প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

কান পেতে রই...

অবসর (বিশেষ) সংখ্যা , ডিসেম্বর ৩০, ২০১৪

 

‘ভদ্র’ তাঁর অন্য নাম

জগন্নাথ বসু

 

একটি ইংরেজী নীতিকথা খুবই শুনতে পাওয়া যায় – “It is nice to be important but it is more important to be nice” । অবশ্য একবিংশ শতাব্দীর মানুষ কিন্তু আজকাল সেই নীতিকথাকে আর মেনে চলতে চাননা। তাঁদের কাছে সাফল্য আর নিজের গুরুত্বই বেশী জরুরী, তার জন্য ভদ্রতা বা নীতিজ্ঞানকে বিসর্জন দিতে তাদের বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই। কিন্তু আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি এমনএক মানুষকে যিনি এই নীতিবাক্য অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতেন। তিনি এক প্রবাদপ্রতীম শিল্পী, কিন্তু তাঁর মধ্যে অহংকারের ছিটেফোঁটাও ছিল না।

প্রথম দর্শনে হয়তো তাঁকে একটু রাশভারী লাগতে পারে, কিন্তু একটু আলাপ হলেই বোঝা যায় ভদ্রলোক অত্যন্ত সাদাসিধে। তাঁর পোশাক আশাকের মতই অনাড়ম্বর, রঙ্গপ্রিয়। ফর্সা, দোহারা চেহারা, ধুতি পাঞ্জাবীতে সৌম্য, কাঁধে লম্বা একটা ভাঁজকরা চাদর, হাতে নস্যির ডিবে – হনহন করে শ্যামপুকুর থেকে বেলা দশটায় ধর্মতলার ট্রাম ধরেন রোজ। নাম বললে তো চিনবেনই, এমনকি কথা বললেও যে কোন অচেনা মানুষ ফিরে তাকাবে তাঁর দিকে। কেউ একটু খোঁজ খবর করলেই জানবেন, ভদ্রলোক একজন সেলিব্রিটি। তবে অন্যরকম। এঁর চাইতে অনেক কম বিখ্যাত মানুষজন ও গাড়ি হাঁকিয়ে পথ চলেন। সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা প্রায় বলেনই না, আর ইনি তো সাধারণ-অসাধারণের মধ্যে কোনও তফাৎ করেন না। কাজের মধ্যে যখন ডুব দেন – হিসাব করেন না ‘কী পাচ্ছি’, - ‘কতটুকু পাচ্ছি’, দিয়েই যান, দেদার দেওয়া। এমনি করে বিশের দশক থেকে আশির দশক পর্য্যন্ত তাঁর উপহার গোটা আকাশবাণী কলকাতাটাই। এতক্ষণে নিশ্চয়ই বোঝা যাচ্ছে, ‘ভদ্র’লোক আর কেউ নন, স্বয়ং বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। বাঙালীর সেরা উৎসব দুর্গাপুজোর সঙ্গে যাঁর নামটি জড়িয়ে গেছে অঙ্গাঙ্গি ভাবে ভাবে। মহালয়ার ভোর মানেই তো চন্ডীপাঠ, ঘুম ঘুম চোখে গরম চা আরনস্টালজিয়ায় ভেসে যাওয়া। বীরেন ভদ্রের মন্দ্র স্বরের উদাত্ত উচ্চারণ নয়া শুনলে যেন পুজো আসেনা। একবারই এর অন্যথা হয়েছিল।

১৯৭৬ সাল। আকাশবাণীর কর্তৃপক্ষ ঠিক করলেন চিরাচরিত ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ বীরেন্দ্রকৃষ্ণর বদলে উত্তমকুমারকে দিয়ে করাবেন। তাঁদের গোপন বৈঠকে বাদ পড়লেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র।

এই নতুন উদ্যোগ ঘুণাক্ষরেও টের পাননি বীরেনদা। পরিবর্তিত ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র স্ক্রিপ্ট লিখেছিলেন ডঃ গোবিন্দগোপাল মুখোপাধ্যায়।* ভদ্রলোক ছিলেন বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতের বিভাগীয় প্রধান। নির্দিষ্ট দিনে রেডিয়োয় বাজল নতুন অনুষ্ঠান ‘দেবীং দুর্গতিহারিণীম্’। এবং চূড়ান্ত ফ্লপ।

উত্তমকুমার কিন্তু এ দায়িত্ব নিতে চাননি। তিনি বীরেনদার কাছে গিয়ে তাঁর অস্বস্তি ও অযোগ্যতার কথাও বলেছিলেন। বীরেনদা অবশ্য তাঁকে আশ্বস্ত করে উৎসাহই দিয়েছিলেন। সম্প্রচারের দিন খাটে বসে ছেলের সঙ্গে মন দিয়ে বীরেনদা শুনেছিলেন উত্তমকুমারের মহালয়া। সবটা শোনার পরে বীরেনদা নাকি শুধু এটুকুই বলেছিলেন, “লোকে যদি নেয় নিক।” এ কথা শুনেছি বীরেনদার পুত্র প্রদ্যোৎকুমারের কাছে।

সমালোচনার ঝড় উঠল। বেতার অফিস ভাঙচুর হল। অফিসের সামনে লোকে গালিগালাজ করতে লাগল। অনেকের এমনও মনে হয়েছিল যে মহালয়ার পুণ্য প্রভাত কলুষিত হল! এ বার বুঝি অমঙ্গল কিছু ঘটবে! ভাবটা এই যেন উত্তমকুমার হেরে গেছেন আর জিত হয়েছে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রর। সেসব কথায় কর্ণপাত করেননি তিনি। বাণীকুমার, পঙ্কজ মল্লিক, বীরেন্দ্রকৃষ্ণর মহিষাসুরমর্দিনী ফিরে আসায় স্পষ্টতঃ খুশী হয়েছিলেন তিনি। আসলে উত্তমকুমারকে অসম্ভব স্নেহ করতেন। একদিন কথায় কথায় বলেছিলেন, হাফনোট কাকে বলে জানো? – উত্তমকুমারের কথা বলাতে সামান্য একটু জড়ানো ভাব থাকে, লক্ষ করেছ, ওটাই হাফনোট – রোমান্টিক সিনে যা অব্যর্থ। প্রেমের সংলাপে বেশি ক্ল্যারিটি থাকলে, স্পষ্ট উচ্চারণ করলে মনে হবে ব্যাপারটা ভেতর থেকে আসছে না- সাজানো গোছানো, বুঝলে? একটু ফ্লার্টিশাস আর কি!

এই ঘটনার বছর পাঁচেক পর উত্তমকুমারের মৃত্যুর দিন তাঁরই পাশে দাঁড়িয়ে কেওড়াতলা শ্মশানে বাকরুদ্ধ হয়ে তাঁর ধারাবিবরণী শুনছি। উত্তমকুমারের শরীরে যখন আগুন ছোঁয়ানো হল,ক্ষণিকের জন্য থেমে গেলেন তিনি। চোখটা চিকচিক করে উঠল। তারপর তাঁর সেই চিরাচরিত বাচনে বলে যেতে লাগলেন,

“যে সুন্দর কমনীয় শরীর মুখমন্ডল এতকাল তাঁর অজস্র ভক্তকে আনন্দ দিয়েছে, সেই শরীরে আগুন স্পর্শ করল। ছোঁয়ালেন তাঁর প্রিয়তম পুত্র গৌতম। মহানায়কের নশ্বরদেহ ঘিরে এখন আগুনের লেলিহান শিখা। একটু একটু করে গ্রাস করে নিচ্ছে তাঁর শরীরকে। আমি দেখতে পাচ্ছি, কাতারে কাতারে মানুষ এসে একবার পাদপদ্ম স্পর্শ করতে চাইছে” –

আমি পাশে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম উত্তমকুমারকে ঘিরে সাধারণ মানুষের আবেগকে কী অনায়াসে তিনি গলায় তুলে নিচ্ছিলেন। এর আগে ও তিনি আর একবার বাঙালীর শ্রেষ্ঠ মানুষটির শেষযাত্রার বিবরণ দিয়েছিলেন।

৭ অগস্ট। ১৯৪১। রবীন্দ্রনাথ চলে গেলেন। রেডিয়োয় সে বার অদ্ভুত একটা কাণ্ড ঘটালেন বীরেনদা। পুরো শোকযাত্রা শ্রোতাদের ধারাবিবরণী দিয়ে শোনালেন তিনি। তারই কিছু অংশ এখানে না বলে পারছি না। বীরেনদা বলছেন,

ঠাকুরবাড়িতে বেশিক্ষণ শবদেহ রাখার রীতি নেই, বিশেষত মধ্যাহ্নে যিনি প্রয়াণ করেছেন বিকেলের মধ্যে তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন করতেই হবে। সংবাদ সংগ্রহ করতে করতে আমরাও নিমতলা শ্মশানে এসে হাজির। ও পারে দূরের ওই নীলাকাশে অস্তগামী সূর্য শেষ বিদায়ের ক্ষণে পশ্চিম দিগন্তে ছড়িয়ে দিল অগ্নিবর্ণ রক্তিম আভা, আর এপারে এই পৃথিবীর বুকে বহ্নিমান চিতার লেলিহান অগ্নিশিখায় পঞ্চভূতে বিলীন হল এক মহপ্রাণের পূত-পবিত্র শরীর। রবি গেল অস্তাচলে...।”

রেডিওর কাজ শব্দ নিয়ে খেলা করা, কথা দিয়ে চিত্রনির্মাণ। উনি বারবার বলতেন গলা দিয়ে ড্রয়িং করা চাই। যা তিনি নিজে বহুবার করে দেখিয়েছেন। আসলে জুতো সেলাই থেকে চন্ডীপাঠ – কোন কাজটা তিনি করেননি রেডিওর জন্য। মহিলামহল চালিয়েছেন ‘বিষ্ণুশর্মা’ ছদ্মনামে। আকাশবাণী-র নিজস্ব একটা কাগজ ছিল। নাম ‘বেতারজগৎ’। ‘বেতারজগৎ’ ছিল বীরেনদার প্রাণ। একবার সরকারের পক্ষ থেকে বন্ধ করে দেওয়া হল সেই কাগজ। তাতেও বীরেনদাকে দমাতে পারেনি। জি পি ও-র সামনে ভরা শীতে আপাদমস্তক চাদর মুড়ি দিয়ে বীরেনদা রাস্তায় দাঁড়িয়ে ‘বেতারজগৎ’ বিক্রি করতেন। নাট্য প্রযোজনা, অভিনয়, বিরূপাক্ষর রসরচনা পাঠ, কি নয়।

আসলে বাংলা সংস্কৃতির সঙ্গে তাঁর ছিল নাড়ির যোগ। সরকারি শিরোপা তাঁর না জুটলেও, লক্ষ লক্ষ বাঙালীর হৃদয়ে তাঁর আসন পাকা হয়ে আছে। শুধুমাত্র সৃজনশীলতার সঙ্গে যুক্ত থাকবেন বলে তিনি স্টাফ-আর্টিস্টই থেকে গেলে্ন। আমলা হতে তাঁর মন সায় দেয়নি, এর ফলে জোটেনি সরকারি পেনশন। সামান্য পারিশ্রমিকের বিনিময়ে তাঁকে এখানে সেখানে অনুষ্ঠান করতে ছুটতে হয়েছে। সে-সময়টায় ওঁর স্মৃতি একটু একটু করে ঝাপসা হয়ে আসছিল, বার্ধ্যক্যের আক্রমণে শারীরিক ভাবে না হলেও মানসিক ভাবে একটু একটু করে তিনি ভারসাম্য হারাচ্ছিলেন। তবু অনুষ্ঠানে যেতেন সেই চিরচেনা পোশাকে। ধুতি-পাঞ্জাবী, হাতে একটি থলি, স্যান্ডেলটিও কেমন রঙ চটে যাওয়া।

তাঁর এই সরল, অনাড়ম্বর জীবন যাপনের জন্য জীবনের শেষদিকে তাঁকে কিন্তু অনেক অবহেলার স্বীকার হতে হয়েছিল। স্টাফ আর্টিস্ট হয়েই অবসর নিয়েছিলেন বীরেনদা। পেনশন জোটেনি। আসলে আখের গোছানোর কথা কখনও তো ভাবেননি। অবসরের পরে, শেষ পর্যন্ত ‘মহাভারতের কথা’ বলার জন্য ক’টা টাকা পেতেন। ক্রমশ স্মৃতিভ্রংশ হয়ে আসছিল। তাতে অস্বস্তিতে পড়ছিলেন তখনকার প্রোগ্রাম অফিসার। সেই অনুষ্ঠানও আর করানো গেল না! তখন অর্থাভাব মেটাতে পাড়ায় পাড়ায় অনুষ্ঠান উদ্বোধন করে বেড়াতে লাগলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। সেখান থেকেও যে বেশি কিছু পেতেন, তা’ও নয়। সামান্য কিছু জুটত।

বড় অভিমান ছিল তাঁর। মুখে কিছু বলতেন না, আমি বুঝতাম কেন এই অভিমান। আকাশবাণীর এমেরিটাস প্রোডিউসার-এর মতো সম্মাননার পদ জোটেনি তাঁর। বলতে গেলে কিছুই মেলেনি, না কোনও সরকারি খেতাব, না পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ। মিলেছে তো কেবল গুচ্ছের চাদর আর উত্তরীয়!

রেডিয়ো-র মস্ত দায় বয়ে বেড়িয়েছেন চাকরির শেষ দিন পর্যন্ত। অথচ এমন মানুষকেও কী ভাবে যে বারবার অপমানের মুখে পড়তে হয়েছে! একবারের কথা বলি। অবসর নেওয়ার পর রেডিয়ো-য় কী একটা কাজে এসেছিলেন বীরেনদা। ঢুকতে গিয়ে বাধা পেলেন। সিংহ নামের একজন সিকিউরিটি গার্ড বীরেনদার কাছে ‘পাস’ চেয়ে বসল। সেদিন মাথায় রক্ত উঠে গিয়েছিল ওঁর, থরথর করে কাঁপছিলেন, ফর্সা চেহারায় শিরাগুলো দপদপ করছিল। কেবলই চিৎকার করে বলছিলেন, “জন্ম দিয়েছি রেডিয়োকে আমি! জন্ম দিয়েছি! আমিই জন্ম দিয়েছি! আমার কাছে পাস চাইছ? পাস?” মনে হচ্ছিল এ শুধু চিৎকার করে ক্ষোভ উগরে দেওয়া নয়, এর গভীরে কি লুকিয়ে আছে কান্নাও? দৃশ্যটা আজও কিছুতেই মন থেকে তাড়াতে পারি না।

আকাশবাণী-তে বীরেনদা একটা ঘোরানো চেয়ারে বসতেন। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর কর্তৃপক্ষ আমায় সেই চেয়ারটাই ব্যবহার করতে বলেছিল। শুনে আঁতকে উঠেছিলাম। অসম্ভব! এ আমি কিছুতেই পারব না। কোনও ভাবেই রাজি হইনি। তখন অন্য চেয়ার এসেছিল। আর কী আশ্চর্য দেখুন, কালে কালে কিংবদন্তি ওই মানুষটির স্মৃতি জড়ানো সেই চেয়ারটির ঠাঁই হল আকাশবাণী-র অন্ধকার স্টোররুমে!

অবসরের পরেও বীরেনদাকে দেখেছি আকাশবাণী-তে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কাজ নেই....এ ঘর...ও ঘর করছেন। বড় মায়া ছিল যে বাড়িটির প্রতি! বীরেনদাকে ও ভাবে ঘুরতে দেখে আমার কেবলই মনে হত, এ কি সেই জলসাঘর-এর বিশ্বম্ভর রায়? ক্রমক্ষীয়মাণ জমিদারি জমানার শেষ প্রতিভূ! নিজের সাম্রাজ্যকে হাতড়ে বেড়াচ্ছেন। হারানো দিনগুলো ফিরে পেতে চাইছেন।

মনে পড়ছে - কলকাতার কাছাকাছি কোন অনুষ্ঠান, উনিও ছিলেন, আমরাও ছিলাম। উনি অনুষ্ঠানটির উদ্বোধন করে একটি ঘরে গিয়ে বসে আছেন, শীতের রাত, বেশ ঠান্ডা, জানলা দিয়ে হিমেল হাওয়া ঢুকছে। ওদিকে গাড়ি হাঁকিয়ে নামী দামী শিল্পীরা আসছেন, যাচ্ছেন। উদ্যোক্তারা তাঁদের নিয়েই ব্যস্ত। আমি বোধহয় মঞ্চে উঠব, এমন সময় আমার সঙ্গে চোখাচোখি হল; উনি অসহায়ভাবে আমাকে বললেন,-‘জগন্নাথ সেই সন্ধে থেকে এরা আমাকে বসিয়ে রেখেছে, আমি কিন্তু তোমার সঙ্গে যাব’। মনে আছে সেদিন আমি ক্ষোভে ফেটে পড়েছিলাম আর উদ্যোক্তাদের বলেছিলাম,- ’একজন কিংবদন্তির মতো মানুষকে এনে এত অমর্যাদা করবার অধিকার আপনাদের কে দিয়েছে?’ এই বোধহয় হয়। এই ঘটনার কিছুদিন পরেই উনি চলে গেলেন। শেষ হয়ে গেল ইতিহাসের একটি অধ্যায়, শিল্পের জন্য আত্ম-নিবেদিতপ্রাণ একজন মানুষ, আখের গুছিয়ে নেওয়ার কৌশল যাঁর জানা ছিল  না, সরকারি খেতাব অর্জনের জন্য তাঁবেদারি করা যার আসত না, তাঁদের বোধহয় এই অবস্থাই হয় – ‘শেষের সে দিন ভয়ংকর’।

বীরেন ভদ্র ছিলেন আকাশবাণী, দূরদর্শন পরিবারের সকল সদস্য, সদস্যাদের অভিভাবক। তাঁর অবসর গ্রহণের পর নাট্য প্রযোজকের দায়িত্ব এই নিবন্ধকারের ওপর বর্তায়। আমরা যখন এই শ্রুতি মাধ্যমে কাজ শুরু করেছিলাম, তখন এর বনিয়াদ অনেকটাই পাকাপোক্ত। আর ওঁরা যখন শুরু করেছিলেন, তখন থিয়েটারের ভূত এদের কাঁধে চেপে রয়েছে। পাবলিক থিয়েটার রমরমিয়ে চলছে হাতিবাগানে।  শিশিরকুমার, অহীন্দ্র চৌধুরী, নির্মলেন্দু লাহিড়ী, ছবি বিশ্বাস, ভূমেন রায়দের তখন দুর্দান্ত দাপট। বীরেনদার অনুরোধে কেউ কেউ সবে রেডিওতে আসতে শুরু করেছেন। বুঝতে চেষ্টা করছেন ওঁরা, স্টেজ এক্টিং এর সঙ্গে রেডিও এক্টিং এর তফাতটা কোথায়। কিভাবে স্ক্রিপ্টের পাতা ওল্টাতে হয় শব্দ না করে, অভিনয় চলাকালীন। চরিত্রের এন্ট্রি-এক্সিট গুলো কিভাবে স্পষ্ট করে তোলা যায় মাইক থেকে এগিয়ে পিছিয়ে, এইসব।

ঠাকুমা যোগমায়া দেবীর কাছেই বীরেনদার সংস্কৃত শিক্ষা। সেখান থেকেই বোধহয় ‘চণ্ডীপাঠ’-এ মন গিয়েছিল বীরেনদার। স্মৃতি এতই প্রখর ছিল যে আট বছর বয়সে চণ্ডীপাঠ করে সকলকে চমকে দিয়েছিলেন। ঠাকুমাই শেক্সপিয়ার আর গিরিশচন্দ্রর নাটক পড়ে পড়ে শোনাতেন ছোট্ট বীরেন্দ্রকৃষ্ণকে। ১৯২৮ সালে স্কটিশচার্চ কলেজ থেকে বি.এ পাস করেন। তারই ফাঁকে ফাঁকে চলেছিল কম্বুলিয়াটোলায় ‘চিত্রা সংসদ’ ও সাহিত্যিসাধক নলিনীরঞ্জন পণ্ডিত প্রতিষ্ঠিত ‘অর্ধেন্দু নাট্য পাঠাগার’-এ গানবাজনা ও অভিনয় চর্চা।

১৯২৮-এ ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ের সদর দফতরে যোগ দিয়েছিলেন বীরেনদা, কিন্তু তাঁর মন পড়ে থাকত ১ নম্বর গার্স্টিন প্লেসের বেতার কেন্দ্রে। চাকরি তো করতেন, কিন্তু যেই না দুপুর গড়াল, টিফিনের সময় বা বিকেলে ছুটির পরে, বাবু পৌঁছে যেতেন রেডিয়োর বন্ধু-আড্ডায়। সেখানে তখন জমাটি আসর। যার মধ্যমণি ছিলেন প্রেমাঙ্কুর আতর্থী। সেই আসরও মাত করতেন বীরেনদা নিজের কথা দিয়ে। খুব সুন্দর কথা বলতেন তো! এই আসর থেকে ধীরে ধীরে বেতার নাটকে সুযোগ পেয়ে গেলেন বীরেনদা। প্রথমবারেই তাঁর পরিচালনায় নাটকে অভিনয় করলেন বাণীকুমার, পঙ্কজ মল্লিক, পশুপতি চট্টোপাধ্যায়। ১৯২৮-এর ২৬ অগস্ট বেতারে সম্প্রচার হল ‘চিকিৎসা সংকট’ (রচনা পরশুরাম)। সেই সময় ঘটল এক যুগান্তকারী ঘটনা। স্টেশন ডিরেক্টর তখন নৃপেন মজুমদার। তাঁর ডাকেই ১৯২৮-এ বীরেনদা রেডিয়োয় সহকারী পরিচালক হিসেবে যোগ দিলেন। তার পর থেকে কী না করেছেন রেডিয়োর জন্য।

নলিনীকান্ত সরকারের কাছে পাওয়া একটি ঘটনা বলি। তিনি বলছেন, “বর্ষাকাল। বৃষ্টির জন্য বাড়ি থেকে বেতারের কেউই বেরোতে পারেনি। সন্ধ্যা নাগাদ বৃষ্টির তোড় আরও বাড়ল। রেডিয়োটা চালালাম। বীরেন্দ্র ভদ্রের কণ্ঠে ঘোষণা। বললেন, ‘এ বার একটু পিয়ানো শুনুন’। বুঝতে পারলাম, প্রথম আর্টিস্ট আসেননি। পিয়ানো বাজিয়ে অভাব পূরণ করলেন বীরেন্দ্র ভদ্র। দ্বিতীয় আর্টিস্টও অনুপস্থিত। বীরেন্দ্র ভদ্র ঘোষণা করলেন এ বার রবীন্দ্রসঙ্গীত। বাহুল্য এ বার গায়কও বীরেন্দ্র ভদ্র।”

আর একটা ঘটনা মনে পড়ছে। নৃপেন মজুমদার মশাই জামাইষষ্ঠীর দিনে অভিনয় করার জন্য এক ভদ্রলোককে একটি প্রহসন লিখতে অনুরোধ করেছিলেন। ‘আজ দিচ্ছি কাল দিচ্ছি’ করে প্রায় দিন পনেরো পেরিয়ে গেল। নাটক আর লেখা হয় না। এ দিকে জামাইষষ্ঠী এসে পড়ল বলে। শেষমেশ ঠিক আগের দিন, বীরেনদা প্রহসনটি লিখতে বসেন। মাত্র একদিনে একটি বই শুধু লিখে ফেলেননি তিনি, যেদিন সন্ধ্যায় নাটকটি অভিনীত হবে সেদিন চার-পাঁচটি গান লিখে, নিজে সুর দিয়ে কুশীলবদের শিখিয়েও দিয়েছিলেন। নাটকটির নাম ছিল ‘প্রহারেণ ধনঞ্জয়’। যার প্রশংসা আজও লোকের মুখে মুখে ফেরে।

অভিজ্ঞতার নিরিখে কোনটা ঠিক, কোনটা বেঠিক এসব শিখিয়ে দিতেন বীরেনদা আর তাঁর সহকর্মীরা। শেখাতেন স্টেজ থেকে আসা অভিনেতা অভিনেত্রীদের। নিভাননী দেবী, সরযুবালা দেবী, এমনকি একালের শর্মিষ্ঠা দাশগুপ্তও বেতার অভিনয়ের টিপসের ব্যাপারে তাঁদের অকুন্ঠ ঋণের কথা স্বীকার করেছেন। “আকাশবাণী কলকাতা-- আজকের নাটক”  – ধীরে ধীরে রেডিও নাটক জনপ্রিয় হতে লাগলো। শুক্র-শনি-রবি, এই তিনটে দিন ছিল পাবলিক থিয়েটার এর জন্য নির্দিষ্ট। শুক্রবার রাত আটটার নাটকের কাছে হার মেনে রণে ভঙ্গ দিল হাতিবাগানের থিয়েটার। শুক্রবারটা শিফট করে বৃহস্পতিবার নিয়ে যেতে বাধ্য হল কর্তৃপক্ষ।  ঘটনাটির উল্লেখ করলাম রেডিও নাটক কোথায় গিয়ে পোঁছেছিল তা বোঝাবার জন্য।

সব পারফর্মাররাই টীচার হন না। আবার সব টীচাররাই পারফর্মার হন না। দুয়ের এমন সমন্বয় কম মানুষের মধ্যেই দেখা যায়। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ অভনীত ‘চন্দ্রগুপ্ত’ নাটকের চাণক্য কিংবা ‘আলিবাবা’ নাটকের নামভূমিকায় যেমন সেকালের মঞ্চাভিনয়ের স্বাক্ষর, তেমনি ‘প্রহারেণ ধনঞ্জয়’ নামক ফার্সে (নাছোড় ঘরজামাই এর গপ্পো) তাঁর সানুনাসিক বাচনে বলা ‘আসুন না ছোড়দা, একটু কিতকিত খেলে আসি’র মধ্যে খাঁটি রেডিও এক্টিং এর ঘরোয়া আলাপচারিতা। আর শিক্ষক হিসেবে আড্ডা দিতে দিতে তাঁর মণিমুক্তোর মত ছড়ানো পরামর্শ যারা তুলে নিতে পেরেছে, তারাই জানে এসবের মূল্য কি। তিনি বলতেন, রেডিও নাটকের একজন সফল অভিনেতা সঠিক উচ্চারণ, স্বরের আরোহন-অবরোহন, মাইক্রোফোনের কলাকৌশল আয়ত্ত করতেই হয়। একবার ম্যাক্সিম গোর্কীর মা নাটকটির বাংলা রূপান্তর রেডিওয় অভিনীত হয়েছিল। প্রযোজক ছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ। মনে আছে কোন একজন অভিনেতা বারেবারে উচ্চারণে ‘র’ আর ‘ড়’ গুলিয়ে ফেলছিলেন। বীরেনদা প্রযোজক প্যানেল থেকে চিৎকার করে বললেন, “র আর ড় গোলমাল তো অনেকেই পদ্মাপারে রেখে দিয়ে এলেন – তুমি কেন এখনও ওটা ধরে রাখলে?” বলা বাহুল্য অভিনেতা ভদ্রলোকটি ছিলেন পূর্ববঙ্গীয়। অন্যদিকে শ্যামবাজারের দর্জিপারার ‘স’ লাগিয়ে সংলাপ বললেও তেলে বেগুনে জ্বলে উঠতেন তিনি। সম্প্রচারের জন্য হুগলি নদীর তীরবর্তী স্ট্যান্ডার্ড বাংলা বলাই পছন্দ ছিল তাঁর। তবে চরিত্রাভিনয়ের প্রয়োজনে আঞ্চলিকতার দাবিটুকু মেনে নেওয়ার মত আধুনিক মন ছিল বীরেন্দ্রকৃষ্ণর। উচ্চারনে ‘র-ড়’ দোষ কাটাতে উনি শেখাতেন – ‘গড়ের মাঠে গোরুর গাড়ি গড়গড়িয়ে যায়’ বাক্যটি বারে বারে পড়তে। প্রথমটায় ধীরে ধীরে, তারপর দ্রুত গতিতে।

১৯২৯ সাল। রেডিয়োর প্রথা ভেঙে একেবারে অন্য রাস্তায় হাঁটলেন বীরেনদা। মহিলাদের জন্য ‘মহিলা মজলিস’ আরম্ভ করেছিলেন ‘মেঘদূত’ ছদ্মনামে। পরে যদিও তিনি ‘শ্রীবিষ্ণুশর্মা’ ছদ্মনামে অনুষ্ঠান প্রচার করেন। বীরেনদা এই অনুষ্ঠানে বিভিন্ন বিষয়ে বক্তৃতা দিতেন। শ্রোতাদের চিঠিপত্র পড়ে শোনাতেন। পিয়ানো বাজাতেন। মহিলাদের মতামত চাওয়া হলেও বলে দেওয়া হত, মহিলারা যেন ব্যক্তিগত কথা জানিয়ে পত্র না লেখেন। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যে এই অনুষ্ঠান নিয়ে বিতর্ক ওঠে। মহিলাদের কী করা উচিত, বলা উচিত তা বিষ্ণুশর্মা কেন ঠিক করে দেবেন? বহু লোক সে সময় রেডিয়ো স্টেশনে এসে বিষ্ণুশর্মাকে দেখতে চাইতেন। কিন্তু বিষ্ণুশর্মারূপী বীরেন্দ্র ভদ্র আগ্রহী শ্রোতাদের কাছে অধরাই ছিলেন।

রেডিয়ো ছাড়া তো তখন অন্য কোনও বিনোদন মানুষের ছিল না। আর রেডিয়োয় তখন থিয়েটারের ভূত চেপেছিল যেন। বীরেনদাও সেই পথে হেঁটেছিলেন। কিন্তু বীরেনদাকে এক্কেবারে নতুন করে সব কিছু করতে হয়েছিল। তাঁর সামনে তো কোনও কাঠামো ছিল না। কাজ করতে করতে বীরেনদাকে খুঁজে বার করতে হয়েছিল রেডিয়ো নাটকের নিজস্ব ভাষা। কেমন করে পাতা ওল্টাতে হবে, যাতে পাতা ওল্টানোর আওয়াজ না শোনা যায়। সংলাপ বলার সময় চোরা দম কেমন করে নিতে হয়। শুধু কণ্ঠস্বর দিয়ে রাগ, দুঃখ, ভালবাসা সমস্তই প্রকাশ করতে হয় কেমন করে। পরিস্থিতির প্রয়োজনে কেমন করে মাইক্রোফোন থেকে দূরে গিয়ে সংলাপ বলতে হয়, সব বীরেনদা আমাদের শিখিয়েছেন। শিক্ষা দেওয়াতে ওঁর কোনও ক্লান্তি ছিল না। কখনও ধমকাতেন, কখনও ভালবাসতেন, কেউ ওঁর মুখের ওপর কথা বলার সাহস দেখাতে পারত না।

১৯৩১-এর ৮ মে বেতারে অভিনীত হল ডি এল রায়ের ‘সাজাহান’ নাটক। সে এক মনে রাখার মতো ঘটনা! বীরেন্দ্রকৃষ্ণ (আওরঙজেব),অহীন্দ্র চৌধুরী (সাজাহান), দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় (দারা), নিভাননী (জাহানারা), মিস বীণাপাণি (পিয়ারী)। সাধারণ রঙ্গালয়ে অভিনীত গিরিশচন্দ্র ঘোষ, দীনবন্ধু মিত্র, মাইকেল মধুসূদন, ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ, অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, শচীন সেনগুপ্ত প্রমুখ দিকপাল নাট্যকারদের বহু নাটক বীরেন্দ্রকৃষ্ণর প্রযোজনায় বেতারস্থ হয়েছে। অহীন্দ্র চৌধুরী, দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, নরেশ মিত্র, সরযূবালা দেবীকে দিয়ে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ অভিনয় করালেও ওঁর মুখেই শুনেছি শিশির কুমার ভাদুড়ী বেতারে নাটক করতে চাননি। উনি বলেছিলেন, শিশির ভাদুড়ী মাইক্রোফোনের সামনে এসে কেবলই এদিক-ওদিক হাত পা নেড়ে অভিনয় করতে চাইতেন। পরে নাকি বলেছিলেন, ধূর রেডিয়োয় আমি গিয়ে কী করব? সব কেমন বন্ধ, বন্ধ! আমার কিছুই করার নেই!  

রেডিয়োতে তাঁর হাত দিয়ে তৈরি হয় ‘চন্দ্রগুপ্ত’ (দ্বিজেন্দ্রলাল), ‘প্রলয়’(শচীন সেনগুপ্ত), ‘প্রফুল্ল’(গিরিশচন্দ্র ঘোষ)-র মতো নাটক। সব কাজেই এত নিখুঁত সম্পাদনার কাজ করতেন, এখনও ভাবলে অবিশ্বাস্য লাগে। তেমনই এক অভিজ্ঞতার কথা বলি। তখন রেকর্ডিং প্রথা চালু হয়নি। বাঁধা সময়ের মধ্যে অভিনয় শেষ করতে হত। পুরোটাই লাইভ। কাগজ দেখে অভিনয় করে চলেছি। আর বেশ বুঝতে পারছি, আজ আর সময়ের তালে চলা হচ্ছে না। অথচ কী করব, নাটক তো থামানোর উপায় নেই। হঠাৎ দেখি, চুপি চুপি বীরেনদা এসে দাঁড়ালেন। একহাতে আমার মুখ চেপে ধরলেন, অন্য হাতে স্ক্রিপ্টের দু পাতা উল্টে আঙুল দিয়ে একটা জায়গা দেখিয়ে দিলেন। আমি সেইমত অভিনয় করলাম। অভিনয় শেষ হল। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই কলাকুশলীদের নামও বলা হয়ে গেল! কী অদ্ভুত ক্ষমতা! নাটক চলাকালীন তিনি বুঝেছিলেন সম্পাদনা দরকার। তাই এ কাজ করলেন। দু’পাতা বাদ দিলেন। কিন্তু যোগসূত্র ছিন্ন হল না।

বীরেনদার অসম্ভব রকমের এই সব ক্ষমতার জন্য বহু গুণিজন তাঁকে বেশ মান্যি করতেন। আসলে নবীন প্রজন্মের প্রতি তাঁর ছিল অপার স্নেহ। তাঁর প্রযোজিত বেতার নাটকে অভিনয় করে বহু নবাগত নবাগতা পরে বিখ্যাত হয়েছেন। আবার নাটকের মহলার ব্যাপারে তাঁর মত শৃঙ্খলাপরায়ণমানুষ কমই দেখা যায়। সে সময় একটি বেতার নাটকের রেকর্ডিং এর জন্য অন্ততঃ তিনটি রিহার্সাল দিতেই হত। অন্ততঃ বীরেনদার কাছে সেটি ছিল বাধ্যতামূলক। পরে অবশ্য এ নিয়ম আলগা হয়েছিল। তবু বীরেনদার কাছ থেকে মহলা থেকে ছাড়া পাওয়া মুশকিলের।

এ প্রসঙ্গে একদিনের ঘটনা মনে পড়ছে। একটি নাটকের প্রথম দিনের রিহার্সাল সবে শেষ হয়েছে। শিল্পীরা উঠি উঠি করছেন। বিখ্যাত কমেডিয়ান জহর রায় আমতা আমতা করছেন দেখে বীরেনদা বলে উঠলেন। “কি জহর, তোমার আবার কি হল?” “বীরেনদা কাল একটা শুটিং আছে, তাই ভাবছিলাম কালকের দিনটা যদি (বীরেনদা যে জায়গায় বসেছিলেন তার অপর প্রান্তে জহরদা একটু দূরেই বসেছিলেন) আমায় ছেড়ে দেন” – বীরেন ভদ্রর মুখটা গম্ভীর হল। ভুরুটা কুঁচকে গেল – “কাল যে ছবির শুটিং, ওটা আগেও কয়েকদিন হয়েছে কি?” জহর রায় বললেন – “আজ্ঞে তিনদিন হয়েছে।” বীরেনদা প্রায় ছুটে গিয়ে জহরদার পেতে চিমটি কেটে সহাস্যে বললেন, “জহর, ওরা তো তোমাকে তাহলে বাদ দিয়ে দিতে পারবে না।” উপস্থিত সবাই হেসে উঠল। তখন গলাটা খাদে নামিয়ে বললেন, “কাল দশটার সময় একবার ঘুরে যেও, তাড়াতাড়ি ছেড়ে দোব’খন।” জহর রায় আর বীরেনদার মুখের ওপর না বলতে পারলেন না।

জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায়ের কথা বলি। একবার তিনি অল্প টাকা দেওয়ার জন্য স্থির করেছিলেন রেডিয়োতে আর অভিনয় করবেন না। তখন বীরেনদা ওঁকে ডেকে ধমকে বললেন, “তুমি কি রেডিয়োতে টাকা রোজগার করতে এসেছ?” ওই এক কথাতেই কাজ হল। জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায় আর কোনও উচ্চবাচ্চ্য করেননি। রেডিয়োর প্রতি বীরেনদার অমন টান দেখে তিনি আবার রেডিয়োয় চলে আসেন।

বীরেনদার বহুগুণের মধ্যে একটা গুণ ছিল, সময়টাকে নিজের লেখায় সহজে বলে দিতে পারতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে নানারকম অসন্তোষ, ধর্মঘট অচল করে দিচ্ছে কলকাতা। সেই অস্থির দুঃসময়ে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ‘বিরূপাক্ষ’ ছদ্মনামে সেই সময়কালকে ধরার চেষ্টা করেছিলেন। ব্যঙ্গরসের দৃষ্টিতে। সে সময় ভোগ্যপণ্য অগ্নিমূল্য। বীরেনদা লিখেছিলেন,

“কর্তার মেজ বোনের মেয়ে ভুঁদিটার বিয়ে। তাঁর কলকাতার বাড়িতে মামার বিস্তর ঝঞ্ঝাট। লোকলৌকিকতা কমাবার কথা বললে কেউ আমল দেয় না। তাই বলে চারটে মাসিকে বলা হবে না? মেজপিসিমার ননদরা সব কাজে আমাদের বলে, তাদের না বললে চলে? বড়দির ছোট জা ভুঁদির তিন তিনটে সায়া সেলাই করে দিয়েছে, তাকে বলব না? ছোট ঠাকুমার ভাসুরজিকে না বললে বরণডালা তৈরি করবে কে? ন’মাসির দেওর-ঝিদের না বললে চলে? বড় মামার দুই শালিকে বাদ দিলে আর কী এমন খরচটা কমবে!...আর সত্যি কথা ভুঁদির তো পাঁচবার বিয়ে হচ্ছে না!”

বিরূপাক্ষ আসলে ছাপোষা ন্যায়নীতিগ্রস্ত প্রবীণ বাঙালির কথা। এই সম্প্রদায়ের সংখ্যা নেহাত কম নয়। হাস্যরসের আড়ালে বিরূপাক্ষের কথায় তাঁরা তাঁদের নিজেদের মনের কথা খুঁজে পেয়েছিলেন।

এত ভাল ব্যঙ্গরস লিখতেন, এত ধরনের বিষয়ে, অথচ নিজের লেখা সম্পর্কে মমতা বলে কিছুই বীরেনদার ছিল না। বীরেন্দ্রকৃষ্ণর অজস্র রচনা বেতারে পড়া হত বলেই কার্যত সে সব হাওয়া হয়ে গেছে। সে সব আগলে রাখার না ছিল বীরেনদার কোনও বাড়তি আগ্রহ, না ছিল অন্য কারও। পুরনো রেকর্ড করা টেপের ওপরেই নতুন অনুষ্ঠান রেকর্ড করা হয়েছে।ফলে বীরেনদার কত কাজ যে মুছে গেছে, কত লেখা যে হারিয়ে গিয়েছে, তার কোনও হিসেবই নেই। বীরেনদা জানতেন সব। আর ঠাট্টা করে বলতেন, “সংসারের যতটা মজা দেখেছি, তার চেয়ে সংসার আমাকে নিয়ে মজা করেছে বেশি।” এক উদাসী মনের অভিমানও কি ধরা থাকত এমন কথায়? সংসারকে তো উনি কম দিয়ে যাননি। সংসার তাকে দেখল কই! সংসারটা কি সত্যিই ছল? বীরেনদা হয়তো তাই বলতে চেয়েছিলেন।

প্রতিটি মানুষের একটা নিজস্ব গন্ধ আছে। যেমন মায়ের গায়ের গন্ধ,। সেই গন্ধ কাছে এলে মনে হয়, এটা আমার পরম আশ্রয়ের জায়গা। আকাশবাণী স্টুডিয়োতে মাঝে মাঝে একটা গন্ধ পেতাম, সেই গন্ধটা এলেই বুঝতে পারতাম কাছাকাছি তিনি আছেন। সেই গন্ধটা আজও আমার পিছু ছাড়েনি। এই তো সেই গন্ধ হাওয়ায় তাঁকে দেখতে পাচ্ছি... ধুতি-পাঞ্জাবি, চপ্পল পায়ে, গলায় জড়ানো উত্তরীয়, ফর্সা গায়ের রং। তীক্ষ্ণ নাসিকা। ব্যাক ব্রাশ চুল। কাঁচা-পাকা মেদবিহীন লম্বা চেহারার মানুষটা। তিনি ট্রাম থেকে নেমে আপনমনে হাঁটতে হাঁটতে ফুটপাথ দিয়ে সোজা আকাশবাণীর দিকে এগিয়ে চলেছেন। নাম নয়, চেহারা নয়, আস্ত একটা কণ্ঠ, দিগন্ত ছোঁওয়া আকাশ...

রূপং দেহি, ধনং দেহি, যশো দেহি
শক্তির কাছে সুন্দরের প্রার্থনা!



*সংশোধনী: পরিবর্তিত অনুষ্ঠানটির নাম ‘দুর্গে দুর্গতিহারিণীম্।’ এর স্ক্রিপ্ট রচনা করেছিলেন পণ্ডিত ধ্যানেশনারায়ণ চক্রবর্তী। স্তোত্র পাঠ করেছিলেন ডঃ গোবিন্দগোপাল মুখোপাধ্যায় ও মাধুরী চট্টোপাধ্যায়।



লেখক পরিচিতি -  প্রখ্যাত আবৃত্তিকার ও  বাচিক শিল্পী। পারিবারিক উত্তরাধিকার থেকেই নাটক-আবৃত্তির জগতে প্রবেশ। আকাশবাণীর নাট্য প্রযোজনায় বিশেষ কৃতিত্বের অধিকারী। বেতারনাট্যের অভিনেতা ও পরিচালক হিসেবে দুই বাংলাতেই খুব জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। পরবর্তী কালে দূরদর্শনের বহু গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক  পদে আসীন ছিলেন এবং কলকাতা কেন্দ্রের কেন্দ্র নির্দেশক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। বর্তমানে যাদবপুর ও বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথি অধ্যাপক। 

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।