‘মুক্ত’ থিয়েটার অথবা থিয়েটারের ‘মুক্তি’ : একটি ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণা
প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য্য
এ কথা অনস্বীকার্য চল্লিশ-পঞ্চাশের দশক থেকেই বামপন্থী আন্দোলন বাঙালীর শিল্প-সাহিত্য-সঙ্গীতের প্রাঙ্গনটিকে অদৃষ্টপূর্ব দিগন্তে সম্প্রসারিত করেছিল। গল্প-উপন্যাস-কবিতা, গান, নাটক-সিনেমা সবেতেই তার জাদুকাঠির ছোঁয়া, তাকে নস্যাৎ করতে গেলে ইতিহাসকে অস্বীকার করতে হবে (সেও ইদানীং কেউ কেউ করেন বটে, তাঁরা পরবর্তী কালে যে ইতিহাসেরই জঞ্জাল বলে ধিক্কৃত হন সে ইতিহাসও আছে)। সেই চল্লিশের দশকের গোড়া থেকেই ইয়ুথ কালচারাল ইন্সটিটিউট (YCI), সোভিয়েত সুহৃদ সমিতি, ফ্যাসিস্ট বিরোধী প্রগতি লেখক সঙ্ঘ (১৯৪৫), আইপিটিএ বা গণনাট্য আন্দোলনের অভিঘাত বাংলা শিল্পসাহিত্যকে উৎকর্ষের নুতন মাত্রা প্রদান করেছিল। এ এক চিত্তাকর্ষক অভিযাত্রা, যার সুফল বাঙ্গালী তার জীবনের নানা ক্ষেত্রে পরবর্তী ছয়-সাত দশক ধরে পেয়ে এসেছে। এ কাহিনীর অনুপুঙ্খ বর্ণনা দুর্লভ নয়। তা শিল্পসাহিত্যের সুবিস্তৃত দিগন্তে খেই হারাবার ভয় ষোলোআনা, পারতপক্ষে অসম্ভব অন্তত আমার পক্ষে। তাই এ স্মৃতিচারণ মূলতঃ মফস্বলী ‘শখের’ বাংলানাটক নিয়ে, যার ভিত স্বপ্নসন্ধানের ইঁটে গাঁথা, যার দেওয়ালে দারিদ্র-অভাব-অনটনের ঝুল, সময় সময় আধুনিক নাট্যশিক্ষার অভাব ও ফলে উচ্চকিত মেলোড্রামার ড্যাম্পের দাগ লেগে থাকে, তা সত্ত্বেও আকাঁড়া হৃদয়াবেগ যার অনন্য অভিজ্ঞান।
অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়
|
সত্তরের দশকের শেষাশেষি সারা বাংলা জুড়ে একাঙ্ক নাটকের জোয়ার এসেছিল। মনে রাখতে হবে, গ্রুপ থিয়েটার নামটিও বাঙ্গালীরই দেওয়া, ভারতের অন্যান্য প্রদেশে এর অর্থব্যঞ্জনা কতদূর অনুধাবনযোগ্য, সে বিষয়ে আমার স্পষ্ট ধারণা নেই। তবে কথাটায় একটি গোষ্ঠীবদ্ধতা, একটি সমষ্টিগত দায়ের ইঙ্গিত আছে বেশ স্পষ্ট ভাবে। রোজকার আটপৌরে জীবন ছাপিয়ে যাওয়ার একটা ডাক যেন শোনা যায়। একটা স্বার্থহীনতা, কোনো একটা মহৎ উদ্দেশ্য, হলোই বা অনেক সময়ে ঈষৎ অস্পষ্ট তার অভিলক্ষ্য, কিন্তু কোথায় যেন একটা আবছা সামাজিক কর্তব্যের টান, সমাজটাকে বদলাবার আন্দোলনে সামিল হওয়ার প্রয়াস ওই নাট্যধারায় উপ্ত ছিল। পঞ্চাশ-ষাট-সত্তর দশক কলকাতার গ্রুপ থিয়েটারের স্বর্ণযুগ, শম্ভু-অজিতেশ-উৎপল এবং অন্যান্য অনেকেই চোখ-মন-মনন ধাঁধিয়ে দিচ্ছেন, মূলতঃ শহুরে দর্শকের। উৎপল পথনাটিকা নিয়ে বামপন্থী প্রার্থীদের সমর্থনে বাংলার রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছেন, অজিতেশও কলকাতা বাদেও সুদূর আসানসোলের কয়লাখনি এলাকাতে (ওটা তাঁর জন্মস্থান) নাটক নিয়ে যাচ্ছেন। বাদল সরকার তো ‘এবং ইন্দ্রজিত’ বা ‘পাগলা ঘোড়া’র মত মঞ্চসফল নাটক প্রযোজনা করেও স্রেফ নাটককে আরো জঙ্গম, আরো বহনযোগ্য করে আধা শহর-গঞ্জ-মফস্বল-গ্রামের মানুষের সমীপে নিয়ে যেতে থার্ড থিয়েটার বা ওয়ান-ওয়াল-থিয়েটারে মনোনিবেশ করলেন। কিন্তু কলকাতার নাট্যমঞ্চে গিয়ে নাটক দেখা আমার মত মফস্বল/ আধাগ্রামের ছেলের সেই স্কুলে পড়বার কালে ছিল কমপক্ষে বিলেত যাওয়ার সমান। আমার সম্বল ছিল ফি-বছর শীতকাল পড়তেই সেই সারা-বাংলা-একাঙ্ক নাটক প্রতিযোগিতার মঞ্চে দিনপ্রতি কমসে কম তিনটে হিসেবে পাঁচ কি সাতদিন ধরে তিন-পাঁচে পনেরো বা তিন-সাতে একুশখানা স্বল্পদৈর্ঘ্যের নাটক দেখা। বনগাঁ, গোবরডাঙা, বেলঘরিয়া, হালিসহর, কাঁচরাপাড়া, কোলাঘাট, বালুরঘাট, মালদহ টাউন – কোথায় না কোথায় সারা শীতকাল জুড়ে একাঙ্ক নাটক প্রতিযোগিতাগুলো চলতো! কচুরিপানা বা ব্যাঙের ছাতা কথাগুলো খুব নঞর্থ্যক রূপক, তবে সেই সময় বাংলা জুড়ে ছোটবড় নাট্যদলগুলির বাড়বাড়ন্তের হার বোঝাতে এদের ব্যবহারে ক্ষতি কি ? কি সব তাক-লাগানো নাটক দেখেছি বাড়ির কাছে সারা-বাংলা একাঙ্ক নাটক প্রতিযোগিতায়, ভোলা যায় না। বহরমপুর প্রান্তিকের ‘নানাহে’, ‘জানালা’, নৈহাটি যাত্রিকের ‘বাতাসে বারুদের গন্ধ’, ‘গঙ্গা তুমি বইছো কেন’, আঙ্গিকের ‘লাটাখাম্বা’, কাঁচরাপাড়া মঞ্চসেনার ‘মধ্যাহ্ন সূর্য’, দক্ষিনেশ্বর শৌভিকের ‘কেন না মানুষ’, ‘আব্রু’, ‘ভারতবর্ষ’, গোর্কির ‘মা’, বালুরঘাট ত্রিতীর্থের ‘লাঠি’ - অজস্র-অজস্র...কত নাম করবো? কখনো যীশুখৃস্টের সমসাময়িক দস্যু ‘বারাব্বাস’ যে যীশু-হন্তারক রোম-সৈন্যের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে, কখনো কঙ্গোর মুক্তিপথিক ‘প্যাট্রিস লুবুম্বা’ বা ফ্রান্সের ‘গ্যাব্রিয়েল পেরী’, কখনো স্পেনের গৃহযুদ্ধে ফ্যাসিস্ট শাসক ফ্র্যাংকোর মিলিশিয়ার মহড়া নেওয়া স্পেনীয় কমিউনিষ্ট দলের ‘ঝড়ের খেয়া’! ওয়ার্ল্ডভিউ আর কাকে বলে ? বাবা বাড়ির কাছে এইরকম একটি নাটক প্রতিযোগিতার বিচারক হতেন, আর আমি সেই ক্লাস ফোর-ফাইভ (৭৭ কি ৭৮ সাল) থেকে তাঁর সঙ্গ ধরতাম। শীতকাল, অ্যানুয়াল পরীক্ষা শেষ, ফলে বাবাও সোৎসাহে আমায় সঙ্গে নিতেন। নাটকের নেশা আর রুচি সেই সময়েই তৈরি হয় আমার। ক্লাস নাইনে (১৯৮২) একবার মামা কলেজ স্ট্রিটের ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলে নিয়ে গিয়ে সেই হাঁ-করা গাঁয়ের ছেলেকে দেখালেন, ‘টিনের তলোয়ার’। অহো, কি দেখিলাম, রাতের ঘুম উড়ে গেল আমার! বহুদিন নেশাগ্রস্তের মত আউড়ে যেতাম একা একা - “টাকার সামনে অমন অনেক বন্দুকের নল মাটির সঙ্গে মিশে গেছে কাপ্তেনবাবু, দু’হাতে আটটা জড়োয়ার আঙটি, এর যেকোনো একটা, একটা দিয়ে আপনাদের ওই সাহিত্যফাহিত্য সব কিনে নিতে পারি”, অথবা, “এইবার উন্মুক্ত টিনের তরবারি..সায়েব, তোমরা আমাদের দেশে এলে ক্যানে, আমরা তো তোমাদের কোনো ক্ষেতি করিনি, আমরা তো ছিলাম ভায়ে ভায়ে গলাগলি করে, হিন্দু মুসলমানে প্রীতির বাহুতে বেঁধে বাঙ্গালা মায়ের শ্যামল অঞ্চলে মুখ ঢেকে...যতদিন একজন ইংরেজ শয়তান আমার দেশের পবিত্র বুকে পা রেখে দাঁড়ায়ে থাকবে, ততদিন এই মহাবীর তীতুমিরের তরবারি কোষবদ্ধ হবে নে কখনো...যত কৃষকরে হত্যা করেছ, যত কৃষকরমনীর ইজ্জত নিয়েছ, তাদের সকলের প্রতিশোধ আজ আমার এই বাহুতে এসে জমা হয়েছে...হার্মাদ, জলদস্যু...এই নাও তার খানিক ফেরত নাও”। কয়েক বছর পর (১৯৮৭) বাড়ি থেকে সাইকেল-চালানো দূরত্বে খেলার মাঠে বাঁধা মঞ্চে দেখা ‘কল্লোল’। মস্তিষ্কের কোষে কোষে সেঁধিয়ে গেল খাইবারের বিদ্রোহ, গানার শার্দুল সিং-এর রণহুঙ্কার – “রেঞ্জ ওয়ান সিক্স অট অট অট সালভো”, শিহরণ জাগালো মারাঠি লোকসঙ্গীত পৌয়াদা আর লাউনির সুরে হেমাঙ্গ বিশ্বাসের বাঁধা “বাজে ক্ষুব্ধ ঈষানী ঝড়ে রুদ্রবিষাণ...বিদ্রোহী জাহাজ-জঠরে/ বয়লারে বয়লারে জ্বলন্ত অঙ্গারে/ আগুনের ফুলকিতে নাবিকের প্রাণে প্রাণে/ জ্বলিল মশাল”; শেষদৃশ্যে খাইবার জাহাজের ডেকে বোমারু বিমানের মৃত্যুঘন ছায়ার নীচে অকুতোভয় লালপতাকার আকাশছোঁয়া অহঙ্কার! প্রতিটি রোমকূপে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া নেশার ঘোর...সেই নেশার নিশির ডাকে আমিও নাটকে জড়িয়ে পড়লাম আশির-এর দশকের শেষ থেকেই।
যে কথাটা আমি বলতে চাইছি, আমি তো সচেতনভাবে সমাজসংস্কৃতি-ইতিহাস-রাজনীতি শিখতে নাটক দেখা শুরু করিনি, বা আমার বাবাও সেসব মাথায় রেখে ছেলেকে নিয়ে নাটক দেখাতে নিয়ে যেতেন বলে মনে হয়না। সহায়ক পারিবারিক পরিমন্ডল তো ছিলই, সে কথা বলাই বাহুল্য, কিন্তু সেই সময়ের পশ্চিমবঙ্গের সাংস্কৃতিক বাতাবরণ নিতান্ত অগোচরে, কি সুক্ষ্ম অথচ সুনিশ্চিত ভাবে আমার রুচি, সংস্কৃতি, বোধ-বিবেচনা একটা সুনির্দিষ্ট পথে গড়ে উঠতে সাহায্য করেছিল আমি নিজেও তা টের পেলাম না। এরই মধ্যে একদিন সাহিবাবাদে পথনাটক ‘হাল্লাবোল’এর অভিনয় চলতে চলতে আচমকা লুম্পেন-গুন্ডাদলের হাতে খুন হলেন সফদর হাশমি (২রা জানুয়ারি ১৯৮৯)। ধিক্কারে ফেটে পড়লো সাংস্কৃতিক জগত। প্রতি বছর ওই নারকীয় ঘটনার প্রতিবাদে ওই বিশেষ দিনটিকে ‘সফদর হাশমি দিবস’ হিসেবে পালন করা হত। আর ছিল ‘হিরোসিমা দিবস’। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে উঠে শুরু হল ক্লাস পালিয়ে কলকাতা গিয়ে বড় দলগুলির প্রযোজনা দেখে কিছু কিছু শেখবার চেষ্টা। চেতনার ‘মারীচ সংবাদ’, ‘জগন্নাথ’ দেখলাম। উদ্দেশ্যবিহীন জীবনে মেঠো ও সুক্ষ্ম পাওয়া-না-পাওয়ার বঞ্চনা ও ব্যঙ্গবিদ্রূপে সর্বত্র কোনঠাসা জগন্নাথ প্রতিবাদে-প্রতিরোধে অক্ষম, যেন অমেরুদন্ডী প্রাণী (নাটক ‘জগন্নাথ’)। তবুও কখনো একান্তে তার মন বিদ্রোহে ফেটে পড়লেই তার স্বপ্নে হানা দেয় এক-কোপে-মোষ-বলি-দিতে-পারা তার কসাই বাপ - মাথায় লাল কাপড়ের ফেট্টি, কপালে বিরাট রক্ততিলক, হাতে ধরা চকচকে ভয়াল খাঁড়াটা মাথার উপর বনবন ঘোরায়, আবহে বুক কাঁপিয়ে বেজে ওঠে বিসর্জন বা বলির ঢাকের বোল। এই রকম কত দৃশ্য কত সৃজন আমায় সহজিয়া পথে শিখিয়ে দিয়ে গেল, শিল্পরূপ কাকে বলে। মাপ করবেন, শিল্পভাষা আমার আয়ত্ত্ব এমন অবাস্তব দাবী আমি করছি না, তবে অধুনা ট্রাফিক সিগন্যালে রবীন্দ্রগীতি বাজবার মধ্যে রবীন্দ্রপ্রচ্ছায়াও যে উপস্থিত নেই, তা আমি তর্কাতীত ভাবে বুঝতে শিখে গিয়েছিলাম ওই সময়তেই।
শম্ভ মিত্র ও তৃপ্তি মিত্র অভিনীত "চার অধ্যায়" |
উৎপলের পিএলটি ঘোষিত ভাবে রাজনৈতিক নাটক করতেন, শেষবার ওঁকে মঞ্চে দেখলাম ১৯৯০-এ রবীন্দ্রসদনে ‘লালদুর্গ’ নাটকে, যে নাটকে অনন্য উনি একান্ত নিজস্ব দক্ষতায় সোভিয়েত-ভাঙ্গন পরবর্তী পূর্ব-ইওরোপের ঘটনাবলী বিশ্লেষণ করলেন নাটকের আঙ্গিকে। শিক্ষা হোল, মনের অনেক অন্ধকার কাটলো, বাড়ি ফিরে উৎপল-প্রদর্শিত পথে বইপত্তরের খোঁজ করা শুরু করলাম। তুমুল উৎসাহে দেখা, জানা, পড়া, বোঝা চলতে লাগলো (আমি স্পষ্টতঃই বাংলাগান-কবিতা-গল্প-উপন্যাস আর লিটিল ম্যাগাজিনের কথা বাদ রাখলাম, যদিও সেগুলোর নিরন্তর জলসিঞ্চন ছাড়া মনোভূমির উর্ব্বরতা সৃষ্টি অসম্ভব ছিল। এগুলোর একেকটা নিয়েই আলাদা থিসিস রচনা সম্ভব। তাই নিজের কাছেই এই আলোচনা কেমন অসম্পূর্ণ ঠেকছে। কি আর করা!)। বহুরূপীর ‘গ্যালেলিও’(নামভূমিকায় অমর গাঙ্গুলি ও আরো পরে কুমার রায়; আমি শম্ভু মিত্রের গ্যালেলিও দেখতে পাইনি, ‘রাজা অয়দিপাউস’ও না) দেখলাম, বুঝলাম সত্যিই “দুর্ভাগা সেই দেশ, যে দেশে কেবল বীরেরই প্রয়োজন হয়”; জাঁ পল সার্ত্রর ‘লে ম্যাঁ সাল’ বা ‘ক্রাইম প্যাশিওনেল’ অবলম্বনে কবি অরুণ মিত্র অনুদিত বহুরূপীর প্রযোজনা ‘নিন্দাপঙ্কে’ (অল্প কিছুকাল আগে এই একই মূল ফরাসী নাটকের আরেকটি সংস্করণ কোলকাতায় দেখা গেছে ‘রাজনৈতিক হত্যা?’ নামে, অনুবাদিকা অর্পিতা ঘোষ) আমায় পার্টিজীবন, পার্টিকর্তব্য সম্পর্কে কিছু অপ্রিয় কিন্তু জরূরী প্রশ্নের সামনে এনে ফেললো। উত্তর খুঁজতে এর-তার সঙ্গে আলাপআলোচনা, তর্কবিতর্ক চললো এক প্রস্থ, ফলে সার্ত্রের দৃষ্টিকোণ মানি, চাই না মানি, সমৃদ্ধ হলাম। আমায় চমকে দিয়ে বাদল সরকারের নির্দেশনায় অঙ্গনমঞ্চে এল ‘রক্তকরবী’ (পথসেনা, ১৯৯৫), তারও আগে ওই অঙ্গনমঞ্চে থার্ড থিয়েটার ফর্মে দেখেছি ‘হট্টমালার ওপারে’, ‘খাট-মাট-খ্রিং’, ‘জুলুস’, দেখেছি মহাশ্বেতা দেবীর গল্প অবলম্বনে ‘বেহুলা’, ‘বিছন’ আর ‘অগ্নিগর্ভ’। জঙ্গল রক্ষার স্বার্থে জঙ্গলেরই ‘আদি-বাসিন্দা’ (The First Settlers) আদিবাসীদের সরকারি ফৌজ বন্দুকের মুখে খেদিয়ে দিতে আসে, রুখে দাঁড়ায় বসাই টুডু; ফৌজের হাতে গুলি খেয়ে মরে (নাটক ‘অগ্নিগর্ভ’)। কিন্তু রাত পোহালেই শোনা যায়, বসাই নাকি মোটেও মরেনি, অমুক গ্রামে বসাই টুডু লুকিয়ে আছে। আবার জঙ্গল দাপিয়ে ছুটে যায় ফৌজ, আবার চলে বন্দুক, বসাই টুডুর বুক ফুঁড়ে দেয় সরকারি বুলেট...কিন্তু বসাই টুডুকে মারা যায় না, পরের দিন আবার জঙ্গলের আরেক কোণে শোনা যায় ফিসফাস – “বসাই টুডু মরেক লাই !” আমার চেতনাচৈতন্য ভরে দিয়ে গেল এইসব এবং আরো কত নামী-অনামী দলের কত নাটক, কত শিল্পীর কত গান, কত কবির কত কবিতা, কত লিটিল ম্যাগের কত চমকে দেওয়া লেখা - সকলের কথা একটুখানি করে বলতেও যে স্মৃতির জোর দরকার তা আমার অটুট থাকলেও আমার কলমের সে জোর নেই। মোটকথা আর যাই হোক, সেই সময় সকালে খবরের কাগজ খুললেই ভালো লাগুক আর খারাপ লাগুক, শাসকের বদান্য হাসিমুখের ছবি দেওয়া পাতাজোড়া বিজ্ঞাপন দেখা যেত না, কোথায় যেন একটুখানি রুচিবোধ যা আমাদের উত্তরাধিকারে প্রাপ্ত তা এই সব স্থূলতার পথ আটকে দাঁড়াতো। রাজনৈতিক নেতানেত্রীদের প্রমাণ সাইজের কাটআউটের চল এ প্রদেশে ছিল না, ওটা ছিল দক্ষিণের রাজ্যগুলোর একচেটে ব্যাপার, অবশ্য দ্রুতই তা আর্যাবর্ত্মে সংক্রামিত হয়। ইতোমধ্যেই ঘাঁটি-গেড়ে বসা বোধবুদ্ধি-রুচিতে আজকের এই স্থূল প্রদর্শনী বড্ড অশ্লীল লাগে।
তবু সেই আলোর দিনগুলোর নীচে কি একটু একটু করে জড় হচ্ছিল না চাপ-চাপ অন্ধকার ? কষ্টার্জিত স্বাস্থ্যসৌষ্ঠবের পরিতৃপ্তির আড়ালে বাসা বাঁধছিল না কি গোপন ক্ষয় ? সব জলধারা পড়িমড়ি তুমুল উজানে এসে ঝাঁপ দিলেও তলে তলে বইছিল না কি বিপ্রতীপ ভাটার টান ? প্রথমত সরকারি আনুকূল্য ও তারপরে কিছু ব্যক্তিপুঁজির সন্নিবেশে গ্রুপ থিয়েটারের আড়ম্বর ক্রমশঃ বাড়তে থাকলো। তারপর এলো বিজ্ঞাপন (কালের বিবর্তনে সে শুধু আর হাতে লেখা পোস্টার বা খবরের কাগজের কোণে আড়াই বর্গ ইঞ্চির সাদাকালোতে সীমাবদ্ধ রইলো না), মঞ্চসজ্জার বাহুল্য (একটি নাটকে, নাম মনে আছে তবু ইচ্ছে করেই বললাম না, মঞ্চে দোতলা বাড়ির সেট দেখেছিলাম আকাদেমি মঞ্চে), আলো, ধ্বনি, রূপসজ্জা সবেতেই খরচ বাড়তে লাগলো, এবং বড় কথা হচ্ছে, সে বৃদ্ধি সর্ব ক্ষেত্রে মোটেও স্বাভাবিক নয়। এবং যেখানে তা স্বাভাবিক নয়, সেখানে সে সব এড়ানো খুব বেশি করেই সম্ভব ছিল, কিন্তু সে চেষ্টা করবার পরিশ্রমটি অহেতুক বলে মান্যতা পেতে থাকলো উত্তরোত্তর। টিকিটের দাম সিনেমার টিকিটের সঙ্গে পাল্লা দিতে শুরু করলো, ফলে প্রোসেনিয়াম নাট্য এমনিতে তার সংক্ষিপ্ত গন্ডীকে নিজে নিজেই সর্ব অর্থে আরো ছোট করে আনতে উদ্যোগী হল বললে ভুল বলা হবে না। নাট্য-প্রযোজনায় অর্থের ক্রমবর্ধমান প্রয়োজনীয়তা তাকে এইবারে খোলাখুলি বাজারমুখী করে ফেললো; বাজারের রূঢ় শর্তাবলী যারা মানবে না, তারা হারিয়ে যাবে – আর টিঁকে থাকবার প্রতিযোগিতার ষাঁড়ের লড়াই যে সব সময় নীতিনিষ্ঠ হতেই হবে এমন তো কথা নেই, তাই তার নন্দীভৃঙ্গীর দলও নাট্যাঙ্গণে চুপিসাড়ে সূঁচ হয়ে ঢুকে পড়ে কালে অচিরেই ফাল হয়ে উঠলো। সরকারি অনুদানকে পাখীর চোখ করে শাসকদলের নির্লজ্জ তাঁবেদারি মঞ্চে আমদানি করা শুরু হয়ে গিয়েছিল নব্বই দশকের শেষার্ধ থেকেই। একটু মানবিক গোছের, ‘বেশ-বড়-বংশ’ তবু ‘কাঁধে-ঝোলা-নিয়ে-বস্তিতে-ঘুরে-বেড়ায়’ ও ‘সকল-পাঠ-মন-দিয়া-পড়ে’ মার্কা নায়ক বা পার্শ্বনায়ককে নাটকের শেষাশেষি ‘কমরেড’ নামে ডাকাডাকি এই সময় থেকে ব্যাপকভাবে শুরু হল। মফস্বলীয় নাট্যমঞ্চে যেদিকে তাকাই সব্বাই ‘কমরেড’, ‘কমরেড’-এর পাশে শুধু ‘কমরেড’। ২০১০-এ মফস্বলের একটি নামী নাট্যদলের আয়োজিত নাট্যমেলায় আমি হুগলীর একটি নামী নাটকের দলের এই গোত্রের একটি নাটকের উল্ল্যেখ করতে পারি (এই নাটকটির নামও ইচ্ছে করেই উল্ল্যেখ করলাম না) যাতে নায়ক ক্ষমতাসীন বামপন্থী সরকারের বিরোধী শক্তি যারা কিনা সুন্দরবনের শ্বাপদের চেয়েও ভয়ঙ্কর (কারা তারা ? মুলতঃ শিল্পের খাতিরে বহুফসলী জমির অধিগ্রহণের বিরোধিতা করা কৃষকের মদতদাতার দল) তাদের বিরুদ্ধে দৃঢ় প্রতিরোধ গড়ে তোলবার জ্বালাময়ী আহ্বান জানালেন, সঙ্গে সঙ্গে তাদের বিষাক্ত কীট গণ্য করে পায়ের নীচে পিষে মারবার ভঙ্গীটিও করে দেখালেন মঞ্চের উপর (হায়, সত্তর-ছুঁই-ছুঁই দীর্ঘকায় নাট্যনির্দেশক!)। উল্ল্যেখ থাকে যে, সেই শীতের সন্ধ্যেয় এই নাটকের অভিনয়ের প্রায় দু’ বছর পরে, সেদিনের সেই মদতদাতার নবনির্বাচিত সরকারের এক বিধায়ক নিজ তালুকে সালিশি-সভা ডেকে একই পরিবারের তিনটি ভাইকে “পায়ের তল দিয়ে পিষে মেরে দেওয়ার” কথা সগর্বে স্বীকার করলেন প্রকাশ্য জনসভায়। ওহো, বলতে ভুলে গিয়েছি, ওই হতভাগ্য পরিবারটি শোনা যায় বামসমর্থক ছিল।
তবে আমি যেটুকু দেখেছি, এই জাতীয় স্তাবকতাময় নাট্যোদ্যম সাধারণভাবে ক্ষমতার দু-চার ধাপ উপরে বসে থাকা স্তাবকের পিঠ-চাপড়ানিই বেশি পেয়েছে, সরকারি আনুকুল্য গত দশ-পনেরো বছর মফস্বলীয় যে সব নাট্যদলগুলি পেয়েছে বলে জেনেছি, তাদের নিরানব্বই শতাংশ প্রযোজনাই অতি উৎকৃষ্ট মানের বলেই আমার মনে হয়েছে, যথা বালুরঘাট ত্রিতীর্থের ‘জল’, ‘দেবাংশী’, ইউনিটি মালঞ্চ-র ‘হনুয়া কা বেটা’, ‘ঘুমভাঙ্গার গান’, ইছাপুর আলেয়ার ‘জলরঙে দুর্গা’, কাঁচরাপাড়া ফিনিকের ‘রামচরিত’ ইত্যাদি; বলা বাহুল্য, নাম করবার ইচ্ছে থাকলেও করতে পারলাম না এমন ভালো নাটকের সংখ্যা অগুন্তি। কিন্তু মোটের উপর টিকিট বিক্রি করে প্রযোজনাব্যয় চালাতে হলেও থিয়েটার পণ্য হয়ে উঠবে না, প্রগতিশীল সমাজচেতনা তার ভিত্তি হয়েই রইবে, “আদর্শ”, “ত্যাগ” (কোনো এক বৃহত্তর সামাজিক স্বার্থের উদ্দেশ্যে) ইত্যাদি যা কিছু গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের জন্মের শপথ, তার সবই অমলিন অনির্বাণ রইবে, তেমনটি হওয়ার ছিল না, হয়নি। সে সব কখন যে চুপিসাড়ে ফিকে হয়ে গেল, বুঝতেই পারা গেল না। এতে আর কিছু না হোক, হারিয়ে যেতে বাধ্য থিয়েটারের মুখ্য অভিমুখ – তার প্রাণ, তার সর্বশরীর দিয়ে বলতে-চাওয়ার অথবা বলা-উচিত এমন কথাগুলো। বড় হতে হতে গুরুভার হয়ে পড়ে দহে পড়লে তা থেকে মুক্তি সচেতন প্রয়াস ভিন্ন পারতপক্ষে অসম্ভব, বরং আরো তলিয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক পরিণতি। অগুন্তি নাট্যদলের লোগোয় মুখোসের মোটিফ যেন বাঙ্ময় হয়ে উঠতে থাকলো, আমার অসহায় চোখের সামনে। আর থিয়েটার ? সে যেন রবিঠাকুরের “অমনি কে এক মেয়ে” বামী, যে হাতের প্রদীপটি নিভে গেলে “আকাশ ভরে উঠত কেঁদে, ‘হারিয়ে গেছি আমি’!”
এখানে লিও টলস্টয়ের ‘The Power of Darkness’ নাটকের অনুপ্ররণায় অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নান্দীমুখ-প্রযোজিত ‘পাপপুণ্য’ (১৯৭৮) নাটকের অন্যতম এক অভিনেতার (আজ সত্তর পেরিয়েছেন, তবু মফঃস্বলে অক্লান্তভাবে নাটকের কাজ করে চলেছেন) মুখে শোনা একটি ছোট্ট কাহিনী শোনাতে ইচ্ছে করছে। এই কাহিনীটি নান্দীমুখের ‘পাপপুণ্য’ নাটকের প্রথম প্রদর্শন উপলক্ষে প্রকাশিত পুস্তিকায় লিখেছিলেন স্বনামধন্য নাট্যসমালোচক শ্রীশমীক বন্দ্যোপাধ্যায় (আমার পক্ষে সেই পুস্তিকা স্বচক্ষে দেখা সম্ভব হয়নি, কিন্তু আমি আমার সেই শ্রদ্ধেয় দাদাটির স্মরণশক্তির উপর ভরসা না রাখতে পারবার কোনো কারণ আজও পাইনি)। লিও টলস্টয়ের নাটকটি ১৮৮৬তে রচিত হলেও তার প্রদর্শন ১৯০২ পর্যন্ত নিষিদ্ধ ছিল। ১৯০২-এ কন্সতান্তিন স্তানিস্লাভস্কি তাঁর মস্কো আর্ট থিয়েটারের পক্ষ থেকে এটি প্রথম প্রযোজনা করেন। বিপ্লবের পর মহামতি লেনিন মস্কো আর্ট থিয়েটারে প্রযোজনাটি দেখতে গিয়েছেন, বোধহয় নাটকটির বিষয়ে এটা-সেটা নানা বিরূপ মন্তব্যে (কি ধরণের মন্তব্য তা আন্দাজ করাই যায়, নাটকটি সমাজতন্ত্রবিরোধী, পার্টিবিরোধী) কিছুটা প্রভাবিত হয়েই নিজের চোখে দেখতে গিয়েছেন ব্যাপারখানা ঠিক কি। মনে মনে ভেবে রেখেছেন, নাটকখানা আধাআধি দেখলেই বুঝে যাবেন নাটকের সারাৎসার, ফলে বিরতিতেই বেরিয়ে পড়বেন পার্টির জরূরী মিটিংএ যোগদান করতে। কিন্তু, নাটকের মাঝামাঝি আর উঠতে পারলেন না, সে নাটকের অমোঘ আকর্ষণে বসে বসে পুরোটা দেখতে বাধ্য হলেন লেনিন। পুরো নাটক দেখে লেনিনের মুখমন্ডল রক্তলাল, চকচকে টাকে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। লেনিন যেন ঘোর বিচলিত। নাটক শেষে পরিচালকের (স্তানিস্লাভস্কি অথবা নেমিরোভিচ দানচেঙ্কো, আমি নিশ্চিত নই) সঙ্গে সাক্ষাত করতে লেনিন গ্রীনরুমের সামনে এলেন। শশব্যস্তে ভেতরে খবর গেল। অল্পক্ষণ বাদে গ্রীনরুম থেকে বেরিয়ে এসে পরিচালক দেখেন, লেনিন প্রশস্ত করিডোরে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক দ্রুতগতিতে অত্যন্ত অস্থির পায়ে পায়চারী করছেন। তাঁর ভাবভঙ্গিমা এক ঝলক দেখে যেন মনে হয়, সোভিয়েতের সর্বময় কর্তা ভয়ানক বিরক্ত ও ক্রুদ্ধ। কিন্তু নাট্যপরিচালককে দেখামাত্রই দ্রুত এগিয়ে এসে তাঁকে আলিঙ্গন করে সহাস্যে লেনিন আন্তরিক ও আপ্লুত কন্ঠে বললেন, - ‘আমরা রাশিয়ানরা সৌভাগ্যবান যে আমাদের টলস্টয় আছেন (টলস্টয় মারা যান ১৯১০এ)। আপনাকে অভিবাদন, আপনি দয়া করে এ নাটক বন্ধ করবেন না’। আজকের ‘গেম থিয়োরী’-র পরিভাষায় লেনিনের এই উক্তি যে লেনিন তথা সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির একটি ‘উইন-উইন স্ট্র্যাটেজি’ সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ যুক্তিবাদী মানুষের মনে থাকা উচিত নয়। তাই, আমাদের বাংলায় ‘উইঙ্কল-টুইঙ্কেল’ নাটক প্রদর্শনে বাধা সৃষ্টি বা ‘পশুখামার’-এর অভিনয় ঠেকাতে যাওয়া এক নতুনতর সংস্কৃতির জন্ম দিল, বর্তমানে যার পরিবর্ধিত ও পরি(অ)মার্জিত সংস্করণের ঠেলায় শোনা যাচ্ছে একান্ত নাট্য-স্বজন ভিন্ন নাট্যের অন্যান্য লতায়-পাতায় আত্মীয়রা মোকাম কোলকাতায় কেউ কলকে (অর্থাৎ, প্রেক্ষাগৃহ) পাচ্ছেন না, আর তরুণ মজুমদারের মত চলচ্চিত্র পরিচালককে স্টুডিও পেতে চেন্নাই-হায়দ্রাবাদ ছুটতে হচ্ছে।
বাদলবাবু আগেভাগেই তাঁর থিয়েটারকে এই সব বেড়ি পরাবেন না বলে ঠিক করে নিয়েছিলেন, তাঁর থিয়েটার দেখতে দক্ষিণা লাগে না, বাদলবাবুর “ফ্রি থিয়েটার” অবারিত দ্বার। থিয়েটার মানুষের ক্রিয়া, তাই নাট্যপ্রদর্শনে কুশীলব ও দর্শক – উভয়ের মধ্যে সম্পর্কটি মানবিক হওয়া আবশ্যক। ফ্রি থিয়েটারে অভিনেতা বিক্রেতা নন, দর্শকও ক্রেতা নন। এই থিয়েটারে দর্শক ক্রেতার প্রত্যাশা নিয়ে আসে না, অভিনেতারও বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে নিজের কথা বা আদর্শ বিকৃত করবার প্রয়োজন ওঠে না। বাদলবাবু অবশ্য “দক্ষিণাহীন” থিয়েটার মাত্রেই যে “মুক্ত” (Free) হবেই, তেমনটি কোথাও বলেননি, মানেনওনি। বরং তাঁর কথাতেই বলি, “আর্ট যদি ফ্রি না হয়, তবে আর্টিস্টও ফ্রি হতে পারে না”। ফ্রি বলতে নিশ্চিত শুধু “দেখাশোনা ফ্রি” বোঝানো হচ্ছে না। বাদল সরকারের মতে তাঁর তৃতীয় থিয়েটার সেই সর্বাঙ্গীন অর্থে ফ্রি বা “মুক্ত” হয়ে উঠতে সক্ষম। তাঁর মতে যে মহামুক্তির মোক্ষ প্রথাগত সীন-টানা নাট্যমঞ্চে লাভ অসম্ভব; খোলা মাঠে, জনবহুল চৌকে, রাস্তার পাশে বা অঙ্গনমঞ্চের তৃতীয় থিয়েটারে তা অর্জন করা সম্ভব - যা সুলভ, বহনযোগ্য এবং যেখানে প্রবেশমূল্যজনিত নিয়ন্ত্রণ নেই। “মুক্ত” থিয়েটারের প্রথম শর্ত অভিনেতা ও দর্শকের সত্তায় সত্তায় মেলবন্ধন। চারপাশের সমাজের প্রতিদিনকার মুখোসপরা চেহারাগুলোকে নিজের মুখের (নাকি, সেও আরেকটি মুখোস ?) উপরে চরিত্রানুগ মুখোস এঁটে প্রতিভাত করতে গেলে সে শ্রেষ্ঠতম সেতূবন্ধন অসম্ভব, কারণ সেক্ষেত্রে যোগাযোগ যা কিছু ঘটছে (যদি আদৌ ঘটে) তা মুখোসের সঙ্গে মুখোসের। মানবসত্তার সঙ্গে মানবসত্তার নয়। তাহলে মুখোসপরা অভিনেতা মুক্ত থিয়েটারে অচল পয়সা, মুক্ত থিয়েটার মুখোসের অপসারণ দাবী করে। মুখোস সরে গেলে মানুষের স্বভাব বেরিয়ে পড়ে, সে প্রকাশ অতিমুক্ত, সৎ। নাটকের বিষয়ের অভিঘাত একান্ত নিজস্ব স্বভাবে যে তরঙ্গ তুলবে, তখনই তার প্রকাশ হবে স্বতঃস্ফূর্ত, অবিমিশ্র। অভিনেতার অন্তরতম প্রকাশে দর্শকেরও আবডাল খসে যাবে, ফলে “সেইখানে যোগ তোমার সাথে আমারো”। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই চরমতম বা তীব্রতম মেলবন্ধনের পথটি কি ? অভিনেতাকে কিভাবে এই অনাবিল অকপট প্রকাশ রপ্ত করতে হবে ? শিল্পমাত্রেই শিক্ষণ দাবী করে, এ মুক্ত থিয়েটারে অভিনেতাকে শিখতে হবে ‘বিয়োজন’ – বিয়োগ-করা। সমাজের নানান বিধিনিষেধের গন্ডীবদ্ধতায় অভিনেতার আপন সত্তা হারিয়ে যেতে বসেছিল, সেই আরোপিত মনস্তাত্ত্বিক বাধাগুলোকে বিয়োগ করে করে অভিনেতাকে বার করে আনতে হবে তার স্ব-ভাব, তার আপ্তসার। তবেই নাটকের মুখোমুখি হয়ে, তাকে আত্মস্থ করে তার নাট্যবিষয়ের চলনের অভিঘাতে স্বতোৎসারিত অনুভূতির অনাবিল প্রকাশ সম্ভব হবে, এবং সেটাই ‘মুক্ত’ থিয়েটারের মূল চালিকাশক্তি। তৃতীয় থিয়েটারের নাট্যায়নই শুধু নয়, নাট্যরচনাতেও এই শিক্ষাকে আধার করতে হয়, নয়তো থিয়েটারের অনেকখানি সম্ভাবনা অধরা থেকে যায়। এ হেন ‘মুক্ত’ থিয়েটারের তপস্যা দুনিয়ার নানান জায়গায় নানা নামে নানা প্রকরণে হয়ে চলেছে বিগত ছয়-সাত দশকের বেশি সময় ধরে। জুডিথ মলিনা-জুলিয়ান বেকের লিভিং থিয়েটার (বাদলবাবু শুনেছি এঁদের ওয়ার্কশপ করে এসেছিলেন মার্কিন দেশ থেকে), জোসেফ চাইকিনের দ্য ওপেন থিয়েটার থেকে নোবেলজয়ী দারিও-ফো; অগুস্তো বোয়ালের ফোরাম থিয়েটার – নিপীড়িতের নাট্য, যেখানে দর্শকও সময় সময় অভিনেতা হয়ে ওঠে (Spect-actor) – অতি চিত্তাকর্ষক সেই অন্বেষণ।
সে সব না হয় হল, কিন্তু এই বড় অর্থের “ফ্রি”টা নিয়ে গোল বাঁধছে। ধাঁধা লাগছে ওই “মুক্ত” কথাটায়। একপক্ষ যেখানে কৌশলের পর কৌশল ‘যোগ’ করে, ধাপে ধাপে আয়ত্ত্ব করে কিভাবে মঞ্চে দাঁড়াবে, চলাফেরা করবে, স্বরক্ষেপ পদ্ধতি কি হবে, কোন ভাবানুভূতিতে কেমনতর শারীরিক ভঙ্গী হবে – কিভাবে নাট্যকার বিরচিত নাটকের ‘টেক্সট’ থেকে ‘সুপার-টেক্সটে’ যাওয়া যাবে এবং তার ভিত্তিতে চরিত্রটাকে কিভাবে বিশ্বাসযোগ্য করে প্রকাশ করা যাবে; এবং এ প্রকাশপ্রক্রিয়ার পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতেই থাকবে, নতুবা দর্শকের থেকে সচেতন বিযুক্তি (alienation) সম্ভব হবে না, আর সেটা না হলে অভিনয়-মারফত দর্শকসত্তার পূর্ণ অধিগ্রহণ অসম্ভব। অন্যপক্ষ সেখানে তথাকথিত ‘বিয়োগ’ পদ্ধতির কথা বলে। দর্শকসত্তার সঙ্গে যোগ সংস্থাপনের এই দুই বিপরীতমুখী প্রণালীর সংঘাত কি অবশ্যম্ভাবী ? নাকি দু’টি প্রণালী শেষে গিয়ে একই শীর্ষবিন্দুতে মিলিত হতে পারে, অন্তত হওয়াটা আশ্চর্য নয় ? প্রোসেনিয়াম থিয়েটারের অপেক্ষাকৃত ভারিক্কী হয়ে পড়াটা সে ‘মুক্ত’পথে হাঁটবার অন্তরায় ঠিকই, কিন্তু এ কথাও একই সঙ্গে সত্য যে সেটা মোটেও অনিবার্য ছিল না। খানিক অপব্যবহার আর অনেকখানি পার্থিব নানান ইন্দ্রিয়ানুভূতি ও লিপ্সা তাকে বাজারে এনে দাঁড় করিয়েছে। কিন্তু তাতে সে নিজে বাজারী হয়ে যায় নাকি ? নাকি তার মধ্যে এমন কোনো জন্মগত পাপ আছে যাতে তার বাজারে না এসে অন্য উপায় ছিল না ? তেমন তো মনে হয় না। কিছু প্রোসেনিয়াম নাটকের কথা এই লেখার শুরুতে বলেছি, আরো অনেক অনেক বলতে পারিনি, তার বেশিরভাগেই সমাজসত্তার গভীরতম প্রকাশে অন্তত প্রচেষ্টায় কোনো ভেজাল ছিল বলে আমার মনে হয়নি। স্বীয় দৃষ্টির সীমাবদ্ধতা মেনে না নেওয়াটা নিশ্চিত নির্বুদ্ধিতা, আর এটুকু জ্ঞানগম্যি যার থাকে তাকে একেবারে নির্বোধ বলাটা বোধহয় খুব বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। তৃতীয় থিয়েটারের প্রস্তুতিতে কয়েকটি ব্যায়াম, কয়েকটি খেলায় (অত্যন্ত আকর্ষণীয়, নাট্যকলাশিক্ষায় অপরিহার্য বলে আমার মনে হয়েছে) নিশ্চিত কিছু মনস্তাত্ত্বিক বাধা পার হওয়া যায়, স্বভাবগত গুণাগুণের প্রকাশ সহজতর হয়, কিন্তু শুধু তাতে বহুস্তর আর বহুমাত্রিক মানবস্বভাবের উপর আজন্ম সমাজ-আরোপিত পলেস্তারাটা ঝুরঝুর করে খসে যাবে, তেমনটা সত্যি করে সম্ভব হয় কি? শিক্ষার যদিও কোনো শেষ নেই, কিন্তু ওই ফর্মের নাট্যশিক্ষার কয়েকটি ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণের সুত্রে ওই ব্যায়াম বা খেলাগুলোকে আমার স্রেফ শারীরিক কসরত বলে কখনোই মনে হয়নি। তার চেয়েও বড় কথা, কখনো মনে হয়নি ওগুলো একান্ত ভাবে একমাত্র তৃতীয় থিয়েটারেই প্রযোজ্য প্রকরণমালা। বরং মঞ্চাভিনয়ের ক্ষেত্রেও ওগুলো অতি জরূরী প্রশিক্ষণ হতে পারে বলেই আমার মনে হয়েছে। এই ‘ফ্রি’ থিয়েটারে, তা সে যে ফর্মেই হোক, আমি নিশ্চয় অভুক্তের অভিনয়ে নিজে অভুক্ত থেকে নামবো না। তাহলে ফর্ম যাই হোক না কেন, অস্বীকার করাবার উপায় তো নেই যে নাটক শেষ বিচারে মুখোস-পরাই বটে, মুক্তমনন-সঞ্জাত অন্তর্লীন সততা ভিন্ন সেই মুখোসের বিশ্বাসযোগ্যতা আনবার পথও যে নেই, তা মানতেও আপত্তির কোনো কারণ দেখি না। ঠিক এই দৃষ্টিকোণ থেকে থার্ড থিয়েটারের ‘বিয়োগ’ প্রণালীকে আমার অতি প্রয়োজনীয় নাট্যদর্শন হিসেবে মেনে নিতে এতটুকু আপত্তি নেই, কিন্তু কি অর্থে প্রোসেনিয়াম থিয়েটারের সঙ্গে তার পথ উল্টোবাগে চলেছে বিপ্রতীপ কোনো স্বর্গসন্ধানে তা বুঝতে আমি অপারগ, আজও। যে থার্ড থিয়েটারে ভেবেছিলাম জন্মগত ভাবে পরানো আছে প্রগতিশীলতার কবচকুন্ডল; প্রতিবাদ আর প্রতিরোধের অস্ত্র তার হাতে ধরা নয়, বরং তার সমগ্র হাতটাই সমস্ত রকমের সামাজিক পশ্চাদপদতার আর শোষণের বিরুদ্ধে অমোঘ আয়ুধ, আজ তাকেও যে ব্যবহৃত হতে দেখি চুড়ান্ত প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির সমর্থনে।
তাহলে কি দাঁড়ালো ? ফ্রি থিয়েটার কি শেষ বিচারে ফর্মনিরপেক্ষ হয়ে পড়ছে না ? মুক্তমননের মুক্তমানব ব্যতিরেকে ফ্রি থিয়েটারের কল্পনাটা সোনার পাথরবাটির সমতুল মনে হলে খুব অসঙ্গত হবে কি ? আর ইতিহাসের স্থূল গ্রন্থাদির প্রথম অধ্যায় দুলে দুলে মুখস্ত না করেও এটা বলা বোধহয় কঠিন নয় যে, মানবমুক্তির বিজ্ঞানসম্মত কোনো অরাজনৈতিক পথের সন্ধান অদ্যাবধি মানবেতিহাসে নেই। শুধু থিয়েটার, গ্রুপ থিয়েটার, থার্ড থিয়েটার বা ফ্রি থিয়েটার – যে নামেই তাকে ডাকা হোক না কেন, দিনের শেষে তাই সে একান্ত একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়াই হয়ে ওঠে, তার সব স্ফুলিঙ্গের না-ই বা অগ্নিশিখায় উত্তরণ হল। এ সত্যকে অযথা জাঁকজমকের আড়ম্বর অথবা দৈন্যের অহঙ্কারে লুকিয়ে যে কোনো নাট্যপ্রয়াস তাই মেকী, শস্তা, অন্তঃসারশূণ্য তাৎক্ষণিক চমক ও সমাজবিকাশের পরিপন্থী বলেই নিশ্চিত গণ্য হবে অদূর ভবিষ্যতে। শেষ পাতে আমার সেই চিন্তাশীল বন্ধুর উপলব্ধির কথায় ফিরে আসি। মানবেতিহাস ‘কালীদহে বেনোজলে’ আটকা কভু পড়েনি, সে উত্তরণের পথ খুঁজে নিয়েছে বহু রক্ত-অশ্রু-শ্রম-স্বেদের বিনিময়ে। আর থিয়েটার তো মানুষেরই ক্রিয়া। আজ তাই পথ খোঁজায় ইতিউতি সততার অভাব দেখে হতাশায় গালে হাত রাখিনা, অটুট বিশ্বাস রাখি মানবের অনন্ত শক্তিতে। যে বিশ্বাস হারানো পাপ।
লেখক পরিচিতি: পেশা - কলকাতার উপকন্ঠে একটি কলেজে অর্থনীতির অধ্যাপনা, নেশা - হিমালয় আর থিয়েটার। বাংলায় লেখালেখির অভিজ্ঞতা - না-থাকার মত, ইদানীং দু'চারটি পত্রপত্রিকায় অনিয়মিত কিছু লেখা ছাপা হয় বলে উত্তরোত্তর স্পর্ধা বাড়ছে। তবে সময়ের দাম সম্পর্কে ধারণা না থাকায় উত্তরণ হ'বার নয়। একটা পাহাড়-জঙ্গল জায়গায় হলুদ পাতায় ছাওয়া বনে মরবার ইচ্ছে।
(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।
Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.