প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

কান পেতে রই...

অবসর (বিশেষ) সংখ্যা , ডিসেম্বর ৩০, ২০১৪

 

মাঠের কথকতা-

ভাস্কর বসু

 

আমরা যারা ষাটের দশকে বড় হয়েছি এবং বেড়ে উঠেছি একটু মফস্বলের দিকে, রেডিও আমাদের কৈশোরে এক অদ্ভুত আনন্দের উৎস ছিল। সেই সময় আমাদের সেই মফস্বলে খুব চল ছিল নাটক, যাত্রা, ম্যাজিক শো বা সার্কাসের। কিন্তু তারা ছিল ‘ক্ষণিকের অতিথি’, পুজোর ছুটিতে বা শীতের সময়। রেডিও ছিল সর্বক্ষণের সঙ্গী। সবসময় গুরুজনদের অনুমতি না থাকার দরুন অবশ্য সুযোগ একটু কম থাকত, কিন্তু যেটুকু পাওয়া যেত চুটিয়ে উপভোগ করে নিতাম। নাটক বা বিজ্ঞাপনদাতাদের অনুষ্ঠানে অনেক সময় প্রাপ্তবয়স্ক ব্যাপার থাকত, কিন্তু খেলার ক্ষেত্রে ছিল অবাধ ছাড়। বড়রাও তখন খেলা নিয়ে মাতামাতি করতেন, তাই সেই সুযোগ নিয়ে আমরাও ঝাঁপিয়ে পড়তাম। কলকাতায় না থাকার জন্য আমাদের চট করে টেস্ট ক্রিকেট বা ফুটবলের বড় ম্যাচ দেখার সুযোগ থাকত না, ওই ধারাবিবরণীই আমাদের কাছে ছিল খেলার আকাশ।

আমাদের সময় ট্রানজিস্টর রেডিও বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। ছোট, বড়, মাঝারি, বর্গাকার, আয়তাকার – বিভিন্ন আকারের। ফিলিপস-এর, মার্ফি ব্র্যান্ড-এর সেই শিশুটির ছবিওলা বিজ্ঞাপনের কল্যাণে যন্ত্রটি তখন বাড়িতে বাড়িতে শোভা পাচ্ছে। আমাদের একটা অদ্ভুত অভ্যাস ছিল – আমাদের নিজেদের যখন খেলা হত, তখনও মাঠের একপাশে রেডিওতে অন্য খেলা শোনা হত। এই নিয়ে বিভ্রান্তিও কম হতনা। ক্যাচ উঠেছে বাউন্ডারির ধারে, ফিল্ডার সেইদিকে মন দেবে না কমেন্ট্রিতে কি হল তা শুনবে!! অন্যরা চেঁচাচ্ছে – তুমুল গন্ডগোলে ক্যাচ পড়ে গেল – অন্য ফিল্ডাররা তার মুন্ডুপাত করতে করতে এগিয়ে এসে দাঁড়িয়ে খেলা শুনতে লেগে গেল। ব্যাস, খেলা বন্ধ - সব মিলিয়ে হৈ চৈ ব্যাপার। বিদেশের মাঠে যখন ক্রিকেট খেলা হত, ঐ ধারাবিবরণীর মধ্যেই আমরা সেই মাঠগুলিকে চিনতাম। লর্ডস, ওভাল, সিডনী, ব্রিসবেন, ওয়েলিংটন, সাবিনা পার্ক, করাচী – ঐ কমেন্ট্রি শুনতে শুনতেই কল্পনাতে দেখতে পেতাম ক্রিকেটের সেই তীর্থক্ষেত্রগুলিকে। প্রথম ক্রিকেটের স্মৃতি – বিল লরীর টিমের সঙ্গে পতৌদির টীমের খেলা (১৯৬৯) আর বিশ্বনাথের আবির্ভাব। এই ১৯৬৯ সালে অস্ট্রেলিয়া- ভারত সিরিজে এক বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন ইংরাজি ধারাভাষ্যকার দেবরাজ পুরী। মুম্বাইয়ের প্রথম টেস্টে বাঙালী আম্পায়ার শ্রী শম্ভু পান মশাই ভেঙ্কটরাঘবনকে আউট দিলেও দেবরাজ পুরীর মন্তব্য ছিল সেই সিদ্ধান্ত যথার্থ নয়। তখনকার দিনে মাঠে টেস্ট ক্রিকেট দেখতে ট্রানজিস্টার বগলদাবা করে নিয়ে যেতেন এমন লোকের অভাব ছিলনা। ব্যাস, গ্যালারীতে চিৎকার , চেঁচামেচি, হৈ-চৈ!! পরে পুলিশ এসে থামায়। এরপর থেকে মাঠে রেডিও নিয়ে ঢোকার ব্যাপারে বেশ কড়াকড়ি শুরু হয়। এর দু বছর পরে গাভাসকার আর ওয়াদেকারের স্মৃতি বিজড়িত ইংল্যান্ড ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ বিজয় (১৯৭১) যেন ক্রিকেটের পোকা করে তুলল।

এমনকি রনজি ট্রফি ও দলীপ ট্রফির ম্যাচগুলির কমেন্ট্রি শোনার জন্য আমাদের অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ ছিল। ক্রিকেটের ধারাভাষ্যে দুটি নাম ছিল খুব জনপ্রিয় – অজয় বসু ও কমল ভট্টাচার্য। অজয় বসুর গলাটি ছিল খুব সতেজ, পরিষ্কার, প্রাণবন্ত উচ্চারণে তিনি আমাদের ‘হিরো’ হয়ে উঠতে বেশী সময় নেননি। আমাদের বা তার পরের প্রজন্মের কাছে মাঠকে সরাসরি ঘরের মধ্যে নিয়ে আসতেন অজয় বসু। ক্রিকেট বা ফুটবল, দুটিতেই ছিল তাঁর অনায়াস দক্ষতা। ক্রিকেটে খেলা শুরুর সময় আমরা প্রতীক্ষাতেই থাকতাম, কখন ভেসে আসবে সেই সুমধুর কন্ঠস্বর – “ক্রিকেটের নন্দনকানন ইডেন উদ্যান থেকে বলছি অজয় বসু। আজ ভারত-অস্ট্রেলিয়ার টেস্টের প্রথম দিন --”। “কেতাবি কায়দায়”, “রক্ষণাত্মক ভঙ্গী”, “বাউন্ডারি সীমানা”, “ফিল্ডারদের গাফিলতির সুযোগে চুরি করে রান নেওয়া”, - ইত্যাদি মধুর শব্দবন্ধগুলি আমাদের মনে অসম্ভব দোলা দিত। পাড়ার খেলাতে আমরাও নিজেরা লেগে যেতাম এদের যথেচ্ছ প্রয়োগে।

কমল ভট্টাচার্য প্রাক্তন ক্রিকেটার – তাঁর কথকতার মধ্যে ছিল অদ্ভুত কিছু বাক্যবন্ধ – ‘পেছিয়ে এসে ব্যাক খেলেছেন’ বা ‘বা, বা, বা, ভারী সুন্দর বল’ – একটু মন্থরও ছিল তা। আমাদের প্রায়শই ধৈর্যচ্যুতি ঘটতো। আর একজন ছিলেন – পুষ্পেন সরকার – একটু সানুনাসিক হলেও তিনিও ছিলেন দ্রুত লয়ের কথক। একটা কথা অনস্বীকার্য – তখন যারা ধারাবিবরণীতে আসতেন তাঁদের শব্দ প্রক্ষেপণও ছিল সুন্দর, সেইসঙ্গে অনবদ্য শব্দ ও বাক্য নির্বাচন। এইসব বিষয়ে তাঁরা সম্ভবত: নিত্য চর্চায় থাকতেন, তাই দ্রুতগতিতেও তাঁরা যখন ধারাবিবরণী দিতেন, মানের বিশেষ হেরফের হত না। এখনও মাঝে মাঝে ধারাবিবরণী কানে আসে, কিন্তু গুণগত মানের তফাৎ বড়ই পীড়িত করে। সেই সময়ে বিশেষজ্ঞর ভূমিকাতে থাকতেন পঙ্কজ রায়। তাঁর ‘বকেয়া রান তুলতে পারল না’ আমাদের খুব মজা দিয়েছিল। তবে একবার বিশেষজ্ঞের ভূমিকাতে এসে ইতিহাস সৃষ্টি করে ফেললেন আরো প্রাক্তন এক ক্রিকেটার – শ্রী কার্তিক বসু।

সেবার ১৯৭৯ সালে ভারতীয় বংশোদ্ভূত কালীচরণের নেতৃত্বে একটি বেশ অনভিজ্ঞ ক্রিকেট দল ভারত সফর করছিল। তার আগের বছর কেরী প্যাকারের ওয়ার্ল্ড সিরিজ ক্রিকেটের উদ্ভব। সেখানে খেলার জন্য চুক্তিবদ্ধ থাকাতে  ওয়েস্ট ইন্ডিজের অধিকাংশ ক্রিকেটারই  স্বদেশের হয়ে খেলতে পারেননি। সেই দলের সঙ্গে খেলার জন্য বিষেণ সিং বেদীর হাত থেকে ভারতীয় দলের অধিনায়কত্ব অর্পিত হল সুনীল গাভাসকারের ওপর। তখন বেদীর শারীরিক  অবস্থা খুবই  খারাপ, ফিল্ডিং করতে পারেন না বললেই চলে – স্লিপে তিনি ক্যাচ ফেললেন আর উত্তেজিত  কার্তিকবাবু বললেন – “এ কি বোলার, এর যা অবস্থা তাতে তো একে হাল্কা রোলার রূপে পিচে ব্যবহার করা যেতে পারে”!! তুমুল বিতর্ক হয় এবং পরদিন তিনি ভুল স্বীকার করে নেন। তবে ঐ কৈশোরে যখন আমরা খেলা নিয়ে উন্মত্ত, তাঁর উষ্মার যথার্থতা আমাদের কাছে খুবই গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছিল।

বিদেশে বা কলকাতার বাইরে ক্রিকেট খেলা চলাকালীন একই সঙ্গে হিন্দি আর ইংরেজি কমেন্ট্রি হত -   আমাদের হিন্দি ভাষা শিক্ষার মূল ছিল ঐ কমেন্ট্রিই। আমাদের হিন্দি গান শোনা বা হিন্দি সিনেমা দেখা ছিল নিষিদ্ধ, ছিলনা টেলিভিশন ও তার প্রসিদ্ধ ন্যাশনাল  নেটওয়ার্ক। সুতরাং, নবলব্ধ ‘বল্লা ঘুমানা’ ‘গেন ফেকনা’ ‘পুরীতরহ্ চুকে’, ‘টপ্পা খানেকে বাদ’, ‘পহেলী বারি’, ‘বাহারি কিনারা’ - এই সব শব্দবন্ধ আমাদের কিশোর কানে বেশ অভিনব আর মজার লাগতো!! ‘গেন অফ স্টাম্প কি কাফি বাহার’ আর ব্যাটসম্যানের  ‘খাড়ে খাড়ে বল্লা ঘুমানা এবং ফলস্বরূপ ‘পহলা উইকেট গিরা চেতন চৌহানকে রূপ মে’!!  সে এক অন্য অনুভূতির জগৎ! হিন্দি কমেন্টেটরদের মধ্যে মনে পড়ে রবি চতুর্বেদীর নাম; আরো ছিলেন যোগা রাও বা যশদেব সিং। পরে যোগ দিলেন সুশীল দোশী, মনীষ দেব প্রমুখরা। আমরা বিভিন্ন কমেন্টেটরের সময় আর সেই সময়টুকু ভারতের কতক্ষণ অনুকূল তা হিসেব করে রায় দিতাম, কোন কমেন্টেটর কতখানি ‘পয়া’ বা ‘অপয়া’!! খুব খারাপ অবস্থায় যদি অপয়া কমেন্টেটর আসেন, তাহলে কমেন্ট্রি বন্ধ করে দেওয়াই শ্রেয়। খুব আনন্দের কথা মধ্যপ্রদেশ ক্রিকেট এসোসিয়েশন তাঁদের কমেন্ট্রি বক্সকে সুশীল দোশীর নামে চিহ্নিত করে তাঁকে যথাযোগ্য মর্যাদা দান করেছেন।    

আমরা যারা বাংলা মাধ্যমে পড়াশোনা করেছি, তাদের কথ্য ইংরাজি শিক্ষার পেছনেও ঐ ইংরাজি কমেন্ট্রির বড় ভূমিকা রয়ে গেছে। আমরা তখন ইংরেজি সিনেমাতে খুব অভ্যস্ত ছিলাম না, দূরদর্শনের তো বালাই ছিলনা, আজকালকার মত এত ইংরেজি মাধ্যম স্কুল বা ইংরেজি অনুষ্ঠানের ছড়াছড়ি ছিলনা, কাজেই আমাদের কথ্য ইংরেজির প্রতি সেরকম আকর্ষণও ছিল না, বরং খুবই প্রারম্ভিক দুর্বলতা ছিল। ঐ ইংরেজি কমেন্ট্রি শোনাই ছিল একমাত্র কথ্য ইংরেজি শেখার উৎস। বেরী সর্বাধিকারী, পিয়ার্সন সুরিটা বা দেবরাজ পুরী – এঁরা ছিলেন কমেন্টেটর আর বিশেষজ্ঞ কমেন্টেটরের ভূমিকাতে থাকতেন, লালা অমরনাথ আর ভিজি। পরের দিকে যোগ দিলেন – আনন্দ শেতলওয়াড়, ডিকি রত্নাগর, নরোত্তম পুরীরা। ১৯৭৫-৭৬ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল ভারতে এল ক্লাইভ লয়েডের নেতৃত্বে, সে দলেও একজন কমেন্টেটর ছিলেন – টনি কোজিয়ার। তিনিও ভারতে ধারাবিবরণী দিয়ে বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেটের ধারাভাষ্যকার ছিলেন বিখ্যাত ক্রিকেটার রিচি বেনো!! তিনি সর্বকালের সর্বসেরা অধিনায়কদের মধ্যে পড়েন। ধারাভাষ্যকার হিসেবেও তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে ফেলেন অচিরেই। পরবর্তী ধারাভাষ্যকাররা তাঁর কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছেন। নরোত্তম পুরী তাঁর ধারাভাষ্য জীবনের সবচেয়ে লজ্জাজনক ঘটনার কথা লিখেছেন এই ভাবে – “ "I realized when in the highlights I saw myself in a red pullover (accentuating the effect) standing in commentator box with a mike and speaking at the top of my voice. And Richie Benaud's succinct remark was - here goes an excited Indian commentator sending the good news back home.";

এই  ঘটনাটি খুবই শিক্ষাপ্রদ ছিল। এরপর তিনি বুঝতে পারেন মাঠে ধারাভাষ্যকারদের নিজেদের আবেগকে সম্বরণ করাই বাঞ্ছনীয়।

বিদেশে খেলা চলাকালীন উজ্জ্বল স্মৃতি বেশ কয়েকটি – তার মধ্যে একটি হল ১৯৭৬ সালে ভারত যখন ৪ উইকেটে ৪০৬ করে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে তাদের মাটিতে হারাল !! এর ধারাবিবরণীটি আমরা সরাসরি শুনতে পাইনি, শুনেছিলাম পরদিন সকালে, যখন আমরা জানতাম, ভারত এক অবিশ্বাস্য জয় পেয়েছে। আমদের দুই প্রিয় ক্রিকেটার, সানি ও ভিশি, এই প্রথম একসঙ্গে শতরান  করেন। এত আত্মবিশ্বাস নিয়ে কোনদিন খেলা শুনেছি বলে মনে পড়ে না। আর একটি খেলা ছিল, ১৯৭৯ সালে – ইংল্যান্ডের মাঠে। সেই সিরিজে ভারত চারটি ম্যাচ খেলতে যায় – প্রথম টেস্টে ইনিংস পরাজয়। তারপর দুটি টেস্ট ড্র করে শেষ ম্যাচে চারশোর বেশী রান তাড়া করে প্রায় জিতে যাচ্ছিল। ওই ম্যাচের সময় আমাদের ওই ১৯৭৬ সালের পুরনো ম্যাচের স্মৃতি উদ্বেল করে দিচ্ছিল, পারবে কি ভারত, আরো একবার? গাভাসকারের অসাধারণ  ২২২ রানের ইনিংস –ইমরান খানের সেই পাকিস্তান ইনিংস এর অনুপ্রেরণাতে কপিলদেবকে আগে নামিয়ে পরীক্ষা ব্যর্থ, ফর্মে থাকা বিশ্বনাথকে সম্ভবত ভুল আউট দেওয়া হয়েছিল, ভেঙ্কটরাঘবন দুর্ভাগ্যজনকভাবে রান আউট হয়ে গেলেন – ভারত লক্ষের খুব কাছে এসেও শেষ রক্ষা করতে পারল না। মনে পড়ে ঐ ম্যাচটিতে যথাক্রমে ইংরেজি ও হিন্দিতে ধারাবিবরণীতে ছিলেন শ্রী আশিস রায় ও সুশীল দোশী । ধারাবিবরণীর মাধ্যমে মাঠের উত্তেজনা তাঁরা আমাদের কাছে একেবারে জীবন্ত করে পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। সুশীল দোশী তো একবার উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে  পরিষ্কার বলে দিয়েছিলেন – “শ্রোতাদের মধ্যে যদি কেউ হৃদ-রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি থাকেন, তাহলে তাঁদের চিকিৎসকেরা সম্ভবত: তাঁদের সুপরামর্শ দিচ্ছেন যে তাঁদের পক্ষে বেতার যন্ত্রটি বন্ধ করাই সমীচীন হবে”!! আমাদের সেই সময় অনেক কুসংস্কার ছিল, ওভার চলাকালীন কেউ স্থান পরিবর্তন করবে না, এমনকি ধরা যাক কোন ব্যাটসম্যান সেঞ্চুরির খুব কাছে এসে গেছেন আর কেউ চা খেতে যাচ্ছে, তাকে বারণ –‘আগে সেঞ্চুরি হয়ে যাক’!! উঃ, কি সাংঘাতিক ব্যাপার।

এই সময়, অর্থাৎ সত্তরের দশকের শেষাশেষি,  উল্লেখযোগ্য ব্যাপার ছিল আমাদের নয়নের মণি কপিলদেব এর অভ্যুত্থান – ধারাবিবরণীর সময় আবহে উচ্চ করধনি শোনা যেত – কমেন্টটর বলে বসতেন –“জোর হাততালির আওয়াজ তো আপনারা শুনতেই পাচ্ছেন,- আর আপনাদের অনুমান সঠিক, এখন ব্যাট করতে নামছেন কপিলদেব নিখঞ্জ”!!

তবে আজও যে স্মৃতি আমার কানে ভীষণভাবে উপস্থিত তা হল মোহনবাগান বা ইস্টবেঙ্গল এর বিভিন্ন ফুটবল খেলার কমেন্ট্রির স্মৃতি। অজয় বসু, পুষ্পেন সরকার তো থাকতেনই, তাঁদের সঙ্গে আরো থাকতেন প্রাক্তন খেলোয়াড়েরা – প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, সুকুমার সমাজপতি, সমর (বদ্রু) ব্যানার্জী  এনারা।

সুকুমার সমাজপতি ছিলেন উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতশিল্পী,  কণ্ঠ ছিল সুমধুর আর স্বর প্রক্ষেপণ ছিল অনবদ্য। শান্তভাবে তিনি খেলার যথাযথ বিবরণ দিতেন, তাঁর অভিজ্ঞতা অনুযায়ী সুন্দর যোগ করতেন। বিশেষ মতামতও বা কোন টিমের কি করা উচিত সেইমত ভাবনা চিন্তাও। সুকুমার তাঁর ধারাভাষ্য শুরু করেছিলেন অজয় বসুর হাত ধরে।  কিছুদিন আগে সুকুমার একটি সাক্ষাৎকারে  জানালেন যে ওঁকে অন্ধ ছেলেরা বলেছেন ওঁর ধারাবিবরণীতে যেন ওঁরা চোখের সামনে খেলা  দেখতে পেতেন। এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কি থাকতে পারে। 

তবে চমকপ্রদ কমেন্ট্রি করতেন শ্রী প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় – পিকে! পিকেকে যাঁরা কোচ হিসেবে মাঠে দেখেছেন, তাঁরা মনে করতে পারবেন যে তিনি কোচ হলেও একেবারে খেলার মধ্যে ঢুকে পড়তেন, মাঠে খেলোয়াড়দের সঙ্গে সঙ্গে প্রায় ছোটাছুটি করতেন। একবার বিপক্ষ কোচ অমল দত্তর সঙ্গে এই নিয়ে তাঁর খুব বিরোধ ও বেঁধেছিল। ১৯৭২ – ১৯৭৫, ইস্টবেঙ্গলের কোচ হিসেবে তিনি তখন খুবই সুখ্যাত। তাঁর ‘ভোকাল টনিক’ ময়দানে খুব আলোচ্য বিষয়। তাঁর ধারাবিবরণীর মধ্যেও কিন্তু এই ‘খেলার মধ্যে ঢুকে পড়া’ ব্যাপারটা দিব্যি ছিল।

খেলার মাঠের উত্তেজনা তাঁর কণ্ঠের মধ্যে দিয়ে আমাদের কানে আছড়ে পড়ত – যেমন ভুল পাস করলে তিনি বলে উঠতেন – ‘হায়, হায়, এই ভুল কেউ করে’ কিংবা দারুণ থ্রু পাস দিলে – “অপূর্ব পাস, ডিফেন্সের বুক চিরে –ওঃ, কিন্তু সেখানে কেউ নেই”!! সেই হতাশা বা স্ফূর্তি তাঁর গলায় যেন অদ্ভুত ভাবে ধরা দিত। সম্ভবত: তাঁর খেলোয়াড় বা কোচ সত্ত্বা যেন ছাপিয়ে উঠত তাঁর ধারাভাষ্যকার সত্ত্বাকে। সবচেয়ে মজা লেগেছিল কোন একজন ফরওয়ার্ড, সম্ভবত: সুভাষ ভৌমিক খুব সহজ সুযোগের সদ্ব্যবহার না করতে পারার জন্য তাঁর আক্ষেপপূর্ণ প্রতিবেদন – “কোন ডিফেন্ডার নেই, গোলকিপার মাটিতে পড়ে, সুভাষের পায়ে বল, ফাঁকা গোল – ওঃ, দুঃখের কথা আপনাদের  কি বলব, সেই বল কিনা সুভাষ বাইরে মারলেন”!! আমরা মনশ্চক্ষে দেখতে পেতাম যে কমেন্টারি বক্সে তিনি বোধহয় কপাল চাপড়াচ্ছেন বা চুল ছিঁড়ছেন!!

ভারী সুন্দর ছিল কিন্তু সেই দিনগুলো। চোখ ছিল খোলা আর কান দিয়ে আমরা শুনতাম, দেখতামও। গরমের দিনে খোলা মাঠে, আকাশভরা সূর্যতারার মধ্যে বসে কমেন্ট্রি শোনার অভিজ্ঞতাও যেমন মধুর আবার শীতকালে  ছাতে বসে রোদ পোহাতে আর পড়াশোনা করতে করতেও দিব্যি কমেন্ট্রি শোনা চলত।  ছোট্ট মাপের ট্রানজিস্টর রেডিও নিয়ে লেপের মধ্যে ঢুকে কমেন্ট্রি শোনারও বেশ একটা অন্যরকম অনুভূতি ছিল। বাইরের দেশে খেলা হলে সময়গুলো একটু অদ্ভুত থাকত – ইংল্যান্ডে খেলা হলে সারা সন্ধ্যে কমেন্ট্রি হত যা কিনা ছিল পড়ার সময়। তাও লুকিয়ে চুরিয়ে শোনা চলত। শীতকালে ছিল পরীক্ষা আর টেস্ট খেলাও চলতো ঐ সময় – পরীক্ষা দিতে দিতে আমরা দেখতে পেতাম শিক্ষকরা হয়তো টিচার্স রুমে বসে খেলা শুনছেন। পরীক্ষা শেষে আমরা খাতা জমা দিতাম, আর আমাদের উদ্বিগ্ন, শুকনো মুখ দেখে কোন শিক্ষক হয়তো দয়াপরবশ হয়ে বলে দিতেন – “ওরে, চিন্তা নেই রে, বিশ্বনাথ প্রায় সেঞ্চুরির কাছাকাছি”!! ব্যাস, আমাদের আর পায় কে – দৌড়, দৌড় -  টিচার্স রুমের দিকে। টিচার্স রুমের বাইরে থেকেও শোনা যেত কমেন্ট্রি – আর সেঞ্চুরি করিয়ে আমরা বাড়ীর দিকে হাঁটা লাগাতাম। বলতে বাধা নেই, খেলার প্রতি আমাদের আকর্ষণ বাড়াতে তখনকার বেতার ও তার ক্রীড়া-কথকঠাকুরদের ভূমিকা ছিল অসামান্য।


লেখক পরিচিতি - জন্ম কলকাতায়, বেড়ে ওঠা দক্ষিন চব্বিশ-পরগনার রাজপুর-সোনারপুর অঞ্চলে। ১৯৮৩ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইলেক্ট্রনিক্স ও টেলিকম্যুনিকেশন ইঞ্জিনীয়ারিং পাস করে কর্মসূত্রে ব্যাঙ্গালোরে। শখের মধ্যে অল্প-বিস্তর বাংলাতে লেখা - অল্প কিছু লেখা রবিবাসরীয় আনন্দবাজার, উনিশ-কুড়ি, নির্ণয়, দেশ, ইত্যাদি পত্রিকায় এবং বিভিন্ন ওয়েব ম্যাগাজিন (সৃষ্টি, অবসর, ইত্যাদিতে) প্রকাশিত।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।