প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

কান পেতে রই...

অবসর (বিশেষ) সংখ্যা , ডিসেম্বর ৩০, ২০১৪

 

নানা রঙের দিন

কেয়া মুখোপাধ্যায়

 

ছোটবেলার রবিবারগুলো ছিল অন্যদিনের থেকে একদম আলাদা। সুন্দর একটা লেসের কভারে ঢাকা থাকত দাদুর আমলের বিরাট বাক্সের মত রেডিওটা। বাইরেটায় বাদামী রঙ, ভেতরটা ক্রীম রঙা। লেসের ঢাকা সরিয়ে, নব ঘুরিয়ে রেডিও চালিয়ে স্টেশন ধরা হত রবিবার সকালে। রেডিও চালু হলে ভেতরে জ্বলে উঠত একটা হালকা আলো আর ঠিক স্টেশনটা ধরতে পারলে, সেইখানটায় তিরতির করে নড়ত মেগাহার্ৎজ দেখানোর লাল কাঁটাটা। কাকুর সঙ্গে রেডিওর সামনে বসে পড়তাম আমি। কাকুর হাতে গীতবিতান। সঙ্গীত শিক্ষার আসরে গলা মেলতাম কাকুর সঙ্গে। কিন্তু মনে মনে অপেক্ষা করে থাকতাম এই আসর শেষ হলেই কতক্ষণে আদরমাখা গলায় শুনতে পাব,“তোমাদের ইন্দিরাদি বলছি।  ছোট্ট  সোনা  বন্ধুরা  ভাই, আদর আর ভালোবাসা নাও। কি, ভালো আছ তো সব?”
আর অনেক কচিকাঁচা গলার সঙ্গে গলা মিলিয়ে লম্বা করে বলব,
“হ্যাঁঅ্যাঁঅ্যাঁঅ্যাঁ... ।”

শিশুমহলের ইন্দিরাদির এই খুশিয়াল ডাকে ভরে উঠত আমার রবিবারের সকালটা। আর বিকেলবেলা আসতেন পার্থ ঘোষ, গল্পদাদুর আসর নিয়ে। কী না হত এই দুই আসরে! মন ভরানো ছড়া, কবিতা, গান, গল্প আবার মাঝে মাঝে নাটকও। শুনতে শুনতে কল্পনার ডানায় ভর করে মন উড়ে যেত যেখানে খুশি। ছোটবেলার রেডিওর স্মৃতি বলতেই মনে পড়ে শিশুমহল আর গল্পদাদুর আসরের কথা, সঙ্গীত শিক্ষার আসরও। ছোট্ট আমি অবাক বিস্ময়ে ভাবতাম, কেমন করে ওইরকম একটা কাঠের বাক্স থেকে এক এক করে বেরিয়ে আসছে মন ভরানো সব গান, কবিতা আর ছড়ার সম্ভার!
বিনোদনের জগতের মুহূর্মুহু বৈদ্যুতিন ঘুর্ণিঝড় তখনও আসেনি। রেডিও অসহায় হয়ে পড়েনি। শৈশব জুড়ে ছিল রেডিও আর তার মধ্যেকার আশ্চর্য কন্ঠের অধিকারী মানুষগুলো। উত্তর কলকাতা থেকে ডালহৌসি হয়ে দক্ষিণে মামারবাড়ি যাবার সময় হালকা গেরিমাটি রঙের বাড়িটার কাছ দিয়ে যেত ট্যাক্সিটা। অপার বিস্ময়ে ঘাড় ঘুরিয়ে আমি তাকিয়ে থাকতাম বাড়িটার দিকে। যতক্ষণ দেখা যায়! বাইরে লেখা ‘আকাশবাণী ভবন।’ বাবা বলেছিলেন, ওই বাড়িতে ঢুকেই গান, বাজনা, কবিতা, নাটক শোনান কত বিখ্যাত মানুষ! তখন থেকেই ওই বাড়িটা এক দুর্নিবার আকর্ষণে টানত আমাকে।

দাদুকে আমি দেখিনি। তিনি ছিলেন সঙ্গীতাচার্য গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছাত্র। শুনেছি গরমকালে সন্ধেবেলা তিনতলার ছাদে গানের আসর বসতো। দাদু গাইতেন ধ্রুপদ, খেয়াল; আর কাকা গাইতেন তাঁর প্রিয় রবীন্দ্রনাথের গান। যাঁর সঙ্গে আত্মার যোগ, সেই-ই আত্মীয়। গোটা পাড়া তখন এক পরিবার, পড়শিরাও আত্মীয়- তাঁরাও আসতেন, যোগ দিতেন। অ্যাকাওস্টিক কি ইলেকট্রিক গীটার বাজিয়ে গান গাইতেন বাবা। কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে মিলে বাবা গীটার শিখতেন প্রখ্যাত সুজিত নাথের কাছে। বাংলার সঙ্গীত জগতে হাওয়াইয়ান গীটারে সুর তোলার প্রাণ পুরুষ এই সুজিত নাথ। স্টীল গীটারকে বাংলার সঙ্গীত মহলে প্রথম পরিচিত করেন সুজিত নাথ। ধুতি আর স্ট্রাইপ দেওয়া বাংলা শার্ট পরে নাইলন স্ট্রিং গীটারের স্ট্র্যাপ বুকে বেঁধে সুর তুলতেন, অসাধারণ পিয়ানো বাজাতেন আর দুর্দান্ত অর্কেস্ট্রেশন করতেন। আকাশবাণীর সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। সুজিত নাথের সবচেয়ে প্রিয় ছাত্র আর বাবার প্রিয় বন্ধু ছিলেন কাজী অনিরুদ্ধ। এভাবে গান বাজনার একটা পরিবেশ বাড়িতে ছিলই। আর ছোটবেলা জুড়ে ছিল অগুনতি লং-প্লেয়িং রেকর্ড। এটা ওটা সংসারের নানা কাজের মাঝে গুন গুন করে করে মায়ের গাওয়া রবিঠাকুরের গান আমিও গাইবার চেষ্টা করতাম। গানের পাশাপাশি, বুঝি না বুঝি শ্যামা কি শাপমোচন গীতিনাট্য আশ্চর্য মুগ্ধতা ছড়িয়ে দিত আমার মনে।
কিন্তু সেই সব কিছুকে ছাপিয়ে আমাকে টানত রেডিওর নাটক। শুক্রবার রাত আটটা আর শনিবার ও রবিবার ইথার তরঙ্গে ছড়িয়ে পড়ত দুরন্ত কন্ঠশৈলীর অধিকারী কিছু মানুষের অভিনয়। না, দৃশ্যমান নয়, সবটাই শ্রাব্য। শুধু কন্ঠ দিয়ে আর আশ্চর্য স্বরক্ষেপণে অচেনা, অদেখা কিছু মানুষ গল্পের এক একটা চরিত্র হয়ে উঠে সুখ-দুঃখ, আনন্দ-আবেগ, হাসি-কান্নার রোলার কোস্টারে চড়াতেন শ্রোতাদের। কলকাতা ‘ক’ আর বিবিধ ভারতী মিলিয়ে শ্রোতাদের শ্রবণসুখের সে যেন এক স্বর্ণযুগ! আমার ছোটবেলায় প্রথমে শিশুমহল, তারপর গল্পদাদুর আসর এবং তারও পরে কলকাতা ‘ক’ আর বিবিধ ভারতীর নাটকের অনুষ্ঠানগুলো ছিল আমার ‘গল্প বলা বন্ধু।’ গল্প শেষ হওয়ার পরও কাটতে চাইত না মুগ্ধতার ঘোর। কল্পনার অবাধ তেপান্তরের মাঠে ইচ্ছে মত ছুটিয়ে দিতাম পক্ষীরাজ। কত মন খারাপের দুপুর কি বিকেলে মন ভালো করা কমলা রঙা রোদ্দুর এনে দিত এইসব গল্প।

নাটকের বৈচিত্র্যের তো কোন সীমা পরিসীমা ছিল না বিবিধ ভারতীতে। দেশি বিদেশী কত অজস্র কাহিনীর যে নাট্যরূপ প্রচারিত হয়েছে! একদিনের পূর্ণাঙ্গ নাটক বা গল্প, আবার দীর্ঘদিন ধরে চলা ধারাবাহিক নাটক। স্মৃতির সরণী বেয়ে পিছু ফিরে চাইলে মনে পড়ে বেশ কয়েকটি এমন অনুষ্ঠান, যা ছিল সেই সময়ের শ্রোতাদের নিত্য শ্রবণসঙ্গী। বোরোলীনের সংসার, বাটা-র গল্পের আসর, হাতুড়ি মার্কা ফিনাইল এক্স-এর শনিবারের বারবেলা, কেয়োকার্পিন নাটকের দিন, শালিমারের নাটকের আসর, পি-থ্রী রহস্য সিরিজ, অমর কাহিনী আরব্য রজনী...বলে শেষ করা যাবে না! এক দিকে যেমন সদ্য পড়ে শেষ করা শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘তুঙ্গভদ্রার তীরে’র নাট্যরূপায়ণে ভেসে গেছি  প্রবল উচ্ছ্বাসে, অন্যদিকে শিহরিত হয়েছি গড ফাদার, ডঃ জেকিল অ্যান্ড মিঃ হাইড, কিংবা ড্রাকুলা শুনতে শুনতে। জেমস হেডলি চেজ, হ্যারল্ড রবিন্স, ব্রাম স্টোকার- জগৎ বিখ্যাত থ্রিলার লেখকরা বাংলা অনুবাদের মাধ্যমে নাট্যরূপে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন বেতার যন্ত্রে।

রবিঠাকুরের ‘ডাকঘর’ আর ‘ছুটি’ শুনে চোখের জলে ভেসেছি। এক রবিবার দুপুরে নাটক হল ‘কোনি।’ মতি নন্দীর গল্পটা পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম আগেই। রেডিওতে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখলেন সত্য বন্দ্যোপাধ্যায় আর শাঁওলী মিত্র। জলের মধ্যে থেকে শাঁওলী মিত্র-র ‘ক্ষিত্-দা...’ ডাক যেন একেবারে ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিয়ে গেল আমাকে, সেইসঙ্গে রক্তমাংসের সাঁতারের কোচ সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্ষিত্-দা! সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিনয়ে আপাত কঠিন, অথচ অন্তরে কোমল মানুষটি মুহূর্তে বেরিয়ে আসে যখন একেবারে শেষে কোনি বলে–
'ক্ষিত্-দা, জলের মধ্যে আমার পেটে ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছিল। চারদিকে তাকিয়ে তোমায় খুঁজছিলাম। কোথায় ছিলে তুমি?'
আর ক্ষিত্-দা-রূপী সত্য বন্দ্যোপাধ্যায় ভারি মায়াময় গলায় বলে ওঠেন–
'ঐ যন্ত্রণাটাই তো আমি রে কোনি!'
বিমল কর-এর অসময় নাটকেও ‘আয়না’ চরিত্রে অসামান্য অভিনয় করেছিলেন শাঁওলী মিত্র।      

মা তো গলা শুনেই বলে দিতেন কোন চরিত্রে বিকাশ রায়, কোনজন বসন্ত চৌধুরী, কে অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় আর কোনটি নির্মলকুমার। টোনাল কোয়ালিটি সবার আলাদা আলাদা। বিবিধ ভারতীতে পি-থ্রী রহস্য সিরিজে তখন চলছে ‘ডঃ জেকিল অ্যান্ড মিঃ হাইড।’ নাটকটা বেশ একটা সেনসেশন তৈরি করেছিল। মূল দুটি চরিত্রের দুই অভিনেতারই জলদমন্দ্র কন্ঠ, টোনাল কোয়ালিটিতেও কোথায় যেন একটা সূক্ষ্ম মিল। বিবিধ ভারতীতে অভিনেতাদের নাম বলা হত না। সে যেন এক পাজল! এক দাদা বললেন, মিঃ হাইড গৌতম চক্রবর্তী। আর ডঃ জেকিল?

সেরকমই এক শুক্রবার সন্ধেবেলা কাকু বললেন, আজকের নাটকটা শুনো। নাটকটা ছিল ‘রক্তঋণ।’ একটি মেয়েকে জীবনের চরম মুহূর্তে  রক্তদান করে তার প্রাণ বাঁচাবে গল্পের নায়ক। ভালও বেসে ফেলবে। কিন্তু সে কথা বলা হয়ে ওঠে না। বিয়ে হয়ে মেয়েটি চলে যায় অনেক দূরে। বহু বছর পরে ট্রেনে তাদের হঠাৎ দেখা।  একটা জাদুময় গলা টেনে রাখল শুরু থেকে শেষ। খুব চেনা গলা। বিবিধ ভারতীর কত নাটকেও শুনেছি। নাটক শেষ হতে নাম ঘোষণা হল সতীনাথ মুখোপাধ্যায়। চিনতে পারলাম ডঃ জেকিলকে। প্রিয় অভিনেতার তালিকায় জুড়ে গেল আর একটা নাম। গৌতম চক্রবর্তী ও সতীনাথ মুখোপাধ্যেয়ের টোনাল কোয়ালিটির এই মিল কাজে লাগিয়েই শ্রাবন্তী মজুমদারের প্রযোজনায় ‘ডঃ জেকিল অ্যান্ড মিঃ হাইড’, মুগ্ধ করেছিল শ্রোতাদের।

কি আকাশবাণীর নাটক, কি  বিবিধ ভারতী, দু’জায়গাতেই গৌতমের ভূমিকা দারুণ। অনেকের মতে উনি প্রায় ‘রেডিওর উত্তমকুমার।’ ছিপছিপে রোগা পাতলা চেহারা, কিন্তু জলদমন্দ্র কন্ঠ। চেহারা আর কন্ঠের অদ্ভুত এই বৈষম্যই বোধহয় চলচ্চিত্রে বা টিভি সিরিয়ালে গৌতমের সাফল্যের অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তবে রেডিওতে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। 

গৌতম চক্রবর্তীর পরে এসে, একই ভাবে আশ্চর্য এক রোম্যান্টিক কন্ঠশৈলী দিয়ে বিবিধ ভারতী আর কলকাতা ‘ক’-র নাটক, দু’জায়গাতেই শ্রোতাদের মন জয় করে নিলেন সতীনাথ। যশোবন্তী, চিতি সাপের বিষ, ভালো-মা, ছোটবাবু, সত্যসন্ধ- দুরন্ত সব প্রোডাকশনে তাঁর অভিনয় ছিল অনবদ্য।

শ্রাবন্তী মজুমদারের প্রেজেন্টেশনেও মুগ্ধ ছিলাম আমি। একটু হাস্কি ভারী গলা, তার সঙ্গে এক চিমটে ন্যাকামি আর মাঝে মধ্যে কথায় একটু ইন্টিমেট সেক্সি পরশে কন্ঠকে আরো মোহময়ী করে তুলতেন শ্রাবন্তী। বোরোলীনের আসর কিংবা ওয়েসিস ‘মনের মত গান, মনে রাখার কথা’-র জিঙ্গল থেকে দুরন্ত উপস্থাপনা- সব কিছু দিয়ে মনের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছিলেন তিনি।

রেডিও আর সেখানকার অসামান্য কন্ঠশৈলীর মানুষগুলোর অভিনয়ে মুগ্ধ হলেও কখনো ভাবিনি ঐ বাড়িতে ঢুকে আমিও কোনদিন কিছুতে অংশ নেব। পড়াশোনার পাশাপাশি আবৃত্তি, ডিবেট, ক্যুইজ এইসব নিয়েই কাটত স্কুলের দিনগুলো। ক্লাস ফাইভে সপ্তাহে একদিন আমাদের ছিল ‘খেয়ালখুশি’-র পিরিয়ড। একবার বলা হল টেক্সট বইয়ের যে কোন একটা গল্পকে নাটকের ডায়ালগের মত করে লিখতে। সুকুমার রায়ের ‘রাজার অসুখ’-এর নাট্যরূপ দিয়ে ফেললাম। মনে আছে, দরকার মনে করায় কয়েকটা চরিত্র জুড়েও দিয়েছিলাম। সবাই খাতা ফেরত পেয়ে গেল। শুধু আমি বাদ। আমারটা নিয়ে চলে গেলেন দিদি। কী ব্যাপার কে জানে! পরের দিন শুনলাম, স্কুলের দিদিদের পছন্দ হওয়াতে সরস্বতী পুজোর সন্ধ্যেয় আমার করা সেই নাট্যরূপের অভিনয় হবে। আমিই হলাম মন্ত্রীমশাই। কি খুশিই যে হয়েছিলাম! লেখালিখি চলতে মাঝে মাঝেই। ক্লাস এইটে ইংরেজির দিদি বললেন ‘বিদ্যার্থীদের জন্য’ অনুষ্ঠানে আমাকে যেতে হবে। সঙ্গে আরো দুই বন্ধু। রেডিওর দুপুরবেলার এই অনুষ্ঠানে স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের জন্য সিলেবাসের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হত। নির্দিষ্ট বিষয়ের একজন মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে থাকতেন সেই স্কুলের পড়াশোনায় সেরা তিন-চারজন ছাত্র। আলাপচারিতায় বেশ প্রাঞ্জল করে বিষয়টি বুঝিয়ে দেওয়া হত। রীতিমত স্ক্রিপ্ট তৈরি করে নিয়ে পড়া হল। রেকর্ডিং এর দিন প্রথম সেই বিশাল বাড়িটাতে ঢোকা। সে যে কি উত্তেজনা!

মাঝে কেটে গেল কয়েকটা বছর। আগেই সিন্দুক-প্রমাণ ভাল্ভ রেডিওর জায়গা নিয়ে নিয়েছিল আধুনিক প্রযুক্তির ট্রানজিস্টার। ছোট হতে হতে কিছু কিছু এমন মডেল তৈরি হল, যা প্রায় হাল আমলের সেলফোনের সাইজ- অনায়াসে পকেটে ঢুকিয়ে নেওয়া যায়। হাতে হাতে, কানে কানে রেডিওর জনপ্রিয়তায় নতুন মাত্রা এনে দিয়েছিল ব্যাটারিচালিত ট্রানজিস্টার। কিন্তু এর পাশাপাশি আশির দশক পেরিয়ে নব্বই দশকের মাঝামাঝি তথ্য-প্রযুক্তি আর টেলিভিশনের দৌলতে বদলে গেল বিনোদনের ধরণ। বিজ্ঞাপনের ধরণও। উন্মুক্ত আকাশ হারিয়ে কল্পনার পক্ষীরাজ ক্রমশ আটকে পড়ল টেলিভিশনের বাক্সে। শেষে বন্ধই হয়ে গেল বিবিধ ভারতীর বিজ্ঞাপন কার্যক্রমের বাংলা অনুষ্ঠান। হারিয়ে গেল গল্পের সেইসব সোনার খনি। কলকাতা ‘ক’-র নাটকের প্রতি আমার বিশ্বস্ততা আর আকর্ষণ তখনো অটল। কিন্তু নতুন নাটক আর হয় না সেভাবে। পুরোন নাটকেরই পুনঃপ্রচার। আসলে রেডিওর তখন দুয়োরাণীর অবস্থা। টেলিভিশনের সঙ্গে পাল্লা দিতে না পেরে রেডিওর এই ব্যাকফুটে চলে যাওয়া কিন্তু শুধু আমাদের দেশে হয়নি। হয়েছিল দুনিয়া জুড়েই। কিন্তু অন্য দেশ সামলে উঠলেও আমরা তখনো পারিনি। বাড়িতে ঢুকে পড়া টিভি সিরিয়ালের প্রবল ঢেউ কেড়ে নিল রেডিওর অগুন্তি বিশ্বস্ত শ্রোতা। তার সঙ্গে ছিল আকাশবাণীর টেকনোলজিক্যাল দুর্বলতাও। ট্রান্সমিশন কোয়ালিটি ক্রমশ খারাপ। শুনতে বসলেও ঘ্যাঁস ঘ্যাঁস আওয়াজ আর ভাল করে শুনতে দেয় কই! মহালয়ার আগের দিন শুধু একবার দেখে শুনে নিয়ে নতুন ব্যাটারি ভরে রাখা হয় ভোরবেলার মহিষাসুরমর্দিনী শোনার জন্যে। বছরে ঐ একবারই বলতে গেলে।

এমন সময়, নব্বইয়ের মাঝামাঝি নাগাদ মিডিয়াম ওয়েভের সঙ্গে হাত মিলিয়ে হৈ হৈ করে এসে পড়ল ফ্রিকোয়েন্সি মডুলেশন বা এফ.এম.। শুধু এসে পড়লই নয়, একেবারে ভিনি ভিডি ভিসি বলে আবার নতুন করে জিতে নিল শ্রোতাদের মন। এফ.এম-এর উন্নত প্রযুক্তি যেন রেডিওকে এক নতুন জীবন দিল। চলমান গাড়িতে বা ট্রেনে বসে শুনলেও ট্রান্সমিশনের গুণমানের বিন্দুমাত্র তারতম্য ঘটত না। জনপ্রিয়তা তাই বাড়তে শুরু করল দিনে দিনে। সেই শুরুর দিকে আকাশবাণী ভবনেই আকাশবাণীর এফ.এম. চ্যানেল ছাড়াও আলাদা আলাদা সময় কিনে অনুষ্ঠান শুরু করল টাইমস এফ.এম, এইচএমভি এফ.এম।

টাইমস এফ.এম-এ হত মূলত হিন্দি অনুষ্ঠান। আর দারুণ সব বাংলা অনুষ্ঠান এইচএমভি এফ.এম-এ। সত্যি কথা বলতে কি, আমি সে সময়ে এইচএমভি এফ.এম-ই শুনতাম। কলকাতা দূরদর্শনের চার সেলিব্রিটি তখন প্রেজেন্টার সেখানে। সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, দেবরাজ রায়, ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায় আর মধুমন্তী মৈত্র। ঝকঝকে সম্প্রচার, দুরন্ত সব অনুষ্ঠান এক একটা। এর মধ্যে আর একটা বিস্ফোরণ ঘটে গেছে। ‘নাগরিক ক্লান্তিতে তোমাকে চাই/ একফোঁটা শান্তিতে তোমাকে চাই/ বহুদূর হেঁটে এসে তোমাকে চাই/ এ জীবন ভালবেসে তোমাকে চাই’ গেয়ে গীটারহাতে এক নাগরিক গানওয়ালা ঝড়ের মত এসে আমাকে জিতে নিয়েছেন। না, শুধু আমাকে নয়, আমাদের প্রজন্মকেই। এইচএমভি এফ.এম-এ সেই সুমন চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে দু’ঘন্টার আড্ডা সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের। কাগজে তার বিজ্ঞাপন। কখনো সঙ্গে আবার নাটক আর গল্প দিয়ে সাজানো অনুষ্ঠান।  আর কী চাই? গোটা তরুণ প্রজন্ম তখন এইচএমভি এফ.এম-এর অনুরাগী শ্রোতা।

অন্যদিকে আকাশবাণী এফ.এম-এ তখন অনুষ্ঠান প্রেজেন্ট করতেন নাটক বিভাগের শিল্পীরা। স্বরাজ বসু, পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সৌমিত্র বসু, সৌম্যদেব বসু, দেবাশিস রায়চৌধুরী, অঙ্গনা বসু, সুমিতা বসু, গৌরীশঙ্কর পান্ডা প্রমুখরা। কোন একটা বিষয় ধরে আলোচনা আর মাঝে মাঝে গান, বিকেলে আর রাতে। সকালে আর দুপুরে নতুন রূপে ফিরে এল অনুরোধের আসর, ‘গানের ভেলা’ নাম নিয়ে। ইংরেজি আর হিন্দি গানের অনুষ্ঠানও ছিল এর মাঝে মাঝে।

আরো অনেকের মত এফ.এম. আমাকে আবার রেডিওমুখী করল। সেইসঙ্গে কলেজ জীবনের পাশাপাশি চলছিল পাঠাভিনয়ের চর্চাও। সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের কাছেই নাটক আর গান-ভালবাসা সমমনস্ক কিছু বন্ধু মিলে তালিম নিচ্ছিলাম পাঠাভিনয়ের। তাঁর কাছে পড়তে পড়তে নতুন নতুন ব্যঞ্জনায় আর নতুনতর অর্থে আবিষ্কার করেছি রবিঠাকুরের রক্তকরবী। রবিঠাকুরেরর অনেক বলা কথার মাঝের না বলা বাণীর ঘনযামিনীও ধরা দিয়েছে চেতনায়। মাঝে মধ্যে টুকটাক দুটো একটা অনুষ্ঠানে মঞ্চে শ্রুতিনাটকও করতাম। মাইক্রোফোনের সামনে কথা বলা, কখন কতটা দূরে আর কখন কাছে-  শ্রুতি অভিনয়ের নানারকম সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম পাঠ আমার তাঁরই কাছে। এসবের মধ্যেই অংশ নিলাম এইচএমভি এফ.এম-এর টক শো ‘বিচিত্রিতা’-য়, সতীনাথ মুখোপাধ্যায় আর মধুমন্তী মৈত্র-র সঙ্গে। খুব বেশি প্রস্তুতির সুযোগ ছিল না। আর ফর্ম্যাটটাও নতুন। সে যাই হোক, খুব আনন্দ পেয়েছিলাম।

আমাদের পাঠাভিনয় চর্চার সঙ্গী, খুব উত্সাহী এক বন্ধু একদিন এসে বলল, এফ.এম-এ অনুষ্ঠান প্রেজেন্ট করার জন্যে আকাশবাণী নতুন ছেলেমেয়েদের খুঁজছেন। বললাম, বেশ তো- অ্যাপ্লাই করে দে। কিন্তু সে নাছোড়বান্দা। আমি না গেলে যাবে না। ঠিক ভরসা পাচ্ছে না! তার উৎসাহের প্রাবল্যেই ফর্ম জমা হল। কিছুদিন পর চিঠি এল, লিখিত পরীক্ষা! কী কান্ড! সিলেবাসের পরীক্ষার মধ্যে আবার একখানা সিলেবাসের বাইরের পরীক্ষা! কোনও মানে হয়!

নির্দিষ্ট দিনে গেলাম। হিন্দু স্কুলে সিট। অগুনতি মানুষ- কয়েক’শো তো বটেই। সিরিয়াল করা কিছু চেনা/ আধচেনা মুখও আছে। এঁরাও? মনে মনে ভাবছি, বন্ধুকৃত্য করতে গিয়ে একটা ছুটির দিনের ঝাড়া তিন-তিনটি ঘন্টা নষ্ট! এত ক্যাজুয়ালি কোন পরীক্ষা দিতে যাইনি কোনদিন। প্রশ্নপত্র হাতে নিয়ে কিন্তু অন্য কথা মনে হল। নাঃ, এসেছি যখন, পরীক্ষাটা ভাল করে দেওয়াই উচিত। নানা বিভাগে সাজানো প্রশ্নপত্রের শেষ দুটি ভাগে ছিল ক্রিয়েটিভ রাইটিং - অনুষ্ঠান প্রেজেন্ট করা নিয়ে। কয়েকটি বিষয় দিয়ে বলা হয়েছিল সেই বিষয়ের অনুষ্ঠান উপস্থাপনা কিভাবে করবে দুজন- সেই স্ক্রিপ্ট লিখতে। যতদূর মনে পড়ে, বেশ ভালই দাঁড়িয়েছিল। 

পড়াশোনার চাপে ভুলেই গিয়েছিলাম প্রায়। মাস দুই পর বাড়ি ফিরতে একটা বাদামী খাম ধরিয়ে দিলেন বাবা। ওপরে AIR ছাপ দেওয়া। খুলে দেখি রেডিওয় অডিশনের ডাক।
মরেছে! এবার? আবারও সতীনাথ মুখোপাধ্যায়। তিনি বললেন, রেডিওর একটা নিজস্ব ভাষা আছে। সে ভাষা লেখার ভাষার থেকে আলাদা। এমনভাবে কথা বলতে হবে, যাতে আমাকে দেখতে না পাওয়া, রেডিওর ওপ্রান্তে থাকা মানুষটির সঙ্গেও কম্যুনিকেশনটা ঠিকঠাক হয়। কথায় কথায় একটা সেতু তৈরি হয়। শ্রোতা যেন বুঝতে পারে সহজেই। 
অডিশনে একটা ঘরে একটি ছেলে একটি  মেয়ে আর পর্দার ওপারে পরীক্ষকরা - যাঁদের দেখা যায় না, শুধু শোনা যায়।
তারপর কোথা হইতে কী হইয়া গেল বোঝা গেল না। হঠাৎ দেখিলাম আমি আকাশবাণী এফ.এম-এর প্রেজেন্টার নির্বাচিত হইয়াছি!

চিরকালই রেডিওর ভূমিকা বিনোদনের, এন্টারটেইনমেন্ট। এফ.এম-এর দৌলতে একটু পাল্টে গেল এই ভূমিকা।  এফ.এম-এর কাজ- ‘ইনফোটেইনমেন্ট,’ তথ্য এসে হাত ধরল বিনোদনের। তখন দিনে তিনটে লাইভ টক শো হত, ভোর পাঁচটা থেকে সাতটা ‘ভোরাই’, বিকেল চারটে থেকে ছটা ‘আলাপন’, আর রাত দশটা থেকে বারোটা ‘আজ রাতে।’ সেটা ১৯৯৮ এর অগাস্ট মাস। আমার প্রথম অনুষ্ঠান বিকেলে, আলাপন। সব টক-শো-ই ছিল 'ফোন ইন' অনুষ্ঠান, মানে শ্রোতারা ফোন করে সরাসরি অংশ নেবেন লাইভ অনুষ্ঠানে। আধঘন্টা পর শ্রোতাদের ফোন নিলাম। অভিনন্দন পেয়ে বুঝলাম কাজটা ঠিকঠাকই করতে পারছি। সকলেই বলছিলেন, মনেই হচ্ছে না আজ আপনার প্রথম অনুষ্ঠান! এর থেকে বড় প্রাপ্তি আর কী হতে পারে প্রথম দিনে?

আমার সেই শুরুর দিনগুলোতে এক ঝলক খোলা হাওয়ার মত এফ.এম-এ এসেছিলেন নতুন প্রোগ্রাম এক্সিকিউটিভ কৃষ্ণশর্বরী দাশগুপ্ত। একটা খাতা রেখেছিলেন এফ.এম-এর ঘরে- ‘ইচ্ছে খাতা।’ যার যা বিশেষ অনুষ্ঠান করার ইচ্ছে, তাতে লিখে রাখবে। পরের মাসের ডিউটি চার্ট করার সময় সেসব দেখে অনুষ্ঠান দেবেন তিনি।
সবে কয়েকদিন আগে বিকেলবেলা জীবনের প্রথম দু’ঘন্টার লাইভ টক-শো হোস্ট করেছি। মাসের শেষে নতুন ডিউটি চার্টে দেখি তারপরের অনুষ্ঠানই ‘আজ রাতে’ এবং বিষয় ‘কফি হাউস।’ কফিহাউসের আড্ডা নিয়ে অনুষ্ঠানের ইচ্ছে আমিই প্রকাশ করেছিলাম। লিখে রেখেছিলাম ইচ্ছে খাতায়। কিন্তু জীবনের দ্বিতীয় অনুষ্ঠানই যে সেটা হবে, ভাবতে পারিনি। আসলে ‘আজ রাতে’ ছিল প্রাইম স্লট। নতুন কাউকে সেখানে দেওয়া হত না খুব একটা। আর রেডিওর এফ.এম. কর্মী থেকে শুরু করে স্টেশন ডিরেক্টর (‘এস.ডি.’ বলারই চল ছিল)- সকলেই শুনতেন ‘আজ রাতে।’ তাই ডবল চাপ!

অনুষ্ঠানের দিনটা ছিল ৭ই সেপ্টেম্বর। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্মদিন। শর্বরীদি বললেন, সেদিনই আকাশবাণীর এফ.এম-এ কফিহাউসের আড্ডা নিয়ে ‘আজ রাতে’ অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে তাঁকে স্টুডিওতে উপস্থিত থাকার অনুরোধ করতে হবে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ফোন নম্বরটা লিখে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘তাহলে কাল সকালে কথা বলে নিয়ে আমাকে জানিও।'

পরদিন সকালে হাতে ফোন নম্বরটা ধরা, মনে মনে প্রস্তুতি চলছে কী বলব তার। নিজেকে বলছি, ‘এবার তাহলে ফোনটা করে ফেলা যাক।’  বার দশেক বলা হল কথাটা। কিন্তু ওই অবধিই। ফোনটা করা আর হয়ে উঠছে না।
সেই ছোটবেলা থেকে তাঁর লেখার সঙ্গে পরিচয়। কিন্তু সরাসরি কথা বলা! যাইহোক, দ্বিধা কাটিয়ে শেষমেশ করেই ফেললাম ফোনটা।
রিং হবার পর ওদিক থেকে একটা শান্ত গলায় দীর্ঘ ‘হ্যালো...’
ব্যস! গড়গড় করে বলে ফেললাম,
‘আগামী সাতই সেপ্টেম্বর কফিহাউস নিয়ে আড্ডা এফ.এম-এ। আপনাকে স্টুডিওতে অতিথি হিসেবে চাই। আপনাকে ছাড়া কি কফি হাউসের আড্ডা হয়?’
ওদিকে মৃদু হাসি। তারপর উত্তর এল,
‘কেন হবে না? মান্না দে-কে নিয়েও চমৎকার হয়। আহা কি দারুণ গানটা বলো!’
শুনিয়েই দিলেন দু-কলি। ব্যস! আমি পুরো বোল্ড আউট। তবু একটু যুক্তি খাড়া করার আপ্রাণ চেষ্টা-
‘নিশ্চয়ই। ওই গানটা তো ইতিহাস। কিন্তু আমরা আসলে শুনতে চাইছি আমাদের কবি- সাহিত্যিকদের কথা, তাঁদের সৃষ্টির গোড়ার দিনগুলোতে কী অনিবার্যভাবে মিশে ছিল কফিহাউস – সেই সব গল্প।’
‘শুধু পুরনো দিন? এখনো তো যান অনেকে। আমি অবশ্য পারি না খুব বেশি যেতে...কফি হাউস পত্রিকায় কফি হাউস নিয়ে আমার একটা কবিতা বেরিয়েছিল জানো অনেকদিন আগে...’

এইভাবে গল্প শুরু হল। এফ.এম-এর সেই অনুষ্ঠানটায় সুনীলদা আসতে পারেননি। কিন্তু তাঁর বাড়িতে যেতে বলেছিলেন। আড্ডা দিতে দিতে রেকর্ড করা সেইসব কথা, কবিতা শুনিয়েছিলাম শ্রোতাদের। তার পর থেকে দেশে বিদেশে কতবার যে দেখা আর আড্ডা হয়েছে সুনীলদার সঙ্গে! এও তো এফ.এম-এর সূত্রেই পাওয়া!

কফি হাউস নিয়ে ঐ অনুষ্ঠানের আগের শনিবার সেখানে গিয়ে কথা বলে এসেছিলাম সমসাময়িক কিছু বিশিষ্ট সাহিত্যিকের সঙ্গেও, যাঁদের জীবন জুড়ে তখনও কফি হাউস। শেখর বসু, শৈবাল মিত্র, অমর মিত্র এবং আরো অনেকের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। সকলেই ঐ লাইভ অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন ফোনের মাধ্যমে আর কথায়, গল্পে সমৃদ্ধ করেছিলেন অনুষ্ঠানকে। খুব উপভোগ করেছিলেন শ্রোতারাও।

প্রচলিত ধারার নানা অনুষ্ঠান তো ছিলই। ভালবাসার ভ্যালেন্টাইনস ডে, পুজোর একাল-সেকাল থেকে কবিতার ক্যানভাস- বৈচিত্র্য নানারকম। আমার কিন্তু ইচ্ছে করত একটু অন্য রকম কিছু করতে। খুব উত্সাহ দিতেন প্রোগ্রাম এক্সিকিউটিভ কৃষ্ণশর্বরীদি। একবার ইচ্ছে খাতায় লিখলাম 'ইউথ্যানাশিয়া' নিয়ে অনুষ্ঠান করতে চাই। শর্বরীদি তো উচ্ছ্বসিত- যদিও প্রকাশ্যে তা দেখাবার খুব একটা উপায় ছিল না তাঁর। বিষয়টা খুব সেন্সিটিভ, বিতর্কিতও। তাই স্টেশন ডিরেক্টর এর অনুমোদন চাই। স্টেশন ডিরেক্টর তখন ডঃ অমিত চক্রবর্তী। বিজ্ঞানের মানুষ। অমিতদার প্রথম প্রশ্নই ছিল- ‘নিজে করতে চাইছে?  অন্য কেউ পাবলিককে বিষয়টা খাওয়াতে চাইছে না তো!’ আসলে কোনো বিতর্ক হলে জবাবদিহি তো তাঁকেই করতে হবে, তাই বুঝে নিতে চাইছিলেন। নিশ্চিত হয়ে অনুমতি দিয়েছিলেন। শ্রোতাদের স্বতঃস্ফূর্ত ফোনে আর আবেগে কী ভাবে যে কেটে গিয়েছিল দুটো ঘন্টা! অনেকেই খুব প্রশংসা করেছিলেন, অমিতদাও।

মিউজিক থেরাপি, সেক্স ওয়ার্কারদের এডস্ সচেতনতা- এইরকম সব বিষয়গুলোও শ্রোতাদের মন ছুঁয়ে গিয়েছিল। মনে আছে, ১লা ডিসেম্বরের ওয়ার্ল্ড এডস্ ডে-তে ‘আজ রাতে’-র সেই অনুষ্ঠানের পর শ্রোতারা অনেক অজানা কথা জেনে উচ্ছ্বসিত হলেও আমাকে বেশ বকা-ঝকা শুনতে হয়েছিল বাড়িতে। সেক্স ওয়ার্কারদের বক্তব্য রেকর্ড করে  আনতে যেসব জায়গায় যেতে হয়েছিল, সেটা মনে করেই আমার নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত হয়েছিলেন তাঁরা। এটুকু বাদ দিলে, বরাবরই বাড়ির সকলে, আমার বন্ধুরা ও সহকর্মীরা ভীষণ উৎসাহ দিতেন আমাকে আর ভুল-ত্রুটিগুলো ধরিয়ে দিয়ে ঠিক পথটা দেখিয়ে দিতেন সতীনাথ মুখোপাধ্যায়।

১৯৯৯ থেকে শুরু করে বিজ্ঞান বিভাগের প্রোগ্রাম এক্সিকিউটিভ মানসপ্রতিমদার সঙ্গে দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে প্রেজেন্ট করেছিলাম ‘বিজ্ঞান রসিকের দরবারে।’ মানসপ্রতিমদারই ভাবনার ফসল এই অনুষ্ঠান। বিজ্ঞান নিয়ে এফ.এম-এর প্রাইম স্লটে দু’ঘন্টার নিয়মিত অনুষ্ঠান করা সহজ ছিল না মোটেই। শ্রোতারা আদৌ শুনতে আগ্রহী হবেন কিনা- এ নিয়ে নানারকম মত ছিল। বিজ্ঞান কীভাবে মানুষকে বিনোদন দেবে- সেটা সকলে বুঝতে পারেননি। শুরুর দিন থেকেই যে সফল হয়েছিল অনুষ্ঠানটি- এমন নয়। কিন্তু আস্তে আস্তে নবীন থেকে প্রবীণ- সব বয়সের অগণিত মানুষ বিজ্ঞান রসিকের এই দরবারে সামিল হলেন। সহজ কথায় সাধারণ মানুষের মধ্যে বিজ্ঞান সচতনতা ছড়িয়ে দিতে এই অনুষ্ঠানটির বিকল্প হয় না। গত বছর অনুষ্ঠানটি দেড় দশক পার করল। এটা নিঃসন্দেহে খুব বড় অ্যাচিভমেন্ট।

ইউনিভার্সিটি পেরিয়ে গবেষণায় যুক্ত হলাম যখন, কাজের চাপ বাড়ল অনেকটাই। তারই মধ্যে ব্যালেন্স করে অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি আর প্রেজেন্টেশন। সেসময় একটা জরুরী ভ্যাকসিন-এর ফেজ-থ্রী হিউম্যান ট্রায়াল চলছিল। কখনো কখনো সকাল সাতটায় পৌঁছে যেতে হত ল্যাবে। আবার সেদিনই হয়তো ‘আজ রাতে’ অনুষ্ঠান রেডিওতে। এরকম লম্বা একটা কাজের দিনের শেষে আকাশবাণী পৌঁছে একবার ক্যান্টিনে ঢুঁ মারলেই ব্যস! হুল্লোড় আর হাজার মজার কথার তুবড়িতে উধাও ক্লান্তি। পুজোর সময় ক’দিন ক্যান্টিন বন্ধ। একবার বিজয়ার পর সিনিয়র একজনকে ধরা হল খাওয়াতে। কেক আর চা ছাড়া আর কিছু নেই ক্যান্টিনে। কেক খেতে খেতে গলা শুকিয়ে কাঠ, এমন ড্রাই সে কেক! সবারই এক অভিযোগ। এমন সময় ঢুকল সিদ্ধার্থদা, বাংলা আর হিন্দি গানের চলমান এনসাইক্লোপিডিয়া। ব্যাপারটা শুনে বলল,
‘কিছু করার নেই। কেক সেই একবারই তৈরি হয়েছিল। তিনিও খেয়েছিলেন; আমরাও খাচ্ছি এখন- যা রয়ে গেছে তার থেকে।’
‘তিনি? তিনি মানে?’
একবার সবার দিকে তাকিয়ে সিদ্ধার্থদা অম্লানবদনে বলল,
‘বীরেন ভদ্র। সেই ব্যাচের কেক এখনও যে পাচ্ছ, এ অনেক ভাগ্যি। কমপ্লেন করো না।’

বইমেলা, গানমেলা আর পুজোর সময় সরাসরি মেলা-প্রাঙ্গণ কি উত্সবের আঙ্গিনা থেকে সম্প্রচার হত অনুষ্ঠান। কয়েকজন প্রেজেন্টার বাইরে আর কয়েকজন স্টুডিও প্রান্তে। সেও ভারি জমজমাট ব্যাপার।
একবার পুজোর দশমীর সন্ধ্যেয় প্রতিমা-বরণের লাইভ বিবরণ প্রচার হবার কথা। একেবারে শেষ মুহূর্তের একটা পরিবর্তনে নির্ধারিত এক প্রেজেন্টারের এর বদলে স্টুডিওতে অনুষ্ঠান করতে স্টেশন ডিরেক্টর অমিতদা স্বয়ং। সঙ্গে আমরা আরো দু’তিনজন আছি। অমিতদা রাশভারী মানুষ। অনেকেই সচরাচর এড়িয়ে চলত। পুজোমন্ডপ থেকে যে বরণের 'ফিড' দেবে সে প্রস্তুত। কিন্তু প্রেজেন্টার পরিবর্তনের কথা তার একেবারেই অজানা। ফোনে আচমকা অমিতদার বিখ্যাত ‘হ্যালাআও’ শুনে সে তো ঘাবড়ে টাবড়ে একশা! শেষ মেশ বলল :
‘এখানে মন্ডপে বরণ চলছে। দেখছি সারাবছর যার দিকে মেয়েরা কি মায়েরা ফিরেও তাকান না, এমনকি এই পুজোর ক’দিনেও না; বিজয়ার দিনে কিন্তু তাঁরা সেই ‘শ্বশুর’কেও যত্ন করে মিষ্টি খাওয়ান...’
অমিতদা স্টুডিও থেকে প্রায় হুঙ্কার দিতে গিয়েও কোনরকমে সামলে নিয়ে বললেন- 
‘হ্যালাআও, শোনো, কী বলছ তুমি?’
সে ভাবল, ভাল শোনা যায়নি বুঝি! আবারও একই কথা রিপিট করল।
এদিকে স্টুডিওতে তো আমাদের পেট থেকে সোডার মত ভসভসিয়ে হাসি উঠে আসছে। লাইভ প্রোগ্রাম, হেসে ফেললে তো সব ব্রডকাস্ট হয়ে যাবে! হাসি চাপতে গিয়ে সে এক বেদম অবস্থা!
আসলে আচমকা অমিতদার গলার বিখ্যাত ‘হ্যালাআও’ শুনে ঘাবড়ে গিয়ে সে বেচারার ‘অসুর’ আর ‘শ্বশুর’ গুলিয়ে গিয়েছিল।

এফ.এম-এর দৌলতে নব্বইয়ের মাঝামাঝি থেকে আবার দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গী হয়ে উঠেছিল রেডিও আর রেডিও জকি, সংক্ষেপে আর.জে। অনেক বন্ধুর সঙ্গে যেমন কদিন দেখা বা কথা না হলে খারাপ লাগে, তেমনি পছন্দের কোনো রেডিও জকির অনুষ্ঠান কদিন শুনতে না পেলেও মনটা খুঁতখুঁত করে অনেকেরই। নাগরিক ব্যস্ততায় সাধারণ মানুষের জীবনের বড় একটা সময় কাটে পথে। কখনো কখনো আটকে থাকতে হয় ট্র্যাফিক জ্যামে। সেরকম বসে বসে বিরক্ত হওয়ার সময়গুলোতে কিছুটা হলেও স্বস্তি এনে দিল এফেমিয়ান ভার্চুয়াল 'কথাবন্ধু'রা। যিনি শুনবেন তাঁর দায়িত্ব শুধু পছন্দের চ্যানেলটি খোলা। তারপরের কাজটি এফ.এম-এর প্রিয় আর.জে-র। কথার মাধুর্যে মুগ্ধ করে রাখবেন নানা বয়সী মানুষকে। কখনো পছন্দের গানও শুনিয়ে দেবেন। প্রেজেন্টেশন ভাল হলে অন্তত খানিকক্ষণের জন্যে হলেও শ্রোতা ভুলে যাবেন যে তিনি তখন গড়িয়াহাট কি বাঁশদ্রোণী বা শ্যামবাজার ফাইভ পয়েন্ট ক্রসিং-এ বিপুল জ্যামে ফেঁসে আছেন আর কখন বাড়ি ফিরতে পারবেন তারও কোনও ঠিকঠিকানা নেই! এইজন্যেই তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পেরেছেন আর.জে- রা।

অনেককে বলতে শুনি অনুষ্ঠান প্রেজেন্ট করা আর কি এমন কাজ! কিছু বকবকম্ আর মাঝে মাঝে গান বাজানো। ও যে কেউ করতে পারে। সেটা বোধহয় ঠিক নয়। যে শ্রোতারা দৃশ্যমান নন, বৈচিত্র্যপূর্ণ উপস্থাপনা আর কথার ফুলঝুরি দিয়ে তাঁদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাওয়াটা কিন্তু খুব সহজ কাজ নয়।
সুন্দর আর স্পষ্ট উচ্চারণ, উপযুক্ত শব্দচয়ন, অনর্গল কথা বলার ক্ষমতা, যেকোনো প্রশ্ন বা পরিস্থিতি সামলানোর মত উপস্থিত বুদ্ধি, মিউজিক্যাল সেন্স, সেন্স অব হিউমার, আর নিরপেক্ষতা বজায় রেখে কথা বলার গুণগুলো অবশ্যই থাকতে হবে একজন প্রেজেন্টারের। আর খুব জরুরী, দেশ বিদেশের সমসাময়িক বিষয় ও খবরগুলো সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকা। কথা বলতে হয় নানা ধরণের মানুষের সঙ্গে। নিজেকে নানারকমভাবে প্রকাশ করার ক্ষমতাও অর্জন করতে হয় আর.জে-কে। নাহলে কম্যুনিকেশনের সেতুটাই তৈরি হবে না যে! আর এই সব কিছুর পরে কেকের ওপরের আইসিংটা হল আর.জে-র আত্মবিশ্বাস এবং স্বাতন্ত্র্য। সেইজন্যেই তো ঘুরে ফিরে 'তিনি'! বার বার 'তাঁর' অনুষ্ঠানই শুনতে চাইবেন শ্রোতারা। তাই না?

আকাশবাণীর স্টুডিওতে এফ.এম-এ লাইভ অনুষ্ঠান করার সময় হয়তো আমি একা কিংবা সঙ্গে আর একজন সহ উপস্থাপক। ওপ্রান্তে পুরো এফ.এম. ট্রান্সমিশন রেঞ্জ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা অগণিত না-দেখা শ্রোতা। শুনলে মনে হতেই পারে, বাঃ কি চমৎকার! একেবারে নিরুপদ্রবে নিজের মনের মত করে অনুষ্ঠান করার এমন সুযোগ! আহা!

কিন্তু ব্যাপারটা ঠিক তা নয়। সবসময় মনে রাখতে হত, ঐ অগণিত শ্রোতার মধ্যে ক্যাঁক্ করে ভুল ধরার জন্যে অপেক্ষমান, হাতে-খাঁড়া নিত্যখাড়া-কয়েকজোড়া কান। তার মধ্যে আবার এক জোড়া স্পেশাল কান, যাঁর এই ভুল ধরাটাই চাকরি। তিনি আকাশবাণীর ‘ডিউটি অফিসার।’ বিপুল ভারি দরজা দুটো ঠেলে স্টুডিও চত্বরে ঢোকার ঠিক আগে, ডানদিক আর বাঁদিকের ঘরগুলোতে যাঁরা বসে থাকেন। সামনে একটা রেডিও সেট, বেজে চলছে প্রোগ্রাম আর মাথা ঈষৎ ঝুঁকিয়ে, হাতে একটা পেন আর সামনে খোলা খাতা নিয়ে বসে বসেই ‘অ্যাটেনশন’ ভঙ্গিতে রেডি ডিউটি অফিসার। এই অনন্ত আটেনশনত্বর জন্যেই কোনও ডিউটি অফিসারকে অন-ডিউটি কোনদিন হাসতে দেখেছি কি! বোধহয় না! আর ভুরুজোড়া তো পার্মানেন্ট সেকেন্ড ব্র্যাকেট! লাইভ অনুষ্ঠানে এক পিস্ ভুল হলেই ব্যস, হয়ে গেল! সঙ্গে সঙ্গে পয়েন্ট নোটেড। তারপর ভুলের গুরুত্ব বুঝে তৈরি হবে নোটশীট। সেটা যাবে প্রোগ্রাম এক্সিকিউটিভ থেকে ঘুরে ঘুরে এ.এস.ডি. ...ডি.ডি.পি. ...কি মায় এস.ডি. পর্যন্ত!
ভাবলেই কি রকম হৃদকম্প হয় না? কিন্তু অনুষ্ঠান চলাকালীন অতশত ভাবলে তো আর অনুষ্ঠানই করা যায় না। তখন মনের খুশিতেই অনুষ্ঠান। 

শেষে একটা দিনের কথা না বললেই নয়! ২০০৪ সালের ১১ই মার্চ। প্রয়াত হলেন উস্তাদ বিলায়েৎ খান। রবিবারের সেই রাতে ‘বিজ্ঞান রসিকের দরবারে’ হবার কথা। সকাল থেকে পরের পর ফোন। নির্ধারিত অনুষ্ঠানের পরিবর্তে অনুষ্ঠান করতে হবে উস্তাদজীর স্মরণে। আকাশবাণীর সঙ্গে তাঁর মত-বিরোধে তিনি ‘ব্রাত্য’ হওয়ায়, কয়েক দশক ধরে আমৃত্যু আকাশবাণীতে বাজেনি তাঁর কোনও সুর।  ছুটির দিনে ওপরতলার বিশেষ অনুমোদনে তালা খুলল আকাশবাণীর মিউজিক আর্কাইভ-এর। থরে থরে সাজানো রেকর্ড। না ধুলো জমেনি, কারণ পরিষ্কার করা হয় মাঝে মাঝেই। হাত ছোঁয়াতে অদ্ভুত লাগছিল। মনে হচ্ছিল কত বছর ধরে বঞ্চিত ছিলেন শ্রোতারা! প্রথমে কথা ছিল এক ঘন্টার অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠান চলতে চলতেই ফোন আসতে লাগল আধিকারিকদের। উস্তাদজীর স্মরণই চলতে থাকুক। রাত দশটা থেকে বারোটা বাজিয়েছিলাম তাঁর অসামান্য সব সৃষ্টি। উস্তাদজী সম্পর্কে বলেছিলেন পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী, উস্তাদ রাশিদ খান। সে দিনটা ছিল গভীর দুঃখের আবার এক অর্থে আমার পরম সৌভাগ্যেরও। অনেক বছর আকাশবাণীতে বাজেনি যে সব সুর, সেই সব সৃষ্টি খুঁজে এনে সেই সুর শোনাতে পেরেছিলাম শ্রোতাদের। আর সেই সঙ্গে বড় নিরর্থক মনে হয়েছিল এইসব দ্বন্দ্ব। কালের নিয়মে আমরা সবাই হারিয়ে যাব একদিন না দিন। কী মূল্য আছে প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতার বলে, কলমের এক খোঁচায় সৃষ্টিকে রসিক জনের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দেবার? শিল্পীকে ব্যান্ করার সেসব কাগজপত্তরে সইসাবুদ করেছিলেন যাঁরা- কেউ কখনো মনে রাখবে না তাঁদের। শুধু অমর হয়ে থেকে যাবে শিল্পীর সুর-তাল-ছন্দ।

গবেষণার কাজ নিয়ে বিদেশে চলে আসার আগে পর্যন্ত জড়িয়ে ছিলাম আকাশবাণী এফ.এম-এর সঙ্গে। সেসময়ে স্টেটসম্যানে রেডিও রিভিউতে আমার সঞ্চালনা করা বেশ কিছু অনুষ্ঠানের প্রশংসা হয়েছিল।
না, পেশাদার রেডিও জকি হতে চাই নি কখনো। এটা ছিল আমার নেশা, ভালবাসার জায়গা, আমার প্যাশন। আমার নানা অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথি হয়ে এসেছেন অনেক বিশিষ্ট গুণীজন, তাঁদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ আলাপচারিতার সুযোগ হয়েছে। আকাশবাণী এফ.এম-এর সূত্রে এও তো এক বড় প্রাপ্তি। খুব ভাল লাগে, যখন শুনি বেশ কিছু অনুষ্ঠান আজও মনে রেখেছেন অনেক শ্রোতা। শ্রোতাদের মনে জায়গা করে নেওয়াটাই তো সবচেয়ে বড় পুরস্কার।

অনেকদিন পরে, ২০১৩-তে এফ.এম-এর দারুণ জনপ্রিয় অনুষ্ঠান, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের রহস্য রোমাঞ্চ ‘আসছে সে আসছে’-তে অভিনয়ের সুযোগ হল। কল্পবিজ্ঞানের একটি গল্পে একই সঙ্গে দুটি আলাদা চরিত্রে। একটি চরিত্র মধ্যবয়সী এক বিজ্ঞানীর, অন্যটি এক চার বছরের শিশু। দুটোই আমি। শ্রোতাদের প্রশংসা ও ভালবাসা পেলাম আবার। এভাবেই কাজের মাঝে মাঝে উঁকি দিয়ে আজো মন ভরিয়ে দেয় আমার প্যাশন।

এফ.এম-এর হাত ধরে রেডিওর নবজন্ম না হলে একুশ শতকের মানুষের কাছে, বিশেষত তরুণ প্রজন্মের কাছে রেডিওর কোনও বিশেষ অর্থই আর থাকত না। ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে আসা, চিরকালের নস্ট্যালজিয়া–প্রিয় বাঙালির আর এক রোম্যান্টিক স্মৃতিকথা হয়ে রয়ে যেত রেডিও। রেডিওর সেই নবজন্মের পর, এফ.এম-এর নতুন পথ চলার শরিক হয়ে কাটানো আমার নানা রঙের দিনগুলো স্মৃতির পাতায় আজো ভারি উজ্জ্বল।


লেখক পরিচিতি - কলকাতা ইউনিভার্সিটির ছাত্রী। বর্তমানে আমেরিকার স্যান অ্যান্টোনিওতে প্রবাস-জীবন। ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাসে বিজ্ঞানী হিসেবে কর্মরত। লেখালেখি শুরু স্কুল ম্যাগাজিন থেকে। কলেজ জীবন থেকে রেডিওর প্রতি ভালোবাসা ও আকাশবাণী কলকাতাতে রেডিও জকি প্রায় এক দশক। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত লেখার পাশাপাশি বেড়ানো আর গান শোনায় কাটে ছুটির অবকাশ।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।