অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।


এন জি ও-র খবর

অগাস্ট ১৫, ২০১৮

 

শ্রীজা ইন্ডিয়া - ফুটে ওঠার গল্প

শিব শঙ্কর দাশগুপ্ত

কোনো মহিলার সাথে প্রথম কথা বলাটা আমার চিরকালের সমস্যা; বিশেষ করে এই ধরণের ইনফরমাল ইন্টারভিউতে। তাই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে শ্রীজা ইন্ডিয়ার হয়ে ‘রিক্রুট’ করতে গিয়ে বোকার মত একটু তাড়াহুড়ো করেই প্রথম প্রশ্নটা করে ফেললাম।

“আচ্ছা, সুস্মিতা, তুমি অমর্ত্য সেনের ‘ক্যাপেবিলিটি অ্যাপরোচ’ পড়েছ?”

প্রশ্নটা করেই আমার মনে হল কোথায় যেন একটা ভুল হয়ে গেল। মেয়েটি কেমন একটা করুণ মুখ করে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,

“না, পড়ি নি। ওঁর ‘আরগুমেন্টাটিভ ইন্ডিয়ান’ বইটা পড়তে শুরু করেছিলাম কিন্তু সেটাও শেষ করতে পারি নি।“

“না, সেইজন্য তোমায় প্রশ্নটা করি নি“, আমি একটু লজ্জা মুখ করে বললাম।

“আসলে, আমি এনজিও সেক্টরে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি যে সবাই মহিলাদের ‘এম্পাওয়ারমেন্ট’ নিয়ে প্রচুর কথা বলেন। কিন্তু ‘আমরা কি দিলাম’ আর ‘ওরা কি পেল’ এই দেওয়া-নেওয়ার মধ্যে অনেক সময় ‘বেনিফিসিয়ারির’ আসল প্রয়োজনটা হারিয়ে যায়। সেখানে অমর্ত্য সেনের ব্যক্তিগত সুযোগ ও চাহিদার সামঞ্জস্যটা মাথায় রাখার বিশেষ প্রয়োজন আছে।“

সুস্মিতা ডানহাতের কনুইটা টেবিলে ভর করে বলল, “আমার কিন্তু মনে হয় মানুষের ‘বেসিক নীড’টা আগে ব্যবস্থা করে উচিত। সেখানে আপনি ‘এনজিও’ র কাজে সমস্যাটা কোথায় বলছেন ঠিক ধরতে পারছি না।“

আমাকে কেউ আলোচনায় চ্যালেঞ্জ করলে আমার কথা বলার উৎসাহ দশগুণ বেড়ে যায়।

“না, আমার প্রশ্নটা ‘বেসিক নীড’ নিয়ে নয়। একজন ‘ফার্স্ট জেনারেশন লার্নার’ আর সাউথ পয়েন্টের একটি মেয়েকে কি তুমি একই ভাবে পড়াশুনা শেখাবে?”

“অবশ্যই নয়। কিন্তু শিক্ষার প্রয়োজন তো দুজায়গায়ই ‘বেসিক নীড’?”

আমাদের দুজনের যুক্তি দুটো ভিন্ন পথে চলছে। কোন মীমাংসা হওয়া কঠিন। সুস্মিতা ততক্ষণে অমর্ত্য সেন না-পড়ার অস্বস্তিটা কাটিয়ে উঠেছে। ওর অস্বস্তিকর পরিবেশ ম্যানেজ করার স্কিলটা আমার প্রথম দিনই বেশ ভাল লাগল। মারকেটিং-এর কাজে এটা একটা বড় গুণ।

আমি ইন্টারভিউ-এর টপিকটা পাল্টে ফেললাম।

“শ্রীজা ইন্ডিয়া সিউড়ির এক প্রত্যন্ত এলাকা জুড়ে একটা ফুটবল প্রশিক্ষণ চালায়। সেখানে সাঁওতাল মেয়েদের দম ও গায়ের জোর তোমার বালীগঞ্জের মেয়েদের থেকে অনেক বেশি। কিন্তু সেই মেয়েরা অঙ্ক করতে পারে না বা ইংরাজী বলতে/লিখতে পারে না বলে সমাজের মূলস্রোত থেকে তাদের বাতিল করে দেওয়াটা কি অন্যায় নয়?”

“এইভাবে কখনো ভাবি নি। তবে শ্রীজার সম্বন্ধে ‘ফেসবুকে’ যতটা পড়েছি তাতে ‘প্রজেক্ট’টা বেশ ইন্টারেস্টিং মনে হয়েছে।“ সুস্মিতা নিজের টেরিটোরিতে বলটা দক্ষ মিডফিল্ডারের মত কন্ট্রোল করে নিল।

“আচ্ছা, যদি কেউ ফুটবল না খেলে তাহলে শ্রীজা তাকে পড়াবে না?” সুস্মিতা এবার বলটা আমার ডিফেন্স টোপকে সামনে বাড়িয়ে দিল।

“সেটা কিন্তু ভেবে দেখতে হবে। মেয়েটির কোনোরকম শারীরিক সমস্যা আছে কি না। আমরা খেলার মাঠের যৌথ উদ্যোগকে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করতে চাই। ফলে প্রত্যেকটি মেয়ের খেলার মাঠে উপস্থিতিটা কিন্তু ভীষণ প্রয়োজন।“

“মানে আপনি বলতে চাইছেন যে ওই জার্সি, হাফ প্যান্ট আর বুট পরলেই মেয়েদের একটা মানসিক পরিবর্তন আসবে?”

“সেটা দিয়ে শুরু। কিন্তু ওই যে একসাথে ওঠা-বসা, ব্যথা পাওয়া, গোল করে জড়িয়ে ধরা, সাইকেল নিয়ে বাড়ি ফেরা, বাড়ি ঢোকার আগে ফিসফিস করে বলা, ‘কাল মাঠে আসবি তো?’ – এই সমস্ত কিছুর মধ্যেই শ্রীজার মেয়েদের পরিবর্তনের বীজ লুকিয়ে আছে।“

“আচ্ছা, গ্রামের লোকজন মেয়েদের ফুটবল খেলা নিয়ে কোন আপত্তি করে নি?”

“প্রচুর বিরোধিতা আছে। তবে মেয়েরাই সেগুলো সামলে নেয়। আমি একটি মেয়েকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে ওর শ্রীজায় সবচেয়ে ভালো কি লাগে? মেয়েটি মুচকি হেসে বলেছিল, “আমার আগে এত বন্ধু ছিল না। এখন আমার কত বন্ধু। আমি আর কাউকে ভয় পাই না।“”

“আপনি কথাটা ঠিকই বলেছেন। ‘ভায়োলেন্স’ বন্ধ করতে হলে মেয়েদের প্রথমে সংঘবদ্ধ হতে হবে।“ সুস্মিতা সেদিন সন্ধ্যায় প্রথম আমায় সমর্থন করল।

--------------------------------------------

“এই যে, এসে গেছ? আলাপ করিয়ে দি। ওর নাম সুজাতা সরকার। ও গতবছর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় পিএইচডি করেছে।“

“নমস্কার, সুজাতা।”

“সুস্মিতা মুখার্জী । আমি কিন্তু যাদবপুরের ছাত্রী নই; কোনদিনও ছিলামও না।“

“তোমার পিএইচডির টপিকটা কি ছিল যেন?” আমি সুজাতাকে একটা চেয়ার এগিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম।

“বাংলা সাহিত্যে মধ্যযুগের চর্চা, ধারণা ও নির্মাণ।“

“ওরে বাবা, এবার যাদবপুরের লোকজন আমায় মারবে। আমি মধ্যযুগের স্কলারকে দিয়ে মাঠে ফুটবল খেলোয়াড় তৈরি করছি!“

“আপনি তো আগের দিন বললেন খেলোয়াড় তৈরি করা শ্রীজার উদ্দেশ্য নয়! শ্রীজার মাঠে ফুটবল তো একটা সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার মাত্র।“ সুজাতার কথা বলার ধরণটা বেশ কড়া; অনেকটা স্কুলের দিদিমণিদের মত।

আগের দিন যখন প্রথম আলাপ হয়েছিল তখনই ওকে বলেছিলাম, “তুমি আমাদের কলকাতার মাঠের মেনটর হবে?”

সুজাতা এককথায় রাজী।

“আচ্ছা, তুমি শুনলাম এবছর নেট-এ অল ইন্ডিয়া সেকেন্ড হয়েছ? তোমার তো কলেজে এমনিই চাকরী হয়ে যাওয়া উচিত?”

“এটা বিদেশ নয়, শিব দা। এটা পশ্চিমবঙ্গ; এখানে নিয়ম কানুন একটু অন্যরকম।“

“শ্রীজার কলকাতা পুলিশের সাথে পথ-শিশুদের ফুটবল খেলার মধ্য দিয়ে পড়াশুনা ও স্বাবলম্বী করে তোলার একটা উদ্যোগ চলছে। সেখানে শ্রীজার একজন মেনটর প্রয়োজন।“

“কলকাতার কোথায়?”

“পার্ক সার্কাস ময়দানে। সপ্তাহে তিনদিন সকাল ৭টা থেকে ৯টা।“

“কাজটা কি করতে হবে? আমি কিন্তু ফুটবল খেলা শেখাতে পারব না।”

“গরীব ঘরের বাচ্চা মেয়েদের বুকে জড়িয়ে ভালবাসতে হবে। ব্যস, তাহলেই হবে।“

“গতদিন আপনার সাথে কথা বলার পর আমি অনেক ভাবলাম। এই দশ থেকে ষোল বছর বয়েসের মেয়েদের কিন্তু খুব কড়া হাতে শাসন করতে হবে।“সুজাতা খুব গম্ভীরভাবে বলল।

“না, শাসন অবশ্যই করবে তবে বেত মেরে নয়, ভালবাসা দিয়ে। এটাই শ্রীজার ‘মোটো’। আমরা যেসব মেয়েদের নিয়ে কাজ করি তারা বাড়িতে বা স্কুলে কোথাওই ভালবাসা পায় না। শ্রীজার দিদিমণিও যদি তাদের বকা দেয় তাহলে ওরা যাবে কোথায়?”

“না না, আপনি বুঝছেন না, শিব দা…।” সুজাতা ‘অ্যাডামেন্ট’।

“শোনো, সুজাতা, তাহলে তোমায় একটা গল্প বলি। মিউজিক কম্পোজার বেথোফেনের নাম শুনেছ তো? ওঁর কম্পোজিশনে স্টেজ ভর্তি মিউজিসিয়ান বিভিন্ন ধরণের কর্ড বাজায়, অথচ কি অসাধারণ সঙ্গীত ফুটে উঠে। উনি কিন্তু শুধু ডিসিপ্লিন নিয়ে আটকে থাকলে এই সঙ্গীত সৃষ্টি করতে পারতেন না। উনি ডিসিপ্লিনের ঊর্দ্ধে উঠে সঙ্গীত সৃষ্টি করেছিলেন। মজাটা কি জানো? এই সঙ্গীত সৃষ্টি তাঁর পক্ষে করা সম্ভব হয়েছিল কারণ উনি যখন রোজ সকালে রাস্তায় হাঁটতে যেতেন তখন লোকজন ওঁকে দেখে ঘড়ি মেলাত। একটা নির্দিষ্ট ল্যাম্প পোস্ট যখন তিনি পার হতেন তখন ঠিক সাড়ে পাঁচটা বাজে।“

“বুঝলাম, আপনি বেথোফেনের ডিসিপ্লিনকে আত্মীকরণের কথা বলছেন?”

“একজ্যাক্টলি, শ্রীজার মেয়েদেরও এইরকম ডিসিপ্লিনকে আত্মীকরণের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। শুধু ডিসিপ্লিনের জালে আটকে পড়লে ওই প্যাঁ প্যাঁ করে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গাওয়া হবে। কোনদিনও সিম্ফোনি সৃষ্টি হবে না।“

“মানছি আপনার কথা। সিম্ফোনি সৃষ্টি করতে আমি পারব না তবে শ্রীজার মেয়েদের পড়াশুনায় টেনে উপরে তুলে আনতে পারব। এটা কিন্তু পাক্কা।“ সুজাতার কনফিডেন্স আমার প্রথম দিনই খুব ভাল লেগেছিল।

“শ্রীজার মেনটর হিসাবে ওটাই তোমার কাজ।“

“আচ্ছা, আমি শ্রীজার বাচ্চাদের খেলার আগে একটু ধ্যান করা শেখাতে পারি? মনঃসংযোগ ছাড়া জীবনে ওরা কিন্তু কিছুই করতে পারবে না।“

“পার,তবে ধ্যান শব্দটা ব্যবহার না করাই ভালো। শ্রীজার বাচ্চাদের মধ্যে অনেক অ-হিন্দু বাচ্চা আছে। তাদের মধ্যে যেন কোনভাবে বিভেদ সৃষ্টি না হয়। সত্যি কথা বলতে, রবীন্দ্রনাথের ‘আশ্রম’ বা ‘উপাসনা’ শব্দগুলোয় আমার একটু আপত্তি আছে। ভারতবর্ষের ইতিহাসে আমাদের আরও ‘সেকুলার’ ভাবনা কি কিছু নেই?”

“দাঁড়ান, মহাভারতের একটা সংলাপ আছে যার অর্থ করলে দাঁড়ায় ... কুরুক্ষেত্রে শরশয্যায় শায়িত ভীষ্ম পাণ্ডবদের ধর্মরাজ্য স্থাপনের উপদেশ দিচ্ছিলেন। যুধিষ্ঠির ধর্মের স্বরূপ সম্পর্কে জানবার জন্য আগ্রহী হন। তার উত্তরে ভীষ্ম জানিয়েছিলেন যে ধর্মকে যদি কেউ স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্য রূপে ব্যবহার করে তাহলে সেই বংশ, জাতি বা সংগঠনের সমূহ পতন অনিবার্য।“

--------------------------------------------------

“সুস্মিতা, তুমি তো ব্র্যান্ডিং নিয়ে কাজ করেছ? আমাকে একটু বোঝাও তো একটা আইডিয়া কিভাবে ব্র্যান্ডিং করে কাস্টোমারের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়?”

ব্র্যান্ডিং কথাটা শুনে সুস্মিতার চোখদুটো জ্বলজ্বল করে উঠল। একটু মিষ্টি হেসে শুরু করল,

“আসলে সমস্যাটা হয় কোনটা আগে সেটা ঠিক করা। ব্র্যান্ডিং আগে না কাস্টোমার আগে? এই বিতর্কটা অনেক দিনের পুরনো। তবে আমি বলব যে আজকের ডিজিটাল যুগে আপনি ফেসবুকে যে ভাবে শ্রীজা ইন্ডিয়াকে প্রমোট করছেন সেটা যথেষ্ট ‘প্র্যাগমেটিক’। চেনাশুনা লোকজনকে অনুদানের জন্য বলতে থাকুন। কিছু টাকা নিশ্চয়ই আসবে। আর লোকজনের সাথে কথা বলতে বলতে দেখবেন শ্রীজার ব্র্যান্ডিং আপনা থেকেই তৈরি হয়ে গেছে।“

“একটা উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটা বোঝাতে পারবে?” শ্রীজার ব্র্যান্ডিং নিয়ে আমার ভীষণ কৌতূহল।

“এই ধরুন আপনি এবং আপনার দাদা, শ্রীজার দুজন ডাইরেক্টর। আপনারা দুজনেই কোন স্যালারি নেন না। কিম্বা শ্রীজা প্রতি বছর তার অডিটেড অ্যাকাউন্টস সমস্ত ডোনারদের পাঠাবে। এই যে শ্রীজার বিশেষত্ব যা আর দশটা এনজিও র থেকে শ্রীজাকে আলাদা করে তোলে সেগুলোকে পাব্লিকের কাছে বারবার তুলে ধরতে হবে। সেটাই ব্র্যান্ডিং–এর কাজ।“

কলেজের ক্যানটিনে সন্ধ্যার পর ইন্টারভিউ নেবার একটা মজা আছে। ছেলেমেয়েরা খুব সহজভাবে কথা বলতে পারে। আমিও শিং ভেঙে বাছুরের দলে ঢুকে পরার সুযোগ পাই।

“আর কোন প্রশ্ন করার আগে বল চা খাবে না কফি?” হঠাৎ আমার মনটা খুব ‘চা চা’ করে উঠল। আমি তিন কাপ কফি নিয়ে ফিরে আসার মধ্যে সুস্মিতা ওর ডায়েরি বার করে একটা ফ্লো-ডায়াগ্রাম এঁকে ফেলেছে।

“আপনি আমাকে শ্রীজার ফুটবল প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যগুলো একটু বলতে পারবেন?”

“একবছরের মধ্যে আমরা বেশ কিছু স্বাবলম্বী মেয়ে তৈরি করতে চাই। ফুটবল খেলার মধ্য দিয়ে তারা টিম-ওয়ার্ক, লিডারশিপ ও আত্মবিশ্বাসের একটা জায়গা করে নেবে। প্রত্যেকটি শ্রীজার মেয়ে স্বাস্থ্য-সচেতন হবে এবং এইসব কিছুর মধ্য দিয়ে ওরা পড়াশুনা শিখে একটা জীবিকায় যুক্ত হয়ে যেতে পারবে।“

“কিন্তু এই এতসব আয়োজন মূলত কিসের জন্য?” সুজাতার প্রশ্ন।

“হ্যাঁ, এটা ভালো প্রশ্ন করেছ। এই ফুটবল প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে যখন দল গঠন হবে তখনই স্কুলছুট, বাল্যবিবাহ, নারীপাচার এবং মহিলাদের উপর বিভিন্ন ধরণের ‘ভায়োলেন্স’ কমে যাবে।“

“কমে যাবে কেন বলছেন? আমরা কি সমাজ থেকে কোনদিনও ‘ভায়োলেন্স’ বন্ধ করতে পারব না?” সুজাতা ভুরু কুঁচকে এবার প্রশ্ন করল।

“সমাজ পরিবর্তন ঠিক স্বাস্থ্য পরিবর্তনের মত অব্যর্থ নয়। আমি জোর গলায় বলতে পারব না যে মহিলাদের উপর সমস্ত অত্যাচার শ্রীজা বন্ধ করে দেবে।“ সেদিন সুজাতার মুখের দিকে তাকিয়ে আমি এই কথাটা বলতে পারি নি। পুরুষ মানুষ হিসাবে এই লজ্জা আমার কোনদিনও ঘুচবে না।

সুস্মিতা এতক্ষণ সব পয়েন্টগুলো লিখছিল। হঠাৎ মুখটা তুলে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা, শ্রীজার মেয়েরা দেশ বিদেশে খেলতে যাবে না?”

“সেটাও আমি হ্যাঁ বা না বলতে পারব না। কিন্ত আমি তোমাদের কথা দিতে পারি যে যদি কোন গরীব মেয়ে টাকার অভাবে কোন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে পারছে না তার জন্য শ্রীজা যেখান থেকে হোক টাকা তুলে আনবে। এটা শ্রীজার প্রতিজ্ঞা।

সেদিন আর বেশি কথা হয় নি। সাড়ে আটটায় যাদবপুর থেকে লাস্ট এস-৩১। সুস্মিতা বেহালা যাবে। ওকে উঠে পড়তে হল।

ঠিক হল সামনের শনিবার আমরা শ্রীজার অফিসে বসব। পিয়ালী পাল চৌধুরী বলে আরেকজনও আসবে।

“হ্যাঁ, ভাল কথা … শ্রীজায় কতজন লোক কাজ করে?” লাইব্রেরির পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সুজাতা জিজ্ঞেস করেছিল।

“কলকাতায় তোমরা তিনজন; মুম্বাইতে কান্ট্রি হেড বসেন। উনি প্রতিমাসে একবার কলকাতা আসেন। সিউড়ীতে আমাদের দশজন লোক আছে, তারা ওখানকার খেলা ও পড়াশুনা দেখে। এছাড়া আমাদের চারজন ফুটবল কোচ আছে। এতদিন কলকাতায় অপরাজিতা দত্ত বলে কম্প্যারাটিভ-এর একটি মেয়ে দেখাশুনা করছিল। ও এখন ওর পিএচডি ভর্তি নিয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।“

“আর শ্রীজার অফিস যাব কি করে?”

“যাদবপুর থেকে একটা টালীগঞ্জের অটো ধরবে; বিক্রমগড় পার হয়ে মাদারতলা স্টপে নামবে। সেখানে নেমে রাস্তাটা পার হয়ে একশ মিটার আমার বাপের বাড়ি। ওই বাড়ির একতলায় শ্রীজা ইন্ডিয়ার অফিস।“

----------------------------------------------------

“এই যে পিয়ালী, এস। আলাপ করে নাও সকলের সাথে। এই শ্রীজার অফিস আর এই তোমার সব অফিসসাথী।“

“আচ্ছা, পাশের ঘরে অতগুলো ফুটবল বুট কি শ্রীজার মেয়েদের জন্য?”

“হ্যাঁ, ওগুলো আমি নিউ ইয়র্কের বিভিন্ন স্কুল থেকে যোগার করে আনি। শ্রীজার মেয়েরা খেতে পায় না কিন্তু আদিদাস-এর জুতো পরে খেলে।“

“হ্যাঁ, মেয়েদের খাবারের ব্যাপারে আমার কিছু কথা বলার আছে। আমরা খেলার আগে যে ছোলা এবং গুড়টা মেয়েদের দি, সেটা কিন্তু যথেষ্ট নয়। আমার কিছু বন্ধু শ্রীজার মেয়েদের চীনে বাদাম, খেজুর আর কিসমিস দিতে চায়। সেটা কি আমি নিয়ে আসতে পারি?”

“যা করবে সেটা যেন সব মাঠে একই রকম হয়।“ আমি অফিসে একটু গম্ভীর হবার চেষ্টা করলাম।

পিয়ালী ‘নিউট্রিশন’ এবং ‘ওয়েলনেস’ নিয়ে কাজ করে। ফলে শ্রীজার মেয়েদের এখন ক্যালোরি মেপে খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রতিদিন খেলার পর ডিম, কলা ও কেক-এর সাথে মেয়েরা বাড়িতে কি খাবে তার চার্টও করা হচ্ছে।

“পিয়ালী, তুমি কি জানো আমাদের মেয়েরা বাড়িতে কি খায়?” আমি ওকে একটু সতর্ক করবার চেষ্টা করলাম।

“দাদা, আমি বাড়ি বাড়ি এখনও গিয়ে উঠতে পারি নি। তবে খবর নিয়েছি ওরা কি খায়, সারাদিন কি করে। স্বাস্থ্য, পরিচ্ছন্নতা নিয়ে ওরা কি ভাবে।“

“তোমার কি মনে হয় শ্রীজার মেয়েরা খুব স্বাস্থ্য সচেতন হতে পারবে?”

“কেন পারবে না? হাত ধুয়ে খাওয়া অথবা জল ফুটিয়ে খাওয়া, এগুলো তো সব অভ্যাসের ব্যাপার। সবাই যদি রাজী থাকে তাহলে আমি শ্রীজার পনের বছরের উপরে সব মেয়েকে বলতে চাই যে বাড়িতে জল ফোটানোর দায়িত্ব তাদের নিতে হবে। এবং এই কাজের জন্য আমি প্রতিমাসে ওদের কিছু পুরস্কার দিতে চাই।“

পুরস্কারের কথা শুনে সুজাতা হৈ হৈ করে লাফিয়ে উঠল।

“আমিও তো এই কথাটাই ভাবছিলাম। আমার মাঠে মেয়েরা পিরিয়ডসের সময় স্যানিটারী ন্যাপকিন্ ব্যবহার করে না। যারা করবে তাদের কিন্তু একটা কিছু পুরস্কার দেওয়া উচিত।“

“উচিত তো বুঝলাম কিন্তু পয়সা কোথায়?” শ্রীজার পয়সা কোথা থেকে আসবে সেই চিন্তায় আমার রাতে ঘুম আসে না। রোজ খেলার পর খাওয়া দিয়েই কুলিয়ে উঠতে পারছি না তার উপর আবার নতুন খরচা, তাও আবার প্রতিমাসে!

“ঠিক আছে, দেখা যাক। আমি ফেসবুকে লিখছি, দেখি কোন সুহ্রদ তোমাদের এই খরচাগুলো ‘স্পনসর’ করতে রাজী কি না।“

ঠিক সেই সময় মুম্বাই থেকে আমার দাদা স্কাইপ কল করল। দাদা শ্রীজার ইন্ডিয়া হেড; পেশায় চার্টার্ড আকাউন্টেন্ট; শ্রীজার হিসাব নিকেশ ওই দেখে।

“হ্যাঁ শোন, আজ আমরা সবাই অফিসে। তুই সবাইকে শ্রীজার টাকা পয়সা কিভাবে সামলাতে হবে সেটা একটু পরিষ্কার করে বলবি?”

“অফিসের হিসেব রাখা খুব সোজা কাজ যদি তুমি চুরি না করো।“ দাদার কথায় কোন রাখ ঢাক নেই।

“শ্রীজায় কোন ক্যাশ টাকার কারবার করবে না। যে ভেনডর মাঠে খাবার দেবে তাকে বলবে আমরা তার ব্যাঙ্কে টাকা পাঠিয়ে দেব, হাতে কোন টাকা দেব না। মিনিবাস, ট্যাক্সির জন্য ট্রাভেল ফরম করে দিয়েছি, সেটা তোমাদের ভর্তি করতে হবে। এর বাইরে যা খরচা হবে, সবকিছুর একটা বিল নেবে। বিল ছাড়া আমি কিন্তু কোন ‘পেমেন্ট’ করব না।“

------------------------------------------

“আচ্ছা, শিব দা, আমার শ্রীজা ইন্ডিয়ার একটা বাই-লাইন লাগবে, আজ, এক্ষণই। আমি কাল এই লিফলেটটা ছাপতে দেব।“ সুস্মিতার আবদার না আদেশ ঠিক বুঝতে পারলাম না।

“কি মুশকিল ... আমি তোমায় এই মুহূর্তে কি করে একটা বাই-লাইন দেব?”

“দাঁড়ান, আপনি মেডিটেশন করেন?” সুস্মিতার আবার সেই বড় বড় চোখ করে আবদার।

“আমার কোনোকিছুতেই আপত্তি নেই যতক্ষণ আমরা মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করছি না।“ আমার ক্ষীণ স্বরে কিছু বলার চেষ্টা মাত্র। আমার কথাটা শেষ করার আগেই সুস্মিতা সুজাতার পাশে সোফায় গিয়ে বসে পড়ল।

“শিব দা, আপনি এই চেয়ারটায় চোখ বন্ধ করে বসুন। সবাই ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস নাও; কিছুক্ষণ দমটা বন্ধ করে রাখো; তারপর আবার ধীরে ধীরে ছেড়ে দাও। এইরকম ছ’টা সেট করো। এবার কল্পনা করো সিউড়ির মাদারপুর গ্রামে শ্রীজার পঞ্চাশটা মেয়ে নীল জার্সি পরে মাঠে ফুটবল খেলছে।“

মিনিট দশেক আমরা সবাই চুপচাপ। জানলার বাইরে দেওয়ালে একটা কাক দুবার কা কা করে ডেকে ‘বোর’ হয়ে উড়ে গেল। আমার চোখ বন্ধ। কিন্তু তাও দেখতে পাচ্ছি শেফালির পায়ে বল। ও ডানদিক দিয়ে বিরোধী পক্ষে ঢুকে পড়েছে। হঠাৎ মাঠের অন্য প্রান্তে তুমুল হৈ চৈ শুরু হয়ে গেছে। বেশ কিছু বয়স্ক লোক লাঠি নিয়ে শ্রীজার মেয়েদের তাড়া করেছে। মেয়েরা কিন্তু কেউ মাঠ ছাড়বে না। তারা রুখে দাঁড়াল। কয়েকজন মাঠের বাইরে রাখা নিজেদের সাইকেল তুলে ঢালের মত আত্মরক্ষা করতে শুরু করেছে। শেফালির কিন্তু সেদিকে কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। সে বলটা বিরোধী পক্ষের গোলের দিকে বাড়িয়ে দিয়েছে। এতক্ষণ বাহামণি মাঝ মাঠ ধরে দৌড়চ্ছিল। বলটাকে ধরে সুন্দরভাবে লব করে গোলরক্ষকের মাথার উপর দিয়ে জালে জড়িয়ে দিল। সমস্ত গ্রামের লোক একসাথে চিৎকার করে উঠল, “গো ... ল। শ্রীজার মেয়েরা গোল করেছে। আমরা জিতে গেছি ...”

সেই মারমুখী বয়স্ক লোকেরা একটু থমকে দাঁড়াল। ততক্ষণে সব মেয়েরা এবং তাদের মায়েরা একসাথে হাতে হাত রেখে দাঁড়িয়েছে। এতটা ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ কেউই ভাবতে পারে নি। এই কি তবে পুরুষতন্ত্রের পতনের মুহূর্ত !!!

ততক্ষণে আমার ধ্যানভঙ্গ হয়েছে। সুজাতা, সুস্মিতা ও পিয়ালী তিনজনেই সজাগ। কেমন একটা ঘোরের মধ্যেই বলে ফেললাম,

“শ্রীজা ইন্ডিয়া ... ড্রিবলিং পাস্ট দ্য পেট্রিয়ারকি ...”


গ্রুপ ফটো।


লেখক পরিচিতি: লেখক শ্রীজা ইন্ডিয়ার ফাউন্ডার ডাইরেক্টর। উনি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করার পর সাইয়েন্স, টেকনোলজি ও সোসাইটি নিয়ে র‍্যান্সেলিয়ার পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট (নিউ ইয়র্ক) থেকে পিএচডি করেন। খেলাধুলার মধ্য দিয়ে সমাজে পিছিয়ে পড়া মহিলাদের এম্পাওয়ারমেন্ট ওর গবেষণার বিষয় ও কাজের ক্ষেত্র।

 

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.