কান পেতে রই...

অবসর (বিশেষ) সংখ্যা , ডিসেম্বর ৩০, ২০১৪
আকাশবাণীর বাণীকুমার
দীপক সেনগুপ্ত
সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকেই টেলিভিশন বিভিন্ন বাড়িতে স্থান পেতে শুরু করে; এখন এ যন্ত্রটি নেই এরকম বাড়ি খুঁজে পাওয়া শক্ত। যদিও তার আগে এক সময়ে রেডিওই ছিল খবর ও অন্যান্য অনুষ্ঠান সম্প্রচারের একমাত্র মাধ্যম, এখন সে দায়িত্ব পালন করছে টেলিভিশন। কোন অনুষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দৃশ্যের উপস্থিতি দর্শকমনকে আকৃষ্ট করে অনেক বেশি; সেজন্যই রেডিওর জৌলুষ এখন অনেকটাই স্তিমিত। হয়ত এর একমাত্র ব্যতিক্রম মহালয়ার ভোরে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’। টেলিভিশনের চেয়ে আকাশবাণীর এই অনুষ্ঠানটি এখনও লোকের কাছে অনেক বেশি প্রিয়। অনুষ্ঠানের শুরুটি -
মহিষাসুরমর্দিনী। রচনা ও প্রবর্তনা – বাণীকুমার। সঙ্গীত-সর্জন – পঙ্কজকুমার মল্লিক। গ্রন্থনা ও স্তোত্রপাঠ – বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র।
“আজ দেবীপক্ষের প্রাক-প্রত্যুষে জ্যোতির্ম্ময়ী জগন্মাতা মহাশক্তির শুভ আগমন-বার্ত্তা আকাশ-বাতাসে বিঘোষিত। মহাদেবীর পুণ্য স্তবনমন্ত্রে মানবলোকে জাগরিত হোক ভূমানন্দের অপূর্ব্ব প্রেরণা। আজ শারদ গগনে-গগনে দেবী ঊষা ঘোষণা করছেন মহাশক্তির শুভ আবির্ভাব-ক্ষণ।”
এরপর তিনবার শঙ্খধ্বনির পর শুরু হয় অনুষ্ঠান। সুপ্রীতি ঘোষের পরিশীলিত কন্ঠে গাওয়া সেই গান – “বাজল তোমার আলোর বেণু”।
সাধারণ মানুষের কাছে পঙ্কজকুমার ও বীরেন্দ্রকৃষ্ণ যেভাবে এই ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িত, সেই তুলনাতে একটু হয়তো আড়ালেই থেকে গেছেন বাণীকুমার। অথচ মূল অনুষ্ঠানটির পরিকল্পনা ও রচনা বাণীকুমারেরই। উপরোক্ত গানটির রচয়িতাও বাণীকুমার।
১৩৩৯ বঙ্গাব্দের আশ্বিনে প্রথম প্রচারিত হয় অনুষ্ঠানটি, কিন্তু তখন এর নাম ছিল ‘শারদ বন্দনা’। ১৯৩৪-এর ৮ ই অক্টোবর ( ১৩৪১ বঙ্গাব্দ ) মহালয়ার সকাল ছয়টা থেকে সাড়ে সাতটা পর্যন্ত প্রচারিত হয়েছিল অনুষ্ঠানটি। কিন্তু এটি ঘিরে তীব্র আপত্তি ওঠে – ধর্মকে যারা চিরদিন বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ
করে রাখতে চায়, সেই রক্ষণশীল দলের পক্ষ থেকে। প্রতিবাদের মূল কারণ ছিল – এক অব্রাহ্মণ ব্যক্তির কন্ঠে কেন চণ্ডীপাঠ শোনা যাবে ? রুখে দাঁড়ালেন বাণীকুমার। গ্রন্থনা ও চণ্ডীপাঠ বীরেন্দ্রকৃষ্ণই করবেন এই সিদ্ধান্তে অটল থাকেন তিনি। অন্য একটি আপত্তি ছিল মহালয়ার সকালে পিতৃতর্পণের আগেই কেন চণ্ডীপাঠ হবে ? এ কারণেই ১৯৩৫ ও ১৯৩৬ সালে অনুষ্ঠানটি ষষ্ঠীর ভোরে প্রচারিত হয়েছিল। কিন্তু পরিশেষে বাণীকুমারের সিদ্ধান্ত মেনেই ১৯৩৭ সাল থেকেই মহালয়ার ভোরে প্রচারিত হয় – ‘মহিষাসুরমর্দিনী। ’

অনুষ্ঠানটি সফল ও আকর্ষণীয় করে তুলতে বাণীকুমারের সঙ্গে পঙ্কজকুমার মল্লিক ও বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের নাম অবশ্যই স্মরণীয়; বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, পঙ্কজকুমার মল্লিক ও বাণীকুমার ছিলেন একই বৃন্তের তিনটি ফুল। ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ গীতি আলেখ্যটি পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। এ প্রসঙ্গে একটি নিবন্ধে বাণীকুমার নিজেই লিখেছেন –“
“মহিষাসুরমর্দিনী” আমার প্রথম যৌবনের রচনা। কিন্তু মূল রূপটির বিশেষ পরিবর্তন না ঘটলেও এই গ্রন্থের বর্তমান রূপ বহুতর তথ্য ভাবগর্ভ বিষয় এবং বেদ-পুরাণাদি-বিধৃত শ্লোকাবলী সংযোজনায় সমলংকৃত। প্রকৃতপক্ষে এই গ্রন্থ মার্কন্ডেয় সপ্তশতী চন্ডীর সংক্ষিপ্তসার বললেও অত্যুক্তি হয় না, তদুপরি এর মধ্যে আছে মহাশক্তি-সম্বন্ধে বৈদিক ও তান্ত্রিক তত্ত্বের ব্যঞ্জনা, এবং এর অন্তরে নিহিত রয়েছে শাশ্বত ভারতের মর্মকথা। ......”
মাত্র একবারই ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র প্রচার বন্ধ হয়েছিল। দেশে জরুরী অবস্থা থাকাকালীন ১৯৭৬-এর ২৩ শে সেপ্টেম্বর মহালয়ার ভোরে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’কে সরিয়ে ‘দেবী দুর্গতিহারিণীম’ নাম দিয়ে এক বিকল্প অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়। রূপদান করেছিলেন অভিনেতা উত্তমকুমার, সঙ্গীতশিল্পী লতা মঙ্গেশকর প্রভৃতি স্বনামধন্য
ব্যক্তিবর্গ। কিন্তু ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ স্থানচ্যুত হওয়ায় জনরোষ ফেটে পড়ে। পত্র-পত্রিকায় সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র বরাবরই ভোর হবার আগে রাত্রিবেলাতেই বেতারকেন্দ্রে চলে আসতেন এবং ‘মহিষাসুরমর্দিনী ’ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত উপস্থিত থেকে তারপরে যেতেন। টেপ রেকর্ডারে অনুষ্ঠান চললেও এ অভ্যাস তিনি চালিয়ে গেছেন। কিন্তু ১৯৭৬ সালের পর থেকে তিনি আর কখনও রাত্রি বেলা যেতেন না। এই জরুরী অবস্থার সময়েই অপসারিত হন পঙ্কজকুমার মল্লিক ‘সঙ্গীত শিক্ষার আসর’ থেকে। অবশ্য জনসাধারণের চাহিদাকে মর্যাদা দিতে সেবছর ষষ্ঠীর দিন সম্প্রচারিত হয় ‘মহিষাসুরমর্দিনী।’ আর ১৯৭৭ থেকে স্বমহিমায় মহালয়ার ভোরে ফিরে আসে ‘মহিষাসুরমর্দিনী।’ ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ অনুষ্ঠানটি রচনা ও তরঙ্গায়িত করে বাণীকুমার যে আসাধারণ কাজটি করেছিলেন তৎকালীন স্টেশন ডিরেক্টর দিলীপকুমার সেনগুপ্ত সে প্রসঙ্গে বলেছেন – –
“বাণীকুমার যদি আর কোনো কাজ নাও করতেন, তাহলেও শুধু ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র জন্যই মানুষ তাকে মনে রাখত। ...... শাজাহান যেমন তাজমহল গড়েছিলেন, যা পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্যের একটা হয়ে আছে, আমাদের বাণীদা হাওয়ায় তাজমহল গড়ে গেলেন, যা মানুষের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।”
এছাড়াও বেতারের প্রচারের আর তার বিভিন্ন অনুষ্ঠানের সঙ্গে তাঁর যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে, সেটা আমাদের জানা দরকার। তবে সেটা বলার আগে বাণীকুমারের পরিচয়টা একটু জেনে নেওয়া যাক।
বাণীকুমারের আসল নাম বৈদ্যনাথ ভট্টাচার্য। জন্ম ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৩শে নভেম্বর। পিতা সংস্কৃতজ্ঞ পন্ডিত ও ঐতিহাসিক বিধুভূষণ ভট্টাচার্য ও মাতা অপর্ণা ভট্টাচার্য। তাদের দুই ছেলে ও দুই মেয়ে। আদি নিবাস ছিল হুগলী জেলার আঁটপুর কিন্তু পরে হাওড়ায় এসেই বসবাস শুরু করেন। বৈদ্যনাথ ছিলেন হাওড়া জেলা স্কুলের ছাত্র। পরে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরাজিতে অনার্স নিয়ে প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হন। পিতা পিতামহ সকলেরই সংস্কৃতে ব্যুৎপত্তি ছিল এবং সম্ভবতঃ সেই কারণেই বৈদ্যনাথও সংস্কৃত নিয়ে পড়াশোনা করে ‘কাব্যসরস্বতী’ উপাধি পান। এটা পরে তার কর্মজীবনে যথেষ্ট সহায়ক হয়েছিল। সংস্কৃত পঠন উপলক্ষেই বৈদ্যনাথ বাগবাজারে পন্ডিত অশোকনাথ শাস্ত্রীর সংস্পর্শে আসেন। ইচ্ছা থাকলেও সংসারের চাপে পড়াশোনা আর বেশীদূর এগোয় নি; টাঁকশালে চাকরি নিলেন বৈদ্যনাথ।
১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৬শে আগস্ট বোম্বাই-এর (এখন মুম্বই) ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং কোম্পানি নামে একটি
বেসরকারি সংস্থা ডালহৌসির ১নং গার্স্টিন প্লেসে একটি ভাড়া বাড়িতে রেডিও স্টেশন স্থাপন করে। সংস্থার অধিকর্তা ছিলেন স্টেপলটন সাহেব; ভারতীয় অনুষ্ঠানের তত্বাবধায়ক ছিলেন ক্ল্যারিনেট বাদক নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ মজুমদার, সহকারী প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ রাইচাঁদ বড়াল। সে সময়ে রেডিওর অনুষ্ঠান শুনতে হত কানে হেডফোন লাগিয়ে। একসঙ্গে একজনই অনুষ্ঠান শুনতে পেতেন, একসঙ্গে শোনার সুযোগ ছিল না। মুষ্টিমেয় কিছু অভিজাত ও ধনী ব্যক্তির বাড়িতেই এই বিলাস দ্রব্যটি শোভা পেত। ১৯২৮ সালে ২১ বছর বয়সে বৈদ্যনাথ টাঁকশালের স্থায়ী চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে ‘অল ইন্ডিয়া রেডিও’তে রাইটার স্টাফ আর্টিস্ট ( writer staff artist ) হয়ে কাজে যোগদান করেন – নাম গ্রহণ করেন ‘বাণীকুমার’। সৃষ্টিধর্মী মন নিয়ে টাঁকশালের কলম পেশা চাকরি তার বেশি
দিন ভাল লাগে নি। সেটাই স্বাভাবিক। ১৯৩৬-এ প্রচার সংস্থার নাম হয় ‘অল ইন্ডিয়া রেডিও’ , ‘আকাশবাণী’ নাম হয় ১৯৫৭ সালে এবং ১৯৫৮-এর সেপ্টেম্বর মাসে রেডিও স্টেশন ‘আকাশবাণী ভবন’-এ স্থানান্তরিত হয়।
টাঁকশালের চাকরিরত অবস্থাতেই গৌরী ভাট্টাচার্যের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। বৈদ্যনাথের ছিল পাঁচ সন্তান। বড় মেয়ে অরুণলেখা এবং ছোটমেয়ে সোমলেখা দুজনেরই সুন্দর গানের গলা, গান শিখতেন বিমলভূষণের কাছে। বড়ছেলে ডঃ নৃসিংহ কুমার ভট্টাচার্য ফলিত মনোবিজ্ঞানের প্রাক্তন অধ্যাপক; মেজছেলে অমিতকুমার ছিলেন রসায়নবিদ, তিনি আর ইহজগতে নেই। ছোটছেলে তপনকুমার বাংলা ভাষার শিক্ষক। বৈদ্যনাথেরই সমবয়স্ক কয়েকজন নাট্যপ্রেমিককে নিয়ে গড়ে ওঠা ‘চিত্রা সংসদ’ নামে একটি নাট্যসংস্থা ছিল। ‘চিত্রা সংসদ’ থেকেই নৃপেন্দ্রনাথ যোগাড় করেছেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, বিজন বসু ( বিখ্যাত ঘোষক ও সংবাদ পাঠক ) , পঙ্কজকুমার মল্লিক ও রাজেন সেনকে। তবে পঙ্কজকুমার ছিলেন সঙ্গীতশিল্পী, রেডিও সংস্থার চাকুরিজীবী নন। নৃসিংহকুমার ভট্টাচার্য লিখেছেন –
“তার ( বাণীকুমার ) নাট্যরূপায়িত পরশুরামের ‘চিকিৎসা সঙ্কট’ নাটক বেতারস্থ হবার পরেই তৎকালীন বেতার অধিকর্তা বেছে নেন বাণীকুমারকে বেতার কর্মী হিসাবে। সাল ১৯২৮।”
বেতার কর্মী হিসাবে যোগদান করার পর রামনারায়ণ তর্করত্ন রচিত ‘কুলীন কুল সর্বস্ব’ নাটকটি বেতারে প্রচারের উপযোগী করে নাট্যরূপ দান করেন বাণীকুমার। সম্ভবতঃ এটিই তাঁর প্রথম প্রচারিত বেতার নাট্যানুষ্ঠান। এটিতে অভিনয় করেছিলেন পঙ্কজকুমার মল্লিক, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র ও নটীর ভূমিকায় উমাবতী। বাণীকুমারের বয়স তখন মাত্র ২৩। এভাবে তার কত নাটক যে বেতারে প্রচারিত হয়েছে তার সবকটির হিসাবও নেই। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের মতে –
“বাণীকুমার স্বল্পদৈর্ঘের সহস্রাধিক অনুষ্ঠান রচনা করে গেছেন। ‘কাব্যসরস্বতী’ বাণীকুমারের সংস্কৃতে যথেষ্ট ব্যুৎপত্তি ছিল বলেই তিনি সংস্কৃতে রচিত বহু কাহিনী, স্তোত্র, দেবীবন্দনার সার্থক রূপদান করতে পেরেছেন। ভারতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে তার বহু অনুষ্ঠান বাঙালীর দরবারে পৌঁছে দেবার এই প্রচেষ্টা সশ্রদ্ধ প্রশংসার দাবী রাখে। অশোকনাথ শাস্ত্রীর অনুরোধে তিনি ‘আনন্দমঠে’র নাট্যরূপ দান করেন; ‘সন্তান’ নামে তার সেই নাটক শ্রোতাদের প্রশংসা কুড়িয়েছিল। ”
রবীন্দ্রনাথকে চিরদিনই হৃদয়ে শ্রদ্ধার আসনে বসিয়েছেন বাণীকুমার। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তার ধ্যানের ধন। কবিগুরুর বহু কবিতার নাট্যরূপ দান করেছেন বাণীকুমার। উদাহরণ স্বরূপ ‘ফাঁকি’, ‘দেবতার গ্রাস’, ‘বিরহ’, ‘হোরিখেলা’, ‘পুরস্কার’ ইত্যাদির নাম করা যায়। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রশতবর্ষের অনুষ্ঠান উপলক্ষে ‘কবিপ্রণাম’ নাম দিয়ে বাণীকুমার একটি বন্দনাগীতি রচনা করেন, সুর দিয়েছিলেন পঙ্কজকুমার মল্লিক। এর দুটি লাইন –
“পূরব গগন জাগ্রত করি নব উদয়ন সঙ্গীতে
দিলে এনে তুমি প্রাণ রসধারা বিশ্বে ললিত ভঙ্গিতে ।”
১৩৬১ বঙ্গাব্দের ২৫শে বৈশাখ কবিগুরুর জন্মদিনে বাণীকুমার একটি স্বরচিত কবিতার মাধ্যমে তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। কবিতাটির কয়েক পংক্তি –
“একদা এ বৈশাখের পরম লগনে
শ্যামা বঙ্গ জননীর শোভন ভবনে
চিরজীবী শিশু এক উঠিলেন জাগি
বিধাতার জ্যোতিঃ রেখা শুভ বর মাগি
শোভমানা ললাটিকা তিনি শিশু রবি।
* * * * *
বিকশিল শোভা তার রস-সৃষ্টি-লোকে,
মাধুরীর ধ্যানে-স্তবে অসীম-পুলকে,
অন্তহীন আয়োজন জীবন ভরিয়া –
চির যৌবনের লীলা সুধা উন্মথিয়া।
হে চিরজীবিত কবি – হে চিরজীবন
চিত্ত বন্দ্যনীয় নমি হে চিরনূতন ।।”
বাণীকুমার রবীন্দ্রনাথের ‘বাঁশরী’ প্রযোজনা করলেন ১৯৪৭-এর নভেম্বরে। ১৯৪৯-এর জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে নির্বাচন করলেন ‘ঘরে বাইরে’ ও ‘দুই বোন’; ১৯৫০ নভেম্বরে ‘যোগাযোগ’। এ ছাড়া কবিগুরুর গল্পগুচ্ছের ‘মালঞ্চ’, ‘গুপ্তধন’, ‘মাস্টার মশাই’, ‘পরিত্রাণ’, ‘কঙ্কাল’, ‘সুয়োরাণীর সাধ’, ‘মহামায়া’, ‘কালের যাত্রা’ প্রভৃতি বহু ছোট গল্পের সার্থক নাট্যরূপ দান করেছেন বাণীকুমার। তখন দেশ সবে স্বাধীন হয়েছে। দেশাত্মবোধের ফল্গুধারা বইছে ভারতবাসীর অন্তরে। এ সময়ে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বেছে নিয়েছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র ও শরৎচন্দ্রকে। বঙ্কিমের ‘দুর্গেশনন্দিনী’, ‘সীতারাম’, ‘আনন্দমঠ’, ‘ যুগলাঙ্গুরীয়়’; শরৎচন্দ্রের ‘অরক্ষণীয়া’, ‘মেজদিদি’; রবীন্দ্রনাথের ‘রামকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা’, ‘শাস্তি’ ও ‘মালঞ্চ’ ইত্যাদি রচনাও বাণীকুমারের তালিকায় ছিল। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষে দেশের বিভিন্ন বেতার কেন্দ্র থেকে নানা ভাষায় বৈচিত্র্যপূর্ণ অনুষ্ঠান শ্রোতাদের উপহার দেবার পরিকল্পনা করা হয়। এই উপলক্ষ্যে ৬ টি রবীন্দ্রসঙ্গীত সংস্কৃত ভাষায় অনুবাদ করেন বাণীকুমার। কিন্তু ছন্দ বাদ দিয়ে শুধু আক্ষরিক অনুবাদ করতে তার মন চাইছিল না। লেখা হয়ে গেলে সঙ্গীতজ্ঞ বিমলভূষণকে কাছে বসিয়ে সেগুলি পরিমার্জিত করেন গাইবার উপযুক্ত করে। গানগুলি ছিল –
বঙ্গ মৃত্তিকা বঙ্গ জলম ( বাংলার মাটি বাংলার জল )
মম মূর্ধানমানময় তব ( আমার মাথা নত করে দাও )
ত্বং কথঙ্কারং গায়সি ( তুমি কেমন করে গান কর )
বিপদো মাং গোপয়তু ( বিপদে মোরে রক্ষা কর )
অন্তরংমে বিকাশয়তু ( অন্তর মম বিকশিত কর )
অয়ি ভুবন মনোমোহিনী
প্রথমটি বাদ দিয়ে বাকি ৫ টি গান ১৯৬৩ তে আকাশবাণীতে রেকর্ড করেন পঙ্কজকুমার মল্লিক ও বিমলভূষণ।
দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত প্রয়োজনীয় জিনিস ও বিজ্ঞান বিষয় নিয়েও নাটক উপস্থাপিত হয়েছে; যেমন – কয়লা, কাগজ, টেলিগ্রাফ, টেলিফোন, মুদ্রাযন্ত্র ইত্যাদি।
১৯৩৫ সালে নীতিন বসুর পরিচালনায় মুক্তি পায় ‘ভাগ্যচক্র’ ছায়াছবি। এই ছবিতে প্রথম ‘প্লে-ব্যাক’ পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়। প্রথম ‘প্লে-ব্যাক’ গানটির রচয়িতা ছিলেন বাণীকুমার। গানটি ছিল – ‘মোরা পুলক যাচি তবু সুখ না মানি, যদি ব্যাথায় দোলে তব হৃদয়খানি।’ এ প্রসঙ্গে পঙ্কজকুমার মল্লিক লিখেছেন –
“সখীদের সমবেত-সংগীতে প্রকৃতপক্ষে যাদের কন্ঠ ছিল, তাঁরাই এদেশের প্রথম প্লে-ব্যাক গায়িকার সম্মান দাবী করতে পারেন। ওঁরা হচ্ছেন শ্রীমতী সুপ্রভা ঘোষ (পরে সরকার), শ্রীমতী পারুল চৌধুরী (পরে ঘোষ) ও শ্রীমতী উমাশশী দেবী ।”
‘ভাগ্যচক্র’ ছাড়াও ‘দেনা-পাওনা’, ‘রূপলেখা’ ও ‘দেবদাস’ ছবিতেও বাণীকুমার রচিত গান গাওয়া হয়েছে। ‘দেবদাস’ ছায়াছবিতে কুন্দললাল সায়গলের কণ্ঠে বাণীকুমারের লেখা – ‘কাহারে জড়াতে চাহে ও দুটি বাহুলতা’ ও ‘গোলাপ হয়ে উঠুক ফুটে তোমার রাঙা চরণ খানি’ গানগুলি ছায়াছবির ঈপ্সিত আবেগকে দর্শকদের অন্তরে পৌঁছে দিতে যথেষ্ট সাহায্য করেছে।
প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়বার সময়েই বন্ধুত্ব হয়েছিল চারুচন্দ্র চক্রবর্তীর ( জরাসন্ধ ) সঙ্গে। দীর্ঘকাল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। অবসর গ্রহণের পর খবর পেয়ে জরাসন্ধ আসেন বন্ধু বৈদ্যনাথ ভট্টাচার্য তথা বাণীকুমারের সঙ্গে দেখা করতে। নিজের লেখা ‘লৌহকপাটে’র দুটি খন্ড তুলে দেন বাণী কুমারের হাতে। সে বই থেকে কয়েকটি ঘটনার বেতার নাট্যরূপ প্রযোজনা করেছিলেন বাণীকুমার।
নাট্য-পাগল বাণীকুমার মাত্র একবারই মঞ্চের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। অভিজ্ঞতা সুখের হয় নি। রঙমহলে চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি সময়ে ‘সন্তান’ নাম দিয়ে বঙ্কিমচন্দ্রের একদা নিষিদ্ধ ‘আনন্দমঠে’র নাট্যরূপ দিয়েছিলেন তিনি। মঞ্চস্থ হবার দিনই ‘আজাদ পত্রিকা’ প্রতিবাদ জানাল, এ নাটক নাকি হিন্দু মুসলমানের ঐক্যে ফাটল ধরাবে। বিশেষ করে আপত্তি জানাল ‘বন্দেমাতরম’ গানটি নিয়ে, দাবী ছিল গানটিকে বাদ দিতে হবে। পরে অবশ্য সম্পূর্ণ নাটকটিই মঞ্চস্থ হয় বন্দেমাতরম রেখেই। দর্শকদের প্রভূত প্রশংসা কুড়িয়েছিল নাটকটি। তবে বাণী কুমার আর মঞ্চের দিকে পা বাড়ান নি।
বাণীকুমারের সঙ্গে কবি নজরুলেরও হৃদ্যতা জন্মেছিল। ‘ওমর খৈয়ামে’র বেতার নাট্যরূপ রচনা
করেছিলেন বাণীকুমার। এর সঙ্গীত পরিচালনার ভার স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে গ্রহণ করেছিলেন নজরুল। সেটা ছিল ১৯৪১ সাল। এর পরের বছরেই বিদ্রোহী কবি স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলেন। প্রাণবন্ত সদাহাস্যময় কবির অপ্রত্যাশিত এই মর্মান্তিক পরিণতিতে বেদনাহত বাণীকুমার নজরুলের জন্মদিনে ব্যথার্ত হৃদয়ে যে কবিতা রচনা করেছিলেন তার কয়েকটি পংক্তি উদ্ধৃত করি –
“আজিকে সহসা কেন নিয়তির নিষ্ঠুর শাসন
বাধা দেয় প্রকাশ-আগ্রহ তব, দৃপ্ত সম্ভাষণ। ...
সাধনার মহাক্ষণ ধূলিতে কি হইবে বিলীন,
পরম চৈতন্য-বরে জাগিবে না তব জন্মদিন ?”
স্বল্পবাক বাণীকুমার দেখতে কেমন ছিলেন ? তার বর্ণনা দিয়েছেন তার এক সময়ের সহকর্মী অজিত মুখোপাধ্যায় – “ ...পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে উঠে দাঁড়ালাম। তারপর ভাল করে পা থেকে মাথা অবধি নিরীক্ষণ করলাম। গায়ের রঙ ‘ফরসা ধবধবে’, ঝকঝকে কালো পাম্পসু, ধবধবে কোঁচানো ধুতি, তেমনি ধবধবে পাঞ্জাবী, মুখে পান, চোখে Golden frame-এর Rimless চশমা । মাথার সামনের দিকে টাক। পেছনে ও কানের দু’পাশে কোঁকড়ানো চুল। মাঝে মাঝে কিছু পাকা। মসৃণ করে দাড়ি কামানো। চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। গায়ের থেকে মিষ্টি আতরের গন্ধ ভেসে আসছে। গাম্ভীর্যপূর্ণ চেহারা। সব কিছুর মধ্যেই একটা বনেদী পরিবারের ছাপ।” কানে একটু কম শুনতেন বাণীকুমার। জরদা মেশানো পান তার মুখে প্রায়শই থাকত। আতর মাখতেন তিনি; যুঁইফুলের আতর ছিল তার খুব প্রিয়। এহেন গম্ভীর ও ব্যক্তিত্বপূর্ণ মানুষটির কিন্তু ছেলেমানুষি স্বভাবও ছিল। এরকম একটি মজার ঘটনা জানিয়েছেন তার নাতি লেখক চন্দ্রিল ভাট্টাচার্য। একবার কে একজন তাকে বললেন –‘ বাণীদা আপনার একটা চোখ ছোট হয়ে গেছে মনে হচ্ছে’। ব্যস, বাড়িতে ফিরেই চেঁচামেচি –‘আমার একটা চোখ ছোট হয়ে গেছে, একথা আমাকে বলা হয় নি কেন ?’ বাড়ির লোক তাকে বলল –‘এসব কথা তুমি বিশ্বাস কর কেন ?’ কিন্তু কে শোনে ? আয়না নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে পরীক্ষা করে তিনি নিশ্চিত হলেন যে সত্যিই তার একটা চোখ ছোট হয়ে গেছে। এসবের জন্যই হয় ত জরাসন্ধ বাড়িটাকে ‘বাণীবাবুর আনন্দনিকেতন’ নাম দিয়েছিলেন।
বাণীকুমারের সৃজনশীলতা কেবলমাত্র বেতারের জন্য নাটক রচনা ও প্রচারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে নি। তার রচিত বহু প্রবন্ধ ও গল্প ‘প্রবাসী’, ‘ভারতবর্ষ’, ‘ভারতী’, ‘মাসিক বসুমতী’, ‘বঙ্গশ্রী’, ‘পূর্ণিমা’, ‘সাহানা’ প্রভৃতি সাময়িক পত্রিকা, এমন কি ছোটদের পত্রিকা ‘শিশুসাথী’, ‘শুকতারা’ ও ‘মৌচাকে’ও নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছে। বেতারে তিনি ‘বাণীকুমার’ ছদ্মনামে পরিচিত হলেও সাহিত্যক্ষেত্রে তিনি ‘বৈ.না.ভ.’ , ‘আনন্দবর্ধন’, ‘বিষ্ণু-গুপ্ত’ প্রভৃতি নাম ব্যবহার করেছেন। তার প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে – ‘সন্তান’, ‘সপ্তর্ষি’, ‘গীতবল্লকী’, ‘কথা-কথালি’, ‘মহিষাসুরমর্দিনী’, ‘রায়বাঘিনী’, ‘হাওড়া হুগলীর ইতিহাস’, ‘স্বরলিপিকা’ ( ২ খন্ড )।
যিনি সমস্ত জীবন ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম করে নিষ্ঠার সঙ্গে লক্ষ লক্ষ শ্রোতার কাছে নানা বিষয়ে বহু বৈচিত্রপূর্ণ অনুষ্ঠান পৌঁছে দিয়েছেন তার শেষ জীবন শোনা যায় সুখের হয় নি। স্টাফ আর্টিস্টদের পেনশন ছিলনা। বহু শিল্পীর ক্ষেত্রেই এটা হয়েছে। শিল্প সৃষ্টিতে নিমগ্ন থেকে বহু স্রষ্টাই তাদের ভবিষ্যত জীবনের পরিণতির কথা ভাবেন নি। এক সময়ে যাদের সবাই শ্রদ্ধা ও আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করেছে, জীবনের শেষ পর্বে তারা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে বিস্মৃতির গর্ভে লীন হয়েছেন। ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ ই আগস্ট বাণীকুমার আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। না, সাময়িক ভাবে হলেও তার প্রিয় অনুষ্ঠান ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ বাতিল হবার খবর তাকে শুনে যেতে হয় নি।
( সহায়ক গ্রন্থ : ‘শতবর্ষে বাণীকুমার : স্মরণে ও বরণে’ )
লেখক পরিচিতি - বহু বছর বি.ই. কলেজে (এখন ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, শিবপুর ( IIEST,shibpur )) অধ্যাপনা করেছেন। কিছুদিন হল অবসর নিয়ে এখন সেখানে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে আছেন। অ্যাপ্লায়েড মেকানিক্স নিয়ে গবেষণা করলেও একাধিক বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে - জ্যোতিষশাস্ত্র, পুরনো কলকাতার সংস্কৃতি, ইত্যাদি। অবসর সময়ে 'অবসরে'র সঙ্গে সময় কাটান।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।