কান পেতে রই...
অবসর (বিশেষ) সংখ্যা , ডিসেম্বর ৩০, ২০১৪
পশিত আকাশবাণী শ্রবণে
পল্লব চট্টোপাধ্যায়
হিউস্টন, আমেরিকা, ১৯৮৫ সাল। এখানে আসার পর থেকেই দেখছিলাম আমাদের অ্যাপার্টমেন্টের এক কোণে পড়ে আছে জিনিসটা, যা আজকের দিনে খুব কমন হলেও সেসময় ভারতে প্রায় কেউই দেখেনি তখনও। না, সাঙ্ঘাতিক কিছু নয়, একটা এফ-এম স্টিরিও সেট কাম-ক্যাসেট রেকর্ডার । দু-দিন পরে এক শনিবার সকালে ভাবলাম একটু নেড়ে-চেড়ে দেখি জিনিসটা। দেখি ওটা একটা রেডিওই, শুধু ওয়েভ-লেংথের বদলে ফ্রিকোয়েন্সি লেখা আছে ৮০ থেকে ১১৫ মেগাহার্জ পর্যন্ত। টিউনার ঘোরাতেই একজায়গায় এসে হাত আটকে গেল। স্পষ্ট হিন্দিতে শোনা গেল- ‘ইয়ে হিউস্টন মেট্রো সম্প্রচার ১০১.৫ মেগাহার্জ হ্যায়। হামারি অগলি শ্রোতা হ্যায় পিংকি যো কি ফার্স্ট গ্রেড মে হ্যায়, ঔর গানা হ্যায় কিশোরকুমার কি আওয়াজ মে, ফিল্ম ‘মিস্টার এক্স ইন বম্বে’ সে। তারপরেই শুরু হল- ‘মেরে মেহবুব কয়ামত হোগী, আজ রুশোয়া তেরি গলি মেঁ......।‘ তারপরের গানে আরেক চমক। রবীন্দ্র জৈনের কণ্ঠে ‘এক রাধা, এক মীরা’। এই দুর্লভ অনুষ্ঠানটি আমি ক্যাসেট-বন্দী করে রাখি ও এখনও আছে আমার কাছে। তারপর বহু বছর কেটে গেছে, এখন এফ-এমের বহু কমার্সিয়াল চ্যানেল ছড়িয়ে পড়েছে ভারত জুড়ে। ‘লাগে রহো মুন্নাভাই’ বলে একটি হিন্দি সিনেমাও খুব জনপ্রিয় হয়েছিল, যার হিরোইন ছিলেন একজন ‘Radio jockey’।
সেকালের রেডিও সেট
রেডিওকে ঘিরে আমার এই কৌতূহল কিন্তু ছোটবেলা থেকেই, বোধহয় সেটা ১৯৬৬ সাল, যেদিন বাবা একটি ‘মারফি’র সেট নিয়ে এলেন বাড়ি। তার ছিল দুটি কান (knob), যার একটিতে মোচড় দিলেই কলকাতা-ঢাকা-পাটনা-রাঁচী এমনকি সিলোন (সেটাই যে রাবণের স্বর্ণলঙ্কা ছিল তা দাদু আমাকে ইতিমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছিলেন) পৌঁছে যাওয়া যেত এক মুহূর্তেই । বছর তিনেক পরে ‘গুপি-গাইন-বাঘা-বাইন’ দেখে বুঝেছিলাম যে রেডিওর ভেতর পোরা আছে সেই ভূতের রাজার আশ্চর্য জুতোজোড়া, হ্যাঁ এছাড়া আর কি? আমার ছোট বোনও এ বিষয়ে আমাকে সমর্থন করত। ওর ধারণা ছিল, রেডিওর ভেতরে বাচ্চা ভূতের মত গায়ক-গায়িকারা বসে থাকে। একদিন কি কারণে ওটা চলছিল না, বাবা একটা স্ক্রু-ড্রাইভার দিয়ে পেছনের ঢাকনাটা খুলেছেন আর আমরা দুই ভাই-বোনে মিলে হুমড়ি খেয়ে পড়েছি দেখতে কি আছে ভেতরের ছোট্ট বাক্সটাতে। ও মা, দেখি মানুষও নেই, জুতোও নেই, তার পেটটা জুড়ে বেশ কিছু লম্বাটে বাল্ব, বিস্তর তার আর একটা ঢাউস চোঙা। তবে কয়েকটা মাকড়সা আর আরশোলা ছিল, জানিনা ওরা গান গাইত কিনা। পরে দাদুর কাছে শুনেছিলাম কিভাবে আচার্য জগদীশ বোস রেডিও আবিষ্কার করেন, কিন্তু টাকার অভাবে সেটটি তৈরী করতে দেরী হয়ে যাওয়ায় মার্কনি সায়েব কৃতিত্বটুকু পেয়ে যান। ‘আমাদের বাবার নিশ্চয় অনেক টাকা, তাই রেডিও কিনতে পেরেছেন’, আমি বলি ও তারপর বোনের মন্তব্য - ‘ওনার উচিত ছিল বাবার কাছ থেকে কিছু টাকা ধার নেওয়া’ শুনে গম্ভীর ঠাকুর্দাও হেসে উঠেছিলেন।
এই সময় একদিন আমি আবিষ্কার করলাম যে রেডিও আমাদের বেশ কিছু কাজেও লাগে। কাকা রওনা হয়েছেন গুজরাট, এমন সময় একটা ট্রেন-দুর্ঘটনা ঘটল ওই রুটে। সবাই অস্থির, বাবা ও দাদু প্রতিটা খবর শুনছেন রেডিওতে কান পেতে। কি উদ্বেগ সবার। শেষে কাকার টেলিগ্রামে তাঁর নিরাপদে পৌঁছনোর খবরে সবার স্বস্তি। ক্রিকেট খেলা শুরু হলে তো বাবাকে নড়ানো যেত না রেডিওর সামনে থেকে। একটা ৭২-এর গল্প বলি। ইডেনে খেলা চলছে, পুষ্পেন সরকার আর কমলদা বাংলায় প্রতিটি বলের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে ঠাম্মা-দিদুদেরকেও ক্রিকেট খেলাটা জলের মত বুঝিয়ে দিচ্ছেন। আমার ঠাকুমা সুদ্ধু জানেন যে বিশ্বনাথ আউট হবার কারণ ছিল বলের লাইনে পা না নিয়ে যাওয়া। অথচ মা! খেলা তো বুঝবেনই না, উপরন্তু বাবাকে কেবল তাড়া দেবেন স্নান-খাওয়ার জন্যে, রবিবার হলেও। শেষে বাবা বললেন, ‘তুমিও একটু খেলা শোন, দেখবে খুব ইন্টারেস্টিং’। অগত্যা মা শুনতে লাগলেন কমলদার অ্যানালিসিস- ‘গাভাস্কার যে বলে আউট হলেন সেটি নিচু হয়ে গিয়েছিল। বিশ্বনাথ তো বাইরের বলটি ছেড়ে না দিয়ে খোঁচা মেরে আউট হলেন। এইমাত্র ওয়াদেকার একটি বল চমৎকার খেললেন।...।’ ‘কি বুঝলে’, বাবা জিজ্ঞেস করতেই মায়ের কনফিউসড উত্তর- ‘বুঝলাম না, কতগুলো বল নিয়ে খেলে ওরা!’
মা’র রেডিও শোনার সময় ছিল দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর আর সন্ধ্যে আটটা থেকে দশটা। প্রিয় অনুষ্ঠান ছিল বেতার নাটক, মহিলা-মহল, অনুরোধের আসর ও অবশ্যই ছায়াছবির গান। আমিও শুনতাম, অনুরোধের আসরে কে কোথা থেকে অনুরোধ করছে শুনতে খুব মজা লাগত। আরো অবাক লাগত যখন দেখতাম রবীন্দ্রসংগীতগুলো মা রেডিওর সাথেই গেয়ে যাচ্ছেন দেখে, ভেবে পেতাম না, ওরা যা গাইবে তা আগের থেকেই কারো পক্ষে জেনে যাওয়া সম্ভব হয় কি করে!
হ্যাঁ, আমাদের জন্যেও অনুষ্ঠান ছিল বৈকি। রবিবার সকাল সাড়ে ন’টা বাজলেই ‘শিশুমহল’, একটা পরিচিত কণ্ঠস্বরের জন্যে উতলা হয়ে থাকতাম ভাই-বোনেরা- ‘তোমাদের ইন্দিরাদি বলছি। ছোট্ট সোনা বন্ধুরা ভাই আদর আর ভালবাসা নিও। কি, ভাল আছ তো সব?’ ‘হ্যাঁ’- রেডিওর অনুষ্ঠানে আসা বাচ্চাগুলোর সাথে গলা মিলিয়ে আমরাও চেঁচিয়ে উঠতাম। আর ছিল বুধ ও শনিবার সন্ধ্যেয় ‘গল্পদাদুর আসর’। অবাক হয়ে শুনতাম আমাদের বয়সি ছেলেমেয়েরাও কত প্রতিভাবান হয়, গান, আবৃত্তি, বাঁশি বাজানো- কত কিছু করতে পারে! আরেকটা অনুষ্ঠানের কথা না বললে রচনা সম্পূর্ণ হবে না, সেটা হল মহালয়ার ভোরবেলায় অবশ্য-শ্রোতব্য ‘মহিষাসুরমর্দিনী’, তখন বাবার অত্যাচারে ঘুম ভেঙ্গে ভোরবেলা স্নান করে শুনতে বসতে হত, আর আজ প্রায় ওইটুকুর জন্যেই রয়ে গেছে রেডিও শোনার অভ্যেস।
একাত্তরের গরমের ছুটিতে বি-এ পরীক্ষা দিয়ে ছুটি কাটাতে এ্লেন আমার এক পিসতু্তো দিদি। তিনি এসে আমার সামনে খুলে দিলেন নতুন এক দিগন্ত। সেই প্রথম আমাদের রেডিওতে শোনা যেতে লাগল হিন্দি গান, সিলোন ও বিবিধ ভারতীতে। তখন ছুটির দিনের সকালগুলোতে আমিন সয়ানীর গলা শোনার জন্যে হা-পিত্যেশ করে বসে থাকতাম, কখন শুনতে পাব- ‘ইয়ে সিলোন (পরে হয়েছিল শ্রীলঙ্কা) ব্রডকাস্টিং করপোরেশন কা বিদেশ বিভাগ হ্যায়...’। ছিল প্রতি বুধবার রাত্রি আটটা থেকে বিনাকা (পরে হয়েছিল ‘সিবাকা’) গীতমালা শোনার জন্যে অধীরতা, তার একটা কারণ অবশ্যই পরদিন স্কুলের আলোচনায় কোন গানটা কোন ধাপ বা পাদানে আছে যেন বলতে ভুল না করি; স্যরের পড়া ধরার থেকেও সেটা যেন বেশী ইম্পর্টান্ট হয়ে উঠেছিল। অবাক হয়ে দেখেছিলাম, মান্না দে’র গাওয়া ‘ইয়ারি হ্যায় ইমান মেরা’ গানটি যে ফার্স্ট হয়েছিল বিনাকায়, তা আমাদের রাশভারী বিজ্ঞান স্যারও জানেন! ইতিমধ্যে আমাদের ঘরে এসে পড়েছে আরো দুটি যন্ত্র, তাতে রেডিওর মাহাত্ম্য সামান্য ম্লান হয়েছিল শুরুতে, একটা এইচ-এম-ভি গ্রামোফোন ও কাকার ইটালি থেকে আনা একটি স্পূল টেপ-রেকর্ডার। তবে তাতে কি শুনতে পাব তা সম্বন্ধে কোনও চমক না থাকাতে খুব একটা পাগলামি ছিল না ওসব নিয়ে । রেডিওর মত তারা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠতে পারেনি কোনদিনই। তখন আমাদের গ্রামে বিদ্যুৎ ছিল না, তবু ঠাকুমাকে একটি ট্রানজিস্টার সেট কিনে দেওয়া হয়েছিল, কারণ রেডিওর (কু)-অভ্যাসটি তাঁর মধ্যেও ইতিমধ্যে সংক্রামিত হয়েছিল। আমার ঠাকুরদা অবশ্য ছিলেন শান্তিপ্রিয় মানুষ। রেডিও বাজলেই সুকান্তের ‘দেয়ালিকা’ থেকে উদ্ধৃতি দিতেন-
“বেজে চলে রেডিও-
সর্বদা গোলমাল করতেই রেডি ও।“
তখন ‘বেতার-জগৎ’ নামে একটি পাক্ষিক পত্রিকা বেরোত, আমরাও তার গ্রাহক ছিলাম। তাতে পুরো পক্ষের কলকাতা ক-খ-গ’এর সমস্ত অনুষ্ঠান-সূচী দেওয়া থাকত, আর থাকত স্বরলিপি সমেত ‘এ-মাসের গান’, বিধায়ক ভট্টাচার্য বা মন্মথ রায়ের লেখা রেডিও নাটক ইত্যাদি, যার আকর্ষণও আমাদের কাছে কিছু কম ছিল না।
আজ আমাদের বাড়িতে কি দূর-দূরান্তের আত্মীয়দের মধ্যে রেডিও ব্যবহারকারীর সংখ্যা আঙুলে গোনা যায়। অথচ একটা সময় ছিল যখন আমাদের গ্রামের কানে খাটো বিজয়দার হাতেও চব্বিশঘণ্টা একটা ট্রানজিস্টার ঝুলত, এমনই অ্যাডিক্ট ছিল। একদিন শুধোলাম, ‘বাঃ, চমৎকার গাইছেন তো মহিলাটি, গীতা রায় বুঝি?’ উত্তর এল, ‘গীতার লয়, ইটো আমার রেডিও বটে। মাগ্না লয়, দুশো টাকা দিয়ে কিনেছি, হঁ!’ বোঝো ব্যাপারখানা, তাও তার রেডিও চাই! মনে পড়ে ৭৭-এর সেপ্টেম্বরে মোহনবাগান-কসমসের খেলা। ভাগ্যবান যারা, তারা মাঠে বসে খেলা দেখেছিলেন। এছাড়া আর উপায় ছিল না, কারণ টেলিভিশন তখনও এসে পৌঁছয়নি এ অঞ্চলে। তবু বিশেষ দিনটি এ জন্যেই মনে পড়ে যে সেদিন আমাদের বৈঠকখানা ও বারান্দা মিলে অন্ততঃ আমরা ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজের ২০-২২ জন বন্ধু একত্রে খেলার কমেন্ট্রি শুনেছিলাম আমাদের রেডিওতে ও সেসময়ের মোহনবাগান পেলে-বেকেনবাউয়ার সমৃদ্ধ দলটির সঙ্গে সুধীর-সুব্রত-প্রসূনরা ২-২ ড্র করায় আমাদের রেডিওটি খুব পয়া প্রমাণিত হয় বন্ধুদের মধ্যে।
ঐতিহাসিক কসমস ম্যাচে ফুটবল সম্রাট পেলের বিপক্ষে মোহনবাগান
ঘরে রেডিও রাখাটাই ছিল তখন একটা স্ট্যাটাস-সিম্বল, আর রেডিওতে চান্স পাওয়া? একদিন খোকনমামার চিঠি এল শান্তিনিকেতন থেকে, অমুক তারিখে সঙ্গীত-ভবনের ছাত্র- ছাত্রীদের নিয়ে কলকাতা ‘ক’ থেকে একটা অনুষ্ঠান আছে, পারলে শুনো। চেনা মানুষের গলা রেডিওতে শুনতে সেদিন আমাদের বাসায় ভিড় হয়েছিল দেখবার মত। রেডিওর অনুষ্ঠানে ডাক পাওয়া তখনকার মধ্যবিত্ত সমাজের চোখে মনে হত এক পরম-প্রাপ্তি। এই সূত্রে একটা মজার কথা মনে পড়ে গেল, সাহিত্যিক তারাপদ রায় একবার বিখ্যাত মূকাভিনেতা যোগেশ দত্তকে শুধিয়েছিলেন, ‘মশায়, বিশ্বজোড়া নাম তো করলেন, কিন্তু রেডিওতে আজ পর্যন্ত একবারও ডাক পেলেন না!’
মূকাভিনেতা শ্রী যোগেশ দত্ত
কত কথাই যে মনে পড়ে, তবু মনে হয় এ সব যেন বিগত কোন জন্মের কাহিনী, কোনও ‘জাতক-কথা’ থেকে পড়ে চলেছি। এখন রেডিও বলতে শুধু এফ-এম বোঝায়, যা গাড়িতে থাকে আর মোবাইল সেটের সাথে পাওয়া যায়, কানে হেডফোন লাগিয়ে ছেলে-ছোকরারা গান শোনে সারাক্ষণ। মিডিয়াম ও শর্ট-ওয়েভ সমন্বিত বিশাল রেডিও সেট প্রায় উধাও বাজার থেকে, আর সেই সাথে শৈশব ও বাল্যের সব স্মৃতির নিদর্শনও।
লেখক পরিচিতি - জন্ম ও বেড়ে ওঠা বিহার (অধুনা ঝাড়খন্ডের) ধানবাদ কয়লাখনি ও শিল্পাঞ্চলে, সেখানে 'নানা জাতি, নানা মত, নানা পরিধান' হলেও বাংলা ও বাঙালিদের প্রাধান্য ছিল একসময়। ১৯৮২ সালে রাঁচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনীয়ারিং পাস করে পেট্রোলিয়াম লাইনে চাকুরী, বর্তমানে কুয়েত অয়েল কোম্পানিতে কর্মরত। শখ-গান-বাজনা আর একটু-আধটু বাংলাতে লেখালেখি। কিছু লেখা ওয়েব ম্যাগাজিনে (ইচ্ছামতী, আদরের নৌকো ও অবসর) প্রকাশিত ।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।