নারী

মার্চ ৩০, ২০১৬
নারীর পথ চলা
ঊর্মি রহমান
আমরা একটা হিংস্র সময়ে বসবাস করছি। এই হিংস্রতা গোটা উপমহাদেশ জুড়ে, এই হিংস্রতা পশ্চিমেও। পার্থক্য এইটুকু যে, সেখানে কখনো কখনো প্রতিকার আমরা দেখতে পাই, কিন্তু আমাদের নিজ বাসভূমে সেটা দেখার সৌভাগ্য আমাদের খুব কমই হয়। এই হিংস্রতা আমাদের সবার জীবনকেই অস্থির করে তোলে, ক্ষুব্ধ, ক্রুদ্ধ করে তোলে আর আমাদের নিজেদের অসহায়তার কথা আবারও মনে করিয়ে দেয়। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না, এই হিং¯হিংস্রতার একটা বড় শিকার নারী। নারীকে অপেক্ষাকৃত দুর্বল মনে করা হয় এবং এটাও সত্য যে, সমাজ ও রাষ্ট্র অধিকাংশ সময় নাগরিকদের রক্ষা করতে পারে না। কখনো কখনো সে চেষ্টা হতেও আমরা দেখি না। দেশের প্রতিটি নাগরিককে রক্ষা করার দায়িত্বে যাঁরা নিযুক্ত, তাঁরা সেটা সবসময় চান কিনা সে ব্যাপারেও আমরা নিশ্চিত নই। সুতরাং নারীর সুরক্ষার কোন প্রশ্ন সেখানে আসে না। অনেক ক্ষেত্রেই অপরাধ প্রতিকারের দায়িত্বে নিযুক্ত ব্যক্তিবর্গের সদিচ্ছার অভাব, কিংবা রাজনৈতিক চাপ অথবা নারীর প্রতি এক ধরণের অবজ্ঞা, নিঃস্পৃহতা বা বৈরিতা কাজ করে।
বাংলাদেশে ১৯৮৩ সালে নারী নির্যাতন বিরোধী (নিবৃত্তমূলক শাস্তি) অধ্যাদেশ জারী হয়েছে। যার পেছনে ছিল বাংলাদেশের নারীদের লড়াই। এর আওতায় রয়েছে নির্যাতন, নারী পাচার, ধর্ষণের মত অপরাধ। তবে এই আইনের অধীনে অনেক অপরাধই আনা সম্ভব হয় না। ফেমিসাইড’এ ফেলার জন্য অপরাধের যে সাক্ষ্যপ্রমাণ দরকার, তা অধিকাংশ ক্ষেত্রে পাওয়া যায় না। আইন দিয়ে কখনোই অপরাধ দমন করা যায় না। তার জন্য যে মানসিকতার প্রয়োজন, যে সচেতনতার প্রয়োজন, সেটা এখনো আসেনি, কখনো আসবে, সে প্রত্যাশা করতে পারি না। তাই শুধু হতাশাই আমাদের সম্বল। ধর্ষণের পর নারীকেই অনেক সময় কাঠগড়ায় তোলা হয়। এমনকি তার চরিত্রের ওপর কালিমা লিপ্ত করা হয়। ধর্ষণের বিস্তারিত বিবরণ জানতে চেয়ে তাকে আবারও বেয়াব্রু করা হয়। নারীর পোশাক নিয়ে মন্তব্য করা হয়। সম্প্রতি এক সাংবাদিক বন্ধুর কাছে শুনলাম, কন্যার স্কুলে তিনি অপেক্ষমাণ ছিলেন, একজন এসে তাঁকে ওড়নাটা ভাল করে গায়ে জড়িয়ে নিতে বলে। কারণ? অপেক্ষমাণ পুরুষদের অসুবিধা হচ্ছে। আমার এক ভাগিনেয়ী একথা শুনে বলেছিল, পুরুষরা পর্দা করতে পারেন, তাঁদেরই যখন অসুবিধা! এ প্রসঙ্গে বলা যায়, এ ধরণের কথা আমাদের শৈশব, কৈশোর বা তারুণ্যে শুনতে হয়নি, এমনকি সে সময়ের ইসলামী দেশ পাকিস্তানেও না (উল্লেখ্য, আমরা তখন পাকিস্তানের নাগরিক ছিলাম)। সে সময় ধর্ম বা ধর্মীয় অনুশাসন নিয়ে কেউ আলোচনা করতো না, কারো ওপর নিজের মতবাদ চাপিয়ে দেবার কোন চেষ্টা ছিল না। ধর্ম কোন ইস্যু ছিল না। ধর্ম নিয়ে কোন আলাপ-আলোচনা, বক্তৃতা-বিবৃতি হতো না। তখন কি মানুষ কম ধর্মপ্রাণ ছিলেন? না, কিন্তু যে যার ধর্ম নির্বঘ্নে, একান্তে পালন করতেন। ধর্মপালন ছিল মানুষের ব্যক্তিগত বিষয়। আর তাতে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীর সঙ্গে মেলামেশা, ভাব-ভালবাসায় কোন সমস্যা ছিল না। কিন্তু গোটা বিশ্বে এখন মৌলবাদের উত্থান হচ্ছে, সেটা প্রায় সব ধর্মেও ক্ষেত্রেই সত্য। তাই আজ হিজাব পরিহিতা নারীর সংখ্যা যেমন বেড়েছে, তেমনি শুধু ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের নয়, হয়ত অন্য ধর্মের মানুষের মধ্যেও ধর্মীয় পরিচয় প্রকাশ্যে দেখাবার প্রবণতা বেড়েছে।
নারী কি কখনো স্বাধীন ছিল? সত্যি কি মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ছিল? মাঝে মাঝে বিষয়টা ধোঁয়াশা সৃষ্টি করে। এখনো অনেক এলাকায় মাতৃতান্ত্রিক সমাজের কথা শুনি। কিন্তু সেখানকার বন্ধুদের কথায় জেনেছি, তাদের সেই মাতৃতান্ত্রিক সমাজে পুরুষরা সব কিছুই নারীর ওপর ছেড়ে দিয়ে অলস সময় ব্যয় করে। নারীকে ঘরে-বইরে, দু’দিক সামলাতে হিমসিম খেতে হয়। সিমন দ্য বুভোয়া লিখেছেন, অতীন্দ্রিয় অর্থে ভূমি ও নারীর মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান। নারী সৃষ্টি করলেও সৃষ্টির গৌরব সে ভোগ করে না। এমনকি যে সন্তানকে যে দীর্ঘ সময় গর্ভে ধারণ করে আর তারপর তিলে তিলে মানুষ করে, তার ওপরই বা তার কতটুকু অধিকার আছে? ইসলামী শরিয়তে সে অধিকার বলতে গেলে নেই। একজন নারী তাঁর সন্তানের শুধু ‘কেয়ারটেকার’ মাত্র, স্বাভাবিক অভিভাবক’ নয়। তাই তাকে বিচ্ছেদের পর সন্তানকে কাছে রাখার জন্য লড়তে হয়, যে লড়াইতে সবসময় তার জিৎ হয় না, কারণ আইনি সহায়তা তার নেই। এঙ্গেলস্ যদিও বলেছেন, সব ধরণের সমাজ দু’টি স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে – আর সে দু’টি হচ্ছে উৎপাদন ও সন্তানের জন্মদান। নারীই হচ্ছে সে, যে একই সঙ্গে জীবন সৃষ্টি করে এবং জীবনের প্রয়োজনীয় সামগ্রী দান করে। এ সমাজ পুরুষ একা গড়ে তোলেনি। কিন্তু উপমহাদেশের নারীর জন্য এগুলো শুধু কথার কথা, জীবনের পথে সত্য নয়।
বাংলাদেশের সংবিধানে বলা রয়েছে, নারী পুরুষের সঙ্গে দেশের ও জনজীবনের সর্বত্র সমান অধিকার ভোগ করবে। শাসনতান্ত্রিক এই অধিকার নারীকে সমান অধিকার দেয়নি। এখনো নারী দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক। এখনো নারীকে সমাজের অনেক অপরাধের দায় বহন করতে হয়। এখনো অনেক ক্ষেত্রে বিয়ের আসরে নারীকে মূল্য ধরে দিতে হয়। উপমহাদেশের অন্যত্র কন্যা সন্তানের জন্মের জন্য বিজ্ঞানকে তোয়াক্কা না করে নারীকে অপরাধী হিসেবে কাঠগড়ায় তোলা হয়। বাংলাদেশে কন্যাভ্রুণ হত্যার কথা ততটা শোনা না গেলেও কন্যাকে অবজ্ঞা-অবহেলা সইতে হয় আর উপমহাদেশের অন্যত্র এটা ব্যধির মত। এখনো মিডিয়া জগতে নারীকেই পণ্য হিসেবে তুলে ধরা হয়। নারী বিভিন্ন পেশাগত দায়িত্ব পালন করছে, যোগ্যতার সাথে পা রাখছে। উচ্চ প্রযুক্তিগত বা আমরা যাকে হাইলি স্কিলড্ কাজ বলি, সেসব তো আছেই, সম্প্রতি দু’তিনজন নারী রিক্সাচালকের কথাও শুনেছি আমরা, যা একান্তভাবে পুরুষের কাজ বলে মনে করা হয়। এক সময় যেসব পেশায় পুরুষের একাধিপত্য ছিল, নারী সেসব পেশায়ও পা রাখছে। একই সঙ্গে ঘর ও বাহির সামলাচ্ছে। সন্তানের প্রতি দায়িত্বে কোন ত্রুটি থাকছে না। স্বেচ্ছায় হোক বা অবস্থার চাপে পড়ে, নারী এখন একক মায়ের দায়িত্ব পালন করছে আর সফল হচ্ছে। তার পরও তার সামাজিক অবস্থানে কোন ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে কিনা, সেটা নিয়ে নিঃসংশয় হওয়া সহজ নয়।
নানাভাবে নারী বৈষম্যের শিকার - রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক, ধর্মীয় ও সংস্কারগত। নারীকে অর্থনৈতিক পরিসরে আনার যে কাজ অনেক আগেই সম্পন্ন হবার কথা ছিল, তা আজও হয়নি। কন্যা সন্তানের শিক্ষার ব্যাপারেই বা ক’টা পরিবার সচেতন? হয়ত অ্যাকাডেমিকভাবে খুব ভাল। কিন্তু বিয়ের পর এগিয়ে যাবার শক্তি, সাহস ও অনুপ্রেরণা ক’জন পায়? অনেক কর্মজীবী নারীকেই সংসারের কাজ সম্পর্কে ব্যঙ্গোক্তি শুনতে হয়, ‘তুমি কর্মজীবী নারী, এসব করবে কেন?’ আবার এমনও শোনা গেছে, স্ত্রীকে চাকরি করতে দিতে রাজী কোন পুরুষ তার কাজের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ আনতে চেয়েছে। আমি একজনকে জানি যার স্বামী তাকে বলেছে, ‘তুমি চাকরি করতে পারো, তবে অফিসের বাইরে গিয়ে কোন কাজ করতে পারবে না।’ বলা বাহুল্য তিনি সে কথায় কর্ণপাত করেননি এবং পরবর্তী জীবনে তাঁর পেশায় প্রচুর উন্নতি করেছেন। আমার সংসারের কাজে সহায়তা করতো যে তরুণী, সে মৈত্রেয়ী দেবীর আশ্রমে বড় হয়েছে। রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে পারে। শিক্ষিত। কিন্তু যার সাথে বিয়ে হয়েছে, সেই পুরুষপুঙ্গব প্রতি রাতে মদ খেয়ে এসে তাকে মারধোর করে। তার সামাজিক অবস্থান থেকে তো সে উঠতে পারলো না। এর কোন প্রতিবিধান আমার জানা নেই।
শরিয়তের ওপর নির্ভর করে বাংলাদেশের পারিবারিক আইন অনুযায়ী সম্পত্তি আইনে পিতার সম্পত্তি পুত্র যা পায়, কন্যা পায় তার অর্ধেক। পুত্রহীন পিতার একমাত্র কন্যা অর্ধাংশ পায়। পিতার ভাই এবং ভাইপোরাও সেখানে দাবীদার। আমার নিজের জীবনের অভিজ্ঞতাই একথার সাক্ষ্য। আমার পুত্রহীন পিতার মৃত্যুর পর তিনবোনের মধ্যে বড় হিসেবে আমি সাকসেশন সার্টিফিকেট আনতে আদালতে গিয়ে একথা জানতে পারি। আমার চাচাকে যখন একথা জানিয়ে বলি যে, ‘তুমি বাবার সম্পত্তি দাবী করবে না, একথা লিখে দাও।’ আমার প্রবল ¯স্নেহপ্রবণ বিস্মিত চাচা লিখে দিয়েছিলেন। সন্তানহীনা স্ত্রী স্বামীর সম্পত্তির এক চতুর্থাংশ এবং সন্তান থাকলে পাবে এক অষ্টমাংশ। বাংলাদেশের মুসলমান নারীদের জন্য এই বিধান। কিন্তু হিন্দু নারীদের জন্য নেই। বাংলাদেশের হিন্দু নারীদের সম্পত্তি আইনে কোন অধিকার দেওয়া হয় না। বহু আগে প্রবর্তিত ধর্মীয় অনুশাসন বদলানো যায়। কিন্তু সাহস করে সে কাজ করতে কেউ রাজী নন। কিছু মানুষ আইন বদলাতে চান না স্বার্থে। আর অনেক ক্ষমতার রাজনীতি করেন এবং ভয় পান, যদি এর ফলে তাঁদের ভোট কমে যায়।
সন্তানের ওপর মায়ের সঠিক অর্থে কোন অধিকার নেই একথা আগেই বলেছি। পুত্রের ক্ষেত্রে আট বছর আর কন্যার ক্ষেত্রে বয়ঃসন্ধি বা ১২ বছর বয়স পর্যন্ত মা তার রক্ষণাবেক্ষণ করবে। এই সময়ে মা আবার বিয়ে করলে সে অধিকারটুকুও হারাবে। কিন্তু বাবা একাধিকবার বিয়ে করলেও তার অধিকার এতটুকু খর্ব হয় না। বিচ্ছেদের পর আমি নিজে যখন জানতে চেষ্টা করলাম সন্তানের কাস্টডির ব্যাপারে আমার কতটুকু কি অধিকার আছে, তখন অবাক হয়ে শুনলাম, আমি নাকি আমার সন্তানের, যাকে আমি গর্ভে ধারণ করেছি, ন’মাস বহন করেছি, জন্ম দিয়েছি, আমি নাকি তার স্বাভাবিক অভিভাবক নই, শুধু কেয়ারটেকার মাত্র। অথচ মা না বলে দিলে পিতৃপরিচয়ের প্রমাণ কি? লড়াই করেই আমার সন্তানকে আমার কাছে রাখতে হয়েছে। মধ্যস্থতাকারীরা আমার সহায়তা করেছেন, আমার শিশুপুত্রের মা’কে ছেড়ে না-যাবার দৃঢ়তা কাজ করেছে, আইন নয়।
নারীর এখনো অনেক পথ পাড়ি দেওয়া বাকী। অনেক নারী সে লক্ষ্যে আন্দোলন করছেন, লড়ছেন। তাঁদের দেখলে ভরসা পাই। কিন্তু যখন দেখি বিশ্ব নারী দিবসে বিভিন্ন পণ্যে নারীদের জন্য বিশেষ ছাড় কিংবা নারী দিবসের ফ্যাশনের বিজ্ঞাপন, তখন মনটা দমে যায়। বুঝতে পারি না আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে আছে, এগোচ্ছি না পিছোচ্ছি।
লেখক পরিচিতি - জন্ম খুলনায়, আদি নিবাস ফরিদপুর। ফরেস্ট অফিসার বাবার সঙ্গে শৈশব কেটেছে সুন্দরবন ও পার্বত্য চট্টগ্রামের জঙ্গলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়া শেষে দৈনিক সংবাদ’এ সাংবাদিকতা শুরু করেন। এরপর নানা পত্র-পত্রিকা, বাংলাদেশ প্রেস ইন্সটিটিউট, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র, উইকলি হলিডে’তে কাজ করেন। সাপ্তাহিক বিচিত্রায় খণ্ডকালীন কাজ করেন। এরপর আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসে যোগ দিতে লন্ডন চলে যান। বিবিসি’র পর লন্ডনেরই একটি স্থানীয় সরকারে যোগ দেন। বর্তমানে অবসর জীবনে কলকাতায় বসবাস করছেন। ফিকশন ও নন-ফিকশন মিলিয়ে তাঁর বেশ কিছু প্রকাশিত গ্রন্থ রয়েছে।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।