প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

প্রাচীন ভারত

সুকুমারী ভট্টাচার্য স্মরণ সংখ্যা , জুন ৩০, ২০১৫

 

সুকুমারী ভট্টাচার্য – একটি আলোকবর্তিকা

বিজয়া গোস্বামী


সুকুমারীদির সাথে আমার যে যোগাযোগ, তা মোটামুটি ৪০ বছরের বেশি। হ্যাঁ, আমি তাঁর ছাত্রী ছিলাম, কিন্তু তার পরেও প্রায় সারা জীবন ধরেই তাঁর সঙ্গে আমার সম্পর্ক বজায় ছিল। এক সময়ে আমি তাঁর সহকর্মীও ছিলাম, কিন্তু এর বাইরে আমাদের সম্পর্ক ছিল বন্ধুত্বের। এই ধরণের উঁচু-নিচু ভেদাভেদ কোনো দিন তাঁর কাছে গুরুত্ব পায় নি, বয়সের বা অবস্থার কোনো পার্থক্য তাঁর ব্যবহারে  কোনোদিন দেখিনি।

সুকুমারীদির জন্ম ১২ই জুলাই ১৯২১ সাল, আমার জন্মতারিখ ওই একই দিনে – ৩০ বছর পরে। বহুদিন পর্যন্ত আমরা পরস্পর শুভেচ্ছা বিনিময় করতাম – ‘আশীর্বাদ’ কথাটার ওপর দিদির খুব এলার্জি ছিল। দিদি ঠাট্টা করে বলতেন জুলিয়াস সিজারের সাথে জন্ম একই দিনে।

আমি যখন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে এম এ ক্লাসে ভর্তি হলাম, তখন সুকুমারীদি যথেষ্ট সিনিয়র অধ্যাপিকা, তাঁকে সবাই সমীহ করে চলত। এমনকি অধ্যাপক রমারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, বিভাগীয় প্রধান এবং নিজেও রাশভারী মানুষ, তিনিও সুকুমারীদিকে বেশ সমীহ করতেন। ছাত্রেরা সাধারণত দিদিকে বেশ ভয় পেত, কিন্তু তাঁর স্বভাবের মধ্যে যে কোমলতা ছিল তার পরিচয় পেলে আর ভয় থাকত না। কত দুঃস্থ ছাত্রছাত্রীকে যে তিনি বিপদে সাহায্য করেছেন তার হিসেব আমার কাছেও নেই। বিশেষ করে যেসব মেয়েকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হত, বা যারা শ্বশুরবাড়িতে অত্যাচারের শিকার হত, তাদের জন্য দিদি সবসময়েই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁর এক প্রাক্তন ছাত্রের বোনকে কিভাবে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল, সকলকে বলা হয়েছিল মেয়েটি অসুখে ভুগে মারা গেছে - তার ভাইকে পাড়ার লোকেরা গোপনে সেই পোড়া ঘর দেখিয়েছিল, - এই গল্প বলতে বলতে বৃদ্ধ বয়সেও তাঁর চোখে জল দেখেছি। এই করুণাই তাঁকে কঠোর করেছিল, যেখানেই তিনি দেখতেন নিঃসহায় মানুষের ওপর অত্যাচার হয়েছে, তাঁর অন্তরাত্মা সেই উৎপীড়নের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে।

সুকুমারীদির লেখালেখির উৎস এখানেই। তাঁর লেখায় বারে বারে শূদ্র ও নারীর উপর প্রাচীন ভারতে যে অত্যাচার হয়েছে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ স্বত-উৎসারিত হয়ে প্রকাশ পেয়েছে। তাই বলে তাঁর চিন্তা বা গবেষণা কোনো দিক দিয়েই নেতিবাচক ছিল না। তাঁর জীবনে শেষ লেখা ‘বেদের যুগে ক্ষুধা ও খাদ্য’ বইটি রচনা করতে যে কত বই তাঁকে দেখতে হয়েছে সে কথা তিনি বলেছিলেন – এত পরিশ্রম শুধু ‘বন্দে মাতরম্‌’ গানে ‘সুজলাং সুফলাম্‌’ কথাগুলি কতটা সত্য তা যাচাই করতে! কোনো কিছু খাপছাড়া বা আধা-খ্যাঁচড়া ভাবে চর্চা করতে কোনোদিন তাঁর ধাতে ছিল না।

সুকুমারীদি আজীবন বামপন্থী রাজনীতিতে – বরং বলা ভালো সাম্যবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। এর মূলেও তাঁর উৎপীড়ন ও উৎপীড়িতের বিষয়ে অবিচল মনোভাব। কখনো কোনোভাবে কোনো উৎপীড়নকেই মেনে নিতে পারেন নি। সমানভাবে বলা যায়, কখনো কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে তাঁকে পরাঙ্‌মুখ হতে দেখিনি।  সমাজ জীবনে হোক, কর্মজীবনে হোক, তাঁর চিরদিন এই আপোষহীন মনোভাবই দেখেছি। প্রথম জীবনে তাঁর ‘প্রথম ভালোবাসা’ সংস্কৃত পড়তে গিয়ে প্রাচীনপন্থী পণ্ডিতদের কাছে বাধা পেয়েছিলেন।  কিন্তু তাতে দমে যান নি, পরে সংস্কৃত পড়ে, যথোচিত সম্মান অর্জন করে, সবার শ্রদ্ধা আকর্ষণ করে, তার উত্তর দিয়েছিলেন।

কর্মক্ষেত্রেও সুকুমারীদির লড়াই অব্যাহত ছিল। তিনি যখন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃতের অধ্যাপিকা, তাঁর জনৈক সহকর্মীর অসহযোগিতায় তাঁর পদোন্নতি দীর্ঘদিন বিলম্বিত হয়েছিল। তবে সেখানেও তাঁর পাণ্ডিত্য, তাঁর অগাধ জ্ঞানের পরিচয় সম্মানিত হয়েছে।

দেশে বিদেশে সর্বত্র সুকুমারীদির পাণ্ডিত্য এবং তাঁর অভিনব মতাদর্শ স্বীকৃতি লাভ করেছে। প্রাচীন ভারত সম্বন্ধে চর্চা করতে গিয়ে তিনি যেখানে উন্নত চিন্তাধারা দেখেছেন অকুণ্ঠভাবে তার প্রশংসা করেছেন। আবার যেখানে অতি রক্ষণশীলতা, দৃষ্টিভঙ্গীর সীমাবদ্ধতা, সামাজিক উৎপীড়নের ছবি দেখেছেন, সেখানে কঠোরভাবে তার সমালোচনা করতে পিছ পা হন নি। প্রাচীন কাল থেকে আধুনিক জগৎ, বেদ, উপনিষদ, মহাভারত, রামায়ণ, সাহিত্য, অলংকার, ধর্মশাস্ত্র, অর্থশাস্ত্র, দর্শন, বৌদ্ধ সাহিত্য, বাংলা সাহিত্য, কঠিন দার্শনিক তত্ত্বের ব্যাখ্যা, কাব্যের মাধুর্য বিশ্লেষণ, রবীন্দ্রসাহিত্যের রসগ্রহণ – কোনদিকে যে তাঁর দৃষ্টি পড়ে নি তা বলতে পারি না।
বিভিন্ন শাস্ত্র-সাহিত্যের যে ধরণের বস্তুবাদী ব্যাখ্যা সুকুমারীদি করেছেন তা আমাদের সকলেরই অনুধাবনযোগ্য। বিশেষত, কোনো কিছুকেই যে চিরাচরিত সত্য বলে মনে করে নেওয়া উচিত নয়, সবকিছুই যুক্তি ও বুদ্ধির নিকষে যাচাই করা আবশ্যক, এই শিক্ষা সুকুমারীদি চিরদিন দিয়ে এসেছেন। আমরা যারা তাঁর ছাত্রছাত্রী তারা জানি, তাঁর মতের বিরোধিতা করলে তিনি কখনো রাগ করেন নি। বিপক্ষে যা বলার আছে ধৈর্যসহকারে শুনেছেন। তাঁর মতের সাথে মিললে ভালো, না মিললেও ক্ষতি নেই। সবাই নিজের নিজের মতো করে চিন্তা করুক, এটাই তিনি চেয়েছিলেন।

অনেকে বলেন সুকুমারীদি ক্রিশ্চান ছিলেন বলে হিন্দুধর্মের ওপর তাঁর আক্রোশ। তাঁরা কিসের ভিত্তিতে একথা বলেন জানি না, কারণ কোনো ধর্মের বিষয়েই তাঁর পক্ষপাত কখনো দেখি নি। কোনো ধর্মবিশ্বাস তাঁর ছিল বলে মনে হয় নি কোনোদিন। ধর্মের ছল করে উৎপীড়ন কখনোই তাঁর কাছে গ্রহণযোগ্য হয় নি। আর একটা কথা প্রায়ই শুনি, সুকুমারীদি পুরুষবিদ্বেষী ছিলেন। এ বিষয়ে তাঁর নিজের বক্তব্যই উদ্ধৃত করছি। “...... পুরুষ-সমাজও বদলেছে। আজকে মেয়েরা পুরুষদের কাছ থেকে যে সমর্থনটা পাচ্ছে আজ থেকে দশ-পঁচিশ বছর আগে হলে পেত না। ...... পুরুষ তো সত্যিই শত্রুপক্ষ নয় – অত্যাচার যখন করে শাশুড়ি, ননদ, জা – সবাই করে। এখনও স্ত্রীর ওপর অত্যাচার হলে কোনো স্বামী বাবা-মার সামনে সরাসরি প্রতিবাদ করতে দ্বিধা করে। ...... আজ ৮৬ বছরের জীবনে দাঁড়িয়ে মনে হয় ধর্ম-অর্থ-প্রতিষ্ঠা – সব তুচ্ছ। নারী ও পুরুষের বন্ধনটাই আসল। আসল পরস্পরকে সম্মানের আদর্শ। সামাজিক ক্ষেত্রেও কেউ কাউকে অতিক্রম করে নয় – নারী-পুরুষের সমতায় এগিয়ে চলুক আগামী সমাজ।” (বারণরেখা, ৪র্থ সংখ্যা, ফেব্রুয়ারী, ২০১৫, পৃঃ ৪৩-৪৪)।

সুকুমারীদির  জীবনদর্শন ছিল অসাধারণ রকমের ইতিবাচক। এই প্রসঙ্গে মহাভারত বিষয়ে তাঁর উক্তি বিশেষ করে স্মরণীয়। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পর যুধিষ্ঠিরের যখন জীবনে বিতৃষ্ণা  জন্মেছে, তখন বিদুর তাঁকে একটি রূপক কাহিনী বলেন। এক ব্রাহ্মণ এক কূপে পড়ে গেছেন, কুয়োপাড়ে একটি লতাকে আঁকড়ে সে পা ওপরদিকে, মাথা নীচেরদিকে করে ঝুলে আছে। কুয়োর পাড়ে এক মহাগজ সেদিকে ধীরে ধীরে এগোচ্ছে। যে লতাটিকে ধরে লোকটি ঝুলে আছে, সেটি ইঁদুরে কাটছে। লতায় মৌচাক ঝুলছে, সেখানে মৌমাছিদের আনাগোনা। কূপের নীচে এক মহাসর্প। এর মধ্যে মৌচাক থেকে বিন্দু বিন্দু মধু তার মুখে ঝরে পড়ছে, তাতে তার তৃষ্ণা নিবারণ হচ্ছে না, বেড়েই চলেছে। বিদুর উপসংহারে বলেছেন, এই হল জীবন। সুকুমারীদি বলছেন - “রোগব্যাধি-জরা, নানা রিপুর আনাগোনা, নিরন্তর প্রাণসংশয়, অবশ্যম্ভাবী আসন্ন মৃত্যু, এসবের মধ্যে জীবন মানুষকে কি দিয়ে মুগ্ধ করে রাখে? ঐ মধু। প্রত্যেক জীবনেই কোনো না কোনো উৎস থেকে বিন্দু বিন্দু মধু এসে পড়ছে থেকে থেকে, তাই এই সর্বতোভাবে বিপন্ন ও অনিশ্চিত জীবনেও এত আসক্তি মানুষের। মহাভারতে মানুষ যেন বলছে – জীবন আমাকে কিছু দেবে বলে নয়, আমার শ্রেষ্ঠ সত্ত্বা থেকে আমি জীবনকে কিছু দেবার মতো স্পর্ধা রাখি, এ স্পর্ধা আমার মানুষের হয়ে। একমাত্র মানুষই সমস্ত বিপদের ঊর্ধ্বে উঠে জীবনকে মহিমান্বিত করতে পারে। ...... চরম বিজয়ের উৎস তার অন্তরাত্মার মধ্যেই নিহিত; সেখানে সে নিত্যবিজয়ী।” (মহাকাব্য মহাভারত; প্রাচীন ভারত সমাজ ও সাহিত্য, আনন্দ পাবলিশার্স, ১৩৯৬, পৃ ৯৮)

 


লেখক পরিচিতি - বিজয়া গোস্বামী যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃতের অধ্যাপক। সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্য এবং বৌদ্ধ সাহিত্যে তাঁর বিশেষ দক্ষতা। অবসর সময়ে পড়াশুনা, গান, থিয়েটার ও পশুপাখী নিয়ে থাকেন।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।