প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

প্রাচীন ভারত

সুকুমারী ভট্টাচার্য স্মরণ সংখ্যা , জুন ৩০, ২০১৫

 

হরপ্পা সভ্যতার গবেষণা ও কিছু রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি

দিলীপ চক্রবর্তী

হরপ্পা গবেষণার চার ধরণের রাজনৈতিক ও আদর্শগত সমস্যা দেখা যায়। প্রথমটা শুরু হয়েছিল ১৯২৪ সালে হরপ্পা সভ্যতার আবিষ্কারের পরে পরেই, তার ভাষা নিয়ে। এস কে চ্যাটার্জীর মতে হরপ্পার ভাষা ছিল দ্রাবিড় জাতীয় আর সেই তত্ত্ব তামিলনাডু ও দক্ষিণ ভারতের দ্রাবিড় পন্থীদের মধ্যে এত বেশী গৃহীত হয়েছিল যে এর বিরোধিতা করাও এখনো পাপ বলে মনে করা হয়। এই ধারণার বজ্রমুষ্টি এখনও আলগা হয় নি, অন্তত তামিলনাড়ুতে। চেন্নাই-এর রোজা মুথাইয়া রিসার্চ লাইব্রেরীতে প্রকাশিত “Dravidian proof of the Indus script via the Rig Veda : A Case Study” গবেষণাপত্রটিতে আই মহাদেবন বলেছেন যে হরপ্পার লিপি প্রাচীন দ্রাবিড় লিপির একটি আদি রূপ বলাটাই সঠিক। হিন্দু পত্রিকার ১৫ নভেম্বর, ২০১৪ সালে বলা হয়েছে –

“সিন্ধু সভ্যতা ভেঙ্গে পড়ার পর... এই সভ্যতার কিছু জনসংখ্যা দক্ষিণ ভারতের দিকে চলে যায় এবং ‘সিন্ধু দ্রাবিড় দক্ষিণের দ্রাবিড় ভাষাগুলিকে প্রভাবিত করে’। এই মাইগ্রেশনের শুরুর দিকের কিছু  চিহ্ন ‘পুরোনো তামিল’ ভাষাতে পাওয়া যায়।”
মহাদেবনের মতে গবেষণা প্রাপ্ত ফল বলছে যে “সিন্ধু সভ্যতার উত্তরপুরুষেরা ইন্দো-আর্য ভাষাকে গ্রহণ করে, এবং সিন্ধু সভ্যতা ও গোড়ার দিকের বৈদিক সভ্যতার মধ্যে একটা লম্বা সময়ের ফাঁক আছে”।  মহাদেবন, যিনি সিন্ধু সভ্যতার লিপি নিয়ে ১৯৬৮ সাল থেকে গবেষণা করেছেন, আরো বলছেন যে বৈদিক যুগ সিন্ধু সভ্যতার পরবর্তী ও “ঋগ্বেদ হচ্ছে দুটি সভ্যতার যৌগিক ফল”।

সিন্ধু সভ্যতার বাসিন্দারা ইন্দো-আর্য ভাষায় কথা বলত এই তত্ত্বটি পরে পরে গড়ে উঠলেও, এখনকার পণ্ডিতদের মধ্যে যারা বিশ্বাস করেন যে সিন্ধু সভ্যতাই হচ্ছে ভারতের সংস্কৃত-কেন্দ্রিক সভ্যতার উৎস, তাদের মধ্যে এই তত্ত্বটি এখনও খুব ভালভাবেই গৃহীত। তবে শুরু শুরুতে সিন্ধু সভ্যতা অ-বৈদিক ও প্রাক-বৈদিক এই যুক্তির স্বপক্ষে প্রচুর পাণ্ডিত্যপূর্ণ প্রচেষ্টা হয়েছিল। John Marshall (১৯৩১) তার মহেঞ্জোদারো রিপোর্টে এর স্বপক্ষে বললেও, আর পি চন্দ-র মতো তার অন্য কিছু সহকর্মীরা এই ব্যাপারে সম্পূর্ণ সহমত ছিলেন না ও তারা প্রস্তাব দিয়েছিলেন এই সভ্যতাতে ঋগ্বেদের একটা আভাস আছে। এটা অবশ্য সেযুগে কোনো রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি পায় নি।  ঋগ্বেদের সাথে সম্পর্কের স্বপক্ষে তর্ক করেছিলেন বি এন দত্ত, যিনি একসময় আন্তর্জাতিক কম্যুনিস্ট আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন। এই মতটি আরো জোরালো ভাবে দেখা যায় ভারতীয় ইতিহাস কংগ্রেসে পি ভি কানে-র প্রেসিডেন্সিয়াল বক্তৃতাতে, যেটি ১৯৫৩ সালে প্রকাশিত হয়। সিন্ধু সভ্যতা প্রাক-বৈদিক বা অ-বৈদিক এই মতবাদের বিশ্বাস কিন্তু হারিয়ে যায় নি। ১৯৪৬ সালে Mortimar Wheeler হরপ্পায় পুরাতাত্ত্বিক খননের পর সেই তত্ত্বটা আরো বেশী করে জেঁকে বসে।  এর কারণ Wheeler পুরাতাত্ত্বিক স্তরের নমুনার ব্যাখ্যা করে বলেন যে এই শহর বহিরাগতের আক্রমণের ফলে ধ্বংস হয়েছিল ও সেই বহিরাগতরা ছিল তথাকথিত আর্যরা, যাদের ‘পুর-ধ্বংসের’ কথা ঋগ্বেদে উল্লেখ আছে। এটা স্বাধীন ভারতের পুরাতাত্ত্বিকদের কাছে সাদরে গৃহীত হয়েছিল। যে কয়েকজন পুরাতাত্ত্বিক Wheeler-এর সাথে সহমত ছিলেন না, তাদের মধ্যে কে এন শাস্ত্রীর নাম উল্লেখযোগ্য। যাদের মতে সভ্যতার সূর্য পশ্চিমে উদিত হয়েছিল, সেই সব ভারতীয়দের মধ্যে Wheeler-এর মতবাদ কেন স্বীকার পেয়েছিল সে বিষয়ে আমি মন্তব্য করতে চাই না। তবে এই সহজ তথ্যটি স্বাধীনতাত্তোর ভারতের পুরাতাত্ত্বিকদের মধ্যে জাতীয়তাবাদের অভাবের দিকটি আলোকপাত করে। তবে বহিরাগতদের আক্রমণে সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংসের তত্ত্বটি প্রভাব হারিয়েছে একথা বললে ভুল হবে। ডাঃ বরুণ সিং, যিনি মূলত একজন ডাক্তার স্কলার, এক ই-মেল সিরিজে, Robbins Schug (2012)-এর একটি লেখার তাৎপর্য নিয়ে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।

“হরপ্পার জনগণের মধ্যে গভীর আঘাত সম্বন্ধিত এক নতুন গবেষণাতে দাবী করা হয়েছে যে সেখানে অন্যান্য প্রাচীন শহরগুলির থেকে অনেক বেশী আঘাতের প্রমাণ পাওয়া গেছে (Robbins Schug et al, 2012)। সেখানে পাওয়া ৪% কঙ্কালের অবশিষ্টাংশে অথবা ১৫.৫% মাথার খুলিতে গভীর আঘাতের বাহুল্য পাওয়া গেছে। গবেষকরা ১৯২৯ থেকে ১৯৪৮ পর্যন্ত পুরাতাত্ত্বিক স্থানগুলিতে পাওয়া মানুষের অবশেষ পরীক্ষা করেছেন। Dr Nancy Lovell পরীক্ষিত ও ১৯৬৭-৬৮ এবং ১৯৮৬-৮৯ সালের নমুনাগুলি এই গবেষণা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। এঁদের গবেষণার মূল উদ্দেশ্য ছিল হরপ্পা সত্যিই এক ‘শান্তিময় স্থান’ ছিল কি না এবং সামাজিক ভেদাভেদ ও হিংসার কাঠামো বিহীন একটি রাষ্ট্র ছিল কি না, তার পরীক্ষা করা। কিন্তু তাদের পাওয়া ফলাফল বিপরীত নির্দেশ দেয়, যাতে হিংস্রতাই এই আঘাতগুলির সম্ভব্য প্রধান কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়। সর্বশেষ সংক্ষিপ্তসারে এরা আর্যদের আক্রমণের তত্ত্বটিকে দূরীভূত করার জন্য খেদ করেছেন এবং আরো বলেছেন যে Kennedy ইত্যাদি গবেষকরা হরপ্পাতে হিংস্রতা জনিত আঘাতের তথ্যগুলিকে অবহেলা করাই এটার এক সম্ভব্য কারণ।”
Schug-এর যে গবেষণাপত্রটি বরুণ সিং উল্লেখ করেছেন সেটি হল “A Peaceful Realm? Trauma and Social Differentiation at Harappa?”  এটি International Journal of Paleopathology 2, 2012, pp 136-147 প্রকাশিত, সাথে দুজন ভারতীয় সহ-লেখক Deccan College-এর বীণা মুশ্রিফ-ত্রিপাঠী এবং Anthropological Survey of India-র অনেক্রম সাংখ্যায়ণ। বলাই বাহুল্য যে এটি মূলত Robbins Schug-এর গবেষণা, যাতে ত্রিপাঠী ও সাংখ্যায়ণ সাহায্য করেছেন।

সিন্ধু সভ্যতা নিয়ে দ্বিতীয় সমস্যাটি হল এর মূল উৎস সম্বন্ধে। যদিও John Marshall বিশ্বাস করতেন ও তার মহেঞ্জোদারো রিপোর্টে লিখেছেন যে এই সভ্যতার মূল উৎস ভারতেরই মাটিতে, তখন থেকেই একটা ধারাবাহিক চেষ্টা চলেছে এর মূল উৎস মেসোপটেমিয়ার সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত করবার। এই ধারনাটি বিভিন্ন আকার-আকৃতিতে এখনও কিছু ইন্দোলজিস্ট ও পুরাতত্ত্ববিদদের মধ্যে চালু আছে। ইতালীয় ইন্দোলজিস্ট Verardi যখন মহেঞ্জোদারোর স্তূপে জিজ্ঞুরাত (Ziggurat) এর কথা ভাবেন, তখন তিনি এরই ইঙ্গিত দেন। অথবা আমেরিকান G. Possehl-এর মতো অন্য পশ্চিমী পুরাতাত্ত্বিকেরা যখন এর মূল উৎস ব্রোঞ্জ যুগে মধ্য এশিয়ার সাথে মেলামেশা বা দেয়া-নেয়ার মাঝেই নিহিত ভাবেন, তাঁরা মূলত এই ধারণাটিকেই চিরস্থায়ী করার প্রচেষ্টা করেন। এই ধারণাটির বেশ কয়েক ধরনের অর্থ থাকতে পারে। যেমন ধরা যাক, যখন বলা হয় সিন্ধু সভ্যতার তারিখ মেসোপটেমিয়ার ক্লাসিক বিকাশের কিছু পরে, তখন এই ধারণাটিরই প্রতিধ্বনি শুনতে পাওয়া যায়। ভারতের ইতিহাস বিষয়ে বহু ভারতীয় ও বিদেশী বইয়ে নির্দ্বিধায় এই ধারণাটিকে গ্রহণ করেছে বলে মনে হয়। সম্প্রতি পাকিস্তানের Mukhtar Ahmed-এর “Pakistan – An Archelogical History (2014)”  বইয়ে এটারই এক চিত্তাকর্ষক অভিব্যক্তি দেখা যায়। যদিও Dr. Ahmed পেশাদার শিক্ষক নন, তিনি এই ব্যাপারে যথেষ্ট আগ্রহ দেখিয়েছেন ও দক্ষিণ এশিয়ার পুরাতত্ত্ব নিয়ে একটি বড়ো বই লিখেছেন।  তাঁর মতে পুরাতাত্ত্বিক তথ্যে একটা দ্রুত চোখ বোলালেই দেখা যায় যে বর্তমান পাকিস্তান নামে পরিচিত অঞ্চলটি সর্বদাই ভারত নামের অঞ্চলটিকে এড়িয়ে চলেছে এবং সংস্কৃতি ও জেনেটিক্স-এর দিক দিয়ে মধ্য এশিয়ার দিকেই ঝুঁকে আছে। যদি আমার ঠিকঠিক মনে থাকে, এই ধারণাটি প্রথম যার লেখায় পাওয়া যায় তিনি এ এচ দানী, যিনি আসলে ছত্তিশগড়ের মানুষ ও বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষিত। তিনি তাঁর কেরিয়ারের শেষের দিকে এই নিয়ে চুপচাপ থাকলেও, আমাদের পাকিস্তানি সহকর্মীদের ক্রেডিট দিতে হবে যে তাঁরা কেউই সিন্ধ বা খাইবার পাখতুঙ্খয়ার সাথে গঙ্গা-যমুনার সমতলভূমি বা উপমহাদেশের আরো ভেতরের চিরাচরিত যোগাযোগ অস্বীকার করেন নি। আসল কথাটা হচ্ছে যে মধ্য এশিয়ার সাথে হরপ্পা সভ্যতার তথাকথিত affinity বহু ভারতীয় পুরাতাত্ত্বিকের লেখাতে দেখা যায় প্রত্যক্ষ ভাবে, যেমন আছে শিরীন রত্নাগরের লেখায় (যা Mukhtar Ahmed তাঁর লেখায় অনুমোদন ও উল্লেখ করেন) কিংবা পরোক্ষভাবে, যারা মধ্য এশিয়ার সাথে ভারতের পুরাতাত্ত্বিক যোগাযোগের প্রমাণ হুট করতেই খুঁজে বার করেন। একদল ভারতীয় পুরাতাত্ত্বিকদের একটা ক্রমবর্ধমান বিশ্বাস আস্তে আস্তে দৃঢ় হচ্ছে যেটা হল, হরপ্পা সভ্যতার পূর্বদিকের পাওয়া সাইটগুলির বয়েস পশ্চিম দিকের সাইটগুলির তুলনায় কম নয়। (গত ৫০ বছরে পঞ্জাব, হরিয়ানা ও পূর্ব উত্তর প্রদেশে বহু প্রাচীন পুরাতাত্ত্বিক সাইট পাওয়া গেছে যাদের বয়েস হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোর কাছাকাছি। এদেরকে এই লেখাতে পূর্ব দিকের সিন্ধু সভ্যতা বলা হয়েছে – সম্পাদক) আর ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হচ্ছে যে, ভারতীয় উপমহাদেশের ও অন্যান্য কিছু পুরাতাত্ত্বিকেরা এই তত্ত্বটি দীর্ঘদিন ধরে বাধা দেবার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। আসলে সিন্ধু সভ্যতার পূর্বের শুরুটা পশ্চিমের শুরুর কাছাকাছি। যদিও এই ব্যাপারটা এখনো আমাদের কাছে স্পষ্ট হয় নি, তবে তার একটা আভাস ইতিমধ্যেই পাওয়া যাচ্ছে।

এর সাথে আরো একটা তথ্য জড়িয়ে আছে - রাজস্থানের আরাবল্লী অঞ্চলে একটা আলাদা ও সম্ভবত স্বনির্ভর সভ্যতা গড়ে উঠেছিল যা ছিল ভারতীয় উপমহাদেশে কৃষি ও ধাতুবিদ্যার কেন্দ্র। এর স্বপক্ষে প্রমাণ ক্রমশই দৃঢ় হয়ে উঠছে। আর হরপ্পার বিকাশে এই অঞ্চলের সম্ভব্য অবদান কিছুতেই উপেক্ষা করা যায় না।  সেই রকম পূর্বদিকের বিকাশের ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে।  গঙ্গার অববাহিকায় গোড়ার দিকের ধান চাষ হরপ্পার সংস্কৃতি ও বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে ছিল, যা হরিয়ানাতে পাওয়া হরপ্পা সভ্যতার কিছু চাল থেকে বোঝা যায়। হরপ্পা সভ্যতা যে বালুচিস্তান থেকে কৃষিকাজের উন্নতির সাথে সাথে একমুখী হয়ে পূর্বদিকে চলেনি তা বোঝা যায় পূর্ব দিকের এই ধরণের অবদান গুলি থেকে। আরো একটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হচ্ছে যে হরিয়ানার টিন (ধাতু) সমৃদ্ধ তুসাম অঞ্চলের খনক নামের এক জায়গায় টিন নিষ্কাসনের প্রমাণ পাওয়া গেছে, যা প্রাচীন ও পরিণত হরপ্পার আমলের। হরিয়ানার তুসাম অঞ্চলের প্রচুর টিন ধাতুর আকর যে হরপ্পার টিনের যোগান দিতে পারে বর্তমান লেখকই প্রথম এই তথ্যটির প্রতি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। লেখক রোহতক-এর ড. বিকাশ পাওয়ারের  কাছে জানতে পারেন যে খনক নামের জায়গাটিতে ছাই ও কিছু প্রাচীন এবং পরিণত আমলের হরপ্পার ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। এই তথ্যটি জানার পর লেখক বেনারসের প্রফেসর আর এন সিংহ –কে এই জায়গার পুরাতাত্ত্বিক খনন করতে অনুরোধ করেন ও এখানে স্থানীয় টিন নিষ্কাসন হত কিনা তা খুঁজে দেখতে বলেন। প্রফেসর সিংহ পরে জানান যে লেখকের অনুমান ঠিক ও এখানে স্থানীয় টিন নিষ্কাসনের চিহ্ন পাওয়া গেছে।

তৃতীয় সমস্যাটা হচ্ছে বৈদিক সাহিত্যের সাথে হরপ্পার তুলনামূলক বিচার। যদি হরপ্পাকে প্রাক-বৈদিক এবং অ-বৈদিক বলে ধরা যায়,  তাহলে বলতে হয় যে ভারতে হিন্দুধর্মের বিকাশ আসলে সিন্ধু সভ্যতার শেষে বহিরাগত আর্যদের দ্বারা ভারতে আনীত। যখন হরপ্পা সভ্যতায় হিন্দু ধর্মের উপাদানের কথা উঠলে বিদেশী এবং উপিন্দর সিংহ-এর মতো ভারতীয় ঐতিহাসিকরা চমকে ওঠেন, তখন তাঁরা উপরিউক্ত তত্ত্বটিরই পরোক্ষে সমর্থন করেন। ব্রিটিশ ঐতিহাসিক John Kay-কে Archeological Survey of India এবং National Cultural Fund থেকে স্পনসর করা হয়েছিল ভারতীয় পুরাতত্ত্বের প্রাচীন ইতিহাস নিয়ে একটি বই লিখতে। বহু ইন্টারনেটের লেখক হরপ্পা সভ্যতার ধর্মের ওপর তাঁর নিম্নলিখিত রচনা থেকে উদ্ধৃতি করেন –

“হরপ্পার ধর্মবিশ্বাস আমাদের অজানা। কোনো স্থানকে নিশ্চয়ভাবে মন্দির হিসেবে সনাক্ত করা যায় না। আর যজ্ঞের কুণ্ড, cult objects এবং দেব-দেবী সম্বন্ধে যে প্রচলিত তত্ত্বগুলি আছে, সেগুলি বহু শতাব্দী পরের ‘doubtful retrospective reference’-এর ভিত্তি করে তৈরি। ইসলামীয় জ্যোতির্বিদ্যা দিয়ে মিশরের পিরামডগুলির অবস্থান নির্ণয়ের তত্ত্বের মতো এই ধরনের অনুমানগুলিও বৃথা। সংক্ষেপে এই তত্ত্বগুলি মূলত কল্পনাপ্রসূত ও বিশ্বাসযোগ্য নয়।”

উপসংহারে এর অর্থ হচ্ছে যে হরপ্পার ধর্মবিশ্বাস অ-হিন্দু।  

যারা হরপ্পা সভ্যতা চলমান ভারতীয় ঐতিহ্যের উৎস হিসেবে সন্দিহান, তাঁরা চতুর্থ সমস্যাটির উল্লেখ করেন। তাঁরা বিশেষত গুজরাট ও অন্যান্য আঞ্চলিক সভ্যতাগুলির মধ্যে হরপ্পা সভ্যতাকে বার বার ‘imported element’ বলে প্রস্তাব করেন। ডেকান কলেজের ডিরেক্টর এম কে ধাওয়ালিকার ও বসন্ত শিন্ডে এবং বরোদার এম এস ইউনিভার্সিটির পুরাতত্ত্ববিদ ভি এচ সোনায়ানে ও অজিত প্রসাদ-এরা এই মতবাদ বিশ্বাস করেন। এই ভারতীয় ঐতিহাসিকদের মত অনুযায়ী এই ধরনের আঞ্চলিক সংস্কৃতিতে হরপ্পার প্রভাব হচ্ছে বিদেশী বা বহিরাগত। আর এটা হচ্ছে হরপ্পা সভ্যতাকে মূল ভারতীয় সভ্যতার ধারা থেকে আলাদা করে দেখানোর পৌনঃপুনিক চেষ্টা।

সামগ্রিক সিন্ধু সভ্যতায় আঞ্চলিক প্রভাব ও বিকাশের কথা অনস্বীকার্য, যদিও আমি নিশ্চিত নই যে এই ধরনের আঞ্চলিক প্রভাব আলাদা করে সনাক্ত করার জন্য মৃৎশিল্প (pottery) ছাড়া আর কোনো বৈশিষ্ট্য আছে কি না। এই তত্ত্বটির শুরু করেছিলেন G Possehl, যিনি আলাদা ভাবে Sorath Harappan কথাটি চালু করেন, যা বর্তমানে পুনে ও বরোদার ঐতিহাসিকেরা যথেচ্ছ ব্যবহার করেন এবং  এমনকি উত্তর গুজরাট ও মেহসানার আঞ্চলিক হরপ্পা সভ্যতাকে ‘Anarta Culture’ নামে অভিহিত করতে দ্বিধাবোধ করেন না। আমার আশ্চর্য লাগে যে Archeological Survey of India-তে এবং অন্যান্য কিছু অত্যুৎসাহী ব্যক্তি পঞ্জাব ও হরিয়ানার বিশাল অঞ্চলটিকে Bara Culture বলে থাকেন। কিছু পণ্ডিতের এই ধরনের প্রবণতা অনেকটা বৈষ্ণব, শৈব, ইত্যাদি বিভিন্ন মতবাদের পরিপ্রেক্ষিতে হিন্দুধর্মের বিরাট বিস্তারকে অস্বীকার করার মতন। খালি বিদেশী পণ্ডিতেরা নয়, খ্যাতনামা ভারতীয় ঐতিহাসিকেরাও এতে প্রচুর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। যেভাবে ব্যাপারটা এগোচ্ছে, তাতে ভবিষ্যতে ভারতীয় পণ্ডিতেরা তর্ক জুড়বেন যে সিন্ধু সভ্যতা বলে কোনো এক বিস্তৃত ও ব্যাপক সভ্যতা কোনোদিন ছিল-ই না।

সামগ্রিক ভাবে দেখতে গেলে হরপ্পা সভ্যতার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি বেশ বিভ্রান্তিকর দৃশ্য প্রদান করে। আমি বলতে চাই আর্যদের আগমন (Aryan Migration) এই বিতর্কের একমাত্র উপাদান নয়। এমনকি তথাকথিত আর্যদের সমস্যা কয়েকটি প্রারম্ভিক প্রশ্নের আওতার বাইরে নয়। আর যদি বৈদিক সাহিত্য সমূহ ভারতীয় সাহিত্য বলে গণ্য হয় তাহলে ভারতীয় উপমহাদেশের সীমার বাইরের গুরুত্বপূর্ণ কোনো কিছুর সাথে কিভাবে এদের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত করা যায়? কোনো প্রকল্পিত সভ্যতার বিষয়ে কাজ করার সময় ভাষাতত্ত্ব (Linguistics) কেন এত গুরুত্ব পাবে? ভাষাতত্ত্ব কি ভাষার বিবর্তন ও বিকাশের সময়কাল স্বাধীনভাবে অন্য কিছুর সাহায্য ছাড়াই নিরূপণ  করতে পারে?  আমি জানি যে কিছু পুরাতত্ত্ববিদ ‘Linguistic Archeology’-তে বিশ্বাস করেন - সেটা পুণের Linguistic Archeology-র সেমিনারেই হোক বা Cambridge-এর McDonald Institute of Archeological Research,  যেখানে এই থিমের সেমিনার অনেকবার হয়েছে, -  যেখানেই হোক, এই বিষয়ের একফোঁটা প্রমাণ আছে কি? ভারতের মতো দেশে, যেখানে অসংখ্য ভাষা বর্তমান, সেখানে প্রত্যেক ভাষা তাদের নিজেদের নিজেদের পুরাতাত্ত্বিক ইতিহাস দাবী করলে কি ধরনের সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব হাজির হবে তা কেউ কল্পনা করতে পারে কি? আমি দীর্ঘদিন ধরে এই বিশ্বাস পোষণ করে আসছি যে আর্য-সমস্যাটা একটা জাতি-বর্ণগত (racist) সমস্যা তাই একে কোনো শিক্ষাগত (academic) সমস্যা হিসেবে দেখা একেবারেই উচিত নয়। বৈদিক সাহিত্য সমূহ হচ্ছে আসলে ভারতীয় সাহিত্য, তাই এদের ভৌগোলিক বিস্তার ও কালক্রমের পর্যায় বিবেচনা করে এটা মনে হওয়াই স্বাভাবিক যে এরা সিন্ধু সভ্যতার বিভিন্ন দশার প্রতিফলন। বহু বছর আগে স্বামী শংকরানন্দ ও আমার আর এক শিক্ষক এস আর দাস বলতেন যে পরবর্তী বৈদিক (Late Vedic Stage) পর্যায়টি যদি সিন্ধু সভ্যতার পরিণত পর্যায়ের (Matured Indus Stage) হিসেবে সনাক্ত করা হয়, তাহলে কোনো সমস্যাই থাকে না। আমি পরবর্তী বৈদিক পর্যায় সম্বন্ধে যথেষ্ট জানি না যে এই তত্ত্বটি স্বীকার বা অস্বীকার করব। সিন্ধু সভ্যতা নিয়ে প্রচুর পুরোনো ও নতুন তত্ত্ব থাকলেও, আমার মতে এই সম্বন্ধে কোনো সন্দেহই থাকা উচিত নয় যে সিন্ধু সভ্যতাই ভারতীয় ঐতিহ্যের উৎস ছিল, এবং এটা স্বীকার করতে বাধা নেই যে তা মূলত হিন্দু ঐতিহ্য। এর বিস্তারিত প্রমাণ আসতে হয়তো আরো কিছু বছর লাগবে কিন্তু যা এখনও পর্যন্ত পাওয়া গেছে তা ‘হ্যাঁ’ বলার পক্ষে যথেষ্ট।

হরপ্পার মূল রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে এই সভ্যতাকে ভারতীয় সংস্কৃতির মূল কাণ্ড থেকে আলাদা করে দেখানো। এর রূপ যাই হোক না কেন, এটি জাতীয়তাবাদ বিরোধী মনোভাব এটা ইন্টারেস্টিং যে অনেক ভারতীয় এতে সামিল হতে দ্বিধাবোধ করেন নি।

(মূল ইংরেজী থেকে বাংলা অনুবাদ – সম্পাদক। মূল ইংরেজীতে লেখাটি পড়ার জন্য এখানে ক্লিক করুন)

 


লেখক পরিচিতি - ঐতিহাসিক ও পুরাতত্ত্ববিদ (Archeologist) দিলীপ চক্রবর্তী Cambridge University (UK)-র Emeritus Professor. তাঁর রচনা প্রায়শই অন্যান্য লেখকরা তাদের বইয়ে ও গবেষণার কাজে ব্যবহার করেন।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।