বইয়ের খবর
নভেম্বর ৩০, ২০১৬
নতুন করে পাওয়া পুরানো একটি বই
দীপক সেনগুপ্ত
কলকাতা নিয়ে চর্চা নতুন কোনো বিষয় নয়। নামী-অনামী বহু লেখক নানা
দৃষ্টিকোণ থেকে এই পুরানো শহরটিকে দেখেছেন এবং তাদের গবেষণালব্ধ
বা পঠিত জ্ঞান লিপিবদ্ধ করে গেছেন। প্রত্যক্ষদর্শীর লিখে রাখা
বিবরণ আর কটা পাওয়া যায়? অধিকাংশই ইতিহাস ঘেঁটে তুলে আনা তথ্য।
অতীত সম্বন্ধে যদি কেউ তার নিজের অভিজ্ঞতার কথা লিখে গিয়ে থাকেন
তবে সে তথ্যের মূল্য অপরিসীম। অনেক সময়ে সে সব ঘটনা মনশ্চক্ষে
মূর্ত হয়ে ওঠে।
জহরলাল ধরের লেখা ‘সচিত্র কলকাতার কাহিনী’ পড়তে পড়তে আঠারো শতকের
শেষ দশকের কলকাতায় কিছুক্ষণের জন্য ফিরে যাওয়া যায়। বইটির প্রথম
প্রকাশ কবে জানা নেই তবে প্রথম সংস্করণ ১৩০৩ বঙ্গাব্দে, আজ থেকে
প্রায় ১২০ বছর আগে। এটি কলকাতার ইতিহাস কোন অর্থেই নয়, সে সময়ের
সমাজজীবনের কিছু খণ্ডচিত্রের দেখা মেলে মাত্র। তারই মধ্যে গড়ে
উঠেছে একটা প্রেম কাহিনী। নান দ্বন্দ্ব, সংঘাত, প্রতিহিংসা ও স্বার্থপরতার
আবর্ত তৈরি হয়েছে কিছু পুরুষ ও মহিলাকে কেন্দ্র করে। অপহরণের ঘটনাও
ঘটেছে। বাবু কালচার ও বটতলা সংস্কৃতি সে সময়ে সমাজে যথেষ্ট প্রভাব
ফেলেছিল এটা সকলেরই জানা। তার কিছু আভাসও মেলে এ বইতে। প্রেম কাহিনীর
ফাঁকে ফাঁকে দেখা মেলে কলকাতার রাস্তাঘাট, ফেরিওয়ালার ডাক ও প্রাত্যহিক
জীবনযাত্রার কিছু চলন্ত ছবি। এগুলি মাঝে মাঝে যেন রূপ পরিগ্রহ
করে জীবন্ত হয়ে ওঠে।
বইটির আকার তেমন বড় নয়। মাত্র ১৬০ পৃষ্ঠায় লেখক তার বক্তব্য শেষ
করেছেন। এরই মধ্যে তৈরি করেছেন ২২টি পরিচ্ছেদ, অনেক পরিচ্ছেদের
নাম দেওয়া হয়েছে কলকাতার কোন একটি স্থান বা রাস্তার নাম ধরে ;
যেমন ষষ্ঠ পরিচ্ছেদের নাম হয়েছে ‘বটতলা, - সংবাদপত্রের অফিস’ অথবা
নবম পরিচ্ছেদ হয়েছে ‘পাথুরিয়াঘাটার মহারাজের রাজবাটী’। বইটি শুরু
হয়েছে ‘কলকাতার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস দিয়ে’। সাড়ে তিন পৃষ্ঠার সেই
ইতিহাস থেকেই জানা যায় কিছু তথ্য – “আধুনিক কলকাতা তিনটি ক্ষুদ্র
ক্ষুদ্র গ্রামের সমষ্টি মাত্র : যথা সুতানুটি গ্রাম, গোবিন্দপুর
ও কালীকোটা। ‘ক্যালকাটা’ বা ‘কলকাতা’ শব্দ কালীকোটা শব্দের অপভ্রংশ।
পূর্ব্বে কালীঘাটের মহামায়া মন্দির কালীকোটা নামে প্রচলিত ছিল।”
রাধারমণ মিত্র তার ‘কলিকাতা দর্পণে’ কলিকাতা নামের উৎপত্তি নিয়ে
দীর্ঘ আলোচনা করেছেন, খণ্ডন করেছেন বেশ কিছু নামী ব্যক্তির বক্তব্য
; কিন্তু জহরলাল ধরের পরিবেশিত এ তথ্যটি নতুন। আরও জানা যায় –
“প্রবাদ এই যে তৎকালে রাজা নবকৃষ্ণই বিশুদ্ধ ইংরাজি ভাষায় কথা-বার্ত্তা
কহিতে পারিতেন। ...... মাতৃশ্রাদ্ধে তিনি প্রায় ত্রিশ লক্ষ টাকা
ব্যয় করেছিলেন।” অথবা, “মহাত্মা দ্বারিকানাথ ঠাকুর” পিরালি বংশে
একজন মহামান্য ব্যক্তি ছিলেন।”
মূল বর্ণনা শুরু এর পর থেকেই। প্রথম পরিচ্ছেদের নাম ‘চিৎপুররোড,
যোড়াসাঁকোর মোড়’। একটি আকর্ষণীয় বিষয় হ’ল সেদিনের কলকাতার কিছু
খণ্ডচিত্র ছড়িয়ে রয়েছে বইটিতে। প্রথমেই রয়েছে – “আজ মহাপূজার মহাপঞ্চমী,
সুতরং সহর কলিকাতায় মহা আয়োজন। বেলা প্রায় সাড়ে পাঁচটা। তারিখ
১১ই আশ্বিন। [ যথারীতি সালের কোন উল্লেখ নেই ]।...... না শীত,
না গ্রীষ্ম। আজ যোড়াসাঁকোর মোড়ে মহা ভিড়। কে কার ঘাড়ে পড়ে, কে
কার পকেট মারে, তার কিছুই ঠিক নাই। ... আজ চিৎপুর রোডের অপূর্ব্ব
শোভা। দেশীয় বিদেশীয় লোকে রাস্তা পরিপূর্ণ। ...... রাস্তা গাড়ি
ঘোড়া ও ট্রামকারের শব্দে কম্পমান। মজুমদার কোম্পানি, - আর. সি.
মল্লিক-মল্লিক ব্রাদার্স প্রভৃতি বড় বড় টেলারসপে মহাধুম। উচ্চ
প্রাচীর রং বেরং প্ল্যাকার্ডে সুসজ্জিত। পথে হ্যান্ডবিলের ছড়াছড়ি।
বটতলার দৌলতে ফচকে ছোঁড়ারা “এবার পূজায় বিপদ ভারি, বৌ চেয়েছে সোনার
চুড়ি” প্রভৃতি রংদার বোলচালে অগাধ বই ফিরি করে বেচ্চে।”
কলকাতায় তখন ঘোড়ায় টানা ট্রাম চলছে। ট্রাম কোম্পানির ঘোড়া সম্বন্ধে
লেখকের মন্তব্য – “...... যে কয়কটি উক্ত কোম্পানির ঘোড়া আছে, তার
মধ্যে অধিকাংশই বে-আড়া। চলছে তো বেশ চলছে, কিন্তু যদি একবার বদমায়েসি
ধল্লে, তখন লাঠিসোটা মেরে ও ঠেলাঠেলি করেও গাড়ি চালান ভার। ......
গ্রীষ্মকালে ঘোড়ার মৃত্যু ও খুন জখম তো পদে পদে।” আমাদের দেশে
তখনো বৈদ্যুতিক ট্রাম চালু হয় নি, কিন্তু বিদেশে চালু হওয়া এই
ট্রামের উপযোগিতা সম্বন্ধে লেখক সম্পূর্ণ সচেতন – “ইউরোপখণ্ডে
একপ্রকার ট্রামকার আছে, যাহা বৈদ্যুতিক শক্তির দ্বারা পরিচালিত
হয়। তাহাতে ঘোড়া অথবা ইঞ্জিনের কিছুই আবশ্যক নাই, সুতরাং কয়লার
ধোঁয়ার দুর্গন্ধও নাই, আর ঘোড়ার লেদিও নাই। বৈদ্যুতিক ট্রামকার
যখন বেগে গমন করে, তখন বোধ হয় যেন কোন মহা মন্ত্রবলে গাড়ি চলেচে।
এ সওয়ার গাড়ির মহাগুণ এই, যে গাড়ি যতই বেগে চলুক না কেন, ইচ্ছা
কল্লেই তৎক্ষণাৎ একদম থামান ও চালান যায়।”
প্রেম কাহিনীর মুখ্য নায়িকা সোহাগিনী বসুর আবির্ভাবও এই প্রথম
পরিচ্ছেদেই। পেশায় তিনি লেডি ডাক্তার। আকর্ষণীয় চেহারার বর্ণনা
– “যুবতীর নাম সোহাগিনী। সোহাগিনীর বয়স প্রায় ২৫’২৬ বৎসর। রঙ উজ্জ্বল
শ্যামবর্ণ। মুখখানি অতি সুন্দর। উজ্জ্বল নয়নদ্বয়ে বিদ্যা ও জ্ঞানের
জ্যোতি বিরাজমান। সুঠাম কলেবর পাশ্চাত্য সভ্যতা ও আধ্যাত্মিক তেজে
সুগঠিত। বাস্তবিক, বিদ্যা ও জ্ঞানের জীবন্ত প্রতিমা।”
বর্তমান আলোচনায় প্রতিটি পরিচ্ছেদের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিয়ে যারা
বইটি ভবিষ্যতে পড়তে ইচ্ছুক তাদের আগ্রহ দমিয়ে দেওয়াটা নিরর্থক।
তবে লেখকের পরিচয়টা ত আমাদের পেতেই হবে। কে ছিলেন লেখক জহরলাল
ধর ? এটা জানার কোন উপায়ই থাকত না যদি না বইটির দশম পরিচ্ছেদে
লেখক আত্মপরিচয় লিপিবদ্ধ করে যেতেন। কারণ, জীবনীকোষে তার যেটুকু
পরিচয় দেওয়া আছে সেটা হল, তিনি ছিলেন বৈজ্ঞানিক। ব্যস, এই টুকুই।
খুব সংক্ষেপে দেখা যাক লেখক তার নিজের সম্বন্ধে কি বলে গেছেন।
লেখক সাগরধর লেনের বাসিন্দা, সুবর্ণ বণিক ব্যবসায়ীর ঘরে জন্মেছিলেন,
পিতামাতার একমাত্র আদরের সন্তান। পাঁচ বছর বয়সে পড়াশোনা শুরু করেন
; সাত বছর বয়সে ইংরাজি স্কুলে ভর্তি হয়ে দু’বছর পরেই ছেড়ে দেন।
পরের তিন বছর পণ্ডিতের কাছে সংস্কৃত এবং পরে আরও দু’বছর অন্য এক
শিক্ষকের কাছে ইংরাজি শিক্ষা। চোদ্দ বছর বয়সে হিন্দু স্কুলে পঞ্চম
শ্রেণীতে এবং সতের বছরে তৃতীয় শ্রেণীতে উঠেছিলেন তিনি। এর পরই
তার বিয়ে হয় ; তার উদ্দেশ্যে পিতামহীর উপদেশ ছিল –“যখন বিবাহ হইল,
তখন আর ইস্কুলে যাওয়া ভাল দেখায় না।” অতএব প্রথাগত শিক্ষার সেখানেই
ইতি। কিন্তু লেখক ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ – “ইস্কুল ছাড়িলাম বটে, কিন্তু
যে কোন গতিকে পারি লেখাপড়া শিখিবই শিখিব।” সে সময়টা ছিল যাত্রা,
পাঁচালী, থিয়েটার ও আমোদ প্রমোদের যুগ। এই দলেই যোগ দেন তিনি এবং
মদ গাঁজা ইত্যাদি নেশায় আসক্ত হয়ে পড়েন। কিন্তু তার বিদ্যালাভের
উৎসাহে ভাঁটা পড়ে নি। শব্দকোষ খুলে বাড়িতে ইংরাজি বই পড়ার চেষ্টা
চালিয়ে গেছেন। আঠারো বছর বয়সে বর্তমান পুস্তকটি প্রকাশ করেন লেখক।
লক্ষণীয় যে, বইটিতে আঠারো বছরের পরের ঘটনাও লিপিবদ্ধ হয়েছে। সম্ভবত:
বইটি লেখকের আঠারো বছর বয়সে প্রকাশিত হলেও প্রথম সংস্করণটি বের
হয় অনেক পড়ে, ১৩০৩ বঙ্গাব্দে। এই সংস্করণটিই এখন বাজারে লভ্য।
বউবাজারের নামী পুস্তক ব্যবসায়ী শম্ভুচন্দ্র আঢ্যর একমাত্র কন্যার
সঙ্গে বিয়ে হওয়ায় গ্রন্থকারের বইয়ের কোন অভাব ছিল না। যখন যে বই
চেয়েছেন, পেয়েছেন। গণিত ছিল জহরলালের অতি প্রিয় বিষয়। হেয়ার স্কুলের
সঙ্গে হিন্দু স্কুলের প্রতিযোগিতায় ‘অঙ্কবিদ্যার দ্বারা’ হেয়ার
স্কুলকে হারিয়ে দিতেন তিনি। এতে প্রেসিডেন্সি সহ অন্যান্য বহু
কলেজের অধ্যাপকেরা তাকে পুরস্কৃত করেছেন। লেখকের কথায় – “জ্যামিতি,
বীজগণিত, ত্রিকোণমিতি, বলবিজ্ঞান, গতি-বিজ্ঞান প্রভৃতি উচ্চ ও
মিশ্রগণিত গৃহে বসিয়া গুরুর উপদেশ ব্যতীত শিক্ষা করিতে লাগিলাম।
...... তখন আলোক ও তাড়িত বিজ্ঞানের মিশ্রগণিত কার্য্যে পরিণত করিতে
লাগিলাম। পদার্থ বিজ্ঞান ও রসায়ন শাস্ত্র, গণিতাক্ষরে পরীক্ষা
করত, নানা বৈজ্ঞানিক যন্ত্র আবিষ্কার ও নির্ম্মান করিতে লাগিলাম।”
নাট্যজগতের অমৃতলাল বসু ও গিরিশচন্দ্র ঘোষের সঙ্গে লেখকের সুসম্পর্ক
ছিল। তিনি ছিলেন বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম প্রস্তুত করার কাজে পারদর্শী।
গিরিশ বাবু তার ‘দক্ষ-যজ্ঞ’ নাটকে ‘দশমহাবিদ্যার বৈজ্ঞানিক আবির্ভাব
ও অন্তর্ধানে’র ভার তার উপর অর্পণ করেন। এটি সমসাময়িক সংবাদপত্র
ও জনসাধারণের অজস্র প্রশংসাও লাভ করেছিল। ইতিমধ্যে লেখক যাদুবিদ্যার
প্রতি কৌতূহলী হয়ে পড়েন। নিজের হাতেই যন্ত্রপাতি তৈরি করে খেলা
দেখিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন তিনি। দর্শকদের মধ্যে বড়লাট,
ছোটলাট ও রাজাবাহাদুরেরাও ছিলেন। আবিষ্কারের নেশা লেখককে পেয়ে
বসেছিল। তিনি লিখেছেন – “বাল্যকাল হইতে টানা পাখার কলে আমার মহা
সক ছিল। সুতরাং সেই অবস্থায় সামান্য ঘড়ির কলের দ্বারা আমি একটি
ক্ষুদ্র ‘পাখার কল’ প্রস্তুত করিয়াছিলাম। তাহার পর যখন বিজ্ঞান
শাস্ত্র শিক্ষা করি তখন জলের ভারে, বায়ুর ভারে, বাষ্পের চাপে এবং
বৈদ্যুতিক শক্তি সহকারে নানারূপ পাখার কল প্রস্তুত করিয়াছিলাম।”
এছাড়া তিনি ‘সেফটি-ডোর-লক’ উদ্ভাবন করেছিলেন। বড়লাট সন্তুষ্ট হয়ে
তাকে সমগ্র ভারতবর্ষে যন্ত্রটির পেটেন্ট রাইট ও সত্ত্ব প্রদান
করেছিলেন। জ্যোতিষশাস্ত্রেও (astronomy) যথেষ্ট জ্ঞান অর্জন করেছিলেন
লেখক। বারিদবরণ ঘোষ মহাশয় জানিয়েছেন যে তিনি ‘জ্যোতিষ’ (১৮৯২)
নামে জহরলাল ধরের লেখা একটি বইয়ের সন্ধান পেয়েছেন। ধরে নেওয়া যেতেই
পারে এই জহরলাল এবং আলোচ্য গ্রন্থ প্রণেতা একই ব্যক্তি।
ঋণে জর্জরিত হয়ে লোকলজ্জা এড়াতে আগেই দেশত্যাগী হয়েছিলেন জহরলালের
পিতা। এরপর মাতৃবিয়োগের পর তিনি সম্পূর্ণ একা হয়ে যান। উল্লেখ্য
যে নিজের পরিবার সম্বন্ধে আর কোন তথ্য তিনি কিন্তু জানান নি। মাতৃবিয়োগের
পর তিনি যা সামান্য বিষয় লাভ করেছিলেন, সেটাও তিনি বিজ্ঞান শিক্ষার
কাজে ব্যয় করেন। স্পষ্টতই তিনি ছিলেন প্রকৃত জ্ঞানতপস্বী। ‘সচিত্র
কলকাতার কাহিনী’র লেখক সম্পর্কে এটুকুই বলার। আগেই বলা হয়েছে,
লেখক তার বইতে তৎকালীন কলকাতার চলমান জীবনের কিছু জীবন্ত ছবি আমাদের
উপহার দিয়েছেন। এখানে কয়েকটির বর্ণনা দিই। এতে আশা করি যারা বইটি
কিনে পড়বেন তাদের কৌতূহলে ঘাটতি পড়বে না।
“একে জ্যৈষ্ঠ মাস, তায় বেলা প্রায় দুই প্রহর। কাজেই রোদের চোটে
সহরে কাট ফাটচে। রাস্তার কুকুরগুলো জিব মেলিয়ে হাঁ করে হাঁপাচ্ছে।
কাক, সালিক ও চড়াইপাখি আলসে ও কারনিসের নীচে চুপ করে বসে আছে।
ট্রামগাড়ির ঘোড়াগুলোর মাঝে মাঝে সর্দ্দিগরমি হচ্ছে;-টপাটপ পড়চে
আর মরচে। সহরে ওলাউঠার এত প্রাদুর্ভাব হয়েছে যে, নিমতলার শ্মশানে
আর স্থান নাই;-চুলি ক্রমাগত জ্বলছে। রাস্তায় লোক অতি কম। কেবল
গৃহস্থের আধবয়িসী মেয়েগুলো চুপি চুপি ঘোমটা দিয়ে গঙ্গাস্নানে চলেছে।
তবে মাঝে মাঝে ‘পাণিপিনেকা বরফ’, ‘টাকায় দুখানা চারখানা আটখানা
কাপড়’, ‘রিপুর কর্ম্ম’, ‘শ্লেবে জুতিয়া জুতা বুরুষ’ প্রভৃতি ফিরিয়লাদের
ডাক মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছে। ......”
অথবা,
“ক্রমে বেলা এগারটা বেজে গেল। অফিসার বাবুরা বাড়িছাড়া হলেন। গৃহস্থের
মেয়েরাও কতকটা স্বাধীনতা পেলে। অমনি বটতলার ফচকে ছোঁড়ারা অবসর
বুঝে মেয়ে মহলে বই বেচতে বেরুলো। মেয়েরা, কেউ বারান্ডায়, কেউ ছাতের
উপর, কেউ বা খড়খড়ির পাখি তুলে উকি ঝুঁকি মাচ্ছে। পথের ধারে ছোঁড়ারা,
‘চাই ফোচকে ছুঁড়ির গুপ্তকথা’ ‘রাঙ্গামেয়ের গোদাভাতার’ ‘কচুবনে
লঙ্কাকান্ড’ ‘মনমজানে নিধুর টপ্পা’ প্রভৃতি মেয়ে ভুলানো বোল চালে
মেয়ে মহলে বই বেরোচ্ছে। ......”
এ রকমই -
“বেলা প্রায় দশটা। ছেলেরা ‘হো হো’ শব্দে বই হাতে ক’রে ইস্কুলে
চলেছে। কেরানী বাবুরা ফিট ফাট হয়ে পান চিবিয়ে, কেউ শেয়ারের গাড়ি,
কেউ ট্রামকারে চলেছেন। ট্রামওয়ের ধারে খুদে খুদে ছোঁড়ারা, পেন্সিল,
কাগজ আর পকেট বুক ঘুরে ঘুরে বেচ্ছে। অনাহুত আতুর ও অন্ধের দল পালে
পালে গাড়ির সামনে দাঁড়াচ্ছে, আর বলছে-“বাবুগো! অন্ধকে একটি পয়সা
দাওগো বা-বাঃ!” অনেক ঘড়ি চেনওয়ালা মাতব্বর বাবু, পাছে কিছু দিতে
হয় ব’লে, অমনি মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে চাইছেন। ......” ইত্যাদি।
এগুলি পড়ে সকলেরই সেকালের ‘আলালের ঘরের দুলাল’ (১৮৫৮), ‘হুতোম
প্যাঁচার নকশা’ (১৮৬২) বা এই ধরণের অন্যান্য বইয়ের কথা মনে পড়বে।
বস্তুতঃ বর্তমান বইটিকে কোন কোন সমালোচক নক্সা হিসাবেই চিহ্নিত
করেছেন। তবে সবটা নয়।
একটা প্রশ্ন থেকেই যায়। পুস্তকে বর্ণিত প্রেম কাহিনীটি কি পুরোটাই
লেখকের কল্পনাপ্রসূত? না কি, সত্যি এ ধরণের কিছু ঘটেছিল ? নাম
নিশ্চয়ই পরিবর্তিত হয়েছে। তবে লেখকের লেখা পড়ে তার মানসিকতা সম্বন্ধে
যে ধারণা গড়ে ওঠে, তাতে মনে হয় কাহিনীটা সবটাই কাল্পনিক নাও হতে
পারে। অন্তত আমার তাই মনে হয়েছে। আজ আর এটা যাচাই করে দেখার কোনো
উপায় নেই।
বইটির নাম ‘সচিত্র কলকাতার কাহিনী’ হলেও চিত্র রয়েছে মাত্র একটি।
আখ্যাপত্রের ঠিক পরেই রয়েছে সেটি। একদল লোক কোন একটি সেতুর উপর
দাঁড়িয়ে দূরে চিমনি থেকে ধোঁয়া বের হওয়া ও অট্টালিকা শোভিত ‘আধুনিক
হয়ে ওঠা’ কলকাতার দৃশ্য আস্বাদন করছে। প্রচ্ছদে রয়েছে সেকালের
পটে আঁকা ধরণের একটি চিত্র।
পরিশেষে ধন্যবাদ জানাতে হয় লেখক গবেষক বারিদবরণ ঘোষকে। বইটি লোকচক্ষুর
অন্তরালেই চলে গিয়েছিল। তিনি পুরানো একটি কপি বেলুড় পাবলিক লাইব্রেরী
থেকে উদ্ধার করে পুনঃর্মুদ্রণের ব্যবস্থা করেছেন। বইটির প্রকাশক
‘পরশপাথর’, সে সময়ের দাম দেড় টাকা হলেও এখন দক্ষিণা দেড়শ’ টাকা।
লেখক পরিচিতি : বহু বছর বি.ই. কলেজে (এখন ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, শিবপুর ( IIEST,shibpur )) অধ্যাপনা করেছেন। কিছুদিন হল অবসর নিয়েএখন সেখানে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে আছেন। অ্যাপ্লায়েড মেকানিক্স নিয়ে গবেষণা করলেও একাধিক বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে - জ্যোতিষশাস্ত্র, পুরনো কলকাতার সংস্কৃতি, ইত্যাদি। অবসর সময়ে 'অবসরে'র সঙ্গে সময় কাটান।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।