অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।


এন জি ও-র খবর

অগাস্ট ১৫, ২০১৮

 

উদ্ভাস

সুবীণ দাশ

পথেঘাটে, বালিগঞ্জ লেকের ধারে দেখা যায় কিছু নামহীন ছেলে-মেয়েদের। তাদের পিতারা ভোর না হতে বস্তির ঘর ছেড়ে ছড়িয়ে পড়ে শহরে, রুজি রোজগারের চেষ্টায়। মায়েরা তাদের বাচ্চাগুলোকে ঈশ্বরের নামে ছেড়ে দৌড়ে বেড়ায় বাবু-বিবিদের ঝাঁ চকচকে বাড়ীতে রোজকার কাজের লোক হয়ে। সেই দুপুর নাগাদ শেষ হয় মায়েদের দৈনন্দিন সকালের কাজ। সেই সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বাচ্চাগুলো দৌড়ে বেড়ায় রাস্তায় ঘাটে, লেকের পাড়ে পাড়ে। কোনটা কখন পা পিছলে লেকের জলে পড়ে হারিয়ে যাচ্ছে, কোনটা রাস্তায় গাড়ীর ধাক্কায় হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে, সে খবর কেউ রাখে না। মা-রা বস্তিতে ফিরে এলে রান্না চড়ায়। বাচ্চাদের পেটে তখন কিছু পড়ে। এই ভাবেই চলছিল তাদের দৈনন্দিন জীবন। বাচ্চাগুলো একটু বড় হয়ে উঠলেই হয়ে ওঠে ছিনতাইবাজ, চুল্লু খোর, চোর, পকেটমার বা মস্তান। মেয়েদের মায়েরা জুতে দেয় কোন বাবুর বাড়ীতে ঝি বৃত্তিতে। আর নানান অন্ধকার পথে শুরু হয় এদের আনাগোনা।

লেকের আশেপাশের স্কুলে শিশুদের পৌঁছে দিয়ে, কিছু মায়েরা (যাদের বাড়ী স্কুল থেকে বহু দূরে) তারা লেকের গাছের ছায়ায় বসে সময় কাটিয়ে শিশুদের নিয়ে বাড়ী ফেরে। সাথে নিয়ে আসে টুকটাক খাবার। সেই সব হাভাতে বাচ্চাদের দল এদের পাশে ভিড় জমাত কিছু উচ্ছিষ্ট খাবারের আশায়। কয়েকজন মহিলা এদের সাথে কথাবার্তা বলত, জানতে চাইত তারা কোথায় থাকে, সকালে কি খেয়ে লেকে আসে, পড়ালেখা করে কিনা? ধীরে ধীরে এই বাচ্চাদের কথা থেকে এনারা জানতে পারেন, নেই এদের কোন শৈশব, নেই কোন সুষম খাওয়া, শিক্ষা তাদের কাছে আকাশের চাঁদে মতন দূরে। হয়ত নিজেদের সুপ্ত অপরাধ-বোধ থেকে এনারা এই বাচ্চাদের কল্যাণার্থে শুরু করেন ভাবনা চিন্তা। জন্ম হয় “উদ্ভাস” নামে এক স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের।শুরু হয় সমাজের অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘরগুলির জানালা খুলে আলোর সন্ধান দেওয়া।


'বর্তমান' পত্রিকা থেকে

এই প্রতিষ্ঠানের প্রাণ পুরুষ শ্রী বরুণ ঘোষ মহাশয় ও তাঁর সুযোগ্য সহধর্মিণী নিজেদের দুঃখ কষ্ট তুচ্ছ করে ঝাঁপিয়ে পড়েন এই প্রয়াসে। প্রথমে সকালে শুরু হয় হতভাগ্য শিশুদের নিয়ে শিক্ষার ক্লাস। সাথে দেওয়া হত সামর্থ্য অনুযায়ী খাদ্য। প্রথমের দিকে লেকের কোন একটি গাছতলায় চলত তাদের পঠন পাঠন। সেখান থেকে ঢাকুরিয়ার আয়কর ভবনের গাড়ী বারান্দার ছাদের তলায় উঠে আসে সেই শিক্ষার প্রয়াস। আয়কর বিভাগের অধ্যক্ষদের সাথে রফা হয় সকাল সাতটার থেকে দশটা পর্যন্ত চলবে পঠন পাঠনের ক্লাস। বেশ কিছু পড়াশুনায় উৎসুক ছাত্র ছাত্রীদের স্থানীয় স্কুলে নাম লেখাতে সমর্থ হন উদ্যোক্তারা।দিন যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বেশ কিছু ছাত্র ছাত্রী মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় কৃত কার্য হয়ে উচ্চ শিক্ষার জন্য ভর্তি হয়েছে কলেজে।অবশ্যই সমস্ত খরচ বহন করে উদ্ভাস।যারা কিছুদিন আগেও জানত না তাদের জন্য ভবিষ্যতে কি অপেক্ষা করছে, উদ্ভাস আজ তাদের দিশা দেখাতে সক্ষম। শুরু হয়েছে একটি দাতব্য হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসালয়। যেখানে বস্তির গরিব মানুষদের চিকিৎসা করার প্রয়াস চলে।


উদ্ভাস-এর প্রকাশিত একটি সিডি

তবু ও বলব এই বিরাট দিন আনে দিন খাওয়া মানুষদের জন্য এ অতি তুচ্ছ।

সরকারি সাহায্যের বাইরে থেকে এই ধরনের প্রয়াস সততই প্রশংসার দাবী রাখে। আজ এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বহু গুণী-মানী ব্যক্তিরা নিজেদের যুক্ত করেছেন। বিনা পারিশ্রমিকে তাঁরা শ্রম দান করেন এই বাচ্চাদের জন্য। বহু হিতৈষী ও দরদী মানুষের সাহায্যে আজ ও পথ চলছে এই উদ্ভাস নামক সমাজ সেবী প্রয়াস।

এটি শুরু হয়েছিল ১৯৮৮ সালের ৩০শে ডিসেম্বরে। আজ ও সেই পথ চলা একই ভাবে চলতে সমর্থ কিছু শুভানুধ্যায়ীদের সাহায্যে ও কিছু পাগল মানুষদের নিরলস আন্তরিক প্রচেষ্টায়।


লেখক পরিচিতি: লেখক মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং-এর স্নাতক। চিফ ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে বহু বছর নানান সাগর ঘুরে এখন অবসর নিয়েছেন। বেড়াতে ভালোবাসেন, ছবি তুলতেও।

 

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.