নারী
জুন ১৫, ২০১৬
মৌখিক তিন তালাক এবং ভারতীয় মুসলমান নারী
ঊর্মি রহমান
উপমহাদেশে মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে তিন তালাকের চর্চা অনেক কাল ধরেই চলে আসছে। এখানে উল্লেখ করার মত ঘটনা হচ্ছে বাংলাদেশ, পাকিস্তান বা ইন্দোনেশিয়ার মত মুসলমান-প্রধান দেশে তিন তালাক নিষিদ্ধ ঘোষণা করে শরীয়তের ওপর নির্ভরশীল ইসলামী পারিবারিক আইনে পরিবর্তন আনা হয়েছে, অথচ অন্যতম বৃহত্তর গণতান্ত্রিক দেশ ভারতে এখনো এই প্রথা চালু আছে। তবে সম্প্রতি তিন তালাক নিয়ে আলাপ-আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক হচ্ছে, যার মূলে রয়েছে এই অন্যায় প্রথার বিরুদ্ধে এক নারীর লড়াই।
৩৫ বছর বয়সী শায়ারা বানু তিন তালাকের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে মামলা দায়ের করেছেন। ভারতে তিনি প্রথম নারী যিনি তাঁর মৌলিক অধিকারের দাবীতে ব্যক্তিগত আইনকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন। তাঁর ১৫ বছরের বিবাহিত জীবনে তাঁকে বার বার গর্ভপাত ঘটাতে বাধ্য হতে হয়েছে। তিনি যখন উত্তরাখণ্ডে বাপের বাড়িতে ছিলেন, তখন তাঁর স্বামী রিজওয়ান আহমেদ এলাহাবাদ থেকে তাঁকে ডাকযোগে তালাকনামা পাঠিয়ে দেন, যাতে দু’জন সাক্ষীর সই ছিল। শায়ারা তিন তালাক, বহুবিবাহ এবং হালালা (যেখানে পূর্ব স্বামীকে আবার বিয়ে করতে চাইলে অন্য কাউকে বিয়ে করে, তার সঙ্গে সহবাস করে বিয়েকে পোক্ত করার পরই তার কাছ থেকে বিচ্ছেদ নিয়ে আগের স্বামীকে বিয়ে করা যায়), এ সবগুলোকেই চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন। তিনি বৈষম্যের বিরুদ্ধে সুরক্ষার দাবী জানিয়েছেন।
তিনি জানান বিয়ের পর থেকে যৌতুকের দাবী জানানো হয়। তাঁর সামান্যতম ত্রুটি দেখলে স্বামী তালাকের হুমকি দিতেন। বিয়ের দু’বছরের মধ্যে সন্তান ধারণ না করায় তাঁর শাশুড়ি তাঁর স্বামীকে বলতেন তাঁকে তালাক দিতে। বার বার তাঁর গর্ভপাত ঘটানো হয়। কতবার, সেটা তাঁর মনেও নেই। হয়ত ৬/৭ বার। তাঁকে আধা ঘণ্টার দূরত্বে বোনের বাড়ি যেতে দেওয়া হতো না। কিন্তু অত্যাচার সয়ে সয়ে যখন তিনি মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন তখন তাঁর স্বামী তাঁকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে বলেন, তিনি সুস্থ হয়ে আবার স্বামীর ঘরে ফিরে আসতে পারবেন। সেটা ছিল গত বছরের এপ্রিল মাসের কথা। তিনি স্বামীকে বার বার খবর দেন তাঁকে নিয়ে যেতে, তাঁর সন্তানদের সাথে কথা বলতে দিতে। এর কোনটাই হয়নি। তার বদলে ডাকযোগে তালাকনামা এসেছে, যাতে দু’জন সাক্ষীর সই রয়েছে। তাঁর ১৪ বছর বয়সী পুত্র আর ১২ বছর বয়সী কন্যা তাঁর কাছ থেকে দূরে, তাঁর স্বামীর সঙ্গে আছে। তিনি চাইলেও তাঁদের দেখতে পারছেন না বা কাছে আনতে পারছেন না। তাঁর স্বামী রিজওয়ান তাঁকে মারধোর করার কথা অস্বীকার করেন। গর্ভপাতের কথা অবশ্য স্বীকার করেন। শায়ারা তাঁকে টিউবেকটমির কথা বলেছিল। কিন্তু রিজওয়ান বলেছেন, টিউবেকটমি বা ভ্যাসেকটমি ‘হারাম’। তাঁর বক্তব্য তিনি শরীয়ত ও হাদিস মেনেই শায়ারাকে তালাক দিয়েছেন। এখন তাঁকে ফিরিয়ে নেবার উপায় নেই, শরীয়ত সেটার অনুমতি দেয় না।
শায়ারার বাবা এলাহাবাদের আর্মি কোয়ার্টারে থাকেন। তিনি সেনাবাহিনীর অ্যাকাউন্টেন্ট। তিনি মেয়েকে আদালতে যেতে উৎসাহিত করেন। রিজওয়ান ডাকযোগে তালাকনামা পাঠিয়ে দেয়, সেটাই তাঁর রিট পিটিশনের বিষয় বলে জানান তাঁর আইনজীবী বালাজী শ্রীনিবাসন। শায়ারা তিন তালাক এবং তাৎক্ষণিক তিন তালাকের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, এর আগে এনজিওগুলো একক পারিবারিক আইনের দাবীতে মামলা করলেও সেগুলো ধোপে টেকেনি, কারণ সেগুলো কোন ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষের মামলা ছিল না। শায়ারা প্রথম ভারতীয় মুসলমান নারী, যিনি এই চ্যালেঞ্জ জানালেন। তিনি ভারতীয় সংবিধানে যে মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে, তারই ভিত্তিতে এই চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন। এই মামলায় জিতলে এবং তাঁর তালাক রদ হয়ে গেলে তিনি কি তাঁর স্বামীর ঘরে ফিরে যাবেন? শায়ারার জবাব, যেতেও পারেন সন্তানদের কথা ভেবে, তবে সেটা তখনই হবে, যদি তাঁর স্বামীর মধ্যে পরিবর্তন আসে। শায়ারার বাবা চান না মেয়েকে অত্যাচারীর ঘরে ফিরে যেতে দিতে। শায়ারা বানু টাইমস অব ইন্ডিয়াকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে আর্জি জানাতে চান যেন হিন্দু ও মুসলমানদের জন্য আইন একই হয়। তিনি বলেছেন, তিন তালাক ইসলাম-বিরোধী, কারণ পবিত্র কোরানের কোথাও তিন তালাকের কথা বলা হয়নি। এর মধ্যে এনডিটিভি’র এক অনুষ্ঠানেও বিভিন্ন মুসলমান বক্তা ও দর্শক একই মত প্রকাশ করেছেন।
শায়ারার এলাকার এক ইমামের মতে, ধর্মীয় বিষয়ে রাষ্ট্রের নাক গলানো ঠিক নয়। তিনি জানান, মুসলমান পুরুষরা কারণ ছাড়া তালাক দেয় না। তিন তালাক দেবার নিয়ম হচ্ছে, স্বামী প্রথমবার তালাক উচ্চারণ করার পর স্ত্রীকে শুধরে নেবার সময় দেবে। আবার তালাক শব্দটা উচ্চারণ করবে, তারপর স্ত্রীকে আরো সময় দেবে তারপর তৃতীয়বারের মত তালাক শব্দটা উচ্চারণ করবে। যদিও ডাক বা এসএমএস যোগে পাঠানো তালাকের ক্ষেত্রে সেটা ঘটে বা ঘটতে পারে না। ঐ ইমামের বক্তব্য হচ্ছে, কোন কারণ ছাড়া মুসলমান স্বামীরা স্ত্রীকে তালাক দেয় না, যদিও এ ব্যাপারে অনেকেই একমত হবেন না। দি মুসলিম পার্সোনাল ল’ (শরীয়ত) অ্যাপ্লিকেশন অ্যাক্ট, ১৯৩৭ অনুযায়ী ভারতীয় মুসলমানরা শরীয়ত অনুযায়ী চালিত হবে। মুসলিম ম্যারেজ অ্যাক্ট, ১৯৩৯ বিলুপ্ত করার পর থেকে মুসলমান নারী আদালতে গিয়ে বিবাহ বিচ্ছেদ চাইবার অধিকার পায়। আলোচ্য ইমাম বলেন, কোন অ্যাক্ট কি বলছে, সেটা তিনি পরোয়া করেন না। একমাত্র পুরুষদেরই তালাক দেবার অধিকার আছে, নারীর নেই।
তবে আইন সংখ্যালঘুদের কতটা সাহায্য করতে পারে, সে ব্যাপারে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে ১৯৮৫ সালের একটি মামলার কথা স্মরণ করা যেত পারে। শাহ বানু সুপ্রিম কোর্টে খোরপোষের মামলায় জিতলেও পরে সরকার সেটা বাতিল করে দেয়।
অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল’ বোর্ড তিন তালাক বাতিলের বিরোধিতা করে। বিভিন্ন নারী সংগঠন তাদের কর্তৃত্ব বা অধিকার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। ভারতীয় মুসলিম নারী আন্দোলন বা BMMA এই বোর্ডের বিলুপ্তি দাবী করেছে। তারা বলেছে, অধিকাংশ মুসলমান তাদের কথাবার্তা ও সিদ্ধান্তের সঙ্গে নিজেদের মেলাতে পারে না। খ্যাতনামা মুসলিম বিদ্বান ব্যক্তিবর্গ এবং জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশনের সাবেক চেয়ারপার্সন বলেছেন, বোর্ড যাই বলুক, তিন তালাক সম্পূর্ণভাবে বিবাহ বিচ্ছেদ সম্পর্কিত কোরানের আইনের পরিপন্থী। কিছু কাজ যে হচ্ছে না, তা নয়, যদিও তার গতি অতি মন্থর। তেলেঙ্গানার কাজীরা নিঃশব্দে বিভিন্ন ধরণের তালাকের ব্যাপারে পরিবর্তন আনছেন। তাঁদের অভিযোগ মুসলমান পুরুষরা তাঁদের না জানিয়েই স্ত্রীদের ডিভোর্স দিচ্ছে। এখানে উল্লেখ্য যে, কাজীর সামনে ডিভোর্স দেবার নিয়ম রয়েছে। সেকেন্দ্রবাদের প্রধান কাজী বলেন, একতরফা ডিভোর্সকে উৎসাহিত না করাটাই এই সমস্যা দূর করার উপায়। উভয় পক্ষের উপস্থিতিতে এই প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে। দু’জনকে কাউন্সেলিং’এ পাঠিয়ে বিয়ে রক্ষা করাও সম্ভব। অনেকের মতে ইসলামী আইন সম্পর্কে অজ্ঞতা এর কারণ। সেজন্য সে ব্যাপারে সচেতনতা দরকার। আউটলুক পত্রিকার এক রিপোর্টে দোলা মিত্র লিখেছেন, মুসলমান নারীদের অনেকেই ভারতে একক পারিবারিক আইন চান। কিন্তু রাজনৈতিক নেতারা এ ব্যাপারে নিশ্চুপ। এবার পশ্চিমবঙ্গসহ যে ক’টি রাজ্যে নির্বাচন হল, তার কোনটিতেই রাজনৈতিক দলের ইশতেহারে মুসলিম তোষণের বিষয়াবলী থাকলেও কিন্তু এই বিষয়টা অন্তর্ভুক্ত ছিল না। দোলা মিত্র রুকসানা বেগম নামে একজনের কথা লিখেছেন, তাঁর বয়স যখন ৩০, তখন যাঁর স্বামী দ্বিতীয় স্ত্রী বাড়িতে আনাতে তিনি যখন প্রতিবাদ করেন, তখন তিনি মৌখিক তালাক দেন। রুকসানা ছেলেসহ বাপের বাড়ি ফিরে আসেন। তিনি সেলাই-ফোঁড়াই শিখে ছেলেকে একাই মানুষ করেন। এরকম উদাহরণ অনেক রয়েছে।
মুসলমান নারীসমাজ তাদের সমস্যা সমাধানের জন্য রাজনৈতিক দলের ওপর আস্থা রাখে না। রাজনৈতিক দলের মূল উদ্দেশ্য নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা। সেজন্য যা করা দরকার বা যতটুকু দরকার, তার বেশী দলগুলো করে না বা করতে চায় না। পশ্চিমবঙ্গেও ২৮% মুসলমান জনগোষ্ঠীর অর্ধেক নারী। তাদের সবাই যে স্বাধীনভাবে ভোট দেয়, তা-ও নয়। অধিকাংশ সময় তাদের পরিবারের পুরুষ সদস্যরা বলে দেয় কাকে ভোট দিতে হবে। তাদের ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর আগ্রহ নেই।
ব্যতিক্রম আছে কিছু কিছু এলাকায়। রিসার্চ স্কলার হাসনারা খাতুন বলেছেন, আরামবাগে তাঁর গ্রামে বহুবিবাহ বা তালাককে ভাল চোখে দেখা হয় না। কোন পুরুষ তাঁর স্ত্রীকে তখনই তালাক দিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করতে পারবেন, যদি তাঁর স্ত্রী সন্তান ধারণে অক্ষম অথবা ব্যভিচারী হন। সেটাও ঠিক করে দেবে সম্প্রদায় বা সমাজ। এখানে আমার দেখা বাংলাদেশের একটি গ্রামের কথা মনে পড়ে গেল। সাংবাদিক হিসেবে সেই গ্রামে গিয়েছিলাম একটি কাঁথা প্রকল্প দেখতে। সেখানে গিয়ে দেখেছিলাম অর্থনৈতিক স্বাধীনতাপ্রাপ্ত গ্রামের মেয়েরা একটি সালিশ তৈরি করেছে, যা নারীদের নিয়েই গঠিত। ঐ গ্রামের কোন পুরুষ দ্বিতীয় বিয়ে করতে চাইলে তাকে ঐ সালিশের সামনে হাজির হতে হয়। বোঝাতে হয় তার দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণের কারণ (প্রথমা মানসিকভাবে অসুস্থ কিংবা ব্যভিচারী), সালিশ তাতে সন্তুষ্ট হলেই তাকে দ্বিতীয় বিয়ের অনুমতি দেওয়া হয়। আর গ্রামের পুরুষরা সেটা মেনেও চলে।
আগেই বলেছি আরা কয়েকটি দেশের মত বাংলাদেশে মৌখিকভাবে তালাক দেওয়া বা তিন তালাক বেআইনি বলে ঘোষিত হয়েছে বেশ আগে - ১৯৬১ সালে। সে সময় মুসলিম পারিবারিক আইনে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন আনা হয়েছিল। মৌখিক তালাক বাতিল ছাড়াও কাবিননামায় (ম্যারেজ ডকুমেন্ট) স্ত্রীকে ডিভোর্স দেবার অধিকার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বিবাহ বিচ্ছেদ চাইলে তালাক-ই-তওফিজ’এর সাহায্য নেওয়া যায়, যেখানে পৌরসভা অথবা ইউনিয়ন পরিষদের কাছে আবেদন করা বাধ্যতামূলক। পৌরসভা অথবা ইউনিয়ন পরিষদ তখন তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করবে, যা প্রথমে দেখবে পুনর্মিলন সম্ভব কিনা এবং সেটা সম্ভব না হলে বিচ্ছেদে ইচ্ছুক দম্পতিকে ৯০ দিন অপেক্ষা করতে হবে, তারপরই তাদের বিবাহ-বিচ্ছেদ সম্পূর্ণ হবে। এই অধ্যাদেশের ফলে তিন তালাক কার্যকর থাকছে না। বিচ্ছেদে ইচ্ছুক স্বামী মুখে তিন তালাক উচ্চারণ করলেও তাদের আইনত: বিবাহিত বলে ধরা হবে। বিবাহ বিচ্ছেদেও অন্য পদ্ধতিটি হচ্ছে ‘খুলা’ যেখানে উভয়ের সম্মতিক্রমে বিচ্ছেদ হয়। তবে এখানে কিছু বৈষম্য থেকে যাচ্ছে, যদি স্ত্রী বিচ্ছেদের ব্যাপারে প্রথমে এগিয়ে আসেন, তাহলে তাঁকে ক্ষতিপূরণ দিতে হয়। মুসলমানের মধ্যে যৌতুক ছিল না, সেটা পরে যুক্ত হয়েছে। কিন্তু যেটা ছিল, সেটা হচ্ছে দেনমোহর বা মোহরানা, যেখানে বিয়ের সময় একটা মূল্য ধার্য করা হয়, যেটা স্ত্রীর প্রাপ্য। এমনকি তিনি বিবাহ বিচ্ছেদ চাইলেও এ ব্যাপারে তাঁর অধিকার এতটুকু খর্ব হয় না। প্রথমত: এই নিয়ম সমাজের অধিকাংশ মানুষের বিশেষ করে নারীদের অজানা। তাই বহু শিক্ষিত পুরুষও দেনমোহরের টাকা স্ত্রীকে দেয় না। তাছাড়া নারীকে এ ক্ষেত্রে যেহেতু ক্ষতিপূরণ দিতে হয়, অনেক সময়ই তাঁর কাছে ক্ষতিপূরণ দেবার মত অর্থ থাকে না। তাই তাঁকে দেনমোহরের দাবী ছেড়ে দিতে হয়। বিচ্ছেদে আগ্রহী পুরুষকে কিন্তু ক্ষতিপূরণ দিতে হয় না। তার উচিত দেনমোহরের অর্থ বিচ্ছেদপ্রাপ্ত ¯স্ত্রীকে দিয়ে দেওয়া। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা সেটা দেয় না আর স্ত্রী এ ব্যাপারে অজ্ঞ থাকায় দাবী করে না।
পশ্চিমবঙ্গের কথায় আসি। দরিদ্র ও পল্লী এলাকার মুসলমান মেয়েদের অনেক সমস্যা রয়েছে। যেমন, বাল্য বিবাহ, শিশু শ্রম, শিশু ও নারী পাচার এবং অল্প বয়সে সন্তানসহ বিবাহ বিচ্ছেদ। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী দরকার সচেতনতা। আজকাল অনেকের মধ্যেই সেটা আসছে। এনডিটিভি’তে সুতপা দেবের এক রিপোর্টে একজন কুমারী মায়ের কথাও জেনেছি। তাঁকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দেয়ে সহবাস বাধ্য করে এক যুবক। গর্ভবতী হলে সে বিয়ে করতে অসম্মতি জানায়। ঐ তরুণী সকলের কথাকে অগ্রাহ্য করে সন্তানের জন্ম দেয়। তাঁর বক্তব্য অপরাধ তাঁরা দু’জন করেছেন, শিশুটি তো নিষ্পাপ। চরম দারিদ্র্য ও লাঞ্ছনা-গঞ্জনার মধ্যেও তিনি তাঁর পুত্রকে মানুষ করছেন। তবে সামাজিক অন্যায় ও দুর্নীতির শিকারও সহজেই নারী হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার দরিদ্র মুসলমান নারীদের কিছু তাঁত দেবে বলে প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু তার জন্য তাদের ঘুষ দিতে হয়। যারা দেবে না বা দিতে পারবে না, তারা সেটা পাবে না। উপরে বর্ণিত সংকট ছাড়াও গ্রামের অন্য নারীদের মত মুসলমান নারীদের নিরাপত্তার প্রশ্নটিও আছে। আশার কথা পশ্চিমবঙ্গের কিছু গ্রামে মেয়েরা আত্মরক্ষার উপায় শিখছে। মুসলমান নারী নেত্রীরাই উদ্যোগী হয়ে তার ব্যবস্থা করেছে। গ্রামাঞ্চলের মুসলমান মেয়েরা কারাটে শিখছে।
মুসলমান মেয়েদেরও উন্নয়নের জন্য অনেকে কাজ করছে। তার মধ্যে একটি বড় সংস্থা হচ্ছে ভারতীয় মুসলিম মহিলা আন্দোলন বা BMM. এটি ১২টি রাজ্যে কাজ করছে যার সদর দফতর হচ্ছে মুম্বাই। ভারতীয় মুসলিম মহিলা আন্দোলন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কাছে মুসলমান নারীদের বিভিন্ন বৈষম্যের প্রতিকার চেয়ে আবেদন জানিয়েছে যাতে তিন তালাকের বিষয়টাও অন্তর্ভুক্ত আছে। তাতে বলা হয়েছে বিবাহ বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে ৯০ দিনের আর্বিট্রেশনকে বাধ্যতামূলক করতে হবে এবং মৌখিক তালাককে অবৈধ ঘোষণা করতে হবে। সন্তানের মাকে ন্যাচারাল গার্ডিয়ান বা স্বাভাবিক অভিভাবক ঘোষণা করতে হবে। ইসলামী আইনে মা শুধুমাত্র কেয়ার-টেকার, স্বাভাবিক অভিভাবক নন। অনেক সময়ই পুত্র সন্তানের ক্ষেত্রে ৮ বছর বয়স এবং কন্যা সন্তানের ক্ষেত্রে সে রজঃস্বলা হওয়া পর্যন্ত মা তার দেখাশোনা করে। তারপর যে স্বামী তাকে ডিভোর্স দিয়েছে, তার হাতে সন্তানকে তুলে দিতে হয়।
ভারতীয় মুসলিম মহিলা আন্দোলন বা BMMA’র উদ্যোগে ৫০ হাজারের বেশী মুসলমান নারী ও পুরুষ তিন তালককে নিষিদ্ধ ঘোষণার দাবীতে এক পিটিশনে স্বাক্ষর করেছে। তারা এই কোরানবিরোধী চর্চার বিরুদ্ধে ন্যাশনাল কমিশন ফর উইমেনের হস্তক্ষেপ দাবী করেছে। সংগঠনের সহ-প্রতিষ্ঠাতা জাকিয়া সোমান জানিয়েছেন, বিভিন্ন রাজ্যে এই প্রচারাভিযান চালানো হয়, যার মধ্যে আছে পশ্চিমবঙ্গ, ওডিশা, রাজস্থান, বিহার, ঝাড়খণ্ড-, গুজরাট, মহারাষ্ট্র. কেরালা. তামিলনাড়ু, কর্ণাটক, তেলেঙ্গানা, মধ্যপ্রদেশ ইত্যাদি।
টাইমস অব ইন্ডিয়া পত্রিকার এক খবরে জানা গেছে অল ইন্ডিয়া মুসলিম পারসোনাল ল’ বোর্ডের নির্বাহী সদস্য আসমা জেহরা বলেছেন, অধিকাংশ মুসলমান নারী মুসলিম পারসোনাল ল’ পরিবর্তনের ব্যাপারে একমত নন। তিনি মনে করেন এই আইন পরিবর্তনের অধিকার কারো নেই। তিনি আরো বলেন, যাঁরা এই আইন মেনে চলতে রাজী নয়, তারা স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্ট’এর অধীনে বিয়ে করতে পারে। উল্লেখ্য স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্ট’এ ধর্ম কোন বাধা হয়ে দাঁড়ায় না এবং ধর্ম পরিবর্তন না করেও দু’জন ভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষ বিয়ে করতে পারেন। তাঁকে যখন বলা হয় যে, ভারতীয় মুসলিম মহিলা আন্দোলন বা তাদের সঙ্গে একমত ব্যক্তি বা সংগঠন মুসলিম পারসোনাল ল’এর বিলুপ্তি চায় না, তার সংস্কার চায়, তখন তিনি বলেন, যারা এসব বলছে, তারা কোরান বা হাদিস পড়েনি।
শায়ারা বানুর আবেদনের পরে আফরিন রহমান নামে আরো একজন মুসলমান নারী তাৎক্ষণিক তিন তালাককে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন। এদিকে আসমা জেহরা ও তাঁর সঙ্গীরা সংবাদ সম্মেলনে তাঁদের বক্তব্য পেশের একদিন পরেই কিছু বিশিষ্ট পুরুষ এই আইনের বিরুদ্ধে ভারতীয় মুসলিম মহিলা আন্দোলনের প্রচারাভিযানকে সমর্থন জানিয়েছেন।
এই কাজ যে সহজে হবে, এমন আশা ভারতীয় মুসলমান নারীরা করে না, কিন্তু হতে পারে, একদিন হবে, এই আশা নিয়ে তারা বেঁচে আছে।
লেখক পরিচিতি - জন্ম খুলনায়, আদি নিবাস ফরিদপুর। ফরেস্ট অফিসার বাবার সঙ্গে শৈশব কেটেছে সুন্দরবন ও পার্বত্য চট্টগ্রামের জঙ্গলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়া শেষে দৈনিক সংবাদ’এ সাংবাদিকতা শুরু করেন। এরপর নানা পত্র-পত্রিকা, বাংলাদেশ প্রেস ইন্সটিটিউট, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র, উইকলি হলিডে’তে কাজ করেন। সাপ্তাহিক বিচিত্রায় খণ্ডকালীন কাজ করেন। এরপর আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসে যোগ দিতে লন্ডন চলে যান। বিবিসি’র পর লন্ডনেরই একটি স্থানীয় সরকারে যোগ দেন। বর্তমানে অবসর জীবনে কলকাতায় বসবাস করছেন। ফিকশন ও নন-ফিকশন মিলিয়ে তাঁর বেশ কিছু প্রকাশিত গ্রন্থ রয়েছে।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।