সংগীত
সেপ্টেম্বর ১৫ , ২০১৫
‘পূজোর গান’ এর রেকর্ড – তুমি যে গিয়াছ বকুল বিছানো পথে
সোমেন দে
বাঙালীর হয়তো তেমন ব্যবসা বুদ্ধি নেই, ক্ষমতাবান হওয়ার প্রবল আকাঙ্ক্ষা নেই, ধনবান হবার তীব্র উচ্চাশা নেই। তাই জাত হিসেবে অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়েছে, এটা সত্যি। কিন্তু বাঙালীর প্রাণে চিরকাল গান ছিল ভরপুর। দুঃখে শোকে, উৎসবে, বাসনে, জন্ম মৃত্যু বিবাহে, নৌকো বাইতে বাইতে, ধান রুইতে রুইতে, ছাত পেটাতে পেটাতে বাঙালী গান রচনা করেছে,সুর দিয়েছে,গলা খুলে গেয়েছে। সে গান বৈশিষ্ট্যের বিশালতায় পৃথিবীর যে কোনো দেশের গানের ধারা কে লজ্জা দিতে পারে। এ দেশে এসে সাহেবরা বাঙালীর এই গানের খিদের মধ্যে যে একটা ব্যবসায়িক সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে সেটা তারা বুঝে ফেললেন।
১৯০২ সালে এক ইংরেজ বণিক কোলকাতায় এলেন তাঁর গ্রামোফোন এন্ড টাইপরাইটার কোম্পানি লিমিটেডের শাখা খুলতে। তাঁর নাম ছিল - ওয়াটসন হড। হড সাহেব ছিলেন বিচক্ষণ ব্যবসায়ী। তিনি এ দেশে এসেই বুঝলেন যে এ দেশে গান সৃষ্টি হয় প্রচুর, ভালো গায়ক গায়িকা আছে, গান লেখার, গান বাঁধার লোক আছে, কিন্তু গানের সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা নেই। । তিনি বিলেত থেকে ডেকে নিলেন ফ্রেড গেইসবার্গ এক রেকর্ডিংয়ের কারিগরকে। অবশ্য হড সাহেবদের আগেও এ দেশে রেকর্ডিং শুরু হয়েছিল। তা শুরু করেছিলেন থিয়েটারের অমরেন্দ্র দত্ত আর বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বোস। কিন্তু সে রেকর্ডিংএর তারা বাণিজ্যকরণ করেননি। হড সাহেবরা তাই ফাঁকা মাঠ পেয়ে গেলেন। সে কালে শহরের পয়সাওয়ালা বাবুরা গান শুনতে যেতেন হয় কোনো ঘরোয়া আসরে, শ্যামবাজারী থেটারে আর নয়তো জানবাজারের বাইজি বাড়িতে। নিজস্ব জলসাঘরওয়ালা জমিদার না হলে বাবুদের নিজেদের ঘরে বসে ইচ্ছে মত গান শোনার কোনো উপায় ছিল না।
তাঁরা ব্যবসার দৃষ্টি দিয়ে তাক করলেন এই অবস্থাকে। তাঁরা বিলেত থেকে এমন প্রযুক্তি নিয়ে এলেন যা দিয়ে গান গালার চাকতিতে রেকর্ড করে বাবুদের বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া যায়। বাইজী বাড়িতে গিয়ে গান শোনার চেয়ে নিজের বাড়িতে ফরাস পেতে সুগন্ধি তামাক সেবন করতে করতে নিজের সুবিধা ও পছন্দ মত গান শোনাটা বাবুদের নিশ্চয় পছন্দ হবে এই ভেবে তারা ব্যবসায় নামলেন। সম্পন্ন বাঙালী বাবুদের ঘরে ঢুকলো একটি নতুন আসবাব- যার নাম গ্রামোফোন| নতুন গ্রামোফোন কোম্পানির স্লোগান হোলো – ‘সুখী গৃহকোণ – শোভে গ্রামোফোন’। একেবারে জব্বর ক্যাচলাইন।
বাঙালী সুখী গৃহকোণের মাপকাঠি হিসাবে গ্রামোফোনকে সত্যি সত্যিই দেখতে আরম্ভ করলো। ক্রমে তা বড়লোক থেকে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যেও গ্রামোফোনের চাহিদা বাড়তে থাকলো। একবার এক গৃহস্থের ঘরে একটি গ্রামোফোন যন্ত্র ঢুকিয়ে দেওয়া মানেই সে ঘরে ডিস্ক রেকর্ডের স্থায়ী চাহিদা তৈরি করে দেওয়া এটা সাহেবদের বুঝতে অসুবিধা হল না। সুতরাং গ্রামোফোনের সঙ্গে সঙ্গে ডিস্ক সঙ্গীতের চাহিদা ক্রমে বাড়তে লাগলো। এই নতুন পণ্যটি বাঙালীর অবসরযাপনের ধারাকে অনেক খানি পাল্টে দিল। গোড়ার দিকে গান রেকর্ড করার জন্যে যাদের পাওয়া গেল তারা সবাই পেশাদার শিল্পী। সে সময় শহরে গানকে পেশা হিসেবে নেওয়ার ব্যাপারে বেশ কিছু সামাজিক ট্যাবু ছিল। তাই যারা রেকর্ডে গান গাইতে এলেন তারা মূলত বাইজী শ্রেণীর। যেমন গওহর জান, ইন্দুবালা, আঙ্গুরবালা, কৃষ্ণভামিনী ইত্যাদি। যে কোনো সামাজিক ট্যাবু চিরকাল থাকেনা। সময় একটু একটু করে তা ভেঙ্গে দেয়। এ ক্ষেত্রেও তাই হল। গ্রামোফোন কোম্পানি সচেষ্ট হলেন ভদ্র সমাজ থেকে শিল্পী খুঁজে বের করে আনার। এক দুজন করে আসতেও লাগালেন।
কিন্তু প্রাথমিক সংস্কার কাটানোর জন্যে তারা যে পেশাদার নয় সেটা বোঝাবার জন্যে রেকর্ডের লেভেলে তাদের নামের পাশে ব্র্যাকেটে ‘এমেচার’ শব্দটি লিখে দেওয়া হত। হায় বাঙালীর সংস্কার, গানকে পেশা হিসাবে কখনো নিতে নেই মনুসংহিতায় নাকি এ রকম বিধান দেওয়া আছে। তবে মনুর অনেক বিধানের মত এ বিধানটিকেও সময় বাতিল করে দিল। এমন কি অভিজাত পরিবার থেকেও কেউ কেউ এগিয়ে এলেন রেকর্ডে গান গাইবার জন্যে। যেমন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের ভগ্নী অমলা দাশ এলেন ‘মিস দাস (এমেচার )’ নাম নিয়ে। চোঙ্গাওয়ালা গ্রামোফোনে দম দিয়ে কালো চাকতির ডিস্ক গ্রামোফোনে চাপিয়ে ইজি চেয়ারে বসে গান শুনে অবসর বিনোদন বাঙালীর সংস্কৃতিতে ঢুকে পড়লো। গ্রামোফোন কোম্পানির ব্যবসা হু হু করে বাড়তে লাগলো। রেকর্ডে গান আসার ফলে বাঙালী সমাজে তিনটে পরিবর্তন ঘটলো। এক নম্বর, গান, সে যে কোনো ধরনের গানই হোক চণ্ডীমণ্ডপ, থিয়েটার, বাইজীবাড়ি আর জলসাঘর থেকে বাঙালীর অন্দর মহলে প্রবেশ করলো। রেকর্ডের গান শুনতে শুনতে গৃহস্থ বাড়ির মহিলারাও রান্না করতে করতে গুনগুন করে দু কলি গান গাইতে আরম্ভ করলেন।
দু নম্বর হল, গান সঠিক ভাবে সংরক্ষণের একটা উপায় বেরোলো। দীর্ঘ কালের স্মৃতি ও শ্রুতিবাহিত পরম্পরায় গানের যে বিকৃতি ঘটে যেত তা থেকে মুক্তি পাওয়া গেল।
তিন নম্বর হল গানের গুণাগুণ বোঝার একটা মাপকাঠি তৈরি হল। রামপ্রসাদ, ভোলা ময়রা, নিধুবাবু, যদুভট্ট, গোপাল উড়ে এঁরা কেমন গান গাইতেন তা বোঝার কোনো উপায় নেই। কিন্তু গওহর জান থেকে লোপামুদ্রা মিত্রের গানের ডকুমেন্টেশন আমদের কাছে রয়ে যাবে চিরদিন।
সে সময় সাধারণত রেকর্ডের গানগুলি বেরোতো সেপ্টেম্বর অক্টোবর মাসে। হয়তো শারদোৎসবের কথা মাথায় রেখেই। কিন্তু ঠিক ‘পূজোর গান’ বলে কিছু ছিলো না। কোম্পানির মাথায় ফন্দী এলো, এমনিতে গাঁয়ে গঞ্জে তো বাঙালী আগমনী গান গেয়েই থাকে এই সময়টায়, তাই শহরের বাঙালীর উৎসবের মুডের সঙ্গে যদি রেকর্ডের গানটাকে যদি জুড়ে দেওয়া তা হলে বেশ ব্যবসার সম্ভাবনা আছে।
১৯১৪ সালে তারা নেমে পড়লেন ‘পুজোর গান’ এর মার্কেটিং স্ট্রাটেজীতে। সে বছর তারা ১৭টি রেকর্ড বের করে বিজ্ঞাপনে লিখলেন – ‘শারদীয়া পূজা উপলক্ষে’| বিজ্ঞাপনের পোস্টারটি ছিল অভিনব। একটি নবীনা বাঙালিনীদের মত করে সাড়ি পরে নত মস্তকে নম্র নেত্রে দুহাতে পদ্ম ফুল বাড়িয়ে দিয়ে অঞ্জলির ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে আছে এক পুষ্করিণীর ধারে, এক পাশে দেখা যাচ্ছে কাশ ফুল, অন্য পাশে পাহাড়ের ফাঁকে সূর্যোদয় বুঝিয়ে দিচ্ছে সময়টা সকাল বেলা। ইনলেতে লেখা ‘শারদীয়া পূজা উপহার’ September 1914 . নূতন ১০ ইঞ্চি ডবল সাইডেড ভায়োলেট (ধূমল বর্ণ ) – বাঙালা গ্রামোফোন রেকর্ড।’
শিল্পীদের তালিকা এ রকম – মানদাসুন্দরী দাসী, নারায়ণ চন্দ্র মুখার্জী, কে মল্লিক, কৃষ্ণভামিনী, সরলা বাঈ, চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, শশীভূষণ দে, বেদানা দাসী ইত্যাদি। সে বছর শ্রীমতী অমলা দাশ দুটি রবি বাবুর গানও গেয়েছিলেন – হে মোর দেবতা আর প্রতিদিন আমি হে জীবনস্বামী।
এ খান থেকেই ‘পুজোর গান’ শুরু করলো তার যাত্রা।
এর পর আমাদের দুর্গোৎসবের সঙ্গে গ্রামোফোন ডিস্কের গানের একটা অলিখিত আত্মীয়তা গড়ে উঠলো এবং সেটা ক্রমশ গভীর হতে লাগলো। গেরস্ত বাঙালীর পূজোর বাজেটে ধুতি সাড়ি কামিজ সেমিজ ফ্রক স্নো পাউডার আলতা সিঁদুর-এর সঙ্গে পছন্দের শিল্পীদের দু একটা রেকর্ড কেনাও ঢুকে পড়লো।
রেকর্ডের বিক্রি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন গুণী সঙ্গীতশিল্পীরা রেকর্ড করতে আসতে আরম্ভ করলেন। শিল্পীদের গান গেয়ে অর্থ উপার্জনের একটা নূতন রাস্তা খুলে গেল। বিশ শতকের প্রথম দশকে এলেন গওহর জান, লালচাঁদ বড়াল, গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের মত প্রবাদপ্রতিম শিল্পীরা। সেই সঙ্গে এলেন কয়েক জন নূতন শিল্পী, যেমন বিনোদিনী, কুমুদিনী, ভুবনেশ্বরী ইত্যাদি।
উনিশ শতকের দ্বিতীয় দশকের যা ঘটলো সেটাকে বলা যেতে পারে বাংলা গানের জগতের এক রেনেসাঁ। কেন বলছি সেটা নামগুলি শুনলেই বোঝা যাবে কেন এ সময়টাকে নবজাগরণ বলা হয়েছিল - আশ্চর্যময়ী দাসী, এম এন ঘোষ, ইন্দুবালা, কৃষ্ণ চন্দ্র দে, পঙ্কজকুমার মল্লিক, কমলা ঝরিয়া, ধীরেন্দ্রনাথ দাস, দিলীপকুমার রায় প্রমুখ| এরা রেকর্ডের বাংলা গানকে এক ধাপে অনেকটা এগিয়ে নিয়ে গেলেন তাঁদের উচ্চস্তরের সাংগীতিক প্রতিভা দিয়ে।
কৃষ্ণচন্দ্র দে ১৯১৭তে পুজোর গান করলেন ‘মা তার মুখ দেখে কি’। সেকালে সুপার হিট। এ ছাড়া তাঁর কণ্ঠে যে সব পুজোর গান পরবর্তী কালে জনপ্রিয় হয়েছিল সেগুলি : স্বপন দেখিছে রাধারানী, আমি চন্দন হয়ে, সখী লোকে বলে কালো ইত্যাদি।
১৯৩৯ সালে প্রকাশিত কৃষ্ণ চন্দ্র দের গাওয়া পূজোর গান – স্বপন দেখিছে রাধারাণী (গানটি শুনতে চাইলে নীচে ক্লিক করুন)
১৯২২শে আঙ্গুরবালা গাইলেন –কত আশা করে তোমারি দুয়ারে। ১৯২৩শে ইন্দুবালা গাইলেন তুমি এসো হে তুমি এসো হে, ওরে মাঝি।
১৯২৫ সালে দিলীপ কুমার রায় পুজোতে রেকর্ড করলেন - তিনি গাইলেন দুটি গান- ছিল বসি সে কুসুম কাননে, রাঙ্গাজবা কে দিল তোর পায়ে।
১৯২৫ সালে প্রকাশিত দিলীপ কুমার রায়ের গাওয়া পূজোর গান – রাঙ্গা জবা কে দিলো তোর পায় (নীচে ক্লিক করুন)
১৯২৫শে সাহানা দেবী গেয়েছিলেন দুটি অতুল প্রসাদের গান – কত গান তো হল গাওয়া, শুধু দুদিনেরি খেলা।
সম্ভবত কাজি নজরুলের গানের প্রথম রেকর্ডটি বেরোয় ১৯২৫ সালের পুজোয় - হরেন্দ্রনাথ দত্তের কণ্ঠে -, তার পরে নজরুলের গান করেন ইন্দুবালা, ধীরেন্দ্রনাথ দাস, হরিমতি, মৃণালকান্তি দাস,যূথিকা রায়, জ্ঞানেন্দ্রনাথ গোস্বামী প্রমুখ|
কমলা ঝরিয়া ১৯৩০ সালে পুজোতে প্রথম রেকর্ড করলেন –প্রিয় প্রেম ভুলোনা, নিঠুর দয়াবান কেন হানো। ১৯৩১শে ধীরেন্দ্রনাথ দাস গাইলেন সেই বিখ্যাত গান যা আজো গাওয়া হয়ে থাকে – শঙ্খে শঙ্খে মঙ্গল গাও।
১৯৩১ সালে প্রকাশিত ধীরেন্দ্র চন্দ্র দাসের গাওয়া পুজোর গান – আজি শঙ্খে শঙ্খে মঙ্গল গাও (নীচে ক্লিক করুন)
কনক দাস ১৯৩১ সালে দুটি অতুল প্রসাদের গান গাইলেন – কী আর চাহিব বল, তব চরণ তলে সদা রাখিও। তিনি ১৯৩৬শের পুজোতে গেয়েছিলেন দুটি রবীন্দ্রসঙ্গীত – কাছে থেকে দূর রচিল, সে দিন দুজনে।
এতদিন পর্যন্ত বাংলা আধুনিক গান বলে তখনো কোনো গানকে চিহ্নিত করা হয়নি। এই আধুনিক গানের তকমাটি কখন থেকে লাগলো এ নিয়ে কিছু মতভেদ আছে। একটি মত বলছে ১৯৩০ সালে ২৭শে এপ্রিল কলকাতা বেতারে শ্রী হৃদয়রঞ্জন রায় নামক এক গায়কের অনুষ্ঠান প্রচারের সময় আধুনিক গান শব্দটি ব্যবহার করেন। তার কিছুদিন পর থেকেই এই নামটি বাঙালী গ্রহণ করে নেয়। অবশ্য রবি ঠাকুর তার অনেক আগেই ইন্দিরা দেবী লিখিত একটি চিঠিতে তাঁর নিজের গানকে আধুনিক গান বলে উল্লেখ করে ছিলেন।
১৯৩০ সালে বাংলা চলচ্চিত্র সবাক হল| বাংলা সিনেমায় দর্শক মনোরঞ্জনের জন্যে প্রচুর গান ব্যবহার করার প্রয়োজন হল| নতুন সুরকার গীতিকার গায়কদের দরকার হয়ে পড়লো| একটা নতুন দিগন্ত খুলে গেল| ডিস্ক কোম্পানিগুলিরও ব্যবসা বাড়তে লাগলো| একদিকে চলচ্চিত্রের গান অন্যদিকে বেসিক বাংলা গান, দু রকম রেকর্ড বের হতে থাকলো। বেসিক বাংলা গানগুলি বেশির ভাগই আধুনিক গান| ক্রমশ পুজোর সময় প্রকাশিত বেসিক বাংলা গানের সংখ্যা বাড়তে লাগলো| প্রতি মাসে গানের রেকর্ড না বের করে পূজোর সময়েই সব সুরকার গায়করা তাদের শ্রেষ্ঠ গানগুলি প্রকাশ করতে শুরু করলেন। সিনেমায় তখন স্টার প্রথা শুরু হয়নি হয়নি কিন্তু বাংলা গানে অনেক উজ্জ্বল তারকা আলোকিত করলেন বাংলাগানের আকাশ।
চল্লিশের দশক থেকেই শ্রোতাদের কাছে পূজোর গানের জন্য একটা উন্মাদনা তৈরী হওয়ার শুরু হল| পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে এই উন্মাদনা একেবারে তুঙ্গে উঠলো। বাংলা আধুনিক গানের তথাকথিত ‘স্বর্ণযুগ’ শুরু হল পঞ্চাশের দশকে। যেমন সব স্বর্ণ কণ্ঠের গায়ক গায়িকারা এলেন, তেমনি এলেন অসামান্য সুরকাররা আর সেই সঙ্গে এলেন অসাধারণ গুণী গান লিখিয়েরা।
শুধু এই চল্লিশ থেকে ষাট দশকের সময় সীমায় যা সব যুগান্তকারী পুজোর গান বেরিয়েছে তা নিয়ে লেখা এই স্বল্প পরিসরে সম্ভব হবেনা| তাই কয়েকটি মাত্র মাইলস্টোন গানের কথাই উল্লেখ করছি|
১৯৩৭ এ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের আত্মপ্রকাশ ঘটলো – জানিতে যদি গো তুমি আর বল গো বল এই দুটি গান গেয়ে। তার পর যে কী করে বাঙালীর সব ঋতুই হেমন্ত কাল হয়ে উঠল সে এক অন্য ইতিহাস। প্রথমে কিছুটা পঙ্কজ মল্লিক ধাঁচে আরম্ভ করলেও অচিরেই নিজের এক ঋজু, মেঘমন্দ্রিত কণ্ঠের স্বকীয় স্টাইল তৈরি করলেন এবং পঞ্চাশ ষাট ও সত্তর দশক জুড়ে তাঁর গাঁয়ের বধূ, রাণার, দুরন্ত ঘূর্ণি, ধিতাং ধিতাং বোলে, আমায় প্রশ্ন করে, শোনো কোনো এক দিন –পূজোর এই সব সলিল-হেমন্তর সম্মেলনের গানগুলি বাংলা গানের ইতিহাসে একটি আলাদা অধ্যায় দাবী করবে। সলিল চৌধুরী ছাড়াও পূজোতে গাওয়া কিছু মৃত্যুহীন গান - নচিকেতা ঘোষের সুরে ‘কোন পাখী ধরা দিতে চায়’ ‘যদি জানতে চাও’ সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের সুরে ‘তোমার আমার কারো মুখে কথা নেই’ নিজের সুরে ‘অলির কথা শুনে’ ‘আমি দূর হতে তোমারে দেখেছি’ ইত্যাদি।
১৯৪৯ সালে প্রকাশিত হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া পুজোর গান – কোনো এক গাঁয়ের বধু (নীচে ক্লিক করুন)
১৯৪২ সালে আর একটি সুললিত রোমান্টিক কণ্ঠ পেল, যার নাম জগন্ময় মিত্র। তার গাওয়া ‘চিঠি’ গানটি তো হইচই ফেলে দিয়েছিল। নিবিড় প্রেম সঙ্গীতের একটি নিজস্ব স্টাইলে হিন্দিতে জগমোহন এবং বাংলাতে জগন্ময় নামে তিনিও অনেক কাল আধিপত্য করেছেন।
১৯৪২ সালে প্রকাশিত জগন্ময় মিত্রের গাওয়া পুজোর গান – তুমি আজ কত দূরে (চিঠি) (নীচে ক্লিক করুন)
শচীন দেব বর্মণ কণ্ঠে ছিল লোক গানের ভঙ্গির সঙ্গে এক নেশা ধরানো অননুকরণীয় স্টাইলেজেশনের মিশ্রণ। ১৯৪৪ সে তিনি বোম্বাই পাড়ি দিলেন হিন্দি ফিল্মে সুরকার হওয়ার জন্য এবং সেখানে গিয়ে সাড়া ফেলে দিলেন। কিন্তু মাঝে মাঝেই পুজোর গান করে যাচ্ছেন কখনো হিমাংশু দত্তের সুরে কখনো নিজের সুরে| ১৯৩৬ সালের পূজোয় গাইলেন ‘মম মন্দিরে’ ১৯৩৮ সালে –তুমি যে গিয়াছ বকুল বিছানো পথে আর ১৯৫৬ সালে সেই চির নবীন গান – ‘মন দিলোনা বঁধু’ ইত্যাদি।
১৯৩৮ সালে প্রকাশিত শচীন দেব বর্মনের গাওয়া পুজোর গান – তুমি যে গিয়াছ বকুল বিছানো পথে (নীচে ক্লিক করুন)
চল্লিশের দশক ছাড়িয়ে পঞ্চাশের দশক পড়তেই একে একে পুজোর গান করতে আসতে লাগলেন একেক জন সব দিকপাল গায়ক গায়িকারা।
১৯৫৩ সালে পুজোয় প্রথম বাংলা আধুনিক বেসিক রেকর্ড করলেন মান্না দে। নিজের সুরে তিনি দুটি গান গাইলেন - হায় হায় গো আর কত দূরে আর। বোম্বের বাসিন্দা হয়েও পরবর্তী কালে প্রধানত পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায় কখনো নিজের সুরে কখনো নচিকেতা ঘোষের সুরে তিনিও পঞ্চাশ, ষাট ও সত্তরের দশকে গেয়ে গেছেন অসংখ্য পূজোর গান।
১৯৫৩ সালে প্রকাশিত মান্নাদের পুজোর গান – কত দূরে আর নিয়ে যাবে বল (নীচে ক্লিক করুন)
১৯৫৯ তে গীতা দত্ত গাইলেন কানু ঘোষের সুরে – ওই সুর ভরা দূর নীলিমায় আয় আয় আয় রে ছুটে আয়। তিনিও বোম্বের সিনেমার জগত প্লাবিত করলেন তাঁর মায়াবী কণ্ঠে কিন্তু পূজোয় বাংলা গান গাওয়া ছাড়েন নি।
১৯৫৯ সালে প্রকাশিত গীতা দত্তের পুজোর গান – ঐ সুর ভরা দূর নীলিমায় (নীচে ক্লিক করুন)
১৯৫২ সালের পুজোয় শ্যামল মিত্র সুধীর লাল চক্রবর্তীর সুরে গাইলেন – স্মৃতি তুমি বেদনা। বাংলা গানের চল্লিশ দশকের নেজাল স্টাইলে পরিবেশনের তিনিই সম্ভবত শেষ প্রতিনিধি। আজীবন তিনি সেই স্টাইলটি বজায় রেখেছিলেন।
১৯৫২ সালে প্রকাশিত শ্যামল মিত্রের পুজোর গান – স্মৃতি তুমি বেদনা - (নীচে ক্লিক করুন)
১৯৫৩তে পুজোয় পান্নালাল ভট্টাচার্যের সেই বিখ্যাত শ্যামাসঙ্গীত বেরোলো যা নিতান্ত নাস্তিক প্রাণেও ভক্তি রস সঞ্চার করতে পারে – মায়ের পায়ে জবা হয়ে।
১৯৫০ সে পুজোতে সন্ধ্যা মুখার্জী গাইলেন – ওগো মোর গীতিময় যা আজও আমাদের হৃদয় দ্রবিত করে। তিনি পরবর্তী কালে সিনেমায় সুচিত্রা সেনের লিপে তাঁর গানগুলি এক যুগ ধরে একচেটিয়া রাজত্ব করেছে। কিন্তু সেই সঙ্গে পূজোতে গেয়ে গেছেন এমন অনবদ্য সব গান যা শুধু তাঁর পক্ষেই গাওয়া সম্ভব।
১৯৫০ সালে প্রকাশিত সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া পুজোর গান – ওগো মোর গীতিময় (নীচে ক্লিক করুন)
১৯৫৭তে মানবেন্দ্র মুখার্জী গাইলেন সেই ভাসিয়ে দেওয়া অতীন্দ্রিয় রোমান্টিক গান –আমি এতো যে তোমায় ভালোবেসেছি। কণ্ঠে ধ্রুপদী অলঙ্করণ নিয়েও তিনি গেয়েছেন অসাধারণ রোমান্টিক সব গান।
১৯৫৭ সালে প্রকাশিত মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের পুজোর গান - আমি এতো যে তোমায় ভালোবেসেছি (নীচে ক্লিক করুন)
১৯৫২ তে দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় সলিল চৌধুরীর সুরে ভরাট গলায় গাইলেন – শ্যামল বরণী ওগো কন্যা। সত্যিকারের ব্যারিটোন কণ্ঠে গাওয়া তাঁর গানগুলিতে কিছুটা রবীন্দ্রসঙ্গীতের আদল ছিল আবার কিছুটা আলাদা একটা ধরন ছিল।
১৯৫২ সালে প্রকাশিত দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া পুজোর গান – শ্যামল বরণী ওগো কন্যা (নীচে ক্লিক করুন)
১৯৫২তে সতীনাথ মুখোপাধ্যায় মরমিয়া কণ্ঠে গাইলেন – পাষাণের বুকে লিখো না আমার নাম। তাঁর গানে এক ধরনের বিষণ্ণতা থাকতো যা তাঁকে আলাদা করে রাখতো।
১৯৫২তে তালাত মামুদ এক অদ্ভুত ট্রিমেলো দেওয়া স্টাইলাইজড কণ্ঠে গাইলেন –চাঁদের এতো আলো তবু সে আমায় ডাকে। তিনি অবাঙালী এবং মূলত হিন্দি সিনেমার গানের শিল্পী হয়েও প্রায় প্রতি বছরে পূজোর গান গেয়ে গেছেন।
১৯৫২ সালে প্রকাশিত তালাত মাহমুদের পুজোর গান – চাঁদের এতো আলো (নীচে ক্লিক করুন)
১৯৫৮তে প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় মধুক্ষরা কণ্ঠে গাইলেন। – মেঘলা ভাঙ্গা রোদ উঠেছে। তার পরে অজস্র হিট গান গেয়েছেন।
১৯৫৩র পুজোয় উৎপলা সেন ঈষৎ হাস্কি গলায় গাইলেন সলিল চৌধুরীর সুরে একটি অনবদ্য সলিল-ঘরানার গান-, মেঠো সুরের গান আমার।
১৯৫৮তে লতা মঙ্গেস্কর গাইলেন হেমন্তের সুরে একটি শান্ত ছায়াচ্ছন্ন গান - প্রেম একবারই এসেছিল জীবনে।
১৯৫৮ সালে প্রকাশিত লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া পুজোর গান – প্রেম একবারই এসেছিল জীবনে (নীচে ক্লিক করুন)
আশা ভোঁসলে ১৯৫৯র পুজোয় রেকর্ড করলেন মান্না দের সুরে হৃদয়ে দোলা দিয়ে যাবার মতই গান - আমায় তুমি যে ভালো বেসেছো জীবনে যে তাই দোলা লাগলো।
১৯৫৯ সালে প্রকাশিত আশা ভোঁসলের গাওয়া পুজোর গান –আমায় তুমি যে ভালো বেসেছ (নীচে ক্লিক করুন)
এই দুই কিংবদন্তী বোন তার পর চার দশক ধরে আমাদের গানের ভাণ্ডার কে সমৃদ্ধ করেছেন তার বিবরণ এক আলাদা অধ্যায় দাবী করে।
১৯৫৮তে আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায় গাইলেন – ও আমার ছোট্টো পাখি চন্দনা।
১৯৫৮ সালে প্রকাশিত আলপনা বন্দোপাধ্যায়ের গাওয়া পুজোর গান – ছোট্টো পাখী চন্দনা (নীচে ক্লিক করুন)
গায়ত্রী বসু গাইলেন –আমার সন্ধ্যাপ্রদীপ, ১৯৫৯এ বম্বে থেকে মহঃ রফি সাহেব এসে গাইলেন – কথা ছিল দেখা হলে দু জনে।
ষাটের দশকেও পুজোতে এই সব গায়ক গায়িকারা তো মাতিয়ে রাখলেনই প্রত্যেক বছর পুজোর গানের সম্ভার। সেই সঙ্গে বাঙালী পেল আরো অসাধারণ কিছু শিল্পীদের - ইলা বসু, মাধুরী চট্টোপাধ্যায়, সবিতা চৌধুরী, গায়ত্রী বসু, নির্মলা মিশ্র, আরতি মুখোপাধ্যায়, সুবীর সেন, ভূপেন হাজারিকা, পিন্টু ভট্টাচার্য, নির্মলেন্দু চৌধুরী, অখিল বন্ধু ঘোষ, মৃণাল চক্রবর্তী এবং আরও অনেকে|
আর ষাটের দশক মেলডির যাদুতে মাতিয়ে দিলেন সুরকার সলিল চৌধুরী, নচিকেতা ঘোষ, সুধীন দাশগুপ্ত, রতু মুখোপাধ্যায়, অনল চট্টোপাধ্যায়, অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়রা। এ সময়ে অসংখ্য সাড়া জাগানোর গান হয়েছে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, লতা মঙ্গেশকর এবং সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, মানবেন্দ্র এঁরা তো এই সময়ে গেয়েছেন অবিস্মরণীয় সব গান। তার সব উল্লেখ করলে তালিকা অনেক দীর্ঘায়িত হয়ে যাবে। বরং অন্য কিছু শিল্পীর কয়েকটি জনপ্রিয় গানের উল্লেখ করছি। অখিল বন্ধু ঘোষ -ও দয়াল বিচার কর (১৯৬২), মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায় – কেন জানিনা শুধুই তোমার কথা মনে পড়ে (১৯৬৫), শৈলেন মুখোপাধ্যায়ের – ঝর্ণা ঝর্ণা সুন্দরী ঝর্ণা (১৯৬৫), ইলা বসু- শুধু একটি দিনের চেনা (১৯৬৫ ) পিন্টু ভট্টাচার্যের – চলো না দীঘার সৈকত ছেড়ে (১৯৬৮ ), সুমন কল্যাণপুরের – বাদলের মাদল বাজে (১৯৬৮ ), মাধুরী চট্টোপাধ্যায়ের –ওই যে সবুজ বন বীথিকা, মুকেশের –মন মাতাল সাঁঝ সকাল কেন (১৯৬৮ ), সুবীর সেনের –সারাদিন তোমায় ভেবে (১৯৬৭ ), নির্মলা মিশ্রের কাগজের ফুল বলে (১৯৭৪ ), অনুপ ঘোষালের – এমনি চিরদিন তো কারো যায় না, বনশ্রী সেনগুপ্তের আজ বিকেলের ডাকে (১৯৭৩ ) ইত্যাদি।
১৯৬৭ সালে প্রকাশিত সুবীর সেনের পুজোর গান – সারাদিন তোমায় ভেবে (নীচে ক্লিক করুন)
১৯৬৭তে হৈচৈ মাতিয়ে পুজোর গানের জগতে প্রবেশ করলেন কুমার রাহুল দেব বর্মণ। কিশোরকুমার, যিনি এতকাল কোনো অজানা কারণে পুজোর গান গাওয়া থেকে বিরত ছিলেন, তাঁকে দিয়ে গাওয়ালেন – এক দিন পাখী উড়ে যাবে যে আকাশে।
১৯৬৭ সালে প্রকাশিত কিশোর কুমারের গাওয়া পূজোর গান – একদিন পাখী উড়ে যাবে (নীচে ক্লিক করুন)
আর আর ডি বর্মন নিজেই গাইলেন পরের বছর ১৯৬৮ এ গাইলেন – মনে পড়ে রুবি রায়।
১৯৬৯ সালে প্রকাশিত আর ডি বর্মনের পূজোর গান – মনে পড়ে রুবী রায় (নীচে ক্লিক করুন)
এই দুটি গান দিয়ে বাংলা গানে এক নতুন যুগের শুরু হল। বলা যেতে পারে বাংলা গান চিরাচরিত ধুতি সাড়ি ছেড়ে জিনস পরা শুরু করলো এখান থেকেই। অরকেশট্রেশন, রিদম, শব্দ পরিক্ষেপণ এ সব কিছুর মধ্যে একটা তাজা হাওয়া নিয়ে এলেন তিনি। এর পরে একের পর এক আশা ভোঁশলে কে দিয়ে গাওয়ালেন অনবদ্য সব গান। সেই আরডির বদলে দেওয়া স্টাইলের প্রভাব আজও চলছে।
একশো বছরে বাঙালী সমাজ যেমন অনেক পাল্টেছে তেমনি বাংলা গানেরও স্বভাব চরিত্র অনেকটা পাল্টেছে। বিশ তিরিশ শতকের পুজোর বাংলা গান যে স্টাইলে গাওয়া হত তা শুনলে আজকের যুবক যুবতীদের হয়তো হাসি পাবে। সে সময়ের পূজোর গানে রেকর্ডিং এর গুণমান তো দুর্বল ছিলই। সেই সঙ্গে উচ্চারণে কিছুটা কালোয়াতি ধরন, একটু বেশি রকমের গলার কাজ (গিটকিরি) দেখানোর প্রবণতা, একটু বেশি রকমের অনুনাসিকতা আর মন্দ্র সপ্তক এড়িয়ে তার সপ্তকে কণ্ঠ নিয়ে যাওয়ার প্রবণতা, এই সব মিলে সে সময়ের গানগুলিকে এই সময়ের গানকে থেকে আলাদা করে রেখেছে পরবর্তী সময়ের গান থেকে। এ ছাড়া গানে অরকেস্ট্রেশন করার নানারকম যান্ত্রিক অসুবিধা থাকার ফলে ইণ্টারলুড প্রিলিউড বাজনা প্রায় থাকতোই না। সে সময়ের শিল্পীদের নানা আসরে খালি গলায় গান গাইতে হত বলে এঁরা সব সময়েই ফুল থ্রোট ভয়েসে গান গাইতেন। তাতে গানের বাণীকে ব্যক্ত করার জন্যে পেলবতা দরকার হত সেটা এই সব গানে পাওয়া যেতো না। আসলে গানের বাণীকে ততটা পাত্তাই দেওয়া হোতো না। রবীন্দ্রনাথ খুব সচেতন ভাবে নিজের গান থেকে কালোয়াতি প্রবণতা কে দূরে রাখার চেষ্টা করে গেছেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গান থেকে শিক্ষা নেওয়ার চেষ্টা সে সময়ের সঙ্গীতকারেরা নেন নি। সেটা আরম্ভ হয় চল্লিশের দশকে। তবু এই সময়ের গানগুলি আজও শুনতে ইচ্ছে করে গায়ক গায়িকাদের কণ্ঠসম্পদের জন্যে। দিলীপকুমার রায়ের ‘সমস্ত সুর হন্ত দন্ত ’ করা গান, কৃষ্ণচন্দ্র দের কীর্তনাঙ্গের গানের আর্তির মধ্যেও ধ্রুপদ সঙ্গীতের অনায়াস নৈপুণ্য, যূথিকা রায়ের কণ্ঠে জুঁই ফুলের সৌরভের সঙ্গে সূক্ষ্ম অলঙ্করণ, এ সবই আমাদের পরম ঐশ্বর্য হয়ে আছে এবং থাকবে।
১৯৫০ সালে প্রকাশিত যুথিকা রায়ের গাওয়া পূজোর গান – এমনি বরষা ছিল সেদিন (নীচে ক্লিক করুন)
চল্লিশের দশকে এমন সব সুরকারেরা এলেন যারা ধ্রুপদ এবং দেশজ গানের মধ্যে আবদ্ধ না থেকে পশ্চিমের জানলা খুলে দিলেন। এলো একটা বদলের হাওয়া। বাংলা গান শুধু মাত্র রাগনির্ভর সীমাবদ্ধতা থেকে বেরিয়ে থেকে অনেকটা মেলডি নির্ভর হয়ে উঠলো। গানের বাণীকে যথেষ্ট মর্যাদা দেওয়া হল। রেকর্ডিং ব্যবস্থার উন্নতি হওয়ার ফলে একাধিক বাদ্যযন্ত্র গানের সঙ্গে বাজিয়ে রেকর্ড করার ব্যবস্থা হল। শুধুমাত্র এস্রাজ সারেঙ্গী বেহালা আড় বাঁশি এই অল্পসংখ্যক বাদ্য যন্ত্রের ব্যবহারের মধ্যে আটকে না থেকে কিছু বিদেশী বাদ্যযন্ত্র যেমন পিয়ানো একোরডিয়ান, গীটার, অর্গান, ম্যান্ডলিন এসবের ব্যবহার প্রচলিত হল। সব মিলে পূজোর গানের একটা নতুন চেহারা দেখা গেল। রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুল ইসলাম এই দুই মহান সুরকারের প্রভাব পড়লো বাংলা আধুনিক গানে। সেই সঙ্গে কিছু পাশ্চাত্য সঙ্গীতের ও প্রভাব পড়ল। নূতন সুরের ডালি নিয়ে এলেন কমল দাশগুপ্ত, হিমাংশু দত্ত, সুবল দাশগুপ্ত, রবীন চট্টোপাধ্যায়, শৈলেশ দত্তগুপ্তরা।
পরে তাদের কাছ থেকে রিলে রেসের ব্যাটন নিয়ে শুরু করলেন রতু মুখোপাধ্যায়, সলিল চৌধুরী, নচিকেতা ঘোষ, সুধীন দাশগুপ্ত, অনল চট্টোপাধ্যায়, সুধীরলাল চক্রবর্তী, ভূপেন হাজারিকা,, অভিজিৎ বন্দোপাধ্যায়ের মত সুরকারেরা। এ ছাড়া একত্রে গায়ক-সুরকার হয়ে এলেন হেমন্ত মুখার্জী, মান্না দে, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের মত শিল্পীরা।
আর গানের লিরিক্স এও ঘটলো অনেক পরিবর্তন। অজয় ভট্টাচার্য, প্রণব রায়, মোহিনী চৌধুরী, শ্যামল গুপ্ত, প্রবীর রায়, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, মুকুল দত্ত এঁরা বাংলা গানের লিরিক্স কে নতুন চেহারা দিলেন। এ ছাড়া সলিল চৌধুরী তো একাই একশ। তিনি গানের কথায় অনেকটা আধুনিকতা নিয়ে এলেন। বিশের দশক থেকে ষাটের দশক অবধি চলল পূজোর গানের ডিস্কের জয়যাত্রা। এই সময়ের ডিস্কে প্রকাশিত পূজোর গান নিয়ে একটি আলাদা করে ইতিহাস রচিত হলে সেই সব গুণী মানুষদের প্রতি কিছুটা সম্মান জানান হত। কিন্তু বাঙালীর তো নিজেদের ইতিহাস রচনায় ভয়ানক অনীহা। হয়ত কোনো এক সাহেব এসে এই কাজটায় হাত দেবে কোনোদিন।
সত্তরের দশকে প্রযুক্তির কল্যাণে এক ধাপ এগিয়ে গেল শব্দ রেকর্ডিয়ের জগত। স্টিরিও রেকর্ডিং এলো। তার কিছুদিন পরেই সেই গালার বড় বড় চাকতিকে সরিয়ে চলে এল অডিও ক্যাসেটের যুগ। গান রেকর্ডিং করা অনেক সহজ হয়ে গেল। আর একটি ক্যাসেট দশ থেকে বারোটি গান অনায়াসে ধরিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা হয়ে গেল। আর ডিস্ক নয় এবার বেরোতে লাগলো এলবাম।
ভিনাইল রেকর্ডিং করা বেশ খরচাসাপেক্ষ ছিল বলে রেকর্ড কোম্পানিগুলি খুব সাবধানে পুজোর গান বাছাই করতেন। যার ফলে অনেক শিল্পীকে বহুদিন অপেক্ষা করতে হয়েছে পুজোর গান পাবার জন্যে। মৃণাল চক্রবর্তী, আরতি মুখোপাধ্যায়ের মতন শিল্পীদের বিখ্যাত হয়ে যাবার পরেও পুজোর গান গাইবার সুযোগ পাওয়ার জন্যে অনেকদিন অপেক্ষা করতে হয়েছে। এই রকম একটা নিয়ন্ত্রণ থাকার ফলে পূজোর গানের একটা মান বরাবরই বজায় ছিল। প্রত্যেক গায়ক গায়িকা সুরকার গীতিকাররা চেষ্টা করতেন পূজোর গানে তাদের সেরা কাজটি উপহার দেওয়ার। এই সুস্থ প্রতিযোগিতাই জন্ম দিয়েছে শত শত কালজয়ী গান।
ক্যাসেট যুগ আসার পর সে সব নিয়ন্ত্রণ একটু করে ঘুচে গেল। এ ছাড়া ডিজিটাল রেকর্ডিং, ট্র্যাক রেকর্ডিং-এ খণ্ড খণ্ড করে একটি গানকে রেকর্ড করার ব্যবস্থা, আরো বহু রকমের বৈদ্যুতিন প্রযুক্তির ব্যবহার করার সুবিধা চলে এলো। সুসাধ্যতা যেমন জীবনযাত্রায় অনেক নতুন সুবিধা যেমন এনে দেয় তেমনি তা মানুষের সৃষ্টিশীলতার উপরও কিছুটা আক্রমণ চালায়। ব্যাংএর ছাতার মতন ক্যাসেট কোম্পানি বাজারে চলে এল। তারা নানা শিল্পীদের খুঁজে এনে তাদের লঞ্চ করতে লাগলেন। প্রচার এবং প্যাকেজিং করে গানকে হিট করিয়ে দিতে পারলে তারা দু পয়সা কামাতে পারবেন। তাতে গান ভাল হল বা নাই হল কি আর আসে যায়।
এন্তার বেনোজল ঢুকে পড়লো গানের জগতে। সারা বছর ধরে অনেক এলবাম বেরোতে শুরু হল। Quality আর Quantity র বিরোধ অন্য কোথাও থাক বা না থাক শিল্পের জগতে অবশ্যই আছে। তাই গানের মান ক্রমশ পড়তে লাগালো। তার মানে এই নয় যে বাংলা গানের জগতের সর্বনাশ হয়ে গেল। তার পরেও অনেক ভালো গান তৈরি হয়েছে, অনেক গুণী শিল্পীরা এসেছে। সুমন চট্টোপাধ্যায়ের মতন বাংলা গানের জগতের game changer দের আবির্ভাব তো এই ক্যাসেটে এলবাম বার করেই হয়েছে। নচিকেতা-অঞ্জনের মত নূতন ধারার শিল্পীরা ভূমি-চন্দ্রবিন্দুর মত গানের দলেরা তো এই ক্যাসেট-যুগেই এসেছেন এবং অনেক দিন ধরে ধরে রেখেছেন তাদের জনপ্রিয়তা।
তবে বাঙালীর সেই পুজোর গানের জন্যে সারা বছর অধীর অপেক্ষার দিন আর রইল না, তাদের পূজোর গান শোনার আবেগও ক্রমশ স্তিমিত হয়ে আসতে লাগল। আরো কিছুদিন পরে এলো কম্প্যাক্ট ডিস্ক, যা আর উন্নত প্রযুক্তি। এলো এম পি থ্রি। একটি ছোট্ট রুপালি চাকতিতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এর মত শিল্পীদের সারা জীবনের সাধনার ফসল অনায়াসে ধরিয়ে দেওয়া যায়। এবং তা যখন তখন কপি করে বিশ পঁচিশ টাকায় বিক্রি করা যায়। ভয় হয় এই কারিগরির কেরামতি এক ধরনের ফ্র্যাঙ্কেন্সটাইনের ছদ্মবেশ নয় তো ?
আজও হয়তো পুজোর গান নাম দিয়ে কিছু এলবাম সিডি আকারে বেরোয়| কিন্তু কেউ ওগুলোর জন্যে হা পিত্যেস করে বসে থাকেনা। তেমন করে খবরও রাখে না। সারা বছর শয়ে শয়ে নূতন গান শ্রাবণের ধারার মত ঝরে পড়ে। বিক্রিও হয়, অতি আধুনিক হাই ফাই মিউজিক সিস্টেম কোথাও কোথাও বাজে কিছুদিন| ইউটিউবে আপলোড করা হয়। শ্রোতারা শুনে লাইক দেন। সেই লাইকের সংখ্যা দেখে গান কতটা হিট হল বোঝা যায়। তার পর স্মৃতি থেকে কোথায় যে তারা হারিয়ে যায় কে জানে।
অনুরোধের আসরের মৃত্যু ঘটেছে কবেই। পূজো প্যান্ডেলে পূজোর গান বাজানো এখন ধূসর স্মৃতি। যে নূতন প্রজন্ম হাজার খানেক গান আইপড-মোবাইলে ভরে কানে ইয়ারপ্লাগ গুঁজে পথ চলতে চলতে শোনে তাদের কাছে একটি ৭৮ আর পি এমের গালার চাকতিতে ধরা দুটি মাত্র গান যে কতখানি মূল্যবান হতে পারে তা বোঝানোর চেষ্টা করা বৃথা।
তাই সেই হারিয়ে যাওয়া রেকর্ড যুগের উদ্দেশ্যে শচীন কত্তার মৃত্যুহীন গানের লাইন ধার করে বলা ছাড়া আর কিই বা করার আছে – তুমি যে গিয়াছ বকুল বিছানো পথে ......।
গানের লিঙ্কগুলি ইউ টিউব থেকে নেওয়া।
লেখক পরিচিতি - চাকুরী জীবন বেসরকারি এবং আধা সরকারি কর্পোরেট জগতের বিভিন্ন পদে। এখন অবসরপ্রাপ্ত। লেখেন নেহাতই মনের খিদে মেটাতে। লেখেন নানান বিষয় নিয়ে। তবে যাই লেখেন বিষয় নির্বাচনে কিছু অভিনবত্ব থাকে। গান , চলচ্চিত্র, ভ্রমণ, দিন বদলের ছবি, বাঙ্গালিয়ানা এ রকম আরও অনেক বিষয় এবং অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ। তথ্যকে কৌতুকের মোড়কে এবং ভাবনা কে স্বচ্ছতার আবরণে পরিবেশন করতে চেষ্টা করেন। বিষয় যাই হোক ভাষা সব সময়েই ঝরঝরে, রসস্নিগ্ধ এবং মনোগ্রাহী।
বেশ কয়েকটি ওয়েব পত্রিকাতে লেখেন। দেশ বিদেশে অনেক গুণগ্রাহী পাঠক আছেন।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।