প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

প্রাচীন ভারত

সুকুমারী ভট্টাচার্য স্মরণ সংখ্যা , জুন ৩০, ২০১৫

 

প্রাচীন ভারতের গণরাষ্ট্রগুলি

দিলীপ দাস


প্রাচীন ভারতের ইতিহাস পড়তে গিয়ে দেখি সেখানে বড়ো বড়ো সাম্রাজ্যের ভাঙ্গা গড়ারই কথা বেশী। সাম্রাজ্য ভাঙ্গা গড়ার কথার মাঝে যেসব ছোটো ছোটো রাজ্যগুলি একসময় ভারতের সংস্কৃতির ধারা বহমান রেখেছিল, তাদের কথা খুব কমই দেখা যায় ইতিহাস বইয়ে। বড়ো সাম্রাজ্যগুলির মতো ব্যাপক ও বিরাট না হলেও ছোটো ছোটো রাজ্যগুলিরও ইতিহাস আছে আর সেই ইতিহাস কম চিত্তাকর্ষক নয়। পাটলিপুত্রের রাজপুরীর জাঁকজমক যদি হীরের সাতনরী হার হয়, তাহলে বৈশালীর রাজবাড়ী যেন সুক্তির মধ্যে নিটোল গোলাপী মুক্তোর সারি। মনে পড়ে যায় - ‘রেখা টেনে ছোটোর গতি, বড়ো যে জল গাবিয়ে চলে.........’।

প্রাচীন ইতিহাসে বিশেষ ভাবে নিজেদের চিহ্ন রেখে গিয়েছিল যেই সব ছোট রাজ্যগুলি, তাদের মধ্যে কিছু ছিল গণরাষ্ট্র, অর্থাৎ সেখানে রাজা বা নেতা নির্বাচিত হতেন। এই নির্বাচন অবশ্য বর্তমানের নিরিখে সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক ছিল না, কিন্তু তাহলেও রাজ্যের উত্তরাধিকারী কে হবে তা রাজকুলের বংশপরম্পরায় ঠিক করা হত না। এই রাষ্ট্রগুলিতে নাগরিকদের মধ্যে বিশেষ কিছু লোক নেতা নির্বাচন করতেন, তাই এদের Oligarchy বললে ঠিক হবে। নেতা নির্বাচনের পদ্ধতিটা ছিল খুব সুন্দর, এই প্রবন্ধের শেষের দিক তার আলোচনা আছে।

ছোট রাজ্যগুলির ইতিহাস সবচেয়ে ভালোভাবে পাওয়া যায় বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মগ্রন্থগুলিতে। পুরাণের এদের কয়েক জায়গায় সামান্য উল্লেখ আছে, তবে পুরাণগুলি ব্রাহ্মণ্য-ধর্মের নীতি অনুযায়ী রাজচক্রবর্তী রাজাদেরই মর্যাদা দিত, তাই ছোটোখাটো রাজাদের সেখানে বিশেষ পাত্তা দেওয়া হয় নি।

যদিও ‘রাজা’র প্রথম উল্লেখ বহু আগে, ঋগ্বেদে দশ রাজার যুদ্ধের কাহিনীতে পাওয়া যায়,  কিন্তু ইতিহাসে গণরাজ্যের বিবরণ আমরা প্রথম পাই ৬০০ খ্রীষ্ট পূর্বাব্দ নাগাদ। সারা ভারতে তখন ষোলটি মহাজনপদ (ষোড়শ মহাজনপদ) গড়ে উঠেছে। তবে ষোলটি মহাজনপদের তালিকা  পুরাণ, বৌদ্ধ শাস্ত্র ও জৈনশাস্ত্রগুলিতে এক এক জায়গায় এক এক রকম। এই মহাজনপদগুলি হয়ে উঠেছিল সেই যুগের রাজনীতি, সৃষ্টি ও কৃষ্টির কেন্দ্র।  তাদের শক্তি যত বেড়েছে, পেশী ফুলিয়ে তারা একে অপরের সাথে যুদ্ধে নিরত হয়েছে আবার পরস্পরের মধ্যে বৈবাহিক সম্বন্ধ স্থাপন করে সন্ধি করেছে। আজ লড়াই ঝগড়া, কাল ভাব, এই ভাবেই গড়ে উঠেছে সেই সময়ের ইতিহাস।

যদি ‘রাজ্য’ বললে রাজা শাসিত ভূখণ্ড বোঝায়, তাহলে গণরাষ্ট্রগুলিকে রাজ্য বললে একটু ভুল হবে। কারণ এদের ‘গণ’, বা ‘সংঘ’ বললেই বোধহয় ঠিক বলা হয়। প্রাচীন গ্রন্থগুলিতে এদের এভাবেই বর্ণনা করা আছে। পাণিনি তাঁর অষ্টাধ্যায়ী ব্যাকরণে দুই ধরণের দেশের কথা বলেছেন, জনপদ এবং সংঘ বা গণ। আধুনিক ইতিহাসের বইয়ে এদের Principality বলা হয়েছে। এই প্রবন্ধে এদের গণরাষ্ট্র বলা হয়েছে গণ শাসিত ভূখণ্ড এই যুক্তিতে। এই গণরাষ্ট্রগুলির মধ্যে অনেক-ক’টাই আদিতে ছিল রাজা শাসিত রাজ্য, পরে গণ শাসিত রাষ্ট্রে পরিণত হয়, আবার কিছু গণরাষ্ট্র পরে পাশা উলটে রাজ্যে পরিণত হয়। যেমন বিদেহ ছিল শুরুতে রাজতন্ত্র আবার পরে খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে গণরাষ্ট্রে পরিণত হয়। আবার সেই সময়ে কুরু ছিল রাজতন্ত্র, পরে সেটি গণরাষ্ট্রে পরিণত হয়। গণ এবং সংঘের ফারাকটা ঠিক স্পষ্ট নয়, বৃজ্জি ও মল্লকে প্রাচীন লেখাতে সংঘ বলে উল্লেখ করা আছে। বোধহয় বড়োসড়ো রাষ্ট্রদের সংঘ আর ছোটোখাটোদের গণ বলা হত।

গণরাষ্ট্রগুলির মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ও বর্ণময় ছিল হিমালয়ের পাদদেশে বৃজ্জি বা বজ্জি (পালি), যা ছিল আটটি বা নয়টি গোষ্ঠীর এক মিলিত সংঘ, যার রাজধানী ছিল বৈশালী। এই গোষ্ঠীগুলির মধ্যে চারটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গোষ্ঠী ছিল বৃজ্জি, লিচ্ছবি, বিদেহ ও ন্যায় বা জ্ঞাতৃকা। অন্যান্য গোষ্ঠীগুলির, যেমন উগ্র, ভোগ, কৌরব বা ঐক্ষবক – এদের কথা খুব কমই জানা যায়। এই চার গোষ্ঠীর সকলের আবার আলাদা আলাদা রাজধানী ছিল। রামায়ণে বর্ণিত বিদেহ নামে রাজ্যটি সেই যুগে হিমালয়ের কোলে এই গণরাষ্ট্রর অন্তর্গত ছিল, যার রাজধানী ছিল মিথিলা, রামায়ণের সাথে সামঞ্জস্য রেখেই। জ্ঞাতৃকাদের রাজধানী ছিল কুন্দপুর এবং বৃজ্জি ও লিচ্ছবিদের রাজধানী ছিল বৈশালী, যা ছিল সমস্ত মিলিত সংঘের প্রধান রাজধানী বা হেডকোয়ার্টারও। বৈশালী ছিল সুদৃশ্য নগর প্রাকার, সুউচ্চ সৌধ ও পদ্ম-পুষ্করিণী দিয়ে সাজানো সেই যুগের এক বিখ্যাত নগরী। লিচ্ছবিদের সাথে কোশলরাজ্য ও মল্লগণের সম্পর্ক ভালো ছিল, কিন্তু মগধের সাথে ছিল ঝগড়া। একবার লিচ্ছবিরা মগধরাজ বিম্বিসারের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করে। তারপর বৃজ্জিদের নেতা চেতকের (সম্পর্কে জৈন তীর্থংকর মহাবীরের মামা) কন্যা চেল্লনার সাথে বিম্বিসারের বিয়ে হবার পর লিচ্ছবি আর মগধের মধ্যে শান্তি স্থাপন হয় এবং যতদিন বিম্বিসার বেঁচে ছিলেন ততদিন এই শান্তি বজায় ছিল। এই আট-ন’টি সংঘ সকলে মিলেমিশে বৃজ্জি শাসন, এটা বেশ কয়েকশো বছর নির্বিঘ্নে চলেছিল, কিন্তু বিম্বিসারের ছেলে অজাতশত্রুর সময় মগধের সাথে বৃজ্জি-লিচ্ছবি সংঘের  শত্রুতা বেড়ে এক যুদ্ধে পরিণত হয়। এই যুদ্ধের কথা এই প্রবন্ধে পরে আসবে।

মল্ল গণরাজ্যটি ছিল বৃজ্জিদের পশ্চিমে এবং সেটাও ছিল নয় গোষ্ঠীর মিলিত সংঘ। এদের দুটি রাজধানী ছিল, কুশীনর ও পাব। মল্লদের উল্লেখ মহাভারতের ভীষ্মপর্বেও আছে। মনু মল্লদের ব্রাত্য-ক্ষত্রিয় বলেছেন। মল্লরা শুরুতে রাজা শাসিত রাজ্য ছিল, কুশ-জাতকে ইক্ষাকু নামে মল্লদের এক রাজার নাম পাওয়া যায়। পরে মল্লরা সংঘে পরিণত হয়। এদের সাথে বৃজ্জিদের বেশ ভাব ছিল। এরা প্রধানত বৌদ্ধ ও জৈনধর্মের অনুসরণ করত। বুদ্ধের মৃত্যুর কিছু পরেই মল্লদের দেশ মগধের অন্তর্ভুক্ত হয়।

যখন অন্যান্য রাজাদের রাজ্যগুলি ছিল গঙ্গা-যমুনার মতো নদীগুলির উর্বর সমতলভূমিতে, তখন বেশির ভাগ গণরাষ্ট্রগুলি ছিল হিমালয়ের পাদদেশে। মৎস্য কিন্তু হিমালয়ের পাদদেশে ছিল না, এটা ছিল বর্তমান রাজস্থানে, জয়পুর, আলওয়ার ও ভরতপুরের অঞ্চলগুলি নিয়ে। এই রাজ্যের স্থাপক বিরাটের নাম অনুযায়ী এর রাজধানীর নাম ছিল বিরাটনগর, বর্তমানের বৈরাট। এই বিরাট কি মহাভারতের রাজা বিরাট? তবে মৎস্য গণরাষ্ট্র ছিল কিনা সেই নিয়ে সন্দেহ আছে।

মৎস্য গণের সাথে আর একটি বিখ্যাত গণরাজ্য,  শূরসেন রাজ্যের সম্পর্ক বেশ ভালো ছিল। শূরসেন রাজ্যটির, সাথে হিন্দুদের এক প্রিয় দেবতার নাম জড়িয়ে আছে। শূরসেনদের রাজধানী ছিল যমুনা তীরবর্তী মথুরা (পাঠান্তর মদুরা)। বৌদ্ধ শাস্ত্রে এর রাজার নাম অবন্তীপুত্র, যিনি বুদ্ধের শিষ্য ছিলেন। আর মহাভারত ও পুরাণ অনুযায়ী এই রাষ্ট্রটির শাসন করতেন যদু বা যাদবগণ, বৃষ্ণিগণ যার শাখা ছিলেন। মেগাস্থিনিসের ইন্ডিকাতেও শূরসেনের উল্লেখ আছে।

বৌদ্ধশাস্ত্রে কপিলাবস্তুর শাক্যদের গণরাষ্ট্র বলা হয়েছে। আরও বলা আছে যে শাক্যরা সভার মাধ্যমে যুদ্ধ, শান্তি, সন্ধি, জোটবাঁধা ইত্যাদি নীতি স্থির করত। বুদ্ধ শাক্যবংশে জন্মেছিলেন বলে বৌদ্ধশাস্ত্রে এদের সম্বন্ধে বিশদভাবে বলা আছে। কোশলরাজ প্রসেনজিতের স্ত্রী শাক্যবংশীয় ছিলেন। পরে প্রসেনজিতের পুত্র বিধুদ্ধব শাক্যবংশ ধ্বংস করে।

কোলিয় গণরাষ্ট্রটি ছিল শাক্যদের পূর্বে, রোহিণী নদী এই দুই-এর সীমানা নির্ধারণ করত। সম্ভবত শাক্যদের সাথে এদের আত্মীয়তা ছিল। কোলিয়দের নাকি এক ধরনের নগররক্ষক বা পুলিশ ফোর্স ছিল, যারা বিচিত্র পাগড়ি পরে থাকত ও নাগরিকদের পীড়ন করত। ব্যাপারটা বেশ চেনা চেনা লাগছে, তাই না?

ভগ্‌গ নামে আর একটি গণরাষ্ট্রের সন্ধান পাওয়া যায়, যমুনা ও শোন নদীর মাঝে কোথাও এক জায়গায়। এদের রাজধানী ছিল সুংসুমারা পাহাড়ে। সম্ভবত এরা বৎসরাজ্যের অধীনস্থ ছিল বা আত্মীয়তা সূত্রে বদ্ধ ছিল।

পিপ্পলিবনের অধিবাসী মোরিয়গণের সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানা যায় না, তবে পণ্ডিতেরা মনে করেন ষষ্ঠ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের এই মোরিয়দেরই এক বংশধর চন্দ্রগুপ্ত পরে উত্তর ভারতের বিরাট মৌর্য সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন।

পাণিনির অষ্টাধ্যায়ীতে ক্ষুদ্রক, মালব, অম্বষ্ঠ, হস্তিনায়ণ, মদ্র, মধুমন্ত, শিবি, ইত্যাদি বহু গণের কথা বলা আছে। অপেক্ষাকৃত পরে বৃষ্ণি, অন্ধকদের মথুরা অঞ্চলের সংঘ হিসেবে উল্লেখ আছে এবং বাসুদেব কৃষ্ণকে  ‘সংঘ-মুখ্য’ বলা হয়েছে। এছাড়াও, অলকাপ্পার বুলি, কেশপুত্রের কালাম – এদেরও গণরাষ্ট্র বলে উল্লেখ করা আছে।

অনেক ঐতিহাসিক গণরাষ্ট্রগুলিকে প্রজাতন্ত্র বলে আখ্যা দিয়েছেন, ও গ্রীসের রিপাবলিকের সাথে তুলনা করে। বর্তমানের ঐতিহাসিকরা আরো নিরপেক্ষ বিচার করেছেন ও এগুলিকে Oligarchy বলেছেন, কারণ এদের শাসনব্যবস্থায় ক্ষমতা মুষ্টিমেয় কিছু অভিজাত কূলের হাতে ন্যস্ত ছিল। এই অভিজাত সম্প্রদায় ছিল বিভিন্ন ক্ষত্রিয়কুলের প্রধানেরা। গণরাষ্ট্রের নেতাকে গণপতি, গণ-জ্যেষ্ঠ, গণরাজা অথবা সংঘ-মুখ্য নামে অভিহিত করা হত। অভিজাতকুল যেখানে সভা করতেন সেই জায়গার নাম ছিল সন্থাগার। দৈনন্দিন কাজকর্ম অল্প কিছু লোকের দ্বারা চালিত হত।

অনেক সময় গণরাষ্ট্রের বহু রাজার উল্লেখ পাওয়া যায়। যেমন একপন্ন জাতকের কথা ধরতে গেলে লিচ্ছবিগণের ৭৭০৭ রাজা, সেই সংখ্যক উপরাজা ও সেনাপতি ছিল। বৌদ্ধ শাস্ত্র মহাবাস্তু-তে আবার এই সংখ্যাটা অনেক বাড়িয়ে বলা হয়েছে। ঐতিহাসিকরা মনে করেন এই সংখ্যাটা হচ্ছে বিভিন্ন ক্ষমতাশালী ক্ষত্রিয় পরিবারের সংখ্যা, যেখানে ‘রাজা’ হচ্ছে পরিবারের প্রধান ও উপরাজা হচ্ছে তাদের বড় ছেলেরা।

ভদ্দশাল জাতকে বলা আছে এই ক্ষত্রিয় পুরুষ প্রধানের দল বছরে একবার বসন্ত উৎসবের সময় মিলিত হতেন, কাছের এক ‘পোক্‌খরণী’ (পুষ্করিণী) তে স্নান করে সভাগৃহে হাজির হতেন রাজকীয় কাজকর্ম করতে। এই রকম একটি সভাতেই বিখ্যাত রূপোপজীবিনী অম্বাপালিকে (পাঠান্তর আম্রপালী) কোনো এক বিশেষ সম্মানে ভূষিত করা হয়েছিল। সভা শুরু হত ঢাক-ঢোল কাড়া-নাকাড়া পিটিয়ে সকলকে জানান দিয়ে। প্রত্যেকের জন্য আসন নির্দিষ্ট করা থাকত। সভার সংখ্যাপূর্তি বা কোরামের দায়িত্বে থাকতেন ‘গণ-পূরক’। নেতা নির্বাচন বা ভোটাভুটিটা ছিল বেশ চিত্তাকর্ষক। নির্বাচন হত কাঠের শলাকার মাধ্যমে। একজন নির্বাচন কমিশনারও থাকত, যাকে বলা হত ‘শলাকা-গহপাক’ এবং তিনি ছিলেন তাঁর সততা ও নিরপেক্ষতার জন্য সকলের সম্মানিত কোনো ব্যক্তি। গণরাষ্ট্রগুলির গঠন ও কাজের সঙ্গের অনেকে বৌদ্ধ সংঘের মিল খুঁজে পান।

বৌদ্ধ ও জৈন শাস্ত্রগুলিতে গণরাষ্ট্রগুলির উল্লেখ থাকলেও, ব্রাহ্মণ্য শাস্ত্রে এদের উল্লেখ প্রায় নেই বললেই চলে। এর কারণ হিসেবে বলা হয় সে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের কেন্দ্রে ছিল ব্রাহ্মণ পুরোহিত ও রাজা, তাই রাজা বিহীন দেশকে যথেচ্ছাচারী বলে মানা হত। গণরাষ্ট্রগুলিতে কিন্তু ব্রাহ্মণদের কোনো বিশেষ সম্মান দেওয়া হত না। গণের ইতিহাস দেখলে তাতে ব্রাহ্মণদের কোনো বিশেষ দান বা ভূমিদানের উল্লেখ নেই বললেই চলে, অথচ এই দানগুলির সেযুগের রাজতন্ত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। অনেকের মতে যেহেতু গণগুলি ক্ষত্রিয়কুল শাসিত ছিল, সেজন্যে গণরাষ্ট্রগুলিতে  ক্ষত্রিয় ছাড়া অন্যান্য জাতি বর্ণের রাজনৈতিক স্থিতি ও সম্ভবত সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্থিতি ক্ষত্রিয়কুলের তুলনায় নীচে ছিল। পালি  ‘অমবত্থ সুত্তে’ (Pali Canon -দীঘ নিকয়) লেখা আছে যে যখন ব্রাহ্মণ অমবত্থ কপিলাবস্তুতে এসেছিলেন, তখন জনতা তাকে দেখে হেসেছিল ও কোনো সম্মান দেয় নি। অবশ্য Pali Canon-এর মতো বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থে এই বিষয়ে নিরপেক্ষতা আশা করা মুস্কিল হতে পারে।

গণরাষ্ট্রগুলির মিলিত শক্তিই ছিল তাদের সবচেয়ে বড় সম্পদ ও একই সঙ্গে তাদের সবচেয়ে বড়ো দুর্বলতা। অর্থশাস্ত্রে বলা আছে যে রাজাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কৌশল গণরাষ্ট্রগুলির বিপক্ষে খাটে না। সাধারণ যুদ্ধ কৌশলে গণরা অজেয়, তাই সেখানে বিভেদের মাধ্যমে দুর্বলতা সৃষ্টি করার পরামর্শ দেওয়া আছে। অজাতশত্রু দীর্ঘদিন যুদ্ধ করেও বৃজ্জি-লিচ্ছবিদের জয় করতে পারেন নি। বৌদ্ধ ‘মহাপরিনিব্বান সুত্তে’র গল্পে আছে যে ভগবান বুদ্ধ যখন রাজগৃহে অবস্থান করছিলেন, তখন অজাতশত্রু তার মন্ত্রী ভাস্করকে পাঠান তাঁর কাছে। অজাতশত্রু ভাস্করকে বলেন যে আপনি গিয়ে বুদ্ধকে বলবেন যে আমি বৃজ্জি আক্রমণ করব। তারপর বুদ্ধ কি বলেন তা শুনে আসবেন, কারণ তিনি ভবিষ্যতদ্রষ্টা। বুদ্ধ বলেন যে তিনি বৈশালীতে থাকার সময় তাদের শিক্ষা দিয়ে এসেছিলেন কি করে একত্রে থাকতে হয়, বয়োজ্যেষ্ঠদের সম্মান করতে হয়, নারীদের সম্মান ও রক্ষা করতে হয়, ইত্যাদি। যতদিন বৃজ্জিরা এই উপদেশ মেনে চলবে, ততদিন তাদের উন্নতি হতে থাকবে ও তাদের যুদ্ধে পরাজিত করা অসম্ভব। ভাস্কর সেই কথা যখন এসে অজাতশত্রুকে বললেন, তখন রাজা বুঝতে পারলেন যে একমাত্র বিভেদ সৃষ্টির দ্বারাই বৃজ্জিদের পরাজিত করা সম্ভব ও ভাস্করকে সেই কাজে গুপ্তচর করে পাঠালেন। ভাস্কর অনেক সময় নিয়ে কৌশলের সাহায্যে বৈশালীতে বিভেদ আনলেন ও অজাতশত্রুর হাতে বৃজ্জির পরাজয় ঘটল।

পরাজিত হলেও বৃজ্জি-লিচ্ছবির ক্ষমতা যে একেবারে অস্তমিত হয় নি সেটা প্রায় আট  শতাব্দী পরেও দেখতে পাই, যখন গুপ্ত রাজা চন্দ্রগুপ্ত লিচ্ছবি দুহিতা কুমারদেবীকে বিয়ে করেন ও স্বর্ণমুদ্রায় রাজার সাথে রাণীরও ছবি প্রচলন করেন। তাদের সন্তান সমুদ্রগুপ্তও নিজেকে লিচ্ছবি-দৌহিত্র বলে প্রচার করেছেন। কাজেই লিচ্ছবিদের সাথে আত্মীয়তা তখন গৌরবের বিষয় ছিল।

গণরাষ্ট্র গুলির কথা মেগাস্থিনিসের ইণ্ডিকা ও গ্রীক লেখকদের লেখাতেও পাওয়া যায়। মহাভারতেও এই ধরণের রাষ্ট্রের উল্লেখ আছে। যৌধেয়, মালব, উদ্দেহিক ও অর্জুনায়ণ গণগুলির নাম-অঙ্কিত মুদ্রা খ্রীষ্টাব্দ প্রথম শতাব্দীগুলিতে পাওয়া যায়।

গণরাষ্ট্রগুলির শেষ হয় কি ভাবে? আলেকজান্ডারের ভারত অভিযানের সময় উত্তর পশ্চিমের ছোট ছোট গণরাষ্ট্রগুলি, যেমন মদ্র, মধুমন্ত, অশ্বায়ন, ইত্যাদিরা, তাকে সবলে তাকে বাধা দিয়েছিল, কিন্তু তার সমরকৌশলের কাছে দাঁড়াতে পারেনি। গুপ্ত সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের ভারত বিজয়ের সাথে সাথে প্রায় এক হাজার বছরের গণরাষ্ট্রগুলির ইতিহাসে যবনিকা নেমে আসে।

ভাবতেও ভালো লাগে যে, প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের বিশাল সভাগৃহে খালি রাজারাই নয়, গণরাজারাও সসম্মানে সিংহাসনে বসে জনকল্যাণে ব্রতী হয়েছিলেন।

তথ্যসূত্র সংগ্রহ

  1. Majumdar R C (Ed), History and Culture of Indian People – Vol II (Age of Imperial Unity), Bharatiya Vidya Bhavan, Bombay 1960, pp 1-17
  2. Singh, Upinder, History of Ancient and Medieval India, Dorling Kindersley, Delhi, 2008, pp. 260-269

 


লেখক পরিচিতি - যাদবপুর ও ব্যাঙ্গালোরের ইন্ডিয়ান ইনস্‌টিটিউট অফ সায়েন্সের প্রাক্তনী। বর্তমানে আমেরিকার সেন্ট লুইস্‌ (মিসৌরী) শহরবাসী। ইতিহাস পেশা নয়নেশা। প্রাচীন ভারতের ইতিহাস ও Indology নিয়ে নাড়াচাড়া করতে ভালবাসেন।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।