প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

কান পেতে রই...

অবসর (বিশেষ) সংখ্যা , ডিসেম্বর ৩০, ২০১৪

 

বেতারের নানারকম

আনন্দ দাশগুপ্ত

 

এক

বেতারে সঙ্গীত শিক্ষার আসর

কলকাতার রেডিও স্টেশনটির সূচনাপর্বে পঙ্কজ মল্লিক ও রাইচাঁদ বড়াল দেখতেন সঙ্গীত বিভাগ, রাজেন সেন সংবাদ বিভাগ, যোগেশ বসু ছিলেন গল্পদাদু, বৈদ্যনাথ ভট্টাচার্য ওরফে বাণীকুমার ছিলেন গীতিকার-ভাষ্যকার আর বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র ছিলেন সাহিত্য, নাটক ও বিচিত্র বিষয়াদিতে। ১৯৩২ সালে দুর্গাপূজা উপলক্ষে আরম্ভ হয়েছিল অনুষ্ঠান 'মহিষাসুর মর্দিনী।' কালজয়ী এই অনুষ্ঠানের সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন পঙ্কজ কুমার মল্লিক, ভাষা স্ক্রিপ্ট আর গীতরচনার দায়িত্বে ছিলেন বৈদ্যনাথ ভট্টাচার্য এবং চন্ডীপাঠের দায়িত্বে ছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ৪৪ বছর জনপ্রিয়তার সঙ্গে চলেছিল উদযাপিত এই অনুষ্ঠানটি। ১৯২৯ সালের শেষের দিকে পঙ্কজ মল্লিক কলকাতা বেতারের আর একটি ঐতিহাসিক অনুষ্ঠান সঙ্গীত শিক্ষার আসর পরিচালনা শুরু করেছিলেন। এটা ছিল সঙ্গীতশিল্পী তৈরির একটা কারখানা। পঙ্কজ তাঁর স্মৃতিচারণকালে সঙ্গীত শিক্ষার আসরে তাঁর সুরে অলক গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা প্রথম গানটির সুর কিংবা কথা স্মরণ করতে পারেননি। তবে দ্বিতীয় গানটি ছিল কাজী নজরুল ইসলামের 'মোর ঘুম ঘোরে এলে মনোহর/নমো নম, নমো নম, নমো নম।' আসরে অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত এবং দ্বিজেন্দ্রলালের গানও শেখানো হতো। এছাড়াও তাঁর শিক্ষার সহস্রাধিক গানের তালিকায় ছিল পদকীর্তন, শ্যামাসঙ্গীত, পল্লীসঙ্গীত, দেশাত্মবোধক সঙ্গীত, আনুষ্ঠানিক গান তুলসীদাস, সুরদাস, গুরু নানক, মীরাবাঈ প্রমুখের হিন্দী ভজন। দীর্ঘ ৪৭ বছর ধরে রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রচারে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল এই আসর।

দুই

এই ওয়ান্ডার বক্সে (টিভি যে যুগে একটা ধারণামাত্র, তখন বেতার যন্ত্রকে তা-ই মনে হত) যা কিছু প্রচারিত হচ্ছে তাই শোনার প্রবণতা ছিল। তাই মূলত পল্লির কৃষিজীবীদের জন্য প্রচারিত অনুষ্ঠানও সর্বসাধারণের চিত্ত বিনোদন করত। তা ছাড়া ঢাকঢোল বাজিয়ে দু’পক্ষের তরজা লড়াই, পল্লিগীতি, কীর্তন (ছবি বন্দ্যোপাধ্যায়, কৃষ্ণচন্দ্র দে প্রমুখ) রম্যগীতি (বাংলা এবং হিন্দিতে, যেমন ‘জননী তেরি জয় হো’), এ মাসের গান, সঙ্গীত শিক্ষার আসরে পঙ্কজকুমার মল্লিকের রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষাদান (‘ও আমার দেশের মাটি’ কিংবা ‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে’), মার্গসঙ্গীত এবং অবশ্যই অনুরোধের আসর জনপ্রিয় ছিল। নীলিমা সান্যালের মতো বলিষ্ঠ এবং পরিচ্ছন্ন উচ্চারণে সংবাদপাঠ, সবিনয় নিবেদন-এ শ্রোতাদের চিঠিপত্রের উত্তরদান, ইন্দিরা দেবীর শিশুমহল (কখনও তাতে শিশুদের নাটকও হত, যেমন ‘লক্ষ্মণের শক্তিশেল’), যন্ত্রসঙ্গীত, আরও অনেক কিছু রেডিওকে একটি অন্যতম জনপ্রিয় গণমাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল।

জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এমপিথ্রি ফরম্যাটের মিউজিকও৷ তবে জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে এ সবগুলো মাধ্যমকেই বহুলাংশে ছাড়িয়ে গেছে হাল আমলের এফএম রেডিও৷ শুধুমাত্র রেডিওর সুবাদে বাংলা গানের যে বিস্তৃতি ঘটেছে সেই বিস্তৃতিটিও তাই অনেক বেশি করে চোখে পড়ার মতো৷ যদিও বাংলা গানের সার্বজনীন প্রসারে এফএম রেডিও’র এই কালচারটি যে স্বতন্ত্রভাবে একটি জায়গা দখল করে নিচ্ছে তা কিন্তু নয়৷ বরং আমাদের দেশের এফএম স্টেশনগুলো তাদের সহযোগী মনোভাব নিয়েই দেশীয় সংগীতের সামগ্রিক বিকাশে সহায়ক ভূমিকা রাখবার চেষ্টা করছে৷

তিন

বেতারের নাটক –কয়েক জনের কথা

অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়

বাংলা থিয়েটারে অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম জুড়ে গিয়েছিল শম্ভু মিত্র এবং উৎপল দত্তের সঙ্গে। একের পর এক মঞ্চসফল প্রযোজনার পাশাপাশি চলচ্চিত্র, যাত্রা, রেডিও— অভিনয় শিল্পের প্রতিটি মাধ্যমেই নিজের প্রতিভার ছাপ রেখেছেন তিনি। নাট্যকার হিসেবেও তিনি খ্যাত। বাংলা নাট্যমঞ্চে তিনি, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় এখনও মিথ।

ষাটের দশক থেকে তিনি সিনেমাতেও অভিনয় করা শুরু করেন অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়। সব মিলিয়ে তাঁর অভিনীত চলচ্চিত্রের সংখ্যা পঞ্চাশের কাছাকাছি। এর মধ্যে কয়েকটি হিন্দি ছবিও আছে। তপন সিংহ, নবেন্দু চট্টোপাধ্যায়, দীনেন গুপ্ত, অরুন্ধতী দেবী, মৃণাল সেন, জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায়, রবি ঘোষ, তরুণ মজুমদার ছাড়াও আরও অনেক পরিচালকের নির্দেশনায় তিনি সিনেমায় অভিনয় করেন। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘গণদেবতা’র চলচ্চিত্রায়ণ করেন তরুণ মজুমদার। সেই ছবিতে অজিতেশের অভিনয় অবিস্মরণীয়। বৃহত্তর বাঙালি সমাজের কাছে অজিতেশ ছিলেন মূলত সিনেমার অভিনেতা।  অভিনয় শিল্পের আরও একটা মাধ্যম রেডিওতেও প্রচুর কাজ করেছেন অজিতেশ। প্রথাগত অভিনয়ের বাইরে চরিত্র নিয়ে ভেবে সংলাপ উচ্চারণ করতেন অজিতেশবাবু। আঞ্চলিক ভাষার অভিনয়ে ওঁর কাছাকাছি কেউ ছিলেন না।

মন্মথ রায়

মন্মথ রায়ের পিতামহ গুরুগতি ছিলেন পুলিশ ইনস্পেকটর। বালুরঘাটে রায় পরিবারের বসত ভিটে ‘বরদাভবন’ ছিল তার পিতামহী বরদাসুন্দরীর নামানুসারে। এখানে থাকাকালীন মন্মথর লেখা নাটকের পাতায় থাকত বরদাভবনের নাম। ১৯২৩ সালে তপোবালাদেবীর সঙ্গে বিয়ে হয় মন্মথবাবুর। স্ত্রীকে অবশ্য তিনি ‘চিত্রলেখা’ নামেই ডাকতেন। তাদের চার সন্তান— জয়ন্তী, প্রদীপ, চন্দন ও কুমকুম। রায় পরিবার ছিল কালী ভক্ত। মন্মথবাবুর জীবনে, এমনকী তার রচনাতেও সে প্রভাব লক্ষণীয়। শ্রীরামকৃষ্ণ, সারদামণি ও স্বামী বিবেকানন্দকে নিয়ে লেখা নাটক তার যথেষ্ট প্রমাণ বহন করে। তাঁর লেখা একাঙ্ক নাটকের সংখ্যা প্রায় ২০৪টি। ‘লোকরঞ্জন শাখা’র জন্য লেখা নাটকের সংখ্যা ১০টি ও সিএপির জন্য ৪টি। চলচ্চিত্রের জন্য লেখা চিত্রনাট্য ও কাহিনি— ‘চাঁদ সদাগর’, ‘মহুয়া’, ‘শুভত্রহ্যস্পর্শ’, ‘অভিনয়’, ‘খনা’, ‘কুমকুম’, ‘রাজনর্তকী’, ‘মীনাক্ষী’, ‘যোগাযোগ’, ‘অলকানন্দা’, ‘ঝড়ের পরে’, ‘চিত্রাঙ্গদা’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ক্ষুধিত পাষাণ’-এর চিত্রনাট্যও তাঁর লেখা। আকাশবাণীর বেতার নাটক প্রায় ৪০টি — বুড়িবালামের তীরে, সারদামণি, রঘু ডাকাত, সাঁকো, চরৈবেতি, কনে দেখা, আত্মহত্যা, জেল, কুকুরবেড়াল, দুর্গেশনন্দিনীর জন্ম ইত্যাদি। শ্রেণি ভাঙার উল্লেখ প্রথম দেখা যায় তার ‘কালীবাড়ি’ নাটকে। এ ছাড়া অন্যান্য সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তিনি নাটক রচনা করেছেন— ধর্মঘট, সাবিত্রী, অশোক, মির কাসিম, খেলা, জীবনটাই নাটক, লালন ফকির ইত্যাদি।

বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র

আকাশবাণী কলকাতার প্রচারিত নাটকগুলো আজ বাঙ্গালীর এক পরম গর্বের ধন। তখন কলকাতায় দূরদর্শন আসেনি। ক্যাসেট বা টেপ রেকর্ডার তখনও বাজারে সেভাবে আসেনি। শুধুমাত্র স্পুল টেপ রেকর্ডার আকাশবাণীতে এবং কলকাতার কিছু মাত্র বাড়ীতে ছিল। গান শোনার জন্য ছিল ৭৮ স্পীডের রেকর্ড আর ছিল ভালভ সেটের রেডিও। নাটক শোনার জন্য ছিল শুধুমাত্র আকাশবাণী কলকাতা। তাই আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রের নাটকের আর্কাইভ আজ অতি মূল্যবান যদিও তা ব্যাপকভাবে প্রচার এবং বিক্রি করায় আকাশবাণী কলকাতার প্রভূত অনীহা। আকাশবাণী কলকাতার নাটকের ইতিহাসে যে মানুষটির অবদান অনস্বীকার্য তাঁর নাম শ্রী বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র।

জগন্নাথ বসু’র ‘বেতারের কথকতা এবং’ পড়তে-পড়তে ফিরে যাই সেই সময়ে, জানতে পারি আমার ভাল লাগা অনেক নাটকের প্রযোজক ছিলেন তিনি। আরও জানতে পারি সে সব নাটক প্রযোজনার নেপথ্য কাহিনীও কম নাটকীয় ছিল না মূল নাটকের চেয়ে। আমার ক’জন প্রিয় শিল্পীর কণ্ঠবৈশিষ্ট্যের প্রায় নিখুঁত বর্ণনা দিয়েছেন জগন্নাথ বসু — “রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তের ভরাট কণ্ঠস্বরে রোম্যান্টিক অভিনয়, নির্মলকুমারের স্মার্ট উচ্চারণ, সুন্দর বাচনভঙ্গি, শেখর চট্টোপাধ্যায়ের জলদগম্ভীর কণ্ঠস্বরে খলনায়কের পার্ট, নীলিমা দাস ও কণিকা মজুমদারের মানসিক টানাপড়েনের অনবদ্য চরিত্রায়ণগুলো আজও সজীব হয়ে আছে মনে।... নীলিমা দাসের গলায় ছিল বিষাদ, রোমান্টিকতা, আভিজাত্য, গভীরতা, অন্যদিকে লাস্যময়ী ঝুমুরওয়ালির ভাবসাবও।... গলা দিয়ে বিভিন্ন বয়স, মুড প্রকাশ করাটা শ্রীমতী দাসের কাছে সবসময়ই থ্রিলিং ব্যাপার।... মঞ্জু দে আর বিনতা রায়ের পরিশীলিত বাচনভঙ্গি, ব্যক্তিত্ব আর বুদ্ধিদীপ্ত ভাবটা ছিল বেশি। শ্রীমতী দে-র প্রতিটি সংলাপ উচ্চারণ স্বাভাবিক, অর্থবহ।... পরিশীলিত উচ্চারণ ও সুকণ্ঠের জন্য খ্যাতি ছিল অনুভা গুপ্তর।... বনানী চৌধুরীর... কণ্ঠেও ছিল আভিজাত্য। সবিতা বসু’র গলার আদুরে ভাব, বাসবী নন্দীর স্নিগ্ধতা, মীনাক্ষী গোস্বামীর ব্যক্তিত্ব, শিপ্রা মিত্রের খসখসে অল্প ধরা ধরা ভাব,... শেফালি দে, মিতা চট্টোপাধ্যায়ের উচ্চারণে আঞ্চলিক ভাষা প্রাণবন্ত হয়ে উঠতো।...”

রক্তকরবীর প্রসঙ্গ

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি রূপক-সাংকেতিক নাটক রক্তকরবী। প্রবাসী পত্রিকার আশ্বিন, ১৩৩০ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়। গ্রন্থাকারে প্রথম প্রকাশ ইংরেজি ১৯২৬ সালে। অনেকের মতে এটি রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ নাটক। সমালোচক শিশিরকুমার দাশের ভাষায়, “মানুষের প্রবল লোভ কীভাবে জীবনের সমস্ত সৌন্দর্য ও স্বাভাবিকতাকে অস্বীকার করে মানুষকে নিছক যন্ত্রে ও উৎপাদনের উপকরণে পরিণত করেছে এবং তার বিরুদ্ধে মানুষের প্রতিবাদ কীরূপ ধারণ করেছে তারই রূপায়ণ এই নাটকে।” বহুরূপী নাট্যগোষ্ঠী বহুবার সফলভাবে এই নাটক মঞ্চস্থ করেছে। রাজাচরিত্রে বিশিষ্ট নট শম্ভু মিত্র ও নন্দিনী চরিত্রে তৃপ্তি মিত্রের অভিনয় আজ প্রবাদপ্রতিম। আকাশবাণী থেকে শম্ভুমিত্র-তৃপ্তি মিত্র অভিনীত এই নাটকের একটি অডিও রেকর্ডও প্রকাশ করা হয়।

বেতারে প্রথম বাংলা নাটক-

কলকাতা বেতারে প্রথম বাংলা নাটক প্রচারিত হয় ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদের লেখা ‘নরনারায়ণ’ ১৯২৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর রাত ৮টা ৪৫। নাটকটির নির্বাচিত অংশের ও কর্ণের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন শিশির ভাদুড়ী। একবার রেডিওতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বৈকুণ্ঠের খাতা’ নাটকটি অভিনীত হয়। সেখানে অভিনয় করেন বিভিন্ন লেখক। যেমন, প্রমথনাথ বিশী, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, মনোজ বসু, সজনীকান্ত দাস, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র ও পরিমল গোস্বামী। নামকরা সাহিত্যিকদের গল্প-উপন্যাসের নাট্যরূপ, দেশ-বিদেশের ধ্রুপদী কাহিনি বারবার সম্প্রচার করেছে বেতার। যা থেকে উপকৃত হয়েছেন বহু নিরক্ষর ও দৃষ্টিহীন মানুষ। যাঁরা কোনও দিন বই খুলে পড়তেন না, তাঁরাও জানতে পেরেছেন ধ্রুপদী সাহিত্যকে, শুধুমাত্র বেতারের জন্য।

ইথার তরঙ্গে ভেসে আসত কিংবদন্তি অভিনেতাদের স্বর্ণকণ্ঠ। বৃহস্পতি, শনি, রবিতে হাততালির বন্যা বইয়ে যাঁরা দর্শকদের মাত করে দিতেন, তাঁরাই আসতেন শুক্রবার রাতে রেডিও স্টেশনের স্টুডিয়োতে। ষাট-সত্তর দশক-এ এলেন আরেক দল অভিনেতা। যাঁদের বেতার অভিনয় বাঙালিরা আজও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। যেমন নির্মলকুমার, জয়ন্ত চৌধুরী, নীলিমা দাস, কালী বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রেমাংশু বসু, বীরেশ্বর সেন, শুক্লা বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘আজকের নাটক’ শুক্রবার, শনিবার, রবিবার আর মাসের শেষ বৃহস্পতিবার (লং প্লে) বাঙালি শ্রোতাকে নাড়িয়ে দিয়েছিল, গত কয়েক দশক ধরে। কারণটা আর কিছুই নয়, কিছু সৃজনশীল মানুষের নিত্য অনুসন্ধান ছিল এই মাধ্যমটিকে জানতে, বুঝতে। শুধু অভিনয় কেন, এফেক্টস, মিউজিক এসবের জন্য তাঁরা কী অমানুষিক পরিশ্রম করেছিলেন, তার কোনও ইয়ত্তা নেই। আকাশবাণী কলকাতা – তার জন্মলগ্ন থেকেই কণ্ঠ বা বাচিক শিল্পের জগতে এক যুগান্তকারী অধ্যায় শুরু করেছিল। তার মধ্যে বাংলা নাটক প্রচারে এক অনন্য ভুমিকা পালন করে এসেছে। আকাশবাণী কলকাতার প্রথম ‘drama like’ অনুষ্ঠান ‘Micro Drama’ প্রচারিত হয় ৩ রা সেপ্টেম্বার রাত ৯ টা ৪৫ মিনিটে। ১৯২৭ সালের শেষদিকে উত্তর কলকাতার শ্যামবাজারের একটি ক্লাব – “চিত্রা সংসদ” এর ডাক পড়ে আকাশবাণী কলকাতায় একটি নাটক প্রচার করার জন্য। এই ক্লাবটিতে সেই সময় যে সকল সদস্যরা ছিলেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সর্বশ্রী বাণীকুমার, পঙ্কজ কুমার মল্লিক, সিতাংশুজ্যোতি মুখোপাধ্যায়, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, হীরেন বসু এবং অসমঞ্জ মুখোপাধ্যায়। তাঁরা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের “দায়ে পড়ে দারগ্রহ” নাটকটি প্রচার করেন। এরপর তাঁরা “Radio Drama Group” গঠন করেন। ঐ সময় যে সকল নাটক প্রচারিত হতো আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র থেকে – তা সবই সরাসরি সম্প্রচারিত হতো। প্রথম দিকের নাটকগুলির প্রচারিত সময় ছিল মাত্র কুড়ি কিংবা পঁচিশ মিনিট মাত্র। এরপর শুধুমাত্র শুক্রবারে রাত ৮ টার সময় তিন ঘণ্টা সময় বরাদ্দ হল। ১৯৩৭ থেকে প্রায় সব নাটকেরই প্রযোজনা করেছিলেন শ্রী বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। এবং প্রচুর নাটকে তিনি অভিনয়ও করেছিলেন।

শেষ কথা- আমি ও  আকাশবাণী কলকাতা

সে অনেককাল আগের কথা। তখন থাকি পাটনায়। একদিন খবর পেলাম, আমার স্বরচিত কবিতা পাঠের জন্য আকাশবাণী কলকাতার যুববাণী বিভাগে আমি মনোনীত হয়েছি। সময় দেওয়া হয়েছে পনেরো মিনিট। সেটা ১৯৭১ সাল। খুব উত্তপ্ত সময় সেটা। যাই হোক  একজন তরুণ কবির জন্য এ ছিল বেশ শ্লাঘার বিষয়- বিশেষ করে দূর প্রবাসে। নিজের বন্ধুদের মধ্যে আমি হিরো হয়ে গেলাম।

কলকাতায় গেলাম, উঠলাম মামার বাড়িতে। পরদিন নির্ধারিত দিনে গেলাম আকাশবাণী ভবনে। তখেনো নেতাজী ইনডোর হয়নি। হালকা গঙ্গার হাওয়া ভেসে আসত। তখন যুববাণী বিভাগের কর্ণধার ছিলেন কবি কবিতা সিংহ। তাঁর সঙ্গে দেখা করতে হল। আমি মুগ্ধ- এই প্রথম একজন প্রতিষ্ঠিত কবিকে দেখে। তার আগে অবশ্য পাটনায় বনফুলকে দেখেছি পাটনা  কালীবাড়ির  এক ঘরোয়া  অনুষ্ঠানে। দেখেছি বিমল করকেও। পাটনায়  আমার ডাক্তার মামার বিশিষ্ট বন্ধু ছিলেন তিনি। সে কথা তাঁর ‘উড়ো খই’ নামক স্মৃতি কথায় লিখেছেন বিমল কর। তাছাড়া সেই তরুণ বয়সে পেয়েছিলাম বাংলা সাহিত্যের নতুন একজনকে। রোগা মত, লাজুক সেই মানুষটি শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। তাঁর লেখা ঘুণপোকা তখন জাস্ট পড়েছি। সেও  ছিল পাটনা  কালীবাড়িরই  এক ঘরোয়া অনুষ্ঠান।

আবার ফিরে আসি অকুস্থলে। কবিতাদি অনুমতি দিলে চলে গেলাম এক যুবকের কাছে। এক মাথা চুল, প্রাণচঞ্চল এবং কাজেনিবেদিতপ্রাণ সেই তখনকার জগন্নাথ বসু নিজে আমাকে ডেকে নিলেন রেকর্ডিং রুমে। বেরিয়ে তাঁকে ও কবিতাদি কে ধন্যবাদ জানালাম। রিসেপশান থেকে একটা  চেক পেয়েছিলাম- পনেরো টাকার।

এভাবেই আমার স্মৃতিতে আজো উজ্জ্বল হয়ে আছে আকাশবাণীর জগৎ।    


লেখক পরিচিতি - ডঃ আনন্দ দাশগুপ্ত - প্রথম জীবন কেটেছে প্রবাসে, পাটনাতে। ১৯৮৬ সাল থেকে বিভিন্ন গবেষণা সংস্থায় অধ্যাপনায় রত, বর্তমানে ব্যাঙ্গালোরে একটি সরকারী সংস্থায় কর্মরত। সাহিত্যের প্রতি ভালবাসা থেকে লেখালেখি শুরু অনেকদিন ধরেই। প্রকাশিত হয়েছে কবিতার বই, এছাড়া বিভিন্ন প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে বেশ কিছু পত্র-পত্রিকাতে, এই সময়, কৃত্তিবাস, ইত্যাদি। সম্পাদিত গ্রন্থ - স্বাধীনতা।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।