প্রাচীন ভারত
সুকুমারী ভট্টাচার্য স্মরণ সংখ্যা , জুন ৩০, ২০১৫
প্রাচীন ভারত ও আমি
ঋজু গাঙ্গুলি
বাঙালির ইতিহাস-চর্চা নিয়ে ইংরেজি ও বাংলায় থান ইঁট-প্রমাণ থেকে শুরু করে চটি, হরেক মাপের ও গুণমাণ-এর গাদাগাদা বই বাজারে বিরাজমান। কিন্তু আমার মত গোদা পাঠক সেই সব বই-এর ভালোমন্দ বিচার করতে পারবেনা। তার বদলে, আমি আমার প্রাচীন ভারত চর্চা সংক্রান্ত (অট্টহাসি হাসছেন, তাই তো? হাসুন-হাসুন। এক মাঘে শীত যায়না!) কিছু কিসসা পেশ করতে চাই।
প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের সঙ্গে আমার প্রথম মোলাকাত ক্লাস সিক্স-এ। সেই বইতে অবশ্য সবই এত সংক্ষেপে দেওয়া ছিল যে, উত্তরকে শক্তপোক্ত বানাতে সাল-তারিখ ব্যবহার করতে হবে, যেকোন উত্তরে কোটেশন (বেশির ভাগেরই উত্স ভিনসেন্ট স্মিথ) গুঁজে দিলে ভালো হবে, আর বড় প্রশ্নের উত্তরে কমপক্ষে তিন পাতা না লিখলে ১০-এ ৪-ও উঠবে না: এই তিনটি জিনিসের বাইরে আমি বিশেষ কিছু শিখিনি। আমি নিশ্চিত যে আমার মত করে ইতিহাসের প্রথম পাঠ বেশির ভাগ ছাত্রকেই নিতে হয়েছিল। তবে ব্যাপার জটিল হয়ে দাঁড়াল ক্লাস নাইনে ওঠার পর, যখন গ্রিস-রোম-আত্তিলা সব বিদায় নিল, আর প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের সঙ্গে আমাদের গভীর ও গম্ভীর পরিচয় করিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব নিলেন শ্রী প্রভাতাংশু মাইতি ও শ্রী অতুলচন্দ্র রায়। এঁদের বই-এ কনিষ্কের মুণ্ডহীন মূর্তি দেখে ট্রমাটাইজড হয়েই আমার ‘প্রাচীন ভারত’ চর্চার সূত্রপাত।
সি.বি.এস.ই বোর্ডে এন.সি.ই.আর.টি-র যে বইগুলো টেক্সট হিসেবে পড়ানো হয়, সেগুলো লেখা এবং সম্পাদনা যাঁরা করেন তাঁরা নিজেরা এক-একজন ডাকসাইটে ঐতিহাসিক, এবং হাতে-কলমে ইতিহাসের উপাদান (অর্থাৎ প্রত্নবস্তু, মুদ্রা, পুঁথি, ইত্যাদি) পরীক্ষা করে কীভাবে তার বিশ্লেষণ করতে হয়, সে নিয়ে তাঁদের সুস্পষ্ট অভিমত আছে। কিন্তু আমরা যাঁদের লেখার মাধ্যমে সিন্ধু সভ্যতা (এখন অবশ্য হরপ্পা সভত্যা বলা হয়, সরস্বতী সভ্যতাও বলা হচ্ছে কোথাও-কোথাও) থেকে শুরু করে শশাঙ্কের অসভ্যতা (রাজ্যবর্ধনকে মার্ডার করার ব্যাপারটা তো এই ভাবেই দেখানো হয়) অবধি শিখলাম, তাঁরা কে, এবং আমাদের ইতিহাস শেখানোর লিজ তাঁদের কে দিয়েছিল, এই গূঢ় প্রশ্নের কোন উত্তর আজও পেলাম না। তবে হ্যাঁ, ওই বইগুলো থেকে যা-যা বুঝেছিলাম তা মোটামুটি এরকম: -
(১) উত্তরে এক ঢালা বিরাট একটা অনুচ্ছেদ না লিখে, বরং যে কোন জিনিসকে যত বেশি সম্ভব পয়েন্ট-এ ভেঙে লিখতে হয়।
(২) সিন্ধু সভ্যতা আর বৈদিক সভ্যতা (পরে অবশ্য জেনেছিলাম: বেদের যুগে সভ্যতা নয়, ছিল সংস্কৃতি, কারণ নগরায়ণ না ঘটলে নাকি সেই সময়কার জীবনযাত্রা-কে সভ্যতার পর্যায়ভুক্ত করা যায়না)-র তফাৎ, মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের কারণ, কনিষ্কের শাসনব্যবস্থা, হর্ষবর্ধনের গুণাবলি: সবই লিখতে হয় সাল-তারিখ আর ঘটনাবলির সুনির্দিষ্ট পর্যায় বুঝে।
রহড়া রামকৃষ্ণ মিশন নিয়ে আমার স্মৃতি মোটেই সুখের নয়, কিন্তু ইতিহাসের দুই শিক্ষকের সযত্ন প্রচেষ্টায় ইতিহাসে আমার একটা আগ্রহ তৈরি হয়ে যায়। অতঃপর, মাধ্যমিকে আমার একটি প্রিয় বিষয়ে (ইংরেজিতে) লেটার ফস্কালেও ইতিহাসে লেটার পেলাম। উত্সাহে প্রায় আনন্দাশ্রু বিসর্জন করে বাবাকে বললাম যে আমি হায়ার সেকেন্ডারিতে আর্টস নেব, আর বিশেষ ভাবে ইতিহাস পড়ব। যা হওয়ার তাই হল। আমার বাবা কমল মিত্র টাইপের লোক না হলেও এক্ষেত্রে প্রায় সেই রকম ভূমিকাই পালন করলেন, এবং বিবেকানন্দ সেন্টেনারি কলেজে সায়েন্স নিয়ে ভর্তি হতেই হল। তারপর ইতিহাসের সঙ্গে আমার প্রত্যক্ষ সম্পর্ক ছিল না পাক্কা ৬টি বছর। ওই সময়ে আমি ভি.সি কলেজ ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরেছি, এমনকি বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়েও পোস্ট-গ্র্যাজুয়েশন করার আশায় এক চক্কর দিয়ে এসেছি। ইতিহাস যেটুকু ছুঁয়েছি তা শুধুই মাধ্যমিক পরীক্ষার আগে কোন পাড়াতুতো ভাই বা বোনকে একটু-আধটু গাইড করার জন্যে। কিন্তু নিয়তি (ইতিহাসের টিচার, নিঃসন্দেহে) আমার জন্যে অন্য রকম কিছু পরিকল্পনা করে রেখেছিলেন।
১৯৯৭-এর সেপ্টেম্বর মাসে, বি.এইচ.ইউ থেকে মাস্টার্সের মাঝপথে কোর্স ছেড়ে ফিরে আসার পর, ব্যারাকপুরে আমাদের বাড়ির যে ঘরটায় আমার সাম্রাজ্য ছিল (আসলে সামন্ত ছিলাম, সম্রাট-বিরাট-একরাট ছিল আমাদের বিড়ালেরা) সেখানে বসে, গভীর ভাবনাচিন্তার পর আমি কঠোর বৈজ্ঞানিক মতে নিম্নলিখিত ইনফারেন্স-গুলো মনে-মনেই নোট করলাম: -
(১) কলেজ-ইউনিভার্সিটি-র বাঁধাধরা পড়াশোনা আমার দ্বারা আর হবেনা।
(২) শুধুমাত্র কেমিস্ট্রি অনার্সে গ্র্যাজুয়েট (সে যতোই হই না কেন যাদবপুরের স্টুডেন্ট) হিসেবে বাংলায় কেন, ভূ-ভারতে কোথাও চাকরি জুটবে বলে মনে হয়না।
(৩) চাকরির জন্যে পরীক্ষায় বসতে হবে; আর পরীক্ষা দিয়ে চাকরিই যদি করতে হয় তাহলে “মারি তো গণ্ডার, লুটি তো ভাণ্ডার” মন্ত্র জপে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের জন্যেই বরং লড়ি।
(৪) কলকাতার তথাকথিত কোচিং সেন্টারগুলোর দশা দেখে মনে হয় যে এখানে পড়লে পরীক্ষায় উতরোবার কোন সম্ভাবনা নেই। অর্থাৎ যা করার নিজেকেই করতে হবে।
(৫) নিজে-নিজে পড়ে পরীক্ষার জন্যে প্রস্তুতি যদি নিতেই হয়, তাহলে এমন কোন বিষয় নিতে হবে যেটা নিয়ে পড়তে-পড়তে আমি বোর হব না।
(৬) তাহলে বাদ গেল কী কী? বিজ্ঞানের সব ক’টা বিষয় আর ইংরেজি (বড্ড কঠিন), সোসিওলজি/ অ্যানথ্রোপলজি/ জিওগ্রাফি/ সাইকোলজি (এর কোনটাই আমি একা পারব না, কারও না কারও সাহায্য লাগবে), পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন/পলিটিক্যাল সায়েন্স (বড্ড বোরিং)। তাহলে রইল কী? গল্পের বই ছাড়া বাঁচতে পারিনা, তাই একটা বিষয় হিসেবে অটোমেটিক চয়েস হল বাংলা সাহিত্য। আর অন্যটা? ইয়েসসসসসস! ইতিহাস!
১৯৯৮-এ আমি প্রথমবার সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দিই, আর শেষবার ২০০০-এ। এই তিনটে বছর আমি ইতিহাস পড়েছিলাম শুধুমাত্র চাকরির পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়ার আশায়। কিন্তু সেই সময়টা স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল একটা কারণে: অটলবিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বে স্বাধীন ভারতে সেই প্রথম গরিষ্ঠতা নিয়ে দিল্লির মসনদে বসেছে ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স, আর প্রায় অনিবার্যভাবে ভারতের ইতিহাসের সবথেকে ধূলিধূসর অধ্যায়টি (অর্থাৎ প্রাচীন ভারত)-র নতুন ব্যাখ্যা করার জন্যে উদ্যোগী হয়েছে একটি বিশেষ গোষ্ঠী। প্রশ্ন বানানোর দায়িত্বে তখনও প্রবল প্রতাপ রয়েছে কংগ্রেস-ঘেঁষা মার্ক্সবাদী হিস্টরিওগ্রাফি অনুসরণকারীদের। পাঠ্য বই বানানোর ক্ষেত্রে জে.এন.ইউ-এর অধ্যাপকেরা বাতিল হয়ে যাচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু খাতা দেখার দায়িত্বে যাঁরা আছেন তাঁরা বেশিরভাগই আর.এস.শর্মা, রোমিলা থাপার, ইরফান হাবিব, বিপান চন্দ্র-র বই পড়ে ডিগ্রি পেয়েছেন। আবার খাতা দেখার পুরনো ক্লিক-টা ভেঙে নতুন অধ্যাপকদেরও দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে, যাঁদের মধ্যে অনেকেই মার্ক্সবাদী ঐতিহাসিকদের ঘোর বিরোধী, এবং ইতিহাসের জাতীয়তাবাদী ব্যাখ্যায় আগ্রহী। সব মিলিয়ে, সেই সময়ে আমরা কোন বই পড়ব, বা কোন লেখকের বক্তব্যকে প্রামাণ্য হিসেবে মানব, তার থেকেও বড় হয়ে দাঁড়িয়েছিল: কোন প্রশ্নের উত্তরে কী লিখলে মোটামুটি নিরাপদ থাকা যাবে, সেই বিচারটা।
কিন্তু ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভাঙে, আর এ তো ছিল আমার প্রিয় বিষয়। তাই, সেই যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়েও, প্রাচীন ভারত ও বিদ্বদ্জনেদের দ্বারা সেই বিষয়ে চর্চার পদ্ধতি নিয়ে বেশ কিছু প্রশ্ন আমার মাথায় খোঁচা দিয়েছিল। প্রশ্নগুলো এরকম: -
(১) হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী এবং রমেশচন্দ্র মজুমদার-এর হাতে গড়ে ওঠা জাতীয়তাবাদী ঘরানার ইতিহাস চর্চাকে বর্জন করে কোসাম্বি, শর্মা, থাপার, ও অন্যান্য মার্ক্সবাদী ঐতিহাসিকেরা প্রাচীন ভারতের ইতিহাস চর্চায় স্বাধীনতার পর থেকে একটি বিশেষ ধারার প্রচলন করেছেন। এখনও সিন্ধু সভ্যতার লিপির পাঠোদ্ধারই করা গেল না, আর অনেকে স্নানাগার থেকে কখনও “রিলিজিয়াস প্রস্টিটিউশন” খুঁজে পান, তো কোথাও আবিষ্কার করেন যে ওই সভ্যতার শাসক ছিল পৌরহিত্য ও বাণিজ্য: এই দুয়েই পটু এক সম্প্রদায়। একইভাবে, হুন আক্রমণ ও তার পরিপ্রেক্ষিতে ছোট-ছোট রাজাদের উত্থানের ফলে প্রাচীন ভারতে কেন্দ্রীকৃত শাসনব্যবস্থা অপ্রাসঙ্গিক ও নাম-সর্বস্ব হয়ে পড়ছিল ঠিকই, কিন্তু সেটাকে অনেকে যখন বলেন ইউরোপিয়ান ফিউডালিজম বা সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার ভারতীয় রূপ, তখন মাথায় রক্ত চড়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক বলে মনে হয়, তাইনা?
(২) এর উল্টোদিকে, অর্থাৎ রামায়ণ-মহাভারত আর বৌদ্ধ জাতককে একাসনে বসিয়ে প্রাচীন ভারতের “গৌরবগাথা” নির্মাণের যে প্রবণতাটি তখন গোকুলে বাড়তে শুরু করেছিল, আজ সে অক্রুরের আহ্বানে মথুরায় আসার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কালকূট হিসেবে সমরেশ বসু যেসব সাহিত্য রচনা করে গেছেন, তাতে তিনি বারবার এটাই বলার চেষ্টা করেছেন যে আমাদের পুরাণ ও কিংবদন্তী আমাদের ইতিহাসকে বহন করছে ঠিকই, কিন্তু সেই ইতিহাস ঠিক পাঠ্য বই-এর ইতিহাস নয়। তাতে কোথাও লেখার মধ্যে ডুবে গিয়ে ভাব ও ভাষ্যের মধ্যেই তথ্যকে খুঁজে নিতে হবে, কোথাও আবার নিজেকে নিয়ে যেতে হবে অনেকটা দূরে, যাতে অতিশয়োক্তির আড়ালে ঢেকে যাওয়া সত্যিটার আসল চেহারা আন্দাজ করা যায়। সেই দূরত্বটা বজায় না রেখে নিজের মনে আগে থেকেই বয়ে চলা থিওরির পোষাকে সত্যিটাকে কেঁটে-ছেঁটে ‘ফিট’ করানোর চেষ্টা একই রকম ভুল, আর দীর্ঘমেয়াদি ভাবে ক্ষতিকর। কিন্তু এই “নব্য জাতীয়তাবাদী” ঘরানা তার পরেও বলতে চায় যে প্রাচীন ভারতে রকেট, মিসাইল, কসমেটিক সার্জারি: এসব ছিল। এই একই “ঐতিহাসিকেরা” যখন কৃষ্ণকে ভগবান হিসেবে সাব্যস্ত করতে চান, তখন আমার বরং মার্ক্সবাদী বা অন্যান্য ঐতিহাসিকদের কথাটা বেশি যুক্তিসঙ্গত বলে মনে হয়, যখন তাঁরা বলেন যে ভারতে কৃষ্ণের লিজেন্ড তৈরি হয়েছে ব্রাহ্মণদের বুদ্ধিতে, যাঁরা বেদের নারায়ন নামক ঋষি, বিষ্ণু নামক অপেক্ষাকৃত গৌন এক সৌর দেবতা, দেবকীপুত্র কৃষ্ণ - যার প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ছান্দোগ্য উপনিষদে বা কিছু পণ্ডিতের মতে খ্রিষ্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দীতে উজ্জয়িনীর বিখ্যাত নৈয়ায়িক ঘোর অঙ্গিরস-এর ছাত্র কৃষ্ণ দেবকীপুত্র, (কারো মতে তিনি আবার এক জৈন তীর্থঙ্করের সহপাঠীও ছিলেন), উত্তর ভারতে গো-পালক সম্প্রদায়ের মধ্যে জনপ্রিয় এক লোকনায়ক (ঘোর কৃষ্ণবর্ণ, মারদাঙ্গায় পটু, নারীদের সঙ্গে ছলাকলায় রীতিমত, ইয়ে, পারদর্শী), এমন নানা জায়গার নানা প্রবাদ আর গল্পকে ভাগবত আর পুরাণ-এর মাধ্যমে সংকলিত করে একটি দেবতার জন্ম দেন, যাতে একজন দেবতার পূজন-রীতির প্রচলনের মাধ্যমে অনেক সম্প্রদায় ও জনগোষ্ঠীর ওপর আধিপত্য স্থাপন করা যাবে।
তবে এই সব যুদ্ধ-বিগ্রহ এখন অনেকদিন ধরে চলবে, আর চলাও উচিত, নইলে প্রাচীন ভারতের ইতিহাসকে নতুন চোখে না দেখে লোকে তো তুচ্ছ আচারের মরুবালিরাশি কীভাবে বিচারের স্রোতঃপথ-কে গ্রাস করে ফেলল তাই নিয়েই পরে হাহাকার করবে। আমি বরং এই নিয়ে মনের পুকুরে অনেকদিন ধরে ঘাই মারা একটি প্রশ্ন সবার সামনে তুলে ধরে বিদায় নিই, আর সেটা হল: প্রাচীন ভারতের চর্চা নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের কীভাবে আগ্রহী করে তোলা যায়? এই বিষয়টি নিয়ে এক-না-এক সময় প্রত্যেক অভিভাবককেই ভাবতে হয়, কারণ ওই একটি বিষয়কে “বোরিং” আখ্যা দিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিতে চায় প্রায় সব ছাত্রছাত্রী। তাই আমার মনে হয় যে আমরা যদি গল্পের মাধ্যমে ইতিহাসকে একটু-একটু করে ওদের কাছে তুলে ধরি, যেখানে “কার বাবা কে ছিল ও কত বছর রাজত্ব করেছিল”-র থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হবে ওদের মনে প্রশ্নের পর প্রশ্ন জেগে ওঠার সুযোগ করে দেওয়া, তাহলে প্রাচীন ভারত ছাত্রছাত্রীদের কাছে একটা বিভীষিকা না হয়ে বরং রহস্যের খাসমহল হিসেবে দেখা দেবে।
সত্যজিৎ রায় “মহাকাশের অতিথি”-র শেষে প্রফেসর শঙ্কুর হাতে রেখে দিয়েছিলেন এক দেদীপ্যমান প্রস্তরখণ্ড, যার মধ্যে লুকিয়ে ছিল মানবজাতির সব থেকে বড় চারটি সমস্যার সমাধান। সেই সমাধানের মর্মোদ্ধার করার মত প্রযুক্তি প্রফেসর শঙ্কুর কাছে তো বটেই, পৃথিবীতেই ছিলনা। কিন্তু রাতের অন্ধকারে সেই ছোট্ট টুকরোটা থেকে বেরোনো আলোর আভা তাঁকে মানুষের কল্যাণে অক্লান্তভাবে কাজ করার উত্সাহ দিয়েছিল। শিক্ষকেরা যদি আগুনের পরশমনিটা এদেশের ছাত্রদের মনে ছুঁইয়ে দিতে পারেন, তবে তারা খাঁটি সত্যান্বেষী হিসেবে অনুসন্ধান করে সেই ধূসর অতীতকে রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শে সজীব করে পেশ করবে আমাদের সামনে। তা না করে, “জোরে জোরে পড়ো: অশোক খ্রীপূঃ ২৭৩ থেকে ২৩২ অবধি রাজত্ব করেছিলেন” স্টাইলে চললে শেষের সেদিন ভয়ংকর, যেদিন অমিশ ত্রিপাঠির “মেলুহা ট্রিলজি” ইতিহাস বলে গণ্য হবে, আর আমি-আপনি “ও শিবু, ও সিজি, ও গুজি” বলে পাগলের মত ছুটে বেড়াব।
আমি যা বলতে চাচ্ছি, সেটা মনে হচ্ছে আর একটু স্পষ্ট করা দরকার। আমার বক্তব্য -
(১) মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে, যে বইগুলোর ওপর নির্ভর করে আগামী দিনের গবেষণা বা অনুসন্ধান করার দীপশিখা ছাত্রছাত্রীদের মনে জ্বালানোর কথা আমাদের সিলেবাস-প্রণেতারা ভাবছেন (বা কিছুই না ভেবে সব ছেড়েছুড়ে বসে আছেন) সেগুলো নিয়ে চললে আমাদের ইতিহাস-চর্চার ভবিষ্যৎ অন্ধকার।
(২) সব যুগে ও সব দেশে ইতিহাস অবজেক্টিভিটি (কঠিন-কঠোর তথ্য) আর সাবজেক্টিভিটি (সেই সব তথ্যের ব্যাখ্যা আর তথ্যগত শূণ্যস্থানগুলো যুক্তি দিয়ে ভরাট করা) দিয়ে রচিত হয়। ভারতেও সেটা হবে, আর ওই সাবজেক্টিভিটি নিয়ে মারামারি হবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেই বিতর্ক ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে শেয়ার করলেই বরং ভালো, কারণ আগামী দিনের নয়া ইতিহাস তো তারাই লিখবে।
লেখক পরিচিতি - লেখক এক উদ্যমী পাঠক, যিনি বিপ্লব, চোখের জল, মানবচরিত্রের অতলস্পর্শী গভীরতা, সিন্ডিকেট, সারদা, ধোনি, ইত্যাদি তাবড় বিষয় থেকে দূরে, স্রেফ বেঁচে থাকার বই পড়তে চান। নিজের ভালবাসা থেকেই লেখালিখি।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।