অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।


এন জি ও-র খবর

অগাস্ট ১৫, ২০১৮

 

স্বয়ম্ভর গোষ্ঠী প্রকল্প – একটি সম্ভাবনাময় সামাজিক আন্দোলন

মৈনাক রায়

যে বিষয় নিয়ে কিছু লিখবার দায়িত্ব বর্তেছে, সেটা শুরু করতে গেলে কয়েকটি কথা আমাদের একটু স্মরণ করে নেওয়া একান্ত দরকার। যদিও এইসব কথা বা তথ্য আমরা সবাই-ই জানি, তবু তার প্রাসঙ্গিকতা অনস্বীকার্য। তৃতীয় বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় তিন-চতুর্থাংশ মানুষই আন্তর্জাতিক মাপকাঠিতে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। শুধু তাই নয়, এই দরিদ্র জনগোষ্ঠীর প্রায় সত্তর শতাংশই কিন্তু নারী। ধনতান্ত্রিক আর্থিক পরিকাঠামোতে বৈষম্য শুধু অবশ্যম্ভাবী নয়, তা দৃশ্যতঃ ক্রমবর্ধমান। শ্রেণিগত, জাতিগত এমন কি লিঙ্গগত বৈষম্য – সব কিছুতেই আমরা এর প্রতিফলন দেখতে পাই। ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় মূল অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণের সুযোগ সীমিত। এই সুযোগের অভাবের পিছনে একটা বড় কারণ কৃষিতে জমিবন্টন জনিত অসাম্য। এর সঙ্গে যোগ হয় কৃষিতে ধনতন্ত্রের বিকাশ, যা নিরন্তরভাবে সৃষ্টি করে বেকারত্ব, ফলস্বরূপ মানুষ মূল কৃষিকাজ থেকে বিচ্যুত হয়ে নিক্ষিপ্ত হয় অসংগঠিত ক্ষেত্রে। শিল্পক্ষেত্রে আরো মুনাফা লাভের ঝোঁকে ক্রমাগত বাড়তে থাকে শিল্পে নিয়োজিত পুঁজির আধিপত্য, আর আরো মানুষ বাধ্য হয় বেকারত্বের কবলে পড়তে, শেষ পর্যন্ত এদেরও ঠাঁই মেলে সেই অসংগঠিত ক্ষেত্রে। বাধ্যতামুলকভাবে অসংগঠিত ক্ষেত্রে জড়ো-হওয়া এই বিপুল জনতা কোনোক্রমে বেঁচে-বর্তে থাকবার লড়াই চালিয়ে যায় – কেউ ফিরিওয়ালা, কেউ বা অন্যান্য নানা নিম্ন-আয়ের পেশায়। এদের কয়েকজনের কথা শুরুতেই একটু জেনে নিই।

সবিতা পারুই (নাম পরিবর্তিত), সাকিন গাববেড়িয়া (দক্ষিণ ২৪ পরগণা) – এঁর কথা দিয়েই শুরু করা যাক। নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়ে, জরির কাজে পারদর্শী। বাণিজ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে সফল ভাবে এই কাজ করে পরিবারের আয় সামান্য বাড়াবার জন্য তার প্রয়োজন ছিল যৎসামান্য অর্থের, মাত্র পাঁচ শত টাকার। কিন্তু কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানই তাকে তার সামান্য ঋণের চাহিদা পূরণ করেনি। করবেই বা কি করে, ব্যাঙ্কের কাছে গ্রহণযোগ্য কোনো ‘বন্ধক’ই সবিতার পক্ষে যে দেওয়া সম্ভব ছিল না। কাঁচা মাটির বাড়ি, সামান্য বাসনপত্র – এসব কি ব্যাঙ্কের পক্ষে বন্ধক রেখে তার বিনিময়ে ঋণ দেওয়া সম্ভব? এছাড়া ঋণদানের জন্য সবিতার নামে ব্যাঙ্কে খাতা (Account) খুলতে হবে, পাঁচশো টাকার ঋণের খাতা (Loan A/c) চালু রাখার জন্য ব্যাঙ্কের যা চালন-ব্যয় (operational cost), ব্যাঙ্কের কাছে এই স্বল্প ঋণের সুদ থেকে তা কখনো লাভজনক হতে পারে না। ফলে বাণিজ্যিক ব্যাঙ্ক বা প্রাতিষ্ঠানিক অর্থিক সংস্থার দরজা সবিতার জন্য বন্ধ। সবিতা তাই বাধ্য হয়ে ছিল মহাজনের কাছ থেকে পাঁচশো টাকা ঋণ নিতে। শর্ত ছিল, প্রতিমাসে পঞ্চাশ টাকা করে পাঁচ বছর ধরে তাকে ঋণ শোধ করতে হবে! এ হেন সবিতার সঙ্গে এই নিবন্ধকারের দেখা হয়েছিল সবিতা এই অকল্পনীয় শর্তে পাঁচশো টাকা ঋণ নেওয়ার দু’ বছরের মাথায়। জানি না, সবিতা কবে তার ঋণ শোধ করে উঠতে পেরেছিল! একই রকম গল্প মর্জিনা বিবির, সবজী বিক্রি করতো, পুঁজির অভাব মেটাতে একহাজার টাকা ধার নেয় মহাজনের কাছ থেকে। প্রতিমাসে একশো টাকা করে ধার শোধ করে গেছে, তিন বছরের মাথায় ওর সঙ্গে দেখা – তখনও তার ঋণ শোধ হয়নি! সে বলতেও পারেনি, আর কতদিন তাকে এই বোঝা টানতে হবে, ‘ঋণ পরিশোধ’এর বোঝা! এমন অসংখ্য মানুষ আছে, সবার গল্প মোটামুটি একই রকম। তাই দীর্ঘতর করছি না এই বিবরণ।

এর থেকে সহজে যেটা উঠে আসে তা হলো - তৃতীয় বিশ্বের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী অসংগঠিত ক্ষেত্রে কোনোভাবে দিন-গুজরান করছেন, এঁদের অনেকের যেমন ঋণের প্রয়োজন, তেমনি অনেকেই আছেন যাঁরা তাঁদের যৎসামান্য আয়ের একটা অংশ, তা সে যতো ক্ষুদ্রই হোক না কেন, ব্যয় না করে ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করতে চান। কারুর সে ক্ষমতা হয়তো মাসে পঞ্চাশ টাকা, কারুর বা একশো টাকা। কিন্তু এই ক্ষুদ্র সঞ্চয়েও উৎসাহ প্রদান করতে প্রাতিষ্ঠানিক আর্থিক সংস্থা অপারগ একই কারণে – এই যৎসামান্য সঞ্চয়ের জন্য বাণিজ্যিক ব্যাঙ্ক খাতা (Savings A/c) খুলতে আগ্রহী নয়, কারণ সেই চালন-ব্যয় – ফলে উৎসাহের অভাবে এই স্বল্প সঞ্চয় তার গতিশীলতা অর্জনে ক্রমশঃ ব্যর্থ হওয়াই স্বাভাবিক ভবিতব্য। ফলে গরীব-গুর্বো মানুষগুলো কোনোদিক থেকেই উত্তরণের কোনো পথই পাচ্ছিল না।

এর অপর দিকে নিজস্ব নিয়মে অল্পবিস্তর প্রায় সমস্ত বিশ্বে ধনতন্ত্রের দুর্বলতা ও সঙ্কট প্রকাশ পাচ্ছিল। এর একটা বড় কারণ ক্রয়ক্ষমতার সঙ্কোচনে ক্রেতার সংখ্যা ছিল ক্রমহ্রাসমান, ফলে সৃষ্টি হচ্ছিল ‘চাহিদার অভাব’ (Deficiency in Demand)। আর এই ‘চাহিদার অভাব’এ আবার বিনিয়োগের চাহিদায় ভাঁটার টান দেখা যাচ্ছিল। ব্যাঙ্কে সঞ্চিত সম্পদ বিনিয়োগের চাহিদার অভাবে সৃষ্টি করছিল আরেক সঙ্কট। এই অবস্থায় ব্যাঙ্কের অস্তিত্বের প্রয়োজনেই বিনিয়োগের চাহিদা বৃদ্ধির প্রয়োজন হয়ে দাঁড়াল অগ্রাধিকার। কিভাবে ধনতন্ত্রের এই সঙ্কট থেকে ব্যাঙ্ক-ব্যবস্থাকে বের করে আনা যায়, সেই চিন্তাই বড় হয়ে দাঁড়ালো অর্থনীতিবিদদের কাছে।

প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাঙ্ক-ব্যবস্থা একটা সময় বুঝতে সক্ষম হলো যে, ক্ষুদ্র ঋণের ব্যক্তিগত চাহিদা যত স্বল্পই হোক না কেন, তার সামগ্রিক পরিমাণ মোটেই ফেলনা নয়। কোনোভাবে যদি এই ক্ষুদ্র ঋণের বাজার দখল করা যায় তাহলে হয়তো বের হয়ে আসা যাবে ওই সঙ্কট থেকে যার কথা একটু আগেই আলোচিত হয়েছে। কিন্তু তাতে আবার বাধ সাধছে দু’টি বিষয়; প্রথমতঃ, ঋণদানকারী ব্যাঙ্কের ঝুঁকির সমস্যা, মূলতঃ ঋণ-গ্রহীতার কাছে গ্রহণযোগ্য ‘বন্ধক’এর (Collateral) অভাব; এবং দ্বিতীয়তঃ, চালন-ব্যয় জনিত অলাভজনক পরিস্থিতি। এই জোড়া সমস্যা সমাধানে অর্থনীতিবিদগণ এক নতুন দাওয়াই-এর সন্ধান দিলেন আর তা হলো ব্যক্তিগত ঋণের পরিবর্তে গোষ্ঠীকে ঋণদান, যা ঋণপ্রদানের ক্ষেত্রে স্বল্পতাজনিত অলাভজনক পরিস্থিতি থেকে ব্যাঙ্ককে উদ্ধার করতে সক্ষম হবে। এক্ষেত্রে একজনের ব্যক্তিগত ঋণের পরিমাণ যদি এক হাজার টাকা হয়, তাহলে তা হয়তো ব্যাঙ্কের কাছে উৎসাহব্যঞ্জক প্রস্তাব নয়। কিন্তু ওই একই দৃষ্টিকোণ থেকেই দশজনের গোষ্ঠীর জন্য দশ হাজার টাকা ঋণের চাহিদার প্রস্তাব অনেক বেশি উৎসাহব্যঞ্জক। শুধু তাই নয়, গোষ্ঠীর ক্ষেত্রে “peer pressure” ভীষণভাবে কার্যকরী হবে যা ঋণদানকারী ব্যাঙ্কের ঝুঁকির পরিমাণ কমিয়ে আনতে পারবে। এবং এই গোষ্ঠীগত “peer pressure” ব্যক্তিগত ‘বন্ধক’এর চেয়ে অনেক বেশি কার্যকরী ‘বন্ধক’এর ভূমিকা পালন করতে সক্ষম। অন্যদিকে স্বল্পসঞ্চয়ের সমষ্টিগত পরিমাণও খুব কম হবে না, গোষ্ঠীর সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে উৎসাহপ্রদানের মাধ্যমে ঋণ পরিশোধের বিষয়টিও সুনিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

এই বন্দোবস্ত একদিকে যেমন ব্যাঙ্কগুলির আর্থিক স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারবে, তেমনি গোষ্ঠীগুলির সদস্যদের আয়বৃদ্ধির প্রক্রিয়াটিকেও গতিশীল করতে সাহায্য করবে। এ হেন আয়বৃদ্ধি আবার অচিরেই বিশ্ববাজারে দ্রব্য-সেবার চাহিদা বর্ধনে সহায়ক হবে। এই বাস্তবতা বুঝতে খানিকটা সময় নিলেও শেষ অবধি এই পথেই প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাঙ্ক-ব্যবস্থা যাত্রা শুরু করলো, তবে একটু অন্যভাবে। তৃতীয়পক্ষের সাহায্যে ব্যক্তি-গোষ্ঠী ও ব্যাঙ্ক নিজেদের মধ্যে গাঁটছড়া বাঁধলো। শুরু হলো এক নতুন অধ্যায়। বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান উৎসাহী হয়ে পড়লো এই গোষ্ঠীগুলির কাজে। ভারতবর্ষেও NABARD এর নেতৃত্বে শুরু হলো গোষ্ঠীগঠনে উৎসাহপ্রদান কর্মসূচী। এদেশে এইসব গোষ্ঠীর নাম দেওয়া হলো ‘স্বয়ম্ভর গোষ্ঠী’ (Self-Help Group), যদিও কাজটা স্বাভাবিক কারণেই একেবারেই সহজ ছিল না। গোষ্ঠী হলো ব্যক্তিরই সমষ্টি, আর ব্যক্তিদের সমমনস্কতা গোষ্ঠীর সম্বন্ধতার প্রধান উপাদান। এই গোষ্ঠীগুলিতে অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তির সংখ্যা কত হওয়া উচিত, সে নিয়ে বিতর্ক আছে। গোষ্ঠীর আদর্শ সদস্যসংখ্যা নিরূপণ করাও খুব সহজ কাজ নয়। আর ব্যাঙ্ক-ব্যবসায় নিয়োজিত আমলাদের এই সম্পর্কে কোনো পূর্ব-অভিজ্ঞতা থাকাও সম্ভব নয়। এ ছাড়া গোষ্ঠীভুক্ত মানুষদের পারস্পরিক মেলামেশা বৃদ্ধির মাধ্যমে একক মানুষের ব্যক্তিজীবনের চালচলন ও সমবেত জীবনের আদর্শের সংঘাত দূর করে গোষ্ঠীর সম্পৃক্ততা বৃদ্ধির বিষয়টিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর পরে আসে গোষ্ঠীর আয়ব্যয়এর হিসাব সংরক্ষণের মতো পেশাদারী জ্ঞানের প্রসার ও তার সুষ্ঠু ব্যবহার। এই সমস্ত কাজগুলির জন্য প্রয়োজন হয়ে পড়লো একদল পেশাদারী লোকের বা সংস্থার যাদের বলা যায় সহায়তাকারী (Facilitator)। এ ব্যাপারে বিশেষ উৎসাহ নিয়ে এগিয়ে এলো বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা (Voluntary Organizations) ও অসরকারী সংস্থা (Non Government Organizations)। এরা গোষ্ঠীগঠন, হিসাবরক্ষা এবং সর্বোপরি ব্যক্তি থেকে গোষ্ঠীতে উত্তরণের মানসিকতা গঠন ও প্রসারে বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করলো। এই পরিষেবাপ্রদানে উৎসাহ দিতে ব্যাঙ্কও আবার তার সুদের হারে কিছুটা তারতম্য সৃষ্টি করে সহায়তাকারীকে একটি লভ্যাংশ (margin) প্রদানের ব্যবস্থা রাখলো, যার মধ্যে দিয়ে সহায়তাকারীর পেশাদারিত্বকে সুনিশ্চিত করবার ব্যবস্থা হলো, যাতে সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি স্রেফ ‘ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো’-র মতো না হয়ে পড়ে।

১৯৯২ সালে NABARD একটি Pilot Project শুরু করে, সেই সময় মাত্র ৫০০টি গোষ্ঠী নিয়ে শুরু হয় এই প্রকল্প যেগুলিকে বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। ১৯৯৯ সালে ভারত সরকার স্বর্ণজয়ন্তী গ্রাম স্বরোজগার যোজনার মাধ্যমে দারিদ্যসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষকে এর সঙ্গে সংযুক্ত করবার অঙ্গীকার করেন। বিভিন্ন প্রান্তিক গোষ্ঠী যেমন তপশিলী জাতি ও উপজাতির জন্য ৫০% হারে ভর্তুকি ও অন্যান্য আর্থিকভাবে অনগ্রসর মানুষের জন্য ৩০% হারে ভর্তুকি ঘোষণার মাধ্যমে স্বয়ম্ভর গোষ্ঠী গঠন ও প্রসারে প্রবল জোয়ার আসে। ১৯৯২-৯৩ আর্থিক বছরে ২৫৫টি গোষ্ঠী ব্যাঙ্ক ঋণপ্রদানের সঙ্গে যুক্ত ছিল, যাদের সমবেত ঋণের পরিমাণ ছিল ০.২৯ কোটি টাকা। ২০০৫-০৬-এর মধ্যে এইরকম গোষ্ঠীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ালো ২২ লক্ষের বেশি আর ব্যাঙ্ক-প্রদত্ত ঋণের পরিমাণ গিয়ে দাঁড়ালো প্রায় সাড়ে ১১ হাজার কোটি টাকায়!

এইখানে একটি তথ্য উল্লেখ করা একান্ত প্রয়োজনীয় তা হলো, এই সমস্ত স্বয়ম্ভর গোষ্ঠীর সিংহভাগই কিন্তু মহিলা-স্বয়ম্ভর গোষ্ঠী। এর অনেকগুলি কারণ আছে। প্রথমতঃ, উৎপাদনমুখী সম্পদ যেমন জমির মালিকানা থেকে মহিলারা সাধারণভাবে বঞ্চিত। ফলে আয় সৃষ্টির ক্ষেত্রে তাঁদের সুযোগ সবচেয়ে কম। আগেই বলেছি তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র জনতার সত্তর শতাংশই নারী। তাই তাঁদের আর্থিক সক্ষমতা সৃষ্টির বিষয়টি অগ্রাধিকার পাওয়াই উচিত। দ্বিতীয়তঃ, দরিদ্র পরিবারের ক্ষুধা নিবারণের দায় প্রধানতঃ নারীর। ক্ষুধার্ত শিশু মায়ের কাছেই দাবী করে খাদ্য। মহিলারা নানা ধরণের soft skill-এর অধিকারিণী (যেমন চারুশিল্প, মিষ্টান্ন তৈরি, আচার তৈরি, গৃহপালিত পশুপালন ইত্যাদি), সামান্য পুঁজির অভাবে সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তাঁরা তাঁদের পরিবারের আয়বৃদ্ধিতে সাহায্য করতে পারেন না। আবার দেখা যায় দরিদ্র পুরুষ সাধারণভাবে নেশাগ্রস্ত, কিন্তু দরিদ্র নারী তা নয়। ফলে গৃহীত ঋণের সদব্যবহারে তাঁরা পুরুষের তুলনায় অনেক বেশি সক্ষম। এই সত্য পরীক্ষিত ও প্রতিষ্ঠিত। উপরন্তু এও দেখা গেছে, ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রেও মহিলারা অনেক বেশি সচেতন ও দায়বদ্ধ থাকেন, মূলতঃ আত্মসম্মান রক্ষার তাগিদে। গোষ্ঠী-সংঘবদ্ধতা সৃষ্টি ও বজায় রাখবার ক্ষেত্রেও নারীরা পুরুষের তুলনায় বেশি উদ্যোগী। দীর্ঘদিনের বঞ্চিত জীবনে খানিকটা যেন হঠাৎ-করেই-পাওয়া কিছু করবার সুযোগ সদব্যবহারে তাঁরা অনেক বেশি আগ্রহী ও দায়িত্বশীল। এই সমস্ত আপেক্ষিক সুবিধার কারণে মহিলা-স্বয়ম্ভর গোষ্ঠী প্রসারে প্রত্যক্ষভাবে আগ্রহী ছিল ব্যাঙ্ক ও সহায়তাকারী সংস্থাগুলি। সব মিলিয়ে স্বয়ম্ভর গোষ্ঠীর দ্রুত প্রসারে মহিলা-স্বয়ম্ভর গোষ্ঠীর নিরঙ্কুশ প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়। মহিলা স্বয়ম্ভর গোষ্ঠীগুলির সাফল্যও বহুমুখী। পরিবারের আয় ও সঞ্চয় বৃদ্ধি ছাড়াও দেখা গেছে, স্থায়ী সম্পদ সৃষ্টির ক্ষেত্রে (যেমন, চাষের নতুন জমি ক্রয়, বিভিন্ন ধরণের অর্থকরী যন্ত্রপাতী ক্রয়) মহিলা স্বয়ম্ভর গোষ্ঠীগুলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছে। এছাড়া দেখা গেছে অনেক ক্ষেত্রে তাঁরা তাঁদের গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনে NGO-র সাহচর্য্যে শিশুর স্বাস্থ্য-পুষ্টি-শিক্ষার মতো বিষয়গুলিতে সচেতনতা লাভ করেছেন। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে পুরুষের উপর পু্রোপুরি নির্ভর না করে নিজেরাই এগিয়ে এসেছেন। স্বয়ম্ভর গোষ্ঠীগুলির সদস্যাদের পরিবারে দারিদ্র্যের প্রকোপ মোটের উপর অবিশ্বাস্য হারে কমেছে। বিভিন্ন সমীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে, সচেতনতা বৃদ্ধি ও ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে স্বয়ম্ভর গোষ্ঠীগুলির সঙ্গে যুক্ত পরিবারগুলি অন্য পরিবারের তুলনায় অনেক বেশি এগিয়ে গিয়েছে। বলতে দ্বিধা নেই যে, এই স্বয়ম্ভর গোষ্ঠী প্রকল্পের অগ্রগতির ফলে, বিশেষতঃ নিয়োজিত অসরকারী সংস্থাগুলির স্বেচ্ছাসেবকদের নিরলস প্রচেষ্টায় প্রামীন দরিদ্র পরিবারের আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যেই শুধু বৃদ্ধি পায়নি, পাশাপাশি শুরু হয়েছে এক নবতম সামাজিক বিপ্লব।

এবার এই স্বয়ম্ভর গোষ্ঠীগুলির সাফল্যের খতিয়ানটি আরেকটু বিশদে দেখা যেতে পারে। দীর্ঘদিন ধরে স্বয়ম্ভর গোষ্ঠীগুলির কাজকর্মের সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকবার ফলে কয়েকটি বিষয় এই নিবন্ধকারের গোচরে এসেছে। প্রথমতঃ, যা নিয়ে শুরু করা যায় তা হলো – ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে সাফল্য। সংবাদপত্রে প্রায়শঃই দেখি বৃহৎ শিল্পপতিদের ঋণ খেলাপের সংবাদ, কেউ কেউ তাঁদের বিপুল ঋণ শোধের প্রচেষ্টাটুকুও না করে নিরাপদে বিদেশে আশ্রয় নিয়ে থাকেন। অথচ যে প্রান্তিক জনতা তাদের ‘বন্ধক গ্রহণ যোগ্যতা’র অভাবে এতকাল প্রাতিষ্ঠানিক ঋণের আঙিনায় ব্রাত্য হয়ে ছিল, তাদের ঋণ পরিশোধের পরিসংখ্যান রীতিমতো চমকপ্রদ – বহুক্ষেত্রেই তা ১০০%! এমন স্বয়ম্ভর গোষ্ঠীরও সন্ধান পাওয়া গেছে যার সঞ্চিত ক্ষুদ্র-সঞ্চয় এমন পর্যায়ে পৌঁচেছে যে তারা তাদের সদস্যদের ঋণের চাহিদা তাদের গোষ্ঠীগত পুঞ্জীভূত সঞ্চয় থেকেই মিটিয়ে ফেলতে পারছে! এবং, এখানেও বলা আবশ্যক, মূলতঃ মহিলা-স্বয়ম্ভর গোষ্ঠীগুলিই এই জাতীয় সাফল্যের প্রধান দাবীদার। পরিবারের আয়বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও অভূতপূর্ব সাফল্যের সাক্ষ্য রেখেছে মহিলা-স্বয়ম্ভর গোষ্ঠীগুলি যা প্রমাণ করে যে গোষ্ঠী-সদস্যারা যে ক্ষুদ্র-ঋণ নিয়েছেন তা তাঁরা যথাসাধ্য ব্যবহার করেছেন উৎপাদনমুখী বিনিয়োগে। হাঁসমুরগী পালন, সেলাইকল ক্রয়, এমনকি সবজী বা ফুলচাষের মতো কাজে বিনিয়োগ করে তাঁরা যথেষ্ট সাফল্যের স্বাক্ষর রেখেছেন।

নিম্ন-আয়ের এই সদস্যারা যে শুধু তাঁদের পরিবারের মাথাপিছু আয়বৃদ্ধিতে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছেন তাই নয়, সবচেয়ে বড় সাফল্য এসেছে তাঁদের সামাজিক জীবনের মানের গুণগত উন্নয়নে। আর এই ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছে সহায়তাকারী সেই অসরকারী সংস্থাগুলি। উন্নততর জীবনাচরণে শিক্ষা-স্বাস্থ্য-পুষ্টির মতো বিষয়গুলির গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতার প্রসারে এরা যথেষ্ট সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছে। এবং দেখা গেছে, স্বয়ম্ভর গোষ্ঠীর মহিলা সদস্যরা প্রায় সকলেই বুঝতে সক্ষম হয়েছেন আর্থিক ও সামাজিক জীবনে উত্তরণের পথে এই বিষয়গুলির কতখানি জরূরী। তাঁদের দৈনন্দিন জীবনচর্চায় দেখা গেছে এক গুণগত পরিবর্তন। পরিবারের শিশুদের স্কুলে যাওয়া, পুষ্টিকর খাদ্যাভাস, অথবা পানীয়জলের বিশুদ্ধতা ও শৌচকর্মের মতো বিষয়গুলিতে এঁরা স্বয়ম্ভর গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত নয় এমন পরিবারের সদস্যদের তুলনায় অনেক বেশি সচেতন।

পরিবারের অভ্যন্তরে বিভিন্ন ধরণের সিদ্ধান্তগ্রহণের ক্ষেত্রে, এমনকি আর্থিক সিদ্ধান্তগ্রহণের ক্ষেত্রেও এই মহিলাকুল আজ অনেক বেশি অগ্রণী ও স্বাধীন। এক কথায়, ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রেও স্বয়ম্ভর গোষ্ঠীর মহিলা সদস্যরা এগিয়ে গেছেন, এও দেখেছি স্বচক্ষে যে তাঁরা দল বেঁধে গ্রামের পুরুষদের নেশার আড্ডা ভেঙ্গে দিচ্ছেন বা নাবালিকা বিবাহ রুখে দিচ্ছেন। এই ক্ষমতায়নের প্রক্রিয়া কিন্তু চলছে, অনেকটা নীরবে, প্রচারের ঢক্কানিনাদের বাইরে। অর্থাৎ বলা যেতে পারে তাঁরা আর্থিক কর্মকান্ডে নিয়োজিত হওয়ার সুযোগকে ক্রমশঃ বাড়িয়ে চলেছেন, যা সক্ষমতা সম্প্রসারণের (capability enhancement) নিরিখে উন্নয়নের সমার্থক। হয়তো সেই উন্নয়নে বহিরঙ্গের চাকচিক্য তেমন নেই। নেই সশব্দ বিজ্ঞাপন। তবু প্রধানতঃ নিম্নবর্গের পরিবারগুলির এই মহিলারা নীরবে এগিয়ে চলেছেন স্বয়ম্ভর গোষ্ঠীগুলির হাত ধরে। তবে মনে রাখা প্রয়োজন এগুলি যদি সাফল্য হয়ে থাকে, তবে তা এসেছে বহু ঝড়-ঝঞ্ঝা পেরিয়ে, অনেক সংগ্রামের পথ বেয়ে। স্বয়ম্ভর গোষ্ঠীর সদস্য হওয়ার অপরাধে নিজের পরিবারে নিগৃহীত হয়েহেন বহু মহিলা এমন চিত্রও বিরল নয়। শ্বশুর-শ্বাশুড়ি-স্বামী সকলেই সহযোগিতা করা বা উৎসাহ দেওয়া তো দূরস্থান, বরং তাঁদের পথ আটকে দাঁড়িয়েছেন বারবার। স্বয়ম্ভর গোষ্ঠীর সভায় যোগ দিতে যাওয়া এই মহিলাদের কাছে এক সময়ে ছিল রীতিমতো অ্যাডভেঞ্চারের ব্যাপার, পরিবারের বাকি সদস্যদের অগোচরে আসতে হতো সভায়। নিরন্তর সংগ্রাম, সচেতনতা প্রসারে সহায়তাকারী সহযোগী সংস্থার অবিরত প্রয়াস ও সদর্থক ভূমিকার কারণে আজ সে চিত্র বহুলাংশে পরিবর্তিত হয়েছে।

‘ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ডরায়’ – এই প্রবচনটি আউড়ে শেষ করতে চাই। স্বয়ম্ভর গোষ্ঠীর বিস্তারের ফলে কিন্তু শুধুমাত্র পরিবারে যুগ-যুগান্তর চলে আসা পুরুষতন্ত্রের ভিত নড়বড়ে হয়ে যায়নি, অস্তিত্ব সংকটে ভীত পড়েছে মহাজনী কারবারীরাও। নিম্নবর্গের মানুষের আয়বৃদ্ধি এবং তার সাথে সঞ্চয়বৃদ্ধির ফলে এরা বিপদসংকেত পেয়ে গিয়েছে। প্রতিঘাত তারা করবেই, করছেও। অর্থের জোরে ছলে বলে কৌশলে এই প্রক্রিয়াটিকে ধাক্কা দেওয়ার ইঙ্গিত আমরা বহু জায়গায় দেখতে শুরু করেছি। নদীয়া জেলায় একটি নামকরা ও সফল অসরকারী সংস্থার অধীন স্বয়ম্ভর গোষ্ঠীগুলি কোনো এক অজ্ঞাত কারণে সদস্যদের সঞ্চয় গ্রহণ করা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিয়েছে, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের একটি সার্কুলারকে সামনে রেখে। ক্ষুদ্র-ঋণ প্রকল্পে চলে আসছে বহু ব্যক্তিগত পুঁজি, এমনকি অনাবাসী পুঁজিও। এসব নিয়ে ভাববার সময় এসেছে, এক্ষুণি যথাযথ গুরুত্ব সহকারে এগুলোর ফলাফল বিশ্লেষণ করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নিলে এই সমগ্র প্রক্রিয়াটির অঙ্কুরেই বিনষ্ট হওয়া অবশ্যম্ভাবী।


লেখক পরিচিতি: কোলকাতার উপকন্ঠে একটি কলেজে অর্থনীতির অধ্যাপক। নানা পত্রপত্রিকায় অর্থনীতি ও সমাজনীতি বিষয়ে নিয়মিত লিখে থাকেন। স্বয়ম্ভর গোষ্ঠী, ক্ষুদ্র-ঋণ, সামাজিক ক্ষমতায়ন দীর্ঘদিনের আগ্রহ ও গবেষণার ক্ষেত্র।

 

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.