প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

প্রাচীন ভারত

সুকুমারী ভট্টাচার্য স্মরণ সংখ্যা , জুন ৩০, ২০১৫

 

প্রাচীন ভারতের সংস্কৃতি

মণিকা মুখোপাধ্যায়

[পাঠকের অবগতির জন্য একটি অনুরোধ, এই বিষয়টি বিশ্লেষণাত্মক -- তাই একটু দীর্ঘ। পাঠককে তাই ধৈর্য্য রেখে পড়ার আবেদন রইল। -- লেখিকা] 

ভূমিকা:

যে কোন সংস্কৃতির কথা বলতে গেলে প্রথমেই সংস্কৃতির ধারণাটি স্পষ্ট করে নিতে হয়। তার পর সেই সংস্কৃতিটির  তাৎপর্য বা মর্মার্থ এবং তার সক্রিয় থাকার ক্ষমতা ও সেই ক্ষমতার উৎস কি-- এই সব কথাগুলো বলে নিতেই হয়। সনাতন বা প্রাচীন ভারতের সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনাতে অবশ্যই এই প্রসঙ্গগুলি আসবে।

ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ায় বিদেশী পণ্ডিতদের  প্রভাবে অনেক ভারতীয় পণ্ডিতই মনে করতেন ভারতীয় সংস্কৃতি  উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত এবং তা নিম্নমানের আর সেই সংস্কৃতিই উচ্চমানের হয়ে দাঁড়ায় যখন ভারত তার সংস্কৃতিতে পশ্চিমী সভ্যতার (Western) ফলন আনে। ভারতবাসীকে এই ধারণা দানের পিছনে খুব সম্ভবত নাম করা যায় John Stuart Mill ও Herbert Spencer-এর। ভারতবাসী হিসেবে ছেলেবেলা থেকেই 'রামায়ণ' ও মহাভারতের' কাহিনী শুনে বা পড়ে বড় হয়েছেন প্রায় সকলেই, কিন্তু সেই কাব্যগ্রন্থগুলির অপযশই করেছেন পশ্চিমী পণ্ডিতেরা এই বলে যে সেগুলি সভ্যতার আলোক বঞ্চিত বা অসভ্য বর্বরদের কাহিনী। The Mission House তাঁদের ছোট ছোট পুস্তিকায় প্রচার করেছেন-- যে ভারতীয় পণ্ডিতরা এই দুই মহাকাব্যগ্রন্থ থেকে ভারতীয় সংস্কৃতির নিরবচ্ছিন্নভাবে টিকে থাকার ক্ষমতার সন্ধান পেয়েছেন, তাঁরা নেহাত‍‌ই আদিম  প্রাক-সভ্যের পর্যায়ে পড়েন।

স্বভাবতই মনে প্রশ্ন আসে উপরোক্ত কথা যদি সত্য হয়, তাহলে ভারতীয় সংস্কৃতি কি করে এত যুগ ধরে বেঁচে আছে, যেখানে প্রাচীন অনেক সংস্কৃতি-- যেমন গ্রীক ও রোমান সংস্কৃতি, ইজিপ্ট ও পারস্যের গৌরব এখন জাদুঘর বা সংগ্রহশালার বিষয়বস্তু।   

আর একটি  সত্য-- যখন ভারত জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ হচ্ছিল তখন যদি ভারতের পায়ের তলার মাটি শক্ত না হত অর্থাৎ নিজস্ব সংস্কৃতির ধারক না হত-- তাহলে ভারতবাসী নিজের ভূমিতেই বিদেশী হয়ে থাকতো যেমন ছিলেন Indian Civil Services- এর ইংরেজ সদস্যরা। কোন দেশের শিকড়ের সঙ্গে যোগ না থাকলে কখনই জানা যায় না সেই দেশবাসীদের--  তাঁরা কি চান কি তাঁরা আত্মীকরণ অর্থাৎ নিজের করে নেবেন সেই সব প্রসঙ্গ।

বর্তমানের বস্তুবাদী সমাজের অনেকেরই পক্ষে নিজের শিকড়কে উজ্জীবিত করে তোলা হয়তো কঠিন হবে। আজকের যুবসমাজ শিক্ষিত হচ্ছে সম্পূর্ণ অন্য মন্ত্রে যেখানে প্রাচীন সংস্কৃতি, মূল্যবোধ ইত্যাদির ধারণা তারা না পায় ঘরে, না পায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাও অপূর্ণ থেকে যাচ্ছে ভারতীয় সংস্কৃতির অন্তর্দৃষ্টি বা পরিজ্ঞান ছাড়া। সংস্কৃত ভাষার শিক্ষা প্রায় নেই বললেই চলে। প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসের শিক্ষাও একই পরিণতি পেয়েছে।

যৌবন সব কিছুকে উড়িয়ে দেওয়ার বয়স। ভারতীয়  সভ্যতা, সংস্কৃতি, রীতি নীতি, মৌলিক নীতিবোধ তখন অকিঞ্চিৎকর মনে হয়। কিন্তু সেই যৌবনের অন্তে নিজের সন্তানদের শিক্ষা দেবার সময় উপলব্ধি হয় "কি শিখি , জীবনের ভিতই যে গড়া হয় নি" কিন্তু তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে সেই ভুল শোধরাবার।

সংস্কৃতি  কি

জীবনকে দেখতে হবে ইতিহাসের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে-- সংস্কৃতি কি ও তার মূল্য কি বুঝতে গেলে।
ইতিহাস হচ্ছে মানবসমাজের একীকরণ ও বিভাজনের কথা, আর সংস্কৃতি হচ্ছে মানবসমাজকে জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে একাত্মীকরণের কথা। তাই সংস্কৃতি বা culture কথাটি পরিষ্কার হওয়া দরকার। কালচার বলতে অনেকেই বোঝেন নাচ, গান-- সে যে স্তরেরই হোক। ভারতবর্ষের বড় শহরগুলিতে এই cultural show প্রায়ই অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে যার মধ্যে  খাঁটি  ভারতীয় সংস্কৃতির কিছুই থাকে না।

সংস্কৃতি সভ্যতার ইতিহাস নয় (Culture is not civilization) । একটি উপমা এখানে দেওয়া যেতে পরে। শ্রীরামচন্দ্র ও শ্রীমতী সীতা নৌকা করে যাতায়াত করেছেন বনবাস কালে। আমরা এখন বড় উড়োজাহাজে চড়ে যাতায়াত করি। তাঁরা গাছের বাকলের পোষাক পড়েছেন বনবাসের সময়, খালি পায়ে পথ হেঁটেছেন। আমরা নাইলন, পলিয়েষ্টারের পোষাক পরি। আমাদের বাস্তব প্রয়োজনের সব জিনিষ অনেক উন্নত, অনেক আরামদায়ক ও পরিশ্রম লাঘবকারী বিজ্ঞানের দানে। বর্তমানের মানুষ আমরা- তাই দাবী করবো আমরা অনেক বেশী সংস্কৃতি সম্পন্ন রামচন্দ্র ও সীতার অপেক্ষা।

যে জামাকাপড় আমরা পরিধান করি, তার জন্য যে কারখানা তৈরি হয়েছে, জলকে ধরে রাখার জন্য যে বাঁধ তৈরি করা হয়েছে, রাস্তাঘাট, আলোর ব্যবস্থা ইত্যাদি  করা হয়েছে তা সভ্যতার (civilization ) একটি দিক।
সংস্কৃতি মূলত: এই সব বস্তুগত ব্যাপার থেকে একেবারেই আলাদা। সংস্কৃতি হচ্ছে জীবনের একটি বিশেষ দিক, যা মৌলিক মূল্যবোধের বৈশিষ্ট্যে পূর্ণ ও মানবসমাজ তা বহন করে চলে যুগ যুগান্তর ধরে। সংস্কৃতি হচ্ছে একটি জাতির সাহিত্য, কলা, ধর্ম, সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও সামাজিক ব্যবহারের মধ্যে প্রকাশিত মূল্যবোধ। ব্যক্তির স্পষ্ট বা খোলাখুলি আচরণ ও কাজ ও সমষ্টির কাজ উদ্বুদ্ধ হয় সম্মিলিত গুষ্টির আকাঙ্ক্ষা থেকে।

শুধুমাত্র ভৌগোলিক নৈকট্য সংস্কৃতির সমপ্রকৃতি নির্দেশ করে না। আফ্রিকাতে বহু ধরণের সামাজিক নিয়ম, সংস্কার ও বহু আচরণ বিধি আছে। তাই এই সবগুলিকেই আফ্রিকান সংস্কৃতি বলা ভুল হবে, বা সংস্কৃতি কথাটির অপব্যবহার হবে।

তাহলে আবার প্রশ্ন সংস্কৃতির স্বরূপ কি বা কি দিয়ে সংস্কৃতি তৈরি।

(১) সংস্কৃতির প্রথম চিহ্ন-- এর ধারাবাহিকতা। অতীত থেকে আসা এই সংস্কৃতি বর্তমানের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয় এবং ভবিষ্যতের রূপ নির্ধারণ করে। সময়ের সঙ্গে সম্পর্কিত সংস্কৃতির বিভাজন তাই এর সঠিক ছবি দেয় না।

সংস্কৃতি বহতা নদীর মত-- সঙ্গে নিয়ে চলে সম্মিলিত একটি বিশেষ মানবসমাজের কথা। এই বহতা নদীর স্রোত অবিরাম বয়ে চলে। অন্য ভাবে বলতে গেলে একটি বিশেষ সংস্কৃতির জন্ম হয় যখন বিশেষ একটি জনগোষ্ঠীর জীবনধারা প্রবাহিত হয় অবিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন মাধ্যমের সাহায্যে; যেমন-- এক সংস্কার, একই রকম আচরণ বিধি, একই রকম প্রতিষ্ঠান, কোন কিছুর প্রাপ্তির বা জয়লাভের একই রকম স্মৃতিজড়িত ঘটনাবলী, সৌন্দর্য্যবোধ ও নন্দনতত্ত্ব সংক্রান্ত সমগ্র জনগোষ্ঠীর একই ধারণা, সম্মিলিতভাবে কাজ করার বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি।
এগুলি না থাকলে কোন সংস্কৃতির জন্মও হয় না, রক্ষাও পায় না। উদাহরণস্বরূপ ভারতবর্ষের যেখানেই আমরা যাই-- দেখি নির্দিষ্ট কিছু  আচরণবিধি যা সমাজের বৃহৎ অংশই পালন করে। সেখানে কিছু ছোটখাটো ত্রুটি বিচ্যুতি হয়তো থাকতে পারে-- কিন্তু সেটি ব্যতিক্রমী বলেই মনে হয় এবং যে ব্যতিক্রমী সেও মনে জানে এটা সঠিক নয়।

(২) সংস্কৃতির দ্বিতীয় চিহ্ন-- একটি বিশেষ সংস্কৃতি যখন ক্রম: উন্নয়নের পথে চলে তখন সেই সংস্কৃতির ধারকরা তাঁদের মৌল-প্রতিষ্ঠানগুলির একটি অপরিবর্তনশীল সমান রূপ দেয়। যদি বিবাহ বা পরিবার প্রথার একটি সমানরূপ বা ধারণা, আদর্শ ও উদ্দেশ্য না থাকে তাহলে সেই সংস্কৃতির নিজস্ব বৈশিষ্ট্য বা ধারাবাহিকতা থাকে না।

(৩) সংস্কৃতির তৃতীয় চিহ্ন-- একটি জনগোষ্ঠীর অত্যাবশ্যক সংস্কৃতির জন্য প্রয়োজন অতীতের জয়যুক্ত ঘটনাবলীর পুঙ্খানুপুঙ্খ স্মৃতি। এই সমস্ত জয়ের ঘটনাগুলি পৌরাণিক, ঐতিহাসিক, অথবা কাল্পনিক যাই হোক না কেন তাতে কিছু এসে যায় না। কিন্তু সেগুলি জনচেতনায় ভালোভাবে গাঁথা থাকতে হবে যার থেকে শুভ সংস্কার তৈরি হয়।

ভৌগোলিক সন্নিবেশ দুটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে মোটামুটি এক সংস্কৃতি সৃষ্টি করতে পারে, কিন্তু তা কখনই সাধারণ বা সম সংস্কৃতির পরিচায়ক হবে না। ভারতের হিন্দু ও মুসলমানরা যদি পুরানো জয়ের প্রতি সমদৃষ্টিসম্পন্ন না হয়, কেউ যদি শুধু শিবাজী বা রাণা প্রতাপকে নিয়ে গর্ব বোধ করেন এবং অন্যরা মহম্মদ গজনী ও অওরংজেবের প্রতিই কেবল সম্মান প্রদর্শন করেন তাহলে কিছুতেই বলা যাবে না দু দলের মধ্যে সমসংস্কৃতি রয়েছে।

এখানে একটি কথা বলে রাখা উচিত, সব সংস্কৃতিতেই সব চিহ্নগুলি সর্বদাই সমভাবে বিদ্যমান থাকবে-- এমন নয়। কোন এক সময়ে কোন একটি বৈশিষ্ট্য প্রধান হয়ে উঠতে পারে-- কিন্তু অধিকাংশই সংস্কৃতির অঙ্গ হবে-- এমনটা হতেই হবে একটি সংস্কৃতির প্রাণবান হবার জন্য ও ধারাবাহিকতা রক্ষা করার জন্য।

(৪) সংস্কৃতির চতুর্থ চিহ্ন-- একটি বিশেষ প্রয়োজনীয় চিহ্ন সংস্কৃতির মধ্যে থাকবে। যখন কোন বিপদ, বাধা বা দুর্দশা জনগোষ্ঠীর মধ্যে আসবে, তখন সেই জনগোষ্ঠী এক হয়ে একই ধারণা নিয়ে সেই সব বিপদের সম্মুখীন হয়ে কাজ করবে। কোন দ্বিমত সেখানে থাকবে না। একটি সংস্কৃতির জীবনীশক্তি মাপা যায় যদি সেখানে গৌণ কিন্তু প্রভাবশালী জনগণ মুখ্য জনগণের সঙ্গে এক হয়ে দুর্দশার বিলোপ সাধন করে এগোতে পারে তার নিরিখে।  কিন্তু যদি তা সম্ভব না হয় তবে সেই সংস্কৃতিতে ভাঙন ধরে। যখন এই সব বৈশিষ্ট্যগুলি, যথা -- প্রথা (tradition), আচরণবিধি (norms of conduct), প্রতিষ্ঠানসমূহ (institutions), অতীতের কৃতিত্বপূর্ণ কাজের স্মৃতি (memory of triumphs achieved) এবং সমবেত প্রচেষ্টা বা ইচ্ছাশক্তি কোন কর্ম সম্পাদনের জন্য থাকবে জনগণের মধ্যে, তখনই তারা এক হবে এবং তাদের সংস্কৃতি একটি সম্পূর্ণ রূপ নিয়ে তাদের ভাগ্য গঠনের পথ খুলে দেবে।

একটি অতি অসাধারণ ঘটনার উল্লেখ এখানে করা যায়। একটি সংস্কৃতির বলিষ্ঠ জীবনীশক্তির পরিচয় পাওয়া যায় দ্বিতীয় বিশ্বমহাযুদ্ধ ঘটার আগে। ইহুদীরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অত্যন্ত দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে জীবন কাটাত। কখনো ঘেটোতে বা কখনও রাজনৈতিক বন্দিশালায়। অমানবিক অত্যাচার তাঁরা সহ্য করেছেন যুগ যুগ ধরে। কখনও তাদের একসঙ্গে অনেককে হত্যা করা হতো। দ্বিতীয় বিশ্বমহাযুদ্ধের সময়ে ষাট লাখের মতো ইহুদীদের নাৎসি বন্দিশালায় হত্যা করা হয়। এই রকম বর্বরোচিত অত্যাচারের পরও তাঁরা তাঁদের সমাজ ও সংস্কৃতি গঠন করেছেন -- একটি সমান প্রথা ও Old Testament-এ বর্ণিত কৃতিত্বপূর্ণ ঘটনাবলীর স্মৃতি থেকে শিক্ষা নিয়ে। তাঁরা সম্মিলিত ভাবে কর্তব্য নির্ধারণে প্রণোদিত হন। তিয়াত্তরটি দেশ থেকে তাঁরা প্যালেষ্টাইনে একত্রিত হন। জিহোভার ‘Promised land’- এর স্মৃতি (যা হাজার হাজার বছর আগের কথা) নিয়ে তাঁরা স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে একসঙ্গে দুঃখ-কষ্ট সহ্য করে, যুদ্ধ করে, মৃত্যু বরণ করে নতুন ইসরাইলের জন্ম দেন। মরুভূমি, জঙ্গল, জলাজমিকে শস্যশ্যামল করে তোলেন, কারখানা-শিল্প গড়েন ও একটি প্রতিরক্ষামূলক শক্তি গড়ে পৃথিবীর কাছে নিজেদের প্রমাণ করেন।   এটি একটি দৃষ্টান্তমূলক বলিষ্ঠ সংস্কৃতির পরিচায়ক যদিও তা যতই প্রাচীন ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে আসুক না কেন।

আমরা যখন কোন সংস্কৃতির জীবনীশক্তি নিয়ে আলোচনা করি, দেখি এর বৈশিষ্ট্যগুলি একে অন্যের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত কতগুলি নির্দিষ্ট মৌলিক মূল্যবোধের দ্বারা এবং এই বোধ একটি মুখ্য ধারণা থেকে তৈরি হয়। এই মুখ্য ধারণা (central idea) সংস্কৃতির অঙ্গকে পূর্ণ করে পুষ্ট করে ও সবলতা দেয়।

সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে, পারিপার্শ্বিকের, সভ্যতার বিষয়বস্তু পরিবর্তিত হয়, নতুন বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তির উদয় হয়। তখনই গৌণ কিন্তু প্রভাবশালী জনগোষ্ঠীর দায়িত্ব বাড়ে। তাদের প্রতিযোগিতাকে গ্রহণ করে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে হয়। শুধু তাই নয়, আচরণবিধির নিয়ামক মূল প্রতিষ্ঠানগুলির প্রয়োজন মত  পুনর্বিন্যাস করতে হয়--সংস্কৃতির মৌলিক মূল্যবোধের কথা মনে রেখে।

সময়ের স্রোতের সঙ্গে তখনই সংস্কৃতি তাল মিলিয়ে চলবে, তার পথ পরিবর্তন করবে প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে, নতুন পথ গঠন করে, অপ্রয়োজনীয়কে ত্যাগ করে, তা সত্ত্বেও সেই সংস্কৃতির অত্যাবশ্যক একতা, বৈশিষ্ট্যগুলি একই থাকবে। কিন্তু যখন এই গুণগুলির অবসান ঘটবে সেই সংস্কৃতি তখনই মৃত্যুর পথে যাবে।

এখানে গ্রীক সভ্যতার কথা উল্লেখ করতে পারি। আজকের যে গ্রীক যুবক, যদিও একই গ্রীস দেশে সে বাস করছে, তবু তার সাথে Pericles-এর সময় যে যুবক বাস করত -- অনেক তফাত রয়েছে দুজনের মধ্যে, কারণ, যে মূল্যবোধগুলি তখন ছিল আজ আর তা নেই। আমরা তাহলে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি  যে প্রাচীন গ্রীসের সংস্কৃতির মৃত্যু হয়েছে সেদিন, প্রাচীন গ্রীসবাসীরা যেদিন থেকে আর তাদের মূল্যবোধকে জীবনের সাথে জড়িয়ে রেখে সম্পূর্ণ করতে পারেনি। এভাবে রোমান সংস্কৃতিরও অবসান ঘটেছে যখন বিদেশী দাসরা Gaul ও Germany থেকে এসে রোমকে ভরিয়ে দেয়। রোমান যুবশক্তি তাদের  পূর্বপুরুষদের  সব কৃতিত্বের স্মৃতি ভুলে গিয়ে রোমকে পুরনো গৌরব ফিরিয়ে দেওয়ার চিন্তাই করল না। যে রোম একদিন পৃথিবীর প্রভু ছিল সে হারিয়ে গেল তার সংস্কৃতিকে নিয়ে।   

তাহলে বলতে পারি সংস্কৃতি বেঁচে থাকতে পারে একমাত্র গৌণ প্রভাবশালী জনগণের চেষ্টাতে। রাজনীতিতে একজন প্রায় পাগল হয়ে যাওয়া লোকের ভোট আর একজন জ্ঞানীর ভোটের মূল্য একই। সেখানে সংখ্যাই গোণা হবে জয়ের জন্য। কিন্তু, মানুষের ব্যাপারে চিন্তাশীল কর্মক্ষম গৌণ মানবশক্তিরই প্রয়োজন থাকে। Toynbee বলতেন  dominent minority। বিপদের মুখে, বিচ্ছিন্নতার মুখে প্রতিযোগিতার মনোভাব  নিয়ে , সাহসের সঙ্গে সেই গৌণশক্তিই বাঁচিয়ে রাখবে সমাজ ও সংস্কৃতিকে।

প্রতি প্রজন্মের মানুষকেই ধারক হতে হবে এই ভাবনাগুলির। এই ধারণা বা বোধগুলিকে গুরু-শিষ্য পরম্পরার মত হস্তান্তর করা যায় না। প্রতি প্রজন্ম একে পুনরুদ্ধার করবে এবং সংস্কৃতির মূল বৈশিষ্ট্যগুলিকে গ্রহণ করে বাঁচিয়ে রাখবে। এতক্ষণ সংস্কৃতির সংজ্ঞা, বৈশিষ্ট্য দিয়ে কিছুটা বোঝানো গেল হয়ত  মূলত: সংস্কৃতি কি? এবার আমাদের মূল বিষয় ভারতীয় সংস্কৃতির কথায় আসব।

এমন দিন যেন না আসে যখন ভারতীয় যুবক/যুবতীরা ভারতীয় সংস্কৃতিকে হারিয়ে ফেলবে -- তাহলে অন্যান্য অনেক পুরনো সংস্কৃতির মত ভারতীয় সংস্কৃতিও মৃত্যুদশা প্রাপ্ত হবে। তখন ঐ যুবক/যুবতীরা শিক্ষিত বর্বর হবে বা পশ্চিমের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হয়ে বেঁচে থাকবে। তাই তাঁরা কখনই ধারক হতে পারবেন না যে সময়ে তাঁরা জীবিত থাকবেন বা ভবিষ্যতের জন্যও।

ভারতীয় সংস্কৃতির জন্ম কি ভাবে হয়েছিল, এর বৃদ্ধি বা উন্নতির পিছনে কি কি বিষয় কাজ করেছিল, মৌলিক মূল্যবোধের রূপরেখা কি ভাবে তৈরি হয়েছিল ও তার মধ্যমণি বা মূল তত্ত্বটি কি ছিল যার সাহায্যে নিয়মনীতি, আচার ব্যবহার প্রথা, প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল এবং হাজার হাজার বছর ধরে  কোন জীবনীশক্তি একে বাঁচিয়ে রেখেছে-- এই সব প্রশ্নগুলির উত্তর পেতে হবে ভারতীয় সংস্কৃতিকে জানতে গেলে।    প্রথমেই বুঝতে হবে কোন ভৌগোলিক সীমারেখার মধ্যে ভারতীয় সংস্কৃতির জন্ম হয় এবং কারা এর মূল ধারণাগুলি তৈরি বা বহন করেছিলেন। 

বহু বহু বছর আগে ভারত আজকের ভারতের মত ছিল না। আরাবল্লী পর্বতের পশ্চিম ভাগে একটি ভূখণ্ড গণ্ডোয়ানা নামে (Geologist বা ভূতত্ত্ববিদদের মতে) ছিল যা মরিশাসের সাথে পশ্চিম দিকে যুক্ত ছিল এবং পূর্ব দিকে যুক্ত ছিল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আর্কিপেলাগোর সাথে (South-East Asian Archipelago)। হিমালয় এবং আজকের পুরো উত্তরভারত ছিল সমুদ্রের তলায় (Sea of Tethys) । এই ছিল তথাকথিত ভারতের মানচিত্র কোটি কোটি বছর আগে। 

ধীরে ধীরে হিমালয় সমুদ্রের তলদেশ থেকে মাথা উঁচু করতে থাকে, আর সেখানে এক ভূখণ্ডের  সূচনা হয় ও সময়ের সাথে তা বিশাল আকার ধারণ করে। সেই ভূখণ্ডে বয়ে যাওয়া নদীর পলি মাটি জমে তৈরি হয় আজকের উত্তরভারত। টেথিস সমুদ্র দুভাগে ভাগ হয়ে যায় -- একটির নাম হয়  আরব সাগর ও অন্যটি বঙ্গোপসাগর। ডেকান (Deccan) বা দাক্ষিণাত্য এলাকার নদীগুলি  রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ, পাঞ্জাব, বিহার, বাংলা, আসাম ও মণিপুরের পাললিক স্তরের নীচে চলে যায়।        

এই ভৌগোলিক উত্থানই সৃষ্টি করে বর্তমানের ভৌগোলিক ভারতকে। হিমালয় সমস্ত পৃথিবী থেকে ভারতকে উত্তর দিকে আলাদা করে রাখে ও প্রহরীর কাজ করে। হিমালয় থেকে বয়ে আসা নদীর পলিমাটি  উর্বর কৃষিভূমির জন্ম দেয়। ভারতীয় সংস্কৃতিতে হিমালয়ের এই ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক।  

পুরাকালে বিভিন্ন জাতির ও বিভিন্ন ভাষার জনগোষ্ঠী এই নতুন জন্মানো ভূখণ্ডে আসতে শুরু করে বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। সেই ভূখণ্ডের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য তাদের জীবনকে রূপ দিতে আরম্ভ করে। একটি মিশ্র জাতির সহাবস্থান শুরু হয়।   আফ্রিকা থেকে আদিম মানুষ সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। Proto-Australoids, early Mediterranean people আসে তার পরে। উত্তর ও পূর্ব দিকে অল্প সংখ্যক মঙ্গোলিয়ানদের দেখা যায়।
পরের দিকে ভূমধ্যসাগরীয়রা নিজেদেরকে দ্রাবিড়ীয়ানদের সাথে মিলিয়ে নেয়। কিছু পণ্ডিতের মতে য়্যালপাইন অঞ্চলের লোকেরা সম্ভবত: বেদের যুগের আগে আসে, যাদের খাঁটি আর্য বলা যেতে পরে। পরে বৈদিক আর্যরা আসে যাদের নরডিক জনগোষ্ঠীর বলে মনে করা হয়।

ভারতীয় ভাষাগুলির মূল চারটি নির্দিষ্ট ভাষা পরিবার:

১)  The Austric speech family বা কোল ও মুণ্ডা গোষ্ঠী (পার্বত্য এলাকায় সীমাবদ্ধ)

২)  The Tibeto-Chinese অথবা Sino-Tibetian ভারতের পূর্ব সীমানায়

৩)  Dravidian  -- দ্রাবিড়গোষ্ঠী

৪)  Aryan অথবা Indo-European গোষ্ঠী   

তৃতীয় ও চতুর্থ, এই দুটির ভাষাই সবচাইতে তাৎপর্যময় বা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় আসে। বৈদিক আর্যদের ভাষার সাথে অন্যান্য ভাষার সংমিশ্রণেই ভারতীয় ভাষগুলির উৎপত্তি হয়। এই সংমিশ্রণের উদাহরণ পাওয়া যায় উত্তর ভারতের অনেক সাধারণ শব্দগুলিতে ও প্রবাদবাক্যে, এবং 'দ্রাবিড়িয়ান' শব্দের উল্লেখ থাকে দক্ষিণী ভাষায়।   

খ্রীষ্ট জন্মের প্রায় ২,০০০ বছরেরও আগে সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসীরা নিয়ে আসে তাদের উচ্চ বস্তুবাদী সংস্কৃতিকে, যার পরিচয় পাওয়া যায় এবং মহেঞ্জোদারোর ও হরপ্পার লোথালের  (Lothal) ঐতিহাসিক তথ্য থেকে।  কিছু পণ্ডিতের মতে এরা দ্রাবিড়জাতির ছিলেন। তাদের দুর্গ, জনগণের জন্য নির্মিত স্নানাগার, জাহাজে করে ব্যবসার আদানপ্রদান, আন্তর্জাতিক ব্যবসা, সব কিছুর প্রামাণ্য দলিল আছে ইতিহাসের পাতায়। ইতিহাস তাদের জীবনযাত্রার অভ্যাস, পোষাক, মৃতের সৎকার ব্যবস্থা ও দেবতার উপর আলোকপাত করে।  

অন্য জাতিগুলি, যারা নর্মদা নদের উত্তরে বসবাস করতো, তাদের উল্লেখ ইতিহাসে বিশেষ পাওয়া যায় না, তবে তাদের নাগা বলে অভিহিত করা হতো।  

ঐ সময়ে যারা উত্তরপ্রদেশ ও বিহারে বাস করতো তাদের কপারহেড্স (Copperheads) নাম দিয়েছিল পুরাতাত্ত্বিকরা (Archeologist), যেহেতু তারা তামার তৈরি অস্ত্র ব্যবহার করতো। হতে পারে অনার্য, নাগা, নিষাদ, অসুর যাদের উল্লেখ মহাভারতে পাওয়া যায়, তারা এই শ্রেণীভুক্ত ছিল। 

নর্মদার পশ্চিমে যারা বাস করতো তাদের কথাও বিশেষ জানা যায় না, আর জানা যায় না তাদের কথা, যারা দ্রাবিরিয়ানদের বিরুদ্ধে গিয়ে তাদের ক্রমশ: দক্ষিণ ভারতের দিকে ঠেলে দেয়।

মূল বিষয়

কিছু পণ্ডিতের মতে, ২০০০ বি.সি-র আগেই আর্যরা ইতিহাসের পাতায় স্থান পেয়ে গিয়েছিল এবং মোটামুটি হাজার বছরের মধ্যেই তারা ইউরোপ এশিয়াতে ছড়িয়ে পরে--লিথুয়ানিয়া থেকে ফিনল্যান্ড, উত্তর ভারতের কনৌজ- লখনউ পর্যন্ত। এর প্রমাণ পাওয়া যায় তাদের ব্যবহৃত গ্রে পটারী এবং তাদের ব্যবহৃত ভাষা থেকে।
১৪০০ খ্রী পূর্বাব্দে বর্তমান সিরিয়াতে, হিটাইট ও মিতান্নিদের মধ্যে সন্ধিপত্রে (যা Bӧgaz Koi inscription নামে বিখ্যাত),  বৈদিক দেবতা ইন্দ্র, মিত্র, নাসত্য (অশ্বিনীকুমারদ্বয়) ও বরুণের নাম পাওয়া যায়। ঐ ভাষা Cappadocia ও Syria-র লোকেদের জানা ছিল। ইন্দো-ইরানিয়ান আর্যরা উত্তর ভারতে আসে আফগানিস্থান হয়ে। একসময়ে এদের ধর্ম এক ছিল। zend Avesta জোরাষ্ট্রিয়ানদের পবিত্র বইয়ের কিছু স্তোত্র বা পদ্য ঋক বেদে পাওয়া যায়। ১৫০০ বি সির কিছু আগে বৈদিক আর্যরা ভারতে আসে তাদের প্রাকৃতিক ধারণা ও সেই সাথে পালনীয় রীতি নীতি নিয়ে। সঙ্গে আনে তাদের গরু, ঘোড়া। সবচাইতে বড় উদ্দেশ্য ছিল নিজেদের প্রতিষ্ঠা করা ও চারিদিকের স্থানগুলি জয় করার অসীম ইচ্ছে।

সেই সূত্রে তাদের দ্বন্দ্ব শুরু হয় স্থানীয় অধিবাসীদের সঙ্গে, যাদের আর্যরা দাস বলত। পাঞ্জাবের রূপার অঞ্চলের খনন কার্যে হরপ্পাবাসীদের বসবাসের নিদর্শন মেলে। ১৫০০ বি সি-তে হরপ্পার ধ্বংসাবশেষের উপর নতুন বসতি স্থাপিত হয় যা ৫০০শত বৎসর টিকে ছিল। তাদের ব্যবহৃত জিনিস যা পাওয়া গেছে তাতে বোঝা যায় ঐ ৫০০শত বৎসর ওখানে বৈদিক আর্যরাই বাস করত। হস্তিনাপুরের খননকার্যে প্রমাণ পাওয়া যায় ১৫০০ বি সি-তে ওখানে বৈদিক আর্যরা বসতি স্থাপন করে এবং সেটাও ৫০০ বৎসর টিকেছিল। গঙ্গার বন্যায় ধ্বংস হয় সেই বসতি। কয়েকটি পুরাণে পাওয়া কুরুরা বন্যার কারণে হস্তিনাপুর ছাড়তে বাধ্য হয় এবং কৌশাম্বীতে রাজধানী সরিয়ে নেয়, রাজা নিচাক্ষুর (অর্জুনের বংশধর) পরিচালনায়। 

ঐ সময়ে প্রায় ৫০০ বৎসর ধরে আর্যরা নিজেদের মধ্যে এবং অনার্যদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। যুদ্ধে এগোতে এগোতে তারা মিশে যায় বিভিন্ন জাতির সঙ্গে, সেই সব জাতিদের প্রথা, বিশ্বাস সব কিছুর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়ে এক নতুন ঐক্যের সৃষ্টি করে। আর্য রাজারা পাঞ্জাব, দিল্লী, মথুরা, উত্তরপ্রদেশ, কাশী এবং রাজস্থানের কিছু অংশে রাজত্ব করে। কিন্তু তাদের রাজ্যজয়ের ইতিহাস থেকে গুরুত্ব বেশী পায় তাদের সংস্কৃতির জীবনীশক্তির এবং তার প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতার, তাদের সংস্কৃতির শ্রীবৃদ্ধি ঘটে  বৈদিক ঋষিদের (পণ্ডিত/scholar) আশ্রম ব্যবস্থায়।     
সেই আশ্রমগুলি মূলত: সপ্তসিন্ধু বা সাতটি নদীর তীরে অবস্থিত ছিল, বিশেষ করে সরস্বতী নদীর তীরে আশ্রমগুলির প্রভূত প্রশংসা রয়েছে ঋগ্বেদে। হিমালয় থেকে উৎপন্ন এই শক্তিশালী নদী পশ্চিম দিকে বয়ে সমুদ্রে পতিত হতো। রাজস্থানের কিছু অংশ দিয়ে বয়ে যেত এই নদী। এখন অবশ্য এই নদীর আর কোন চিহ্ন নেই, শুকনো এক খণ্ড পরে আছে ‘ঘাগ্গর’ নামে। বৈদিক সভ্যতার শেষে ভৌগোলিক বেশ কিছু পরিবর্তন হয় যার কারণে সরস্বতী নদী শুকিয়ে যায় এবং দিক পরিবর্তন করে পূর্ব দিকে, নাম হয় যমুনা।  বৈদিক সভ্যতার অন্তে তাদের সব বৈশিষ্ট্য যা বস্তুবাদী সংস্কৃতির  (materistic culture) পরিচয় বহন  করতো, তা হারিয়ে যায়। তাদের জীবনেও বহু পরিবর্তন এসেছিল অন্য জাতির সঙ্গে বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ হবার পর। 

আর্য জাতি সম্বন্ধে এত কথা বলার একটাই উদ্দেশ্য -- এই বৈদিক আর্য সভ্যতাই প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতির জনক ও প্রাণশক্তি। প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠাতা বৈদিক আর্যরাই গঠন করে সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলি -- যেমন কুল, পরিবার, জন, গোষ্ঠী, পাঁচটি আর্যগোষ্ঠী। বাকীরা ছিল অনার্য, দাস গোষ্ঠীর লোক যাদের ছিল বোঁচা নাক (snub nose) গায়ের কালো রং ও ভাষা সম্পূর্ণ অন্য ছিল।

আর্যদের জীবনযাত্রা-প্রণালীর বিশেষ বৈশিষ্ট্য, তাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবন তাদের অন্য সব জনগোষ্ঠীদের থেকে আলাদা করে চিহ্নিত করে। হয়ত সেটাই কারণ তাদের প্রতিষ্ঠা লাভের। আর্যরা বলিষ্ঠ জাতি -- তাছাড়া যুদ্ধে তারা ঘোড়ার ব্যবহার করত। তারাই প্রথম বন্য ঘোড়াকে বশ মানিয়ে গৃহপালিত পশুতে রূপান্তরিত করে ও যুদ্ধের কাজে ব্যবহার করে। অন্য পক্ষের যোদ্ধারা ছিল বেশীর ভাগই পদাতিক বা নিচু শ্রেণীর পশু ব্যবহার করত -- যথা, গাধা, খচ্চর ও ষাঁড়। ঋক্ বেদে ঘোড়াকে শক্তি ও বীর্যের প্রতীক বলে বহু প্রশংসা করা হয়েছে। 

বৈদিক আর্যদের বলিষ্ঠ সংস্কৃতি, যা আবার বলিষ্ঠ প্রথার পরিচায়ক, ক্ষমতাসম্পন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠান, নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব বিষয়ে অত্যধিক প্রত্যয় এবং সর্বোপরি সম্মিলিত ভাবে কোন কাজ করার ক্ষমতা ও ইচ্ছে আর্যদের উচ্চ মানই নির্ধারণ করে।

তাদের সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে পিতৃতান্ত্রিকতার প্রথা সর্বোচ্চ গুরুত্ব পায়, তার পরে স্থান পায় কুলের সুদৃঢ় বন্ধন। কুল হচ্ছে পিতৃকুলের পূর্বপুরুষ ও তাদের বংশধরদের সমিতি যেখানে পিতা পরিবারের প্রধান ও সম্পত্তির অধিকারী। কুলের পূর্বপুরুষদের সঙ্গে বিভিন্ন আচারের মাধ্যমে সংযোগ রাখছেন বলে তারা মনে করতেন এবং এই প্রথাকে খুবই গুরুত্বের সঙ্গে সবাইকে পালন করতে হতো। পিতৃযজ্ঞ, তর্পণ, পিণ্ডদান, শ্রাদ্ধ এই সব আচার-অনুষ্ঠান তারা পূর্বপুরুষদের জন্য করতেন -- পিতামহ, পিতা, পুত্র, পৌত্র এইভাবে একতাবদ্ধ হয়ে থাকতো ক্ষমতায়, প্রথায় ও অধিকারে।

পৃথিবীর কোথাও কোথাও অবশ্য মাতৃতন্ত্র ছিল, এখনও হয়তো আছে কোথাও -- যেমন কেরলে নায়ারদের মধ্যে মাতৃতন্ত্রই মুখ্য প্রথা। 

এই কুল প্রথা থেকে আবার গোত্রের উৎপত্তি হয়। অর্থাৎ কোন একজন পুরুষ থেকে সেই গোত্রের উৎপত্তি ও সেই গোত্রাধিকারীদের সবাইকে একই পরিবারভুক্ত বলে গণ্য করা হতো যাদের মধ্যে বিবাহ নিষিদ্ধ ছিল।  পিতৃতান্ত্রিকতা একটি মানসিক বন্ধনের সৃষ্টি করে পরিবারে ও সমাজে যা একতাবদ্ধ হতে ও সমাজ, পরিবারকে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করে ও কোন বিভেদ সৃষ্টি হতে দেয় না।  

কুল প্রথা বা প্রতিষ্ঠান থেকে জন্ম নেয় মৌলিক মূল্যবোধগুলি যা আবার জন্ম দেয় পরিবার প্রথার। পরিবার সমাজের একটি ছোট আকার এবং সংস্কৃতির গোড়ার দিকের কেন্দ্রস্থল। এই পরিবার প্রতিষ্ঠান থেকে জন্ম হয় বিভিন্ন প্রথার ও আচার-ব্যবহারের সঠিক মাপকাঠি। শিশু অবস্থা থেকেই পরিবারের সদস্যদের একতাবদ্ধ হয়ে থাকা, পরস্পরকে ভালোবাসা, আত্মত্যাগ ও বংশানুগৌরবে গৌরবান্বিত হয়ে একসাথে কোন কাজ করার পাঠ মিলত ও তা পালন করতে হত। 

আর্য সংস্কৃতি এই সব প্রথা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অনন্তকাল ধরে তার বিপুল প্রাণশক্তি নিয়ে বয়ে চলেছে মানুষের সমাজে  (ভারতীয় সমাজে বিশেষ করে)। এই বৈদিক আর্যসংস্কৃতির আর একটি মূল্যবান দিক (যা পরিবারের টিকে থাকা ও উন্নতির জন্য বিশেষ প্রয়োজন) স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে অটুট বন্ধন। বিবাহের সময়ে যে কথাগুলি বর ও বধূকে উচ্চারণ করতে হয় তা একটি পবিত্র প্রতিজ্ঞা যাতে দুজন ব্যক্তিকে এক করে দিচ্ছে। এই বিবাহ বন্ধন এমন একটি অলঙ্ঘ্য ব্যবস্থা যা পরিবার, কুল, প্রতিষ্ঠান সবকে একত্রে ধরে রাখার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। 

সামাজিক-ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আর্যদের যজ্ঞ প্রথার ছিল দ্বিতীয় স্থান। যজ্ঞের মাধ্যমে আহুতি প্রদান করে পূর্বপুরুষ ও ঈশ্বরের সাথে আন্তরিক সম্পর্ক স্থাপন ছিল এর উদ্দেশ্য। (প্রাক্ বৈদিক যুগেও যজ্ঞের প্রথা ছিল, পবিত্র অগ্নিতে উৎসর্গীকৃত বস্তু, পবিত্র সোমরস আহুতি দেওয়া হতো।) গৃহস্থকে যজ্ঞের অগ্নি প্রজ্বলিত করে রাখতে হতো চিরস্থায়ী করে। তা ছাড়া ঋতুনির্ভর যজ্ঞও হতো, যেখানে সমাজের বহু লোকের সমাগম হতো, সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান চলত বহু দিন ধরে।  

এই সব প্রথার অন্তরালে যে মূল্যবোধটি জড়িয়ে ছিল -- তা হল ত্যাগের বোধ (spirit of sacrifice)। এই বোধ নিয়ে করা যজ্ঞ শুধু মানুষ ও ঈশ্বরের সঙ্গে মিলন করে আকাঙ্ক্ষিত বস্তুলাভই একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল না। সৃষ্টিকে, পৃথিবীকে বহুদিন ধরে বাঁচিয়ে রাখাও এর অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল।

যজ্ঞের মাধ্যমে এই ত্যাগের মহিমা তাই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে আর্য সংস্কৃতিতে। ঋতের বিধান অনুযায়ীই যজ্ঞকর্ম সম্পাদন হতো। ঋতের বিধান বা শাশ্বত বিধানের (eternal law) অধীনে নিখিল বিশ্ব নিয়মবদ্ধ। এটাই সত্য -- এর বিরুদ্ধে সব অ-সত্য। এই ঋত সত্য বলে শক্তির উৎস নয় শুধু -- এর একটি সৌন্দর্যেরও দিক আছে। ঊষা -- ভোরের দেবী (বা সূর্য) নিয়ম করে রোজ উদিত হয় বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বা জগত্শৃঙ্খলার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে তাই তা চিরন্তন সত্য। বেদের ঋষিরা বলেন মানুষ মহতের পর্যায়ে যেতে পরে যদি এই ঋত মেনে চলতে পারে। (বর্তমান পৃথিবীতে বোধ হয় এই ঋতকে মেনে চলার কোন লক্ষণই নেই -- সভ্যতা অনেক এগিয়ে গেছে বৈজ্ঞানিক তথ্যপ্রযুক্তিগত উপাদান নিয়ে, কিন্তু ভুলে গেছে আসল সত্যটি -- নিখিল বিশ্বের নিয়মের কথা -- তাই আজ চতুর্দিকে বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কথা আমরা শুনতে পাই।)
এই সত্যই মানুষের বোধে, আচরণে, প্রতিভাত হতো। সব কর্মেরই উদ্দেশ্য ছিল সত্যের খোঁজ। সত্য বোধ এমনই একটি অনুভূতি যা মানুষকে অপরাজিত, বিশ্বাসযোগ্য ও ভরসা জনক বলে প্রতিষ্ঠিত করে। সত্যসুষমা, সত্য কর্ম, সত্য বাক্যই শ্রেষ্ঠ মানবচরিত্রের নিদর্শন। সামাজিক নিয়ম নির্দেশগুলি ও ক্ষত্র (kstra) শাসনভাব এই সত্যের উপরই প্রতিষ্ঠিত।         

বৈদিক সংস্কৃতির মূল কথা এই ঋতের উপরই নির্মিত হয়েছে ভারতীয় প্রাচীন সংস্কৃতি ও সভ্যতা। নিখিল-বিশ্ব (The cosmic order) এক এবং বিভাজনহীন, একই সঙ্গে বস্তুজগৎ, নীতিজগৎ ও ধর্মীয় জগতকে ধরে রেখেছে। সৃষ্টি ও তার ক্রমবিকাশ বা বিবর্তন, সবই এই cosmic order-র নিয়মে চলে। 

ঋত বা সত্যের প্রকাশ শুধুমাত্র ধর্মীয় আচরণেই প্রতিভাত হয় না। এই সত্যের বোধ মানুষের অসৎ প্রবৃত্তিকে দূর করে ও সমাজবদ্ধ হয়ে থাকার প্রেরণা দেয়। সমাজে থাকা মানেই সত্যের পথে চলতে হবে। এই সত্য চিন্তায়, কথায়, কাজে প্রয়োগ করলেই ফল পাওয়া যাবে।

যজ্ঞে আহুতির ফল তখনই পাওয়া যাবে যখন মানুষ সব আমিত্ববোধ (ego), লোভ, ভয়, ক্রোধ, ঘৃণা ও অহংকার নিবেদন করবে পবিত্র অগ্নিতে আহুতি হিসেবে, অর্থাৎ তাপসের সঙ্গে। তাপসের অর্থ -- আত্মশাসন করে শরীর ও মনের শুদ্ধিকরণ -- যা মানুষকে আমিত্ববোধ দ্বারা চালিত সহজাত প্রবৃত্তি ও আকাঙ্ক্ষা থেকে মুক্তি দেবে। এই তাপস শক্তির উজ্জীবন হলে মানুষ নিজেই শুধু  শক্তিবান হয় না -- তার মধ্যে ভালবাসা বা প্রেমের জন্ম হয় -- তাকে নতুন এক মানুষ করে তোলে -- আর সম্মিলিত ভাবে এক নতুন উৎকর্ষময় মানবজাতির অভ্যুত্থান হয়।
ক্ষত্র (rulership) সামাজিক নীতি ও স্তরগুলিকে, অর্থাৎ ব্যবহার বিধি, রীতি-নীতি ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলির সমন্বয় সাধন করে জীবন নির্বাহের উপযোগী করে তোলে সত্য, যজ্ঞ ও তাপসকে ভিত্তি করে। 
আর এই সব গুণাবলীর অধিকারীরা সামাজিক, নৈতিক ও বস্তুবাদের অনেক উন্নতি সাধন করতে পারে, উপকারী পরিবর্তন আনতে পারে। সুখী পরিবেশ সৃষ্টি করা ও সকলকে সুখ দিতে পারে এই গুণাবলী বা ক্ষমতার অধিকারীরা। অন্যদিকে, পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীনতা, সামাজিক ও বাস্তববোধের অভাব অ-নৈতিকতার জন্ম দেয়। এই মূল ভিতগুলির বা মূল্যবোধগুলির উপরই ভারতীয় সংস্কৃতির জন্ম ও বৃদ্ধি পাওয়া এবং হাজার হাজার বছর টিকে থাকা। 
বৈদিক ঋষিদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হবে এই সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখতে পারলে। 

হাজার হাজার বৎসর আগে মানবজাতি যখন মানসিক ও ধর্মীয় উন্নতির বিভিন্ন স্তর পার করছিল সীমিত ক্ষমতা নিয়ে এবং বিভিন্ন ভগবানের ধারণা নিয়ে, গোষ্ঠীর শাসকই নিজেকে ভগবান বলে দাবী করত -- সেই সময়ে বৈদিক আর্যদের এই মূল্যবোধগুলি হাজির হয় তাদের বিশ্বজনীনতা নিয়ে, যার মাধ্যমে জীবনবোধের সমন্বয় হয়ে প্রতিষ্ঠানগুলিকে জীবন্ত করে তোলে সঠিক সর্বরকমের মানবিক পরিবেশ তৈরি করার উদ্দেশ্যে।
বৈদিক যুগের আশ্রমগুলি এক একটি সুসংবদ্ধ পরিবারের মত ছিল। একটি ছোটখাটো বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো ছিল সেগুলি। ছাত্ররা সাধারণ শিক্ষার (general) সঙ্গে সঙ্গে ব্যবহারিক দিকেরও শিক্ষা পেত। তখন আশ্রমের ঋষিরা পুরোহিত ছিলেন না, তাঁরা ছিলেন সু-শিক্ষক। ছাত্রদের তৈরি করতেন দৈহিক, মানসিক ও নৈতিক শিক্ষা দিয়ে, ভবিষ্যতে ছাত্ররা যাতে সমাজে উঁচু স্থান অধিকার করতে পারে। 

এখানে একটি উদাহরণ দিচ্ছি -- বেদ অধ্যাপনান্তে আচার্য (শিক্ষাগুরু) শিষ্যকে (অর্থাৎ ছাত্রদের) বেদের শিক্ষার অর্থ বলছেন:

“সত্যং বদ। ধর্মং চর। স্বাধ্যায়ান্মা প্রমদঃ। আচার্যায় প্রিয়ং ধনমাহৃত্য প্রজাতন্তুং মা ব্যবচ্ছেত্সীঃ। সত্যান্ন প্রমদিতব্যম্। কুশলান্ন প্রমদিতব্যম্। ভৃত্যৈ ন প্রমদিতব্যম্। স্বাধ্যায়-প্রবচনাভ্যাং ন প্রমদিতব্যম্। দেবপিতৃকার্যাভ্যাং ন প্রমদিতব্যম্॥
মাতৃদেবো ভব। পিতৃদেবো ভব। আচার্যদেবো ভব। অতিথিদেবো ভব। যান্যনবদ্যানি কর্মাণি তানি সেবিতব্যানি। নো ইতরাণি। যান্যস্মাকং সুচরিতানি তানি ত্বয়োপাস্যানি। নো ইতরাণি। যে কে চাস্মচ্ছ্রেয়াংসো ব্রাহ্মণাঃ। তেষাং ত্বয়াসনেন প্রশ্বসিতব্যম্। শ্রদ্ধয়া দেয়ম্। অশ্রদ্ধয়া অদেয়ম্। শ্রিয়া দেয়ম্। হ্রিয়া দেয়ম্। ভিয়া দেয়ম্। সংবিদা দেয়ম্। এষ আদেশঃ। এষ উপদেশঃ। এষা বেদোপনিষত্। এতদনুশসনম্। এবমুপাসিতব্যম্। এবমুচৈতদুপাস্যম্॥
ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ॥⤜
(তৈত্তিরীয়োপনিষদ্- শিক্ষাবল্লী, একাদশ অনুবাকঃ) 

উপদেশাবলীর অনুবাদ বাক্যক্রম (sentence) অনুযায়ী দেওয়া হল:

“সত্য বলিবে। ধর্মাচরণ করিবে। অধ্যয়নে উদাসীন হইবে না। আচার্যের জন্য অভীষ্ট ধন (দক্ষিণা) আহরণান্তে (গৃহস্থাশ্রমে যাইয়া) সন্তান-ধারা অবিচ্ছিন্ন রাখিবে। সত্য হইতে বিচ্যুত হইও না। ধর্ম হইতে বিচ্যুত হইও না। মঙ্গলজনক কার্যে উদাসীন হইও না। অভ্যুদয় কার্যে ভ্রান্ত হইয়ো না। স্ব-অধ্যায় ও অধ্যাপনা বিষয়ে প্রমাদগ্রস্ত হইয়ো না। দেবকার্য ও পিতৃকার্যে ভ্রান্ত হইয়ো না। মাতা তোমার দেবীরূপিণী হউন। পিতা তোমার দেবতাস্বরূপ হউন। অনিন্দিত কর্মসকলনুষ্ঠান কর। অপরগুলি নহে। যাহা আমাদের সদাচার তাহাই তোমার অনুষ্ঠেয়। অপরগুলি অনুষ্ঠেয় নহে। যে সকল ব্রাহ্মণ আমাদের হইতে শ্রেষ্ঠতর তুমি তাঁহাদিগকে আসনাদি দিয়া তাঁহাদের শ্রম দূর করিবে। শ্রদ্ধা সহকারে দান করিবে। অশ্রদ্ধার সহিত করিবে না। স্বীয় ঐশ্বর্যানুসারে দান করিবে। বিনম্রভাবে দান করিবে। প্রীতির সহিত দান করিবে।
ইহাই আদেশ। ইহাই উপদেশ। ইহাই বেদের রহস্য আর ইহাই ঈশ্বরাজ্ঞা। এইভাবে সমস্ত অনুষ্ঠান করিবে। এই প্রকারেই সব আচরণ করিবে।
ত্রিবিধ শান্তি বর্ষিত হউক তোমার জীবনে।”

(কিন্তু আধুনিক পাশ্চাত্ত্য শিক্ষায় টাকা ও সাফল্য হয় শিক্ষার মূল মানদণ্ড, প্রকৃত মনুষ্যত্ব নয়। সমাজের উঁচুতলায় উঠবে তারাই যারা টাকা রোজকারের শিক্ষাটাই বড় করে শিখবে। এর ফল -- টাকার বলে তারা সমাজের সকলকে তাদের কাজ সহ কিনে নিতে পারবে এবং কে কি করবে তার নির্দেশ একমাত্র সে ব্যক্তিই দেবে।)       

বৈদিক যুগে ঋষিরা আচার্যপদে অধিষ্ঠিত থেকে ছাত্রদের সত্যের/ঋতের পথে চলতে দীক্ষা দিতেন। (উপরের উপনিষদে লিখিত উপদেশটি স্মরণ করুন।) এই আচার্যরা বা এই প্রতিষ্ঠান একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য বৈদিক সংস্কৃতির। পরে এটাই গুরু পরম্পরা প্রথায় পরিণত হয়। এর মাধ্যমে শিক্ষণীয় প্রথা,  তার বিশেষ কৌশল ও আদর্শ জীবিত থাকত। দীক্ষার মাধ্যমে ছাত্ররা লাভ করত পরিশীলিত মাধুর্যময় স্বভাব ও তার ফল হতো লোকের বিশ্বাস অর্জন। আর বিশ্বাসের মাধ্যমেই সত্যে পৌঁছানো যায়।

ইতিহাস বলে একটি সংস্কৃতির পূর্ণ বিকাশ হয় যখন সমাজে শিক্ষাব্যবস্থা যুবসমাজের মনে একটি শুভ ধারণার বা ব্রতের (mission) জন্ম দেয় ও পরিচালিত করে একটি পূত/পবিত্র জীবনযাপনের জন্য -- অর্থাৎ কাজে, কথায়, চিন্তায় সত্যের ব্যবহার। আচার্যরা তাই শিক্ষা দিতে সক্ষম ছিলেন। যুবসমাজ যদি স্ব-ইচ্ছাপূরণকেই প্রাধান্য দেয়, তাহলে সমাজের নিয়মাবলী ভেঙে পড়ে এবং পরবর্তী প্রজন্ম সঠিক শিক্ষালাভ করতে পারে না। ফলে সামাজিক ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলির জীবনীশক্তি হ্রাস পায় ও ক্রমে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। 
ব্রহ্মচর্য পালন ছিল প্রশিক্ষণ গ্রহণ আশ্রমে থেকে। তারপরে গার্হস্থ জীবন, যেখানে বংশধারা রক্ষা করে সৃষ্টিকে বাঁচিয়ে রাখা ও প্রাপ্ত শিক্ষাকে সন্তানদের মাধ্যমে বাঁচিয়ে রাখা যা পরম্পরাগত ভাবে বয়ে যাবে।      আশ্রমিক তার আশ্রমজীবনে ঋত, তাপস ও ব্রাহ্মণ (এর প্রাথমিক অর্থ যে বৈদিক প্রার্থনা করে)- জীবন অতিবাহিত করে সমাজের নেতা হয়ে উঠতে পারতেন ও সমাজকে স্থায়ী মূল্যবোধ, অন্তর্দৃষ্টি ও বিচারবোধের দ্বারা চালিত করতেন। সমাজে সামাজিক ও মানবিক (psycho-social) মূল্যবোধের ভিত সুদৃঢ় ও স্থায়ী হতো। 
রাজারা যুদ্ধের নেতা হতেন, অস্ত্র যারা চালাতেন তাঁরা ক্ষত্রিয় বলে গণ্য হতেন। আর্যদের একটি বড় অংশ চাষবাসের দিকে যায়। তাদের বৈশ্য বলা হতো। অনার্যরা যারা সংস্কৃতিবান হয়ে ওঠেনি, তাদের শূদ্র বলা হতো।       

এই চারটি ভাগ আর্যদের শ্রীবৃদ্ধির সময় বংশগতভাবে চিহ্নিত হতো না, কাজের মাধ্যমে ছিল তাদের ভাগ। কিন্তু একে অপরের প্রতি নির্ভরশীল ছিল বলে একটি একতাবদ্ধ সমাজ গড়ে উঠেছিল।
বৈদিক শিক্ষার মূল কথা ছিল -- জীবনের সুখ ও আরামের দিকে ধাবিত না হওয়া --

‘Vedik rishis firm determination was above material comforts, beyond the lure of wealth and success.
‘Let the source of high knowledge, the intelligence and the resolute will and the deathless flame within the hearts of men without which no action can be done.
‘Let all these inspire my mind
‘To will the good of all.’

এই ব্রত (mission) আর্যদের প্রেরণা যোগাতো সম্মিলিত ভাবে সমাজের অগ্রগতির জন্য কার্যক্রমকে। 
আর্যরা চাইতেন আর্য সভ্যতা সংস্কৃতির পূর্ণ বিস্তার যেখানে আইনবিরোধী কারোর স্থান হবে না। কিন্তু একই সময়ে আর্যরা ভারতভূমিতে এসে যারা আর্য নয় তাদের সামাজিক রীতি-নীতি, প্রথা, ধর্মবিশ্বাস -- সব কিছুর সঙ্গে সামঞ্জস্যবিধান করে নেয়, দ্রাবিড় ও অন্যান্য জাতির সঙ্গে বিবাহ সম্পর্ক স্থাপন করে এবং ঐক্য স্থাপন করে সমাজে যার ফল একটি মূল সংস্কৃতি স্থাপন, যার উল্লেখ এই প্রবন্ধে আগেও করা হয়েছে। 

তবে আর্য ঋষি বশিষ্ঠ, বিশ্বামিত্রেরও আগে অন্য এক আর্য ঋষির দল দক্ষিণ ও পশ্চিম ঘাটে আসেন ও বসতি স্থাপন করেন। তাঁরা ও তাঁদের শিষ্য ঋষিরা আর্য সংস্কৃতিকে অনেক এগিয়ে নিয়ে যান। লোপামুদ্রা ও অগস্ত্য মুনি বিন্ধ্যাচল পর্বত পার হয়ে দক্ষিণ ভারতে আর্য সংস্কৃতি নিয়ে আসেন এবং তা বিস্তৃত করেন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া পর্যন্ত। অগস্ত্য মুনিকে বলা হয় তামিল ব্যাকরণ ও কবিতার জনক।

একই সময়ে ভৃগুরাও পশ্চিম ঘাটে তাঁদের বসতি স্থাপন করেন। ক্যাম্বে থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত ব্রাহ্মণেরা নিজেদেরকে আজও ভৃগু বা পরশুরামের বংশধর বলে মনে করেন। কেরলের নাম্বুদিরি ব্রাহ্মণেরা যুগযুগান্তরের ব্যবধান সত্ত্বেও আজও Vedik lore-কে বাঁচিয়ে রেখেছেন।

যখন আদিবাসী সংস্কৃতির (tribal culture) সঙ্গে আর্য সংস্কৃতির সংমিশ্রণ ঘটে -- ঋষিরা আর্যদের সর্বজনীন প্রথা ও প্রতিষ্ঠানগুলিকেই প্রাধান্য দিয়ে তাঁদের সংস্কৃতিকে অনার্যদের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলেন।  

পরশুরাম একুশটি যুদ্ধে সমস্ত আর্য রাজাদের পরাজিত করে তাদের মেরে ফেলেন। হয়ত সেই সঙ্গে বৈদিক যুগের শেষ হয়।
বৈদিক যুগের পরবর্তী সময় খুব সম্ভবত: শুরু হয় যীশুখ্রীষ্টের জন্মের সপ্তম শতাব্দীর আগে। আর্যরা তখন গঙ্গার তীরে নিজেদের বসতির পুনর্বাসন করে। আর্য-দ্রাবিড় গোষ্ঠীর রাজারা বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। ইতিহাস সাক্ষী সেই সময়ের গৌরবময় উজ্জ্বল বিকাশের সব রকম অর্থে। ভারতের ইতিহাসের একটি গৌরবময় অধ্যায় এটি।
আমাদের প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতির বিষয়ে জানতে গেলে একটি সত্য কখনই ভুললে চলবে না যে, ভারতীয় সংস্কৃতি আর্য-দ্রাবিড় সংস্কৃতির সমন্বয়, দুই-এর সামাজিক,  ধর্মীয়, জাতিচেতনা উদ্ভূত কৃষ্টি রয়েছে এর মূলে। এই সমন্বয় সাধিত হয় ভাষা, মূল্যবোধ, প্রথা, প্রতিষ্ঠানগুলির একীভূত করণের দ্বারা। এই দুই সংস্কৃতির প্রভাব পড়ে উত্তর ভারতে বিশেষ করে, যখন এই দুই জাতি বেদের যুগে ও পরে একে অন্যের সংস্পর্শে আসে। দ্রাবিড় ভাষার বেশ কিছু অংশ আর্য ভাষায় মিশে যায়। তবে আর্যরা বলিষ্ঠ ও সাহসী জাতি হলেও তাঁরা বস্তুবাদী সংস্কৃতির অঙ্গ ছিলেন না। কারণ, তাঁরা প্রধানত যাযাবর প্রথায় জীবন যাপন করতেন। দ্রাবিড় জাতীয়রা এ ব্যাপারে অনেক উন্নত ছিল। আর্যরা পরে ঐ সংস্কৃতিকে নিজেদের সংস্কৃতির অন্তর্গত করে।

দুই জাতির সংমিশ্রণের উদাহরণ -- বেদব্যাস -- আর্য ঋষি পরাশরের পুত্র, কিন্তু তাঁর মা উত্তরপ্রদেশের কল্পীর এক জেলের মেয়ে, যিনি পরে আর্য রাজা শান্তনুর রাণী হন ও কৌরব- পাণ্ডবদের প্রপিতামহী। শ্রীকৃষ্ণের পিতা বাসুদেব ও পাণ্ডবদের মাতা কুন্তী শুরের ঔরসজাত ও এক নাগা মায়ের গর্ভজাত।

বেদের পরবর্তী ও বেদের যুগেও মুখ্য আর্য জনগোষ্ঠীর উদ্দেশ্যই ছিল বৈদিক মূল্যবোধগুলিকে জারিত করে দেওয়া সকলের মধ্যে – “words of vedic sage- ‘Aryanising all’ “ তার অর্থ বিভিন্ন আদি জনগোষ্ঠীর মধ্যে একই আচার, ব্যবহার, সামাজিক, ধর্মীয় রীতি-নীতি, প্রথা ও প্রতিষ্ঠানগুলি একীভূত করে একটি ঐক্যের বোধ আনা, যাতে সমগ্র মানবগোষ্ঠী সংঘবদ্ধ হয়ে সমাজ ও সংস্কৃতির বৌদ্ধিক, সামাজিক সংস্কৃতির উন্নতিসাধন করে।

এই ভাবে গৌরবর্ণ আর্যরা রাজনৈতিক ও সামরিক ভাবেও দ্রাবিড়গোষ্ঠীর উপর আধিপত্য বিস্তার করে ও তাঁদের সংস্কৃতিই উচ্চস্থানে থেকে আর সকলকে তা গ্রহণ করাতে সক্ষম হয়। সামাজিক গোষ্ঠীর মধ্যে যারা বৈদিক সংস্কৃতি পুরোপুরি গ্রহণ করে তাঁরা দ্বিজ নমে অভিহিত হয়। দ্বিজ শব্দের অর্থ দ্বিতীয়বার জাত। আশ্রমে বাসকালীন উপনয়নের পর এই দ্বিতীয় জন্ম শুরু হতো। আর এখানে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, বিজেতা ও পরাজিত -- এরকম কোন বিভেদ ছিল না।  

আর যারা এই সংস্কৃতি গ্রহণ করেনি, তারা শূদ্র বলে আখ্যা পায়। তবে এদের মধ্যে যারা উন্নত বৈদিক সংস্কৃতি গ্রহণ করতে ইচ্ছুক ছিলেন তাদেরকে সেই সুযোগ দেওয়া হতো। এই প্রথা বহুযুগ ধরে চলেছে এবং এখনও বর্তমান। অস্পৃশ্যতাবাদ (untouchability) তখন ছিলই না।

বেদ-পরবর্তী যুগে বশিষ্ঠের বংশধর কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন (যিনি পালিত হয়েছিলেন কুরুক্ষেত্রের আশ্রমে) বেদের মন্ত্রগুলিকে আর বেদে বর্ণিত সব কিছু (যা বৈদিক সংস্কৃতি সম্বন্ধে এত্ক্ষণ বলা হয়েছে) সংগ্রহ করেন সেগুলির পুনর্সংকলন করেন, তাদের উদ্দেশ্য ও সম্পর্ক অনুযায়ী চারটি ভাগে সংকলিত করেন। এই কারণে তাঁকে বেদব্যাস (ব্যাস অর্থ বিভাজন) নামেও অভিহিত করা হতো।

মহাভারতের কুরু-পাণ্ডবদের বিখ্যাত যুদ্ধশেষে যুধিষ্ঠির সমগ্র ভারতের রাজচক্রবর্তী হন। এই যুদ্ধের প্রতিফলন পড়ে সমগ্র ভারতবাসীর মানসিক পর্দায়। যত কাব্য, মহাকাব্য রচিত হয়েছে এই যুদ্ধ নিয়ে তাতে দুজন বিশিষ্ট মানবের কথা বিশেষ ভাবে বলা হয়েছে। একজন ঋষি-জ্ঞানী বেদব্যাস ও অন্যজন শ্রীকৃষ্ণ -- যোদ্ধা, দূরদর্শী, বাস্তববাদী ও বিজ্ঞ রাজনৈতিক -- অমিতশক্তিধর, চিরজয়ী অতিমানব। বেদব্যাস ধর্মের ব্যাখ্যাতা আর শ্রীকৃষ্ণ তার রক্ষক।

এবারে বলা যায় আর্য-দ্রাবিরিয়ান সভ্যতা  ও সংস্কৃতির রূপান্তরিত মূল্যবোধের কথা। শুরুর দিকে দ্রাবিড়জাতির পিতৃতন্ত্রকে গ্রহণ করে এবং তার ফলে অন্য প্রথা ও প্রতিষ্ঠানগুলিও গ্রহণ করে এবং পরিবার প্রতিষ্ঠানের উপর গুরুত্ব আরোপ করে তাকে উন্নত করে এই লক্ষ্যে যে, পরিবারে সকলের প্রতি সকলের গভীর সম্বন্ধ থাকবে।
বহুবিবাহ প্রথাটি সাধারণত: অনার্যদের মধ্যেই ছিল। সংমিশ্রিত নতুন সমাজে আর্যরাও এই প্রথা গ্রহণ করে। তাঁদের ধর্মীয় ধারণা ও কার্যাবলীও মিশে যায়। জীবন সম্পর্কে ধারণা বা বোধ, পরিবারের ধারণা, উৎসব অনুষ্ঠান ইত্যাদির দুটো ধারা একই সঙ্গে চলতে থাকে। বৈদিক আর্যদের ধারাকে বলা হতো ‘নিগম’ আর দ্রাবিড়গোষ্ঠী যারা যোগকে (yoga) প্রাধান্য দিয়েছিল -- সেটিকে বলা হতো ‘আগম’। দ্রাবিড়দের পিতা-ভগবান হলেন ‘শিব’ এবং হরপ্পার সংস্কৃতিতে তার প্রমাণ রয়েছে। বৈদিক রুদ্রর সাথে তাঁকে মেলানো হয়।  
এশিয়ার অনেক স্থানেই সিংহবাহিনী মাতৃমুর্ত্তির আরাধনার প্রচলন ছিল। বৈদিক আর্যদের কাছে তা অপরিচিত ছিল। কিন্তু পরে শিবের স্ত্রী উমা ও পার্বতী নামে এই দেবী পূজার প্রচলনকে তাঁরাও নিজেদের ধর্মীয় আচারে সামিল করে নেন। পিতা ও মাতা ভগবানকে আনার পর দ্রাবিড় জাতীয়রা পুত্র ভগবানের সৃষ্টি করলো -- কুমার স্কন্দ, কার্ত্তিক, মুরুগন ইত্যাদি নামে।

অন্যদিকে বৈদিক মতে বিষ্ণু (যা সূর্যের আর এক নাম) সর্বোচ্চ দেব ছিলেন দেবলোকে। 'দ্রাবিড়িয়ান' সংস্কৃতি যোগ হওয়ায় শিব ও বিষ্ণু একাসনের অধিকারী হলেন।   
যজ্ঞ ছিল রাজা ও ঋষিদের করণীয় কর্তব্য। নতুন মিশ্র সংস্কৃতিতে বৈদিক হোমের জায়গায় স্থান পেল পূজা অনুষ্ঠান। সহনশীলতা ও অহিংসা এই দুটি তাত্পর্যময় দিক যোগ হল মিশ্র সংস্কৃতিতে।   মিশ্র সংস্কৃতির এই নবজাগরণের প্রভাবে ধর্মের জন্ম হল, যার উপর ভিত গড়েছে ভারতীয় সংস্কৃতি। ধর্মের ব্যাখ্যা এ ভাবে দেওয়া যায় -- এটি বিশেষ কেউ একজন সৃষ্টি করেন নি। বহু প্রজন্মের আশ্রমিক জ্ঞানী গুণীরা তাঁদের সৃজনশীল ক্ষমতা ও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে ধর্মের একটি সংজ্ঞা দেন যা সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়ে। আশ্রমবাসী এই ঋষিরা বেদের মূল ধ্যান ধারণাগুলিকে অনুসরণ করে জীবন যাপন করতেন ও তাঁদের সংস্পর্শে আসা অন্যদেরকেও ঐ ভাবে জীবন যাপনে আগ্রহান্বিত করতেন।
ভারতবর্ষে তখন পাঁচমিশেলি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ তাদের বিভিন্ন স্তরের বিভিন্ন সংস্কৃতি নিয়ে বাস করত। আর্য আশ্রমগুলি তখন দুটি সমস্যার সম্মুখীন হয়। প্রথম -- এই বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকেদের একতাবদ্ধ করে তাদের মধ্যে একটি সমান সমাজচেতনাবোধ আনা। দ্বিতীয় -- এমন একটি সমাজ গঠন করা যেখানে জাতি, সংস্কৃতিগত কোন বিভেদ থাকবে না এবং ক্রমশ ওই একত্রিত সমাজ ধর্মের অর্থাৎ বেদের সত্য ইত্যাদি নিয়মগুলি অনুসরণ করবে।

কথায়, কাজে, চিন্তায় সত্যের প্রয়োগ, যজ্ঞানুষ্ঠানে ও তাপস (নিজের অহংবোধ তথা, সব রিপুর আহুতি দেওয়া) পালন করে ব্যক্তি নিজেকে সুনিয়ন্ত্রণ করার উপযোগী হয়। এটাই ধর্মাচরণ। একেই মানবধর্ম বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এর একটি সামাজিক উদ্দেশ্য ও ধর্মীয় লক্ষ্যও রয়েছে। শুধু তাই নয়, ব্যক্তির উপর এর প্রভাবে তার কিছু নৈতিক দায়বদ্ধতাও থাকে। মানবধর্মের মূল কথা সকলের ভালো হওয়া (for the good of man)।     

রুশোর সময় থেকে আধুনিক পৃথিবী শুনে আসছে মানুষের সাম্যের কথা। কিন্তু বাস্তবিক ভাবে তা হয়তো সম্ভব নয়। মানুষ বংশগতভাবে, জন্মগতভাবে, মানসিক গঠন ও ক্ষমতায় একে অন্যের থেকে পৃথক। সেই কারণে সমাজের বিভিন্ন বিভাগ তৈরি হয় যেখানে একই উৎপত্তিস্থল, একই পেশা ও একই আগ্রহ মানুষকে সংঘবদ্ধ করে এক একটি সামাজিক স্তর তৈরি হয়। প্রাচীন ভারতেও তাই ছিল। বর্ণ ধর্ম বৈদিক যুগের মতো পরবর্তী পর্যায়েও চলে যদিও তাতে বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বিভাগকে অনুসরণ করা হতো বেদের সময়েরই মতো। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র এই চার বর্ণের প্রধান ব্রাহ্মণ যাদের দায়িত্ব নেতা হিসাবে সামাজিক ও মানসিক নিয়মাবলী সৃষ্টি করে সমাজকে ঠিক পথে চালিত করা; ক্ষত্রিয়দের প্রধান দায়িত্ব ছিল প্রয়োজনমত অস্ত্রের সাহায্যে যুদ্ধ করা ও সমাজকে ও ধর্মকে রক্ষা করা; ব্রাহ্মণদের অনুমতি ছাড়া ক্ষত্রিয়রা কিছু করতে পারত না। অন্য দিকে ব্রাহ্মণদেরও ক্ষত্রিয়দের ছাড়া সমাজ চালানো সম্ভব হতো না।  একে অপরের উপর নির্ভরশীলতাই ঐক্য আনে এই সত্যই প্রতিষ্ঠিত হয় তাতে। বৈশ্যরা ব্যবসা বাণিজ্য করে, মহাজনী কারবার করে, কৃষিকাজ করে অর্থের যোগান রাখতো। ব্রাহ্মণদের মতো কঠোর নিয়মাবলী পালন  করতে হতো না বা ক্ষত্রিয়দের মতো যুদ্ধও করতে হতো না বৈশ্যদের।    
শূদ্ররা তাদের স্ব-অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল না। ব্রাহ্মণগৃহে ব্রাহ্মণ গৃহপতির অধীনে কাজ করলেও তারা এবং তাদের পরিবার ব্রাহ্মণ পরিবারের অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য করা হতো। তাদের জন্য পেশার বিভিন্ন রাস্তা খোলা থাকত, শিল্পকলা, বিভিন্ন প্রকার জিনিষের ব্যবসা করা, সৈন্যদলে যোগ দেওয়া এবং বিপর্যয়ের সময় বৈশ্যদের পেশা নেবার সুযোগ তাদের থাকত। খালি বেদগ্রন্থ পড়ার অধিকার তাদের ছিল না। ক্ষমতা থাকলে রাজাও হতে পারতো, কিংবা সমাজের উঁচু স্থান লাভ করতে পারতো। এইভাবে সমাজে সকলেরই স্থান ছিল।     
স্মৃতি গ্রন্থগুলি পড়লে সেই সমাজের সামাজিক আদর্শ বা দর্শন ভালো করে যানা যায়। মানবধর্ম সমাজে প্রতিযোগিতার আদর্শ না রাখার পক্ষপাতী কারণ -- মানবসমাজের সাধারণভাবে আগ্রহ থাকে নিজের নিজের অহংবোধ বা আমিত্ববোধকে প্রাধান্য দিয়ে অসত্যের দিকে ধাবিত হওয়ার। তখনই সৃষ্টি হয় হিংসা, লোভ স্ব-ইচ্ছাপূরণের প্রবল স্পৃহা।
অন্যদিকে প্রতিযোগিতার মনোভাব থাকলে সেই সমাজের গতি অন্যরকম হয়, সমান অধিকার বা সমান স্থান পাবার জন্য ভবিষ্যতের রাস্তা খোলা থাকে সকলের জন্য যেখানে জাতি, ধর্ম, বর্ণ কোন কিছুর বিভেদ থাকে না। কিন্তু এই ব্যবস্থা খুব অনিশ্চিত। কাজ (employment) অনিশ্চিত।   

প্রতিযোগিতার পরিবেশ এক শ্বাসরুদ্ধকারী অবস্থার সৃষ্টি করে⤓কে কাকে ফেলে এগিয়ে যাবে। তার ফল -- দুশ্চিন্তা, ক্ষোভ সারাজীবনের সঙ্গী হয়ে পড়ে। আর এই পরিস্থিতিতে নিরপত্তাহীনতা, মানসিক ও সামাজিক উদ্বেগ সৃষ্টি হবেই। সকলের ভালো (the highest good) যা মানবধর্মের পথ, তা গুটি কয় ব্যক্তিরই থাকে। প্রত্যেকেই নিজের উন্নতির চেষ্টায় নিজের সব শক্তি ব্যবহার করবে এটা সত্যি, কিন্তু আর যারা ততটা শক্তিধর নয় তাদের ক্রমশ: পিছনের সারিতে চলে যেতে হয় -- তাদের মধ্যে জন্ম নেয় হতাশা -- তার থেকে রাগ -- রাগ থকে ঘৃণাবোধ যা সমাজের পক্ষে খুবই ক্ষতিকর।

মানবধর্মের সামাজিক দর্শন ব্যক্তির সব চেষ্টাকেই অগ্রাহ্য করে না -- যে ব্যক্তি শুধু নিজেরই উন্নতির কথা ভাবে তকে গ্রহণ করে না। প্রত্যেকে সমাজের প্রতি কর্তব্য করবে প্রথমে  এটাই সার কথা। তা ছাড়া ব্যক্তি যে বংশে জন্মায় তার গুণাবলী সহজাতভাবে পাবে, বাবা-মায়ের বিশেষ দক্ষ শৈলীগুলি সন্তানের মধ্যে থাকবে এবং পরিবারের সকলে তকে উত্সাহ দেবে বংশগত ধারা বা কাজের দক্ষতাকে অর্জন করতে।             

প্রতিযোগিতাহীন সমাজে ব্যক্তি তাই তার পরিবারের পেশাকেই দক্ষতার সঙ্গে অর্জন করতে শিখবে। সমাজের অন্যরাও ব্যক্তিকে তার সাফল্যের চেষ্টায় সহযোগিতা করে সমাজের ‘সকলের ভালো’ এই মূল লক্ষ্যে পৌঁছবে। প্রত্যেকেই তার নিজ নিজ দায়িত্ব সম্পাদন করলে অহংবোধ/আমিত্ববোধ ও স্ব-ইচ্ছাপূরণ (self indulgence) এই সব ত্রুটিগুলি দূর হয়ে যাবে এবং বিভিন্ন সামাজিক সঙ্ঘগুলি তাদের স্বকীয়তা স্ব-স্ব সম্মান বজায় রেখে সমাজকে এগিয়ে নিতে পারবে।
এবারে এত কথা বলার পরে প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতির একটি সার সংক্ষেপ দেওয়া যায়।   

সৃষ্টি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের নিয়মের বা cosmic order-এর অধীন বা বলা ভালো সৃষ্টি cosmic order-এর ফল। ঋত ও ধর্ম সেই সৃষ্টিকে ও তার অন্তর্গত সব কিছুকে চালায় বা শাসন করে। এবং এটাই একমাত্র এবং বিভাজনহীন ব্যবস্থা যা কাজ করে বস্তুবাদ, নৈতিক, ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক, দার্শনিক সব রকম পরিবেশের উপর।
যে কোন ব্যক্তিই সত্যকে আদর্শ করে জীবন যাপন করতে পারে। সেই জীবন যাপনই সব চাইতে উঁচু স্থান পায় কারণ কাজে, কথায় কর্মে সত্যের ব্যবহার সেই ব্যক্তিকে সমাজের সকলের কাছে গ্রহণীয় করে তোলে ও সকলে তার কথা মেনে চলে। এটাই ‘Highest Good’-এর জীবন।    

এই Cosmic order-এর আর একটি বিশেষ দিক ‘সামান্য ধর্ম’ (the law of moral causation) এই নীতি ব্যক্তিকে শেখায় অহিংসা, সত্যবদ্ধতা, চুরি না করা, স্বত্বাধিকার না থাকা। এসব প্রতিনিয়ত জীবনে অভ্যাস করলে ব্যক্তি জয়লাভ, ভালোবাসা, ধন-দৌলত, শক্তি ও সাহস সবই অর্জন করতে পারে যা বাস্তব জীবনের মুখ্য উদ্দেশ্য।          
Cosmic order-এর আর একটি বৈশিষ্ট্য কর্মবাদ, যেমন কর্ম ফলও তেমনি হবে। এই কর্মবাদের শৃঙ্খল থেকে অব্যাহতি পাওয়া যায় যদি ‘সকলের ভালো’ এই লক্ষ্যে পৌঁছানো যায়। মানবধর্মের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি তাই এমন থাকা উচিত যেখানে সামাজিক প্রথা, আচরণবিধি, সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলি ব্যক্তিকে সাহায্য করবে তার মূল আদর্শর দিকে পরিচালিত হতে।

সমাজে তাই প্রতিযোগিতামূলক ব্যবস্থা বা অবস্থা থাকবে না। প্রত্যেকেই তার ক্ষমতা ও যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ ও কর্তব্যসম্পাদন করবে ও সমাজকে দৃঢ় বন্ধনে রাখবে। সমাজের মাথায় এমন ব্যক্তিদের থাকতে হবে যারা সুশৃঙ্খল জীবন যাপন করবে, অর্থলালসা বা বৈষয়িক বোধ থাকবে না -- মৌলিক মূল্যবোধগুলি শিক্ষা দেবে। তাঁরা যদি কঠোর দারিদ্রের মধ্যে থাকেন তবে সমাজ তাঁদের সাহায্য করবে যাতে বেঁচে থাকার জন্য (struggle for existence) যুদ্ধ না করতে হয়।

মানুষ তার ক্ষমতা মানসিক গঠন ও বংশগতভাবে চারটি ভাগে বিভক্ত: (১) নেতা শ্রেণী যারা জ্ঞানের আলোর সন্ধান দেবে, (২) কর্মক্ষম শক্তিশালী লোক, (৩) এমন ব্যক্তি যাদের শক্তি থাকলেও কাজে অনীহা ও (৪) এমন ব্যক্তি যারা নিষ্ক্রিয় বা অলস।  

এখন প্রতিযোগিতাহীন সমাজে এদের সকলকেই দায়িত্ব কর্তব্য পালন করতে হবে তাদের নিজ নিজ ক্ষমতা অনুযায়ী। তার অর্থ সমাজই বলে দেবে কার কি করণীয় যাতে কারোর ব্যক্তিগত সুখ সম্ভোগের দিকেই একমাত্র দৃষ্টি না থাকে। 

শুধু কোন ব্যক্তির উন্নয়নই লক্ষ্য নয় যাতে কম দক্ষ ব্যক্তিরাও নিজেদের উন্নতি করে সমাজে উঁচু স্থান পেতে পারে সেদিকেও সমাজপতিদের লক্ষ্য রাখতে হবে।         
এই প্রতিযোগিতাহীন সমাজে সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলি এমন ভাবে গঠিত হবে যেখানে জনমতের প্রাধান্য থাকবে এবং প্রতিটি শ্রেণীর কর্তব্য দায়িত্ব জনগণই ঠিক করে দেবে। এই জনমত গঠন করার পেছনে থাকবে সমাজপতিদের  সুনেতৃত্ব, উদাহরণ এবং আবেদন। এইরকম ব্যবস্থায় নেতৃস্থানীয়দের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা সাহায্য করবে সমাজে বিভিন্ন প্রথা ও প্রতিষ্ঠান নী ভাবে তৈরি হবে সঠিক মূল্যবোধের উপর ভিত্তি করে।

শাস্তিপ্রথার মাধ্যমে সংশোধনের চেষ্টা শুধুমাত্র ব্যক্তির আমিত্ব বা অহংবোধকে চেপে রাখতে বাধ্য করবে যা জনমতপ্রধান সমাজের পক্ষে বিরূপ ভাবেরই চেষ্টা করবে,  একতাবদ্ধ শৃঙ্খলাপরায়ণ, সত্যে প্রতিষ্ঠিত সমাজ ও সংস্কৃতি গড়ে উঠবে না। সুশিক্ষা-সুপারিবারিক সংগঠন, সুসামাজিক সংগঠন -- সর্বোপরি আচার্যরা প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতিকে সৃষ্টি করে বহু যুগ ধরে এগিয়ে নিয়ে গেছে।         

C. Rajagopalachari কি বলেছিলেন ভারতীয় সংস্কৃতি সম্বন্ধে তা একটু বলা প্রয়োজন বোধ করে সংযোজন করছি। (He was a versatile man whose lectures on Indian culture were of great importance and his approach is quite different) তাঁর মতে সংস্কৃতি হচ্ছে একদল মানুষের একসঙ্গে দলবদ্ধ হয়ে জীবনযাত্রা অতিবাহিত করা এবং সেই জীবনযাত্রা প্রণালী এক প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মে অনুসৃত হবে। এই মানুষের সমাজে প্রত্যেকেই তাদের দীর্ঘ জীবন ইতিহাস নিয়ে আলাদা সংস্কৃতির ধরণ গঠন করে, তবে সেই সমাজে সাধারণ সকলেরই গ্রাহ্য সাংস্কৃতিক গুণাবলী যেমন থাকে তেমনি প্রত্যেক জাতির নিজস্ব বৈশিষ্ট্যও থাকে।      

প্রথমেই দেখে নিতে হবে সব জাতির কাছেই সংস্কৃতির সাধারণ ধর্মটা কি? সংস্কৃতি কথাটিকে খুব সহজ ভাবে ব্যাখ্যা করলে হবে না। যখন কোন মানুষকে সংস্কৃতিবান বলা হয় তখন তার চরিত্রগত গুণ বা দোষের কথা বলা হয় না। ভালোমানুষ আর সংস্কৃতিবান মানুষ এই দুটির মধ্যে পার্থক্য আছে। অনেক ভালোমানুষ আছে যাদেরকে আমরা সংস্কৃতিবান বলতে পারি না। সংস্কৃতি সাহিত্য সৃষ্টি করা বা বীণা বাজানোর পারদর্শিতার নিরিখেও বিচার হয় না। সংস্কৃতি মানুষটির সাধারণ ব্যবহার, কথা বলার ভঙ্গী ও অন্যান্য আচরণ থেকে প্রতিভাত হয় -- এর সঙ্গে চরিত্রের ভালো-মন্দের কোন সম্পর্ক নেই। 

সংস্কৃতি আবার শুধু নৈতিক চরিত্রের মাপকাঠিতেও বিচার হয় না। চরিত্র মানুষের ভিতরে৫র দিক আর সংস্কৃতি মানুষের বাইরের দিক। সংস্কৃতি মানুষের ব্যবহার, তার জীবনযাত্রাপ্রণালীর উপরই নির্ভর, চরিত্রের উপর নয়। তবে চরিত্রের সঙ্গে সম্পর্ক আছে সংস্কৃতির কিছুটা এই অর্থে যে বাইরের আচরণ, ব্যবহার সবই ভিতরের চরিত্রের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলে।    

মানুষকে প্রকৃতি সংবেদনশীল পাঁচটি ইন্দ্রিয় দিয়েছেন। এই ইন্দ্রিয়গুলির সাহায্যে সে ক্ষমতা অর্জন করে ও জীবনের আনন্দ উপভোগ করে। ক্ষমতা আবার মানুষকে অসৎ, দুর্নীতিপরায়ণ করে তোলে আর সে কথা মানুষকে মনে করানোও হয়। Lord Acton এই মন্তব্যটি করেছিলেন যদিও তা রাজনৈতিক বিষয়েই বলা।    
সংস্কৃতি বিষয়ক দুর্নীতি অন্য ধরণের। ইন্দ্রিয়গুলি মানুষকে আনন্দের অনুভূতি করায়। প্রতিটি ইন্দ্রিয়ের আবশ্যিক কাজও আছে যা জীবনধারণের জন্য অতি প্রয়োজন। তারা আবার শারীরিক আনন্দের যোগানদার। মানুষ তার এই ইন্দ্রিয়গুলির যখনই অতি ব্যবহার করবে তার মধ্যে অসৎ ভাব আসবে তখনই। সভ্যতার কাজ হচ্ছে মানুষের এই ইন্দ্রিয়প্রবণতার প্রবৃত্তিকে সংযত করা। সভ্যতার সত্যি অর্থই হল নিয়ন্ত্রণ।       

সমাজচেতনা, ও সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে বাস করা -- মানুষকে নিয়ন্ত্রিত করে ইন্দ্রিয়বশ হওয়া থেকে। এই ইন্দ্রিয়গুলিকে সঠিক ভাবে চালনা করে সমাজে একত্রিত হয়ে বাস করার যোগ্যতা অর্জন করে, ব্যক্তিগত ভাবে ইন্দ্রিয় আসক্তিকে নিয়ন্ত্রণে আনলেই তা সভ্যতার পরিচায়ক। সভ্যতার আরো অন্য অর্থ আছে কিন্তু সত্যি এবং সব চাইতে প্রয়োজনীয় অর্থ এটাই। সভ্যতা শুধুমাত্র প্রযুক্তির উন্নতিই নয় বা জীবনের বস্তুগত সুখ-সুবিধার উপকরণের যোগানদার নয়।

আমাদের মনে রাখতে হবে সভ্যতা একটি বিমূর্ত বিশেষ্য (abstract noun) এবং একটি জীবনযাত্রাপ্রণালীকে (state of living) নির্দেশ করে, কোন বস্তুকে নয়। সভ্যতা জংলি-বর্বরোচিত আচরণ, অত্যধিক আবেগ, যেমন ক্রোধ, যৌনকামনা ইত্যাদির নিয়ন্ত্রণ আনবে। সভ্যতার দুটি অঙ্গ এই নিয়ন্ত্রণের। একটি সরকার যা সব সভ্যতারই বিশেষ প্রয়োজনীয়, আর একটি সংস্কৃতি যা পরিবারের শিক্ষা, প্রথা, ধর্মীয় ধারণা বা বিশ্বাস, সাহিত্য এবং সাধারণ শিক্ষার মাধ্যমে বিকশিত হয়। সংস্কৃতি অসংযম, উচ্ছৃঙ্খলতাকে দমন করে অন্দরের দিক থেকে আর সরকার শাস্তিমূলক আইন প্রয়োগ করে বাইরে থেকে। যদি এই দুটি সংস্থা পরাজিত হয় তখন নিন্দা, অপবাদের মাধ্যমে বা পুরোপুরি ভাবে সমাজ থেকে বহিষ্কার করে সমস্যার সমাধানের চেষ্টা হয়। সরকার জোর করে বাইরে থেকে নিয়ম প্রয়োগ করে আর সংস্কৃতি ভিতর থেকে নীরবে কাজ করে।    
সংস্কৃতির প্রভাবে মানুষ নিজের ইচ্ছাতেই নিয়ম পালন করে। এই স্ব-ইচ্ছায় কিছু পালন খুবই শক্তিশালী, আর জোর করে চাপানো নিয়মে মানুষ জেদি গোঁয়ার হয়ে যায়। সংস্কৃতি তাই স্ব-নিয়ন্ত্রণের সফলতা। চরিত্র ও সংস্কৃতি এক নয় আগে বলা হয়েছে যদিও, তবু চরিত্রকেও সমান দরজা দেওয়া যায় সংস্কৃতির সঙ্গে সাধারণ ভাবে। খোসার ভিতরে ফল থাকে। অনেক সময় খোসার সুগন্ধ ফলের থেকেও বেশী হয় -- যেমন কমলালেবু বা কলার খোসা, তেমনি সংস্কৃতিসম্পন্ন ব্যবহার সদ্গুণের থেকে আকর্ষক বেশী। সংস্কৃতি একটি সামাজিক সদাচার তাই সমাজে সহজেই পরিলক্ষিত হয় এবং সমাদর পায় সদ্গুণের থেকেও। ফলের খোসা ও ফল একই সঙ্গে বর্ধিত হয় পেকে যাওয়া পর্যন্ত -- ঠিক তেমনি সংস্কৃতি মনের ভিতরে ও চরিত্র বাইরের কাজকর্মের অর্থাৎ স্বভাব গঠনের মাধ্যমে একই সঙ্গে বেড়ে ওঠে।

সংস্কৃতি কপটতার ফাঁদে পড়বে যদি চরিত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হয়। কোন কপটতাই (hypocrisy) সংস্কৃতি নয়। বিনয়নম্রতাও সংস্কৃতির একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক। “বিদ্যা বিনয়সম্পন্নে ব্রাহ্মণে”। বিদ্যা, বিনয় ও জ্ঞান ব্রাহ্মণের সম্পদ। এই তিনটি সম্পদ ছাড়া সংস্কৃতি হয় না। একজন সংস্কৃতিবান বিনয়ী সত্যের যত কাছে  -- একজন সংস্কৃতিবান কিন্তু আত্মগরিমায় গর্বিত ও আত্মপ্রচারকারী মানুষ সহজাত বা প্রকৃতিদত্ত ক্ষমতার অধিকারী হলেও সত্য থেকে দূরে ও সমাদর কমই পায়।         
শুধু খাওয়া-পরা, বাসস্থানের ব্যবস্থা সংস্কৃতি তৈরি করে না। সমাজবদ্ধ হয়ে বাস করার যে আনন্দ, জীবনকে পরিপূর্ণ করার আনন্দ সংস্কৃতির ভিত তৈরি করে। মানসিক নীচতা, অসত্ভাব ও নিষ্ঠুরতা -- এই তিনটি কদাচার থেকে দূরে থাকাই সংস্কৃতির অঙ্গ।  কাউকে বা গরীবকে কিছু দেওয়ার সময় সহানুভূতিপূর্ণ আচরণ, সুন্দর স্নেহশীল কথা দেয় জিনিষটি থেকে অনেক বেশী মূল্যবান। এটাই সংস্কৃতি।  

ভারতীয় সংস্কৃতি মূলত আত্মসংযমের উপর প্রতিষ্ঠিত। নিজের যা কিছু আছে, তা অন্যের সঙ্গে বিশেষ করে গরীবের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া, চিত্তের নির্মলতা, অনাড়ম্বর জীবন যাপন, সন্ন্যাস এবং সর্ব ধর্ম সহিষ্ণুতা হচ্ছে তার মূল উপকরণ -- ভারতীয় সঙ্গীত বা ভারতনাট্যম নৃত্য নয়।

কুলধর্ম ও দেশধর্মও সংস্কৃতির একটি বিশেষত্ব। ভারতবর্ষের জাতীয় ব্যবহার একটি মৌলিক সুসংগঠিত দেশ ধর্ম যা পরিবার, জাতি, একটি নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যযুক্ত এলাকায় সকলকে একত্রিত করে এবং একে অন্যের পেশার সম্পূরক হয় -- তখনই একটি জাতি বা nation-এর উদ্ভব হয়। প্রাচীন ভারতের যুক্ত পরিবার (joint family) একটি এমন প্রতিষ্ঠান ছিল যেখানে পরিবার ধর্ম সকলকে একত্রে বেঁধে রাখত ও একে অন্যের সহযোগিতা, বিপদের সময় এক যোগে তার সম্মুখীন হওয়া সকলের উন্নতি সাধন -- এই গুণগুলি বর্তমান ছিল। যুক্ত পরিবার নিজেই একটি সমাজতান্ত্রিক ধাঁচের সংগঠন, আবার সেখানে ব্যক্তির স্বাধীনতাও থাকে, তার ভিতরের উদ্যম বা শক্তিকে কাজে লাগিয়ে উন্নতি করার। 
ভারতীয় সমাজে বিবাহ প্রথাটি শুধু পাত্র-পাত্রীর বিবাহবন্ধনই সূচিত করতো না -- দুটি পরিবারও সম্পর্কিত হতো, যদিও এখন সেই প্রথার অনেক ব্যতিক্রম ঘটেছে অর্থনৈতিক কারণ ও আন্তর্জাতিক মেলামেশার ফলস্বরূপ, কিন্তু তার মূল ধারাটি একই আছে। এটি একটি পারিবারিক প্রথা। বিবাহের মন্ত্রে যত কথা বলা হয়েছে তা আসলে একটি চুক্তিপত্র (যদি এই ভাষায় বর্ণনা করি) কিন্তু সেটি কিছুতেই লঙ্ঘন করা যেত না। 

সামাজিক সংগঠনের সিঁড়িটি  কিন্তু এক লাফে পরিবার থেকে সামাজিক সংগঠন ⤒ তার থেকে জাতীয়তাবোধ বা জাতির ধারণায় ওঠা যায় নি।    
যুক্ত পরিবার -- তার থেকে সংগঠন (community) যা যুক্ত পরিবার থেকে বড় -- তার থেকে জাতি -- যেখানে পরস্পরের মধ্যে বোঝাপড়া, সহযোগিতার মনোভাব এবং পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধার ভাব বজায় রেখে সামাজিক মূল্যবোধগুলিকে বাঁচিয়ে রাখা ও পরবর্তী প্রজন্মকে একই শিক্ষা দেওয়া -- এই ছিল মূলমন্ত্র। মূল কথা ছিল একজনের দায়িত্ব কেবল তার স্ত্রী-সন্তানের প্রতি কর্তব্যেই সীমাবদ্ধ থাকতো না -- জাতির, যা বর্ধিত পরিবার বলে চিহ্নিত হতো -- তার প্রতিও দায়িত্ব থাকতো। একজন প্রভাবশালী লোক তাঁর প্রভাব খাটিয়ে অন্যের, তা নিজের পরিবারের হোক বা অন্যের (বর্ধিত পরিবারের) হোক তাকে সাহায্য করতে হতো। বর্তমানের প্রেক্ষিতে এটা স্বজনপোষণ বলে দোষারোপ পাবে।       
সংস্কৃতি পুরোটা না হলেও আংশিক ভাবে নির্ভর করে আত্মসংযমের উপর (আগে উল্লেখিত) এবং রাষ্ট্রের নিয়ম ও শৃঙ্খলার উপর, এবং সব সমাজেই এই ধারাটি বজায় থেকেছে। ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বলতে পারা যায় ভারতবাসীরা জাতি প্রথার (caste system) প্রতি কতটা ঋণী।

ভারতবর্ষই সম্ভবত: একটি রাষ্ট্র যেখানে এক শাসনতন্ত্র (সরকার) থেকে আর এক শাসনতন্ত্র (সরকার) পরিবর্তনের মধ্যে সময়ের দীর্ঘ ব্যবধান ঘটেছে। এমনও অনেক সময় গেছে যখন জনগণ না রাজ্য সরকার, না কেন্দ্রীয় সরকার পেয়েছে। ঐ সব সময় এই পরিবার ও জাতি প্রথার শৃঙ্খলা ও নিয়মই জনগণকে সুসংবদ্ধ রেখেছে সংস্কৃতির আত্মসংযমের শিক্ষার সাহায্যে। তখন শুধু যে সমাজ নিয়ম-নীতি মেনে চলেছে তা নয় -- ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প কলা, সঙ্গীত, নৃত্যকলার সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ কারিগরদের কাজ সফলতার সঙ্গে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়েছে। সরকার না থাকাতে কোন পার্থক্য হয় নি। একজন নেতৃস্থানীয় লোকই রাজার মত সব দায়িত্ব সামলাতেন। জীবনদর্শনের কোন নিচু মান দেখা যায় নি। স্বাস্থ্য পরিষেবা, চুক্তিবদ্ধ ভাবে কাজ করা, সম্পত্তি রক্ষা, সকলের নিরাপত্তা সবই ভাল ভাবে হয়েছে এই জাতি প্রথার (caste system) মাধ্যমে যা পৃথিবীর অন্য কোন জায়গার ইতিহাসে পাওয়া যায় না যখন সেখানে অরাজকতা বা মাৎস্যন্যায় চলেছে। এই সব কিছুই পরিচালিত হয়েছে ভারতীয় সমাজের উন্নত সংস্কৃতির দ্বারা। জাতির মধ্যে ভাঙন ধরে নি কারণ সকলেই সম্পৃক্ত ছিল একই মূল্যবোধে। কুলধর্ম, জাতিধর্ম ও ভারতধর্ম এক সূত্রে গ্রথিত করে রেখেছিল পুরো ভারতীয় সমাজকে। সংস্কৃতি শুধুমাত্র জীবনকে পরিপূর্ণ করে নি -- যখন ভারতেও অরাজকতা উপস্থিত হয়েছিল সংস্কৃতি রাজা বা অন্যান্য রাজকর্মচারীর জায়গায় নিজেকে প্রতিপন্ন করেছে দায়িত্ব পালনে, জাতি প্রথার সাহায্যে।     

এর কোন নথি বা প্রমাণপত্র নেই। কিন্তু যখনই প্রয়োজন হয়েছে এই কাজটি সম্পন্ন করেছে পরিবার ও জাতিধর্ম। এই দুটি সন্দেহাতীত ভাবে সম্পন্ন করেছে কোন ঢাক ঢোল না পিটিয়ে। তারা কোন রেজিস্টার রাখে নি বা নতুন আইনও প্রণয়ন করে নি। সংস্কৃতির সঠিক মূল্যায়ন এই প্রাচীন সমাজেরই অবদান। 

তথ্য সূত্র -
Foundations of Indian Cuiture--K.M.Munshi
Our culture-- C.Rajagopalachari
Cultural Heritage of India---compiled & edited by V.Sivaramakrishan
some other essays published in Bhavan's Journal.


লেখক পরিচিতি - পড়াশুনো ত্রিপুরা ও কলকাতায়। মনোবিদ্যায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। কিছুকাল শিক্ষকতা করেছেন, বর্তমানে সমাজসেবী। একটি সর্বভারতীয় N.G.O. সংস্থার সঙ্গে যুক্ত। সংসার ও কর্ম জগত্‍‌ সামলানোর ফাঁকে ফাঁকে লেখালেখি করেন।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।