বিবিধ প্রসঙ্গ
জুলাই ৩০, ২০১৬
বেলাশেষের রক্তিম মরীচিকা
সোমেন দে
বর্ণান্ধতা এক ধরনের রোগ, যা সারা পৃথিবীতে পুরুষদের ক্ষেত্রে খুব বিরল রোগ নয়। এই রোগ থাকলে সাধারণত লাল বা সবুজ রঙ ঠিক মত দেখতে পাওয়া যায় না।
নির্মল কুমারী মহালনাবীশের লেখা থেকে আমরা জানতে পারি লাল রঙ রবীন্দ্রনাথের চোখে ধরা পড়তনা। রবীন্দ্রনাথ ঠাট্টা করে বলতেন
–
‘ অথচ আমি তোমাদের লাল ফুল ভাল দেখতে পাইনে বলে আমাকে ঠাট্টা করো। নীল রংটা টা যে পৃথিবীর রঙ, আকাশের শান্তির রঙ, তাই ওটার মধ্যে চোখ ডুবে যায় ; আর লাল রংটা হল রক্তের রঙ, আগুনের রঙ অতএব প্রলয়ের রঙ, মৃত্যুর রঙ – কাজেই বেশি দেখতে না পেলে দোষ কি? ’
অথচ জীবনের উপান্তে এসে, যখন তিনি অমরত্ব পাবার মত সব কিছু অর্জন করে ফেলেছেন, সব কীর্তি করায়ত্ত, পেয়ে গেছেন পৃথিবীর সব চেয়ে দামী পুরস্কার, দেশ বিদেশে সম্বর্ধিত হয়েছেন, খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে, তখন কবি কেন হঠাৎ লেখার সময় কমিয়ে দিয়ে সেই রঙ নিয়েই ছবি আঁকায় মজেছিলেন, এবং সে ছবিতে সেই লালের আধিক্যই দেখা গেল, সেটা একটা রহস্যই থেকে যাবে। সারা জীবন ধরে সমস্ত সত্তা দিয়ে তিনি খুঁজে বেড়িয়েছেন নূতনকে। নূতন ভাষা, নূতন অভিব্যাক্তি, নূতন আঙ্গিক। অসুস্থ অবস্থায় জীবনের শেষ জন্মদিনেও চিরনূতনেরে ডাক দিয়েছেন। শেষ বয়সে কি তাঁর মনে হয়েছিল ছন্দের ঘোমটায় আটকে থাকা কবিতায় তাঁর যেমন খুশি খেলা করার স্বাধীনতা অধরা থেকে গেছে? তাই কি তাঁকে বলতে হয় ‘
এই টলমলে অবস্থায় এখন দুটো পাকা ঠিকানা পেয়েছি আমার বানপ্রস্থের – গান আর ছবি।
গানে সৃষ্টির স্বাধীনতা খোঁজা চলেছে অনেক দিন ধরেই। কিন্তু সেখানেও পাওয়া হয়নি ‘পাগলামি করার অবিমিশ্র স্বাধীনতা ’। মাত্র তিন চার বছরের মধ্যে প্রায় আড়াই হাজার ছবি এঁকে ফেলাটা বোধহয় অবিমিশ্র স্বাধীনতারই প্রকাশ।
মালতি পুঁথি নামক খাতায় আঁকা ছবি
|
ছোট বেলায় কবি আঁকা শিখেছিলেন ড্রয়িং শিক্ষকের কাছে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে বসে, আর পাঁচটা বালকের মত। ছবি আঁকায় তাঁর কোন বিশেষ দক্ষতার কথা শোনা যায় নি। মালতী পুঁথি নামে একটি খাতা পাওয়া যায় যেখানে কবির ১৮৭৪ থেকে ১৮৮৬ সালের রচনার সঙ্গে আমরা বেশ কিছু স্কেচ দেখতে পাই। তাতেও তেমন কিছু অসাধারণ পটুত্ব দেখা যায় নি।
ছোট বেলার স্মৃতিতে এক জায়গায় তিনি বলছেন –
‘মনে পড়ে, দুপুরবেলায় জাজিম-বিছানো কোণের ঘরে একটা ছবি-আঁকার খাতা লইয়া ছবি আঁকিতেছি। সে যে চিত্রকলার কঠোর সাধনা তাহা নহে– সে কেবল ছবি আঁকার ইচ্ছাটাকে লইয়া আপনমনে খেলা করা। যেটুকু মনের মধ্যে থাকিয়া গেল, কিছুমাত্র আঁকা গেল না, সেইটুকুই ছিল তাহার প্রধান অংশ। এ দিকে সেই কর্মহীন শরৎমধ্যাহ্নের একটি সোনালি রঙের মাদকতা দেয়াল ভেদ করিয়া কলিকাতা শহরের সেই একটি সামান্য ক্ষুদ্র ঘরকে পেয়ালার মতো আগাগোড়া ভরিয়া তুলিতেছে। জানি না কেন, আমার তখনকার জীবনের দিনগুলিকে যে-আকাশ যে-আলোকের মধ্যে দেখিতে পাইতেছি তাহা এই শরতের আকাশ শরতের আলোক। সে যেমন চাষিদের ধান-পাকানো শরৎ তেমনি সে আমার গান-পাকানো শরৎ– সে আমার সমস্ত দিনের আলোকময় অবকাশের গোলা বোঝাই-করা শরৎ– আমার বন্ধনহীন মনের মধ্যে অকারণ পুলকে ছবি-আঁকানো গল্প-বানানো শরৎ। ‘
এখানে বোঝা যায় যা মনের মধ্যে থেকে গেল আঁকা গেলনা, তার জন্যে একটা অতৃপ্তি থেকে গেল বালক কবির মনে।
কিন্তু এর পর আমরা কোথাও তাঁকে ছবি আঁকতে দেখছি না। যৌবনে শিলাইদহ তে থাকাকালীন জগদীশ চন্দ্র বসু কে একটি চিঠি লিখে আবেগভরে জানিয়েছিলেন তিনি ওখানে কিছু ছবি এঁকেছেন।কিন্তু সে ছবির কোন হদিশ পাওয়া যায়নি।
পূরবীর পাণ্ডুলিপিতে আঁকা doodle
|
কিন্তু এর পর আমরা কোথাও তাঁকে ছবি আঁকতে দেখছি না। যৌবনে শিলাইদহ তে থাকাকালীন জগদীশ চন্দ্র বসু কে একটি চিঠি লিখে আবেগভরে জানিয়েছিলেন তিনি ওখানে কিছু ছবি এঁকেছেন। কিন্তু সে ছবির কোন হদিশ পাওয়া যায়নি। তাঁর লেখা পাণ্ডুলিপিতে উনি মাঝে মাঝেই কিছু শৈল্পিক কাটা কুটি করছেন, নিজের খেয়ালে। ওগুলো কি তাঁর অঙ্কন শিল্পী হবার অবদমিত ইচ্ছের প্রকাশ ছিল? তিনি যখন এই সব আঁকিবুকি কাটছেন, তখন সেই জোড়াসাঁকো বাড়ির অন্য কোন ঘরে বসে তাঁর দুই ভ্রাতুষ্পুত্র ভারতীয় শিল্প জগতে বিশাল বিপ্লব ঘটিয়ে চলেছেন। আর রবীন্দ্রনাথ যে এই বিপ্লব থেকে একেবারে নির্লিপ্ত বসে ছিলেন এমন মনে করবার কোন কারণ নেই। তবু তিনি নিজে তুলি তুলে নিচ্ছেন না। সংকোচের সঙ্গে ভাবছেন –
‘ ঐ যে চিত্রবিদ্যা বলে একটা বিদ্যা আছে তার প্রতিও আমি হতাশ প্রণয়ের লুব্ধ দৃষ্টি পাত করে থাকি – কিন্তু আর পাবার আশা নেই … অনান্য বিদ্যার মত তাঁকে তো সহজে পাবার জো নেই–তাঁর একেবারে ধনুর্ভাঙ্গা পন।’
গুলে খেতে তাঁর মত আর কেই বা পারতেন। এ দেশ এবং বিদেশের শিল্প আন্দোলনের গতি প্রকৃতির সঙ্গে তাঁর পরিচয়ের কোন ঘাটতি ছিল না। তাহলে চিত্রবিদ্যার প্রতি এই হতাশ প্রণয়ের লুব্ধ দৃষ্টিপাত কেন?
আমরা দেখলাম তেষট্টি বছর বয়সে তিনি শুধু লেখার মায়ায় আবদ্ধ না থেকে ধরা দিচ্ছেন রেখার মায়ায়, রঙের বর্ণচ্ছটায়।
১৯২৪ সালে পূরবী কাব্য গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি লেখার সময় লেখার পাতার শূন্যস্থানগুলিতে তাঁর বিভিন্ন ধরনের doodle গুলি দেখে ফেলেন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো। তিনিই উৎসাহ দেন আলাদা করে ছবি আঁকার। কিন্তু নিজেরও একেবারে যে ইচ্ছে ছিল না এমনটা বোধহয় নয়।
–শঙ্খ ঘোষের ভাষায় এই ছবিতে ‘সেই ধরতে চাওয়া আর ধরতে না পারার চিরন্তন রক্তিম বেদনা ’
|
কবি মাতলেন ছবি আঁকায়। এবং রঙ্গে রেখায় একটা হুলুস্থুল বাধিয়ে দিলেন। নেশাগ্রস্তর মত ছবি আঁকতে লাগলেন। তিন বছর পর ১৯৩০ সালে ভিক্টোরিয়া মানে কবির বিজয়া, প্যারিসে তাঁর ছবির একটি exhibition এর আয়োজন করলেন। পরে এই প্রদর্শনী হয় বারমিংহাম, লন্ডন, বার্লিন, মুনিখ, ড্রেসডেন, কোপেনহেগেন, জেনেভা, মস্কো, বস্টন, নিউ ইয়র্ক আর সব শেষে ফিলাডেলফিয়াতে। তাঁর ছবি দেখে ইয়োরোপ ও আমেরিকার দর্শকদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া হল। তবে প্রশংসাই বেশি শোনা গেল। বার্লিন ন্যাশানাল গ্যালারি তাঁর পাঁচটি ছবি কিনলেন।
কবির নিজের চিত্রবিদ্যায় পারদর্শিতার উপর আস্থা জন্মাল।
দেশে তাঁর ছবিকে তখন অবধি কেও তেমন করে গুরুত্ব দেয়নি।কিন্তু বিদেশে ছবি দেখে অনেকেই মুগ্ধ হলেন। বিখ্যাত ফরাসি কবি পল ভ্যালেরি বললেন –
your pictures will be lesson to our artists.
ভারতীয় আর্ট ও মন্দির বিশেষজ্ঞ স্টেলা ক্রেম্রিস লিখলেন –
‘Training of the hand is one thing, guidance by the spirit another. The work of Rabindranath Tagore, singularly free from conventions and schooling, is subject to a discipline of its own. It does not stop short at design and composition. Each of the hundreds of drawings and paintings is a living and balanced artistic organism.
আসলে রবীন্দ্রনাথ এমন ছবি আঁকলেন যা কোনো প্রচলিত ধারায় পড়ে না। তিনি নিজে একদিকে জাপানী শিল্পকলা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন, আবার জার্মানি ‘ব্লু রেডার ' গোষ্ঠীর কাজের প্রশংসক ছিলেন। গ্রীক ভাস্কর্যের সমঝদার ছিলেন, কিন্তু যখন নিজে ছবি এঁকেছেন তা একান্তই তাঁর নিজের স্টাইলে। কেউ তাঁকে বলেছেন ইমপ্রেশনিস্ট, কেউ বলেছেন এবস্ট্রাক্ট, কেউ বলেছেন আদিম আধুনিক।
আবার তিনি নিজে এ সব ধারণাকে উড়িয়ে দিয়ে রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়কে লেখা একটি চিঠিতে লিখেছেন ,
“আমি কোন বিষয় ভেবে আঁকিনে - দৈবক্রমে একটা অজ্ঞাতকুলশীল চেহারা চলতি কলমের মুখে খাড়া হয়ে ওঠে।”
এই কারণেই অনেকেই তাঁর ছবিকে অনেক বিশেষজ্ঞ বলেছেন naive বা childlike বলেছেন। তবে আনন্দ কুমারস্বামী বলেছেন-
Childlike, but not childish.
এই মুখেই কি ছিল কাদম্বরী দেবীর মুখের আদল?
|
প্রধানত জলরঙেই ছবি আঁকতেন তিনি। নিকষ কালো চাইনিজ ইঙ্ক ও ব্যবহার করতেন। কখনো আবার ফুল থেকে তৈরি রঙ ব্যবহার করেছেন। এ ছাড়া রঙ পেন্সিল, ক্রেওন এ সবও ব্যবহার করেছেন। একবার তেলরঙে ছবি আঁকার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু তেলরঙ তাঁর ভাল লাগেনি। আবার ফিরে গেছেন জলরঙেই। যতটুকু জানা যায় তিনি একটি মাত্র তুলি ব্যবহার করতেন। রঙ নির্বাচনে বিশেষ ধৈর্য দেখাতেন না। অনেকসময় পেনের উল্টো দিক এবং আঙ্গুল ব্যবহার করতেন ছবি আঁকার জন্য। বেশির ভাগ ছবি এক সিটিং-এই শেষ করেছেন। তাঁর আঁকা নারীমুখগুলিতে একটি চাপা বিষণ্ণতা সব সময় থাকতো। একবার নন্দলাল বোস কে বলেছিলেন তাঁর আঁকা নারীমুখ গুলির মধ্যে কাদম্বরী দেবীর মুখ হয়ত ছায়া ফেলেছে।
তিনি ছবিতে সূক্ষ্মতার চেয়ে জোরের প্রয়োজনীয়তার কথা বলতেন। রথীন্দ্রনাথকে তাই চিঠিতে লেখেন –
‘আমাদের নববঙ্গের চিত্রকলায় আর একটু জোর সাহস এবং বৃহত্ব দরকার আছে। এই কথাটা আমার বার বার মনে হয়েছে।আমরা অত্যন্ত ছোট খাটোর দিকে মন দিয়েছি।’
এই জোর আমরা রবীন্দ্রনাথের ছবিতে বার বার দেখি। তাঁর ছবিতে অনেক সময়ে দুঃসাহসী রঙের প্রয়োগ দেখা যায় যা প্রথাগত ভাবে খুব স্বাভাবিক নয়। উজ্জ্বল হলুদ রঙ তাঁর খুব প্রিয় ছিল। যখন ভ্যান গগকে বিশেষ কেউ চিনতেন না তখন তিনি ভ্যান গগের ছবির ভক্ত ছিলেন। তার প্রমাণ, তিনি কাউকে কখনো অনুকরণ করেন নি, কিন্তু ভ্যান গগের একটি ছবি নকল করেছিলেন ভালবেসে। হয়ত ভ্যান গগের ছবির জোরালো ভাবটাই তাঁকে টেনে ছিল। নন্দলাল বোসের ছবিতেও উজ্বল রঙের ব্যবহার ছিল। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ছবিতে ছিল একধরনের দ্যুতি। তাঁর শুধু কালো আর বেগুনী কালিতে আঁকা ছবিতেও ছিল এক আশ্চর্য জমক, যা হয়ত কিছুটা প্রথাবহির্ভূত।
শেষ বয়সে ছবির নেশা যে তাঁকে গ্রাস করছে এবং কাব্য চর্চার বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে সেটা তিনি বুঝতেন। নিজেই বলেছেন –
‘ ছবির নেশায় আমার কাব্যের উপর কিছু উৎপাত বাধিয়েছে। অধিক বয়সে তরুণী ভার্যা মানুষকে অভিভুত করে এমন একটা প্রবাদ আছে। আমার প্রাচীনাটি তরুণীর সঙ্গে পেরে উঠছে না।‘
জীবনের উপান্তে এই তরুণী ভার্যার প্রতি প্রেম তাকে আরও একবার অস্থির করেছে।
ঠিক যেমন তরুণ রবি সদর স্ট্রিটের বাড়ীর জানলা দিয়ে সূর্যোদয় দেখে নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ লিখে ফেলেছিলেন তেমনি আরও একবার নির্ঝরের স্বপ্ন ভঙ্গ হল অস্তাচলের রবির চেতনায়।
সে রকম আভাস পাই তাঁর নিজের লেখায় –
‘ আমার বয়স সত্তর হয়ে এলো। আজ তিরিশ বছর ধরে যে দুঃসাধ্য চেস্টা করেছি আজ মনে হচ্ছে যেন ভিত পাকা হবে। ছবি কোনোদিন আঁকিনি, আঁকবো বলে স্বপ্নেও বিশ্বাস করিনি। হঠাৎ দু তিন বছরের মধ্যে হু হু করে এঁকে ফেললুম … এর মানে কি? জীবন গ্রন্থের সব অধ্যায় যখন শেষ হয়ে এলো তখন অভুতপূর্ব উপায়ে আমার জীবন দেবতা এর পরিশিষ্ট রচনা উপকরণ জুগিয়ে দিলেন।’
কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত কে একটি চিঠিতে সুন্দর ভাবে লিখছেন তাঁর রেখার মায়ার ধরা পড়ার কথা –
‘পড়েছি আজ রেখার মায়ায়।
কথা ধনীঘরের মেয়ে,
অর্থ আনে সঙ্গে করে,
মুখরার মন রাখতে চিন্তা করতে হয় বিস্তর।
রেখা অপ্রগল্ভা, অর্থহীনা,
তার সঙ্গে আমার যে ব্যবহার সবই নিরর্থক।
গাছের শাখায় ফুল ফোটানো ফল ধরানো,
সে কাজে আছে দায়িত্ব;
গাছের তলায় আলোছায়ার নাট-বসানো
সে আর-এক কাণ্ড।’
অনন্ত প্রতীক্ষার ছবি
|
আমরা বহুবার তাঁকে অস্থির হতে দেখেছি। নিজেকে ভেঙ্গেছেন বারবার। এক জায়গায় থিতু হন নি কোন কালে। ছুটে বেড়িয়েছেন সুরুল থেকে রামগড় পাহাড়, কুষ্টিয়া থেকে মংপু, শিলাইদহ থেকে বোলপুর। শান্তিনিকেতনে বার বার পালটেছেন নিজের বাড়ি। কি জানি কিসের সন্ধানে নোবেল পুরস্কার পাবার কয়েক মাস পরেই তিনি নিজেকে এক জন ব্যর্থ মানুষ বলে রথী ঠাকুরকে চিঠি লিখছেন জীবনে কিছুই করা হল না। তাঁর কাছে সফলতার সংজ্ঞাটা ঠিক কি ছিল কে জানে। তাই ছবি আঁকার ইচ্ছের সঙ্গে অন্তত যশ লাভের আকাঙ্ক্ষার কোনো সম্পর্ক ছিলো বলে মনে হয় না।
গাছের তলার আলোছায়ার নাট বসানো শুধু এক খেয়াল খেলা নয়। তার চেয়ে অধিক কিছু। তিনি গানে বলেছেন সীমার মাঝে অসীমের কথা। সে অসীমকে ধরতে যাওয়ার জন্যে রঙ তুলিকে আশ্রয় করার ভাবনা তাঁকে তাড়া করেছিল হয়ত। এক জায়গায় তিনি বলছেন –
‘ ছবিতে যে আনন্দ, সে হচ্ছে সুপরিমিতির আনন্দ – রেখার সংযমে সুনির্দিষ্ট কে সুস্পষ্ট করে দেখি – মন বলে ওঠে, নিশ্চিত দেখতে পেলুম ’।
এই সুনির্দিষ্টকে সুস্পষ্ট করে দেখার তাঁর এই অন্তর্দৃষ্টির বিশ্লেষণ করা আমাদের মত সাধারণ মানুষের পক্ষে তো সম্ভব হবেই না। এমন কি গণেশ পাইনও বলছেন –
রবীন্দ্রনাথের ছবি বিশ্লেষণ করা তাঁর সাধ্যাতীত।
কী আছে ওই চোখ দুটিতে? তা যেন মোনালিসার হাসির মত অনাবিষ্কৃত।
|
এমন করে পৃথিবীর কোন চিত্রী হয়ত ভাবেন নি। তাই তাঁর ছবি একান্ত ভাবে তাঁরই। তাঁর ছবির কোন ঘরানা তৈরি হবেনা কোনোদিন। কোন ‘ইজম’এর ছকে ফেলা যাবেনা তাঁর ছবিকে। তবু তিনি অনন্য হয়েই থাকবেন চিরকাল।
২০১০ সালে লন্ডন শহরে একটি নীলামে এই ছবিটি বিক্রী হয়েছিল ৩,১৩,২৫০ ডলারে।
|
সৃষ্টির কোন তাড়না থেকে বয়সের ভার তুচ্ছ করে জীবনের সাঁঝ বেলায় এক নূতন আগুন জ্বালতে চেয়ে ছিলেন তিনি রঙ ও রেখায়, যে আগুন জ্বালা তাঁর বিশাল বহুমুখী সাহিত্য সৃষ্টির মধ্যেও অপূর্ণ থেকে গেছিল, তা বুঝে ওঠা আমাদের পক্ষে হয়ত কোনোদিন সম্ভব হবে না। আমরা তাঁর এই মূর্ত থেকে বিমূর্ত আবার বিমূর্ত থেকে মূর্ততে যাওয়ার যাত্রা পথের দিকে মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকব চিরকাল।
কবি তাঁর ছবিকে verses in line মানে রেখার কাব্য বলেছিলেন। নন্দলাল বোস তাঁর ছবিতে ছন্দের বিন্যাসের কথা বলেছেন।
আমরা সবাই জানি রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন তাঁর গান বাঙ্গালিকে মনে রাখতেই হবে। কিন্তু অনেকেই জানেন না তাঁর আঁকা ছবি নিয়েও একটি ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন। সেটা এ রকম –
‘আমার মৃত্যুর পর ওর (তাঁর ছবির) আবরণ মোচন কোরো – তখন ওর মূল্য হবে ঐতিহাসিক দিক থেকে।
’
ঠিক তাই হয়েছে। এ দেশে তো বটেই বিদেশেও তাঁর ছবির মূল্যায়ন হয়েছে নতুন করে।
রবীন্দ্রনাথের আঁকা বেশ কিছু ছবি বিভিন্ন সময়ে বিদেশে চলে যায়। ২০১০ সালে লন্ডনে বিখ্যাত নীলাম সংস্থা Sotheby’s রবীন্দ্রনাথের বারোটি ছবি নীলামে তুলেছিল। আমরা জানতে পারি বারোটি ছবি নীলাম করে পাওয়া যায় 1,600,000 ডলার। পৃথিবীর যে কোনো চিত্রশিল্পীর কাছেই এই অর্থমূল্য ঈর্ষণীয়।
আমরা তাঁর ছবির সঠিক মর্মোদ্ধার করতে পারি বা না পারি অবন ঠাকুরই তাঁর ছবি সম্বন্ধে সার কথাটি বলেছিলেন – রবি কাকার ছবি ,এক একটা ভলকানিক ইরাপশনের মতো।
লেখক পরিচিতি - চাকুরী জীবন বেসরকারি এবং আধা সরকারি কর্পোরেট জগতের বিভিন্ন পদে। এখন অবসরপ্রাপ্ত। লেখেন নেহাতই মনের খিদে মেটাতে। লেখেন নানান বিষয় নিয়ে। তবে যাই লেখেন বিষয় নির্বাচনে কিছু অভিনবত্ব থাকে। গান , চলচ্চিত্র, ভ্রমণ, দিন বদলের ছবি, বাঙ্গালিয়ানা এ রকম আরও অনেক বিষয় এবং অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ। তথ্যকে কৌতুকের মোড়কে এবং ভাবনা কে স্বচ্ছতার আবরণে পরিবেশন করতে চেষ্টা করেন। বিষয় যাই হোক ভাষা সব সময়েই ঝরঝরে, রসস্নিগ্ধ এবং মনোগ্রাহী।
বেশ কয়েকটি ওয়েব পত্রিকাতে লেখেন। দেশ বিদেশে অনেক গুণগ্রাহী পাঠক আছেন।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।