অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।


এন জি ও-র খবর

অগাস্ট ১৫, ২০১৮

 

উত্তর আমেরিকায় নারীবাদী সংগঠন – মানবী

শমীতা দাশ দাশগুপ্ত

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মহিলাদের জন্যে পারিবারিক নির্যাতন বিরোধী সংস্থা প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৭০ দশকের শেষে, নির্যাতিত মহিলা এবং তাঁদের সমর্থকদের প্রচেষ্টায় ও উৎসাহে। পরিবারের মধ্যে থাকলে যে নির্যাতিত মহিলাদের প্রাণসংশয় হতে পারে, তাঁদের জন্যে সেই সময়েই মিনেসোটা রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল গোপন আবাস (শেল্টার)। কোন আর্থিক সামর্থ্য ও সমাজের সমর্থন ছাড়াই সংস্থাগুলি চলত নারীবাদী সদস্যদের আত্মোৎসর্গ আর নারী-প্রতিরক্ষার অদম্য দায়িত্ববোধে। ক্রমে সেই অবস্থার অনেক পরিবর্তন ঘটেছে।

ভারত, তথা দক্ষিণ এশিয়া থেকে মার্কিন দেশে জোরদার অভিবাস আরম্ভ হয় ষাটের দশকে, ১৯৬৫ সালে ইমিগ্রেশন-আইন পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে। দক্ষিণ এশিয় অভিবাসী সমাজের প্রথম দশ-পনেরো বছর কেটেছিল নতুন, অচেনা দেশে স্থিতু হতে। অন্য কোনদিকে মন দেবার কোন অবকাশ তারা পায়নি। আইন অনুসারে যেহেতু শুধু ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, ও বৈজ্ঞানিকদের অভিবাসের ছাড়পত্র দেওয়া হত, মার্কিন দেশে ভারতীয় অভিবাসী সমাজ হয়ে দাঁড়াল উচ্চশিক্ষিত ও উচ্চবিত্ত। তৎকালীন সাংবাদিকরা অর্থনৈতিকভাবে সফল এই বিশিষ্ট সমাজের নাম দিল ‘মডেল মাইনরিটি।’ সেই ইতিবাচক আখ্যায় প্রীত ভারতীয় সমাজ, আভ্যন্তরীন সব রকম সমস্যা লুকিয়ে রেখে, ব্যস্ত হয়ে পড়ল নিজের ‘মডেল’ ভাবমূর্তি বজায় রাখতে। আমরা, যারা ষাটের দশকে অভিবাস নিয়েছি, যারা চারদিক থেকে শুধু সাফল্যের খবরই পেতাম, তাদের ধারণা হয়েছিল অভিবাসী ভারতীয় সমাজে কোন সমস্যা নেই, জটিলতা নেই। আমরা সত্যিই ‘মডেল’ গোষ্ঠী।

এই নিশ্চিন্ততা ধ্বংস হয়েছিল ১৯৮১ সালে, নিউ জার্সির একটি মর্মান্তিক ঘটনায়। ১৪ই ফেব্রুয়ারির দিন, এক ২৭ বছরের মহিলা, দুই সন্তানের মা, তার ২৯ বছরের স্বামীকে খুন করে। দুজনেই ভারতের অভিবাসী। আদালতে মহিলা বর্ণনা করলেন স্বামীর হাতে দৈনন্দিন জীবনে কী অমানুষিক অত্যাচার তাঁকে সহ্য করতে হত। উনি মনে করতেন যে কোন মুহূর্তে উনি প্রাণ হারাতে পারতেন। বিচার শেষে জুরি তাঁকে খুনের অপরাধ থেকে মুক্তি দিল। জুরি সদস্যরা একমত হলেন অত্যাচারে মহিলার ‘সাময়িক উন্মত্ততা’ (temporary insanity) ঘটেছিল। আশ্চর্য, তখন কোন ভারতীয় সংস্থা মহিলাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি। পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন মার্কিন রাজনৈতিক জগতের কর্মী এক বাঙালি মহিলা। এর চার বছর বাদে, ১৯৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় নারীবাদী সংস্থা, মানবী। তবে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে মানবী প্রথম ভারতীয় মহিলাদের সংস্থা নয়। তার আগে দু’একটি মহিলা সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু দক্ষিণ এশিয় অভিবাসী মহিলাদের বিরুদ্ধে পারিবারিক অত্যাচার বন্ধ করার উদ্দেশ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মানবীই প্রথম সংগঠন।

'মানবী'-র লোগো

মানবী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ছ’জন দক্ষিণ এশিয় মহিলা। সৌভাগ্যবশত আমি তাঁদের একজন। প্রতিষ্ঠাতাদের কয়েকজন অভিবাসী আর কয়েকজন শিশুবয়সে এসে মার্কিন মুলুকেই বড় হয়েছেন – চিন্তাধারায় প্রত্যেকেই নারীবাদী। মানবী প্রতিষ্ঠার কারণ ছিল সুচিন্তিত। মার্কিন ‘মেইনস্ট্রিম’ সংস্থাগুলির সঙ্গে কাজ করে আমরা বুঝতে পেরেছিলাম সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্বেতাঙ্গ দল অভিবাসী দক্ষিণ এশিয় সমাজের দাবী কখনই মেটাতে পারবে না। সংখ্যালঘু, ভিন্ন সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর চলার গতি এবং বিশেষ প্রয়োজন সংখ্যাগরিষ্ঠ সংস্থার বোঝার ক্ষমতা বা ইচ্ছে, কোনটাই নেই। এই উপলব্ধি থেকেই দক্ষিণ এশিয় সংস্কৃতিতে নিমজ্জিত মানবীর জন্ম।

মানবীর ভিত্তিতে রয়েছে নারীবাদ। যদিও নির্যাতিত মহিলাদের সর্বাঙ্গীণ সাহায্য করা এই সংস্থার কর্মসূচির একটি অঙ্গ, এর প্রধান লক্ষ্য সমাজের পূর্ণপরিবর্তন। অর্থাৎ শুধু পারিবারিক নির্যাতন বন্ধ করা নয়, জাত, শ্রেণী, বর্ণ, ধর্ম, ক্ষমতার উর্ধে উঠে সম্পূর্ণ নারীসমাজকে ন্যায় ও সমতার মঞ্চে নিয়ে আসাই এর উদ্দেশ্য।

যে অর্থনৈতিক, ধর্মীয়, আইনি, এবং অন্য প্রথা মানুষের সামাজিক অধিকার ক্ষুণ্ণ করে, মানবীর সংজ্ঞায় তাই হল নির্যাতন। নারী-পুরুষের অসম সামাজিক ব্যবস্থার ফলশ্রুতি নারীর যৌন ও শারীরিক অত্যাচার। এই নির্যাতনের কমবেশি শিকার সব মহিলাই। নিঃসন্দেহে যে মহিলারা প্রত্যক্ষ ভাবে শারীরিক ও যৌন অত্যাচারের শিকার হন, তাঁদের প্রয়োজন তাৎক্ষণিক সাহায্য। তবে শুধু এ ধরনের সাহায্য দিয়ে থেমে গেলে সমস্যার সমাধান কোনদিনই হবে না। যে পুরুষপ্রাধান্যের (patriarchy) জন্যে নারী-নির্যাতন সম্ভব হচ্ছে, তা উৎখাত না করতে পারলে একই অবস্থার পুনরাবৃত্তি ঘটবে।

রেভারেন্ড ডেসমন্ড টুটুর মতে ন্যায়পরায়ণ সামাজ গড়তে গেলে তিনটি পদক্ষেপের প্রয়োজনঃ

(১) যে ধরনের সামাজিক ক্ষতি ঘটেছে বা ঘটছে তার সোচ্চার স্বীকৃতি দেওয়া। অর্থাৎ সামাজিক সমস্যা লুকিয়ে না রেখে তা প্রকট করা;
(২) ঘটে যাওয়া সামাজিক ক্ষতি যতটা সম্ভব পূরণ করা; এবং
(৩) যে পরিস্থিতির জন্যে এই ক্ষতি করা সম্ভব হয়েছে তার আমূল পরিবর্তন সাধন, যাতে ভবিষ্যতে একই অবস্থার পুনরাবৃত্তি না ঘটে।

অর্থাৎ সাহায্য/সেবা (service provision) এবং সমাজ পরিবর্তনের (social change) কাজ পাশাপাশি চালাতে হবে।

এই আদর্শ অনুসারে মানবীর কর্মসূচীতে রয়েছেঃ

• পারিবারিক অত্যাচারে আপৎকালীন সাহায্য ও অ্যাডভোকেসি
• যৌন নির্যাতনে সাহায্য করা
• দক্ষিণ এশিয় সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পরামর্শ দান
• দোভাষিক সহায়তা দান
• যানবাহন ও যাতায়তে সাহায্য করা
• নিয়মিত মহিলাদের সাপোর্ট গ্রুপ চালানো
• মহিলাদের আদালতে যাওয়া ও স্বাস্থ্য সংক্রান্ত ব্যাপারে সহায়তা করা
• আইনি সাহায্যের জন্যে নিয়মিত ক্লিনিক চালানো ও উপযুক্ত উকিল নিয়োগে সাহায্য করা
• নির্যাতিত মহিলা ও তাঁদের সন্তানদের জন্যে গোপন আবাস চালানো
• সমাজে নারী অধিকার সংক্রান্ত শিক্ষা শিবির ও কর্মশালা করে নারী নিগ্রহ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো ও প্রতিরোধ গড়ে তোলা
• অভিবাস সংক্রান্ত আইনি সহায়তা দান
• মহিলাদের আন্তর্জাতিক সমস্যায় যথাযথ সাহায্য করা

এছাড়া বিভিন্ন মহিলার বিশেষ সমস্যায় যথাযথ সহায়তা দান মানবীর কর্মসূচীর মধ্যেই পড়ে। সেই জন্যে নানান আন্তর্জাতিক সংগঠনের সঙ্গে মানবী নিয়মিত যোগাযোগ রাখে ও তাদের সঙ্গে সহযোগিতা করে।


লেখক পরিচিতি: লেখক একজন শিক্ষক, গবেষক ও সমাজকর্মী। উত্তর আমেরিকার প্রথম দক্ষিণ এশীয়় পারিবারিক নির্যাতন বিরোধী সংস্থা মানবী-র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। কেতাবি লেখা বই সব ইংরেজিতে। বাংলাতেও পত্র পত্রিকায় লেখেন। বাংলা বই - দ্বন্দ্ব এবং মৃত্যুর মুখ চেনা। যৌথ সম্পাদনা - গোয়েন্দা হাজির ১ ও ২ । অবসর-এর জন্মলগ্ন থেকে উপদেষ্টা মণ্ডলীতে যুক্ত।

 

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.