প্রথম পাতা

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

নারী

নভেম্বর ৩০, ২০১৬

 

রক্তের অক্ষরে কতকাল লেখা হবে ‘তাহাদের’ কথা

নাহার তৃণা


নারীর মন নাকি পুরুষের শত সাধনার ধন। সাধনায় বাঁধা পড়া এ মনের অধিকারীর দেহলতা পুরুষের আরাধ্য হয়ত, কিন্তু সেভাবে কামনা চরিতার্থের বস্তু নাও হতে পারে। অর্থাৎ পুরুষ বিকৃতির পথে না হেঁটে সৎভাবে সেটা কামনা করতে পারেন। কিন্তু নারী শব্দের আগে যদি ‘পতিতা’ শব্দটা জুড়ে বসে? ছিটকে সরে যায় যেন সাধনার একাগ্রতা। সহজলভ্যতা আর বিকৃত আকাঙ্ক্ষায় অনেক পুরুষ তখন এই বিশেষ নারীর দেহ ভোগে পেতে চান। এরা তখন মনহীন, কেবল শরীরসর্বস্ব সত্তা। এদের নিয়ে মৌজ মাস্তি কিংবা হাস্যরস চলতে পারে, কিন্তু ভদ্রবাড়ির চৌহদ্দি বা সামাজিক পরিমণ্ডলে এদের প্রবেশ নিষেধ। এদের নিয়ে প্রকাশ্য আলোচনা মানেই সমাজের কাছে সম্ভ্রান্ত বলে পরিচিত পুরুষের ইজ্জতের ফালুদা! যদিও এদের অনেকেই খুব গোপনে বিশেষ পাড়ায় গিয়ে নিজেদের বাসনা পূরণে সিদ্ধ পুরুষ। কিন্তু প্রকাশের হ্যাপায় পড়ে সামাজিক হেনস্থার হুড়ো খেতে রাজী নন। তবে এক সময় এমন নারীকে নিজের হারেমে রাখাটা ছিল পুরুষের জন্য রীতিমত গৌরবজনক, সামাজিক কৌলিন্যের চিহ্নস্বরূপ। প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, নারীকে এ পথে আসতে বাধ্য হতে হয় কেন? এভাবে নারীকে ভোগ্যপণ্যের মত ব্যবহারের রীতি রেওয়াজ সব সমাজে সব সময়েই কি প্রচলিত ছিল? এক কথায় এর উত্তর কঠিন। আলোচনার সুবিধার্থে এখানে পঠিত কিছু বইয়ের সূত্র ধরে এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করবো।

বিশিষ্ট লেখিকা সেলিনা হোসেন এবং মাসুদুজ্জামান সম্পাদিত, মুজিব মেহেদীর ‘নারীপণ্য’: জেণ্ডারকোষ থেকে জানতে পারি, একটা সময় ছিল যখন নারী এবং পুরুষ দুটি ভিন্ন সত্তা পারস্পরিক সমঝোতায় স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করতো। জীবন ধারণের জন্য তারা মিলিতভাবে খাদ্য সংগ্রহের কাজে করতো, সেখানে শ্রেণিভেদের বালাই ছিল না। ছিল স্বাধীনভাবে তা ভোগের অনুমোদন। ক্রমশ: যখন উৎপাদনের কলাকৌশল গুলো পুরুষকেন্দ্রিক হতে শুরু করে নারী পুরুষের মাঝে শ্রেণিভেদের দেয়াল মাথা তুলে দাঁড়ায়। শুরু হয়ে যায় সামাজিক শ্রম বিভাজন আর উৎপাদিত দ্রব্য পরিচিতি পায় পণ্য হিসেবে।

আজ অবধি উৎপাদিত দ্রব্য পণ্য বা কমোডিটি বলেই চিহ্নিত হয়ে আসছে। সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে পণ্যদ্রব্য কেবল ‘প্রত্যক্ষভাবে সামাজিক প্রয়োজন মেটানো’ হলেও ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সেটা মুনাফার দিকে হেলে পড়া । এ অর্থব্যবস্থায় শ্রমশক্তির উৎপাদনই কেবল পণ্যদ্রব্য পদবাচ্য নয়, এমনকি শ্রমশক্তিও সেখানে পণ্যদ্রব্য। এই সংজ্ঞাভাষ্যের সীমাকেও অতিক্রম করে নারী যখন বাধ্য হয়ে বা স্বেচ্ছায় ভোগ্যা হিসেবে নিজের মহিমা থেকে অবনত, তখন গোটা নারীমানুষটিই পরিণত হয় পণ্যে। এখানে সে শ্রম দিয়েও প্রচলিত অর্থে শ্রমশক্তি হিসেবে স্বীকৃত হয় না, হয় ভোগ্যবস্তুরূপে।(১)

শ্রী পান্থ রচিত "পড়ার বইয়ের বাইরের পড়া" বইটির দ্বাদশ অধ্যায়ের কিছুটা এ প্রসঙ্গে আওড়ে নেয়াটা খুব একটা অপ্রাসঙ্গিক হবে না ভেবে এখানে উল্লেখ করছি,

প্রাচীনযুগে নারী সামান্য নারী নন, দেবী। বৃক্ষের মতোই প্রাকৃতিক এক অস্তিত্ব। তিনি রহস্যময়। তিনি সৃষ্টির আদি, মানবের ধাত্রী। তাঁর বুকে জীবনদায়ী অমৃতধারার উৎস। স্বভাবতই তাঁর স্তন পবিত্র এবং পূজ্য। প্রাচীন পৃথিবীর নারীর স্তন সম্ভ্রম ও শ্রদ্ধার উপলক্ষ। সেকারণে তার এ অঙ্গটিকে কামের বস্তু হিসাবে না দেখে দেখা হয়েছে পূজিত শ্রদ্ধার বস্তু হিসাবে। লৌহযুগে পবিত্র পানপাত্র গড়া হয়েছে স্তনের আদলে। একালে অবশ্য হলিউডে একই বস্তু কখনও কখনও দেখা যায় যৌনতার প্রতীক হিসেবে, পুরুষের কামনার বার্তাবহ তৈজস হিসাবে। নারী যতদিন পূজার বেদিতে অধিষ্ঠিত ছিলেন ততদিন তাঁর অবস্থান ছিল শ্রদ্ধার। কিন্তু পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটে নারীকে স্থান চ্যুত করে বেদিতে পুরুষ দেবতাদের অধিষ্ঠানের পর।(২)

দেখা যাচ্ছে নারীর শুধু ক্রমশ: স্থানচ্যুতিই ঘটে না, মানুষ হিসেবে তার স্বাধীন সত্তাটিও হুমকির মুখে পড়ে। যে নারী ছিলেন শক্তির, শ্রদ্ধার অস্তিত্ব,কালক্রমে তার পরিচিতি হয় ভোগ্যপণ্য (অনেকাংশে) আর পুরুষ হন তার ভোক্তা। বিশ্বায়নের এই যুগে অর্থনীতির মূল মনোযোগ মুনাফা, আর সে কারণেই পৃথিবীতে মুনাফালোভীর দল একমুখে 'যুদ্ধ নয় শান্তি চাই' যেমন বলে একই সাথে অস্ত্র বিক্রির বাজার সচল রাখতে সক্রিয় থাকে। একইভাবে 'নারী পণ্য নয় মানুষ' এহেন গালভরা স্লোগান ছড়াবার আড়ালে নারীকে পণ্য হিসেবে বাজার তৈরি এবং তা টিকিয়ে রাখতে পৃথিবী জুড়ে সর্বোচ্চ নেটওয়ার্ক চালু রাখার ব্যবস্থায় তৎপর থাকে। দুঃখজনক হলেও সত্যি, অনেক নারীই পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোর ধ্যানধারণা সম্পন্ন এই প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত।। এসব কারণে সভ্যতার এতটা পথ উজিয়ে এসেও এই পৃথিবীর ভেতরেই অন্য আরেকটা নরকসম পৃথিবী টিকে থাকে যুগের পর যুগ। মনে প্রশ্ন জাগে সেই পৃথিবীতে যাতায়াতকারী নিজেদের বিকৃত প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা ভোক্তাসকল বেশি অসহায়, নাকি যারা কিছু টাকার বিনিময়ে শরীর বিকোতে বাধ্য হচ্ছেন তারা বেশি অসহায়?

"কত রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়েছে এই পৃথিবীতে। সে যুদ্ধ সম্পদ কীর্তি আর অধিকার সম্প্রসারণের জন্য, হিংসায় উন্মত্তার জন্য। পৃথিবীর জ্ঞানী বিবেক এখন যুদ্ধ করে ব্যাধি, অপুষ্টি, অনাহার, দারিদ্র আর নিরক্ষরতার বিরুদ্ধে। আরেকটি যুদ্ধে তো অবতীর্ণ হতে পারে সভ্যতা গর্বিত আমাদের এই আধুনিক পৃথিবী। যুদ্ধ ঘোষণা করুক না সে, মানবিকতার 'ফ্রন্ট লাইনে দাঁড়িয়ে!' যুদ্ধ করুক অভিশপ্ত পেশায় শৃঙ্খলিত পৃথিবী জোড়া নারীকে অন্ধকারের ঘৃণ্য জীবন থেকে মুক্ত করার জন্য। যুদ্ধ হোক তাদের প্রাপ্য মানবাধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য। পৃথিবী কি ভুলে গেছে তারাও মানুষ?" (৩)

রিজিয়া রহমানের "রক্তের অক্ষর" উপন্যাসে এমন প্রশ্নের উত্তরটা মর্মান্তিকভাবে না বোধকেই আটকে ছিল,আছে, যুগের পর যুগ। পৃথিবীর আদিমতম পেশার ছদ্মবেশে এ তো আসলে নারীর উপর পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নির্মম যৌন নিপীড়ন। যা কালের বিচারে লোপাট হওয়া তো দূরের কথা, বরং তা আরও বেশি আধুনিক এবং আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কিংয়ের মাধ্যমে সবচেয়ে দ্রুত প্রসারিত এবং লাভজনক ব্যবসা হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। এই ব্যবসার পেছনে শত শত লাভের গুড় খাওয়া পিঁপড়ে পিলপিল করে। যাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার বিষয়টা সোনার পাথরবাটির মতো গালগল্পের। তবে চেষ্টা যে চলেনি তা না। সে চেষ্টা সমুদ্রে শিশির বিন্দুর মতো মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর পর্বে লীগ অব নেশন (LON) প্রায় উঠে পড়ে লেগেছিল এই বৃত্তি বন্ধ করার জন্য। LON এর ক্ষেত্রে কয়েকটি সামাজিক ঘটনা বিশেষভাবে উৎসাহ-উদ্দীপক ছিল যথা, রাশিয়ায় নভেম্বর বিপ্লব। সোভিয়েত রাশিয়ার পত্তন ও সোভিয়েত পতিতাবৃত্তি বন্ধের আন্তরিক প্রয়াস। এলা উইন্টার(Ela Winter) লিখিত 'Red Virtue' বইটি থেকে জানা যায় যে মহান নভেম্বর বিপ্লবের পর পরই চেষ্টা শুরু হয় কীভাবে এই বৃত্তি থেকে পতিতাদের সরিয়ে আনা যায়। সংকল্প অনুযায়ী স্থির হয় এদের সবাইকে উৎপাদনশীল কর্মে নিযুক্ত করা হবে যাতে সারাদিনের পরিশ্রমের পর তারা আর অবাধ যৌনসংগমের কথা ভাবতে না পারে। কিন্তু কিছুদিনের পরীক্ষার পর দেখা গেল যে দীর্ঘদিনের অভ্যাসবশত: ঐ একদা-পতিতার দল দিনের কাজের শেষে সন্ধ্যের নিরিবিলিতে আবার ‘যৌন খদ্দের’ সংগ্রহে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে। তদানীন্তন সোভিয়েত সরকার অবিলম্বে তাদের logistics বা কৌশল বদল করে ফেললেন। এদের কাজের সময় নির্দিষ্ট হল সন্ধ্যা থেকে ভোর অবধি। অর্থাৎ অন্য কর্মীদের ক্ষেত্রে যে সময় দিন, এদের পক্ষে তা হল রাত এবং তাদের রাত এদের দিনে বর্তালো। বহুতর পরীক্ষার মধ্য দিয়ে সোভিয়েত সরকারকে পতিতাবৃত্তি মোকাবেলা করতে হয়েছিল। সোভিয়েত রাশিয়ার এ ধরনের প্রয়াস ইউরোপের দেশগুলির জ্ঞানচক্ষু উন্মীলন করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পর্বে UNO মানুষের সামাজিক ও নৈতিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। তৎপরতা দেখা দেয় কিভাবে সমাজ থেকে এই জঘন্য ও ঘৃণ্য প্রথাটি তুলে দেয়া যেতে পারে তার জন্য বিভিন্ন ধরনের চিন্তাভাবনা ও কার্যক্রম গ্রহণ করে।"(৪)

জাতিসংঘের পতিতাবৃত্তি নিরোধক বিভিন্ন চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী বা স্বাক্ষরে মত না দেয়া দেশ্যগুলিতে আজ পর্যন্ত এই পেশা লোপাটের কোনও আলামত পাওয়া যায়নি। বরং তা বহাল তবিয়তেই আছে। ফ্রান্স এবং সুইডেন এক্ষেত্রে সামান্য ব্যতিক্রম হয়ত। যে সোভিয়েত রাশিয়া একদা এই ঘৃণ্য পেশা বন্ধের জন্য তৎপর হয়েছিল, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে ভেঙে টুকরো হয়ে যাওয়া সে ভূখণ্ডের নানান অংশ থেকে আসা নারীর সংখ্যা এই বৃত্তিতে বেশ বড় একটা অংশ বলে জানা যায়।

শুরুর যে প্রশ্ন সামনে রেখে এই আলোচনাকে টেনে এতদূর আসা, এখন দেখা যাক সে প্রশ্নের উত্তর কতটুকু পাওয়া সম্ভব। পতিতাবৃত্তিকে একটি আদিমতম পেশা বলা হয়ে থাকে। কিন্তু এটি যতটা পেশা, তারচেয়ে বেশি নিগ্রহ, নির্যাতন, নিপীড়ন বলাই বুঝি বাঞ্ছনীয় হবে। আর সেই নির্যাতন হচ্ছে যৌন নির্যাতন বা নিপীড়ন। ইতিহাস হাতড়ে ''দ্য এপিক অব গিলগামেস বইটির সূত্র থেকে জানা যায় যে খ্রী:পূ: দু'হাজার বছর আগে সুমের, আক্কাদ ও ব্যাবেলনীয় ইতিহাসে Harlat বা বেশ্যার উল্লেখ পাওয়া যায়।" এরা পবিত্র পতিতা হিসেবে সমাজে আখ্যায়িত হতো।(৫)

ইতিহাসের জনক হিরোডেটাস (খ্রিষ্টপূর্ব ৪৮৪ খ্রিষ্টপূর্ব ৪৩০/২০)-এর লেখায় এই পবিত্র পতিতাবৃত্তির বহু নমুনা পাওয়া যায়, যেটি প্রথম শুরু হয়েছিল ব্যাবিলনে। সেখানে প্রত্যেক নারীকে বছরে অন্তত একবার করে যৌনতা, উর্বরতা ও সৌন্দর্যের দেবী আফ্রোদিতির মন্দিরে যেতে হতো এবং সেবাশুশ্রূষার নমুনা হিসেবে একজন বিদেশীর সাথে নামমাত্র মূল্যে যৌনসংগম করতে হতো। একই ধরনের পতিতাবৃত্তির চর্চা হতো সাইপ্রাস, করিন্থ, সার্দিনিয়া এবং কিছু ফিনিশীয় সংস্কৃতিতে ভূমধ্যসাগরের অন্যান্য বন্দর শহরগুলোতে তা সংক্রমিত হয়, যেমন সিসিলি, ক্রটন, রাসানো ভাগলিও, সিক্কা ভেনেরিয়া এবং অন্যান্য শহর।

কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র থেকে পতিতা ও পতিতাবৃত্তি সংক্রান্ত ভারতবর্ষীয় চিত্র পাওয়া যায়। তাঁর জীবৎকাল নিয়ে পণ্ডিতে পণ্ডিতে মতদ্বৈধতা আছে। তবে অনেকের মতে কৌটিল্য বেঁচেছিলেন মৌর্য শাসনামলে। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা অনুযায়ী, তিনি প্রথম মৌর্যসম্রাট চন্দ্রগুপ্তের (খ্রিষ্টপূর্ব ৩২১ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ২৯৭) কাউন্সেলর ও উপদেষ্টা ছিলেন। তাঁর রচিত বিখ্যাত অর্থ শাস্ত্রের মতে, দেহব্যবসা একটি প্রতিষ্ঠিত প্রথা। পুরোপুরি ঘৃণিত বা গোপন নয়। কোনও কোনও ক্ষেত্রে রাষ্ট্র এর অনুমোদন করে এবং সংগঠকের ভূমিকা নেয়। ঋগ্বেদ ও জাতকেও এর অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছেন পণ্ডিতরা। এমনকি কৌটিল্যের সময় দেহব্যবসা শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত হয় বলে জানা যায়, যে শিল্পের নাম ছিল বৈশিক কলা। বিশেষজ্ঞরা এ শিল্পের চর্চা করতেন এবং শিক্ষা দিতেন।

মহাভারতেও গণিকাদের বর্ণময় জীবন ও রাজকীয় জাঁকজমকের বর্ণনা আছে। যেমন উদ্যোগপর্বে কৌরবপক্ষের গণিকাদের কাছে যুধিষ্ঠির শুভেচ্ছাবার্তা পাঠান। কৌরবসভায় শ্রীকৃষ্ণ যখন শান্তির জন্যে দৌত্য করতে আসেন তখন তাঁকে অভ্যর্থনা জানান গণিকারা। রামায়ণে দেখা যায়, রাম ভরতকে জিজ্ঞাসা করছেন যে তিনি গণিকা, ঘোড়া ও হাতির ব্যাপারে সন্তুষ্ট কিনা। জৈন লেখক হেমচন্দ্রের লেখায় একটি কিংবদন্তীর উল্লেখ আছে যে, রাজা নন্দ গণিকার গর্ভজাত এক নাপিতের সন্তান।

পৃথিবীর অনেক দেশ, যাদের প্রধান আয় পর্যটন শিল্প নির্ভর, সেসব দেশে এখনো সরকারি তত্ত্বাবধানেই দেহব্যবসা পরিচালিত হয়। এমনকি বাংলাদেশ আঠারো বছর বয়সোত্তীর্ণ নারীকে দেহব্যবসা চালাবার জন্য লাইসেন্স দিয়ে সারাদেশে ১৪টি পতিতালয় পরিচালনা করে। (৬)

তাহলে এটা স্পষ্ট যে, পয়সার বিনিময়ে যৌনতা কেনা-বেচার রীতি রেওয়াজ বিভিন্ন সময়কালে দেশে দেশে সমাজের মধ্যে বেশ ভালোভাবেই চালু একটা ব্যবস্থা হিসেবে চিহ্নিত ছিল। ব্যভিচারী রমেশেরা নানান চেহারায় কতশত মানদা দেবীকে যে এই অভিশপ্ত অন্ধকার গলির বাসিন্দা হতে প্রলুব্ধ বা বাধ্য করে তার হিসেব কে রাখে! সমাজের চারদিক থেকে প্রত্যাখ্যানের হুল যখন "রক্তের অক্ষর" এর কেন্দ্রীয় চরিত্র '৭১ এর বীরাঙ্গনা খ্যাত ইয়াসমীনকে একজন বারাঙ্গনায় পরিণত করে তখন সভ্য সমাজের দাবীদার প্রতিটা মানুষ কি একটি বারের জন্য লজ্জায় অপমানে জর্জরিত হন না? হতে পারে তা উপন্যাস, কিন্তু এমন ঘটনা লোকচক্ষুর আড়ালে একেবারেই ঘটেনি তা বুকে হাত রেখে আমরা বলার সৎসাহস রাখি কি? মহাভারতে বর্ণিত গণিকাদের মত এদের জীবন জৌলুশময় তো নয়ই বরং এতটাই মানবেতর সে জীবন ধারণ, যে আমাদের কল্পনাতেও হয়ত সেটা আনা কষ্টসাধ্য। দমবন্ধ হয়ে আসা এমন অস্বাস্থ্যকর ঘিনঘিনে পরিবেশে আজো কত মা বোন নিজেকে সাজিয়ে গুছিয়ে পণ্য হিসেবে বিক্রির জন্য গলির মোড়ে মোড়ে দাঁড়াচ্ছেন সে খবর আমাদের অজানাই থেকে যায়। কত কত পিরু তার অপুষ্ট শরীরে মানুষ নামের কিছু পশুর প্রবৃত্তি নেভাতে গিয়ে গ্রামের বাড়ি ফিরে যাবার স্বপ্নটুকু চোখের জলে ভাসান দিয়ে মৃত্যুর কাছে আত্মসমর্পণ করে আজো(সূত্র: রক্তের অক্ষর)।

গোলাপি পট্টির জরাজীর্ণ ভাড়াবাড়ি ধ্বসে যে কোনও সময় যে কারো মৃত্যু ঘটতে পারে এমনটা জানা সত্ত্বেও ধার্মিক বাড়িওয়ালা কাজী সাহেব তাতে তোয়াক্কা করেন না। কারণ তার কাছে এইসব রূপোপজীবিনীরা কুকুর বেড়ালেরও অধম। মাস গেলে ভাড়াটাই তার কাছে মুখ্য। অথচ মুখে বানোয়াট বুলি! কিছু অসহায় মানুষের রক্ত পানি করা টাকায় এইসব কাজী সাহেবদের প্রতিপত্তি বাড়তে থাকে আর ভাঙা দালানের নীচে চাপা পড়ে পিরু, মমতা, পারুলদের সাথে সাথে ওদের স্বপ্নগুলোও চিরদিনের মত হারিয়ে যায় (সূত্র: রক্তের অক্ষর)। তারপরও 'ওরা আমাদের মতই মানুষ' এমন হাস্যকর দাবী তুলে আমরা নিজেদের ভণ্ডামিকে আড়াল করতে গিয়ে আরও প্রকট করে ফেলি।

এতসব লাঞ্ছনা গঞ্জনা ভুলে একজন মানদা দেবী সমাজের আর দশটা মেয়ে যেন এপথে না আসে সে বিষয়ে সাবধান করতে যখন "শিক্ষিতা পতিতার আত্মচরিত" লিখতে বসেন, তখন অনেক সমাজপতিদের মধ্যে সেই পুরুষতান্ত্রিকতার দাবিয়ে রাখবার ভাবনাটা রব তোলে গেলো, গেলো, বলে। সমাজের এইসব পুরুষদের ভাবখানা এমন যে এসব নিয়ে পতিতা আবার লিখবে কেন? এমন মানসিক দীনতার কারণে একজন বিনোদিনী দাসী লিখিত বাংলাদেশের পেশাদার রঙ্গালয়ের ইতিহাসের মূল্যবান দলিলকে অগ্রাহ্য করা যায়। চরম অবহেলা করা যায় তার কাব্য প্রতিভা, সাবলীল সাহিত্য রচনার স্মৃতিটুকুও। এমন পরিস্থিতির মুখে মানদা দেবীর সাহসী উচ্চারণ ভেকধারী মানুষদের আদৌও স্পর্শ করে না যেন।

নারী সম্বন্ধে পুরুষের নানা প্রকার হীন ধারণার জন্যই নারী আজ বিশ্বে সমানাধিকার দাবী না করিয়া পারিতেছেন না। যদি তাঁহারা কেবল ইহাই ভাবিয়া থাকেন যে পতিতার কি বই লিখিবার ক্ষমতা আছে? ইহার উত্তরে বলা যাইতে পারে যে, পতিতগণ যদি বই লিখিতে বা পত্রিকা সম্পাদনা করিতে পারেন, তবে পতিতাগণ পারিবে না কেন? (৭)

'মানুষের মধ্যে পাপ থাকে না। পরিবেশ পাপ ছড়ায়' ইয়াসমীনের এমন বক্তব্যকে সত্যি করতে আমরা কি পারিনা সমাজ থেকে এমন অস্বাস্থ্যকর পরিবেশকে দূর করতে? কেন একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এমন একটি পেশাকে বৈধতা দিয়ে আদতে নারী নির্যাতনকেই বৈধতা দেবার মত হঠকারিতা করে? গণতন্ত্রের একটি প্রধানতম শর্ত হচ্ছে মানবাধিকার নিশ্চিত করা। নরকসম সে পৃথিবীর মানুষগুলোর প্রতি রাষ্ট্র বা সমাজ তেমনটা দেখাতে মর্মান্তিকভাবেই কী ব্যর্থ নয়? এমন রাষ্ট্র কেবল সুবিধাভোগীদের জন্য গণতান্ত্রিক, সবার জন্য নয়। শরীর বিক্রি ছাড়াও এসব হতভাগ্য মানুষগুলো আরও অনেক কাজে পারদর্শিতা দেখাতে সক্ষম; কিংবা বিশেষ প্রশিক্ষণের সুবিধা পেয়ে সেরকম দক্ষতা দেখাতে সক্ষম এটা বিশ্বাস করি। তাদের সেই সব দিকগুলোকে খুঁজে বের করে স্ব স্ব দক্ষতা অনুযায়ী কাজে নিযুক্ত করলে এবং সুইডেন, ফ্রান্সের অনুকরণে আইন প্রণীত হলে হয়ত একদিন সমাজ থেকে এই জঘন্য,অমানবিক, নির্যাতনমূলক পেশার বিলুপ্তি ঘটবে। পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না রেখে এদের উচ্ছেদে রোগের নিরাময় কখনোই সম্ভব হবে না, বরং তাতে করে সেটা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে।

কোনও এক কুসুম কিংবা জরিনাকে, যখন রাতের অন্ধকারে ঘুমন্ত ফুটপাত থেকে আরও অনেক কিশোরী/যুবতীদের সাথে তুলে এনে বেশ্যাপাড়ার বাসিন্দা বানিয়ে দেয়া হয়, কিংবা অন্য কোনোভাবে তাকে বাধ্য করা হয় এ পথে আসতে, তখন তার জন্য কুসুম- জরিনারা কতটুকু দায়ী থাকে? এ প্রশ্নের উত্তর যে আধুনিক সভ্য সমাজ কিংবা রাষ্ট্রের কাছে নেই সে ঠিক কোন মাপকাঠিতে আধুনিক কিংবা সভ্য! তথাকথিত 'খারাপ পাড়া'র মেয়েরা যে শুধুই মাংসপিণ্ড বা পুরুষের বিকৃত আনন্দের সঙ্গী না, তারাও ঐসব পুরুষদের ঘরে থাকা মা-বউ বোনদের মতই মানুষ, একজন মানুষের সবটুকু অধিকার তাদেরও পাওনা। এসব রূঢ় সত্যকথনে যাতে তারা বিগড়ে না যায়, তাই তাদের একটা বিকৃত লালসাময় ঘেরাটোপের মধ্যে রাখা হয় সারাক্ষণ। আর এধরনের ভয় থেকে এ ধান্ধার কলকাঠি নাড়ানেওয়ালারা সে অনুযায়ী ব্যবস্থাও নিয়ে থাকে। এক্ষেত্রে হিরু গুণ্ডা, কাঞ্চন গুণ্ডা, মাসী বা মানদা দেবীর শিক্ষিত উকিলবাবু থেকে শুরু করে এর সাথে জড়িত সবাই একাট্টা। লাভের গুড় খাওয়া এসব পিঁপড়েদের চক্রব্যূহ যতদিন থাকবে ততদিন 'ম্যান ইজ বর্ন ফ্রী, বাট হি ইজ এভরিহোয়ার ইন চেইন' কথাটা রক্তের অক্ষরে লিখে যেতে থাকবে ইয়াসমীন, কুসুম, পরী, ও আরও অনেকে। অন্যদিকে আধুনিক সভ্যতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তাকে ‘পৃথিবীর আদিমতম পেশা’ বলে পাশ কাটানোর তামাশা মুখ বুজে সরে যাবে রাষ্ট্র কিংবা সমাজ!

সহায়ক তথ্যসূত্র:

১.‘নারীপণ্য’: মুজিব মেহদী, জেন্ডারকোষ (১ম খণ্ড), সেলিনা হোসেন ও মাসুদুজ্জামান সম্পাদিত, মাওলা ব্রাদার্স ২০০৬
২. ‘পড়ার বইয়ের বাইরের পড়া’, শ্রী পান্থ
৩. ‘রক্তের অক্ষর’, রিজিয়া রহমান, বেঙ্গল পাবলিকেশন্স, ইবুক সংস্করণ, ফেব্রুয়ারি ২০১৫
৪. মানদা দেবী ও রমেশদার চাপান-উতোর - বামারচণ মুখোপাধ্যায়/বেলা দত্তগুপ্ত, করুণা প্রকাশনী
৫. ‘বারবণিতা প্রসঙ্গ’:বেলা দত্তগুপ্ত, 'মানদা দেবী ও রমেশদার চাপান-উতোর’ বামাচরণ মুখোপাধ্যায় (সম্পাদিত)

 


লেখক পরিচিতি - আমার জন্ম ঢাকায়। বর্তমানে উত্তর আমেরিকায় বসবাস করছি। নানান ধরনের বই পড়তে ভীষণ ভালোবাসি। শখের বশে লেখালিখি করলেও খুব ইচ্ছে করে যে জীবন আমার নয়, কিন্তু হতেও তো পারতো, এমন মানুষের পাশে নিজেকে দাঁড় করিয়ে সে জীবনটা দেখি।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।