কান পেতে রই...
অবসর (বিশেষ) সংখ্যা , ডিসেম্বর ৩০, ২০১৪
একাত্তরের ‘সংবাদ পরিক্রমা’
প্রণবেশ সেন
আশ্চর্য সেই একাত্তরের দিনগুলো – বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের সেই দিনগুলো। কাজ করতাম আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রের সংবাদ বিভাগে। তাই ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েছিলাম এই আগুন-ঝরানো দিনগুলোর সঙ্গে। আজ মনে হয় যখন অসংখ্য অচরিতার্থ আকাঙ্ক্ষা এখানে-ওখানে মুখ থুবড়ে পড়ে রয়েছে, তখন বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামী মানুষগুলোর পাশে দাঁড়ানোর বিরল গৌরবও তো বহু ভাগ্যে মিলেছিল। লিখতাম ‘সংবাদ পরিক্রমা’, লিখতাম ‘বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের নিউজ’। এটা যদি বিরল গৌরব হয়, কিংবা একটা সাফল্য, তবে তো পটভূমিটাও মনে রাখা দরকার হয়ে পড়ে। তাই শুরু করছি একেবারে গোড়ার কথা দিয়ে।
গোড়ার কথা
গোড়ার কথা মানে ‘সংবাদ পরিক্রমা’র কথা। ১৯৬৫ সাল। ভারত-পাকিস্তান লড়াই সবে শেষ হয়েছে। তার নাম-গন্ধ নেই কোথাও। না পাকিস্তানে, না ভারতে। ৬৬ সালের গোড়ার দিকে আকাশবাণীতে পূর্বাঞ্চলীয় শ্রোতাদের জন্য একটি বিশেষ বেতার তরঙ্গ চালু হল। আমি বার্তা বিভাগে যোগ দিলাম ৬৬-র ফেব্রুয়ারীতে। এর আগে পর্যন্ত কলকাতা- ‘ক’য়ে ‘স্থানীয় সংবাদ’ ও ‘সংবাদ সমীক্ষা’ প্রচারিত হত। আর প্রচারিত হত সংবাদ বিচিত্রা। কিন্তু পূর্বাঞ্চলীয় শ্রোতাদের জন্য অনুষ্ঠান চালু হবার সময়ে ঠিক হল রাত দশটা থেকে দশটা-পাঁচ পর্যন্ত একটি সংবাদ ভাষ্য প্রচারিত হবে। সংবাদভাষ্যমূলক এই অনুষ্ঠানটির নাম রাখা হল ‘সংবাদ পরিক্রমা’। ঠিক হল ওই অনুষ্ঠানে ভারত-পাকিস্তান মৈত্রীর ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। বলতে হবে দু দেশের ঐতিহ্যের কথা, দু-দেশের জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষার কথা। তুলে ধরতে হবে দু-দেশের পারস্পরিক সহযোগিতার প্রয়োজনের কথা। আমারই ওপর দায় বর্তাল সংবাদের সঙ্গে সঙ্গে ঐ সংবাদভাষ্য রচনারও।
লিখতাম। সপ্তাহে পাঁচ দিন লিখতাম আমি। কিন্তু কি আশ্চর্য পরিবেশ! কেউ শুনতে রাজী নন ভারত-পাকিস্তান মৈত্রীর কথা, বন্ধুত্বের কথা। অথচ দায় বর্তেছে এই মিষ্টি মিষ্টি কথা শোনানোর। চুটিয়ে চিঠিপত্র আসত শ্রোতাদের কাছ থেকে। বেশীর ভাগ চিঠিই ভর্ৎসনামূলক। হতাশা গ্রাস করতে চাইত। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই দেখলাম অবস্থাটা ধীরে ধীরে পাল্টাতে শুরু করল। জনমতের জোয়ার বইতে লাগলো উলটো খাতে।
আমার কথা
আমি বাংলাদেশের ছেলে। জন্ম সিরাজগঞ্জে তবে আমার বড় হওয়াটা পাবনা শহরে। ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে চলে আসি কলকাতায়। বাকি পড়াশুনো, স্কুল কলেজ ও সংবাদ পত্রে হাতেখড়ি সবই কলকাতায়। সে-সময় পূর্ব পাকিস্তানের প্রগতিশীল আন্দোলনের নেতৃত্বে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের অনেকেই হয় আমার পিতৃবন্ধু, না হয় আমার নিজের বন্ধু। এই প্রত্যক্ষ যোগসূত্রের ফলেই ‘সংবাদ পরিক্রমা’ হয়ে উঠেছিল এমন একটা জানলা, যার খিল খুললে দেখা যেত এ-পারে যে বাংলাদেশ ও-পারেও সেই বাংলা।
আকাশবাণীতে যোগ দিলাম ছেষট্টির ফেব্রুয়ারীতে। থাকতাম পাইকপাড়ার বাসাতে। অনেকদিন আকাশবাণী ফেরত শিয়ালদা হয়ে দমদম ছুঁয়ে বাড়ি পৌঁছতাম। যুদ্ধ শেষ হয়ে তাসখন্দ চুক্তি হয়ে গেলেও কিন্তু ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যোগাযোগের বিচ্ছিন্নতা কমেনি। ভারত ও পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে কিছুদিন আগেই। তবুও শিয়ালদহ স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকত একটা সবুজ রঙের ট্রেন। ঐ ট্রেনটাই আসত পূর্ব পাকিস্তান থেকে। আমার নিজের স্মৃতি জড়িয়ে আছে ওই ট্রেনটির সঙ্গে।
একদিনের একটা পরিক্রমার কথা মনে পড়ছে। তখনও সে সবুজ গাড়ীটা প্ল্যাটফর্মেই পড়ে থাকত। কেমন মলিন। ধূলি-ধূসর। সব গাড়ী যাচ্ছে-আসছে ঐ গাড়ীটাই অনড়। তখন গিরীন চক্রবর্তীর একটি গান খুব চালু ছিল। গানের লাইনগুলো – ‘শিয়ালদহ গোয়ালন্দ আজও আছে ভাই / আমি যাব আমার বাড়ী সোজা রাস্তা নাই’। গাড়ীটা দেখেই ঐ গানটা মনে পড়ত। পুজোর কদিন আগেই মহালয়া, বীরেন ভদ্র, বাণীকুমার, পঙ্কজ মল্লিকের ‘মহিষাসুরমর্দিনী’- আর ছুটির মেজাজ। এবারও সেই ছুটির মেজাজ এল, কিন্তু বাড়ী যাওয়া হবে না। পরিক্রমা লিখলাম, ঐ সব সূত্র ধরে। দেবু পড়ল। দেবুর পড়ার একটা মজা আছে। দেবু (দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়) যখন স্ক্রিপ্ট পড়ে তখন স্ক্রিপ্টটা অন্য কোনো লেখকের থাকে না। ওটা যেন পুরোপুরি ওর নিজের কথা হয়ে যায়। দেবু পড়ছে, নিউজরুমে বসেই আমি শুনছি। ধীরে ধীরে মনটা যেন কেমন ভারী হয়ে উঠল। বেতার অনুষ্ঠানের এই এক মজা। ইথার তরঙ্গে ভেসে গেল, কোথায় পৌঁছল আদৌ পৌঁছল কিনা, সাড়া জাগল কিনা, তার হদিশ পাওয়া ভার।
এই যে অবস্থা, এ তো আমার একার ছিল না। ছিল অধিকাংশ মানুষের। পরের দিন সকালের শিফটে আমার আর দেবুর কাজ ছিল। সেদিনও সকালের খবর পড়া শেষ করে দেবু কেবল ওপরে উঠে এসেছে। ক্যান্টিনে চায়ের অর্ডার গেছে। এমন সময় ত্রিশ–পঁয়ত্রিশ বছর বয়সের এক ভদ্রলোক এসে হাজির –উসকো খুসকো চুল, চোখ দুটো লালচে । একটা অস্থিরতা প্রকাশ পাচ্ছে ওর সর্বাঙ্গে। ভদ্রলোক আমার দিকে চেয়ে ভাঙা ভাঙা গলায় বললেন– আমি একটু দেবদুলাল বাবুর সঙ্গে দেখা করতে চাই। আমি দেবুকে ডেকে বললাম, দেবু উনি তোকে খুঁজছেন। দেবু মুখ তুলতেই ভদ্রলোক নমস্কার করে বললেন, একটু কথা ছিল। যদি একটু বাইরে আসেন...। দেবু বারান্দায় গেল। আমি তখন চোখ রেখেছি খবরের কাগজে । চার-পাঁচ মিনিট পরেই দেবু ঘরে ফিরে এল। আমার দিকে তাকিয়ে বলল- কি লিখেছিস রে কাল পরিক্রমায়? ভদ্রলোক কেঁদেকেটে একশা। বার বার দু-হাত ধরে বলছিলেন, আমার মনের কথা আপনি জানলেন কী করে? জানেন, এইবারই প্রথম পুজোর ছুটিতে বাড়িতে যেতে পারব না, মাকে দেখতে পাব না। ঠিক এই ব্যাপারটাই ঘটেছিলো সব পরিক্রমার ক্ষেত্রে। আমার কথা কেমন করে যেন সকলের কথা হয়ে যেত।
মধ্যিখানে চর
এমনি করেই চলতে চলতে ‘সংবাদ পরিক্রমা’ পা দিল সত্তরের দশকে। কত বিষয় নিয়েই না লেখা হয়েছে পরিক্রমা – রাজনীতি, অর্থনীতি, ইতিহাস, সংস্কৃত, সাহিত্য, স্থাপত্য– হেন বিষয় নেই যা স্থান পায়নি সংবাদ পরিক্রমার পাতায়। কিন্তু সত্তর দশকে এসে তার নতুন চেহারা। ‘সংবাদ পরিক্রমা’ তখন কোটি-কোটি মানুষের সংগ্রাম-সাথি।
পূর্ব পাকিস্তান থেকে পূর্ব বাংলা
পশ্চিম পাকিস্তানের আধিপত্যকামিতা, নিষ্ঠুর শোষণ ও সামরিক শাসন রুখতে ৬০-এর দশকে শেখ মুজিবর রহমান তুলে ধরলেন তাঁর ছ-দফা দাবি, শুরু করলেন তাঁর স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলন। ততদিনে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ তাঁদের দেশকে বলতে শুরু করেছেন পূর্ব-বাংলা। ওদিকে প্রেসিডেন্ট আয়ুব খানের তুঘলকি কান্ডকারখানারও যেন শেষ নেই। তিনি ফতোয়া দিলেন বাংলাও নয়, ঊর্দুও নয়, বাংলা এবং ঊর্দুকে মিলিয়ে একটি মিলিজুলি জবান তৈরি করে তাকে জনপ্রিয় করে তুলতে হবে। তাঁর দেশের দু-খন্ডের ঐক্য সুদৃঢ় করতে। রবীন্দ্রনাথ ও নতুন করে আক্রান্ত হলেন ৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধের পর। রেডিও পাকিস্তানে রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচার বন্ধ করে দেওয়া হল। প্রতিবাদের ঝড় উঠল।
এই যৌবন জলতরঙ্গ রোধিবে কে
শেখ মুজিবের ছ-দফা দবি যখন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, পূর্ব বাংলার মানুষ যখন সেই দাবির সমর্থনে তাঁর পাশে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে, তখন আয়ুব খান আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে এক মিথ্যা মামলা সাজালেন। সামরিক ও অসামরিক কিছু ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে বলা হল এরা পাকিস্তানকে ভাঙবার জন্যে ভারতের সঙ্গে চক্রান্ত করেছে। প্রথম দিকে ষড়যন্ত্রকারীদের নামের তালিকায় শেখ মুজিবরের নাম ছিল না। পরে ওই নামটি ঢুকিয়ে দিয়ে শেখ মুজিবকেও গ্রেপ্তার করা হয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠন গুলি ঐক্যবদ্ধ হয়ে শেখ মুজিবের ছ-দফা দাবি সহ মোট ১১ দফা দাবিকে সামনে রেখে গঠন করলেন ছাত্র সংগ্রাম কমিটি। তোফায়েল আহমেদ, আবদুর রব, সিরাজুল ইসলাম, নূর-এ-আলম সিদ্দিকি প্রমুখের সংগ্রাম কমিটি। ছাত্র-জনতা রাস্তায় নেমে এল। এত মানুষ রাস্তায় যে সৈন্যদের রাইফেল তুলে ধরবার জায়গাটুকুও নেই। ঊনসত্তরে উঁকি দিল বাহান্নর মুখ। উদ্বেলিত জনস্রোতে ভেসে গেল মিথ্যা ও সাজানো আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। ২৩ ফেব্রুয়ারি রুদ্ধ কারার অন্তরাল থেকে বেরিয়ে এলেন শেখ মুজিবর রহমান। ছাত্র সংগ্রাম কমিটি তাঁকে সংবর্ধনা জানাল। তাঁকে অভিহিত করা হল ‘বঙ্গবন্ধু’ হিসাবে। এই সময়েই শোনা যেতে লাগল ‘জয় বাংলা’ স্লোগান। ঘরে ঘরে গীত হল ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।’ এই যৌবন জলতরঙ্গে খড়কুটোর মতো ভেসে গেলেন আয়ুব খান।
আরো একটি বাঁক
১৯৭০ সালের ৭ই ডিসেম্বর পাকিস্তানে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হল প্রাপ্ত বয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে। আশ্চর্য সেই নির্বাচন। প্রাদেশিক সভায় এবং জাতীয় সভায় শেখ মুজিবরের আওয়ামি লিগ পেল সংখ্যাগরিষ্ঠতা। শেখ মুজিব ঘোষণা করলেন ছ-দফার ভিত্তিতেই সংবিধান রচনা করা হবে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানও বললেন মুজিবই হবেন দেশের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী।
জাতীয় সভার অধিবেশন ডাকা নিয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান একবার শেখ মুজিবর রহমানের সঙ্গে আর একবার পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলি ভুট্টোর সঙ্গে আলোচনা করতে লাগলেন। কখনো ঢাকায়, কখনো-বা করাচীতে এই আলোচনা চলতে থাকল।
একাত্তরের তিরিশে জানুয়ারী একটি ভারতীয় বিমানকে ছিনতাই করে নিয়ে যাওয়া হল লাহোরে। ঢাকা থেকে লাহোর উড়ে গিয়ে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি জুলফিকার আলি ভুট্টো আন্তর্জাতিক আচরণবিধি লঙ্ঘন করে বিমান ছিনতাইকারীদের অভিনন্দন জানালেন। ভারতীয় নেতৃবৃন্দের অনুরোধ-উপরোধ সত্ত্বেও ২রা ফেব্রুয়ারী বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ঐ বিমান ধ্বংস করা হল। পশ্চিম পাকিস্তানি নেতৃবৃন্দ আবার শুরু করলেন ভারত বিরোধী প্রচারণা।
বাতাসে বারুদের গন্ধ
১৯৭১ এর ৩রা ফেব্রুয়ারী। ভারত তার আকাশসীমার ওপর দিয়ে পাকিস্তানি বিমান চলাচল নিষিদ্ধ করে দিল।
ওদিকে জেনারেল ইয়াহিয়া-ভুট্টোর শলা পরামর্শ চলতেই থাকল। একসময় শেখ মুজিব জাতীয় সভার অধিবেশন ডাকাতে বিলম্ব হওয়াতে উদ্বেগ প্রকাশ করলেন। ওদিকে ভুট্টো জানালেন ছ-দফা সূত্র তাঁর পক্ষে গ্রহণযোগ্য নয়। ঢাকায় ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হাঙ্গামা ঘটতে থাকল। ২ মার্চ থেকে শুরু হল আওয়ামি লিগের অসহযোগ আন্দোলন।
এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম
তারিখটা এখনো মনে আছে। ৮ই মার্চ, সকাল তখন আটটা। কান রয়েছে ঢাকা কেন্দ্রের অনুষ্ঠানের দিকে। ভেসে এল ঘোষকের কন্ঠস্বর। প্রচারিত হবে রমনা ময়দানে আওয়ামি লিগ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের গতকালের, অর্থাৎ ৭ই মার্চের ভাষণ। চমকে উঠলাম। ভাষণ তো নয়, একটা মুক্তিকামী দেশের কন্ঠস্বর। আর সেই কন্ঠস্বর আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে ঘোষণা করল –
“এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” সেই প্রথম স্পষ্ট করে বুঝতে পারলাম এক নয়া ইতিহাসের সম্মুখীন হতে চলেছে উপমহাদেশের মানুষ।
৮ মার্চ তো ওই ভাষণ ঢাকা থেকে রিলে করা হল। ১৬ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এলেন শেখ মুজিবের সঙ্গে আর এক দফা আলোচনা করার জন্য। একদিকে আলোচনা চলতে লাগল, অন্যদিকে সেনাবাহিনী অসামরিক ব্যক্তিদের ওপর গুলি চালাল জয়দেবপুরে। ভুট্টোও এলেন ঢাকাতে।
২৩ মার্চ- পাকিস্তান দিবসে শেখ মুজিবের নির্দেশে বাংলাদেশের ঘরে ঘরে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা তোলা হল।
অমারাত্রির দুর্গতোরণ যত ধূলিতলে হয়ে গেল ভগ্ন
২৫শে মার্চ, ১৯৭১। দুপুর থেকেই বাংলাদেশের আকাশে-বাতাসে বারুদের গন্ধ। দেড়টা নাগাদ ঢাকায় খবর পৌঁছল চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর সঙ্গে জনতার সংঘর্ষ ঘটেছে। নিহত হয়েছেন বহু মানুষ। সৈয়দপুরে এমনি সংঘর্ষে কুড়িজন নিহত ও শতাধিক আহত হলেন। ঢাকায় তখন চাপা উত্তেজনা। বিকেলের দিকে ঢাকার রাজপথে সাঁজোয়া গাড়িগুলি একটি দুটি করে বেরিয়ে পড়তে শুরু করল। সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এক বিশেষ বেতার ভাষণে শেখ মুজিব ও আওয়ামি লিগের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতা ও চক্রান্তের অভিযোগ আনলেন। শেখ মুজিব তাঁর অনুগামী নেতৃবৃন্দকে সর্বত্র ছড়িয়ে পরে ঘরে ঘরে ‘প্রতিরোধের দুর্গ’ গড়ে তোলার নির্দেশ দিলেন।
২৬শে মার্চ, ১৯৭১। বাংলাদেশের ভিতরে এক গোপন বেতারকেন্দ্র থেকে এক বিবৃতি প্রচার করে জানানো হল যে, শেখ মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন এবং বিশ্ববাসীর কাছে সাহায্য ও স্বীকৃতি দানের আহ্বান জানিয়েছেন।
২৫শে মার্চ যদি হয়ে থাকে কালো দিন, তবে ২৬শে মার্চ, ১৯৭১ তারিখটি বাংলাদেশে সোনার জলে লেখা একটি দিন – স্বাধীনতা দিবস।
চট্টগ্রামে মুক্তাঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বিপ্লবী বেতারকেন্দ্র থেকে ও ২৭শে মার্চ বিদ্রোহী পাকিস্তানি বাহিনীর মেজর জিয়া–উর- রহমানও শেখ মুজিবের ঘোষণার সূত্র ধরেই হানাদারবাহিনীদের বিরুদ্ধে পালটা আঘাত হানবার আহ্বান জানালেন।
বোঝা গেল শেখ মুজিবের নির্দেশমতো স্বাধীনতার সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম শুরু হয়ে গেছে।
শোনো একটি মুজিবরের থেকে
তখন তো এদেশে সকলের মনে শয়নে-স্বপনে-জাগরণে বাংলাদেশ, আমার বাংলাদেশ। বাংলাদেশ নিয়ে গল্প লেখা হচ্ছে, নাটক লেখা হচ্ছে, প্রবন্ধ লেখা হচ্ছে, লেখা হচ্ছে কবিতা, লেখা হচ্ছে নতুন নতুন গান। বাংলা সাহিত্যের পশ্চিমখন্ডে ততদিনে একটি নতুন উপশাখা যুক্ত হয়ে গেছে যাকে বলা যেতে পারে বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রাম শাখা।
একটা গানের কথা মনে পড়ছে, গানটি প্রথম প্রচারিত হয়েছে রেডিওতে, রেকর্ড হয় তার পরে । লোকসঙ্গীত শিল্পী দিনেন্দ্র চৌধুরী, অংশুমান রায় ও গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার থাকতেন গড়িয়া অঞ্চলে। একটা চায়ের দোকানে ওঁদের আড্ডা বসত। সেদিনও বসেছে। কথার পিঠে কথা জমছে। কিন্তু গৌরীদা কেমন যেন একটু অন্যমনস্ক। একসময় পকেট থেকে একচিলতে কাগজ বার করে কি একটা লিখতে লাগলেন, আর মাঝেমাঝেই টুকরো কথা ছুঁড়ে দিচ্ছিলেন আড্ডাটাকে তেজী রাখতে। কিছুক্ষণ বাদে গৌরীদা অংশু আর দিনেনকে বললেন, দেখো তো গানটা চলবে কিনা। পড়া শেষ হতেই লাফিয়ে উঠলো অংশু। বলল - গৌরীদা, এটা আপনি কাউকে দিতে পারবেন না। গানটায় সুর দেব আমি, গাইবও আমি। কিছুক্ষণ সুর ভেঁজে টেবিলে তবলার বোল বাজিয়ে অংশু গেয়ে উঠলো – “শোনো একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি প্রতিধ্বনি আকাশে বাতাসে উঠে রণি.........।
এর কদিন পর দেবুদের বাড়িতে আড্ডা জমছে বাংলাদেশের বিশিষ্ট শিল্পী কামরুল হাসানের সঙ্গে। উপেন তরফদারও সেখানে হাজির তাঁর টেপ-রেকর্ডার সমেত। গিয়েছিল কামরুল ভাইয়ের সাক্ষাৎকার নিতে। এমনসময় অংশু এসে পৌঁছল পূর্ণদাস রোদের ঐ বাড়ীতে। কামরুল ভাইয়ের সঙ্গে ওর পরিচয় করিয়ে দেওয়া হল। অংশু সঙ্গে সঙ্গে গেয়ে উঠল – “শোনো একটি মুজিবরের থেকে---” । টেবিলে তাল ঠুকতে লাগলো দিনেন। উপেনের টেপ-রেকর্ডারও চালু হয়ে গেছে ততক্ষণে। ঐ আড্ডার শেষে উপেন ও অংশু চলে এল রেডিওতে। আমাকেও ডেকে নিল উপেন। তিনজনে বসলাম নিউজ-রিলের কক্ষে। গানটা বার দুয়েক শোনা হল। ঠিক হল এই গানটা আমরা এখনই প্রচার করব না। প্রচার করব একটি বিশেষ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে। আরো ঠিক হল গানটির সমে যখন ‘বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ’ কথাটা ফিরে আসবে তখন ঐ ইন্টারলুডে শেখ মুজিবের ৭ই মার্চের ভাষণের কিছু কিছু অংশ ইনসার্ট করা হবে। গানটা সযত্নে নিউজরিলের লকারে রেখে দেওয়া হল।
চলো মুজিবনগর
বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের এক পর্যায় এল ১২ এপ্রিল। গঠিত হল স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার। শেখ মুজিবর রহমান হলেন রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপরাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দিন আহমেদ প্রধানমন্ত্রী। পরের দিন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে এক ভাষণে বিশ্বের রাষ্ট্র নায়কদের কাছে বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দানের জন্য অনুরোধ জানালেন।
আমার মনে আছে, একটি ‘সংবাদ পরিক্রমা’য় এবং ‘সংবাদ বিচিত্রা’য় ‘শোনো একটি মুজিবরের থেকে’ গানটি ব্যবহার করা হয়েছিল। তুমুল হইচই পড়ে যায় বাংলাদেশে। দাবানলের মত গানটি ছড়িয়ে পড়ে। কুষ্টিয়া অঞ্চলে একদল মুক্তিসংগ্রামী এসে এই গানটির জন্য কৃতজ্ঞতা জানান। বলেন, তাঁদের যখন হতাশায় ভেঙে পড়ার উপক্রম, তখন এই গানটি মৃতসঞ্জীবনীর কাজ করে। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে ‘সংবাদ পরিক্রমা’র মত এই গানটির অবদানও অবিস্মরণীয়। বাংলাদেশের মুক্তির পর বাংলাদেশ সরকার এরই স্বীকৃতিতে পরিক্রমা লেখক প্রণবেশ সেন, পরিক্রমা পাঠক দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘শোনো একটি মুজিবরের’ গানটির শিল্পী অংশুমান রায় এবং গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারকে ‘বঙ্গবন্ধু’ স্বর্ণপদক দেবার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছিলেন। ভারত সরকার ‘দেবু’কে সম্মানিত করেন ‘পদ্মশ্রী’ উপাধিতে। একটি দেশের বেতারের, অন্য একটি দেশের মুক্তি সংগ্রামে এভাবে সহায়ক হবার ঘটনা আর কোথাও ঘটেছে বলে জানা নেই।
এত রক্ত মধ্যযুগও দেখেনি কখনো
তারিখটা ঠিক মনে নেই। ডাইরির পাতায় একটা পরিক্রমার খসড়া দেখতে পাচ্ছে। লেখাটা শুরু হয়েছিল এইভাবে –
‘ওরা আসছে। আসছে তো আসছেই। শহর থেকে, গ্রাম থেকে, নদী নালা খালবিল পেরিয়ে, অরণ্য পর্বত ডিঙিয়ে। ওরা আসছে নৌকোয়, গাড়িতে, পালকিতে, পায়ে হেঁটে, কোলে কাঁধে চেপে। ওরা আসছে নাৎসি জার্মানদের কবল থেকে পালিয়ে আসা ইহুদীদের মত। ওরা আসছে ইজরায়েল অধিকৃত প্যালেস্টাইন থেকে হটিয়ে নেওয়া আরবদের মত। ওরা আসছে ভিয়েতনামী শরণার্থীদের মত। কিন্তু না, কোনো শরণার্থী সমাগমের সঙ্গেই তুলনা চলে না বাংলা দেশ থেকে চলে আসা এইসব শরণার্থীদের। আর এই শরণার্থীরা শিকার হয়েছিল এক নৃশংসতম এক নারকীয় অভিযানের। এদের কেউ কেউ সর্বস্ব খোয়ানো, কেউ কেউ স্বজন হারানোর বেদনায় মুহ্যমান। কেউ কেউ অপুষ্টিতে এবং অপুষ্টিতায় ভুগছে। সবাই প্রায় আতঙ্কগ্রস্ত। মানবিক মর্যাদার এতটুকু অবশেষ তাঁরা দেখতে পাননি, এতদিন যাদের ভাই বলে ভেবে এসেছে সেই পশ্চিম পাকিস্তানিদের মধ্যে’।
একজন জার্মান সাংবাদিক এই বিশাল শরণার্থী শিবিরের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন – এ তো ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের এক ভয়ংকর আক্রমণ। এক-দুই নয়, হাজার হাজার নয়, লক্ষ লক্ষ নিরস্ত্র সৈন্য পাঠাল তারা সীমান্তের ওপার থেকে। এদের বিরুদ্ধে অস্ত্র নিয়ে লড়াই করা চলে না। স্নেহ দিয়ে, মানবিকতা দিয়ে, মমতা দিয়ে এদের গ্রহণ করতে হয়।
শরণার্থী শিবিরগুলি দেখে এইসব অভিজ্ঞতার কথা দিনের পর দিন লিখেছি ‘সংবাদ পরিক্রমা’য়। এ তো যাঁদের দেখেছি তাঁদের কথা। যাদের দেখিনি, যাঁরা বাংলাদেশের ভিতরেই হানাদারবাহিনীর হাতেই নিহত হয়েছেন, তাড়া খেয়ে এখানে ওখানে পালিয়েছেন, আক্রান্ত হয়ে রক্তাক্ত হয়েছেন, বহু শ্রমে এবং স্বপ্নে গড়ে তোলা এক চিলতে বাড়িতে যাঁরা শবদেহ হয়ে পড়ে থেকেছেন, তাঁদের অভিজ্ঞতা বলব কেমন করে? সীমান্তের এপার থেকে তো তাঁদের দেখা যায় না। তবু যেটুকু দেখেছি, যেটুকু শুনেছি, তা থেকে মনে হয় মধ্যযুগও এত রক্ত দেখেনি কখনো।
আগত শরণার্থীদের একটা মোটা অংশেরই মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়েছিল সীমান্ত এলাকায়। এই শরণার্থীদের অবস্থা সরেজমিনে দেখতে এসেছিলেন সেনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি, ব্রিটিশ এম পি ব্রুস ডগলাসম্যান, আর্থার বটলমি, এসেছেন রাষ্ট্রসঙ্ঘের উদ্বাস্তু পুনর্বাসন কমিশনার প্রিন্স সদরউদ্দিন আগা খান এবং আরো অনেকে। তাঁরা নিন্দা করেছেন পাকিস্তানের অত্যাচারের, প্রশংসা করেছেন ভারতীয় ত্রাণ– প্রয়াসের। বহু বিদেশী সাংবাদিকও এসেছেন। এঁদের কথা নিয়ে, এঁদের অনুভব নিয়েও পরিক্রমা লিখেছি একের পর এক।
জয় দিকে দিকে
যুদ্ধ হয়ে উঠল জোরালো। মুক্তিবাহিনী ততদিনে হয়ে উঠেছে সুসংগঠিত ও শাণিত। জয় করছে এক-একটি ক্ষেত্র। তাদের অপূর্ব বীরত্বগাথা ছড়িয়ে পড়ছে দিকে দিকে।
সেদিন ৬ ডিসেম্বর। নিউজরুমে ডিউটি করছি আমি আর দেবু। সকালবেলায় বুলেটিনগুলোর প্রচার সবে শেষ হয়েছে। চায়ের পেয়ালা হাতে নিয়ে গল্প করছি নিজেদের মধ্যে। বেলা তখন সাড়ে দশটা। টেলিপ্রিন্টারে চোখ পড়তেই দেখি খবর এসেছে লোকসভার অধিবেশনের শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সদস্যদের তুমুল হর্ষধ্বনির মধ্যে বাংলাদেশকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দেবার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছেন।
তখন তো আমাদের বুলেটিনের সময় ছিল না। একজন বিশিষ্ট শিল্পীর খেয়াল পরিবেশিত হচ্ছিল। পরবর্তী বুলেটিন দিল্লি থেকে, তাও আধঘন্টা পরে। কিন্তু এতক্ষণ চেপে রাখব কী করে এই খবরটা? শিল্পীর অনুষ্ঠান সাময়িক বিরতি ঘটিয়ে খবরটা প্রচার করা হল।
খবরটা প্রচারিত হবার সঙ্গে সঙ্গে সারা শহর তোলপাড়। উপেন তরফদার ছুটে এল। আমি আর ও গেলাম সার্কুলার রোডে, যেখানে থাকতেন বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দ। ভারত সরকারের এই সিদ্ধান্ত সম্পর্কে স্বাগত প্রতিক্রিয়া সংগ্রহ করা হল অস্থায়ী উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী খোন্দকার মুস্তাক আহমেদ এবং অর্থমন্ত্রী ক্যাপটেন মনসুর আলির। সেদিনও রাতে পরিক্রমা লিখেছিলাম আমিই। আর সেই পরিক্রমার প্রথম লাইনটি ছিল সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতার একটি পঙক্তি- ‘এদেশ আমার গর্ব / এ মাটি আমার কাছে সোনা।’
জেনোসাইড থেকে এলিটোসাইড
১৪ই ডিসেম্বর সকালে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ বাহিনী সাভারে পৌঁছে যায়। মুক্তিপ্রেমী মানুষের অকুন্ঠ অভিনন্দনে অভিষিক্ত হন তাঁরা। এখন শুধু প্রতীক্ষা– কখন আসবে সেই নবজীবনের মুহূর্ত। ভারতীয় সেনাবাহিনীর অধ্যক্ষ জেনারেল মানেকশ আকাশবাণীর মাধ্যমে সতর্ক করে দিলেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে।
এদিকে-ওদিকে বিচ্ছিন্নভাবে হানাদারদের এক-একটি দল আত্মসমর্পণ করতে লাগল। এই আত্মসমর্পণের মুখেওপাকিস্তানি স্বৈরতন্ত্র তার ঘাতক রূপটিকে ছাড়তে পারল না। এতদিন ধরে চলছিল জেনোসাইড, পরাজয়ের অব্যবহিত আগেই তারা শুরু করল এলিটোসাইড- বুদ্ধিজীবী ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের হত্যা অভিযান।
১৫ই ডিসেম্বর সারা দেশ অপেক্ষা করছে পাকিস্তান সেনা বাহিনীর আত্মসমর্পণের খবরটুকু জানবার জন্য – সকাল গেল, দুপুর গেল, সন্ধ্যা গেল – তবু সেই খবরটি পৌঁছল না। ঐ ১৫ই ডিসেম্বর রাতের পরিক্রমায় লিখলাম-
বাংলাদেশে আমাদের সংগ্রামী বন্ধুরা, আজ এই রাতে তোমাদের জানাই ভারতের কোটি কোটি মানুষের সংগ্রামী অভিনন্দন, লাখো লাখো সেলাম। কারণ আমি জানি এই রাত ভোর হবে, পুবের আকাশে উঠবে নতুন সূর্য, আর ঐ সূর্যকে ছিনিয়ে আনছ তোমরা, আমার সংগ্রামী ভাইয়েরা। আমি জানি ঢাকা মুক্ত হয়েছে, পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে বেরিয়ে এসেছে বিশ্বের কনিষ্ঠতম গণতন্ত্রের রাজধানী রূপে। ইতিহাসের এই পরম ও অনিবার্য সত্যকে আমি এখনো ঘোষণা করতে পারছিনা। কিন্তু এও জানি এ-সত্যকে পৌঁছে দেবই পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে– আজ নয়, কাল।
সূর্যাস্তে সূর্যোদয়
সেই কাল এল– এল ১৬ ডিসেম্বর। জেনারেল নিয়াজি আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নিলেন। জেনারেল নাগরা, ব্রিগেডিয়ার সন্ত সিং, ব্রিগেডিয়ার ক্লে এবং টাইগার সিদ্দিকি ঢাকায় নিয়াজির সদর দপ্তরে গিয়ে চূড়ান্ত করলেন আত্মসমর্পণের পদ্ধতি প্রকরণ।
বুড়ি গঙ্গার তীর। শীতের আকাশ তখন সূর্যাস্তের রঙে রাঙা। ঘড়িতে তখন চারটে কুড়ি। ঢাকার রেসকোর্স ময়দান প্রত্যক্ষ করল এক ঐতিহাসিক দৃশ্য।
এগিয়ে এলেন বিজয়ী ও পরাজিত বাহিনীর নায়করা। স্বাক্ষরিত হল ইন্স্ট্রুমেন্ট অফ সারেন্ডার। সেই দলিলে স্বাক্ষর দিলেন পাকিস্তানি বাহিনীর জেনারেল নিয়াজি এবং যৌথ কমান্ডের জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা।
বুড়িগঙ্গার তীরে সূর্য তখন অস্ত যেতে চলেছে মুক্ত বাংলায় স্বাধীন বাংলায় নতুন করে উঠবে বলে। প্রায় ওই সময়েই লোকসভার সদস্যদের কানফাটানো করতালি ও হর্ষধ্বনির মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ঘোষণা করলেন–
ঢাকা এখন একটি স্বাধীন দেশের রাজধানী। লোকসভা এবং সমগ্র জাতি এই ঐতিহাসিক ঘটনায় আনন্দিত হবেন। জয়োৎসবের এই শুভ মুহূর্তে আমরা বাংলাদেশের জনগণকে অভিনন্দন জানাই, অভিনন্দন জানাই সে-দেশের সাহসী ও সংগ্রামী যুবকদের।
আমাদের আশা এই যে, এই সন্ধিক্ষণে, এই নতুন জাতির জনক শেখ মুজিবর রহমান তাঁর ন্যায্য স্থান গ্রহণ করে বাংলাদেশকে শান্তি, প্রগতি ও ঐশ্বর্যের পথে চালিত করবেন। এখন সময় এসেছে যখন তাঁরা সকলে একত্রে সোনার বাংলায় তাঁদের ভবিষ্যৎ জীবনের সুখস্বপ্ন দেখতে পারবেন। তাঁদের জন্য আমাদের শুভকামনা রইল।
হুমায়ুন আজাদ তাঁর ১৬ ডিসেম্বরের স্মৃতিচারণায় লিখেছিলেন -
“সন্ধ্যায় ইন্দিরার ভাষণ শুনে লাফিয়ে উঠলাম। ফিরে এসেছে আমার স্বাধীনতা, স্বদেশ, বর্ণমালা, কবিতা।”
কিন্তু আমি কী লিখবো এই ১৬ ডিসেম্বরের রাতে? আমি তো ঢাকায় নেই, রয়েছি কলকাতায়। কলকাতা এখন আক্ষরিক অর্থেই আনন্দনগরী। কিন্তু আমি তো দেখতে পাচ্ছি না বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের বিজয় দিবসের বিজয়োল্লাস। বিভিন্নসূত্রে,ইতস্তত: বিক্ষিপ্তভাবে যেসব খবর আসছে তাতেও তো মন ভরছে না। তবুও লিখতেই হবে। রাত দশটায় প্রচার করতেই হবে সংবাদ পরিক্রমা। লিখলাম –
‘অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণকে আমি ভোঁতা করে দিয়েছি, স্বৈরতন্ত্রের দুর্ভেদ্য দুর্গটা আমি ভেঙে-চুরে চুরমার করে দিয়েছি, প্রয়োজন হলে এক নদী রক্ত দেবার অঙ্গীকার ছিল তাও পূরণ করেছি। আমি এক রণক্লান্ত সৈনিক – স্বাধীনতার সূর্যটাকে ছিনিয়ে আনবার পর মুক্ত, আমি স্বাধীন।’
সময় ও স্বপ্নের যৌথ শিল্প
সময় ও স্বপ্নের যৌথ শিল্প একাত্তরের সংবাদ পরিক্রমার নটে গাছটি এখানেই মুড়ল। এই রচনায় বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসের যে রূপরেখাটি অতি-সংক্ষেপে তুলে ধরা হয়েছে, তারই এক-একটি মুহূর্ত ছিল এই পরিক্রমার বিষয়বস্তু। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিক্রমার ভাষা বদলেছে, আঙ্গিকও বদলেছে, অপরিবর্তিত থেকেছে শুধু উচ্চারিত সত্য।
পরিক্রমা-পাঠক দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর একটি স্মৃতিচারণায় লিখেছিলেন–
‘সংবাদ পরিক্রমার অধিকাংশ স্ক্রিপ্ট লিখতেন প্রণবেশ সেন। পূর্ব বাংলার নাড়ি নক্ষত্রের সাথে ওঁর গভীর-নিবিড় পরিচয় ছিল, সেখানেই ছিল ওঁর আদি নিবাস। প্রণবেশের বাল্য কৈশোর ও যৌবনের প্রারম্ভকাল কেটেছে পূর্ববাংলায় পাবনায় ওঁর নিজের নিজের বাড়িতে এবং হয়তো বা আর কোথাও। ওঁকে প্রশ্ন করে পূর্ব বাংলার মাটি ও মানুষ সম্পর্কে অনেক খবরাখবর জেনে নিতাম ওঁর লেখা স্ক্রিপ্টের মহড়া দেবার ফাঁকে ফাঁকে।
এমনিভাবেই একটু একটু করে অজানা পূর্ব বাংলাকে মনে মনে জেনেছি, কল্পনায় গড়ে তুলেছি। .... স্বদেশের এত কাছে, সীমান্তের ওপারে আমারই মতন বাংলাদেশি মানুষেরা বন্ধন মুক্তির জন্য হাতিয়ার হাতে নিয়ে অকুতোভয়ে লড়াই করছিলেন যখন, তখন মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে আমার হৃদয়ের সবটুকু আবেগ কণ্ঠস্বরে উজাড় করে ঢেলে দিয়ে লড়াই করার অসামর্থ্যকে ঢেকে দিতে চেয়েছিলাম। দীর্ঘ ন-মাসের অরুন্তুদ যন্ত্রণার অবসানে জন্ম নিয়েছিল স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ আমার দ্বিতীয় স্বদেশ।’
জন্মভূমি ও স্বদেশ আবিষ্কার– এই-ই তো একাত্তরের সংবাদ পরিক্রমা।
লেখক পরিচিতি - প্রণবেশ সেন (১৯৩৭- ২০০০) আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রে যোগ দেন ১৯৬৬ সালে। এর আগে কিছুকাল অধ্যাপনা ও প্রিন্ট মিডিয়ায় (দৈনিক জনসেবক পত্রিকা) কাজ করেছেন। সংবাদ বিভাগে সম্পাদনা আর বেতার-ভাষ্য রচনায় তাঁর ভাষা-ভঙ্গি ও বিশিষ্টতা শ্রোতাদের বেতার-সংবাদের আরো কাছে এনেছিল। ‘সংবাদ পরিক্রমা নামে তাঁর বেতার ভাষ্যের জন্য শ্রোতাদের ছিল উৎকর্ণ প্রতীক্ষা। বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলিতে তাঁর বেতার ভাষ্যের জনপ্রিয়তা ছাড়িয়ে যায় বেতারের অন্য সব অনুষ্ঠানকে। দু-দশকেরও বেশি বেতার সাংবাদিকতার পর প্রোগ্রাম এক্সিকিউটিভ হিসাবে যোগ দেন কলকাতা দূরদর্শনে। দূরদর্শনে তাঁর নিকট-দূর অনুষ্ঠানের জনপ্রিয়তাও ছিল তুঙ্গে। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর তিনি ‘বঙ্গবন্ধু’ সম্মানে ভূষিত হন। এই স্বাধীনতার ৪০ বছর পূর্তিতেও তাঁকে মরণোত্তর সম্মান জানান বাংলাদেশ সরকার।
মৃত্যুর বছরখানেক আগে লেখা একই নামের স্মৃতিরঞ্জিত রচনার অংশবিশেষ এই লেখায় নেওয়া হয়েছে। আকাশবাণী ও কলকাতা দূরদর্শনের প্রাক্তন বার্তা সম্পাদক ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস কম্যুনিকেশনের অতিথি অধ্যাপক, ভবেশ দাশ-এর সৌজন্যে মূল রচনাটি প্রাপ্ত। তাঁর সম্পাদনায় লেখাটি ‘কলকাতা বেতার’-বইয়ের প্রথম খন্ডে প্রকাশিত।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।