প্রথম পাতা

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

মতামত ও আলোচনা

নভেম্বর ১৫, ২০১৬

 

হুজুগ নয়, নিষ্ঠা! দলাদলি নয়, মিলিত প্রচেষ্টা আর উৎপাদকতা!

এ কে নন্দি


সাধারণ একটা ঘটনা, কিন্তু এসবই আমাদের বাংলার লাইফ লাইন’! বাংলার একটা ছেলে সন্দীপ, ‘কর্মকারঘরের, বাঁকুড়া জেলার কোন এক গ্রামে তার বাড়ী। পড়াশুনা কিছু তেমন করে নি ক্লাস টেন হবে হয়তো! শান্ত ছেলে - এদিক ওদিক করে কিছুদিনের মধ্যেই শিখে গেল অদ্ভুত সোনার কাজ। শুধু তাই নয়, সুন্দর তার ডিজাইন অর্থাৎ আর্টের কল্পনা শক্তি; আর সেগুলোকে তুলে ধরে বিভিন্ন গয়নাতে, ছোট-ছোট কাটপিস স্যাম্পলহিসেবে। কর্মকার মা-বাপ বুঝল এর দ্বারা হবে কিছু, যা কিছু সোনাদানা ঘরে ছিল তাদের, তাই দিয়ে সন্দীপ বানিয়ে ফেললো বেশ কিছু স্যাম্পল। সেই  দেখিয়ে খুব সহজেই সন্দীপ বর্দ্ধমানের বেশ বড় একটা স্বর্ণকারের দোকানে কারিগর বনে গেল। দেখতে না দেখতেই মালিকের খুব ঘনিষ্ঠ হল এবং ওরই সমস্ত ডিজাইন অনুযায়ী বেশীর ভাগ গয়না-গাটি তৈরি হতে থাকলো। জহুরী মালিক চিনে ফেললো - সত্যি রতন ছেলেকে! এক বছরও গেল না, তারই মধ্যে সন্দীপ বানিয়ে ফেললো মোটামুটি পয়সা। দোকানের কাজের পরেও নিরিবিলি ভাবে বাড়িতে বসে তৈরি করতে লাগলো আরও অনেক স্যাম্পল। এ সবই অতি সূক্ষ্ম, সুন্দর আর তেমনি নিপুণ কারুকার্যে ভরা।

তারপর যা হবার, তাই হল! মুম্বাইতে জুয়ারীদেবী মার্কেটে সন্দীপ এখন সোনার কারবারি জনা পঁচিশ লোক দুভাগে কাজ করে। আঠারো-উনিশ জন সোনার জিনিস বানায়, আর বিভিন্ন বড় কারবারিদের সাপ্লাই করে। সাথে-সাথে আরও পাঁচ-ছ জন আলাদা ভাবে ইমিটেশনের গয়নাতে গোল্ড প্লেটিং এবং পালিশ করে।

সন্দীপের কাছে সময় নেই, ঘরে যেটুকু সময় পায় হিসেব-নিকেশ আর মাঝে-মধ্যে সিসিটিভির মাধ্যমে মোবাইলে দেখতে থাকে ওর কারখানায় সবাই, কে কি করছে এবং দরকার মত তাদের সাথে কথাও বলতে থাকে।

সেদিন সন্দীপের সাথে দেখা হল; বয়স বেশী নয় তিরিশের মধ্যে, এখনো বিয়ে করে নি। জিজ্ঞেস করলাম আরও কিছু করবে কি এবার? এখন পর্যন্ত তুমি তো অবাক করে দিয়েছ, কিন্তু এর পরে কি?” সন্দীপ মৃদু হেসেছে, কোন জবাব দ্যায় নি; হয়তো ভেবে উঠতে পারছে না। জানতে চাইলাম বিয়ে কবে করবে?” তেমন কোন সারা পেলাম না! আমার ওকে কেমন অস্থির আর হতাশ লাগলো! মনে হল সন্দীপের এই ব্যবসা একজনের দ্বারা চালানো আর সম্ভব নয়; বিভিন্ন প্রতিভার কয়েকটা যুবক যদি একজোট হতো, তাহলে হয়তো এ ব্যবসা এক নতুন রূপ নিয়ে বাড়তে পারতো।

সন্দীপের এই পুরো কারোবারকোন কোম্পানির নামে বা রেজিস্টার্ড নয়। এসব, কিছু কানুনকে মেনে করতে হয়। তাছাড়া লিমিটেড কিছু ব্যাপারী ছাড়া বেশি জনের সাথে ব্যবসা করা বা মুম্বাইয়ের বাইরে সাপ্লাই করার মতন সময় ওর থাকে না। সন্দীপ হয়তো উপযুক্ত শিক্ষা, সময় এবং সংযোগের অভাবে, ব্যবসাটা আর বাড়াতে পারছে না! ওর মধ্যে কোন একটা অজানা আশঙ্কা বা দ্বিধাও আছে, যা খুবই স্বাভাবিক। এ আমাদের সামাজিক জটিলতা, অসমর্থতা এবং রাজনৈতিক দুর্নীতির কারণ। সন্দীপের মতন একটা অর্ধ-শিক্ষিত ছেলে, এ গরীব দেশে পঁচিশটা পরিবারকে অন্ন তুলে দিচ্ছে; কিন্তু আফসোস এদের মনোবল বাড়াতে বা দেশের প্রগতি বাড়ানোর জন্য, বিভিন্ন ছোট-ছোট গ্রুপ বানিয়ে এদের শিক্ষিত করতে, এ দেশে কোন পদ্ধতি নেই। ঘৃণিত দলাদলি আর এদের কঠিন পরিশ্রমের পয়সা লুটে নিতে আগ্রহী হয়তো অনেকে আছে!

দুঃখের ব্যাপার, এরকম সন্দীপের মতন কত উদ্যমশীল যুবক জীবনের মাঝপথে এসে থমকে দাঁড়ায় হয়তো কোন সহায়তা দরকার; বা কোন নির্ভর যোগ্য এমন কারও খোঁজ করছে, যার মধ্যে সেই গুণ আছে, যা ওর পক্ষে সম্ভব নয়। এ পৃথিবীতে সফল ব্যক্তি তারাই হয়, যারা নিজের উদ্দেশ্যকে সাকার করার জন্য পছন্দ মতন ব্যক্তি সমূহের সান্নিধ্যে আসে, পুরো সততা এবং আন্তরিকতার সাথে। ঠিক এই ভাবেই কোন এক সংস্থা আর এক সংস্থার সাথে হাত মেলায় মিলিত সুবিধা পাওয়ার আসাতে।

মনে পড়ে ঠিক এরকম হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিধ্বস্ত জাপানের অবস্থা; বাঁচার তাগিদে সকলে ছোট-ছোট শিল্প, বাণিজ্য, ইত্যাদি শুরু করে। তাদের উৎসাহ ছিল অনেক কিন্তু অভিজ্ঞতা আর সামর্থ্য দুইয়েরই কমতি ছিল। তারা একে অপরের সাথে মিলে যেতে লাগলো সম্পূর্ণ আন্তরিকতা, কঠিন পরিশ্রম এবং সংগ্রামের সাথে। ওরা মরিয়া হয়ে যে কোন প্রচেষ্টাকে সফল করতে বদ্ধপরিকর হতো; কেননা একবার ব্যর্থ হয়ে গেলে দ্বিতীয়বার দাঁড়ানোর সামর্থ্য হারিয়ে ফেলবে এই ভয়ে; এ ছিল ওদের বাঁচার লড়াই!

আমাদের দেশের হাল ওই সময়ের জাপানের মতো এতো খারাপ কখনো হয়নি; তাই আমরা ওই টীম-ওয়ার্কআয়ত্ত কোরতে পারলাম না! আর দুঃখের ব্যাপার এই যে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কমজোর শাসনতন্ত্র আমাদের নৈতিকতাকে নষ্ট কোরে দুর্নীতিকে চরমে এনে ফেলেছে! আমাদের সৌভাগ্য এই যে এ দেশের অসংখ্য প্রাইভেট কোম্পানি এবং শিল্পপতিদের নেতৃত্বে দেশ ধীরে-ধীরে এগিয়ে চলেছে বিশ্বস্তরে।  সন্দীপের মতন এরকম যুবক উদ্যোক্তারা হল আমাদের ভবিষ্যৎ। এরা যেদিন কোন কাজ শিখে বা বেকারত্ব ছেড়ে একক বা গোষ্ঠীবদ্ধ ভাবে কোন শিল্প অথবা ব্যবসা করা শুরু করবে, অবশ্যই এ দেশ অনেক ধনী হতে পারবে।

আমি ভাবতে লাগলাম সন্দীপ কেন মুম্বাইতে এলো! নিঃসন্দেহে ও অনেক কিছু শিখেছে। এখন যদি কয়েকজন কে নিয়ে বাংলায় আর একটা সোনার ছোট্ট কারবার খোলে এবং মুম্বাই ও কোলকাতা দুজায়গাতেই সাপ্লাই করে, তো ব্যবসাটা হয়তো আরও বাড়বে! আমার মনে হয় সন্দীপ কিছু পরিচিত এবং সদ্য পাস করা শিক্ষিত কোলকাতা আর মুম্বাইয়ের যুবকদের সাথে সহজ বোধ্য চুক্তি বানিয়ে তাদের মার্কেটিং, আর্থিক বা হিসাবপত্রের কাজে লাগানোর চেষ্টা করতে পারে!

কিন্তু সন্দীপের এই কলকাতার ব্যবসাটা কেমন চলবে তা নির্ভর করছে কর্মচারীবৃন্দ, ব্যাপারী এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থা অর্থাৎ ইউনিয়ন, সমাজ বা দলাদলি আর রাজনীতির উপর! যদি এই ইউনিটটা না দাঁড়াতে পারে, তাহলে সন্দীপ একটা ধাক্কা তো খাবে! সব থেকে বড় কথা - এতোগুলো কর্মচারী, তাদের পরিবার আর শিক্ষিত যুবকেরা সব বেকার হয়ে অন্যত্র অন্নের সন্ধানে ঘুরে বেড়াবে! তখন ইউনিয়ন-পলিটিক্সের নামে ঠুনকো আদর্শবাদী লেকচার শুনে ওই গরীব গুলোর নিদারুণ যন্ত্রণা কিছুতেই কম হবে না! যে সমাজ মানুষের এই চরমতম দুর্দশার দায়িত্ব উপলব্ধি করতে পারে না, আর এসব হতভাগ্যদেরকে বিভিন্ন ভাবে হুজুগে মাতিয়ে তাদের অন্ন ছিনিয়ে ন্যায়, তা নরকের থেকেও বেশী ঘৃণিত!

আশ্চর্যের ব্যাপার হল বাঙালিদের কিছু দুর্লভ গুণ, যা কদাচিৎ অন্য যায়গায় চোখে পড়ে! সারা পৃথিবীতে উৎসবের মধ্যে দিয়ে শিল্প-কলাকে যদি দেখতে হয়, তো সে হল বাংলার দুর্গা পুজো - যুবকদের চমৎকার দলগত প্রচেষ্টা, বিবেচনাপূর্ণ পরিকল্পনা এবং ব্যবস্থাপনা। এ কথা সমস্ত বাঙালির অন্তর্দর্শনের জন্য জানা উচিত; এসব দলগত গুণই শিল্প-উদ্যোগকে চরম শিখরে নিয়ে যেতে পারে। তাহলে কেন সন্দীপ যা মুম্বাইতে করতে পারে, তা কলকাতায় আরও ভালো ভাবে করতে পারবে না? এ প্রশ্ন শুধু বাঙালির নয়, বাংলার প্রতিটি ব্যক্তির ভেবে দ্যাখা জরুরি! আমরা বাংলার জনসাধারণ, সাধারণ সন্দীপের ঘটনা থেকে নিজেদের দায়িত্ব নিশ্চয়ই বুঝতে পারি। উত্তেজনার বশে নাটকীয় ঘটনা, যার পরিণতি জানা নেই; কি হবে তাতে সায় দিয়ে? হাওয়া না পেলে এসব এমনিই বুজে যাবে! তাহলে সবাই হুজুগে না মেতে গম্ভীর হয়ে ভাবতে পারি পরিশ্রম, নিষ্ঠা আর শিল্প-উদ্যোগের উৎপাদকতার থেকে বেশী সুখ আর কিছুতে পাওয়া যেতে পারে কি?  



লেখক পরিচিতি - একে নন্দি, মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ স্নাতক। বর্তমানে সংগঠন উন্নয়নের পরামর্শকারী হয়ে বিভিন্ন কোম্পানিতে সেবারত। অবসরপ্রাপ্ত মহাপ্রবন্ধক, প্রশিক্ষণ এবং উন্নয়ন জেপি গ্রুপ। প্রায় ত্রিশ বছর বিভিন্ন কোম্পানিতে শিক্ষকতা; প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং প্রায়োগিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ, পরিচালন এবং উন্নয়ন মূলক কার্যে নেতৃত্ব করাতে অতিবাহিত।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।