বিনোদন
জানুয়ারি ৩০, ২০১৬
বাংলা থিয়েটারের পথ চলা – সমকালীন সমাজ ও সময়
ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়
২৭ শে মার্চ ‘বিশ্ব নাট্য দিবস’ । ১৯৬১ থেকে বিশ্বের নানা
প্রান্তের নাট্যকর্মীরা এই দিনটিকে যথোচিত শ্রদ্ধার সঙ্গে উদযাপন
করেন। সেই উদযাপনের উদ্দেশ্য থিয়েটার কর্মী তথা নাট্যশিল্পীদের
কাছে আন্তর্জাতিক থিয়েটার ভ্রাতৃত্বের বার্তার সঞ্চার এবং নিশ্চিতভাবেই
নিজের দেশের নাট্য ঐতিহ্যকে ফিরে দেখা । এই ২০১৫তে আমরা পেরিয়ে
এলাম আধুনিক বাংলা থিয়েটারের দুই কিংবদন্তী ব্যক্তিত্ব – বিজন
ভট্টাচার্য ও শম্ভূ মিত্র’র জন্ম শতবর্ষ । আর এই ২০১৫র ২৭শে নভেম্বর
বাংলা ভাষায় নাট্যাভিনয়ের ২২০ বছরও বটে। এই পরিপ্রেক্ষিত মনে রেখে
আমি বাংলা থিয়েটারের পথচলার ইতিহাসটি ফিরে দেখতে চাইব। ফিরে দেখতে
চাইব সেই সময় ও সমাজকে ।
মধ্যযুগ পেরিয়ে আধুনিক যুগের শুরুতেও লোকনাট্যের মধ্যে ভারতীয়
নাট্যকলার শিকড় ছিল। লোকগান, কবিগান, রামযাত্রা, আখড়াই ইত্যাদির
মধ্যে নাট্য উপাদান ছিল। কিন্তু আধুনিক যুগে সেই শিকড় থেকে আমাদের
নাটক ও মঞ্চের উদ্ভব হল না ঔপনিবেশিক শাসনের কারণে। আমাদের থিয়েটারের
উদ্ভব হল ইউরোপীয় ভাবনার অভিঘাতে।
২৭শে নভেম্বর – ক্যালেন্ডারের একটি দিন, বিস্মৃতপ্রায়ও বটে। কিন্তু
বাঙালির সামাজিক ইতিহাসের এক তাৎপর্যময় দিন। আজ থেকে ঠিক দুশো
কুড়ি বছর আগে ১৭৯৫-এর এই দিনটিতে বাঙালির প্রথম নাট্যাভিনয়। বাংলা
থিয়েটার ও বাংলা ভাষায় নাট্যাভিনয়ের সূচনাও এই দিনটিতে।
প্রথম নাট্যাভিনয় উপলক্ষে প্রচারপত্র
|
১৭৯৫ – নগর কলকাতার বয়স তখন সবে একশো বছর। নগরায়ন শুরু হয়েছে
ধীর গতিতে। জঙ্গল, বাদা, ধানখেত ঘেরা কাঁচা মেঠো রাস্তা। একটাও
চওড়া রাস্তা নেই, বিদ্যুতের আলো আসেনি, সংবাদপত্র দূরের কথা ছাপার
যন্ত্রও আসেনি। যানবাহন বলতে পালকি। কিন্তু থিয়েটার এসেছিল। নগর
কলকাতার প্রতিষ্ঠার পঞ্চাশ/ষাট বছরের মধ্যেই ইংরেজরা তাদের বিনোদনের
জন্য তৈরি করেছিল ‘চৌরঙ্গী থিয়েটার’। কিন্তু বাংলা ভাষায় নাটক
লেখা বা অভিনয় করার কথা ভাবতে পারেননি কেউই। ভাববেনই বা কী করে!
বাংলা গদ্যের জন্মই তো হয়নি! ভেবেছিলেন একজন বিদেশী – গেরেসিম
স্তিফানোভিচ লেবেডফ। তিনিই সূচনা করেছিলেন বাংলা ভাষায় প্রথম নাট্যাভিনয়।
রুশ যুবক লেবেডেফ পর্যটক হিসাবে কলকাতায় এসেছিলেন ১৭৮৫-এ। বেহালা
বা ভায়োলিন বাদনে তাঁর পারদর্শিতা ছিল। কলকাতায় আকর্ষিত হন বাংলা
ভাষার প্রতি। দশ বছর কলকাতায় থেকে জনৈক শিক্ষক গোলকনাথ দাসের কাছে
বাংলা ভাষা শিখে একটি প্রহসন ‘দি ডিসগাইস’-এর বাংলা অনুবাদ করলেন
‘কাল্পনিক সঙ বদল’ নামে। অভিনীত হল ২৫ নম্বর ডোমোটোলায় (এখনকার
এজরা স্ট্রীট), মাচা বেঁধে ‘বেঙ্গলি থিয়েটার’ প্রতিষ্ঠা করে। বাংলা
থিয়েটারে নারীর অভিনয়ের সূচনাও হল এই দিনে। গোলকনাথের সহায়তায়
তিনজন বারাঙ্গনা কন্যাকে সংগ্রহ করেন লেবেডফ। কিন্তু সেদিনের অভিনেতা
অভিনেত্রীদের বা লেবেডফের প্রধান সহায়ক গোলকনাথ দাস সম্পর্কে আর
কিছুই জানা যায়না। জানা যায়না কেমন ছিল সেই সূচনালগ্নের বাংলা
অভিনয়। কলকাতা থেকে বিতাড়িত হয়ে ফিরে গিয়ে বন্ধু সাম্বারাস্কিকে
এক পত্র লিখেছিলেন লেবেডফ। লিখেছিলেন – “আমার বহুবিধ পরিশ্রমের
মধ্যেও আমি নিরুৎসাহী ভন্ড ও বন্য প্রকৃতির বাঙালিদের হাস্যরসাত্মক
অভিনয় আয়োজন করিয়াছিলাম”। বাঙালির সেই প্রথম নাট্যাভিনয় উপলক্ষে
লেবেডফ যে প্রচারপত্র বা বিজ্ঞপ্তি প্রচার করেছিলেন সেটিরও উল্লেখ
করছি এর ঐতিহাসিক গুরুত্বের জন্য। কারণ এটি আদি কথ্য বাংলা ভাষার
নমুনাও বটে। তখনও বাংলা গদ্যের সূচনা হয়নি, বানানের শুদ্ধতা বা
যতি চিহ্ন ব্যবহারের কোন বালাই ছিল না। সেই বিজ্ঞাপনটি অবিকৃত
উদ্ধার করলাম –
প্রথম নাট্যাভিনয় উপলক্ষে প্রচারপত্র
“গবর্ণর জেনারেল অনুমতি প্রমান –
লেবেডফ মহাশএর
নওব নাচঘর নং ২৫ ডোমতলার পথে –
এক বাঙালি সংবদোল নামে প্রকাস করা হইবেক –
কাল নাচ হইবেক এই মাহ ১৪ অগ্রহায়ন ইংগরাজি ২৭ নবার
বেলাতি আর বাঙালি জনত্রের সহিত গিতবাদ্য হইবেক –
শ্রী ভারতচন্দ্র রায়ের কবিতা জনত্রের গান হইবেন –
নিচের বারান্দা ও ঘরের ভিতর সিককা ৮
উপরে বারান্দা ৮
নাচের টীকিট নাচঘরে পাওয়া যাইবেক’
এই দিনটির- অর্থাৎ লেবেডফের বেঙ্গলি থিয়েটারের প্রতিষ্ঠা ও বাঙ্গালির
প্রথম নাট্যাভিনয়ের সূচনার আরো কয়েকটি ঐতিহাসিক তাৎপর্য আছে। (১)
আমরা জানতে পারলাম নাট্যাভিনয়ে পুরুষ ও নারী সমবয়সী। (২) বিনোদন
সর্বসাধারণের উপভোগের বস্তু – শুধুমাত্র বিত্তশালীদের নয়। এবং
(৩) আমরা জানতে পারি আদি বাংলা গদ্যভাষার নমুনা। টিকিট কেটে এবং
পুরুষের সঙ্গে মেয়েদের নিয়ে নাট্যাভিনয় হল, ইতিহাসে স্থান পেলো
বটে কিন্তু বাঙালির সেই প্রথম নাট্যাভিনয় আমাদের পরবর্তী নাট্য
রচনা ও অভিনয়ের বিবর্তনে স্থায়ী ছাপ রেখে গেল না। কারণ সে অভিনয়ের
বিশেষ কোন লেখাজোখা পাওয়া যায় না, কলকাতা থেকে ফিরে গিয়ে বন্ধু
সাম্বারাস্কিকে একটি পত্রে কিছু বিবরণ লিখে গিয়েছিলেন, এই যা।
অভিনয়যোগ্য মৌলিক বাংলা নাটক লেখা হল আরো ৬৩ বছর পরে। রামনারায়ণ
তর্করত্ন লিখলেন অভিনয়যোগ্য প্রথম বাংলা নাটক ‘কুলীন কুলসর্বস্ব’-
অভিনীত হল ১৮৫৮তে । অভিজাত জমিদারবাবুরা তাদের গৃহপ্রাঙ্গণে নাট্যমঞ্চ
প্রতিষ্ঠা করলেন। সেইসব অভিনয়ে সাধারণ মানুষের অবাধ প্রবেশাধিকার
থাকত না। বাংলা নাটক বন্দী হল জমিদারবাবুদের প্রাঙ্গণে। সেখান
থেকে বাংলা নাটক উদ্ধার পেল ১৮৭২-এর ৬ই ডিসেম্বর বাঙালির প্রথম
সাধারণ রঙ্গালয় ন্যাশানাল থিয়েটারের প্রতিষ্ঠা ও ‘নীলদর্পণ’ নাটকের
মঞ্চায়নের মধ্য দিয়ে। লেবেডফের ‘বেঙ্গলি থিয়েটারে’র পর বাঙালি
প্রতিষ্ঠিত প্রথম প্রসেনিয়াম থিয়েটার হল প্রসন্ন কুমার ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত
‘হিন্দু থিয়েটার’ ।
বাঙালির সেই প্রথম নাট্যাভিনয় - লেবেডফের নাটকের সংলাপের গদ্যভাষা
খুব প্রাঞ্জল ছিল না, থাকার কথাও নয়। কারণ লিখিত বাংলা গদ্যের
আবির্ভাব হয়েছিল আরো বেশ কয়েক বছর পরে। বাংলা গদ্যের জনক রামমোহন
রায় তখন ২৩ বছরের তরুণ, গদ্য লেখা শুরু করেননি, কলকাতাতেও আসেননি
। ১৮০০সনে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠার পর কেরি সাহেবের উদ্যোগে
অল্প-সল্প পাঠ্য গদ্য লেখা শুরু হয়। সুতরাং ১৭৯৫ সনে লেবেডফের
সামনে নাটক তো বটেই বাংলা গদ্যেরও কোন আদর্শ ছিল না। গবেষকদের
অনুমান মৌখিক কথ্যভাষা মুখে মুখে শুনে আয়ত্ত করেছিলেন লেবেডফ এবং
তাঁর নাটকে লোকের মুখের ভাষাই গ্রহণ করেছিলেন। নাট্য ঐতিহাসিক
ডঃ অজিতকুমার ঘোষ মন্তব্য করেছেন “প্রসেনিয়াম থিয়েটারের সংলাপাশ্রিত
ক্রিয়া প্রধান, সুসংবদ্ধ কাহিনিযুক্ত নাটকের প্রথম নিদর্শনরূপে
নাটকটির মূল্য রয়েছে। ......বাস্তবধর্মী গদ্য নাট্য সংলাপের ভাষার
নিদর্শনরূপে এই নাটকের ভাষার যেমন গুরুত্ব রয়েছে, তেমনি তখনকার
ভাষায় কী ধরনের শব্দ ও বাগ্বিধির প্রয়োগ হত তারও নিদর্শনরূপে এর
গুরুত্ব কম নয়”। ... লেবেডফ তাঁর বন্ধুকে পত্রে জানিয়েছিলেন “দর্শকবৃন্দ
অকপটভাবে ইহাতে পরিতৃপ্তি পাইয়াছিল, কেবল কর্মিবৃন্দই বুঝিতে পারিয়াছিল
যে হিন্দুস্থানী ভাষার শিক্ষকগণ ও অনুবাদকগণ আমার উপর ক্রুদ্ধ
হইয়াছিলেন”।
লেবেডফ
|
সেকালের ইংরাজ সহায়ক সম্ভ্রান্ত শ্রেণীটি, সমাজপতিরা লেবেডফ ও
বাঙালির সেই প্রথম নাট্যাভিনয়ের প্রতি মোটেই সুপ্রসন্ন ছিলেন না।
কেন না, থিয়েটার ও নাট্যাভিনয় তখন ছিল তাঁদের বিধানে নিষিদ্ধ বস্তু।
শেষ পর্যন্ত ইংরেজরা তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে লেবেডফের থিয়েটারে
আগুন ধরিয়ে ধ্বংস করে দেয়। দেনায় জড়িয়ে লেবেডফকে দেউলিয়া ঘোষণা
করে দেশ থেকে বিতাড়িত করে ১৭৯৭ সনে। তাতে ইতিহাসকে আর কী করে মোছা
যায়? ইতিহাস তার শরীরে সমাজ বিকাশের সব বৃত্তান্তই ধরে রাখে। বিদেশী
যুবক গেরেসিম লেবেডফ তাই জড়িয়ে আছেন বাংলা নাট্যসংস্কৃতির পিতৃপুরুষরূপে।
স্মরণীয় হয়ে আছে ২৭শে নভেম্বর ১৭৯৫-এর দিনটি ।
আমাদের নাট্য-ইতিহাসে আর একটি স্মরণীয় দিন হল ৭ই ডিসেম্বর ১৮৭২,
যে দিন সাধারণ মানুষের কাছে রঙ্গালয়ের দ্বার উন্মুক্ত হয়ে গিয়েছিল,
যে দিনটিতে পথ চলা শুরু করেছিল আমাদের সাধারণ নাট্যশালা, আর যে
ধারাবাহিকতা আজও প্রবহমান নানা ভাঙ্গা-গড়ার মধ্য দিয়েও।
হঠাৎ একদিন সাধারণ রঙ্গালয় গড়ে ওঠেনি, পেছনে আছে তার বিবর্তনের
দীর্ঘ ইতিহাস। ইংরাজরা সহ্য করতে পারলো না লেবেডফের থিয়েটারকে।
সেকালের সমভ্রান্ত বিত্তশালীরাও লেবেডফের প্রতি বা তার থিয়েটারের
প্রতি সুপ্রসন্ন ছিলেন না। সাধারণ অনভিজাত লোক বিনোদনের আনন্দতে
ভাগ বসাবে – এটা তাদের ‘না-পসন্দ’ ছিল। এর পর ১৮৩১ সনের আগে বাঙালির
আর কোন নাট্য প্রয়াস বা উদ্যোগ ছিল না।
লেবেডফ পরবর্তী পঞ্চাশ বছরে শিক্ষিত বাঙালীর মননে, সৃজনে যুগান্তকারী
বদল ঘটে গেছে। ইতিমধ্যে ১৮১৭ সনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে হিন্দু কলেজ,
১৮১৫তে রামমোহন রায় কলকাতায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেছেন, বাংলা
সংবাদ পত্রিকার প্রকাশনা শুরু হয়েছে ১৮১৮ সন থেকে, শুরু হয়েছে
পুস্তক প্রকাশনা। ১৮২৬-এ হেনরী ভিভিয়ান ডিরোজিও হিন্দু কলেজে শিক্ষকতায়
এসেছেন, ১৮২৯শে প্রবর্তিত হয়েছে সতীদাহ নিবারণ আইন। ১৮৩০-এ বিদ্যাসাগর
বীরসিংহ গ্রাম থেকে এসেছেন কলকাতার বড়বাজারে রাইমণি দেবীর বাড়িতে,
তিনি তখন ১০ বছরের বালক। ইউরোপীয় শিক্ষায় শিক্ষিত বাঙালির জীবনে
লেগেছে দোলা। অন্যদিকে, ইংরাজদের লঘু রসাত্মক নাট্যাভিনয় দেখে
বাঙালি বিত্তশালী বাবুরাও নতুন ধরনের আমোদের সন্ধান পেলেন। দেশীয়
ধারার বিনোদনের পরম্পরা– যাত্রা, কবিগান, আখড়াই তখন তাদের কাছে
ব্রাত্য। ইউরোপীয় ধরণের নাট্যাভিনয়ের জন্য বাবু প্রসন্নকুমার ঠাকুর
তাঁর গৃহপ্রাঙ্গণে প্রপ্তিষ্ঠা করেন ‘হিন্দু থিয়েটার’। তখনও কোন
মৌলিক বাংলা নাটক লেখা হয়নি, সে আগ্রহও প্রসন্নকুমার ঠাকুরদের
ছিল না। তাদের হিন্দু থিয়েটারে অভিনীত হয়েছিল ইংরাজী নাটক। এই
সঙ্গেই শুরু হয় বিত্তশালী জমিদার বাবুদের গৃহপ্রাঙ্গণে বা বাগানবাড়িতে
নাটক ও নাট্যাভিনয়ের বন্দীত্ব। সেই থিয়েটারে অনভিজাত সাধারণ মানুষের
প্রবেশাধিকার থাকতো না। ইংরাজি ভাষায়, কিংবা সংস্কৃত নাটকের অনুবাদ
নাট্যাভিনয় হত। বাংলার সমাজজীবনের কোন প্রতিফলন যেমন থাকত না সেইসব
নাটকে, তেমনই সাহিত্যগুনান্বিত মৌলিক বাংলা নাটকও লেখা হত না।
১৮৫৮-এ বাংলার নাট্যক্ষেত্রে প্রবল আবির্ভাব হল মধুসূদন দত্তর,
‘শর্মিষ্ঠা’ নাট্য রচনার মধ্য দিয়ে। মহারাজা যতীন্দ্রমোহন সিংহর
বেলগাছিয়া নাট্যশালায় অভিনীত হ’ল ১৮৫৯-এ। এলেন দীনবন্ধু মিত্র,
১৮৬০-এ লিখলেন ‘নীলদর্পণ’ ।
অর্ধেন্দু শেখর মুস্তাফি
|
১৮৬৮-তে প্রতিষ্ঠিত হল বাগবাজার অ্যামেচার থিয়েটার। এই সংগঠনের
মধ্যেই নিহিত ছিল বাঙালির সাধারণ নাট্যশালা গঠনের বীজ। বাগবাজারের
কিছু উৎসাহী যুবক– অর্ধেন্দু শেখর মুস্তাফি, রাধামাধব কর, নগেন্দ্রলাল
বন্দ্যোপাধ্যায়, গিরিশচন্দ্র ঘোষ প্রমুখ নাট্যদল গঠন করে অভিনয়
করলেন দীনবন্ধু মিত্রর ‘সধবার একাদশী’। ১৮৭২-এর ১১ই মে তাদের দ্বিতীয়
নাটক ‘লীলাবতী’ অভিনীত হয় এবং আশাতীত সাফল্য লাভ করে। লীলাবতীর
সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে নিয়মিত নাট্যাভিনয়ের লক্ষ্যে একটি ‘সাধারণ
নাট্যশালা’ প্রতিষ্ঠার কল্পনা করেন তাঁরা, যেখানে বিত্তশালীদের
কৃপাপ্রার্থী না হয়ে টিকিট বিক্রয় করে সর্বসাধারণকে নাট্যাভিনয়ের
প্রতি আকর্ষণ করা যাবে।
অর্ধেন্দুশেখর, অমৃতলাল বসুদের কল্পনা বাস্তবায়িত হল - প্রতিষ্ঠিত
হল আমাদের সাধারণ রঙ্গালয়। চিৎপুরে মধুসূদন সান্যালের গৃহপ্রাঙ্গণ
৩০টাকায় ভাড়া নিয়ে মঞ্চ নির্মাণ করে প্রতিষ্ঠিত হল ‘ন্যাশানাল
থিয়েটার’। ১৮৭২ সনের ৭ই ডিসেম্বর দ্বারোদ্ঘাটন হল বাংলার সাধারণ
নাট্যালয় দীনবন্ধু মিত্রর নাটক ‘নীলদর্পণ’ অভিনয়ের মধ্য দিয়ে।
খুব মসৃণভাবে যে এটা হয়েছিল, তা নয়। টিকিট বিক্রয় করে ন্যাশানাল
থিয়েটার প্রতিষ্ঠার প্রবল বিরোধিতা করে গিরিশচন্দ্র ঘোষ এই উদ্যোগ
থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে দলত্যাগ করেছিলেন, এমনকি ছদ্ম নামে সংবাদপত্রে
এই উদ্যোগের নিন্দাবাদও করেছিলেন। গিরিশচন্দ্র নিজেই লিখেছেন ...
“সাধারণের সন্মুখে টিকিট বিক্রয় করিয়া অভিনয় করা আমার অমত ছিল।
...কয়েকজন গৃহস্থ যুবা একত্র হইয়া ক্ষুদ্র সরঞ্জামে ন্যাশানাল
থিয়েটার করিতেছে, ইহা বিসদৃশ জ্ঞান হইল। এই মতভেদ” (বঙ্গীয় নাট্যশালা
– ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়) । টিকিটের মূল্য ছিল – প্রথম
শ্রেনিতে একটাকা আর দ্বিতীয় শ্রেণীতে আট আনা। প্রথম অভিনয়ের টিকিট
বিক্রয় হয়েছিল চারশো টাকার। ‘নীলদর্পণ’ অভিনয় তখনকার সমাজে কীভাবে
আলোড়িত করেছিল তা এখানে আলোচ্য নয়। সাধারণ রঙ্গালয় প্রতিষ্ঠার
উদ্যোগ প্রসংশিত হয়েছিল। ১২ই জানুয়ারী ১৮৭২, অমৃতবাজার পত্রিকা
লিখেছিল ..... “নীলদর্পণের অভিনেতৃগণ সমাজবদ্ধ হইয়া এই অভিনয়কর্ম
সম্পাদন করিতেছেন। তাঁহারা টিকিট বিক্রয় করিতেছেন ও সেই অর্থে
অভিনয়সমাজের উন্নতি ও পুষ্টিসাধন করিবেন মানস করিয়াছেন। আমরা একান্ত
মনে তাঁহাদের মঙ্গল প্রার্থনা করিতেছি”...।
সেই শুরু আমাদের পেশাদারী মঞ্চ ও মঞ্চাভিনয়ের। নানা ভাঙা-গড়া,উথ্বান-পতন,
শাসকের রক্তচক্ষু, বিরোধ-মিলনের সাক্ষী হয়ে, অর্ধেন্দুশেখর- অমৃতলাল
- গিরিশচন্দ্র –অমরেন্দ্রনাথ দত্ত- বিনোদিনী- তারাসুন্দরী-প্রভা
দেবী - শিশির ভাদুড়ি হয়ে যে ধারাবাহিকতা আজও বহমান। মধুসূদন দত্ত,
দীনবন্ধু মিত্র, ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়,
মন্মথ রায়, বিধায়ক ভট্টাচার্য প্রমুখ কত নাট্যকার সমৃদ্ধ করেছেন
আমাদের নাট্য ইতিহাসকে গত দেড়শো বছরে! শুরুটা হয়েছিল ১৮৭২-এর ৭ই
ডিসেম্বর ।
প্রাক-স্বাধীনতা কালে আমাদের নাট্য ঐতিহ্যে আর একটি যুগান্তকারী
বাঁক এসেছিল ১৯৪৪-এ। বিশ শতকের চল্লিশের দশকে মাঝামাঝি পেশাদারী
মঞ্চে শুরু হয় ক্ষয়ের কাল। অর্ধেন্দুশেখর-গিরিশ-অমরেন্দ্র যুগের
শেষ প্রতিনিধি শিশিরকুমার ভাদুড়ি তখন পেশাদারী মঞ্চের ‘নিঃসঙ্গ
সম্রাট’। ১৯৪০এর দশকটা ছিল এক উত্তাল সময়। দ্বিতীয় সাম্রাজ্যবাদী
যুদ্ধ শুরু হয়েছে ১৯৩৯-এ। যুদ্ধের অনিবার্য পরোক্ষ ফল নিষ্প্রদীপ
বাংলায় কালোবাজারি, মজুতদারি আর সাধারণ মানুষের হতাশা, বেকারি,
দারিদ্র, মনুষ্যত্বের লাঞ্ছনা। বিয়াল্লিশে স্বাধীনতা সংগ্রামের
চূড়ান্ত পর্যায় ভারত ছাড়ো আন্দোলন শুরু হয়েছে । ১৯৪৩-এ দেখা দিল
মানুষের তৈরি ভয়ঙ্কর মন্বন্তর। কলকাতার রাস্তায় একটু ফ্যানের জন্য
মৃত্যুমুখী মানুষের হাহাকার। পঁয়ত্রিশ লক্ষ মানুষের মৃত্যু ঘটেছিল
এই ভয়ঙ্কর মন্বন্তরে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রের এই সমস্ত
সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কার্যকারণে গড়ে উঠেছিল গণনাট্য
সঙ্ঘ। লক্ষ লক্ষ মৃত্যু আর সামাজিক অবক্ষয়ের যন্ত্রণার গভীর থেকে
জন্ম নিল এক এক সৃজনশীল সাংস্কৃতিক সংগ্রাম আর সেই সংগ্রামের অভিঘাতে
জন্ম নিল এক নতুনতর নাট্যধারা,বলা ভালো নাট্য আন্দোলন – গণনাট্য
আন্দোলন, ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের নেতৃত্বে। এই নতুনতর নাট্যধারার
প্রথম পুরোহিত বিজন ভট্টাচার্য এলেন তাঁর ‘নবান্ন’ নাটকের মধ্য
দিয়ে। বাংলা থিয়েটারে সে এক ক্রান্তিলগ্ন। গণনাট্য সঙ্ঘের প্রযোজনায়
বিজন ভট্টাচার্য ও শম্ভু মিত্রর যৌথ পরিচালনায় নাটকটি শ্রীরঙ্গম
মঞ্চে অভিনীত হয় ১৯৪৪এর ২৪শে সেপ্টেম্বর। পূর্ববর্তী একশ’ বছরের
সনাতনী নাট্য ও মঞ্চের প্রয়োগভাবনার ওলট পালট ঘটিয়ে ‘নবান্ন’ হয়ে
গেল বাংলা নাটক ও মঞ্চের এক মাইলফলক। আজও অসংখ্য গ্রুপ থিয়েটার
সেই ধারারই উত্তরাধিকার বহন করে চলেছে। ‘নবান্ন’র নাট্যনির্মাণ
এনেছিল নতুনতর নাট্যভাষা। সনাতনী ‘শিল্পের জন্য শিল্প’-অনুগত সাহিত্যভাবনা
পরিবর্তিত হয়ে গেল নতুনতর স্লোগানে – ‘শিল্প হবে মানুষের জন্য’।
বিজন ভট্টাচার্যর কথায় “যে মানুষেরা রাস্তায় দুর্ভিক্ষের মড়া দেখে
মুখ ফিরিয়ে গেছে, ‘নবান্ন’ নাটক দেখিয়ে সেই মানুষদের চোখে আমরা
জল ঝরাতে পেরেছি - এটা ছিল আমাদের কৃতিত্ব” ।
এ জিনিস বাংলা নাট্যমঞ্চে আগে কখনও হয়নি। সেই উত্তাল সময়েও পেশাদারী
থিয়েটারে বেশিরভাগ নাটকের কাহিনী ছিল প্রধানত পুরাণ, ইতিহাস, দেব-দেবী
নির্ভর কাহিনী কিংবা মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত মানুষের মোটা দাগের
গল্প। মাটির কাছাকাছি থাকা জনজীবনের কাহিনী প্রতিফলিত হ’ত না কোন
নাটকেই। পীড়িত মানুষ যখন খাদ্যের জন্য হাহাকার করছে তখন পেশাদারী
থিয়েটারে অভিনীত হচ্ছে ‘সীতা’, ‘আলমগীর’, ‘মিশরকুমারী’র মত নাটক।
এই নাট্যভাবনাকে চুরমার করে বিজন ভট্টাচার্য মঞ্চে নিয়ে এলেন শ্রমজীবি
মানুষদের। আজকের প্রবহমান বাংলা থিয়েটার মূলত এই নাট্যধারাকেই
বহন করে চলেছে।
স্বাধীনতা-উত্তর সময়কালে পঞ্চাশের দশকে শম্ভূ মিত্র-র বহুরূপী
আমাদের নাটকের রবীন্দ্রনাথকে চেনালেন, পঞ্চাশের দশকে উৎপল দত্তর
প্রবল উপস্থিতি তাঁর লিটল থিয়েটার গ্রুপের ‘অঙ্গার’ নাটকের মধ্য
দিয়ে, ষাটে এলেন অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়। পঞ্চাশের দশক থেকে উঠে
এল অসংখ্য গ্রুপ থিয়েটার। বাংলা থিয়েটারে যেন বিস্ফোরন ঘটে গেল!
সেই প্রসঙ্গ বা স্বাধীনতা-উত্তর বাংলা থিয়েটার আমার আলোচ্য নয়।
আমি ফিরে দেখলাম, বুঝতে চাইলাম বাংলা থিয়েটারের উদ্ভব ও পথচলার
কয়েকটি পর্ব - সমকালীন সমাজ ও সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে ।
লেখক পরিচিতি - প্রবীণ সাহিত্যকর্মী। বাংলা
গদ্যসাহিত্যে তাঁর অবাধ বিচরণ। মূলত প্রাবন্ধিক। ছোট গল্প ও নাটকও
লেখেন। বিভিন্ন অন্তর্জাল ও মুদ্রিত পত্রিকায় তাঁর বহু মননশীল
প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। আঠেরো ও উনিশ শতকের বাংলার সামাজিক ইতিহাস
ও বিবর্তন তাঁর বিশেষ আগ্রহের যায়গা। প্রায় চুয়াত্তর পেরনো বয়সে
দুটি অন্তর্জাল পত্রিকা – ‘অন্যনিষাদ’ ও ‘গল্পগুচ্ছ’ প্রকাশ করে
চলেছেন গত পাঁচ বছর ধরে ।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।