর। এদের গলার স্বর সুন্দর, গায়ের সাদা ও কালো পালকগুলো সুন্দর এবং চাল-চলনও সুন্দর।
পুরুষ দোয়েল ও স্ত্রী দোয়েলদের চেহারায় অনেক তফাত্ আছে। সেটা তোমরা লক্ষ্য করেছো কি? পুরুষ দোয়েলের গায়ের রং চকচকে কালো, কিন্তু তলপেটের পালকের রং সাদা। স্ত্রী দোয়েলের গায়ে ঠিক কালো পালক দেখা যায় না। কালোর বদলে খানিকটা ধূসর রঙের পালক থাকে। কিন্তু এরা খুব অকর্মা। পুরুষ দোয়েলের মত এদের গলার স্বর সেরকম মিষ্টি নয়, তাছাড়া সেরকম চটপটেও নয়।
দোয়েলের সঙ্গে খঞ্জনের মিল দেখে অনেকে খঞ্জনকে দোয়েল মনে করে। তোমরা লক্ষ্য করে দেখবে খঞ্জনেরা যেমন লেজ নাচিয়ে বেড়ায়, দোয়েলরা তা করে না। এদের লেজ সর্বদা খাড়া থাকে, তাছাড়া খঞ্জনদের মত এদের সাদা ভুরুও নেই।
দোয়েলরা এক মুহূর্তও স্থির থাকতে পারে না। কখনো গাছের ডালে, কখনো মাটিতে, কখনো বা ঝোপ-জঙ্গলের ওপরে অবিরাম লাফিয়ে চলে। পোকা-মাকড়ই এদের প্রধান খাদ্য।
বসন্তের হাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দোয়েলদের ডিম পাড়া আর বাসা বাঁধার তাগিদ আসে আর তাদের গলাও তখন খুলে যায়। তখন তাদের ওড়বার ভঙ্গি আর গানের তান শুনলে মনে হয়, যেন পাখীগুলি আনন্দে ভরপুর হয়ে আছে। আনন্দ হলে তোমরা যেমন অনাবশ্যক ঘুরপাক দাও, চিত্কার কর, এরাও যেন তাই করে। দোয়েলরা কাক-শলিকের মত গাছের ডালে বাসা বাঁধে না। এরা গাছের কোটরে , দেওয়ালের ফাটলে বা নালার মুখে খড়কুটো বিছিয়ে ডিম পারে। ডিমগুলির রঙ ফিকে সবুজ, তার ওপরে আবার খয়েরি রঙের পোঁচ থাকে। তোমরা শ্যামা পাখীর নাম বোধহয় শুনেছো। শ্যামাপাখী বাজারে বিক্রি হয়। লোকে এদের ধরে খাঁচায় রেখে পোষে। এদের গান বড় সুমিষ্ট। এরাও দোয়েল জাতিরই পাখী। বনে জঙ্গলে এরা আনন্দে বেড়ায় ও গান করে। আর লোকেরা সেই মুক্ত পাখীগুলোকে ধরে এনে খাঁচায় পোরে!
(দোয়েলের ইংরেজি নাম:Oriental Magpie Robin; বৈজ্ঞানিক নাম:Copsychus saularis; গড় দৈর্ঘ্য:২৩ সে.মি। দোয়েলের ছবিটি শ্রী এম ভেঙ্কটস্বমাপ্পা-র তোলা ও শ্রী আর এস সুরেশ-এর ) সৌজন্যে পাওয়া।)
জ্যান্ত ধনেশ পাখী পথে ঘাটে তোমরা বোধয় দেখো নি। পশ্চিম বঙ্গে এদের তোমরা দেখবে না, এরা থাকে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলার জঙ্গলে। এছাড়া ভারতবর্ষের অন্যান্য জায়গাতেও এদের দেখা যায়। তবে কলকাতার আলিপুরের চিড়িয়াখানায় গেলে, নিশ্চয় এদের দেখতে পাবে। ধনেশ পাখী নানান ধরণের হয়। সবগুলিরই ঠোঁট খুব লম্বা। বড় লম্বা ঠোঁট নিয়ে পাখীগুলো যেন সর্বদা শশব্যস্ত থাকে। এছাড়া ঠোঁটের ওপর আবার খাঁড়ার মত আরেকটা অংশ লাগানো থাকে।
যাই হোক ধনেশ পাখীদের বাসা তৈরি ও সন্তান পালন বড় মজার ব্যাপার। আমরা সেই কথাটাই এখানে তোমাদের বোলব। খড়কুটো দিয়ে এরা বাসা বানায় না। ডিম পাড়ার সময় হলে এরা গাছের পোকা ধরা পচা ডালে গর্ত করে কোটর তৈরি করে। তারপরে স্ত্রী পাখী সেই কোটরে বসে কোটরের মুখ নিজের বিষ্ঠা দিয়ে বন্ধ করে দেয়। তোমরা হয়তো ভাবছো সে কোটরে বন্দী হয়ে না খেয়ে দিন কাটায়। কিন্তু তা নয়, এরা পুরোটা বন্ধ না করে গর্তের মুখে খুব ছোট একটা ছিদ্র রাখে। পুরুষ পাখী বাইরে থেকে পোকা-মাকড় , ফল প্রভৃতি খাবার সেই ছিদ্র-পথের ভিতরে চালান করে। স্ত্রী পাখী তাই খেয়ে পেট ভরায়। এই রকম অন্ধকার কোটরে বদ্ধ থেকে স্ত্রী পাখী ডিম পাড়ে এবং ডিম থেকে বাচ্চা বের হলে সেগুলোকে পালন করে। বেচারা পুরুষ পাখী বাইরে থেকে এক মাস দেড় মাস শুধু খাবার জোগাতে থাকে, নিজের খাবারের দিকে তার নজর থাকে না। এই ভাবে পুরুষ পাখীরা মাঝে মাঝে না খেয়ে মারাও পড়ে। স্ত্রী পাখীরা ভালো-মন্দ খেয়ে মোটা হয়ে বাসা থেকে বার হয়।
বোর্ণিও দ্বীপে নাকি অনেক ধনেশ পাখী আছে। সেখানে বড় বড় পাখীদের ধরে তাদের পালক ছিঁড়ে মাথায় পরা এক সময়ে আদিবাসীদের মধ্যে রেওয়াজ ছিল। ধনেশের ডিম ও ছানারাও ছিল সেখানকার লোকেদের খাদ্য। এই সব উপদ্রবের ফলে ধনেশ পাখীর সংখ্যা সেদেশে এখন অনেক কমে গেছে। দেখ, মানুষরা কত নিষ্ঠুর। গ্রাম ও নগর ছেড়ে যারা গভীর জঙ্গলে বাস করে, তাদেরও মানুষ খুঁজে খুঁজে বার করে এবং তাদের পালক ছিঁড়ে ছানা কেড়ে নিয়ে কষ্ট দেয়।
(ছবিতে যে ধনেশ দেখানো হয়েছে, তার ইংরেজি নাম: Great Indian Hornbill; বৈজ্ঞানিক নাম:Buceros bicornis । এটি ভুটানের একটি স্ট্যাম্প থেকে নেওয়া।)
নীলকণ্ঠ পাখীরা বসন্ত বউরিদের জাতভাই। বর্ধমান, বাঁকুড়া, বীরভূম ইত্যাদি এই জেলায় এই পাখীদের খুব দেখা যায়। কলকাতা অঞ্চলে এবং উত্তর ও পূর্ববঙ্গে (এখনকার বাংলাদেশ) এদের কদাচিত্ দেখতে পাবে। নীলকণ্ঠ পাখী দেখতে খুব সুন্দর। এদের মাথা গলা ঘাড় যেন কতকটা খয়েরি রঙের। কিন্তু ডানা ও লেজের পালকে যে নীল রঙ থাকে তা দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। যখন এরা এক গাছ থেকে উড়ে উড়ে আরেক গাছে যায়, তখন মনে হয় যেন কেউ নানা রঙের কাগজের পাখী বানিয়ে ছেড়ে দিয়েছে।
নীলকণ্ঠ পাখী ভয়ানক ঝগড়াটে। কখনো কখনো নিজেদেরই মধ্যে মারামারি করে মরে এবং সঙ্গে সঙ্গে ভয়ানক চিত্কার করে। চেহারা ভালো হলেও এদের গলার স্বর খুব বিশ্রী।
নীলকণ্ঠরা বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ মাসে গাছের কোটরে বা লোকেদের বাড়ির নালার ফাঁকে বাসা তৈরি করে সেখানে ডিম পাড়ে। এই সময়ে এদের মেজাজ যেন আরও রুক্ষ হয় - তখন সর্বদা ক্যাঁ ক্যাঁ শব্দে চিত্কার করে। এমন কি কাক ও চিলদেরও কাছে পেলে তাদের তাড়া করে। কাকেদের সঙ্গে অবশ্য নীলকণ্ঠ পাখীদের বরবারের শত্রুতা। কাকেরাও সুবিধা পেলেই নীলকণ্ঠ পাখীদের ঠোকরায়।
ছোট পোকা-মাকড়ই নীলকণ্ঠ পাখীদের প্রধান আহার। তাই তোমরা অনেক সময় এদের মাটিতে ঘাসে ওপর চরতে দেখবে। কিন্তু সাধারণত এরা গাছের পোকা-মাকড়ই ধরে খায়।
(নীলকণ্ঠ পাখীর ইংরেজি নাম Indian Roller (Blue Jay); বৈজ্ঞানিক নাম:Coracias benghalensis; গড় দৈর্ঘ্য: ৩৩ সে.মি.। নীলকণ্ঠ পাখীর ছবিটি শ্রী আর এস সুরেশ-এর সৌজন্যে পাওয়া।)
"পানকৌড়ি পানকৌড়ি ডাঙায় ওঠ না,
তোমার শ্বাশুড়ি বলেছে বেগুন কোট না।"
ছেলেবালায় খালের ধারে দাঁড়িয়ে পানকৌড়িদের কত ডেকেছি, কিন্তু একটাও কাছে এসে দাঁড়ায় নি। জলে এলে তারা একেবারে ডাঙার কথা ভুলে যায়।
তোমাদের মধ্যে যারা গ্রামে থাকো, তাদের কাছে পানকৌড়ির বিশেষ পরিচয় দেবার দরকার নেই। যারা শহরে থাকে তারা বোধকরি এই পাখীদের কখনো দেখে নি। পানকৌড়িরা বড় মজার পাখী - রাত্রিটুকু ছাড়া সমস্ত দিনই তারা বিলের বা খালের ধারে কাটিয়ে দেয়। সাঁতার দিতে বা ডুব দিতে এদের একটুও কষ্ট হয় না। এমন রাক্ষুসে পাখীও বোধহয় দুনিয়ায় আর দেখা যায় না - খাই খাই করেই তাদের সারা জীবনটা কেটে যায়। উড়ে উড়ে শরীর ক্লান্ত হলে প্রায় সব পাখীই গাছের ডালে বা মাটিতে বসে বিশ্রাম করে। পানকৌড়িদের বিশ্রাম করা তোমরা দেখেছো কি? জলে ডুব দিতে দিতে হাঁফ লাগলে জলে পোঁতা খোঁটা বা বাঁশের উপরে বসে দুখানি ডানা খুলে দেয় এবং তাদের সেই লম্বা সরু গলাটা বাঁকিয়ে চারিদিকে তাকাতে থাকে। পানকৌড়ির এই চেহারা দেখলে হাসি পায়। এটাই পানকৌড়িদের বিশ্রাম করা।
যখন খাল বা বিলের জলে ডুব দিয়ে মাছ শিকার করে, তখন পানকৌড়িদের দাঁড়কাকের মত কালো বলে মনে হয়। কিন্তু সত্যি এরা সম্পূর্ণ কালো পাখী নয়। এদের পিঠ ও ডানা ধূসর এবং লেজ ময়লা রকমের সাদা। আবার পা দুখানি ধূসর। পানকৌড়িদের ঠোঁটগুলো বড় মজার। তার আগা বাঁকা, কিন্তু সমস্ত ঠোঁট সরু এবং চাপা রকমের।
পানকৌড়িদের উড়বার ভঙ্গি তোমরা দেখো নি? লম্বা গলাটা সামনে এগিয়ে এবং পাদুটি পিছনে ছড়িয়ে এরা উড়ে চলে। সন্ধ্যার আগে একটু নজর রাখলে তোমাদের গ্রামের বিল থেকে এদের ঝাঁক বেঁধে উড়ে যেতে দেখবে। চরবার সময় এরা একা একাই চরে, কিন্তু বাসায় ফেরার সময় এবং বাসা থেকে চরতে বার হবার সময়ে ঝাঁক বাঁধে।
কাক ও শালিকদের মত পানকৌড়িরা প্রায় বারো মাসই গাছের ডালে বসে রাত কাটায়। তারপর ডিম পাড়ার সময় এলে তাদের বাসা বাঁধার ধুম লেগে যায়। বকদের মত পানকৌড়িরা বর্ষাকালেই ডিম পাড়ে। তোমরা বোধহয় পানকৌড়িদের বাসা দেখো নি। কাক ও বকেদের বাসার মতই সেটা খড়কুটো শুকনো ডালপালার স্তুপ বলা চলে। বাসার শ্রীছাঁদ একটুও দেখা যায় না। যাইহোক, এরকম বাসায় তারা পাঁচ ছটা করে ডিম পাড়ে।
(ছবিতে যে পানকৌড়ি দেখানো হয়েছে, তার ইংরেজি নাম: Little Cormorant; বৈজ্ঞানিক নাম: Phalacrocorax niger; গড় দৈর্ঘ্য: ৫১ সে.মি। ছবিটি বাংলাদেশের একটি স্ট্যাম্প থেকে নেওয়া হয়েছে।)
তোমরা পাপিয়া পাখীদের বোধকরি দেখো নি। এরা কোকিলদেরই মত পাতার আড়ালে লুকিয়ে ডাকে - ফাঁকা ডালে প্রায় বসেই না। তাই এদের দেখা মুশকিল। পাপিয়াদের গায়ের পালকের রঙ খানিকটা ধূসর। তারই ওপর কালচে ডোরা থাকে। কিন্তু পেটের তলাটা সাদাটে। তাই হঠাত্ দেখলে এদের শিকরা পাখী বলে ভুল হয়।
পাপিয়া পাখীদের চেহারা না দেখলেও এদের ডাক তোমরা নিশ্চয় শুনেছো। কি সুন্দর ডাক! নিচু সুরে ডাকতে আরম্ভ করে তারা সুর চড়াতে চড়াতে সপ্তমে গিয়ে হাজির হয়। চৈত্র বৈশাখ মাসে যদি এক জোড়া পাপিয়া বাগানে থাকে, তবে সমস্ত বাগান তাদের সুরে ভরে উঠে। রাত্রিতেও তাদের ডাকের বিরাম থাকে না। জ্যোত্স্না রাত্রি থাকলে তারা আপন খেয়ালে গান করে সমস্ত রাত্রি জেগে কাটিয়ে দেয়। লোকে বলে পাপিয়ারা 'চোখ গেল, চোখ গেল' বলে ডাকে। তাই লোকে এদের 'চোখ গেল' পাখীও বলে। যাইহোক পাপিয়াদের গলার সুস্বর বারো মাস শোনা যায় না। ডিম পাড়ার ও বাসা বাঁধার সময় আসলে কোকিলদের মত পাপিয়াদেরও গলা খুলে যায়। তখন তারা চোখ গেল বলে দিবারাত্রি ডাকে। তারপর জ্যৈষ্ঠের শেষে কোকিলদের মত এদেরও গলা স্বর বন্ধ হয়ে যায়। তাই ডাক শুনতে না পেয়ে অনেকে মনে করে যে, বসন্ত ও গ্রীäমকাল বাংলায় কাটিয়ে পাপিয়ারা বর্ষাকালে অন্য দেশে চলে যায়। কিন্তু তা ঠিক নয়। কোকিলদের মত এরাও বারো মাস পাতার আড়ালে লুকিয়ে আমাদের দেশেই কাটায়।
ভালমানুষের মত পাতার আড়ালে লুকিয়ে কাটালেও পাপিয়াদের মধ্যে যথেষ্ঠ দুষ্টুমি আছে। কোকিলেরা যেরকম কাকের বাসায় ডিম পাড়ে, পাপিয়ারাও সেরকম ছাতারে পাখীদের বাসায় ডিম পেড় আসে। ছাতারেরা সেইসব ডিম নিজেদের বলে মনে করে এবং তা দিয়ে সেগুলো থেকে বাচ্চা বার করে। কাজেই পাপিয়াদের বাসাও বাঁধতে হয় না, ডিমেও তা দিতে হয় না।
(পাপিয়ার ইংরেজি নাম: Common Hawk Cuckoo; বৈজ্ঞানিক নাম: Hierococcyx variu ; গড় দৈর্ঘ্য:৩৪ সে.মি। পাপিয়ার ছবিটি শ্রী সুমিত সেন-এর সৌজন্যে পাওয়া)
তোমরা কত রকমের পেঁচা দেখেছো জানি না। আমরা কিন্তু লক্ষ্মীপেঁচা, কোটরে পেঁচা, কালপেঁচা প্রভৃতি অনেক পেঁচা দেখেছি। পেঁচারা শিকারী পাখী। রাত্রি বেলায় শিকারে বার হয়ে ইঁদুর, ব্যাঙ, পাখীদের ছানা ও ডিম চুরি করে খেয়ে পেট ভরায়। পোকা-মাকড়ও এরা পছন্দ করে।
দিনের বেলায় পেঁচাদের সাধারণত দেখা যায় না। কেউ গাছের কোটরে, কেউ পোড়ো ভাঙা বাড়ির ভিতরে, কেউ বারান্দার কার্নিসের ওপর লুকিয়ে দিন কাটায়। তারপর সন্ধ্যা হলে এই সব জায়গা থেকে বার হয়ে শিকারের সন্ধানে ঘুরতে আরম্ভ করে। পায়রারা যখন উড়ে তখন তাদের ডানায় কিরকম চটাপট শব্দ হয় তা তোমরা নিশ্চয় শুনেছো। তাছাড়া অন্য পাখীরাও উড়বার সময় শব্দ করে। কিন্তু পেঁচারা যখন উড়ে বেড়ায় তখন তাদের ডানায় একটুও শব্দ হয় না। তাই চোরের মত নিঃশব্দে গিয়ে এরা পাখীদের ডিম ও ছানাদের চুরি করে খেতে পারে।
লক্ষ্মীপেঁচা তোমরা দেখেছো কি? এরা নিতান্ত ছোট পাখী নয়। মুখগুলো যেন চাকার মত গোল, কিন্তু শরীরটা অন্য পেঁচাদের তুলনায় একটু লম্বা। রঙ লাল্চে, কিন্তু মুখগুলি সাদা। গায়ে আবার হলদে-সাদা ডোরা থাকে। গৃহস্থেরা বলে লক্ষীপেঁচা ঘরে থাকলে লক্ষ্মীশ্রী বাড়ে। তাই বাড়িতে আশ্রয় নিলে কেউ এই পাখীদের তাড়াতে চায় না। কিন্তু এরাই যখন রাত্রে চিত্কার করে, তখন সবারই ভারি রাগ হয়।
গভীর রাতে অনেক পেঁচা কিচ কিচ করে ডেকে উঠল, এটা প্রায়ই শোনা যায়। এই ডাকে অনেক সময়ে ঘুমও ভেঙে যায়। এগুলো কোটরে পেঁচার ডাক। ঠিক সন্ধ্যার সময় বাসা থেকে বার হয়ে এরা দুচারটে মিলে খুব একচোট ডেকে নেয়। তারপর শিয়ালরা যেমন রাতে মাঝে মাঝে একসঙ্গে চিত্কার করে, এরাও সমস্ত রাত্রি ধরে মাঝে মাঝে চেঁচামেচি করে। কেন যে করে, ওরাই জানে! কোটরে পেঁচারা আকারে লক্ষ্মীপেঁচাদের চেয়ে অনেক ছোট। এদের বুকের তলার অনেক পালক সাদা, কিন্তু শরীরে ওপরকার অংশ মেটে লাল - তার ওপর সাদা ফোঁটা বা ডোরাও থাকে।
কালপেঁচা বোধহয় তোমরা কেউ দেখ নি। এরা ভারি বিশ্রী পাখী। গভীর রাত্রে যখন চারিদিক নিস্তব্বì, তখন বাগানের গাছে বসে এক মিনিট বা আধ মিনিট অন্তর কুঃ কুঃ শব্দ করে। এই শব্দ ভয়ানক বিশ্রী শোনায়। শুনেছি কালপেঁচাদের দেখতে অনেকটা কোটরে পেঁচাদের মত। কেবল এদের দুই কানের কাছে দুই গোছা পালক উঁচু হয়ে থাকে। তা দেখে মনে হয় যে, কালপেঁচাদের মাথায় সিং আছে। তবে এরা একটু ভীরু পাখী। রাত্রেও খুব সাবধানে চরে বেড়ায়, তাই দেখতে পাওয়া কঠিন। হুতুম পেঁচাদেরও সচরাচর দেখা যায় না। এরা খুব বড় পাখী - আকারে প্রায় চিলের সমান। এরা হুম হুম শব্দ করে।
পেঁচারা আলাদা করে বাসা বাধে না। গাছের কোটরে বা দেয়ালের ফাটলেই ডিম পাড়ে। ডিমগুলি ফুট্ফুটে সাদা, সংখ্যায় কখনোই বেশি হয় না। অন্য পাখীরা ভয়ে পেঁচাদের ডিম নষ্ট করতে পারে না, তাই ওরা যে একটি দুটি ডিম পাড়ে - তা থেকেই ওদের বাচ্চা হয়।
(লক্ষ্মীপেঁচার ইংরেজি নাম: Barn owl; বৈজ্ঞানিক নাম: Tyto alba; গড় দৈর্ঘ্য: ৩৬ সে.মি.। কোটরে পেঁচার ইংরেজি নাম: Spotted owlet; বৈজ্ঞানিক নাম: Athene brama; গড় দৈর্ঘ্য: ৩৬ সে.মি.। লক্ষ্মীপেঁচার ছবিটি ডন ডেসজার্ডিন-এর সৌজন্যে পাওয়া।)
ফিঙে পাখীদের তোমরা সবাই দেখেছো। পূর্ববঙ্গে (এখনকার বাংলাদেশ) এই পাখীকে চলতি কথায় 'ফেচো' বলেও ডাকে। মিশমিশে কালো পালকে এর সর্বাঙ্গ ঢাকা থাকে। গাছের খুব উঁচু জায়গায় বসে থাকে। দেখলে মনে হয় ফিঙেরা বুঝি খুব অহঙ্কারী পাখী, মাটিতে পা দিতে চায় না। তা নয়, অতবড় লেজ নিয়ে ফিঙেরা মাটিতে চরে বেড়াবে কি করে!
পোকা-মাকড়ই ফিঙেদের প্রধান খাবার। মাটিতে চরে বেড়াবার সুবিধা নেই বলে তারা উড়ে উড়েই পোকা ধরে খায়। যখন ফিঙেরা টেলিফোনের তারের উপর বা বাঁশের উপর চুপ করে বসে থাকে, তখন হয়তো তোমরা মনে কর ফিঙেরা হাওয়া খাচ্ছে। কিন্তু তা নয়। কোথায় পোকা উড়ে বেড়াচ্ছে - সেই সময়ে কেবল তাই ওরা দেখে। পোকা নজরে পড়লেই ছোঁ মেরে ধরে তাকে খেয়ে ফেলে। আমাদের দেশে সন্ধ্যার সময়ে অনেক পোকা বের হয়। তাই সূর্য অস্ত গেলে অন্য পাখীরা যখন বাসায় ফেরে, তখন ফিঙেদের শিকার করার সময় হয়। তোমরা একটু খোঁজ করলেই দেখবে যে, সন্ধ্যার সময়ে যখন বেশ অন্ধকার হয়ে এসেছে, তখনো তোমাদের বাগানে ফিঙেরা উড়ে উড়ে পোকা ধরে খাচ্ছে।
ভয় পেলে বা কোন পাখীকে তাড়াতে গেলে ফিঙেরা যেসব শব্দ করে, তা শুনতে ভালো নয়। অন্য সময়ে যখন আপন মনে ডাকে, তখন তার স্বর বড় মিষ্টি বোধ হয়। বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষ রাত্রিতে ফিঙেরা বাসায় থেকে যে সব শব্দ করে, তা বড় সুন্দর। বোধ করি কালোয়াতদের মত সেই সময়ে ওরা গান অভ্যাস করে। রাত্রি দুটো নাগাদ ওদের ঘুম ভেঙে যায়। তারপর কাছাকাছি যত ফিঙে থাকে, তাদের মধ্যে গানের পালা লেগে যায়। একটা পাখী এক গাছ থেকে গান শুরু করে, অন্য গাছের আর একটা পাখী গান গেয়ে তার উত্তর দেয়। এই ভাবে পুরো বাগান যেন ফিঙেদের গানের আসর হয়ে দাঁড়ায়। বিছানায় শুয়ে এই গানের পালা শুনতে বেশ ভালোই লাগে।
ফিঙেদের বাসা বোধকরি তোমরা দেখো নি। শুকনো ঘাসের শিকড় - এই রকম নানা জিনিস দিয়ে এরা পেয়ালার আকারে ছোট বাসা বানায়। পাছে বাসার ঘাসগুলো এলোমেলো হয়ে যায়, এইজন্য এরা মাকড়সার জাল ঠোঁটে করে এনে বাসার খড়কুটোয় জড়িয়ে রাখে। ফিঙেদের লেজ কত লম্বা তোমরা তো তা দেখেছো। তাই লেজের জায়গা বাসায় হয় না। তাই যখন ওরা ডিমে তা দিতে বসে, তখন লেজ বাসার বাইরে বেরিয়ে থাকে।
ফিঙেরা যখন গাছের আগায় চুপ করে বসে থাকে তখন ওদের শান্তই লাগে। কিন্তু ওরা মোটেই শান্ত নয়। এমন দুষ্টু আর ঝগড়াটে পাখী খুব বেশি নেই। ফিঙেরা এমন ঝগড়াটে যে, কাক, কোকিল, চিল সবার সঙ্গে ঝগড়া বাধিয়ে দেয়। ডিম পাড়ার পর ফিঙেদের মেজাজটা আরও চড়ে থাকে। কোন পাখী এদের বাসার ধারে কাছে ঘেঁসতে পারে না। কোন পাখী যদি ভুল করে বাসার কাছে ডালে গিয়ে বসে, তাহলে ফিঙেরা তাকে ঠুকরে তাড়িয়ে দেয়। পাখী তো দূরের কথা, তখন কুকুর বেড়াল, এমন কি মানুষরাও ফিঙের বাসার নিচ দিয়ে হেঁটে গেলে ফিঙেরা ঠোকর দিতে আসে। ফিঙেরা বিশেষকরে কাকদের দুচোক্ষে দেখতে পারে না। যদি কোন কাক ফিঙের বাসায় গিয়ে উঁকি দেয়, তাহলে রক্ষা নেই। ফিঙেরা কাকের পেছনে ছুটে তাকে ঠুকরিয়ে গ্রাম ছাড়া করে।
যাইহোক, পাখীদের সবার সঙ্গে যে ফিঙেদের ঝগড়া একথা বলা ঠিক হবে না। ঘুঘু ও হলদে পাখেদের সঙ্গে ফিঙেদের যথেঠ ভাব। তাই যে গাছে ফিঙেরা বাসা বাঁধে, সেখানে খোঁজ করলে প্রায়ই ঘুঘু ও হলদে পাখীর বাসা দেখতে পাবে। ফিঙের মত জবরদস্ত পাখী কাছে থাকায় হলদে পাখী ও ঘুঘু নিশ্চিন্ত মনে থাকতে পারে, কারণ আর কোন পাখী এসে তাদের ডিম বা বাচ্চাদের অনিষ্ট করবে না। হিন্দুস্থানীতে ফিঙেকে বলা হয় কোতোয়াল বা দারোগা পাখী। দারোগার কাছে চোর ডাকাতরা যেমন জব্দ থাকে, অন্যান্য পাখীরাও ফিঙের কাছে তেমনি ঠাণ্ডা থাকে।
(ফিঙের ইংরেজি নাম: Black Drongo; বৈজ্ঞানিক নাম: Dicrurus adsimilis; গড় দৈর্ঘ্য:২৮ সে.মি.। ফিঙের ছবিটি শ্রী সুমিত সেন-এর সৌজন্যে পাওয়া।)
যে সব পাখী নদী, খাল বা পুষ্করিণীর ধারে চরে বেড়ায়, তাদের মধ্যে বোধ করি বকই প্রধান। তোমরা কত রকমের বক দেখেছো জানি না। বাংলাদেশের (পশ্চিমবঙ্গ ও বর্তমান বাংলাদেশ) নানা জায়গায় সাত আট রকমের বক দেখা যায়। সাদা কাঁক, লাল কাঁক, কোঁচ (কানি) বক, গাই বগলা, কানা বগলা, নীল বগলা, কাঠ বগলা - এই রকম নানা নামের বক আছে। আমরা এদের সবগুলির কথা বলতে পারব না। যে সব বক সর্বদা আমাদের চোখে পড়ে, কেবল তাদের কথা একটু একটু বলব। বক মাত্রেরই গলা এবং পা শরীরের তুলনায় বেজায় লম্বা। এই লম্বা গলা ঘাড়ের কাছে টেনে রেখে খুব ভালো মানুষের মত এরা জলের ধারে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর কাছে ছোট পোকা-মাকড় বা মাছ দেখতে পেলে আস্তে আস্তে পা ফেলে শিকারের কাছে যায় এবং লম্বা গলাটাকে বাড়িয়ে শিকার ধরে। বকেরা যখন গলা লম্বা করে শিকার ধরে, তখন তা দেখতে বড় মজা লাগে। সে সময়ে অন্য কোন দিকে তাদের নজর থাকে না। বকের দল যখন ঝাঁক বেঁধে মাথার ওপর দিয়ে উড়ে উড়ে যায়, তখন তাদের লক্ষ্য কোর। দেখবে, তাদের পা পিছনে ছড়িয়ে আছে এবং লম্বা গলা ঘাড়ে গুটনো আছে। গলা লম্বা রেখে এবং পা ঝুলিয়ে এরা কখনো উড়ে না। বুনো হাঁস, পানকৌড়ি, সারসেরা কিন্তু গলা লম্বা রেখে উড়ে বেড়ায়। তাই কোন পাখীর ঝাঁক মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেলে, তা বকের ঝাঁক কিনা দেখলেই বলা যায়।
আমরা প্রথমে কোঁচ বকের কথা বলব। তোমরা গ্রামের বিল বা খালের ধারে এদের দেখতে পাবে। এই বকদের গায়ের পালকের রঙ বাদামী হলেও তার ওপরে একটু সবুজের আভা থাকে। তাই যখন জলের ধারে লম্বা ঘাসের মধ্যে চুপ করে বসে থাকে, তখন এদের চেনাই যায় না। কিন্তু তাড়া পেয়ে যখন উড়তে আরম্ভ করে, তখন তাদের ডানার ভিতরকার ফুটফুটে সাদা পালকগুলি স্পষ্ট দেখা যায়। তাদের গায়ে যে বাদামী ও সবুজ পালক আছে, তখন তা বোঝাই যায় না। বৈশাখ মাসের বিকালে পশ্চিমে গাঢ় কালো মেঘ করেছে, বকেরা সারি বেঁধে বাসায় ফিরতে আরম্ভ করেছে। এই সময়ে কালো মেঘের গায়ে সাদা বকগুলিকে ভারি সুন্দর দেখায়।
বকেরা রাত্রে কোথায় থাকে, তা বোধ করি তোমরা সবাই জানো না। কাক ও শালিকরা যেমন গ্রামের বাইরে কোন একটা গাছে জমা হয়ে রাত কাটায়, এরাও তাই করে। আমাদের গ্রামে পুকুরের ধারে একটা অশথ গাছে বকদের এরকম একটা আ®া ছিল। সন্ধ্যা হলেই দলে দলে সেই গাছে এসে বসত, কিন্তু শালিকদের মত কখনো চিত্কার করে ঝগড়াঝাটি করত না। পরস্পর ঝগড়া করা বকদের স্বভাব নয়। ভোরের আলো পূব আকাশে দেখা দেওয়া মাত্র - কাক, কোকিল ও শালিকরা বাসায় বসেই ডাকতে শুরু করে এবং অন্ধকার থাকতে থাকতেই চরতে বার হয়। বকেরা কিন্তু কখনোই তা করে না। ভোরবেলা যখন চারিদিক রোদে ছেয়ে যায়, তখন ওরা জোড়ায় জোড়ায় বা একে একে গাছ ছেড়ে চরতে বার হয়।
কাক, চিল, শালিকরা বাসা বাঁধবার জন্য মাটি থেকে শুকনো ডালপাতা ও খড় নিয়ে গাছে জমা করে। বকেরা কিন্তু তা করে না। কাছের কোন গাছ থেকে শুকনো ডাল ঠোঁট দিয়ে ভেঙ্গে সেগুলি বাসায় নিয়ে যায়। বর্ষার প্রথমে এক একটা গাছে বকেরা এই রকম অনেক বাসা বাঁধে। এক গাছে কেবল একজোড়া বকে বাসা বেঁধেছে - এমন প্রায় দেখাই যায় না। আমরা একবার একটা আম গাছের নিচে পনেরোটা বকের বাসা দেখেছিলাম। গাছের তলা তাদের বিষ্ঠা এবং শামুক গুগলির খোলে ছেয়ে থাকতো - দুর্গন্ধে সেখানে দাঁড়ানো যেত না। বোধ করি, শামুক গুগলি ঠোঁটে করে এনে বকেরা ছানাদের খাওয়াত। মাছের কাঁটাও সেই গাছের তলায় অনেক ছড়ানো দেখেছি।
গাই বগলা বোধ করি তোমরা অনেকে দেখেছো। কোঁচ বকদের মত এরা জলের ধারে একা একা থাকে না। গরুর পালের পেছনে এরা দল বেঁধে চরে বেড়ায়। আমরা গ্রামের বাইরে একটা মাঠে এই রকম বকদের পঞ্চাশ ষাটটাকে একসঙ্গে থাকতে দেখেছি। দূর থেকে মনে হয় যেন কতগুলো সাদা জিনিস মাঠে পড়ে আছে। কাছে গেলে বক বলে চিনতে পারা যায়। গরুর পিছনে চরে বলে এদের গাই বগলা বলা হয়। গরুর সঙ্গে এরা চরে কেন, তা বোধ করি তোমরা জানো না। কোকিলদের বা শালিকদের মত গাই বগলারা ফলমূল খায় না, ছোট পোকা-মাকড়ই এদের প্রধান খাদ্য। কিন্তু গাই বগলারা পুকুরের ধারে গিয়ে খাবার সন্ধান করে না। মাঠে ঘাসের মধ্যে যে সব ফড়িং ও অন্য পোকা লুকিয়ে থাকে, তাই ধরে খাবার জন্য তারা মাঠে যায়। তারপর গরুর পাল মাঠে চলে ফিরে বেড়ালে ঘাসের মধ্যেকার ফড়িং ও অন্য পোকা-মাকড় যখন ভয়ে লাফিয়ে পালাতে চায়, তখন বকেরা সেগুলোকে ধরে খায়। এইজন্যই এদের প্রায়ই গরুর পালের পিছনে থাকতে দেখা যায়।
গাই বগলাদের চেহারা কি রকম, তোমরা লক্ষ্য করেছো কি? কোঁচ বকদের গায়ে যেমন সবুজ ও খয়েরি রঙ থাকে, এদের পালকে তার নামগন্ধ দেখা যায় না। এদের গায়ের প্রায় সব পালকই সাদা। এমন ফুটফুটে সাদা পাখী বোধ করি আর নাই। সর্বাঙ্গের পালক সাদা হলেও এদের ঠোঁটগুলি কিন্তু লাল এবং পায়ের রঙ কালো। কেবল ডিম পাড়ার সময় এলে এদের মাথার পেছন থেকে এক রকম হলদেটে রঙের পালক বার হয়।
সন্ধ্যার সময় যখন মাঠে বেড়ানোর সময়ে মাথার উপর দিয়ে এক দল বক হঠাত্ ওয়াক ওয়াক শব্দ করতে করতে উড়ে গেল - এটা আমরা অনেকে দেখেছি। তোমরাও হয়তো দেখেছো। দেখলে মনে হয় বোধহয় সন্ধ্যা হয়ে আসছে বলে বকের দল সমস্ত দিন চরে ঘুমোবার জন্য বাসায় ফিরছে। কিন্তু তা নয়। এই বকদের নাম নীল বগলা। এরা পেঁচাদের মত গাছের আড়ালে থেকে সমস্ত দিন কাটায়। তারপর সন্ধ্যার সময়ে চরতে বার হয়। এরাও পেঁচাদের মত রাত্রিচর পাখী, কিন্তু পেঁচাদের মত একা আলাদা থাকতে চায় না, এক এক জায়গায় এদের ঝাঁকে ঝাঁকে থাকতে দেখা যায়।
নীল বগলার গায়ের রঙ ও চেহারা বোধ করি তোমরা ভালো করে দেখো নি। এদের মাথা, ঘাড়, পিঠ ও গলার ওপরটা কালো। কিন্তু কপাল, গাল এবং বুক সাদা। তাছাড়া শরীরের বাকি সকল অংশই ধোঁয়াটে রঙের পালকে ঢাকা থাকে। নীল বগলার চোখদুটি টকটকে লাল - দেখতে অতি সুন্দর।
কানা বগলা ও কাঠ বগলাদের তোমরা দেখেছো কিনা জানি না। কানা বগলারা বেশ বড় পাখী। এদের লম্বায় এক পর্যন্ত হতে দেখা যায়। কিন্তু পা খুব লম্বা হয় না। মাথার পালকের রঙ ছেয়েটে। মাথায় ঝুঁটির মত পালক আছে, তার রং কিন্তু কিছুটা সবুজ। এরাও প্রায়ই রাত্রে জলের ধারে ও মাঠে চরে বেড়ায়। গ্রামের কাছে এদের প্রায়
দেখাই যায় না। কাঠ বগলাদের গায়ের পালকের রঙ কিছুটা যেন লাল। কখনো কখনো তোমরা এদের গ্রামের পুকুরের ধারে দেখতে পাবে। বকেরা জলের ধারে চরতে বের হয়ে সাধারণত চিত্কার করে না। কিন্তু দুটো কাঠ বগলা এসে জুটলেই, তারা জোর গলায় পরস্পরকে ডাকাডাকি শুরু করে দেয়।
বকেদের যে উপজাতি সবচেয়ে বড়, তাদের নাম সাদা কাঁক। এরা কখনো কখনো লম্বায় দুই হাত পর্যন্ত হয়। রঙ সাদাটে, ফুটফুটে সাদা নয়। ঠোঁটের রং হলদে, পা কতকটা যেন সবুজ, মাথার ওপর আবার কালো রঙের চূড়ো আছে। কাঁক কাঁক শব্দ করে উড়ে বেড়ায় বলে বোধ করি এদের কাঁক নাম দেওয়া হয়েছে। সাধারণ বকদের মত এদের কখনোই দলে দলে চরতে দেখা যায় না। নজর রাখলে তোমরা হয়তো গ্রামের পুকুরেই এদের দু-একটাকে দেখতে পাবে।
(ছবিতে প্রথম যে বকের ছবি দেখানো হয়েছে সেটি কোঁচ (কানি) বক, তার ইংরেজি নাম: Indian Pond Heron; বৈজ্ঞানিক নাম: Andeola Grayii; গড় দৈর্ঘ্য:৪৩ সে.মি। ছবিটি বাংলাদেশের একটি স্ট্যাম্প থেকে নেওয়া হয়েছে।
গাই বগলার (অনেক সময়ে গো বকও বলা হয়) ইংরেজি নাম: Cattle Egret; বৈজ্ঞানিক নাম: Bubulcus ibis । ছবিটি শ্রী বিবেক আর সিনহা-র সৌজন্যে পাওয়া।
নীল বগলার (অনেক সময়ে ওয়াক বক বা বচকা বলা হয়) ইংরেজি নাম Black-Crowned Night Heron; বৈজ্ঞানিক নাম: Nycticorax nycticorax । নীল বগলা ছবিটি মালদ্বীপের একটি স্ট্যাম্প থেকে নেওয়া হয়েছে।
সাদা কাঁকের ইংরেজি নাম Grey Heron; বৈজ্ঞানিক নাম: Ardea cinerea। এদের দৈর্ঘ্য ৯০ থেকে ৯৮ সে.মি.পর্যন্ত হয়। কাঁক বকের ছবিটি শ্রী আর এস সুরেশের সৌজন্যে পাওয়া।)
বসন্ত বউরি পাখীর আরেকটা নাম গয়লা বুড়ী। কেন এই নাম হল জানি না। এদের চেহারা কিন্তু একেবারেই গয়লা বুড়িদের মত নয়। বসন্ত বউরিদের ডাক তোমরা অবশ্যই শুনেছো। মাঘ মাস থেকে আরম্ভ করে আষাঢ় মাস পর্যন্ত বাগানের গাছে বসে এরা টঙ টঙ শব্দ করে ডাকে। মনে হয় কামারের দোকানে হাতুড়ি পেটার শব্দ হচ্ছে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এদের ডাকের বিরাম থাকে না। বৈশাখ মাসের দুপুরে যখন চারিদিকে রোদে ঝাঁঝাঁ করে, তৃষ্ণায় কাকেদেরও গলা শুকিয়ে আসে, তখনও গয়লা বুড়ীর টক টক টঙ টঙ ডাকের শব্দ শোনা যায়।
বসন্ত বউরির ডাক শোনা সহজ, কিন্তু পাখীদের খুঁজে বার করা কঠিন। এরা ডাকার সময়ে একবার ডাইনে, একবার বাঁয়ে ঘাড় বেঁকায়। তাই কোন দিক থেকে শব্দ হচ্ছে তা সহজে বোঝা যায় না। যাইহোক তোমরা একটু খোঁজ করে বসন্ত বউরি পাখী দেখো। এরা আকারে চড়াইয়ের থেকেও ছোট, কিন্তু ডাক শুনলে মনে হবে কত বড় পাখী ডাকছে! বসন্ত বাউরিদের গায়ের পালকের রঙ সবুজ। কপালে সিঁদুরের ফোঁটার মত লাল ফোঁটা আছে। তারপরে আবার দুই গালের রঙ যেন হলদে এবং পা দুখানি লাল টুকটুকে। গায়ে হলদে, সবুজ, ও লালের এত বাহার থাকলেও পাখীগুলি কিন্তু দেখতে তত ভালো নয়। ঠোঁট মোটা ও সাধারণত কালো। আবার তার গোড়ায় বিড়ালের মত চুল লাগানো আছে। কাঠঠোকরা ও টিয়া পাখীর মত বসন্ত বউরিদের পায়ের দুটো আঙুল সন্মুখে এবং দুটো পিছনে থাকে। এই আঙুলের নখ দিয়ে এদের গাছের গুঁড়ি আঁকড়ে থাকতে দেখা যায়। ফুল-ফল, পোকা-মাকড়ই এদের প্রধান আহার। তাই মনে হয় গুঁড়ি আঁকড়ে এরা গাছের ছাল থেকে পোকা ধরে খায়।
আমরা বসন্ত বউরির বাসা দেখেছি। কাঠঠোকরাদের মত এরা গাছের পচা ও শুকনো ডালে গর্ত করে ভিতরে বাসা বানায়। বর্ষার প্রথমে এদের ডিম হয়। তাই ডিমে তা দেওয়া ও ছানাদের পালন করার কাজে ব্যস্ত থাকে বলে বর্ষাকালে বসন্ত বউরিদের ডাক বেশি শোনা যায় না।
(বসন্ত বউরির ইংরেজি নাম Coppersmith Barbet (Crimsonbreasted); বৈজ্ঞানিক নাম: Megalaima haemacephala; গড় দৈর্ঘ্য:১৭ সে.মি.। বসন্ত বউরির ছবিটি শ্রী আর এস সুরেশ-এর সৌজন্যে পাওয়া।)
বাবুই পাখী কেউ কেউ বায়া পাখীও বলে। গাছের ডালে বোতলের মত বাসা বাঁধে বলে এদের 'বোতল পাখী' বলতেও শুনেছি। বাবুই পাখী আকারে খুব একটা বড় নয়। দেখতে স্ত্রী চড়াইয়ের মত। গায়ের পালকের রং খয়েরি। কিন্তু ডিম পাড়ার সময় আসলে পুরুষ পাখীদের গায়ের রং সুন্দর হলদে রকমের হয়ে দাঁড়ায় এবং গলার রং কালো হয়। স্ত্রী বাবুইদের রং কিন্তু কোন সময়েই বদলায় না।
চড়াই পাখীদের মত বাবুইরাও বীজ ও শস্য খেয়ে পেট ভরায়। তবে ঠোঁটের গোড়ায় পোকা-মাকড় পেলে বোধ করি সেটা ছাড়ে না। বাসায় ছানা হলেই বাবুই পাখীরা কেবল পোকার সন্ধানেই ঘুরে বেড়ায়। ছানারা পোকা খেয়েই বড় হয়।
বাবুইদের বাসা বড় মজার জিনিস। প্রায়ই তাল ও খেঁজুরের গাছের ডালে এরা বাসা বাঁধে। তোমরা গ্রামের বাইরে এক একটা গাছে হয় তো আটটা দশটা করে বাসা ঝুলতে দেখবে। একা থাকা বা একা একা বাসা বাঁধা এদের স্বভাব নয়। তাই এরা অনেকে মিলে একই গাছে অনেকে বাসা তৈরি করে। কাক বা শালিক প্রভৃতি বাসার সঙ্গে বাবুইয়ের বাসার কোন মিল দেখতে পাওয়া যায় না। এই বাসার চেহারা যেন জল রাখার ছোট কুঁজোর মত। কুঁজোর গলা নিচে রেখে ঝুলোলে যে রকম দেখায়, বাবুইয়ের বাসা যেন সেরকম। তাল নারকেল ও খেজুর গাছের আঁশ বা লম্বা খড়ের ছিলা দিয়ে বাবুইরা বাসাগুলি এত সুন্দরভাবে তৈরি করে যে, তা দেখলে অবাক হতে হয়। বাবুই পাখীরা শুধু ঠোঁট দিয়ে যে সুন্দর বাসা তৈরি করে, খুব ভালো কারিগর নানা যন্ত্রপাতি দিয়েও বোধকরি সে রকম বাসা তৈরি করতে পারে না। ঠোঁট দিয়ে খড় ও গাছের ছালের আঁশগুলিকে এমন সরু করে ছেঁড়ে যে, তা দেখলে আশ্চর্য হতে হয়। বাবুইয়ের বাসা গাছ থেকে পড়ে গেলে, তার সরু খড়কুটো দিয়ে অনেকে বালিশ তৈরি করে। এই বালিশ তুলো-ভরা বালিশের মতই নরম হয়।
বাসা বাঁধার সময় হলে মাঠে ও জঙ্গলে গিয়ে ঠোঁট দিয়ে ঘাসের ফালি এবং তাল ও খেজুর গাছের ছালের আঁশ জোগাড় করে আনে। তাল গাছের ডালে আটকে এগুলি দিয়ে বাসা ঝোলাবার দড়ির কাজ করা হয়। দড়ি ঝোলানো হলে বাবুইরা আসল বাসা বাঁধতে শুরু করে।প্রথমে বাসার চেহারা হয় দড়িতে ঝোলানো একটা ঘণ্টা বা ছাতার মত। এই ঘণ্টার নিচে প্রায়েই এক গাছি শক্ত খড়ের দড়ি দাঁড়ের মত লাগানো দেখা যায়। বাবুইরা কাজ করতে করতে সেই ছাতার তলার দড়ির ওপর বসে বিশ্রাম করে। লোকে বলে এটা নাকি বাবুইদের বৈঠকখানা। স্ত্রী বাবুইরা যখন খুব মন দিয়ে বাসা বোনে, তখন পুরুষ পাখী ছাতার তলার দড়ির ওপর বসে তাকে গান শুনিয়ে খুশি রাখে।
অন্য পাখীরা যেমন বাসায় যাবার সময়ে প্রথমে উড়ে গাছের ডালে বসে এবং তারপর ধীরে ধীরে বাসার ভেতর যায় - বাবুইরা তা করে না। এরা উড়তে উড়তে বাসারতলাকার শুঁড়ের মত পথ দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে। অন্য কোন পাখী এভাবে ভেতরে যেতে পারে না। তাই বাবুইদের ডিম সাধারণত নষ্ট হয় না। বাবুইদের বাসায় কখনোই দুই বা তিনটির বেশি ডিম দেখতে পাওয়া যায় না। বর্ষা কালেই এদের ডিম পাড়ার সময়। এদের ডিমের রং সাদা।
(বাবুইয়ের ইংরেজি নাম Baya Weaver; বৈজ্ঞানিক নাম: Ploceus philippinus; গড় দৈর্ঘ্য:১৫ সে.মি.। বাসার ওপরে পুরুষ বাবুইয়ের ছবিটি শ্রী আর এস সুরেশ-এর সৌজন্যে পাওয়া।)
মাছরাঙাদের এক জাতভাইয়ের কথা এখানে তোমাদের বলব। এদের বাঁশপাতি পাখী বলে। কেউ কেউ এদের পত্রিঙ্গা বলেও ডাকে। আকারে এরা চড়াইয়ের থেকে বড় হয় না। কিন্তু লেজগুলি খুব লম্বা। দূর থেকে দেখলে এদের সবুজ পাখী বলে মনে হয়। গায়ের পালকের রং বাঁশের পাতার মত সবুজ বলেই বোধয় এদের নাম দেওয়া হয়েছে বাঁশপাতি। কিন্তু ভালো করে লক্ষ্য করলে এদের গায়ে নানা রঙের পালক দেখা যায়। লেজের লম্বা পালকগুলির কয়েকটা নীল। আবার এই পালকগুলির মধ্যে মাঝের দু'টি পালক বেশি লম্বা। গলার রঙ পেয়ালা, কিন্তু দুই গালের কতগুলো পালকের রঙ সাদা এবং চোখদুটি লাল।
বাঁশপাতিরা ছোট পোকা-মাকড় খেয়েই পেট ভারায়। কখনো কখনো সুবিধা পেলে এরা মৌমাছি ও বোলতা ধরেও খায় শুনেছি। লেজ বড় বলে এরা মাটির উপর চরে বেড়াতে পারে না। ফিঙের মত উঁচু জায়গায় বসে কোথায় কোন পোকা-মাকড় উড়ছে দেখে নেয়, তারপর ছোঁ মেরে ধরে সেগুলোকে খায়।
শীতকালেই আমাদের দেশে বাঁশপাতি পাখী দেখা যায়। তোমরা লক্ষ্য করলে দেখবে সবুজ রঙের এই ছোট পাখীগুলো টেলিফোনের তার বা গাছের শুকনো ডালের আগায় বসে পোকা-মাকড়ের সন্ধানে তাকাচ্ছে এবং মাঝে মাঝে ছোঁ মেরে পোকা ধরছে। বাঁশপাতিদের বাসা অনেক খোঁজ করেও দেখতে পাই নি। যাঁরা দেখেছেন তাঁরা বলেন এরা নখ ও ঠোঁট দিয়ে বাগানের নিরিবিলি জায়গায় বা নদীর ভাঙনে সুরঙ্গ করে। এই সুরঙ্গই এদের বাসা হয়।
(বাঁশপাতির ইংরেজি নাম: Green Bee-Eater; বৈজ্ঞানিক নাম: Merops orientalis; দৈর্ঘ্য: ১৬ - ১৮ সে.মি.। বাঁশপাতির ছবিটি ডন ডেসজার্ডিন-এর সৌজন্যে পাওয়া।)
তোমরা কত রকমের বুলবুল পাখী দেখেছো জানি না, আমরা কিন্তু আমাদের বাগানে কালো বুলবুল এবং সিপাহী বুলবুল - এই দুরকম দেখেছি। কালো বুলবুলদের ঝুঁটি ও ডানা কালো। কেবল তার শেষের কয়েকটা পালকের আগা সাদা। লেজের তলাটা আবার সুন্দর লাল। কিন্তু ঝুঁটি ও মাথা যত কালো, শরীরটা তত কালো নয়। সিপাহী বুলবুলদের চেহারা বড় সুন্দর (ছবি দেখো)। এদের পেটের তলার রং সাদা। মাথার ঝুঁটি মিশমিশে কালো। ডানার পালকের রং খয়েরি। তারপর আবার মাথার দুই পাশের পালকের রং সুন্দর লাল। সিপাহীদের মাথায় যেমন লাল-পাগড়ি থাকে, এদের মাথায় সেরকম লাল পালক থাকে বলেই এই পাখীদের সিপাহী বুলবুল নাম দেওয়া হয়েছে। সাধারণ কালো বুলবুলদের মত সিপাহী বুলবুল সদা-সর্বদা দেখা যায় না। একটু নজর রাখলে কোন সময় এদের দেখতে পাবে। বাগানে গেলে তোমরা বুলবুলদের জোড়ায় জোড়ায় বেড়াতে দেখবে। বুলবুলদের গলার স্বর বড় মিষ্টি। পাকা ফল এবং ফুলের কুঁড়ি এদের প্রিয় খাদ্য। পাকা তেলকুচা এরা বড় ভালোবাসে।
বুলবুলদের বাসা বোধকরি তোমরা দেখো নি। এদের বাসার সন্ধান করার জন্য তোমাদের বেশি কষ্ট স্বীকার করতে হবে না। হয়তো তোমাদের বাগানের বেড়ার ওপরেই দুয়েকটি বুলবুলের বাসা দেখতে পাবে। উঁচু গাছের ওপরে এরা কখনোই বাসা বাঁধে না। বাসাগুলি দেখতে ছোট ছোট পেয়ালার মত। বুলবুলরা খড়কুটো দিয়ে বাসাগুলি তৈরি করে। এই বাসার ওপরেই ওরা গোলাপীর ওপরে লালের দাগ দেওয়া কয়েকটি ডিম পাড়ে। অত বড় লেজ নিয়ে বাসায় বসার জায়গা হয় না। তাই ডিমে তা দেওয়ার সময় বুলবুলরা লেজ উঁচু করে বাসায় বসে, তখন তাদের মুখগুলো থাকে বাসার বাইরে। ডিম থেকে অতি অল্পই বাচ্চা হয়। নিচু ঝোপে বাসা থাকে বলে বেজি, সাপ, গিরিগিটিরা প্রায়ই ডিমগুলিকে নষ্ট করে ফেলে। এরকম বারবার ডিম নষ্ট হলেও বুলবুলরা হতাশ হয় না - আবার নতুন করে ডিম পাড়ে। প্রতি বছর একই বুলবুল তিন-চারবার ডিম পাড়ছে - প্রায়ই দেখা যায়। বোধহয় ডিম বেশি নষ্ট হয় বলেই এরা ডিম পাড়ে বেশি।
(ছবিতে যে বুলবুল দেখানো হয়েছে সেটি সিপাহী বুলবুল, ইংরেজি নাম Red - Whiskered Bulbul; বৈজ্ঞানিক নাম: Pycnonotus jocosus; গড় দৈর্ঘ্য: ২০ সে.মি.। সিপাহী বুলবুলের ছবিটি শ্রী আর এস সুরেশ-এর সৌজন্যে পাওয়া।)
তোমরা এই সরু ঠোঁট পাখীদের দেখেছো কিনা জানি না। এরা দল বেঁধে প্রায়ই জলের ধারে চরতে যায়। খঞ্জন পাখীদের আকৃতির সঙ্গে এদের অনেক মিল আছে। কিন্তু রঙ খঞ্জনের মত নয়, লেজও সেরকম লম্বা নয়। ভরত পাখীদের মাথায় ছোট ঝুঁটি থাকে - ডানার রঙ যেন কতকটা খয়েরি।
ভরত পাখীর ডাক বড় মিষ্টি - ঠিক শিস দেওয়ার মত শোনায়। অন্য পাখীদের মত এরা গাছের ডালে বসে ডাকে না। উড়তে উড়তে যখন আকাশের উপরের দিকে উঠে, তখন শিস দেয়। ভরত পাখীদের বাসা আমরা দেখি নি। কিন্তু শুনেছি, এরা মাটিতে গর্ত করে ও সেখানে ডিম পাড়ে।
ধূলাচটা নামে আমাদের দেশে আর এক রকমের পাখী আছে। এরাও ভরত জাতের পাখী। এদের ঝাঁকে ঝাঁকে মাঠে চরতে দেখা যায়। ভরত পাখীদের মত এরাও আকাশে উঠা নামা করে উড়ে বেড়ায়। পুরুষ ধূলাচটের পালকের রঙ কালচে, স্ত্রীদের রং কতকটা সাদা।
(ভরত পাখীর ইংরেজি নাম Oriental Skylark; বৈজ্ঞানিক নাম: Galerida cristata; গড় দৈর্ঘ্য:১৮ সে.মি.। ভরত পাখীর ছবিটি ট্রেভার কোয়েস্টেড-এর সৌজন্যে পাওয়া।)
আমরা যত পাখী দেখতে পাই তাদের মধ্যে মধুপায়ী পাখীরাই বোধহয় সবচেয়ে ছোট। কোন পাখীদের আমরা মধুপায়ী বলছি, তোমরা বুঝতে পারছো কি? এদের কেউ কেউ 'মৌ-চোষা', কেউ বা 'দুর্গা টুনটুনি' বলেন। তোমরা এদের কি নামে ডাক জানি না, কিন্তু তোমরা এদের নিশ্চয় দেখেছ। মধুপায়ীরা আকারে তিন চার ইঞ্চির বেশি বড় হয় না। ফুলের মধু ও ফুলের ভিতরকার পোকা-মাকড়ই এদের প্রধান আহার। তাই মৌমাছি ভোমরার মত এরাও ফুলে ফুলে উড়ে বেড়ায়। এক মুহূর্তও এদের স্থির থাকতে দেখা যায় না। কেবল ফুলের গাছে লাফালাফি করে বেড়ায়। মধুপাখীদের গায়ে এত শক্তি কোথা থেকে আসে জানি না। আমরা তো আধ মাইল পথ দৌড়ে গেলেই হাঁপিয়ে পড়ি, কিন্তু এরা সমস্ত দিনের লাফালাফিতেও ক্লান্ত হয় না।
মধুপায়ীদের ঠোঁটগুলো কিরকম লম্বা ও বাঁকা, তোমরা বোধ হয় তা দেখেছো। ফুলের ভিতরে সেই ঠোঁট ঢুকিয়ে এরা মধু ও পোকা-মাকড় খায়। তাছাড়া মধু চুষে খাবার জন্য এদের জিভগুলোর আকৃতি কিছুটা নলের মত হয়। ঠোঁট দিয়ে ফুলের তলায় ফুটো করে মধুপায়ীরা মধুখাচ্ছে - এটা আমরা দেখেছি।
শুনেছি ভারতবর্ষে প্রায় তিরিশ ধরণের মধুপায়ী পাখী আছে। তাদের প্রত্যেকের গায়ের পালকের রঙ আলাদা। আমাদের বাংলায় এদের মধ্যে যে উপজাতিকে সর্বদা দেখা যায়, কেবল তাদের কথাই তোমাদের বলব। এই পাখীদের স্ত্রী ও পুরুষদের চেহারা এক নয়। দূর থেকে পুরুষ পাখীদের ভ্রমরের মত সব্জে রকমের কালো বলে বোধ হয় এবং ভালো করে দেখলে পেটের তলাটা ফিকে হলদে রকমের দেখায়। কিন্তু এটা তাদের প্রকৃত রঙ নয়। যদি এই পাখীদের কাছ থেকে পরীক্ষা করার সুযোগ পাও, তাহলে দেখবে এদের মাথার উপরকার খানিকটা রঙ সবুজ, কিন্তু কখনও গোলাপী দেখাচ্ছে। ঘাড় ও পিঠের খানিকটা যেন লাল। প্রিজমের তিনকোনা কাচে সূর্যের আলো পড়ে যেমন নানা রঙের বাহার দেখা যায়, মধুপায়ীদের পালকে সূর্যের আলোতে সেই রকমেই নানা রঙ ক্ষণে ক্ষণে প্রকাশ পায়। তাই এদের গায়ের রঙ যে কি, হঠাত্ বলা যায় না।
মধুপায়ীদের বাসা তোমরা দেখেছো কি? খোঁজ করে পরীক্ষা কোর, দেখবে বাসাগুলোতে খুব কারিগরি আছে। ছোট ঝোপে এরা বাবুইদের মত ঝুলনো বাসা তৈরি করে। শুকনো খড়কুটো মাকড়সার জাল দিয়ে জড়িয়ে এরা বাসা বানায়। কখনো কাগজের ছোট টুকরো ও অন্য পাখীর নরম পালকও বাসায় পাওয়া যায়। মধুপায়ীদের বাসার ছাদ থাকে এবং ভিতরে ঢোকার জন্য ছাদের কাছে একটা পথও থাকে। বাইরে থেকে বাসাগুলোকে একটা খড়ের স্তুপ বলে মনে হয়, কিন্তু ভিতরটা বড় সুন্দর। কোথা থেকে তুলো এনে মধুপাখীরা ভিতরে বিছিয়ে রাখে। আমরা যেরকম গদির ওপর শুয়ে আরাম পাই, ওরাও বাসায় শুয়ে সেই রকম আরাম পায়।
মধুপায়ীদের সাধারণত দুটোর বেশি ডিম হয় না। ঝোপ-জঙ্গলের খুব সরু ডালের গায়ে বাসা বাঁধে বলে বোধহয় কাক, কোকিল, ইত্যাদি দুষ্টু পাখী ডিমগুলোকে নষ্ট করতে পারে না। তাই মধুপায়ীরা যে দুটি ডিম পাড়ে, সাধারণত তাদের প্রত্যেকটি থেকেই ছানা হয়। তবে গিরগিটি ও টিকটিকিরা মধুপায়ীদের ডিমের পরম শত্রু। সন্ধান পেলেই ওরা ডিম চুরি করার চেষ্টা করে।
(মধুপায়ীর ইংরেজি নাম :Purple sunbird; বৈজ্ঞানিক নাম: Nectarinia Asiatica; গড় দৈর্ঘ্য: ১০ সে.মি.। মধুপায়ীর ছবিটি ম্যামপ্যাম কনসার্ভেশন-এর সৌজন্যে পাওয়া।।)
নদীর ধারে গাছে, খালে, বিলে ও পুষ্করিণীতে লম্বা ঠোঁটওয়ালা মাছরাঙা পাখী তোমরা নিশ্চয় দেখেছো। এদের ঠোঁট যেমন লম্বা, লেজ তেমনি ছোট। তোমরা কত রকমের মাছরাঙা দেখেছো জানি না, আমরা তিন রকমের দেখেছি। খাল বিলের ধারে একটু খোঁজ করলে তোমরাও দু এক রকমের মাছরাঙা দেখতে পাবে।
নীল মাথা মাছরাঙা আমাদের দেশে প্রায়ই দেখা যায়। এদের মাথা, পিঠ, ডানা, লেজ - সবই নীল। লেজের রঙ যত গাঢ়, পিঠের সেরকম নয়। আবার ডানার নীলের সঙ্গে যেন সবুজের আমেজও আছে। পা দু'খানি লাল, কিন্তু লম্বা ঠোঁট জোড়াটা কালো। এরা পুকুর বা বিলের ধারের গাছে ভালোমানুষের মত চুপ করে বসে থাকে। তারপর জলের কোন জায়গায় মাছ দেখতে পেলে ঠিক সেই জায়গার উপরে ঘন ঘন ডানা নেড়ে স্থির হয়ে উড়তে আরম্ভ করে। তোমরা যদি লক্ষ্য কর - তবে দেখবে , এই সময়ে মাছরাঙাদের মাথা থাকে নিচের দিকে এবং পা থাকে উপরের দিকে। যাইহোক এই রকম কিছুক্ষণ উড়ে ঝপাত্ করে জলে পড়ে মাছ ধরে ফেলে। কখনো কখনো জলের ভিতরে পোঁতা গোঁজ বা খোঁটার উপরে এদের একঘণ্টা দেড়ঘণ্টা ধরে মাছ ধরবার জন্য চুপ করে বসে থাকতে দেখা যায়।
এছাড়া আর এক জাতের সাদা-বুক মাছরাঙা আমাদের দেশে দেখা যায়। এগুলিও দেখতে বেশ সুন্দর। এদের ল্যাজ ও ডানা নীল। মাথা ও পেট খয়েরি রঙের। কিন্তু গলা, বুক ও গাল সাদা। আবার পা ও ঠোঁট লাল। আগে যে মাছরাঙার কথা বলেছি, তাদের চেয়ে আকারে এরা বড়।
জলাশয়ের ধার ছাড়া মাছরাঙাদের তোমরা মাঠে-ঘাটেও উড়ে বেড়াতে দেখবে। যখন মাছ বেশি জোটে না, তখন এরা মাঠে গিয়ে ফড়িং ও অন্য পোকা-মাকড় খেয়ে পেট ভরায়। লক্ষ্য করলে দেখবে, উড়বার সময়ে এরা ভয়ানক চিত্কার করে। মাছরাঙাদের বাসা খুঁজে বার করা খুব মুশকিল। এরা গাছের ডালে বা লোকের বাড়িতে বাসা করে না। জলাশয় থেকে দূরে কোনো নির্জন জায়গায় এরা মাটিতে যে লম্বা সুড়ঙ্গ তৈরি করে, সেটাই ওদের বাসা। সেখানেই মাছরাঙারা ডিম পাড়ে। আমরা মাছরাঙাদের বাসা স্বচক্ষে দেখি নি। শুনেছি সুরঙ্গের মধ্যে খড়কুটো না বিছিয়েই এরা ডিম পাড়ে। ডিমের রং লাল্চে। বাসার মধ্যে প্রায়ই মাছের কাঁটা জমা থাকে। বোধকরি নিজেরা মাছ খেয়ে এবং বাচ্চাদের খাইয়ে কাঁটাগুলোকে আর বাসা থেকে টেনে বাইরে ফেলে দেয় না। মাছরাঙাদের বাসা তাই বেশ নোংরা।
(ছবিতে যে ছোট মাছরাঙা দেখানো হয়েছে, তার ইংরেজি নাম: Common Kingfisher; বৈজ্ঞানিক নাম: Alcedo atthis; গড় দৈর্ঘ্য:১৬ সে.মি।)
শকুনরা মাংস খায়। কিন্তু সাধারণত শিকার করে খায় না। যে সব মরা গরু, ঘোড়া, জন্তু জানোয়ারদের বাইরে ফেলে দেওয়া হয়, তাদের পচা মাংস এরা ছিঁড়ে খেতে ভালোবাসে। কাজেই শকুনদের ঠিক শিকারি পাখী বলা যায় না। জন্তু জানোয়ারেরা মারা গেলে সেগুলো যদি মাঠে পচতো, তাহলে দুর্গন্ধে টেকা দায় হত। চিল, শকুন, কাকেদের মত পাখীরা ও শিয়াল প্রভৃতি জানোয়ার মরা জন্তুদের খেয়ে বলেই সেগুলো মাঠে-ঘাটে পচতে পারে না।
আমাদের দেশে সাধারণত দুধরণের শকুন দেখতে পাওয়া যায়। সাধারণ শকুন বোধকরি তোমরা সবাই দেখেছো। এরা প্রকাণ্ড পাখী। ভাগাড়ের কাছে গাছের উপরে বসে শকুন যখন রোদ পোয়াবে, তখন তোমরা এদের চেহারা দেখে নিও। সাধারণ শকুনদের মাথায় ও ঘাড়ে পালকের নামগন্ধ থাকে না। গায়ের পালকের রঙ কিছুটা গাঢ় ছাই রঙের, পিছন দিকটা কিন্তু সাদা। তাছাড়া ডানার ভিতরেও সাদা পালক আছে। তাই যখন শকুনরা অল্প উঁচুতে উড়ে, তখন ডানার তলা সাদা দেখায়। খুব উঁচুতে উড়লে ডানার সাদা রঙ আর চোখে পড়ে না। শকুনরা জলে স্নান করে না, তাই গায়ের দুর্গন্ধ কখনো যায় না। তবে রদ্দুরে ডানা মেলে রোদ খুব পোয়ায়। শকুনরা আকাশের খুব উঁচুতে উড়ে। ওদের ডানার জোর এত বেশি যে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা উড়েও ওরা ক্লান্ত হয় না। ওদের চোখের তেজও খুব। আকাশের খুব উপরে উঠেও কোথায় কোন মরা জন্তু পড়ে আছে, তা দেখতে পায়। তারপর প্রথমে একটা কি দুটো সেই মরা জন্তুর কাছে এসে বসে। তাদের দেখাদেখি আরও অনেক শকুন সেখানে এসে হাজির হয়।
গিন্নী শকুন তোমরা দেখেছো কি? এরা শকুনেরই এক উপজাতি, কিন্তু চেহারা সম্পূর্ণ পৃথক। এদের গায়ের অধিকাংশ পালকের রঙই খয়েরি। কিন্তু পায়ে যেন কিছু কিছু সাদা পালকও আছে। নেড়া মাথার চামড়ার রঙ লাল। মাথার দুপাশে আবার কানের মত দুটো লাল অংশ ঝুলতে থাকে। এসব মিলে গিন্নী শকুনদের বেশ বিশ্রী দেখায়। গিন্নী শকুনকে সব পাখী - এমনি কি শকুনরাও সমীহ করে চলে। এদের একটি কি দুটি যদি গো-ভাগাড়ে আসে, তাহলে অন্য সব পাখী সরে যায়। কেন কে জানে।
শকুনদের বাসা বোধকরি তোমরা কেউ দেখ নি। গাছের খুব উঁচু ডালে ডালপালা দিয়ে শীতকালে এরা বাসা বাঁধে। তোমরা হয়তো ভাবছো কাক-শালিকের মত গাছের তলা থেকে এরা খড়কুটো কুড়িয়ে আনে। কিন্তু এরা তা করে না। বেঁকানো ও চ্যাপটা ঠোঁট দিয়ে গাছের কাঁচা ডাল ভেঙ্গে এরা বাসা তৈরি করে। বাসা তৈরি করার সময়ে শকুনদের মেজাজটাও ভয়ানক চটে থাকে। এই সময়ে প্রায়েই তারা নিজেদের মধ্যে মারামারি ও কামড়া-কামড়ি করে। শকুনরা সাধারণত বাসায় একটির বেশি ডিম পাড়ে না। কিন্তু সেই একটিতেই বাচ্চা হয়। অন্য পাখীরা ভয়ে শকুনের বাসায় উত্পাত করে না। ওদের গায়ের দুর্গন্ধের জন্য মানুষও বাসার কাছে ঘেঁসে না। তোমরা যদি লক্ষ্য কর দেখবে, যে সব পাখীদের ডিম বেশি নষ্ট হয়, কেবল তারাই বেশি ডিম পাড়ে।
(এই লেখায় দুধরণের শকুনের কথা বলা হয়েছে। গিন্নী শকুন হল খনেগ King vulture (Sarcogypscalvus), গড় দৈর্ঘ্য ৮৪ সে.মি.। আর অন্য যে শকুন আমরা প্রায়ই দেখি সেটা হল Whitebacked vulture (Gyps bengalensis), গড় গড় দৈর্ঘ্য ৯০ সে.মি। এছাড়া ভারতবর্ষে আরও ছয় রকমের শকুন দেখা যায়। সেগুলির ইংরেজি নাম হল: Cinerous vulture (Aegypius manachus), Griffin vulture (Gyps fulvus), Long-billed vulture (Gyps indicus), Himalayan Griffin vulture (Gyps himalayensis), Egyptian vulture (Neophron percnopterus), এবং Bearded vulture (Gypaetus barbatus)। শকুনের ((Long-billed Vulture) ছবিটি শ্রী বিবেক আর সিন্হা-র সৌজন্যে পাওয়া।)
শঙ্খচিল তোমরা হয়তো দেখেছো। এদের পেটের তলা, বুক, মাথা ও ঘাড় সাদা পালকে ঢাকা থাকে। শঙ্খের মত সাদা পালক গায়ে আছে বলেই বোধ করি এদের নাম শঙ্খচিল হয়েছে। কিন্তু ডানা দুখানি ও শরীরের অন্য অংশ খয়েরি। এই চিলেরা সাধারণ চিলেদের মত দুষ্টু ও পেটুক নয়। মাংস মাছ বা অন্য খাবার জিনিস দেখলে ছোঁ মারে না। এই কারণে শঙ্খচিলকে লোকেরা ভদ্র বলে। ছেলেবেলায় এই চিল দেখলেই আমরা চিলের মত চিত্কার করে বলতাম,
"শঙ্খচিলের ঘটিবাটি
গোদা চিলের মুখে লাথি।"
সত্যি যখন গোদা বা সাধারণ চিলেরা ছোঁ মেরে খাবার কাড়তে গিয়ে হাত রক্তাক্ত করে তখন তাদের মুখে লাথি মারতে খুব ইচ্ছা করে। শঙ্খচিলেরা গ্রামের মধ্যে এসে বা গৃহস্থের বাড়িতে গিয়ে এরকম ডাকাতি করে না। মাছই এদের প্রধান খাবার। তাই শীতকালে খাল, বিল ও পুকুরের জল শুকিয়ে যায়, তখন এদের জলাশয়ের ধারে গাছে বসে থাকতে দেখা যায়। শীতের শেষে গরম শুরু হলে শঙ্খচিলচিলদের আর সন্ধান পাওয়া যায় না।
(শঙ্খচিলের ইংরেজি নাম: Brahminy Kite; বৈজ্ঞানিক নাম:Haliastur indus; গড় দৈর্ঘ্য: ৪৮ সে.মি.। শঙ্খচিলের ছবিটি লরেন্স পো-এর সৌজন্যে পাওয়া)
শরাল হাঁসদের তোমরা দেখেছো কিনা জানি না। এরা ঠিক হাঁস জাতির পাখী নয়। কিন্তু চালচলন এবং সাঁতরাবার ভঙ্গি প্রায় হাঁসদেরই মতন। শরালরা বেশ বড় পাখী। লম্বায় প্রায় এক হাত পর্যন্ত হয়। এদের মাথা ও লেজের রঙ কিছুটা খয়েরি। ডানা বেশ লম্বা চওড়া, কিন্তু লেজ ছোট। এরা ভালো উড়তে পারে না, কিন্তু জলে ডুব দেওয়াতে ও সাঁতারে খুব পটু।
শরাল পাখীরা গাছের কোটরে বাসা করে। আবার কখনো কখনো নদীর ধারে উঁচু জায়গায় গর্ত করেও এদের ডিম পাড়তে দেখা যায়। এদের ডিমের সংখ্যা প্রায়ই আট দশ পর্যন্ত হয়। কোন পাখী বাসা ছেড়ে পালিয়ে গেছে, আর অন্য পাখী সেখানে এসে ডিম পাড়ছে, এটা সাধারণত দেখা যায় না। কিন্তু শরাল পাখী কখনো কখনো অন্য পাখীর ভাঙা বাসা মেরামত করে সেখানে ডিম পেড়েছে - সেটা দেখা যায়। শরাল হাঁসেরা কখনোই একা একা চরে বেড়ায় না। ঝাঁকে ঝাঁকে এসে এদের এক একটা বড় জলাশয়ে কিছুদিন ধরে বেড়াতে দেখা যায়। সেখানকার খাবার ফুরোলে তারা অন্য জলাশয়ে যায়।
বালিহাঁসেরা বারোমাসই আমাদের দেশে থাকে। এরাও শরালদের মত জলাশয়ের ধারে গাছের কোটরে বাসা করে ডিম পাড়ে। কিন্তু এদের ডিমের সংখ্যা হয় অনেক। কখনো কখনো এক একটা বাসায় তেরো চোদ্দটা পর্যন্ত ডিম দেখা গেছে। বালিহাঁসের বাচ্ছারা ডিম থেকে বার হয়েই জলে নেমে সাঁতার দেয়, কিন্তু তখনো উড়তে পারে না। তাই বড় পাখীরা নাকি বাচ্চাদের ঘাড়ে করে জলে নামিয়ে দেয়। আমাদের দেশের বড় বড় জলাশয়ে বালিহাঁসের এইরকম ছানা অনেক সময়ে দেখা যায়।
(শরালের ইংরেজি নাম: Lesser Whistling-Duck; বৈজ্ঞানিক নাম:Dendrocygna javanica; গড় দৈর্ঘ্য: ৪২ সে.মি। বালিহাঁসের ইংরেজি নাম: Cotton Pygmy Goose (Cotton Teal) ; বৈজ্ঞানিক নাম: Nettapus corommandelianus; গড় দৈর্ঘ্য:৩৩ সে.মি। বালিহাঁসের ছবি 'বার্ডস অফ কলকাতা' ওয়েবসাইটে দেখতে পাবে।)
কাক যেমন সর্বদাই দেখা যায়, শালিকও সেই রকম দিনের বেলায় মাঠে-ঘাঠে ও বাড়িতে প্রায়ই নজরে পড়ে। তোমাদের বাড়ির আঙিনায় যখন শালিকের দল চরে বেড়াবে তখন লক্ষ্য কোর। দেখতে পাবে এদের বুকের কিছুটা অংশ, গলা ও মাথা কালো পালকে ঢাকা। ডানা দুখানির উপরটাও কালো। এ ছাড়া শরীর অন্য অংশ গাঢ় খয়েরি রঙের পালকে ঢাকা। হঠাত্ দেখলে মনে হয় যে, শালিকের গায়ে সাদা পালক নেই। কিন্তু তা নয়, যখন এরা ডানা গুটিয়ে চরে বেড়ায়, তখন এদের প্রত্যেক ডানায় একটা করে সাদা পালক দেখা যায়। তাছাড়া যখন এরা ডানা মেলে এক গাছ থেকে অন্য গাছে উড়ে যায়, তখন ডানার তলায় অনেক সাদা পালক নজরে পড়ে। লেজের পালকের ডগাগুলির রঙও আবার সাদা। শালিকের পা ও ঠোঁটের রঙ বড় সুন্দর। ঠিক যেন কাঁচা হলুদের মত। চোখের নীচের রঙও হলদে।
শালিকের চলা তোমরা দেখেছো কি? বাগানে ঘাসের মধ্যে যখন পোকা খুঁজে বেড়াবে, তখন লক্ষ্য কোর। দেখবে এরা আমাদেরই মত একে একে পা ফেলে চলে এবং দরকার হলে দৌড়ে বেড়ায়। শালিকদের পরস্পরের মধ্যে ভাব না থাকলেও চরবার সময়ে এরা দলবদ্ধ হয়ে বার হয়। তবে শালিকেরা ভয়ানক ঝগড়াটে পাখী। প্রায়ই দেখা যায় যে, কোন কারণ নেই - অথচ হঠাত্ দুটো শালিক রেগে মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে পায়ে পা লাগিয়ে লড়াই আরম্ভ করেছে - পরস্পরকে ঠোকর দিচ্ছে। বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ মাসে যখন ঘর-সংসার পেতে ডিম পাড়া ও বাসা বাঁধার সময় আসে, তখনই এই রকম ঝগড়াঝাটি বেশি দেখা যায়। মনে কর তিন চারটি পুরুষ শালিকের মধ্যে শুধু একটি স্ত্রী-শালিক আছে। এখন একটি স্ত্রী-শালিক কোন পুরুষের সঙ্গে থেকে বাসা বাঁধবে ও ডিম পাড়বে এই নিয়েও ওদের মধ্যে মারামারি বাঁধে। কিন্তু যখন মেজাজ ভালো থাকে তখন শালিকদের খুব সুশীল ও শান্ত পাখী বলে বোধ হয়।
শালিকদের গলার স্বর এক রকম নয়। ভয় পেলে এরা চ্যাঁ চ্যাঁ করে যে শব্দ করে তা অতি বিশ্রী। কিন্তু যখন পেট ভরে পোকা খেয়ে ডালে বসে থাকে, তখন এদের গলা থেকে যে আওয়াজ বার হয়, তা বেশ মিষ্টি। বোধ করি এটাই তাদের গান গাওয়া। শালিকদের চুর-চুর, কিচি-কিচি-মিচি, কক-কক-কক - এই রকম গান কি তোমরা শোনো নি? গানের সঙ্গে সঙ্গে আবার গায়ের পালকগুলো ফুলোতে ও ডানা নাড়াতেও দেখা যায়। এদের এই গান গাওয়া দেখলে সত্যিই হাসি পায়। গানে না অছে তাল, না আছে সুর, আবার সঙ্গে সঙ্গে কালোয়াতদের মত মুখভঙ্গি! শালিকরা কি খায়, তা বোধহয় তোমরা জানো না। এরা ডাল, ভাত, ধান, গম, যব, ইত্যাদি থেকে শুরু করে পোকা-মাকড় সব জিনিসই খায়। পোকা-মাকড় খায় বটে, কিন্তু যে-সে পোকা খায় না। ফড়িং এবং গাছের ও ঘাসের মধ্যে যে সবুজ রঙের পোকা পাওয়া যায় - সেটাই এদের বেশি পছন্দ।
শালিকরা সারাদিন চরে বেড়িয়ে এক একটা নির্দিষ্ট গাছে এসে রাত কাটায়। বছরের মধ্য নয়মাস গাছে কাটিয়ে বৈশাখ থেকে আষাঢ় মাস পর্যন্ত ওরা বাসা বানিয়ে থাকে। সেই বাসা বাড়ির কড়িকাঠের ওপরেও হতে পারে, আবার লোকালয়ের মধ্যে কোন গাছেও হতে পারে - ঘোর জঙ্গলে এরা বাসা বাঁধে না। কিন্তু বাসাগুলোতে একটুও কারিগরি দেখতে পাওয়া যায় না। খড়কুটো, সাপের খোলস, নেকড়া-কানি, যা ঠোঁটের গোড়ায় পাওয়া যায়, তাই কুড়িয় এনে সেগুলোর ওপরে বসবার মত একটু জায়গা করে নেয় এবং তাতেই নীল রঙের তিন চারটে করে ডিম পাড়ে।
(শালিকের ইংরেজি নাম: Common Myna; বৈজ্ঞানিক নামগAcridotheres tristis; গড় দৈর্ঘ্য: ২৫ সে.মি। শালিকের ছবিটি এস-ডি-এন-পি বাংলাদেশ থেকে ওঁদের বিজ্ঞাপিত 'সুব্যবহারের জন্য অনুমতি'- এই ভিত্তিতে নেওয়া হয়েছে।)
শিকরা পাখীর নাম তোমরা বোধ করি শুনেছো। এদের প্রায়ই আমাদের দেশে দেখা যায়। বীরভূম, বাঁকুড়াতেই এদের দেখা মেলে বেশি। শিকরা পাখী আকারে পায়রার চেয়ে বড় হয় না। শরীরের তুলনায় লেজগুলিকে যেন একটু বেশি লম্বা মনে হয়। এদের গায়ের পালকের রঙ ছেয়ে এবং বুক পেয়ালা, কিন্তু ডানা ও লেজে কালো ডোরা থাকে। আবার পেয়ালা রঙের বুকের উপরে সাদা ডোরাডুরিও দেখা যায়। কিন্তু এদের বাঁকানো ঠোঁট, হলদে চোখ ও ধারাল নখ দেখলে যেন ভয় লাগে। শিকরাদের চাহনিও বড় কটমটে।
শিকরারা কোন কোন জন্তু শিকার করে তা বোধ করি তোমরা জানো না। চড়াই, ভুরুইয়ের মত ছোট পাখী থেকে শুরু করে, টিকটিকি, গিরগিটি, বিছে, ব্যাঙ, এমন কি ফড়িং পর্যন্ত সব কিছুই সুবিধা পেলে ধরে খায়। আমরা এদের ঘুঘু ও শালিক ধরেও খেতে দেখেছি। কিছুদিন আগে পর্যন্ত সাঁওতালরা শিকরা পাখীদের দিয়ে পাখী শিকার করতো। পোষা শিকরা পাখী নিয়ে তারা বেরোতো। তারপর গাছে কোনো পাখী দেখলে শিকরা পাখীকে তার দিকে ছেড়ে দিত। শিকরা উড়ে গিয়ে সেই পাখীকে ধরে আনতো। আগেকার যুগে রাজা-বাদশারাও শিকরা আর বাজপাখী দিয়ে এইভাবে শিকার করতেন। সৌভাগ্যক্রমে সেগুলো এখন বন্ধ হয়েছে।
শিকরা পাখীরা গাছের খুব উঁচু ডালে বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ মাসে বাসা বাঁধে। কিন্তু বাসা বানানোর ব্যাপারে এরা মোটেই পটু নয়। দুয়েকটা করে খড়কুটো নিয়ে সারা মাস ধরে তারা যা বানায় তাতে বিশেষ কোনো শ্রীছাঁদ থাকে না। এলোমেলো করে সাজানো কতগুলো খড়কুটোই শিকরাদের বাসা। এই রকম বাসায় তারা দু-তিনটে ফুটফুটে সাদা রঙের ডিম পাড়ে। শিকরাদের ছানারাও বাপ-মায়ের মত সাহসী। অন্য পাখী বাসার কাছে এলে এই ছোট বয়সেই তারা শত্রুদের আক্রমণ করে।
(শিকরার ইংরেজি নাম:Shikra; বৈজ্ঞানিক নাম: Accipiter badius; দৈর্ঘ্য: ৩০-৩৬ সে.মি.। শিকরার ছবি সাইমন উলি ও জুলিয়া ক্যাসন-এর সৌজন্যে পাওয়া।)
সাতসয়ালি পাখীদের আরেক নাম হল 'সাত সতী'। এই নাম কেন হল জানি না। কিন্তু পাখীগুলি বড় সুন্দর। মাথা ও ঘাড় কালো। পিছন দিক ও পেটের তলার রঙ আলতার মত। ডানা কালো, কিন্তু তার উপরে আলতা রঙের ডোরা আছে। পাখীগুলি ছোট। কখনোই এরা একা একা বেড়ায় না - অনেকে মিলে গাছে গাছে লাফিয়ে পোকা-মাকড়ের সন্ধান করে।
টুনটুনিদের মত সাতসয়ালিদেরও স্ত্রী-পুরুষের চেহারায় তফাত্ আছে। স্ত্রী-পাখীদের গায়ের রঙ হলদে এবং কালোতে মেশানো। কিন্তু রঙের বাহার থাকে পুরুষের গায়েই বেশি। এই পাখীদের আরেক উপজাতিকে ছোট সয়ালি বলা হয়। এদের মাথা ধূসর, কিন্তু বুকের পালকের রঙ লাল। সয়ালি পাখীদের সর্বদা দেখা যায় না।যদি একটু নজর রাখো, তাহলে তোমাদের বাগানেই কখনো কখনো দেখতে পাবে।
(সাতসয়ালির ইংরেজি নাম: Scarlet Minivet; বৈজ্ঞানিক নাম: Pericrocotus flammeus । সাতসয়ালির ছবিটি শ্রী কোজি ট্যাগি-র সৌজন্যে পাওয়া।)
আমাদের দেশে যত পাখী আছে, তাদের মধ্যে সারস পাখীরাই সকলের চেয়ে বড়। তাদের ঠ্যাঙগুলোই বোধকরি দুই হাত লম্বা। সারসদের গায়ের অধিকাংশ এইজন্য এদের কূলেচর পাখীদের মধ্যে ধরা হয়। কিন্তু কখনো কখনো এদের জলাশয় থেকে দূরে ধানের ক্ষেতে ও মাঠেও চরতে দেখা যায়। পোকা-মাকড়, শামুক-গুগলি, এমন কি ব্যাঙ ও গিরিগিটি পর্যন্ত এরা ধরে খায়। আবার ধান, যব জাতিয় শস্য পেলেও খেতে ছাড়ে না। হাড়গিলারা পায়ের আঙুল দিয়ে ডাল অাঁকড়ে গাছে বসতে পারে, কিন্তু সারসরা তা পারে না। তাই মাটিতেই তাদের চরে বেড়াতে হয়। ডিম পাড়ার সময় হলে জলের উপরে ডালপালা, খরকুটো, ঘাস ইত্যাদি জমা করে ভেলা তৈরি করে তার উপর সারসরা ডিম পারে। যাতে শিয়াল, কুকুর বা অন্য জন্তুরা ডিম নষ্ট না করতে পারে। বর্ষা কাল হল সারসদের ডিম পাড়ার সময়। এই সময় এরা দুটোর বেশি ডিম পাড়ে না। ডিমগুলির রং হয় যেন ঘোলাটে সাদা।
সারসরা সাধারণত জোড়ায় জোড়ায় চরে। শুনেছি স্ত্রী ও পুরুষ সারসের মধ্যে ভাব খুব বেশি। এক জোড়া সারসের মধ্যে যদি কোন রকমে একটি মারা পড়ে, তাহলে অন্যটি শোকে অধীর হয়। কখনো কখনো আহার নিদ্রা ত্যাগ করে। এরা খুব শান্ত পাখী - মানুষের অনিষ্ট করে না। তবু মানুষরা এদের গুলি করে, ফাঁদ পেতে ধরে এবং বাজারে বিক্রি করে।
(ছবিতে যে সারস দেখানো হয়েছে, তার ইংরেজি নাম Painted stork; বৈজ্ঞানিক নাম:
হরিয়াল পায়রা জাতিরই পাখী। আকৃতিতে কতকটা মিল থাকলেও চাল-চলনে ও গায়ের রঙে মিল নেই। হরিয়াল হয়তো তোমরা দেখ নি। এরা কখনোই গৃহস্থদের বাড়িতে চরতে আসে না বা বাগানের গাছে এসেও বসে না। একটু নিরিবিলি জঙ্গলের গাছে হরিয়ালদের সন্ধান পাওয়া যায়। এরা দেখতে অতি সুশ্রী। গায়ের রং যেন হলদেটে সবুজ। বুক ও গলার রং একটু বেশি হলদে। পা দুখানি ছোট, কিন্তু তাদের রঙও হলদেটে লাল। যখন এক ঝাক হরিয়াল কোন গাছে গিয়ে বসে, তখন অনেক সময়ে গায়ের রঙে আর পাতার রঙে এমন মিশে যায়, যে একটি পাখীকেও দেখা যায় না।
পায়রা জাতের পাখী হলেও হরিয়ালরা ধান, গম, সর্ষে কখনোই ছোঁয় না - এদের প্রধান খাদ্য গাছের ফল। ঝাঁকে ঝাঁকে এসে যে গাছে ওরা বসে সে গাছের একটি ফলও ওরা খেতে বাকি রাখে না। সাধারণ লোকে বলে হরিয়ালরা খুব অহঙ্কারী পাখী, তাই মাটিতে পা রাখে না। একথা সত্যি যে, পায়রাদের মত মাটিতে নেমে এরা চরে না। কারণ ওদের খাদ্য ওরা গাছেই পায়। পায়রাদের মত হরিয়ালরা বকম বকম করেও ডাকে না। গোল পায়রা যেমন মাঝে মাঝে কু কু করে আস্তে আস্তে শব্দ করে, হরিয়ালরা সেরকম ডাকে। এই ডাক খুব মিষ্টি, ঠিক যেন শিস দেওয়ার মত।
হরিয়ালরা বাসা ভালো তৈরি করতে পারে না। খড়-কুটো জড় করে গাছের ওপর কোনোমতে একটা বাসা বেঁধে দু-তিনটে সাদা রঙের ডিম পাড়ে বটে, কিন্তু খড়কুটো ঠিকমত সাজানো থাকে না বলে অনেক ডিমই ফাঁক দিয়ে মাটিতে পড়ে ভেঙে যায়। হরিয়ালরা মানুষের কোন ক্ষতি করে না। বনে জঙ্গলে পাতার আড়ালে লুকিয়ে বনের ফল খায়, নিজেদের বাচ্চাদের পালন করে। অথচ মানুষরা খুঁজে খুঁজে ওদের বার করে বন্দুকের গুলি মেরে শিকার করে - মাংস খাবার লোভে! দেখ মানুষের কত অন্যায়!
(হরিয়ালের ইংরেজি নাম: Yellow Footed Green Pegion; বৈজ্ঞানিক নাম: Treron phoenicoptera; গড় দৈর্ঘ্য: ৩৩ সে.মি। হরিয়ালের ছবিটি শ্রী সুমিত সেন-এর সৌজন্যে পাওয়া