প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

প্রাচীন ভারত

সুকুমারী ভট্টাচার্য স্মরণ সংখ্যা , জুন ৩০, ২০১৫

 

প্রাগৈতিহাসিক যুগে ভারতে শৈল-চিত্রণ

শুভেন্দু প্রকাশ চক্রবর্তী

এই রচনার শীর্ষক, লেখার পরিধি নির্ণয় করে দিয়েছে। এই কারণে শুধু ভারত কেন, সমগ্র বিশ্বের অন্যতম গুহাচিত্রের স্থান, অজন্তা, আমার এই রচনার পরিধির মধ্যে পড়ে না। এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা শ্রী নারায়ণ সান্যাল রচিত ‘অজন্তা অপরূপা’ বইয়ে পাবেন। মধ্য প্রদেশের বাঘ গুহাও মানুষের তৈরি গুহা, তাই অজন্তার থেকে প্রাচীন হওয়া সত্ত্বেও এই রচনা থেকে বাইরে রাখা হয়েছে। অবশ্য, এই গুহা সম্পর্কে কোনও প্রামাণ্য বইয়ের কথা আমার জানা নেই।

একটা বিষয় প্রথমেই জানানো উচিত, ভারতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রাগৈতিহাসিক যুগের মানুষ যে সমস্ত গুহা, ছবি আঁকার জন্যে পছন্দ করেছেন, সেগুলি গুহার ভৌগোলিক সংজ্ঞা অনুযায়ী যথাযথ গুহা নয়। ইংরাজিতে এগুলি Rock Shelter (শৈলাশ্রয়) বা কেবলমাত্র Shelter (আশ্রয়) বলা হয়।  

১। ভীমবেটকা

আমাদের দেশে শৈলাশ্রয়ের সর্ব প্রধান উদাহরণ, মধ্যপ্রদেশের রাজধানী ভোপালের ৪৫ কিমি দক্ষিণে রায়সেন জেলার ভীমবেটকায় পাওয়া গেছে। আশ্চর্যের কথা, এই World Heritage স্থান মাত্র প্রায় ৫৮ বছর আগে ১৯৫৭ সালে আবিষ্কৃত হয়।

অজন্তার মত সারা বিশ্বে বিখ্যাত, ভারতের প্রাচীনতম শৈলাশ্রয় তথা বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন, এই ভীমবেটকা। তাই এর বিষয়ে বর্ণনা প্রথমেই করতে হয়। ঐতিহাসিক ওয়াকাঙ্কারের ১৯৫৭ সালে এই আবিষ্কারের অনেক বছর আগেই ১৮৮৮ সালে ভারতের পুরাতত্ত্ব বিভাগ ভীমবেটকার কথা নথিভুক্ত করেছিল এক বৌদ্ধ edifice হিসাবে। তার কারণ, স্থানীয় অধিবাসীরা এই জায়গা সম্পর্কে এমনই ধারণা করতেন। যাই হোক ১৯৫৭-র কিছু আগে ড. ওয়াকাঙ্কার ভীমবেটকার পাশ দিয়েই দক্ষিণের সঙ্গে সংযোগকারী এক প্রধান রেলপথ হয়ে যাবার সময় এখানে কিছু টিলা দেখতে পান। সেগুলোর গঠনের সঙ্গে ফ্রান্স ও স্পেন-এর কিছু টিলার গঠনের সাদৃশ্য লক্ষ করেন। ফ্রান্স ও স্পেন-এর ওই টিলাগুলি বিখ্যাত শৈলাশ্রয়। ড. ওয়াকাঙ্কার এই সূত্র ধরেই কিছু দিন পরে ভীমবেটকায় আসেন আর পৃথিবী “ভীমবেটকা” সম্পর্কে জানতে পারে। 

দর্শন

আমরা তিন অসমবয়সী বন্ধু ডিসেম্বরের শেষে এক সকালে ভোলাল রেল স্টেশনের রিটায়ারিং রুম থেকে একটা ছোট গাড়ি ভাড়া করে বেরিয়ে পড়ি আর সেই প্রধান রেল লাইনের লেভ্‌ল-ক্রসিং-এ কিছুক্ষণ আটকে থেকে সকাল ৯টার মধ্যেই Bhimbetka World Heritage Site-এ পৌঁছে যাই। তখনও টিকিট কাউন্টারে লোক ঠিক মত কাজ আরম্ভ করেনি। মনে হল আমারা তিন জনই সেদিনের প্রথম দর্শনার্থী। গাইড না নিলে শৈলাশ্রয়গুলো ঠিক মত দেখা যায় না, কিন্তু বিভাগীয় গাইডের উপস্থিতি  তখনও হয়নি। এক সাধারণ কর্মচারী এগিয়ে এলো আমাদের গাইড হিসাবে। আমরা ইতস্তত করছি দেখে বলল যে এই স্থান বিখ্যাত হবার আগে থেকেই সে এখানে কাজ করছে আর প্রত্যেকটি স্থান ওর নখদর্পণে। ভাল ভাবেই সে আমাদের সবকিছু দেখিয়ে দেবে। আমার হাতে হ্যান্ডিক্যাম দেখে সেটার জন্য চার্জ লাগবে বললো। কিন্তু তখনও কাউন্টারে চার্জ নেবার লোক কেউ নেই। তাই আমায় চার্জ দিতে হল না আর সেই গাইড আমায় হ্যান্ডিক্যাম সহ-ই ভিতরে নিয়ে গেল। বলার অপেক্ষা রাখেনা যে আমি বিনা পয়সাতেই আমাদের শৈলাশ্রয় দর্শনের চলচ্চিত্রায়ন করতে পেরেছিলাম। তবে একটা ব্যাপার তখন বিশেষ খেয়াল হয়নি, যে ভিডিও ছবি তুলতে গিয়ে স্থির ছবি তোলার সময় করে উঠতে পারলাম না। কেননা আমাদের গাইড খুবই তাড়াতাড়ি এক স্থান থেকে পরবর্তী স্থানে চলে যাচ্ছিল, হ্যান্ডিক্যাম সরিয়ে রেখে স্থির ক্যামেরা ব্যবহার করতে গেলে গাইড দূরে চলে যাবে। তাই আপনাদের চলচ্চিত্রায়নের মাধ্যমেই এখানকার দৃশ্য দেখাতে পারবো, স্থির ছবি দিয়ে নয়।

শৈলাশ্রয়গুলি ঘিরে প্রচুর গাছ-পালা, জঙ্গলের মতই, অবশ্য গাছগুলোয় কিছু কম পাতা রয়েছে আর প্রায় শুকিয়ে গেছে। আসলে এই অঞ্চলটা পাতা ঝরা গাছের জঙ্গল, চির-হরিৎ নয়। তাই ডিসেম্বরের শেষে জঙ্গলের এই অবস্থা। শুনেছি এখানে জলের অভাব নেই। অবশ্য আমাদের ঘোরা অঞ্চলের মধ্যে জলের চিহ্ন দেখতে পাইনি।

আগেই বলেছি যে আমরা এখানে সকাল ৯টার মধ্যেই পৌঁছে গেছি, তাই শীত কালের সকালের রোদের রেশ তখনো রয়েছে। সেই মিষ্টি স্বর্ণোজ্জ্বল রোদের, বাতাসে গাছের পাতা দুলিয়ে লুকো-চুরি খেলা, এক অপূর্ব পরিবেশ সৃষ্টি করছিলো। লাল মাটির ওপর পাথর বাঁধানো প্রায় দেড় দু মিটার চওড়া রাস্তা জায়গাটাকে এক বাগানের রূপ দিয়েছে। মাঝে মাঝে ছোট বড় পাথরের ঢিবির মত রয়েছে। পরে বুঝলাম সেইগুলোই শৈলাশ্রয়, যখন সেগুলোর দেয়াল বা সিলিং-এ প্রাগৈতিহাসিক যুগের মানুষের কীর্তি, নানা রঙের ছবি দেখলাম। সুজিত প্রথম শৈলাশ্রয়ে প্রবেশ করেই ‘ওঃ’ বলে উঠল বিস্ময়ে। আমরা দুজন বাক্‌রুদ্ধ হয়ে গেলাম। সুজিতকে অবশ্য ‘ওঃ’ পেয়ে বসল, কত বার যে এই শব্দ ও পুনরুক্তি করল, তার ইয়ত্তা নেই।

যাই হোক, শৈলাশ্রয় আর সাবেকি গুহার মধ্যে কিছুটা পার্থক্য আছে, সেটা বুঝে নেওয়া দরকার। গুহা সাধারণভাবে সুড়ঙ্গ আকারে হয়ে থাকে,  এর এক দিক বা সময় সময় একাধিক প্রান্ত খোলা থাকে। শৈলাশ্রয়ের সঙ্গে শেড, বা ঢাকা দেওয়া খোলা জায়গার তুলনা করা যায়। ছাদ সহ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তিন দিক খোলা এক ঘর, এই হল শৈলাশ্রয়। দেয়াল সাধারণত পাহাড়ের গা হয়। সেই ঘরের সিলিঙে আর দেয়ালে চিত্রাঙ্কন করা হয়ে থাকে। গুহার মত এগুলোও মানুষ বিভিন্ন সময়ে বসবাস করতে ব্যবহার করেছে।

বর্ণনা

আমার মনে হয় ভীমবেটকার, “এখান থেকে আমরা বাঁ দিকে মোড় নিয়ে ঠিক সামনেই দেখলাম,” এই ধরনের বর্ণনা না করে আলাদা আলাদা ভাবে প্রধান শৈলাশ্রয়গুলির বর্ণনা করলে বিষয়টা বেশি মনোগ্রাহী হবে। আমি সেই পথেই এগোই। তাছাড়া এই রকম বর্ণনা করার আরও এক কারণ আছে। এখানে ৭০০টিরও বেশি শৈলাশ্রয় পাওয়া গেছে। তার মধ্যে প্রায় ৫০০টিতে চিত্রাঙ্কন আছে। আমাদের মত সাধারণ দর্শনার্থীদের পক্ষে সবগুলো দেখা সম্ভব নয় এবং প্রয়োজনও নেই। অনেকগুলিতেই প্রায় একই রকম চিত্রণ। তাই কয়েকটি বিশেষ শৈলাশ্রয়ের বর্ণনা করলেই ভীমবেটকার বৈশিষ্ট্য বুঝতে পারা যায়।

একটি শৈলাশ্রয়ের দেয়ালের চিত্রণগুলোর সমষ্টিকে “শৈল চিড়িয়াখানা” বা Zoo Rock বলা হয়ে থাকে। এর কারণ এখানে হাতি, সম্বর ও চিতল হরিণ আর বাইসনের চিত্রণ আছে। ময়ূর, সাপ, হরিণ আর সূর্যের চিত্রণ পাওয়া যায়  আর একটি শৈলাশ্রয়ে এবং আর একটিতে দুটি দাঁতাল হাতির। আদিম মানবের খাদ্য সংগ্রহের জন্য শিকারের অপরূপ বর্ণনা  একটি শৈলাশ্রয়ের বিষয় হয়েছে। এটাতে তির-ধনুক ও ঢাল-তরোয়াল নিয়ে শিকারের চিত্রণ স্থান পেয়েছে। শিকার যে অনেক সময়ই বিপদের সম্ভাবনা নিয়ে আসে, তাও আমরা আদি মানবের অভিজ্ঞতা থেকে লক্ষ্য করতে পারি একটি শৈলাশ্রয়ের চিত্রণ থেকে। দুই শিকারি তাদের এক সহ-শিকারির বাইসনের তাড়ার মুখে পড়ায় কি রকম ভাবে অসহায় দর্শকে পরিণত হতে হয়েছে, তার বর্ণনা দেখে বিস্ময়াভূত হতে হয় আমাদের। তীরন্দাজ সহ অশ্বারোহী মানুষের চিত্রণ দেখতে পাওয়া যায় একটি শৈলাশ্রয়ে। যে হেতু অশ্বের আগমন ভারতীয় উপমহাদেশে খুব একটা প্রাচীন নয়, তাই বোঝা যায় যে কিছু চিত্রণ প্রাগৈতিহাসিক যুগের নয়। এর সঙ্গে এও ধারণা করা যায় যে ভীমবেটকায় চিত্রায়ন ক্রমান্বয়ে বিভিন্ন যুগে হয়েছিল।
এই পরিপ্রেক্ষিতে ভীমবেটকার এবং সামগ্রিক রূপে প্রাগৈতিহাসিক শৈল-চিত্রণের ক্রম বিকাশ নিয়ে আলোচনা করার প্রয়োজন এসে পড়ে। তবে এই আলোচনা আপাতত মুলতুবি রেখে এখানকার শৈল-চিত্রণের সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য আপনাদের সামনে উপস্থিত করছি।

অনেক বৈজ্ঞানিক মনে করেন যে ভীমবেটকায় এই শৈলাশ্রয়গুলো কোনও কালে সাবেকি গুহা রূপে জলের তলায় ছিল। কালক্রমে জলতল নিচে নেমে যাবার কারণে এগুলো ভূস্তরের উপরে চলে এসেছে। এই ধারণার কারণ হলো যে এই শৈলাশ্রয়গুলোর পাথরের গা অতি মসৃণ এবং বিভিন্ন রং ও চেহারার।

চিত্রণের সাহায্যে গুহা মানবের জীবন যাত্রা সম্পর্কে যা যা পাওয়া যাবার কথা তা ছাড়া মানব সভ্যতার পর্যায়ক্রমের সম্পর্কেও অনেক কিছুর সাক্ষ্য প্রমাণ এইগুলো থেকে পাওয়া যায়। একই স্থানে বিভিন্ন কালের চিত্রণ পাওয়া যায়। এর থেকে বিচার করা যায় যে এই শৈলাশ্রয়গুলো বিভিন্ন সময়কালের মানব বা মানবগোষ্ঠী ব্যবহার করেছিলেন।

Zoo Rock-এর কথা আগেই বলা হয়েছে। এ ছাড়া আরও কিছু শৈলাশ্রয়ে অন্যান্য পশুদের চিত্রণও পাওয়া যায়, যেমন সিংহ, বাঘ, বরাহ, কুকুর, গিরগিটি, কুমির ইত্যাদির। একটি শৈলাশ্রয়ে দুই য়্যান্টিলোপের মধ্যে লড়ায়ের চিত্রণ খুবই চিত্তাকর্ষক। মুকুট পরিহিত সম্ভবত কোনও গোষ্ঠী-অধিপতির অশ্বারূঢ় চিত্রণ এবং পিছনে অস্ত্রসজ্জিত মানুষের মিছিল কোনও আনুষ্ঠানিক বর্ণনা বলে মনে হয়। এই গুহাচিত্রনগুলোয় প্রধানত লাল ও সাদা রং ব্যবহার করা হয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সবুজ ও হলদের ব্যবহারও লক্ষ্য করা যায়। চিত্রণগুলোর রং এখনও বেশ উজ্জ্বল রয়েছে। প্রকৃতিতে পাওয়া বস্তু, যেমন বিভিন্ন গাছ পালা, ফুল, পাতা, মাটি এবং পশুচর্বি থেকে রং উৎপাদন করে চিত্রণ করা হয়েছে তন্তুময় গাছ থেকে তৈরি তুলির সাহায্যে। তা ছাড়া শৈলাশ্রয়ের ভিতরে যেখানে সূর্য রশ্মি পৌঁছাতে পারে না সেই সেই জায়গাগুলো চিত্রণের জন্যে পছন্দ করা হয়েছে রঙের ঔজ্জ্বল্য সেই কারণেও স্থায়ী রয়েছে। আরও এক কারণ এই স্থায়িত্ব রক্ষার সহায়ক হয়েছে। এই জায়গার পাথরে উপস্থিত রাসায়নিক পদার্থ জৈব রঙে উপস্থিত পদার্থের জারণ করে স্থায়ী করে দিয়েছে।

পরবর্তী আলোচনার আগে এখানকার চলচ্চিত্রায়নগুলো দেখে নেওয়া যেতে পারে,

;


শৈল-চিত্রণের প্রকারভেদ

এখানকার শৈলচিত্রণগুলোর বয়স সম্পর্কে কিছু বলবার আগে দুটি বিষয়ে কিছু জানা দরকার। রং ব্যবহার করে যে চিত্রণ পাথরের দেয়ালে প্রধানত প্রাগৈতিহাসিক যুগে মানুষ করেছিল সেগুলো আমরা শৈলচিত্র আখ্যা দিয়েছি, ইংরাজিতে অবশ্য বেশির ভাগ সময়ে Cave paintings না বলে শুধুমাত্র Paintings বলা হয়ে থাকে। এই প্রকারের চিত্রণ ছাড়া আরও একপ্রকার চিত্রণ প্রাগৈতিহাসিক যুগে অনেক গুহা বা শৈলাশ্রয়ে মানুষ করেছে যেগুলোকে ইংরাজিতে Petroglyph বলা হয়েছে। এই শব্দটি দুটি গ্রীক শব্দের সন্ধির ফল। Petros আর Glyphein। Petros অর্থাৎ Rock আর Glyphein হলো Carve। তাহলে ইংরাজিতে হলো Rock Carving। বাংলায় এর কোনও প্রতিশব্দ আমার জানা নেই, তবে আমি প্রতিশব্দটি ‘শৈলকোরণ’ বলছি। পাথর কোরা। এই তথ্যটি হলো প্রথম জ্ঞাতব্য।

দ্বিতীয়টি হলো যে এই কোরণ করতে গেলে বিশেষ যন্ত্রের প্রয়োজন হয়, যা তখনকার মানুষ পাথর বা হাড় থেকে এগুলোর বিশেষ আকার দিয়ে তৈরি করে নিয়েছিলেন। সভ্যতার ইতিহাসে যে সময় মানুষ পাথর বা হাড়ের সাহায্যে এই রকম যন্ত্র তৈরি করতে শিখেছিলেন, সেই যুগ ‘প্রস্তর যুগ’ (Stone Age বা Palaeolithic) নামে বিখ্যাত। Palaeolithic শব্দটিও দুটি গ্রীক শব্দ, Palaios অর্থাৎ Old আর Lithos, অর্থাৎ Stone-এর সন্ধি করে হয়েছে। প্রস্তর যুগ আনুমানিক খৃষ্টপূর্ব ২৭ লক্ষ বছর থেকে খৃষ্টপূর্ব ৪,০০০ বছরের মধ্যের সময়কে বলা হয়। মানুষের সভ্যতার ইতিহাসে এই যুগ প্রায় ৯৯% সময় নিয়ে আছে। অবশ্য এই যুগের বিস্তার, অর্থাৎ আরম্ভ ও শেষ বিভিন্ন মহাদেশ ও অঞ্চলে বিভিন্ন সময়ে হয়েছিল। কালের এত বেশি বিস্তারের কারণে একে আবার তিনটি ভাগে ভাগ করেছেন ১৮৬৫ খৃষ্টাব্দে “Pre-historic Times” নামে বইয়ে John Lubbock। এই তিনটি ভাগ Palaeolithic, Mesolithic ও Neolithic নামে অভিহিত। এই ভাগ বৈজ্ঞানিকরা এখনও মেনে চলেছেন।
যদিও প্রধানত পাথরের তৈরি যন্ত্র, যেমন কুঠার, হাতুড়ি, ইত্যাদির ব্যবহার হতো, তাহলেও সামাজিক চরিত্র, খাদ্য সংগ্রহের প্রকার, বসবাস করার ব্যবস্থা, ইত্যাদির ক্রমবিকাশের উপর নির্ভর করে প্যালিওলিথিক সময়কালকেও আবার তিনটি অংশে বিভাজিত করা হয়েছে। Lower, Middle, আর Upper Palaeolithic। Palaeolithic সময়কালের মত এই বিভাজনেরও এক থেকে অন্যের মধ্যে পরিবর্তনের নিশ্চিত সময় সীমা নির্ধারণ করা যায় না।
Lower Palaeolithic যুগ প্রায় খৃষ্টপূর্ব ১৫ লক্ষ পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল অনুমান করা হয় এবং তার পর প্রায় খৃষ্টপূর্ব ২৪ হাজার বছর পর্যন্ত Middle Palaeolithic কাল বলা হয়ে থাকে। এই সময়কালের শেষের দিকে নিশ্চিতরূপেই Neanderthals মানব তার আদিম রূপ পরিত্যাগ করে আধুনিক মানব, Homo sapiens sapiens রূপ পরিগ্রহণ করে। এই সময়েই ক্রমশ মানুষ তার শিল্পী সত্তা প্রকাশ করা আরম্ভ করে। এই সময়কার বেশ কিছু শৈলচিত্রণ বিভিন্ন শৈলাশ্রয়ে পাওয়া গেছে। তবে অধিকাংশ শৈলচিত্রণ, ঠিক যে Painting বলা যায়, তা নয়। এগুলির নামই Petroglyph বা যার আমি বাংলায় নামকরণ করেছি ‘শৈলকোরণ।’ এই শৈলকোরণ প্রায় সমস্ত দেশেই প্রধানত একই প্রকারের হয়েছিল। এক প্রকার হবার কোনও কারণ নিয়ে আলোচনা কোনও বৈজ্ঞানিক করেছেন কি না, আমার জানা নেই। এগুলো কেমন দেখতে? খোদাই করার পাথরের যন্ত্র দিয়ে পাথরের গায়ে গোলাকার ছোট ছোট গর্ত অথবা লম্বা আঁকা-বাঁকা রেখা। আমার মনে হয় আমাদের পূর্বপুরুষ, এমনটি করাই সবথেকে সহজ আর স্বাভাবিক মনে করেছিলেন বলেই সমস্ত ক্ষেত্রেই এই শিল্প-কর্মই করেছেন। কিছু বৈজ্ঞানিক এই গর্তগুলোর সঙ্গে ধর্মীয় সম্পর্কের কথা বলেছেন। তবে তা যদি ঠিক হয় তাহলে সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগে সারা পৃথিবীতে, যেখানে যেখানে মানুষের উপস্থিতি ছিল, তাঁরা একই ধর্ম মানতেন। অবশ্য, আমাদের জানা যে ধারণা ধর্ম সম্পর্কে আছে, তার সঙ্গে এই ধর্মকে মিলিয়ে ফেলা নিশ্চয় উচিত হবে না। অনেকে ভাবতে পারেন যে পাথরে এমন গর্ত প্রাকৃতিক কারণেই হয়ে থাকতে পারে। বৈজ্ঞানিকরা তাই সেই সন্দেহ নিরসন করার জন্যে গর্তগুলোর আধুনিক বিজ্ঞানের সাহায্য নিয়ে পরীক্ষা করেছেন। গর্ত প্রাকৃতিক না কৃত্রিম, অর্থাৎ মানুষের কীর্তি, তা তাঁরা তার পরেই নির্দিষ্ট করেছেন।

আর এক প্রকারের শৈলচিত্রণের কথা যা আগে বলা হয়েছে, যেগুলোর সাধারণ নাম Petroglyph বা শৈলকোরণ, তা এই গর্তগুলোকে বোঝাচ্ছে। এগুলোর এক বিশেষ নাম করণ করা হয়েছে, Cupule। মনে হয় উদ্ভিদবিদ্যা থেকে শব্দটি সংগ্রহ। উদ্ভিদবিদ্যায় ফুলের গোড়ায় যে পেয়ালাকৃতি ছোট বৃন্ত (বৃতি) ফুল ধরে রাখে সেটিকে Cupule বলা হয়। শৈলকোরণগুলোও প্রায় সেই ধরনেরই হয়ে থাকে।

এইবার আমরা আবার ভীমবেটকায় ফিরে আসি। ১৯৯০ সালে Bednarik নামে এক বিখ্যাত অস্ট্রেলিয়ান ঐতিহাসিক আরো কয়েকজন ঐতিহাসিকের, যেমন কুমার, ত্যাগী ইত্যাদিদের সঙ্গে ওয়াকাঙ্কারের আবিষ্কৃত ভীমবেটকার এক শৈলাশ্রয়ে বেশ কয়েকটি Cupule খুঁজে পান। শৈলাশ্রয়টির আকার এখানকার অন্যান্য শৈলাশ্রয় থেকে অনেক বড়। প্রায় ২৫মি. দৈর্ঘ্যের এক সুড়ঙ্গাকার পথের প্রান্তে বিরাট এক ঘর। মনে হয় যেন কোনও বড় ও প্রধান মন্দিরের নাটমঞ্চ। তাই এর নাম দেওয়া হয়েছে Cathedral Cave। এই ঘরের তিন দিক খোলা। এটিই শৈলাশ্রয়। এই ঘরের একেবারে মাঝখানে বেশ বড় আকারের (২.৫মি. উচ্চতা আর ৩.৪মি. চওড়া) এক কোয়ার্টজাইট পাথর। এই পাথরটি Chief’s Rock বলা হয়। এই পাথরের গায়ে নয়টি Cupule পাওয়া গেছে। আরও পাওয়া গেছে পাথরটিতে লাল রং। পাথরটি কোয়র্টজাইট, তাই রং লালচে হওয়া অস্বাভাবিক নয়, তবে এই রং পিগমেন্টের, অর্থাৎ কোনও রঞ্জক পদার্থ দিয়ে এই রং করা হয়েছে। ওয়াকাঙ্কারের আবিষ্কৃত আর একটি শৈলাশ্রয়েও একটি Cupule আর সঙ্গে একই প্রকারে করা আঁকা-বাঁকা রেখা পাওয়া গেছে।   

Cupule গুলোর খোদাই তা হলে কত বছর আগে হয়েছিল? প্রধানত Bednarik-এর পরীক্ষালব্ধ ফল হল যে এগুলো নাকি খ্রিষ্টপূর্ব অন্তত ২৯ লক্ষ বছর আগেকার মানুষের কীর্তি। ওনার বক্তব্য যে এগুলোর সৃষ্টি নাকি খ্রিষ্টপূর্ব ৭০ লক্ষ বছর আগে হওয়াও বিচিত্র নয়। তাহলে Bednarik –এর মতে প্রস্তর যুগ তাহলে অন্তত খ্রিষ্টপূর্ব ৭০ লক্ষ বছর আগে থেকেই আরম্ভ হয়েছিল, খ্রিষ্টপূর্ব ২৭ লক্ষ বছর আগে নয়*। ভীমবেটকার Cupule-গুলোকে পরবর্তী উদাহরণ, দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ টাউন থেকে প্রায় ৩০০কিমি. দূরে ভারত মহাসাগরের তীরে Blombos Art Cave থেকে চারগুণ বেশি বয়সের বলে নির্দিষ্ট করে। ব্লোম্বোসের Cupule-গুলো প্রধানত জ্যামিতিক নকশার আকারে খোদিত। দক্ষিণ-পশ্চিম ফ্রান্সের ডোরডোগ্নেতে La Ferrassie গুহায় Cupule-গুলো অবশ্য অনেকটা ভীমবেটকার Cupule-র মতই। এগুলোর খোদাই কাল সম্ভবত মাত্র খ্রিষ্টপূর্ব ৩০ হাজার বছর আগের।

পাঠকের মনে থাকতে পারে যে আমি এর আগে ভীমবেটকার শৈলচিত্রণের কালক্রম সম্পর্কে বলতে গিয়ে পরবর্তী সময়ে আলোচনা হবে বলেছিলাম। সেই কালক্রম সম্পর্কে বলার জন্যে আমাদের ভিত গড়া হয়ে গিয়েছে আগের আলোচনা করার সুবাদে।
ভীমবেটকার শৈলচিত্রণ ও শৈলকোরণগুলো্র যথাযথ পরীক্ষা করে বৈজ্ঞানিকরা মোটামুটিভাবে নিশ্চিত হয়েছেন যে এই শিল্পগুলো অন্তত মধ্য প্যালিওলিথিক কাল থেকে একেবারে ঐতিহাসিক যুগ পর্যন্ত ধারাবাহিকতা রক্ষা করে এসেছে। এর মধ্যে কোরণ গুলো এই কালক্রমের প্রথম দিকে আর প্রাচীনতম চিত্রণগুলো মধ্য ও উচ্চ প্যালিওলিথিক কালের মাঝামাঝি সময়ের। কালক্রম বোঝবার জন্যে নিম্নলিখিত সারণিটি বেশ কাজের।

সময়- কাল

কালের নাম

শিল্পের প্রকার

প্রাচীনতম
উদাহরণ (খ্রি.পূ.)

নিম্ন প্যালিওলিথিক

Cupule এবং আঁকা-বাঁকা রেখা (Meandering line)

অন্তত ২৯ লক্ষ বছর

মধ্য ও উচ্চ প্যালিওলিথিক

বিরাটাকার পশুদের রৈখিক চিত্রণ, যেমন, বাইসন, গণ্ডার, বাঘ    ইত্যাদি। গাড় লাল আর সবুজের ব্যবহার।

প্রায় ৩০ হাজার বছর।

মেসোলিথিক

তুলনায় ছোট চিত্রণ। তবে কিছু রৈখিক অলঙ্করণ আছে। পশুদের চিত্রণ ছাড়াও পাখি ও মানুষের উপস্থিতি ও শিকারের দৃশ্য আছে। তির-ধনুক, বর্শা ইত্যাদির ব্যবহার দেখানো হয়েছে। নৃত্য, মা ও শিশু, কবরের ইত্যাদি সামাজিক ক্রিয়া-কলাপের চিত্রণ আছে।

প্রায় ২০ হাজার বছর।

চাল্কোলিথিক

শৈলাশ্রয়ের মানুষদের সঙ্গে নিকটবর্তী কৃষিজীবী মানুষদের সম্পর্ক স্থাপন হয়েছিল তার প্রমাণ এই সময়ের চিত্রণে প্রকাশ পেয়েছে।

১০ হাজার বছরের মধ্যে।

প্রাচীন ঐতিহাসিক যুগ

প্রধানত লাল, হলদে ও সাদায় চিত্রণ এবং সেগুলি পরিকল্পিত ও আলঙ্কারিক। ধার্মিক চিহ্ন, যক্ষ, বৃক্ষ-রূপি ভগবান, আকাশযান ইত্যাদির চিত্রণ দেখা যায়।

প্রায় ২/৩ হাজার বছর।

মধ্যযুগ

অধিক পরিকল্পিত আর জ্যামিতিক তবে সুন্দর নয়। কাঠকয়লা, ম্যাঙ্গানিজ ও নরম লাল পাথর ব্যবহার করা হয়েছে রং করার জন্যে।

ভারতের ইতিহাসে অষ্টম থেকে ষোড়শ শতক


আবার ভ্রমণ

শৈলাশ্রয়গুলো ঘুরতে ঘুরতে সুজিতের ওঃ-এর কথা তো আগেই বলেছি। প্রদীপবাবু নাটক করেন, তাই নিজের মনের অবস্থা নাটকীয় ভাবেই বোঝাচ্ছিলেন। এক নিচু ছাদের শৈলাশ্রয়ের মেঝেতে ধুলার ওপরেই বসে পড়ে উদাস ভাবে বলতে লাগল, ‘এখানেই আমার পূর্বপুরুষ রোজ বসে থাকতেন, আর ওইখানে বসে তাঁর স্ত্রীর দেওয়া খাবার খেতেন।‘ আমি যতই বলি যে তখনকার সমাজ ব্যবস্থা এখনকার মত ছিলনা, আর তখন রান্না করার জন্যে স্ত্রীর প্রয়োজনের কথা বা স্ত্রী বলে কোনও পারিবারিক সম্পর্ক থাকার ব্যাপার আমরা জানি না। প্রদীপ বাবু শুনতেই পাচ্ছিলেন না। তার পর ক্যাথিড্রাল গুহায় ঠাণ্ডা আর মসৃণ কোয়ার্টজজাইট দেয়াল জড়িয়ে ধরে তাঁর সে কি উচ্ছ্বাস।

যাই হোক শেষে আমরা ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট-এর ঘেরা জায়গা থেকে বেরিয়ে এলাম। বাঁদিকে আমাদের গাড়ি নিয়ে ড্রাইভার আজিম অপেক্ষা করছে। ডান দিকে তাকিয়ে কিছুটা দূরে কিছু মানুষের উপস্থিতি দেখিয়ে আজিম আমাদের ওদিকে ঘুরে আসতে বলল। এগিয়ে গিয়ে আমরা দেখলাম যে বেশ উঁচু এক গুহা। সামনেটা মন্দিরের মত সাজানো। ভিতরে ছোট এবং নতুন তৈরি মন্দিরের মধ্যে বেশ বড় শিবলিঙ্গ রয়েছে এবং সঙ্গে সুন্দর এক শিবের মূর্তি। জটাজূটধারী এক যুবক ব্রহ্মচারী আমাদের আহ্বান করলেন। বেশ কিছুক্ষণ আমাদের এই গুহার ইতিহাস শোনালেন। মধ্যম পাণ্ডব ভীম এখানে তাঁর অজ্ঞাতবাস কালে তপস্যা করেছিলেন এবং পরবর্তী সময় হস্তিনাপুরের রাজা যুধিষ্ঠিরের প্রতিনিধি হিসাবে অশ্বমেধের ঘোড়া নিয়ে এই গুহায় এসে অধিষ্ঠান করেছিলেন। স্থানীয় রাজা ভীমের অজ্ঞাতবাস কালেই তাঁকে চিনতে পেরেছিলেন কিন্তু তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাবশত কাউকে তা জানতে দেননি। এবার মহাবলী ভীমের বশ্যতা স্বীকার করে এই স্থান ভেট হিসাবে সমর্পণ করেন। ভীম যেহেতু এখানে বাস বা বসেছিলেন, তার থেকে স্থানের নাম ভীম-বৈঠকা এবং পরে ভীমবেটকা নামে পরিচিত হয়।

এর পরেই আমরা ভীমবেটকা দর্শন সাঙ্গ করে ফেরার পথ ধরি। এই অংশের চলচ্চিত্রায়ন আপনারা “Bhimbetka 4” –এতে দেখতে পাবেন।

২। ভানপুরা

প্রকৃতি মধ্য প্রদেশকে অফুরন্ত সম্পদ দান করেছে। ভীমবেটকার মতই এই ভানপুরাতেও শৈলচিত্রণ আর শৈলকোরণ পাওয়া গেছে। তবে হয়ত যাতায়াতের কিছুটা অসুবিধার জন্যে সাধারণ মানুষের কাছে সেরকম পরিচিতি পায়নি। কাছাকাছি কোনও দর্শনীয় জায়গার অভাবও মনে হয় একে পরিচিত হতে দেয়নি।
মধ্য প্রদেশের একেবারে শেষ প্রান্ত, পশ্চিম-উত্তরে মান্ডসাউর জেলার মান্ডসাউর শহরের ১২৭ কিমি. উত্তর-পূর্বে ভানপুরার অবস্থান।

ভানপুরা থেকে প্রায় ৩৫ কিমি. এবং গান্ধি-সাগর বাঁধ থেকে প্রায় ২০কিমি. দূরে ভানপুরার Rock Art Gallery-র অবস্থান। এই শৈলাশ্রয়গুলোয় প্রায় নিরবচ্ছিন্নভাবে ১২ কিমি. দীর্ঘ শৈলচিত্রণ রয়েছে এবং সেই কারণে একে কেবল মাত্র Rock Shelter না বলে Rock Art Gallery বলা হয়। বিশ্বের দীর্ঘতম  এই শৈলাশ্রয়শ্রেণী চতুর্ভুজনাথ নালা শৈলাশ্রয় নামে পরিচিত। শৈলাশ্রয়গুলোকে দুভাগ করে চতুর্ভুজনাথ নালার পথ বলেই এই নামকরণ।

ভীমবেটকা আর এই শৈলাশ্রয়ের গঠনে বেশ পার্থক্য আছে, এখানকারগুলো উচ্চতায় বেশ কম, প্রমাণ আকারের মানুষ দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না এগুলোর মধ্যে। এমনকি, অনেক স্থানে চিত্রণ দেখতে গেলে শুয়ে পড়ে দেখতে হয়।

এই চিত্রণগুলোর আবিষ্কার, ভীমবেটকার মত বিশেষ মানুষ দ্বারা বিশেষ তারিখে আবিষ্কৃত নয়। সম্ভবত সেই কারণে এটি যে বিশ্বে দীর্ঘতম, তা Rock Art Society of India মাত্র ২০০৭ সালে ঘোষণা করেছে। প্রথম দিকের চিত্রগুলো প্রধানত পশুদের। পশুদের বিভিন্নতা প্রচুর, যেমন, নিলগাই, গণ্ডার, ভল্লুক, নেকড়ে, হাতি, বানর, বাইসন, শেয়াল, উঠ, ঘোড়া। তবে সিংহের চিত্রণ না থাকার কারণ আশ্চর্যের কথা কেননা কাছেই এই আধুনিক কালেও সিংহ পাওয়া যায়। ষাঁড় ও গরুর চিত্রণও পাওয়া যায়, অর্থাৎ তত দিনে পশুপালন নিশ্চয় আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল। জলচর জীবের সংখ্যাও চিত্রণে কম নেই, যেমন, কুমির, কচ্ছপ। বেশ কিছু পাখির চিত্রণও রয়েছে। মানুষের, এবং কেবলমাত্র পুরুষের চিত্রণই রয়েছে ও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তা রেখা দিয়েই করা হয়েছে। অনেকক্ষেত্রেই দুটি বিপরীত ত্রিভুজের সাহায্যে ও আরও কয়েকটি রেখা দিয়েই মানুষ বোঝানো হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে পোশাক পরিহিত মানুষও দেখানো হয়েছে। চিত্রণে প্রায় সব সময়েই লাল রং ব্যবহার হয়েছে, অবশ্য অল্প ক্ষেত্রে সাদা ও হলদের ব্যবহারও লক্ষ্য করা যায়।

ভীমবেটকার মত এখানকার শৈলচিত্রণের বয়স নির্ণয় করায় খুব একটা বৈজ্ঞানিক পরিচেষ্টা করার কথা জানা নেই। কিন্তু কাছেই আর একটি বিরাট আবিষ্কারের ব্যাপারে, যদিও এখনোও অসম্পূর্ণ, তাহলেও আশ্চর্যজনক ফল পাওয়া গেছে। ভানপুরার কাছেই, ইন্দ্রগড় পাহাড়ে ‘দারা-কি-চট্টান’ নামের এক ছোট, সরু অথচ গভীর গুহায় শৈলকোরণ আবিষ্কৃত হয়েছে মাত্র ২০০২ সালে। দয়ালবাগ এডুকেশনাল ইনস্টিটিউট, আগরার ড. গিরিরাজ কুমার, ভারতীয় সর্বেক্ষণ বিভাগের সাহায্যে এই আবিষ্কার করেছেন। বেডনারিক এবং আরও কয়েকজন ঐতিহাসিকের সাহায্যে পরীক্ষা করে প্রাথমিক ভাবে এই কোরণগুলোর সৃষ্টি ৪০ লক্ষ থেকে ১৮০ লক্ষ বছরের বলে ধারণা করা হয়েছে*

সম্প্রতি এই সবকটা শেল্টার বা শৈলাশ্রয় সম্পর্কে সুদীর্ঘ, সচিত্র ও অত্যন্ত সুখপাঠ্য ইংরাজি এক Blog (http://www.beyondlust.in/2013/05/13/the-untold-story-of-mp-bhanpura-chaturbhuj-nala-and-hingalgarh)-এ পড়লাম, আপনাদের এর link জানাবার লোভ সামলাতে পারলাম না।

মধ্য প্রদেশের এই দুটি শৈলাশ্রয় শ্রেণী ছাড়াও আরও বেশ কিছু শৈলাশ্রয়ের সন্ধান পাওয়া গেছে। যেমন রাজধানী ভোপালের কাছেই এঙ্গাভান নামে এক গ্রামে ওই নামের এক পাহাড়ের এক গুহায়। তবে এই দুটির মত এত বেশি শৈলচিত্রণ এই সমস্ত শৈলাশ্রয়গুলোতে পাওয়া যায়নি। সেই কারণেই সেইগুলোর সঙ্গে আমাদের পরিচয় তেমন ভাবে হয়নি। স্থানীয় ভাবে মুষ্টিমেয় বৈজ্ঞানিক ও ঐতিহাসিকগনের কাছেই সেই জায়গার সন্ধান নিবদ্ধ হয়ে আছে।

       ৩। বিহারের (ও ঝাড়খণ্ডের) শৈলচিত্রণ

এই রাজ্যগুলোয় প্রাগৈতিহাসিক যুগের শৈলচিত্রণ যা পাওয়া গেছে, তেমন ভাবে বিখ্যাত হয়ে উঠতে পারেনি। তাই বিশেষ বিশেষ স্থানের আলাদা করে বর্ণনা না করে সাধারণভাবে প্রায় সবকটির বর্ণনা একসঙ্গে করছি।

বিহারে ১৯৭১ সালে সর্বপ্রথম ড. রাকেশ তিওয়ারি গারওয়া জেলায় শৈলচিত্রণ আবিষ্কার করেছিলেন। এর পর হাজারিবাগ, নওয়াদা, কোডরমা, গিরিডি, জামুই, ভবনাথপুর এবং সতীপাহাড়িতে চিত্রণ আবিষ্কৃত হয়।
কৈমুর পাহাড়ের একেবারে শীর্ষের কাছে একটি বেস বড় গুহায় বেশ কিছু চিত্রণ দেখা গেছে। এই গুহায় একসঙ্গে প্রায় ২০০ মানুষ বসতে পারে। গুহার ভিতর দিয়ে এক জলধারা বয়ে যাচ্ছে। এই জলধারা থেকে প্রস্তর যুগের কিছু যন্ত্রাদি পাওয়া গেছে। অল্প দূরেই একটি ছোট গুহা আছে। এই গুহার পাশ দিয়েই আর একটি জলধারা বয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে থাকেও কিছু যন্ত্র পাওয়া গেছে। দুটি গুহাই শৈলাশ্রয় হিসাবে আদি মানবরা বিভিন্ন সময়ে ব্যবহার করার প্রমাণ পাওয়া গেছে। স্বাভাবিক ভাবেই শৈলচিত্রণও রয়েছে। দুই হাত তোলা মানুষের চিত্রণ, শিকারের দৃশ্যায়ন, এক মানুষের কাঁধে করে মারা পশু বহন করা, গাছের সারি, যা দেখলে জঙ্গলের প্রতিরূপ বলে মনে হয়, সূর্য, চন্দ্র, বিভিন্ন প্রকারের পাখি ইত্যাদির চিত্রণ বেশ সুন্দর। পশুদের চিত্রণও স্থান পেয়েছে, যেমন মহিষ, বাঘ, হরিণ ইত্যাদি। শাক-সবজির চিত্রণ বেশ কিছু এখানে দেখা যায়।

সতী পাহাড়িতে কীট পতঙ্গের চিত্রণ বৈশিষ্ট্যর দাবী রাখে। অদ্ভুত ব্যাপার যে পতঙ্গের দুটি পাখা সমান কখনো দেখানো হয়নি। এখানে মাছধরার চিত্রণও স্থান পেয়েছে।

২০০৯ সালের ২৭ জুন রাজগীরের নব নালান্দা মহাবিদ্যালয়ের দীপক আনন্দ নামে এক যুবক, জানিয়েছেন যে তিনি সেখানকার জঙ্গলে শৈলচিত্রণ আবিষ্কার করেছেন। তাঁর বক্তব্য যে সেখানে হারমিটাইট দিয়ে প্রাগৈতিহাসিক যুগে শৈলচিত্রণ করা হয়েছে। ভারতের সর্বেক্ষণ বিভাগকে তিনি আহ্বান জানিয়েছেন এই জায়গার এক্সকাভেশান করতে। 

*      *      *      *      *      *      *      *      *      *      *      *

       শৈলকোরণ, শৈলচিত্রণের থেকে অনেক বেশি প্রাচীন। এ ছাড়া যেখানে যেখানে শৈলকোরণ পাওয়া গেছে, সেখানেই কোরণ করার পাথরের যন্ত্রাদিও পাওয়া গেছে। ভীমবেটকার যে দুটো জায়গায় এবং দারা-কি-চট্টানের যে জায়গায় শৈলকোরণ পাওয়া গেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে এই রচনায়, সেই স্থানগুলোও এই যন্ত্রাদি পাওয়ার ব্যাপারে ব্যতিক্রম নয়। এই প্রসঙ্গে পুনের এক বিখ্যাত প্যালিওলজিস্ট, ড. ভি. এন. মিশ্রর একটি রচনা থেকে পাওয়া কিছু তথ্যের উল্লেখ করা যেতে পারে। মিশ্রর বক্তব্য যে দক্ষিণ ভারতে বাসাল্ট পাথর, যা ওখানে সহজ লভ্য, প্রস্তর যুগে যন্ত্রাদি তৈরি করার কাজে ব্যবহার হোতো। এই পাথরের স্থায়িত্ব পারিপার্শ্বিক  আবহাওয়ার উপর খুবই নির্ভরশীল এবং জল ও অধিক উষ্ণতায় সহজেই ক্ষয় প্রাপ্ত হয়। দক্ষিণ ভারতে জল ও উষ্ণতার আধিক্য হবার কারণে যে সমস্ত যন্ত্রাদি মাটির তলায় প্রোথিত হতে পারেনি, সেগুলি সবই ক্ষয় প্রাপ্ত হয়ে গেছে। আবার প্রাগৈতিহাসিক কালের ভৌগোলিক পরিস্থিতির কারণে এই সব যন্ত্র মাটির নিচে প্রোথিত খুব একটা হতে পারেনি। এই সমস্ত কারণে মাটির উপরে দক্ষিণ ভারতে প্রস্তর যুগের যন্ত্রাদি প্রায় পাওয়া যায়নি। অথচ উত্তর ভারতে অনেক জায়গাতেই মাটির উপরে সেই প্রকার যন্ত্রাদি পাওয়া গেছে, কারণ এখানে কোয়ার্টজাইট পাথরে সেগুলি তৈরি হোতো। এই পাথরের স্থায়িত্ব অত্যন্ত বেশি।

এই প্রসঙ্গের উল্লেখ করার একটি বিশেষ কারণ আছে।  দক্ষিণ ভারতে শৈলকোরণের এবং অধিক প্রাচীন শৈলচিত্রণের না পাওয়ার কারণ উপরোক্ত তথ্যের মধ্যেই নিহিত আছে। এখানকার পাথর বাসাল্ট। কোরণ বা চিত্রণ যদি হয়েও থাকে আদিম যুগে, এই বাসাল্টের উপরেই হয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই আধারের স্থায়িত্ব কম হবার কারণে তার উপরে করা শিল্পকর্মও সম্ভবত কালের করালে লোপ পেয়ে গেছে।

       ৪। কেরালার শৈলচিত্রণ

দক্ষিণ ভারতে প্রস্তর যুগের যন্ত্রাদি না পাওয়ার কারণ সম্পর্কে যা বলা হয়েছে, তা ছাড়া আরও একটি কারণের কথা অনেকে মনে করে থাকেন যে, কেরালা অঞ্চলে প্যালিওলিথিক যুগে বসবাসকারী মানবের সংখ্যা সম্ভবত বেশ কম ছিল।

যাই হোক, ওখানে যে কটা জায়গায় শৈল-চিত্রণ পাওয়া গেছে, তার মধ্যে কোজিকোড জেলায় ওয়ানান্দের এডাক্কাল গুহার শৈল-চিত্রণ তার বৈশিষ্ট্যর কারণে অদ্বিতীয়। এডাক্কাল গুহা আসলে গুহাই নয়! তবে এর বিশেষ গঠনের কারণে একে গুহা বলা হয়ে থাকে। পাহাড়ের গায়ে লম্বভাবে এক বিরাট ফাটল এবং কোনও কারণে এই ফাটলের মাথাতে আর এক বিরাট পথের পড়ে ছাদের আকার নিয়েছে। এবং স্বাভাবিক ভাবে এ এক গুহার আকার নিয়েছে। এর ভিতরের দেয়ালে বেশ কিছু চিত্রণ রয়েছে যা প্রধানত কোরণ করেই করা হয়েছে। অন্যান্য শৈলাশ্রয়ের মতই মানুষ ও পশুর চিত্রণ তো আছেই আর যা চিত্রণ আছে তার জন্যেই এর বৈশিষ্ট্য, মানুষের কাজে আসে এমন সমস্ত বস্তু ও বিভিন্ন প্রকারের চিহ্ন।

এডাক্কাল গুহা-চিত্রণের সৃষ্টি-কাল অনুমান করা হয়েছে মেসোলিথিক অর্থাৎ খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০০ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ১৭০০ পর্যন্ত। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে যে অজন্তার আবিষ্কারের মতোই এবং কাছাকাছি সময়েই এই গুহার আবিষ্কারের ঘটনার কথা। ১৮৬০ সালে ওই অঞ্চলের পুলিস অধিকর্তা, ফ্রেন্ড ফাও-সেট ওয়ানান্দে শিকার অভিযানে এসে এই গুহা ও শৈল-চিত্রণ খুঁজে পান।

*      *      *      *      *      *      *      *      *      *      *    

 ভারতে আরও অসংখ্য শৈলাশ্রয়ের সন্ধান পাওয়া গেছে এবং তাতে শৈল-চিত্রণও অসংখ্য আছে। বেডনারিকের বক্তব্য, “India’s rock art corpus is absolutely huge. And many more new finds will be made. It will take many more years to record this great wealth.”। তবে এই রচনায় এখনো পর্যন্ত আবিষ্কৃত প্রধান প্রধান শৈলাশ্রয়ের বর্ণনা মোটামুটি করা হয়েছে বলে আমি মনে করি। এই রচনা শেষ করার আগে আমি এই সমস্ত চিত্রণের যে মানে খোঁজা আর তার বর্ণনা করা হয়েছে, সেই বিষয়ে কিছু বক্তব্য আপনাদের সামনে উপস্থিত করছি।

ভীমবেটকার Cupule-গুলোর সম্পর্কে বলার সময় সারা পৃথিবীতে Cupule-গুলোর প্রকার প্রায় একই কেন হয়েছে  এই নিয়ে কিছুটা অমীমাংসিত আলোচনা করেছিলাম। ভারতীয় ও অস্ট্রেলীয় বিশেষজ্ঞ, যথাক্রমে কল্যাণ কুমার চক্রবর্তী ও রবার্ট জি. বেডনারিক তাঁদের রচিত বই, “Indian Rock Art and its Global Context”-এ বলেছেন যে, হাজার হাজার বছর আগেকার কোনও একটি চিত্রণের মানে অর্থাৎ শিল্পী কি বলতে চেয়েছেন তাঁর শিল্পে, তা আমাদের এখনকার ধ্যান-ধারণার ভিত্তিতে ভাবা সিদ্ধান্তের সঙ্গে না মেলার সম্ভাবনাই বেশি। আমরা একটা চিত্রের মর্মার্থ উদ্ধার করার বিষয়ে যে জ্ঞান প্রাপ্ত হয়েছি, তা একান্ত ভাবে আমাদেরই পারিপার্শ্বিক এবং সময়-কাল সীমিত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে। আমরা কখনই  আমাদের সেই সীমিত ধারণা তাঁদের চিত্রের উপর চাপিয়ে দিতে পারি না। কে বলতে পারে যে আমরা যে চিত্রকে প্যাঙ্গোলিনের চিত্র বলছি, তা আসলে তখনকার দিনের কোনও এক বিরাট গিরগিটি জাতীয় প্রাণীর নয়? অথবা যাকে আমরা হরিণ বলছি তা আসলে পাহাড়ি ছাগল? আমাদের সময়কার মতো চিত্রের নামকরণ তখন হতো না, তার কারণ কোন লিপি ব্যবহার আরম্ভ হয়নি, বা লিপির জ্ঞান তখনো মানুষের আয়ত্তে আসেনি। নাকি যে লিপি ব্যবহার হতো তা আমরা ধরতেই পারছি না, বা আমাদের আয়ত্তের বাইরে?

এই পরিপ্রেক্ষিতে Harun Yaha নামে এক তুর্কি দার্শনিকের লেখার উপর ভিত্তি করে রচনা, “Civilization Retreat As Well As Advances”-এর কথা মনে পড়ে গেল। Harun Yaha  ছদ্মনাম, তিনি ১৯৫৬ সালে আদনান ওক্টার নামে টার্কির আঙ্কারায় জন্মেছিলেন। তাঁর কথা অনুযায়ী, মানুষ চিরকালই সভ্য মানুষ হিসাবেই পৃথিবীতে আছে এবং প্রাগৈতিহাসিক বলে কিছু নেই, আমরা এর কোনও কথা মনে রাখতে পারিনি বলেই Lost civilization  বা Uncivilized  বলে থাকি। আপনারা বুঝতেই পারছেন যে এই তত্ত্ব ডারউইনের তত্ত্বের বিপরীত। তিনি বলেছেন যে যদি কোনও কারণে আগ পৃথিবীর সমস্ত কিছু ধ্বংস হয়ে যায় আর হাজার বা লক্ষ-কোটি বছর পর নতুন করে সভ্যতা গড়ে ওঠে, এবং আমাদের সময়কালের কিছু চিহ্ন সেই সভ্য মানুষ পায় তাহলে তারাও মনে করতে পারে যে এই সময়টা প্রস্তর-যুগ ছিল। যাই হোক অদনানের বক্তব্যের যথাযথ উত্তর আমাদের জানা আছে, কিন্তু শৈল-চিত্রণের ব্যাখ্যা হিসাবে এনার বক্তব্য বোধ হয় গ্রাহ্য করা যায়। অবশ্য এই সম্পর্কে ওনার নিজের ব্যাখ্যা আছে কি না আমার জানা নেই।

এক অভূতপূর্ব শৈল-চিত্রণের কথা বলি। তামিলনাডুর কিলভালাই-এ কোয়ার্টজাইট পাথরের এক শৈলাশ্রয়ে বেশ কয়েকটি লালচে রঙের চিত্রণ আছে। যেমন, নৌকা বিহারের দৃশ্য, ঘোড়সওয়ার সৈনিক, অনেকগুলি বিভিন্ন চিহ্ন, যার মধ্যে আমরা যাকে স্বস্তিকা বলে থাকি, তাও আছে। তবে সাধারণ অবস্থায় সেগুলি দেখা যায় না। দেখা যায় যখন পাথর জলে ভিজে যায়। শিল্পী কি তাহলে তাঁর ছবি লুকিয়ে রাখবার চেষ্টা করেছেন, না তাঁর এই বিশেষ পাথরের সম্পর্কে জ্ঞানের প্রদর্শন করেছেন? চিত্রণ কি আজকালকার মতো তখনও প্রদর্শন করা হতো?

*      *      *      *      *      *      *      *      *      *      *

এই রচনার এখানেই সমাপ্ত করা উচিত ছিল। তবে সবকিছুই শেষ করলেও শেষ হয়ে গেল বলা যায় না। তাই আমি আরও একটা তথ্য আপনাদের না জানিয়ে এই রচনা শেষ করতে পারছি না। তথ্যটি মনঃকষ্টের উদ্রেক করবে বলে মনে হয়, এবং তা যদি আপনাদের মধ্যে কোনো একজনের মনেও কষ্ট দেয়, তবেই আমার এই রচনা সার্থক হয়েছে বলে আমি মনে করব।

Outlook ম্যাগাজিনে “Way to Dusty Death” (mcomments.outlookindia.com/story.aspx?sid=4&aid=220377) শীর্ষক এক রচনায় যদিও তামিলনাডুর কিলভালাইএর সম্পর্কে লিখেছেন এস. আনান্দ, তা হলেও উল্লিখিত ব্যাপার সমগ্র ভারতের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। আমি সেই রচনার সারাংশ আপনাদের জ্ঞাতার্থে উল্লেখ করছি।

“যদিও বেশ কিছু শৈলাশ্রয় এবং শৈল-চিত্রণের সম্পর্কে প্রায় ২০ বছর হয়ে গেছে জানা হয়েছে, তাহলেও সেগুলোর সাধারণভাবে সংরক্ষণ বা তার পঞ্জিকরণ ইত্যাদি করা হয়নি। কয়েক জায়গায় কিছু বেড়া দেওয়া হয়েছে তবে চিত্রণের উপরেই রাজনৈতিক দলের চিহ্ন আঁকা হয়েছে। শৈলাশ্রয়ের কয়েক হাত দূরেই ডিনামাইটের সাহায্যে পাথর ফাটিয়ে বিক্রির জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সরকারের নাকি আর্থিক সামর্থ্য নেই এই সমস্ত রক্ষা করার। International Foundation of Rock Art Organization-এর অস্ট্রেলীয় সভাপতি, বেডনারিক-এর বক্তব্য, ‘Bolivia, economically worse off than India, has better rock art protection practices. When India can afford nuclear weapons, lack of resources is a blatant excuse. And there is absolutely nothing elitist about wanting to preserve a nation’s greatest historical asset, its patrimony.’।“

চেন্নাই  Government College of Fine Arts-এর অধ্যাপক, জি. চন্দ্রশেখরণ, ঐতিহাসিক, শিল্পী, স্থপতি ইত্যাদিদের সঙ্গে নিয়ে Roots নামে এক সংগঠন গড়েছেন। এঁরা এই সমস্ত শৈলচিত্রগুলোর নকল তৈরি করছেন। তিনি কিছুদিন আগেই তামিলনাডুর এরোড জেলার কারিক্কিউ-এর কাছে পোরিভারাই-তে ১২০X১৫ বর্গ ফিটের এক শৈল-চিত্রণ আবিষ্কার করেছেন। এখানে বানর, সম্পূর্ণ গাছ, পুরুষাঙ্গ সহ শিং যুক্ত একটি হরিণের সম্পূর্ণ শরীরের এক অপূর্ব সুন্দর চিত্রণ রয়েছে। চন্দ্রশেখর, ওরফে চান্দ্রু লিখছেন, ‘সেই চিত্রণের উপরেই অরণ্য বিভাগ জরিপ করার জন্যে চিহ্ন করেছেন। আর আপনি যখন এই লেখা পড়ছেন, কিলাভালাই-এ সম্ভবত আর একবার পাথর ফাটাবার জন্যে ডিনামাইটের ব্যবহার হলো’।

(* Bednarik- এর নির্ধারিত সময়কাল নিয়ে সংশয় রয়ে যায়, কারণ এখনো অবধি (মার্চ ২০১৫) সবচেয়ে পুরোনো Hominid ফসিল পাওয়া গেছে ইথিওপিয়ায়, যার রেডিও-কার্বন বয়স ২৮ লক্ষ বছর– সম্পাদক)

 

 


লেখক পরিচিতি -শিক্ষাবিদ। পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক ছিলেন বহু বছর। নেশা হচ্ছে ভ্রমণ। অবসর-এর একজন নিয়মিত লেখক। ।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।