কান পেতে রই...
অবসর (বিশেষ) সংখ্যা , ডিসেম্বর ৩০, ২০১৪
আমার প্রথম প্রেরণা
সতীনাথ মুখোপাধ্যায়
‘আকাশবাণী কলকাতা,’ রেডিও খুললেই এই শব্দটা ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যেই কানায় কানায় সাজিয়ে দিত হরেক রকম বিনোদনের রঙ বেরঙের পশরা। কী নেই সেখানে! গান, বাজনা, কথাবার্তা, গল্প, নাটক, খবর- ঢেউয়ের মত এসে যেন আছড়ে পড়ত ছোট কিংবা বড় মাপের রেডিও-র মাধ্যমে গৃহস্থ ঘরের মধ্যে। রেডিও অবশ্য খুব ছোট মাপের হত না। পরে ট্রানজিস্টর এসে রেডিওর কৌলীন্য ঘুচিয়ে ‘ক্ষুদ্র তবু তুচ্ছ নয়’ সেই প্রবাদকেই যেন আরও বিশ্বাসযোগ্য করে তুলল।
ওই ‘আকাশবাণী ভবন’ লেখা বাড়িটার প্রতি একটা রহস্যময় তীব্র আকর্ষণ সেই ছোটবেলা থেকেই। আমাদের দুটো বাড়ির পরেই নীতীশবাবুর গান শেখানোর স্কুল। বুধবার বিকেলে আর রবিবার সকালে দলেদলে সব আসে গান শিখতে। নীতীশবাবুর গান শেখানোর কায়দা অভিনব। তাঁর নিজের গলা ছাত্রছাত্রীদের শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শেখাতে শেখাতে ফেটে চৌচির। তাই নিয়েই অবলীলায় রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলগীতি, অতুলপ্রসাদী, রজনীকান্তের গান ছাড়াও নানা রাগ-রাগিণী শেখাতেন। অভিনব বললাম এই কারণে, কোনোদিন তাঁকে হারমোনিয়াম বাজিয়ে শেখাতে দেখিনি। শেখাতেন তবলা পিটিয়ে। সত্যি সত্যি দেখতাম। একতলার বড় ঘরেই গানের ক্লাস। বড় বড় জানলাগুলো খোলা। পাশেই আমাদের খেলার মাঠ। খেলতে খেলতে খেলা ফেলে গানের সুরে টানে ততটা নয়, দেখতে ছুটতাম ওই তবলায় তেরেকেটে ধাঁই সহযোগে গান শোনবার আকর্ষণে। সে এক দৃশ্যই বটে। গান চলছে... রবীন্দ্রসঙ্গীত ‘ফাগুনের নবীন আনন্দে/ গানখানি গাঁথিলাম ছন্দে...’ হারমোনিয়াম পিঁ পিঁ করে বাজাচ্ছেন ছাত্রীটি...মৃদু তাঁর কণ্ঠ। গলা ফাটাচ্ছেন নীতীশবাবু, তবলায় চাঁটির অনুষঙ্গে। ‘ফাগুনের নবীন আনন্দে,’ তেরে কেটে ধেরে কেটে...ধাঁই...একদম বাঁয়া ফাটানো ধাঁই। এই ধাঁই-এর সঙ্গে গুরু শিষ্যার সম্মিলিত কণ্ঠে ধ্বনিত হত ‘নন্দে।’ সাত পাড়া দূর থেকেও ‘নন্দে’ না হোক, ধাঁই অবশ্যই শোনা যেত। বাঁয়াতে চাঁটি মেরেই নীতীশবাবুর হাত পুরো ঊর্ধ্বে...শূন্যে। কোন কোন ছাত্রীকে ওই মোক্ষম চাঁটির দাপটে ভয় পেয়ে আঁতকে উঠতেও দেখেছি। আর জানলার বাইরে আমাদের সম্মিলিত হই হই হাসি।
নীতীশবাবুর ছেলেমেয়েরাও সব এক একজন জুয়েল। আর পুত্রকন্যা মিলিয়ে ৭টি স্বরকেও ধরে রেখেছিলেন তিনি। ৪ মেয়ে ৩ ছেলে যেন সারেগামাপাধানি। তারাও সব কী গানে, কী বাজনায় সহজাত প্রতিভায় ঝলমল করত।
হঠাৎ একদিন শুনি নীতীশবাবুর বড় ছেলে কৃষ্ণরামদা রেডিওতে গান গাইবেন। আমরা সব পাড়ায় ঘরে ঘরে রেডিওতে শুনব সেই গান। উঃ ভাবতে পারছি না! শুনলাম, রেকর্ডিং নয়, সরাসরি। মানে যখন কৃষ্ণরামদা গান গাইবেন, ঠিক তখনই শুনব আমরা।
বিকেল যখন নিজেকে বিলিয়ে দেয়, মিলিয়ে দেয় সন্ধ্যের কোলে, সেই গোধূলি লগ্নে কৃষ্ণরামদার গান। সব ঘরে ঘরে রেডিও চলছে পাড়ায়। অবশেষে এল সেই ঘোষণা। এখন শুনবেন আধুনিক গান, শিল্পী কৃষ্ণরাম বসু। কুঁই কাঁই করে বাজনা, তারপর কৃষ্ণরামদার গলা ভেসে এল ‘ওই হলুদ নদীর বাঁকে সবুজবনের ফাঁকে, পথ যে আমায় ডাকে ইশারায়, আয়রে, কে যাবি ছুটে আয়...। পাহাড়িয়া ও...ই...।’ আমাদের মুখচোখ আনন্দে ডগমগ করছে।
সবারই খুব আনন্দ। তারই মধ্যে আমার মনে একটু দুঃখ ছড়িয়ে গেল। আমি তো কোনদিন ওই রহস্যেঘেরা গান বাজনা গল্প আর নাটক শোনানো বাড়িটাতে ঢুকতে পারব না! আমি তো আর গান গাই না, শিখিও না। এমন কিছুই করি না যার জোরে এরকম একটা ভাবনা মাথায় আসতে পারে! মনের দুঃখ তাই মনেই রইল চাপা।
ছোটবেলায় আমাদের বিনোদনের জগতে যা যা ছিল তার মধ্যে রেডিওর সঙ্গে আর কিছুর কোনও তুলনাই হয় না। শিশুমহলের ইন্দিরাদির সেই ডাক-
‘তোমাদের ইন্দিরাদি বলছি। ছোট্ট সোনা বন্ধুরা সব, আদর আর ভালবাসা নাও। কি ভাল আছ তো সব?’
আর তারপরেই অনেক কচিকাঁচা গলায় একটা বিরাট লম্বা ‘হ্যাঁ’- রবিবারের সকালটা ভরিয়ে দিত। আর বিকেল বেলায় গল্পদাদুর আসর। পঙ্কজকুমার মল্লিকের সংগীত শিক্ষার আসর- সেও কি কম! কিন্তু সব ছাপিয়ে যা আমাকে অবাক করে দিত, চমকে দিত, তা হল রেডিওর নাটক। ভাবতাম এঁরা কারা! চিনি না, জানি না- শুধু গলার স্বরের কারুকাজে এক একটা চরিত্র হয়ে ওঠেন আর আমাদের অবলীলায় কাঁদান, হাসান। তাঁরা ভয় পেলে আমি আতঙ্কিত হই, তাঁরা খুশি হলে আমি আনন্দে ভরে যাই। কী করে এইসব মানুষগুলো তাঁদের সমস্ত অনুভূতি শুধু কণ্ঠ দিয়ে প্রকাশ করে আমাকে, আমার মত আরও অনেক অসংখ্য শ্রোতাকে মুগ্ধ করে রাখেন। এ কী করে সম্ভব! বলতে গেলে সেই তখন থেকেই নাটকে অভিনয়ের পোকাটা মাথার মধ্যে ঘুরঘুর করতে শুরু করল। পারব কি আমি এরকম করতে! ইশ, যদি কোনদিন পারি তাহলে তো ঢুকতে পারব ওই বাড়িটার মধ্যে। আর তারপর...! এই ভাবনাই লালন করেছি মনে মনে দীর্ঘকাল। বাড়িতে তো সেরকম পরিবেশ ছিল না যে আমার মনের এমন সৃষ্টি ছাড়া ইচ্ছে কাউকে বলতে পারি!
মাঝের কিছু বছর টপকে চলে আসি সেই সময়ে, যখন সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল চার্চের মাঠে ‘আন্তিগোনে’ নাটক করছি ম্যাক্সমুলার ভবনের প্রযোজনায়। পরিচালক জার্মানির স্টুটগার্ট স্টেট থিয়েটারের ডিরেক্টর হান্স গুন্থার হাইমে। প্রধান চরিত্র ক্রেয়োনের ভূমিকায় আমি। সে এক অসামান্য, দুর্ধর্ষ, সাঙ্ঘাতিক অভিজ্ঞতা। সেখানেই আলাপ তমালের সঙ্গে। ততদিনে আমি একটা চাকরিতে ঢুকে গেছি। কিছু কিছু গ্রুপে নাটক করি। গলাটা ভাল বলে, অভিনয়টা ভাল লাগে বলে মোটামুটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে সুযোগ টুযোগ পাই। বয়সে ছোট রোগাপাতলা চেহারার তমাল মোটেই চোখে পড়ার মত কিছু নয়। কথায় কথায় একদিন শুনলাম এই তমালই নাকি রেডিওর যুববাণীতে কীসব টক-মিষ্টি প্রোগ্রাম করে। আমার মাথার অ্যান্টেনা সঙ্গে সঙ্গে পিঁক পিঁক করে উঠল। মনের ইচ্ছে জানালাম তমালকে। তমালই ফর্ম এনে দিল। অডিশন দিলাম আর চান্সও পেয়ে গেলাম রেডিওতে প্রোগ্রাম করার। তবে যেদিন যুববাণীর অডিশন ছিল আগে থেকে খোঁজখবর করে সেইদিনই ফর্ম জমা দিলাম আকাশবাণীর মূল অনুষ্ঠানে, কলকাতা ক-এর নাটকে অভিনয় করার জন্যে।
এবার যখন কলকাতা ক-এর অডিশনের ডাক পেলাম একটু ভয় ভয় করছিল সন্দেহ নেই। চেনা-পরিচিত কিছু লোকজন বললেন,
‘একদম টেনশন করোনা। আকাশবাণী কাউকে একবারে পাশ করায় না। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ক’বারে পাশ করে ছিলেন জানো? সতীনাথ মুখোপাধ্যায়?...আর তুমি তো...! ও, তুমিও তো সতীনাথ মুখোপাধ্যায়। চিন্তা করো না, হবে না। হ্যাঁ, অভিজ্ঞতা বাড়বে। অন্তত তিনবার। তার আগে নয়।’
বেশ মুষড়ে পড়লাম। আবার ভাবলাম, যাক আগে থেকে যখন রেজাল্ট জেনেই যাচ্ছি, তখন তো আমার নতুন করে হারাবার কিছু নেই।
অডিশনের দিন কিন্তু ভারি মজা হল। ১০ নম্বর স্টুডিওতে বসে আছি আরও অনেকের সঙ্গে। সবার হাতে হাতে কয়েক পাতা করে স্ক্রিপ্ট দিচ্ছেন এক মহিলা। সেটা পড়ে একটু রপ্ত করে মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে অভিনয় করতে হবে। গলার খেলা দেখাতে হবে। একের বেশি চরিত্র হলে, তাই। আমি যে স্ক্রিপ্টটা হাতে পেলাম, সেটা রবীন্দ্রনাথের ‘দালিয়া।’ কি আশ্চর্য! যে-কটা পাতা আমার হাতে, তাতে সবকটাই মেয়েদের সংলাপ। এদিকে স্ক্রিপ্টও আর বদল করা চলবে না। ‘যার অদৃষ্টে যেমনি জুটেছে সেই আমাদের ভালো’- এই নিয়ম। আমি নিরুপায় হয়ে বললাম-
‘দেখুন, যদি একটাও পুরুষ চরিত্র থাকত তাহলে আমি পাল্টাতে বলতাম না।’
সে মহিলার মন গলল। অন্য কয়েকটা পাতা দিলেন। হায় কপাল! সেই স্ক্রিপ্ট পড়ে তো চক্ষু চড়কগাছ। মাঝখান থেকে ছেঁড়া কয়েকটা পাতা। কী নাটক বলতে পারব না। এবার সংলাপ পুরুষের স্বগতোক্তি, কিন্তু তার বিষয়বস্তু একটা গোটা রাত্তির চূড়ান্ত ভালবাসাবাসির পর ভোররাতের সিক্ত স্মৃতি রোমন্থন। ভাবলাম, অডিশনে এটা বলা বোধহয় ডবল ডিমের বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। আবারও তাঁকে বললাম। প্রথমেই ঝাঁঝিয়ে উঠলেন,
‘বড্ড বিরক্ত করছেন তো আপনি!’
বললাম,
‘দিদি, আপনি ক’লাইন একটু পড়ে দেখুন, তাও যদি বলেন, কি আর করব, পড়ব।’
পাতার দিকে চাইলেন তিনি।
‘ওমা এ কি! কী কাণ্ড! এ কী স্ক্রিপ্ট! কে দিল?’
ততক্ষণে সবার হাতে হাতে পাতা ধরা, সবাই পড়ছেন। এক জায়গায় কিছু পাতা জড়ো করা, মানে উদ্বৃত্ত স্ক্রিপ্ট। তিনি বললেন,
‘যান, দেখুন ওখানে কী আছে আর পড়ে, ওর থেকে যেটা হয় নিয়ে নিন।’
খোলা খোলা তিন চারটে করে পাতা স্টেপল করা, গোটা পাঁচেক নানা নাটকের টুকরো। সেইসব নাটক যেগুলো আগে রেডিওতে কোন না কোন সময়ে অভিনীত হয়েছে, প্রচার হয়েছে শুক্র, শনি বা রবিবার। একটাই সুতো বাঁধা মোটা স্ক্রিপ্ট সবার তলায়। দেখেই বোঝা যাচ্ছে পুরো নাটক, গোটা একটা স্ক্রিপ্ট। হাতে তুললাম। বুদ্ধদেব গুহর কাহিনী অবলম্বনে বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের নাট্যরূপ ‘বিড়াল।’ দুর্ধর্ষ নাটক, মাস ছয়েক আগে রেডিওতে শুনেছি। আমার রীতিমত হাত কাঁপছে। সেই নাটক আমার হাতে। ঝটপট পড়তে শুরু করলাম। কোন জায়গাটা পড়ব, নিজেই ঠিক করলাম। একসময় ডাক পড়ল আমার। মাইকের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। শুরু করলাম পড়া মানে অভিনয়। টানা ৫ পাতা পড়লাম। ভেতরে ভেতরে দারুণ রোমাঞ্চ। আর কাউকেই এতক্ষণ পড়তে দেয়নি।
‘আচ্ছা, ঠিক আছে।’
যখন ভেতর থেকে এই কথা ভেসে এল, তখন একটা বীভৎস খুনের দৃশ্য শেষ করে পরের অসাধারণ একটা স্বগতোক্তি সবে শুরু করেছি ৪/৫ লাইন। থামিয়ে দিল। কোনও মানে হয়? কিন্তু না, ভেতর থেকে কণ্ঠ শোনা গেল আবার।
‘নিজে কি কোন স্ক্রিপ্ট এনেছেন?’
মঞ্চে তখন একটা নাটক করি, ‘বিজাতীয়।’ বেকারত্বের জ্বালা ঘোচাতে এক তরুণ খুব বড়লোক একজনের বাড়িতে কুকুর হয়ে থাকার চাকরি নিয়েছে। একেবারে অন্যরকম নাটক। আমিই সেই কুকুররূপী তরুণ। ব্যাগ থেকে স্ক্রিপ্ট খুলে উত্তেজনায় টগবগ করে পড়তে শুরু করলাম। ওমা! ৭/১০ লাইনের পরই শুনলাম,
‘আচ্ছা, ধন্যবাদ।’
মনটা খারাপ হয়ে গেল। যাঃ, এটা আমার দারুণ তৈরি স্ক্রিপ্ট, এটাই ভাল করে পড়তে দিল না! তাহলে কি ভাল লাগল না!
আর বোধহয় দু’তিনজনের অডিশন বাকি ছিল। তারই মধ্যে একজন নিজের পছন্দের স্ক্রিপ্ট ‘রক্তকরবী’ থেকে রাজা আর নন্দিনীর অংশ পড়লেন। সব শেষ হলে স্টুডিও থেকে বেরিয়ে এলাম। প্রথমেই গেলাম দোতলায় যুববাণীর ঘরে। সেখানে বসেছিলেন যুববাণীর প্রযোজক সূর্য সরকার। অভিজ্ঞ বয়স্ক মানুষ। আমায় দেখেই বললেন,
‘আরে সতীনাথ, দারুণ দারুণ! ফাটায়ে দিয়েসো। তোমার তো হয়ে গেল। আর আমরা তোমায় যুববাণীতে পাব না। এবার তো জেনারেল নাটক। আমার খুব আনন্দ হচ্ছে।’
আনন্দের রেশ ছড়িয়ে গেল আমার মধ্যে। এভাবে যে সরাসরি উনি বলে দেবেন, ভাবতেই পারিনি। নীচে নেমে আকাশবাণীর গেট দিয়ে বেরোব, পথ আটকে দাঁড়ালেন একজন। ইনিই রক্তকরবী পড়েছিলেন। বললেন,
‘আপনার জন্যেই দাঁড়িয়ে আছি। আজ আমিও অডিশন দিলাম, আপনিও দিলেন। আপনি কী করেছেন, জানেন? একটা বীভৎস খুন আমরা ওই স্টুডিওর মধ্যে আজ চোখের সামনে দেখলাম। কী করে করলেন আপনি? সাত আটটা চরিত্র ওইরকম বীভৎস ভাবে...আপনি তো মাইকে সামনে দাঁড়িয়ে হাতে ধরা কাগজ পড়েছিলেন, আর আমরা সবাই পেছনে বসে চোখ বড়ো বড়ো করে হাঁ করে আপনাকে দেখছি, এ ওর দিকে তাকাচ্ছি আর সব ছাপিয়ে দেখছি বাড়ির দরজার সামনে ওই খুনের দৃশ্য।’
আমি একেবারে নির্বাক।
‘শুনুন, আজ আমরা যতজন অডিশন দিয়েছি, তার মধ্যে যদি একজনও উত্তীর্ণ হয় সে নিশ্চয়ই আপনি। আর এখনকার যা ট্র্যাডিশন শুনেছি, প্রথমবারে নাকি পাশ করায় না, আপনার বেলাও যদি তাই হয়, তো বলব এই অডিশনটাই একটা ফার্স। এর কোনো মানেই নেই।’ পরবর্তীকালে জানলাম অডিশনের সেই ভদ্রলোক বিশিষ্ট আবৃত্তিকার উৎপল কুন্ডু।
একটু আগেই দোতলায় সূর্যদা আর গেটের সামনে এই ভদ্রলোক- দুজনের প্রতিক্রিয়ার যোগফল যা দাঁড়ায় সেটা অনুমান করতে পারছি। আবার তাদের কথাও মনে পড়ছে যারা বলেছিল, নিশ্চিন্তে যাও, জেনে রাখো, দু’তিন বারের আগে পাশ করায় না।
যুববাণীতে প্রথম যে প্রোগ্রাম করেছিলাম তা ছিল রবীন্দ্রনাথের কবিতা নিয়ে। বৈশাখের শেষে কবিপক্ষে তিনদিন ধরে হয়েছিল। প্রথম নাটক করেছিলাম মঁপাসার গল্প - ‘পিয়েরো।’ একটা কুকুরকে নিয়ে খুব সেন্টিমেন্টাল গল্প। কলকাতা ক-তে প্রথম নাটক করলাম। অধ্যাপক চিত্তরঞ্জন ঘোষের লেখা হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিওর সংক্ষিপ্ত অথচ নাটকীয় ঘটনায় ভরা জীবন অবলম্বনে ডিরোজিও। গৌতম চক্রবর্তী ডিরোজিও আর তার প্রিয় ছাত্রদের একজন আমি। সেই শুরু। তারপর কত নাটক, কত রকম চরিত্র। প্রথমে একটু ছোট ছোট, তারপর বড় বড়।
একটা নাটকের কথা খুব মনে পড়ে। ‘দাহ’- শ্মশানের গল্প। প্রধান দুটো চরিত্র দুটো ডোম। একটা আমি আর একটা রমাদা, রমাপ্রসাদ বণিক। যেমন অভিনয়, তেমনি পরিচালনা, নাটক লেখাতেও রমাদা সমান দক্ষ। সকলেই বলে আমার কণ্ঠস্বর বেশ ভাল- তাই ভদ্র, সভ্য, শিক্ষিত, মার্জিত, রুচিশীল এমন সব চরিত্রই করতাম বেশিরভাগ। সেখানে একটা শ্মশানের ডোম- বেশ অন্যরকম। চেষ্টাও করেছিলাম অন্যরকমভাবে করার। কী আশ্চর্য! ওই চরিত্রটায় অভিনয় করার জন্যে একটি পুরস্কারও পেয়ে গেলাম, দিশারী পুরস্কার।
পাশাপাশি তখন আকাশবাণীর বিবিধ ভারতীর বিজ্ঞাপন কার্যক্রমের সূত্রে প্রতিদিনই দুপুর থেকে রাত রকমারি নাটকের রমরমা। সেখানেও সুযোগ পেলাম। প্রথম নাটকটাই ধারাবাহিক। পৃথিবী বিখ্যাত গল্প, শার্লক হোমস এর গোয়েন্দাগিরি, স্যর আর্থার কোনান ডয়েলের কাহিনী অবলম্বনে ‘দ্য হাউন্ড অফ দ্য বাস্কারভিলস।’ অবশ্য হোমস বা ওয়াটসন নয়। আসল যে ভিলেন, সেই চরিত্রে আমি। আরও অনেক নাটক করতে করতেও মন পড়ে থাকত লিভিং সাউন্ডের দিকে। সেখানে তখন এই বাংলার শ্রেষ্ঠ সব কণ্ঠের সমাহার। সেখানে সুযোগ পাওয়া মানে আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ হাতে পাওয়া। সেখানেই সেই স্বপ্ন কণ্ঠ- কাজী সব্যসাচী, সেখানেই সেই বিজ্ঞাপনের রাণী শ্রাবন্তী মজুমদার।
ওঃ, কী চেষ্টা করে, কত জুতোর সোল খইয়ে তবে যে সেখানে মাথা ঢোকাতে পেরেছিলাম! এখনো স্বপ্নের মত লাগে। আর সেই সব অনুষ্ঠান- বোরোলীনের সংসার, আরব্য রজনী, পি থ্রি রহস্য সিরিজ, বৈদ্যনাথের ধন্বন্তরির আসর, সিফোমের রূপকথার আসর...এইরকম আরও কত।
লিভিং সাউন্ডের মতই অরূপ গুহঠাকুরতার ‘অ্যাডমেকার্স’-ও রেডিওর বিজ্ঞাপন কার্যক্রমের নাটক প্রযোজনা করত। এমনকি ফটিকচাঁদ চলচ্চিত্র নির্মাণেরও আগে সেই অনুষ্ঠান পরিচালনা করতেন সত্যজিৎ রায়ের পুত্র সন্দীপ রায়। মূলত রহস্য রোমাঞ্চ কাহিনীতেই তাঁর আগ্রহ ছিল বেশি। মৌলালির মোড়ে গোবিন্দবাবুর স্টুডিওতে বসে এমন অজস্র নাটক রেকর্ডিং আর এডিটিং করেছেন নগেন দত্ত। এইসব নাটকের নাট্যরূপ যাঁরা করতেন নিয়মিত, তাঁদের মুনশিয়ানার কোনও তুলনা নেই। এ ব্যাপারে নিঃসন্দেহে অগ্রগণ্য মিহির সেন। মূলত সাহিত্যিক, তবু এই বিজ্ঞাপনী দাপটে কত হাজার গল্প উপন্যাসের যে সার্থক নাট্যরূপ দিয়েছেন মিহির সেন, তার ইয়ত্তা নেই। অভিনেতা-পরিচালক শ্যামল সেনও বেশ কিছু নাট্যরূপ দিয়েছেন। আর একজন ছিলেন, শুধু নাট্যরূপ দিতে নয়, নাটক রচনাতেও সিদ্ধহস্ত। তিনি স্বরাজ বসু। বিশিষ্ট অভিনেতা গঙ্গাপদ বসুর পুত্র। স্বরাজদার স্ক্রিপ্টের বিশেষত্ব ছিল পাংচুয়েশন, যেটা অনুসরণ করলে অভিনেতারা অভিনয়ের সমস্ত ইঙ্গিত পেয়ে যেতেন। সর্ব অর্থে এ এক ব্যতিক্রমী লেখার স্টাইল। স্বরাজদার কণ্ঠও ছিল অসাধারণ। দুরূহ সব চরিত্রে বিচিত্র গলার স্বর তৈরি করে মুগ্ধ করতেন রেডিওর শ্রোতাদের।
লিভিং সাউন্ডে একবার ভারি মজা হয়েছিল। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মেয়ে রাণু মুখোপাধ্যায় গানের জন্য বিখ্যাত। বাংলা বাংলা আধুনিক গানে একটা নতুন ঢেউ এনেছিলেন ভি. বালসারা। শ্রাবন্তী মজুমদার, রাণু মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠ সেই সব গানকে সার্থক রূপ দিয়েছিল। রাণু মুখোপাধ্যায়ের আত্মপ্রকাশের দুটো গান তো কোনোদিন ভোলার নয়-
‘কুচকুচে কালো সে যে জাতে স্প্যানিয়্যাল/ তুলতুলে গা যেন রেশমি রুমাল/ আমি তাকে বুশিবল নাম দিয়ে ডাকি/ বুশিবল এ শহরে আছে একটাই।’ আর একটা ...‘মা আমায় বলেছে আমি নাকি বড় হয়েছি, আগেকার মত যখন তখন যেন সী বীচে আমি আর যাই না...শুধু একটাই তফাৎ লা লা লা লা লা।’
শ্রাবন্তীদি আর রাণু খুব বন্ধু। বোম্বেতে থাকলেও কলকাতায় এলেই লিভিং সাউন্ড স্টুডিওতে আড্ডা মারতে চলে আসতেন রাণু। সত্যি বড় সুন্দর দেখতে রাণুকে। ঝকঝকে ফর্সা, টিকোলো নাক, হাসি যেন মুক্তো ঝরানো- এমন পরিপাটি দাঁতের বাহার। এক ঢাল কালো চুল আর ভীষণ কোমল স্বভাব। কথা বলেন এত আস্তে আস্তে, রীতিমত কান পেতে শুনতে হয়। একদিন এলেন রেকর্ডিং-এর মধ্যেই। ভেতরে গিয়ে বসলেন কনসোলে শ্রাবন্তীদির পাশেই। কনসোল মানে যেখানে রেকর্ডিং-এর মেশিনপত্র সব থাকে। বাইরে স্টুডিও ফ্লোরে স্ট্যান্ড মাইক্রোফোন আর সব শিল্পীরা। মাঝে একটা ছোট্ট চা-এর বিরতি। রাণু মুগ্ধ হয়ে বললেন, ওমা, কী সুন্দর অভিনয় করো তোমরা! শ্রাবন্তীদি বললেন, তুমি একটা রোল করবে নাকি? মিষ্টি হাসিতে যেন গলে গেল রাণু, ‘দূর, আমি কি তোমাদের মত পারি?’ আমরাও সবাই চান্স পেয়ে খুব উৎসাহ টুৎসাহ দিলাম। রাজি হয়ে গেলেন রাণু।
বৈদ্যনাথের ধন্বন্তরির আসরে একটা কি দুটো নাটকীয় দৃশ্যের মধ্যে দিয়ে কোনও একটা রোগের সমস্যা তৈরি হয়। ৫/৭ মিনিটের নাটক। এরপর একজন কবিরাজমশাই এসে সেই রোগের প্রতিবিধানে যা যা করণীয় সব বলেন। রাণুর সঙ্গে আমারই সংলাপ। আমরা স্বামী-স্ত্রী। কী একটা কথা আমি বললাম, যাতে বেশ স্বস্তি পেয়ে, খুশি হয়ে রাণু বলবে, ‘যাক বাবা, বাঁচলাম’ আর সেইসঙ্গে মিষ্টি করে হাসবে। আমি আমার কথা বললাম, রাণু রাণুর কথা বললেন। এরপরের কথা বললেন শ্রাবন্তীদি,
-‘কাট্ কাট্ কাট্। কী হল রাণু? কথা বলার পর তুমি হাসলে না?’
-হ্যাঁ, হাসলাম তো।
-হাসলে! কই, কিছু কানে এল না তো?
আমরাও হতভম্ব। পাশে দাঁড়িয়ে, অথচ হাসি তো আমিও শুনতে পাইনি!
-চলো, রানিং...কী হল রাণু, ‘যাক বাবা, বাঁচলাম’ বলে হাসলে না তো!
-হাসলাম তো!
-কই হাসলে? এখানে তো কিছু রেকর্ড হল না! কোনও শব্দই হল না তো!
-শ্রাবন্তী, আমি শব্দ করে হাসতে পারি না গো। আমার হাসিতে কোনও শব্দ হয় না।
-এই মরেছে! এটা তো অডিও। তুমি হাসছ আমি দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু শুনতে না পেলে…শ্রোতাদের শোনাতে হবে তো!
অন্য একটা চরিত্রে অভিনয় করছিল সুমিতা। বহুরূপীর সুমিতা বসু। শ্রাবন্তীদি বললেন,
-'এই, তুই একটু হাসিটা ডাব করে দে তো। রাণুর কথা শেষ হওয়া মাত্র খিলখিলিয়ে হাসবি। ঠিক আছে রাণু?'
সুমিতা তো স্বভাবসিদ্ধ মিষ্টি হাসিতে খিলখিলিয়ে উঠল। নাটক শেষ। রাণু বললেন,
-বাব্বা, কী অপূর্ব করো গো তোমরা!'
আবার এক প্রস্থ হাসি। রাণুর সেই নির্মল হাসি যেন স্বর্গের মাধুরী ছড়ানো। কিন্তু ওই শব্দহীনা...সাইলেন্সার লাগানো।
শুধু রাণুর কথা কেন বলব, মারাত্মক এক হাসির ফাঁসে একবার লটকে ছিলাম আমিও। শুনেছি শয়তানের হাসির নাকি কোনও শব্দ হয় না, এমনই হাড় হিম করা ভয়ঙ্কর সে হাসি। না, এর সঙ্গে রাণুর হাসির কোনও সম্পর্ক নেই। কিন্তু অনিবার্য সম্পর্ক আছে উৎপল দত্ত র, নাটকে সিনেমায় জবরদস্ত ভিলেনের ভূমিকায় যিনি নমস্য।
তখন ‘অমানুষ’ সিনেমা চলছে রমরম করে। সুন্দরবনের পটভূমিকায় উত্তমকুমার, শর্মিলা ঠাকুর, অনিল চট্টোপাধ্যায়, উৎপল দত্ত - একেবারে নক্ষত্র খচিত সিনেমা। খলনায়ক উৎপল দত্ত প্রত্যেকটা চরিত্রতেই কিছু বিশেষত্ব নিয়ে আসতেন। অমানুষ সিনেমায় একটা ভয়ঙ্কর হাসি হাসতেন উৎপল দত্ত। পুরো মুখ হাসিতে ফেটে পড়ছে, শরীর কাঁপছে থর থর করে অথচ এক বিন্দু হাসির শব্দ নেই। শুধু দমকে দমকে কিছু হাওয়া - প্রথমে লম্বা একটা তারপর ছোট ছোট করে সরাসরি ফুসফুস থেকে গলা দিয়ে ছিটকে ছিটকে বেরোচ্ছে। প্রায় সাপের হিস হিসের মতই মারাত্মক, শিহরণ জাগানো। ত্রাস ছড়িয়ে দেয়।
অনেক কষ্টে প্রচুর মেহনত করে, বিস্তর কায়দা কানুন সামলে, বুকে ব্যথা তুলে সে হাসি রপ্ত করেছি, পুরোপুরি না হলেও খানিকটা। এমনি করেই তো শিখব, নাকি!
লিভিং সাউন্ডে রেকর্ডিং চলছে সিফোমের রূপকথার আসর। বিদেশি রূপকথা, বিউলফ-এর কাহিনী। সেই যে, বিউলফ সমুদ্র থেকে উঠে আসা ড্রাগনের সঙ্গে যুদ্ধ করে তাকে মারবে। প্রত্যেকদিন ড্রাগনের শিকার হত সে দেশের একজন করে মানুষ। বিউলফ এর জন্যেই প্রাণেও বাঁচবে আর সবাই। প্রচন্ড লড়াই চলছে। ফোঁস ফোঁস করে আগুন ছড়াচ্ছে ড্রাগন। সেই অগ্নিশিখা থেকে বাঁচতে সারা শরীরে বর্ম পরে আছে বিউলফ। শুধু চোখ দুটো খোলা।
একসময় চরম মুহূর্তে বিউলফ তার তরবারি সোজা বসিয়ে দেয় ড্রাগনের বুকে।
-নে তবে মৃত্যুর স্বাদ, আজই তোর বিনাশ। এই আমার তরবারির আঘাতে...
প্রচন্ড আর্তনাদ করে উঠল ড্রাগন। জয়ের বীরোচিত হাসিতে ফেটে পড়ল বিউলফ। সেই সামান্য অসতর্ক মুহূর্তেই মৃত্যুর আগে তীব্র আগুন ছড়ালো ড্রাগন, সোজা বিউলফের চোখে। চীৎকার করে উঠল বিউলফ। চিরকালের মত অন্ধ হয়ে গেল আগুনের হলকায়। উজ্জ্বলদা ড্রাগন আর আমি বিউলফ। উজ্জ্বলদা মানে উজ্জ্বল সেনগুপ্ত, আমাদের যিশু সেনগুপ্তের বাবা। ড্রাগনের নাক দিয়ে আগুনের হলকার আওয়াজ। সে তো পরে, সাউন্ড এফেক্টে। ড্রাগনের বুকে আমূল তরবারি বসিয়ে, ওই সংলাপের সঙ্গেই বীরোচিত হাসি হাসতে হবে আমাকে। তারপর চোখে আগুনের হলকা লাগায় আর্তনাদ, চীৎকার এইসব। সংলাপ বললাম, হাসলাম, চীৎকারও করলাম। হঠাৎ হাত তুলে থামিয়ে দিয়ে কনসোল থেকে শ্রাবন্তীদি বলল,
-কি রে, হাসলি না?
-হ্যাঁ, হাসলাম তো।
-কই হাসলি! কী একটা হাওয়ার মত শব্দ হল। হা আ আ আ, শত্রুকে মারার সেই বীরের মত রাজকীয় হাসি কই? চল আবার কর। হাসবি...হাসি থেকেই বিশাল চীৎকার।
ঠিক আছে, আবার সংলাপ বললাম। আবার হাসলাম। আবার সেই এক ঘটনার পুনরাবৃত্তি। বারবার চারবার। শ্রাবন্তীদি রেগে কাঁই।
-কী হচ্ছেটা কি? রূপকথার গল্প মানে একটু লার্জার দ্যান লাইফ। সেখানে একটা যুদ্ধজয়ের হাসি হাসতে পারছিস না? ফ্যাক ফ্যাক করে কি হচ্ছেটা কি এটা?
উজ্জ্বলদাও বোঝাচ্ছে,
-‘ওরকম নয়রে, গলা দিয়ে কাঁপিয়ে কাঁপিয়া হাঃ হাঃ করে হাস। পার্টটা তো দারুণ করলি। শুধু হাসিটা।’
কী করে বোঝাই অমানুষ-এ উৎপল দত্ত-র হাসিটা এমন করে তুলেছি, যে স্বাভাবিক, শব্দ করে হাসিটাই বিস্মরণ হয়ে গেছে আমার!
-এই উজ্জ্বল, বাদ দে। ওর ডায়ালগ বলা হয়ে গেলে তুই হেসে দে জয়ের হাসি। আর এই যে আপনি, দয়া করে তারপরেই চোখে আগুন লাগার আর্তনাদটুকু করে আমাকে উদ্ধার করুন!
উজ্জ্বলদাই বাঁচিয়েছিল সে যাত্রায়। ডুবেছিলাম উৎপল দত্ত-র হাসির মহিমায়। তারপর কনসোল থেকে বেরিয়ে এসে শ্রাবন্তীদির ঝাড়ের নামে বৃন্দাবন। সে কি আর ভোলা যায়!
রেডিওর নাটক প্রসঙ্গে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে রেডিওর বিবিধ ভারতীর বিজ্ঞাপন কার্যক্রমে ঢুকে পড়াটা বিচিত্র কিছু নয়। খুব ভাল বড় মাপের অভিনেতারাও তখন কি একটা নিয়মের সূত্রে বছরে ৬টা কি ৭টা নাটকে অভিনয়ের ডাক পেতেন। প্রথম প্রথম আমরা তো আরোও কম। সেই তুলনায় বিবিধ ভারতীর কল্যাণে প্রতি সপ্তাহেই প্রায় রেকর্ডিং আর প্রতি সপ্তাহেই অন্তত ৩ থেকে ৪টে নাটকে অভিনয় করার সুযোগ, সে কি কম কথা! তাও আবার এক একটা চরিত্র এক একরকম। শিক্ষিত/ অশিক্ষিত, জমিদার/ প্রজা, নায়েব/ লেঠেল, পুলিশ/ চোর, সাধু/ মাতাল, গোয়েন্দা/ অপরাধী, রোম্যান্টিক হিরো/ ভিলেন- কী নয়! অভিনেতা হিসেবে খুব অল্প সময়ের মধ্যে নিজেকে ভেঙেচুরে গড়ে নেওয়ার এমন ব্যাপক বিস্তৃত অবকাশ আর কোথায়?
রেডিওর নাটক হত একটু রইসি মেজাজে। একদিন রিহার্সাল, তার পরদিন বা দু’চার দিন পর রেকর্ডিং। বিবিধ ভারতী সেদিক থেকে খুবই পেশাদারী। এসো, পড়ো, মাইকে দাঁড়াও, অভিনয় করো। একটা শেষ হল যেই, সামান্য চা-এর বিরতি দিয়েই আবার ধরো পরেরটা। স্ক্রিপ্ট ধরা- পড়া- মাইক- টেক্।
এ কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি একটা সাংস্কৃতিক আবহাওয়া বাড়িতে থাকলে ছোটবেলা থেকে এই জগতের প্রতি ভালবাসা গড়ে উঠতে তা অনেকটা সাহায্য করে। তেমন পরিবেশ সেইভাবে আমার বাড়িতে ছিল না। তা সত্ত্বেও, আজকের আমি, শিল্পী আমি হয়ে ওঠার নেপথ্যে সবটুকু কৃতিত্ব রেডিওর নাটকের। আমার প্রেরণা, আমার শিক্ষক, আমার মধ্যে অভিনয়ের প্রতি টান আর ভালবাসা গড়ে তুলতে রেডিওর অজস্র নাটক আর এক কথায় সমস্ত অভিনেতাদের যে কী অসামান্য ভূমিকা, তা আজ ভীষণভাবে বুঝতে পারি।
মঞ্চ বা চলচ্চিত্রের বিদগ্ধ সব অভিনেতারা অনেকেই দীর্ঘদিন যুক্ত ছিলেন রেডিওর সঙ্গে। তাঁদের পাশে দাঁড়িয়ে অভিনয় করতে পারার যে অনন্য অভিজ্ঞতা তারও বুঝি কোনও তুলনা নেই। কাকে রেখে কার নাম বলব! তবে একটা সোনায় মোড়া অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয়ে আছে কিংবদন্তী শিল্পী তৃপ্তি মিত্রকে ঘিরে।
রেডিওর সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ ছিল তৃপ্তি মিত্রর। অভিনয় তো করতেনই , প্রোডিউসার এমিরেটাস-এর সম্মানও পেয়েছিলেন। শম্ভু মিত্রের সঙ্গে বিধায়ক ভট্টাচার্যের 'তাহার নামটি রঞ্জনা', বসন্ত চৌধুরীর সঙ্গে বুদ্ধদেব বসুর 'পাতা ঝরে যায়'- ওঃ কি সব নাটক!
তৃপ্তি মিত্রের জীবনের প্রায় শেষের দিকে কয়েক বছর রক্তকরবী নাটকের সূত্র ধরে তাঁর কাছে যাবার সুযোগ হয়েছিল। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই যাওয়া আর রক্তকরবী নাটক অভিনয় চর্চা- সে যে কি অসামান্য অভিজ্ঞতা! প্রতিদিনের পাঠেই মনে হত কি অদ্ভুতভাবে নাটকের বিষয় ভাবনা, চরিত্রগুলো যেন শতদলের মত ফুটে উঠছে একটু একটু করে নতুন ভাবে। ছোট সর্দার দিয়ে শুরু করে শেষ পর্যন্ত রাজা। এইভাবেই আমার উত্তরণ ঘটেছিল তাঁর কাছে। শম্ভু মিত্র-র পরিচালনায় বহুরূপীর রক্তকরবী এবং তার অভিনয় ধারাকে মাথায় রেখেও নির্দ্বিধায় বলতে পারি, তৃপ্তি মিত্র যেভাবে আমাদের রক্তকরবী পড়িয়েছিলেন, চরিত্রগুলোয় যে অসামান্য প্রাণপ্রতিষ্ঠা করেছিলেন তার তুলনা আর কিছু হতে পারে না। শুধু পাঠের মধ্যে দিয়েও চরিত্র কতটা জীবন্ত করে তোলা যেতে পারে, তা আমার ওঁর কাছেই শেখা।
মনে মনে ভাবতাম, এমন সৌভাগ্য কি কোনদিনও আসবে না, রেডিওতে ওঁর সঙ্গে অভিনয় করি! কি আশ্চর্য! সুযোগ এসে গেল হঠাৎই। দেবল দেববর্মার কাহিনী নিয়ে নাটক হল ‘ভালো-মা।’ নাম ভূমিকায় অবশ্যই তৃপ্তি মিত্র আর সেই মায়ের ছেলে আমি। শৈশবে মাতৃহারা ছেলের দেখাশুনোর দায়িত্ব নিয়ে গ্রাম থেকে এসেছিলেন মহিলা। ছেলের বাবা-ও তাঁর আদর যত্নে, ছেলের প্রতি তাঁর মমতায় আপ্লুত। বহুবার তাঁকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিলেও মহিলা রাজি হন না। বাবা এক সময় চোখ বুজলেন। ছেলে বড় হয়ে গেল, বিয়ে হল। বউ এসে বাধ সাধল মায়ের অনেক কিছুতেই, তখন সে-ই সংসারের সর্বময়ী কর্ত্রী হতে চায়। যেমনটা হয় আর কি! সংসারের তথা কথিত শান্তি সুনিশ্চিত করতে ভালো-মা ভালোয় ভালোয় বিদায় নিয়ে চলে গেলেন গ্রামের বাড়িতে। অনেক বছর পর ছেলে এল তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। একটা দিন রয়েই গেল। রাতে ঘরের মধ্যে আবিষ্কার করল পুরনো একটা তোরঙ্গ, যেটা তাদের বাড়ির, তার বেশ চেনা। এটা এখানে কেন? কী মনে হতে তোরঙ্গ খুলতেই চোখের সামনে আবার নতুন করে উঠে এল তার শৈশব। সেই ছোট্ট ছোট্ট পোষাক যেগুলো ওর খুব ভাল লাগত, সেইসব ছোট ছোট খেলনা। কি ভাবে পরম যত্নে পরিপাটি করে আজো সাজিয়ে রেখেছেন ভালো-মা। আর সেই সঙ্গে ভালো-মাকে লেখা বাবার অজস্র চিঠি, যেখানে সামাজিক মতে বিয়ে করে ভালো-মা কে স্ত্রীর মর্যাদা দিতে চেয়েছে বাবা; কিন্তু সমস্ত প্রলোভনের ঊর্ধ্বে উঠে ভালো-মা, শুধু ভালো-মা-ই থেকে গেছে। দেখতে দেখতে দু চোখ ঝাপসা। পরদিন সকালে চলে আসার সময়েও রাতের কথা একবারও তুলল না ছেলে। থাক, এই অধ্যায়টুকু আড়ালই থাক। শুধু ভালো-মার প্রতি তার শ্রদ্ধা, সম্মান বেড়ে গেল আরো অনেক খানি।
কোনদিন একসঙ্গে অভিনয় করতে পারার বাসনা হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু সেটা যে এত মর্মস্পর্শী একটা কাহিনী হবে, সত্যি ভাবিনি। রেডিওর নির্দিষ্ট রিহার্সালের বাইরেও ওঁর সঙ্গে আলাদা করে নাসিরুদ্দীন রোডের বাড়িতে রিহার্সাল করেছি। রেকর্ডিং এর দিন সক্কাল সক্কাল বলেছিলেন ওঁর বাড়িতে চলে আসতে। একসঙ্গে টেবিলে বসে গরম গরম ভাতে ঘি আর সঙ্গে আলু সেদ্ধ, কুমড়ো সেদ্ধ, ডিম সেদ্ধ- প্রায় অমৃত ভোজ। তারপর ওঁরই সঙ্গে আকাশবাণী ভবন! ভাবা যায়! কখনো কখনো কোন কোন ইচ্ছে এমনভাবে পূর্ণ হয়, মনে হয় স্বপ্নের মত। রেডিও নাটকের সূত্রে ‘ভালো-মা’-ও আমার কাছে এক উজ্জ্বল সোনালী স্বপ্ন।
প্রমোদ গঙ্গোপাধ্যায়ের নাম আজকের প্রজন্ম হয়তো জানেই না। ‘শাখাপ্রশাখা’-র সেই টুকটুকে ফর্সা শিশুপ্রতিম দাদু বা ‘একদিন প্রতিদিন’ এর মৃত্যুপথযাত্রী বৃদ্ধের চরিত্রের কথা বললে হয়তো কেউ কেউ চিনতে পারবে। অভিনেতাই শুধু নন, অনেক নাট্য প্রযোজনাও করেছেন তিনি। সর্ব অর্থে ব্যতিক্রমী একজন। শুক্লা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রযোজনায় একটা নাটকে এক হিন্দিভাষী বৃদ্ধের অভিনয় করেছিলেন। আমারও একটা মুখ্য চরিত্র ছিল। কে বলবে উনি বাঙালি…এমন বিশুদ্ধ হিন্দি-উর্দু উচ্চারণ! বেশ মনে পড়ে, ‘পরওয়র্দিগর’- এই খানদানি শব্দটি সেই নাটকে তাঁর কল্যাণেই শিখেছিলাম। সে উচ্চারণ কোনদিন ভোলার নয়। প্রমোদ গঙ্গোপাধ্যায়ের স্ত্রী গীতা গঙ্গোপাধ্যায় রেডিওরই কর্মী। আবার নাটক প্রযোজনাও করেছেন। গীতাদি কথায় কথায় মুখের মধ্যে চুক্ চুক্ শব্দ করতেন। এ আবার কী! পরে বুঝলাম দাঁতের সমস্যা। অপ্রত্যাশিত ফাঁকে অনভিপ্রেত কিছু জোর করে ঢুকে ঘাঁটি গেড়ে বসে থাকলে, বার না করা পর্যন্ত অস্বস্তি যায় না। এটা অবশ্য একটু বেশি বয়সের সমস্যা। সেই বয়সে বুঝিনি। আমাকে খুবই ভালবাসতেন। অভিনয় করতে গেলে, বিশেষত ভিস্যুয়াল মাধ্যমে, গাল ভারী থাকলে ছবি ভাল আসে না- একথা গীতাদিই প্রথম আমাকে বলেছিলেন। আরো বলেছিলেন,
‘চান করার সময় মুখে যখন সাবান মাখবি, পাঁচ মিনিট টাইম দিবি। দু’হাতের পাঁচ পাঁচ দশ-আঙ্গুল গালের ওপর চেপে চেপে বোলাবি, নিচে থেকে ওপরে। আর যখন একলা থাকবি, আশেপাশে আর কেউ নেই, সুযোগ বুঝে দু’গালে চটাস্ চটাস্ করে থাপ্পড় মারবি। মানে যতটা সইতে পারিস আর কি! গাল ফোলা ভাবটা চলে যাবে।’
লিখতে লিখতে মনে পড়ল, প্রমোদ গঙ্গোপাধ্যায়ের দুটো গালই বেশ ভেতর দিকে ঢোকা ছিল। জানি না, সেটা দাঁত কম থাকার কারণে, নাকি তার নেপথ্যেও গীতাদির কোনও হাতযশ ছিল!
শুধু অভিনয় নয়, রেডিওতে পার্ট করার সূত্রে এগুলো বাড়তি পাওনা কোন সন্দেহ নেই। গীতাদি অসম্ভব খুঁতখুঁতে ছিলেন। এমনকি, প্রমোদদাও তাঁর হাত থেকে রেহাই পেতেন না।
‘উঁহুহুঁ, এটা কী হল! ঠিক করে বল। আবার বল।’
গীতাদির কথা শুনে প্রমোদদা স্ক্রিপ্ট থেকে আলতো করে মাথা তুলে অদ্ভুত চোখে তাকাতেন গীতাদির দিকে। ভুরু জোড়া উঠেছে কপালে, সেখানে চার-পাঁচটা ভাঁজ.. মুখটা সামান্য হাঁ, ফোকলা দাঁত, এলিয়ে পড়া জিভটা দেখা যাচ্ছে, কিছুক্ষণ চোখের পাতা পড়ত না। চোখ পিটপিট করে বললেন,
‘আবার বলব! আচ্ছা বেশ।’
তবে আমার মনে হয় প্রযোজক হিসেবে নয়, প্রমোদ গঙ্গোপাধ্যায়কে গীতাদি ডিরেকশন দিতেন স্ত্রীর অধিকারে। যে সনাতন প্রথা আমাদের সমাজে আবহমান কালের।
শুক্লাদির কথাও খুব মনে পড়ে। রেডিওতে তখন সবে অভিনয় শুরু করেছি। ভাল কোন চরিত্র দেখলে, জনে জনে প্রযোজকদের বলতেন,
‘এই ছেলেটাকে নিন, ভাল করবে।’
এসব তাঁদের কাছেই শোনা। পরিষ্কার বলতেন,
‘শুক্লা বা শুক্লাদি বলল বলেই আপনাকে নিলাম।’
পরে অবশ্য স্বীকার করতেন, শুক্লাদির নির্বাচনে কোন ভুল ছিল না। অনেক নাটকে শুক্লাদির সঙ্গে অভিনয়ও করেছি। বহুদিন পর্যন্ত শুক্লাদির প্রযোজনার কোন নাটক করিনি। একদিন ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, ‘আপনার কোন নাটকে আমায় নেন না কেন?’
শুক্লাদি বললেন,
‘‘আমি প্রোডিউস করলে তো তাতে অভিনয় করতে পারব না। অন্য কেউ প্রোডিউসার হলে তাহলে সে নাটকে তোমার সঙ্গে অভিনয় করতে পারব। খুব ভাল লাগে তোমার সঙ্গে অভিনয় করতে। যদি সিনসিয়ার থাকতে পার, দেখ তুমি একদিন আরো ভাল খুব ভাল অভিনয় করতে পারবে।’
সবে তখন রেডিও নাটকে হামাগুড়ি। এইসব প্রেরণার কথা ভোলা যায়!
তবে শুধু ভালবাসা বা উত্সাহই নয়, রেডিওর ক্যান্টিন কাঁপানো ঝাড়ও খেয়েছি শুক্লাদির কাছে। সেই প্রথম শুক্লাদির একটা প্রোডাকশনে আমাকে ডেকেছেন, কতকটা যেন আমারই ইচ্ছা পূরণ। রিহার্সাল এক প্রস্থ হয়ে যাবার পর ১০ নম্বর স্টুডিও থেকে বেরিয়ে সবাই গেছি ক্যান্টিনে, একটু চা আর টুকটাক কিছু খেয়ে এসে রেকর্ডিং শুরু। তখন ক্যান্টিনে একটা কেক পাওয়া যেত, খুবই সাদামাটা কিন্তু আমার দারুণ লাগত। ক্যাশ কাউন্টারে টাকা দিয়ে দুটো টোস্ট, একটা কেক আর একটা চা নিয়ে বসেছি। আরও অন্য সব অভিনেতারা বসেছেন এ টেবিল, ও টেবিলে। হঠাৎই কোণাকুণি শুক্লাদির টেবিল থেকে একটা হুঙ্কার উঠল।
‘সতীনাথ কী ব্যাপার! তুমি ওই টেবিলে বসে চা টোস্ট খাচ্ছ কি বলে?’
ঘাবড়ে গিয়ে বললাম,
‘হ্যাঁ, মানে শুক্লাদি একটু খিদে পেয়ে গেছে। চা টোস্টের সঙ্গে এই কেকটাও নিয়েছি।’
যেন দোদোমার পলতেতে আগুন লাগালাম! শুক্লাদির গলা উঠল ক্যান্টিনের সিলিং ফুঁড়ে।
‘তোমার স্পর্ধা হল কী করে ক্যান্টিনে এসে নিজে পয়সা দিয়ে খাবার নিতে! আমার প্রোডাকশন যেদিন হবে সেদিন ক্যান্টিনে আমার আর্টিস্টরা যে যা খাবে সব খরচা আমার, তুমি জান না!’
সত্যি জানতাম না। জানলে এমন অপরাধ কেউ করে! খাওয়া উঠেছে মাথায়, চা, টোস্ট, কেক সামনে নিয়ে কাঁপছি। কিছু বলতেও পারছি না। শুক্লাদির গলা শোনা গেল আবার। এবার সামান্য নিচু পর্দায়।
‘আর কোনদিন যেন এ ভুল না হয়! যা নিয়েছ খাও, আর আমি যা যা বলেছি- সিঙ্গাড়া, চপ সেসবও খাবে।’
গলা আরো একটু নিচু হল,
‘আর এই চা টোস্টের দাম মনে করে দিদির থেকে নিয়ে নেবে। মনে থাকবে?’
ওঃ, কত রকম গলা যে করতে পারতেন শুক্লাদি! একবার একটা রহস্য নাটকে একটি অল্পবয়েসী মেয়ের চরিত্র ছিল, যে ভেন্ট্রিলোকুইজম জানে। সেই চরিত্রে শুক্লাদির অভিনয়, স্টুডিওতে দাঁড়িয়ে দেখতে দেখতে মুগ্ধ হয়ে গেছি। আপ্রাণ চেষ্টা করেছি শেখবার।
অজিত মুখোপাধ্যায়কে প্রযোজক হিসেবে অনেকটা কমার্শিয়াল সিনেমার ডিরেক্টরের মত মনে হত। অজিতদার প্রোডাকশন মানেই স্টার কাস্ট। সেরা সেরা অভিনেতারা স্টুডিও আলো করে বসে। হৈ হৈ করে রিহার্সাল, রৈ রৈ করে নাটক। প্রযোজকের তেমন কিছু করার দরকারই করত না। এরই মধ্যে কদাচিৎ নতুন কাউকে পেলে, তাকে প্রায় তেলের ঘানির মত সর্ষে পেষাই করতেন। একবার সেই কোপে পড়লাম আমি। সমরেশ মজুমদারের কাহিনী উত্তরবঙ্গের পটভূমিকায়। দাদু আর নাতির মিষ্টি সম্পর্ক নিয়ে নাটক। নাতির বিয়ের পর নাত-বউ মাঝখানে এসে পড়ায় কিছু সমস্যা দেখা দিল। অবস্থা চরমে উঠল, যখন দাদুর গায়ে দেখা দিল শ্বেতী আর আঙ্গুলের ডগা অসাড়। ‘নহবত’ খ্যাত সত্য বন্দ্যোপাধ্যায় দাদু, আর আমি নাতি। প্রায় প্রতি কথাতেই অজিতদা আমাকে কিছু না কিছু বলবেন। এরকম নয়, ওরকম কর। এভাবে না বলে ওভাবে বল। এটা কেন করলে, ওটা কর। হয়তো একটু বাড়াবাড়িই হচ্ছিল, বাঁচিয়ে দিলেন সত্যদা।
‘অজিত, প্রতি কথায় তুমি এভাবে আটকালে তো রিহার্সালই শেষ হবে না। আর দিব্যি পড়ছে তো। তুমি এত কথায় কথায় থামিয়ে দিয়ে স্বাভাবিক অভিনয়টা নষ্ট কোর না। ও তো কনফিউজড হয়ে যাবে। ওকে ওর মত পড়তে দাও। বাকিটা আমরা দুজনে বুঝে নেব। নাকি বল, নাতি?’
ঐ যে বলে, যত মানুষ তত অভিজ্ঞতা!
যৎপরোনাস্তি খুঁতখুঁতে ছিলেন প্রযোজক সমরেশ ঘোষও। মুখে হাসি থাকলেও, ভুরু কোঁচকানো আর নাকের দু’পাশে গভীর খাঁজ। তবে আদ্যন্ত স্লিম মানুষটির মুন্সিয়ানাও বড় কম নয়। অদ্ভুত সব নাটক বাছতেন, প্রোডাকশন নিয়ে রীতিমত ভাবতেন, চমকে দেওয়ার মত কাজ করতেন এক একটা। একাধিকবার জাতীয় স্তরে পুরস্কারও পেয়েছেন। নারায়ণ সান্যালের 'তিমি তিমিঙ্গিল' নিয়ে রেডিওতে নাটক করেছেন, ভাবা যায়!
প্রযোজক নির্মল গুহও আরেক জন নিপাট ভালমানুষ। নাটক পাগল মানুষ। কী ভাল যে বাসতেন! কতবার এমন হয়েছে নাটকের স্ক্রিপ্ট নিয়ে সোজা বাড়ি চলে এসেছেন। রিহার্সালে যাবার আগে যাতে আমি ভাল করে দেখে নিতে পারি। অসম্ভব বিশ্বাস আর ভরসা করতেন আমাকে।
‘এই রোলটা তোমার। ব্যস, তুমি আছ আর আমার কোনও চিন্তা নেই।’
নাটক বিভাগের ঘরে ঢুকে কতবার যে শুনেছি,
‘এই তো সতীনাথ এসে গেছে। নির্মলদার নাটকে তো হিরো মানেই সতীনাথ।’
ঠিক বিদ্রূপ নয়, টুকরো হাসির খোরাক। নির্মলদা তাও বলতে ছাড়েননি,
‘আশ্চর্য! ও ভাল করে। নাটকটা যাতে ভাল হয় তাই ওকে নেওয়া। এতে দোষের কী আছে।’
মনে আছে, রবিঠাকুরের ‘চোখের বালি’ করবেন নির্মলদা। স্ক্রিপ্ট নিয়ে হাজির বাড়িতে।
‘সতীনাথ, তুমি মহেন্দ্র। গৌতম চক্রবর্তীকে বিহারী করতে বলেছি। আমাকে সবাই খুব সমালোচনা করছে। বলছে, মহেন্দ্র-র চরিত্রে আপনি গৌতমকে নিলেন না! কিন্তু আমি জানি তুমি মহেন্দ্র দারুণ করবে। তোমার কন্ঠের ওজন, ব্যক্তিত্ব মহেন্দ্র-র সঙ্গে দারুণ মানাবে। আমি যে ঠিক, এটা প্রমাণ করার দায়িত্ব তোমার।’
চোখের বালি নাটকে বিনোদিনী করেছিলেন কাজল চৌধুরী। সত্যি দারুণ হয়েছিল। যেহেতু গৌতমদা আমার সিনিয়র, সেও এটা ভালভাবে নিতে পারেনি। তবে অভিনয় করার সময় এসব উষ্মার লেশমাত্র ছিল না। চোখের বালির কোয়ালিটি নিয়েও কেউ কোন কথা বলতে পারেনি। প্রশংসাই করেছিল সবাই। আজ কোথায় গৌতমদা, নির্মলদাই বা কোথায়, কাজলদিও চলে গেলেন এই তো ক'মাস আগে।
অমর গঙ্গোপাধ্যায়কেই বা ভুলি কী করে! বহুরূপীর অন্যতম স্থপতি। কি অসামান্য সব চরিত্র করেছেন মঞ্চে। রক্তকরবীর সর্দার তো কিংবদন্তী। শম্ভু মিত্র-বিহীন বহুরূপীতে তাঁর আর এক অবিস্মরণীয় অভিনয় 'গালিলিও।' কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গীত নাটক বিভাগের কোন একটা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন। থাকতেন নিজাম প্যালেসের একটা কোয়ার্টারে। অবসরের পর চলে গেলেন টালিগঞ্জের কবরখানার পাশে। মাঝে মাঝে ডেকে পাঠাতেন। আলোচনা করতেন অভিনয় নিয়ে। উনিই আমায় প্রথম বলেছিলেন,
‘তোমার গলা বেশ সুন্দর কিন্তু ঐ বাস ভয়েসের মোহে আটকে পড়ো না বাবা, তাহলে তোমার রেঞ্জ হবে এইটুকু। ওপরে নিচে গলা যত পার উঠিয়ে নামিয়ে রেঞ্জটা বাড়াও, নইলে অভিনয়টা খোলতাই হবে কী করে!'
প্রোডিউসার এমিরেটাস হিসেবে তাঁর প্রযোজনায় একটা অসামান্য নাটকে অভিনয় করার সৌভাগ্য হয়েছিল রেডিওতে, বুদ্ধদেব বসুর ‘সত্যসন্ধ।’ নায়ক জয়ানন্দ-র চরিত্রে অভিনয় করে যে কি আনন্দ পেয়েছিলাম! খুব সন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন অমরদাও। এ নাটকটি আদ্যন্ত সেরিব্রাল। রেডিওর জন্যে অতি উৎকৃষ্ট। বুদ্ধদেব বসু কবি, সাহিত্যিক, নাট্যকারও। আমাদের আইনী ব্যবস্থা যে কোন পর্যায়ের প্রহসন, সেটার চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছেন। মুহূর্তের উত্তেজনায় সুন্দরী স্ত্রীকে খুন করে অনুতপ্ত জয়ানন্দ থানায় এসে আত্মসমর্পণ করে বলে আমি খুন করেছি। থানার ইন্সপেক্টর এই স্বীকারোক্তি হেসে উড়িয়ে দেয়। জয়ানন্দর পক্ষে একজন উকিলও দাঁড়িয়ে যায়। আইনী কূটকচালিতে প্রমাণ হয়ে যায় জয়ানন্দ নির্দোষ। তার প্রতি সহমর্মিতায় উচ্ছ্বসিত সমাজের সর্বস্তরের মানুষ। জয়ানন্দ বিভ্রান্ত! তাহলে কোনটা সত্যি? সে নিজে যা জানে, না কি আইন যেটা জানালো! সত্যের অনুসন্ধানী জয়ানন্দ চরম সিদ্ধান্ত নেয়। যেমন নাটকীয় ঘটনার ঘনঘটা, তেমনি অভিনয়ের স্কোপ। উকিলের চরিত্রে শুভাশিস মুখোপাধ্যায়ও দারুণ অভিনয় করেছিল। লিভিং সাউন্ডের সঙ্গেও ওতপ্রোত জড়িয়েছিল শুভাশিস। ওর মত বলিষ্ঠ অভিনেতাকে বাংলা ছবি শুধু ভাঁড়ামির রোল ছাড়া সেভাবে কাজে লাগালো না- এটা দুর্ভাগ্যজনক। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, অমরদা, শুভাশিস আর আমি- ত্রয়ী সম্মিলনে সত্যসন্ধ একটা ধুন্ধুমার প্রোডাকশন হয়েছিল।
শোভনলাল নামটা শুনলেই আমার রবিঠাকুরের শেষের কবিতার কথা মনে পড়ে। আর একজন মাত্র শোভনলালকেই এ জীবনে দেখেছি। রেডিওর অভিনেতা এবং নাট্য প্রযোজক শোভনলাল মুখোপাধ্যায়। কি চমত্কার গলা! কি দারুণ অভিনয়! প্রযোজনাও করেছেন বেশ কিছু নাটক। মূলত অভিনেতা, তাই আর্টিস্টদের অনুভূতিগুলো খুব ভাল বুঝতেন শোভনদা। বেশ কিছু বছর আগে, তখন অনেক ছোট। দার্জিলিং-এ একটা অ্যাক্সিডেন্টের পরের ঘটনা নিয়ে শোভনদা একটা নাটক প্রোডিউস করে ছিলেন, ‘রক্তিম বসন্ত।‘ নায়িকা কে করেছিলেন মনে নেই, দারুণ। আর নায়কের রোলে পাগল করে দিয়েছিল সন্তুদা, সন্তু মুখোপাধ্যায়। বিমল করের ‘অসময়’ নাটকেও অবিন এর চরিত্রে সন্তুদা রেডিওতে দুর্দান্ত অভিনয় করেছিল। আর নায়িকার চরিত্রের মমতাদি, মমতা চট্টোপাধ্যায়।
মমতাদিও এক অসামান্য অভিনেত্রী। কি মঞ্চে, কি রেডিওতে- দুরন্ত। মমতাদি আবার মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের আত্মীয়। সেই মোহিত চট্টোপাধ্যায়, ‘চন্দ্রলোকে অগ্নিকাণ্ড’ লিখে যিনি বাংলা থিয়েটারের মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন। শ্যামল ঘোষের পরিচালনায় এ নাটক নক্ষত্র প্রযোজনা । মোহিতদা বাংলার নক্ষত্র নাট্যকার কোন সন্দেহ নেই। মোহিতদার একটা নাটক নির্মল গুহ-র প্রযোজনায় অভিনয় করেছিলাম। রেকর্ডিং-এর সময় স্বয়ং মোহিতদা উপস্থিত। আমি রোমাঞ্চিত! রেকর্ডিং-এর শেষে মোহিতদার অকুন্ঠ প্রশংসা আজও কানে বাজে।
নক্ষত্র একসময়ের সাড়া জাগানো নাট্যদল আর তার কর্ণধার শ্যামল ঘোষ। শ্যামলদার সঙ্গেও বেশ কয়েকটা নাটক করার সৌভাগ্য হয়েছে রেডিওতে। সুন্দর কন্ঠশৈলী শ্যামলদারও। তীক্ষ্ণ নাসা, টানা টানা চোখ। 'স্ত্রীর পত্র' সিনেমায় পূর্ণেন্দু পত্রী দারুণ কাজে লাগিয়েছিলেন শ্যামলদাকে। স্বভাববিনয়ী শ্যামলদা অত্যন্ত সুরসিক মানুষ। শ্যামলদা রেডিওতে নাটক প্রযোজনাও করেছেন বিশেষ আমন্ত্রণে।
মমতাদিও একসময় নক্ষত্র-র অন্যতম আকর্ষণ ছিল। মমতাদির প্রসঙ্গে একটা কথা না বললেই নয়। বাংলা রঙ্গমঞ্চে সুনাম-দুর্নামে রাসবিহারী সরকার সুপরিচিত। আজ আর কে না জানে, তখন সেই সময়ে তাঁর থিয়েটারে কাজ করা অভিনেত্রীদের অনেককেই একটা বাড়তি দায়িত্ব নিতে হত তাঁর ব্যক্তিগত মনোরঞ্জনের। একই প্রস্তাব এসেছিল মমতাদির কাছে। বিনিময়ে রাসবিহারী উপহার পেয়েছিলেন পায়ের জুতোর ঠাস্ ঠাস্। মমতাদির ব্যক্তিত্ব- কি মানুষ, কি অভিনেত্রী হিসেবে অনন্য। বিবিধ ভারতীর নাটকের সূত্রে মমতাদিকে দেখেছি খুব কাছ থেকে। অভিনয়ের পাশাপাশি শেষের দিকে অনেক নাটকও লিখত মমতাদি। কত নাটকে যে অভিনয় করেছি! ভীষণ স্নেহশীল মমতাদি দরকার মত সুন্দর করে শিখিয়েও দিত। কত দিনের অভিজ্ঞতা তার। একবার মমতাদিরই লেখা একটা নাটকে লম্পট স্বামীর অভিনয় করছিলাম, স্ত্রী মমতাদি। চূড়ান্ত দুর্ব্যবহার করত স্বামীটি, এমনকি এক জায়গায় মদ খেতে খেতে স্ত্রীর কথায় রেগে গিয়ে তাকে মদের গেলাস ছুঁড়ে মারে- এমন একটা দৃশ্যও ছিল। সবটাই কথায়- মানে মাতলামি আর দুর্ব্যবহার। গেলাস ছোঁড়া, ভাঙ্গা- এসব শব্দ তো পরে জোড়া হবে। পার্ট করতে করতে বেশ মুড এসে গেছে, দেখি উল্টো দিকের সোফায় বসে মুক্তিদি মাঝে মাঝে ভুরু কুঁচকে আমার দিকে দেখছে আর পরক্ষণেই খবরের কাগজের আড়ালে মুখ লুকোচ্ছে। এমন করছে কেন রে বাবা! অদ্ভুত কারবার। কারবার যে কত অদ্ভুত, টের পেলাম নাটকের রেকর্ডিং শেষ হবার পর। তীরবেগে ছুটে এসে মুক্তিদি আমার চুলের মুঠি ধরে কি মার, কি মার! বলে কি,
‘হারামজাদা, তুই এটা করতে পারলি! ঐ লম্পট লোকগুলো এরকম জঘন্য কুৎসিত খারাপ ব্যবহার করে, তুই জানলি কী করে! বলতে পারলি কী করে! একবার মনে হল না তোর পাশে দাঁড়িয়ে মমতাদি। কথাগুলো তুই কাকে বলছিস!’
মমতাদিই ধমকে থামাল মুক্তিদিকে।
‘কী যা তা বলছিস। কেমন চমৎকার অভিনয় করল সেটা বল, তা না মারছিস ধরে। আয় বাবা সতী, তোকে আমি একটু আদর করে দিই।’
রঙ্গনা থিয়েটারের যারা মালিক, সেই পরিবারের বড় বউ মুক্তিদি। অসম্ভব ইমোশনাল, মাত্রা ছাড়া। লিভিং সাউন্ডে অভিনয় করত মাঝে মাঝে। আমাকে ভীষণ ভালবাসে আজও। আমার মুখে ঐ কদর্য ভাষা আর দুর্ব্যবহার মেনে নিতে পারেনি। তাই আবেগের এত আতিশয্য। মুক্তিদির এক ভাইপো ছিল বড় স্নেহের, অকালপ্রয়াত। তার সঙ্গে নাকি আমার মুখের ভীষণ মিল। আমার প্রতি অপত্যস্নেহ তাই এতটাই বেশি। সেদিন রেকর্ডিং-এর পর ঐ ধুন্ধুমার। শ্রাবন্তীদি বেরিয়ে শুধু বলল,
‘এ কি সাত পাগলের মেলা!’
শোভনলালদার কথা বলতে বলতে সন্তুদা, মমতাদি, মোহিতদা, শ্যামলদা, মুক্তিদি- সব কেমন এসে গেল পর পর। মুক্তিদির এই অপত্য স্নেহ থেকেই আবার ফিরে আসি শোভনলালদা এবং অবশ্যই রবি ঠাকুরে। মঞ্চে শোভনলালদা কাবুলিওয়ালা শ্রুতিনাটক করত। আমার দেখা হয়নি, কিন্তু শুনেছি তা অসাধারণ। আর কাবুলিওয়ালা মানেই তো অপত্য স্নেহের এক অনির্বচনীয় মাধুর্য।
সময় বড় নির্মম। শোভনলালদা, মমতাদি, মোহিতদা, শ্যামলদা- চাইলে আর কাউকে কাছে পাব না। ফোনে এখনও মুক্তিদি তেমনই স্নেহপ্রবণ।
নাট্য প্রযোজক হিসেবে কতজনের সঙ্গে যে কাজ করেছি! গ্রামের মানুষ নিত্যানন্দ গঙ্গোপাধ্যায় রেডিওর কর্মী এবং নাট্য প্রযোজকও। বহুদিন কলকাতা শহরে এসে কাজ করলেও গ্রামের সারল্য ছিল নিত্যানন্দদার অহংকার, অলংকারও। রামজীবন মিত্র, রুবি বাগচি, ইভা মিত্র, ক্ষৌণীশ বাগচি, অজিত বসু, বিশ্বনাথ দাস, কৌশিক সেন, সুভাষ দাশ, হেনা খান্না, আইভি রাহা- এঁরা কেউ ঘোষক ঘোষিকা, কেউ বা বিভাগীয় কর্মী, মাঝে মাঝে নাটক প্রযোজনাও করেছেন। কেউ কেউ সরাসরি প্রযোজক। পরবর্তীকালে আশিস গিরি, সিদ্ধার্থ সিংহ, সুব্রত মজুমদার, দীপক পোদ্দার- আরওঅনেক প্রযোজকের নাটকে অভিনয় করেছি। কি জানি, তবু হয়তো বাদ পড়ে গেল কারো কারো নাম।
ঢেউয়ের মত মনের তটভূমিতে ধেয়ে আসছে অসংখ্য অভিনেতার অবিরত চেনামুখ। কিছু বা অল্প চেনা। এই রেডিওর সূত্রেই যাদের সঙ্গে পরিচয়। কারো কারো সঙ্গে অভিনয়ের অন্য অঙ্গনেও। স্বপন সাঁইয়ের কথা মনে পড়ে। বর্ধমানের সেই সাঁই বাড়ি, পশ্চিমবাংলার রাজনীতিতে যা ছড়িয়েছিল বাড়তি রক্তিম আভাস। অন্য কিছু নয়, তবে বর্ধমানের দিকে শো বা অনুষ্ঠানে যাবার পথে শক্তিগড়ে ওর ল্যাংচার দোকানে না দাঁড়ালে ভারি কষ্ট পেত। খুব খাওয়াত স্পেশাল ল্যাংচা। প্রায় আদেশের মত বলত,
‘ফেরার সময়েও দাঁড়াবে কিন্তু। বাড়ি নিয়ে যাবে বেশি করে।’
এমনও হয়েছে হয়তো- যাবার খুব তাড়া, শক্তিগড় আসছে দেখেই গাড়ির মধ্যে তোয়ালে দিয়ে মুখ ঢাকতাম। যদি রানিং গাড়িতে স্বপন দেখে ফেলে আর হাত তুলে ডাকে, তখন না দাঁড়িয়ে উপায়!
আরে দূর, অত স্পীডে হাই ওয়েতে দেখা যায় নাকি! আর স্বপনও কি কখন আমরা যাব, আর ক্যাঁক্ করে ধরবে বলে ওৎ পেতে বসে আছে! তবু গাড়ি করে যেতে যেতে সব শিল্পীরা মিলে শক্তিগড় আর স্বপনকে নিয়ে ঐ নিছক মজাটুকু যে উপভোগ করতাম, তাও তো রেডিওর সূত্রেই পাওয়া।
তরুণ মিত্র আর এক বলিষ্ঠ অভিনেতা। থিয়েটার, সিনেমা সবই করতেন। উত্পল দত্ত-রও খুব কাছের মানুষ ছিলেন। তাঁর একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করতাম। রেডিওতে যেদিন রিহার্সাল হত বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রধান চরিত্রের অভিনেতারা স্ক্রিপ্ট সঙ্গে নিয়ে যেতেন। তরুণ মিত্রও তাই করতেন। কিন্তু রেকর্ডিং এর দিন এসে স্ক্রিপ্টটা ফেরত দিয়ে দিতেন। ব্যাগের ভেতর থেকে বার করতেন আরও কিছু পাতা। যেখানে নিজের হাতে লেখা আছে তাঁর সংলাপ আর সহ অভিনেতাদের সংলাপ লেখা অন্য রঙের কালিতে। কিউ হিসেবে।
‘এরকম কেন করেন দাদা?’
‘এ আমার বরাবরের অভ্যেস। আজ পর্যন্ত রেডিওতে যত নাটক করেছি, সমস্ত নাটকে আমার যত সংলাপ- সব এইভাবে আমার হাতে লেখা। ফাইল করে রাখা আছে। হয়তো কোন মানে নেই, তবু এ আমার ইচ্ছে, অভ্যেস।’ কি অদ্ভুত না!
রেডিওতে রোম্যান্টিক রোলে অভিনয় একটা বিশেষ ধরণের কোয়ালিটি। কেউ কেউ তাতে অসাধারণ। যেমন জগন্নাথ বসু, ঐ রোলেই তাঁর দুরন্ত পপুলারিটি। কখনো অন্যরকম চরিত্র যে করেননি তা নয়, তবে সেসব রোম্যান্টিক রোলের ধারে পাশে আসে না। বহুকাল আগে শোনা বিমল কর-এর ‘একা একা’ উপন্যাসের বেতার নাট্যরূপে পাগল হয়ে গিয়েছিলাম জগন্নাথদার অভিনয়ে। কাহিনীও দারুণ। বয়স্ক দুই চরিত্রে মঞ্জু দে আর বসন্ত চৌধুরী। নায়ক তনুশ্যাম চরিত্রে জগন্নাথদা। জাস্ট ফাটাফাটি! জগন্নাথদাকে নিয়ে আরো অনেক কথা বলা যায়। এত কথা যে তাঁকে নিয়ে শুধু একটা চ্যাপ্টার নয়, একটা গোটা বই-ই হয়ে যেতে পারে। জগন্নাথদাই আমাকে পাঠিয়েছিলেন রেডিওর আর এক কিংবদন্তী, জয়ন্ত চৌধুরীর কাছে। মাত্র তিনদিনেই জয়ন্তদা আমার মাথার মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন রেডিও নাটকের সূক্ষ্মতম খুঁটিনাটি। শুধু অভিনেতা নয়, প্রযোজক হিসেবেও জগন্নাথ বসু সর্বজন-সমাদৃত।
রোম্যান্টিক অভিনয়ে আর একজনের কথা কোনোদিন ভুলব না- কণিকা মজুমদার। রেডিও-য় রোমান্সের শেষ কথা। কণ্ঠের সেক্স অ্যাপিল, ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের শ্বাস-প্রশ্বাস আর গভীর আশ্লেষের সংলাপ উচ্চারণ শুনে বেশ অস্বস্তি বোধ করতাম। এত জীবন্তও হতে পারে! আমি যখন একটা নাটকে কণিকাদির সহ অভিনেতা হবার সুযোগ পেলাম, তখন তাঁর মাথার বারো আনা চুল সাদা। তাঁর অভিনয়ে আমার আপ্লুত হবার অনুভূতি না জানিয়ে পারিনি। শুনে খুব খুশি হয়েছিলেন। বলেছিলেন,
‘যে দৃশ্যে অভিনয় করছি, মনে মনে আমি সেটাকে খুব সুন্দর করে আঁকার চেষ্টা করি। আর তারপর তাতে গলার রঙ বুলিয়ে দিই। তোমারও তো বেশ রোম্যান্টিক গলা। ছবিটা সুন্দর করে আঁক, তারপর দেখই না তোমার গলা কী কথা বলে। তুমিও পারবে, নিশ্চয়ই পারবে।’
এমন ছোট ছোট কথা থেকেই টুকরো টুকরো করে আমার শেখা। বললেন,
‘আর একটা কথা মনে রেখো, রোম্যান্সের অভিনয়ে কখনো কটকটে স্পষ্ট উচ্চারণ করবে না। ঐ যে রবীন্দ্রনাথের গান আছে, ‘হৃদয়ে হৃদয়ে আধো পরিচয়/ আধখানি কথা সাঙ্গ নাহি হয়...’ অস্ফুটে উচ্চারণ যদি মোক্ষম করতে পার, তাহলে তোমায় ঠেকায় কে!’
তখন তাঁর অনেক বয়স, তবু কি অসামান্য ব্যক্তিত্ব আর অনায়াস অভিনয়! মণিহারা, চিড়িয়াখানা, দুটি মন- এসবও ভুলে যাব, ভুলতে পারব না রেডিওর কণিকা মজুমদারকে।
বিবিধ ভারতীর নাটকে অভিনয়ের সূত্রে আর এক সম্রাটকে খুব কাছ থেকে পেয়েছিলাম। ‘ডঃ জেকিল এন্ড মিঃ হাইড’ নাটক হবে ধারাবাহিক। আমি ডঃ জেকিল আর গৌতম চক্রবর্তী মিঃ হাইড। এ নির্বাচন শ্রাবন্তীদির। আর ডঃ জেকিলের ঘনিষ্ঠ বন্ধু আর এক ডাক্তারের ভূমিকায় কে! না অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়। আমায় তখন পায় কে! ক'বছর আগে ম্যাক্সমুলার ভবনের প্রযোজনায় ‘আন্তিগোনে’ নাটকে আমি ক্রেয়োন। হঠাৎ একদিন ঠিক শো এর মুখে ফিল্ম সোসাইটির সূত্রে সুপরিচিত আমাদের পাড়ার দিলীপদা কানে কানে এসে বলল,
‘দেবু আজ ফাটিয়ে দে। অজিতেশদা দেখতে এসেছেন, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়।’
আমার বুকের মধ্যে যেন বোমা ফাটল! তখন কলকাতার নানা মঞ্চে রমরম করে চলছে নান্দীকার এর আন্তিগোনে। ক্রেয়োন অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি এসেছেন! সে একটা সন্ধ্যা বটে! অভিনয়ের শেষে দুধ সাদা পাজামা পাঞ্জাবী পরা দীর্ঘদেহী মানুষটি এলেন, মুখে অদ্ভুত একটা হাসি। তখনো কস্টিউম পরে আমি। জল-কাদা-রক্ত মাখা, যুদ্ধ শেষের বিধ্বস্ত আমি। কাঁধে হাত রেখে বললেন,
‘আমার খুব ইচ্ছে করছে একবার দু'হাতে বুকে জড়িয়ে ধরি। কিন্তু ভাই, তারপর কলকাতার রাস্তা দিয়ে বাড়ি ফেরা মুশকিল হয়ে যাবে। দারুণ, দুর্দান্ত।’
আমার অভিনয় জীবনের সেরা পুরস্কার সেদিনই পেয়ে গিয়েছিলাম। সেই অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে পাশাপাশি একসঙ্গে অভিনয়। সেও তো রেডিওর সূত্রেই। রেডিওর কত নাটকে যে অভিনয় করেছেন অজিতেশদা! অনেক রাতে একটা নাটক হত- ‘নেফা সুন্দরী নেফা।’ ঘরের আলো নেভানো, শুয়ে শুয়ে শুনছি নাটক- অজিতেশদার বুক কাঁপানো হাসি রাতে ঘুম কেড়ে নিত!
বাংলা অভিনয় জগতের এমন অনেকেই আছেন যাঁরা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। ভাবতে ভাল লাগে এরকম কয়েকজনের সঙ্গে রেডিওর সূত্রেই দেখার, কথা বলার, একসঙ্গে কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। চলচ্চিত্রের অঙ্গনে হিরো তো হিরো, আবার দুর্ধর্ষ চরিত্রাভিনেতা হিসেবে চিরদিনের উজ্জ্বল নাম বিকাশ রায়। আমি নিশ্চিত, আমার এ অভিমতের সঙ্গে সহমত হবেন সকলে। ছবি বিশ্বাস, পাহাড়ি সান্যাল- এঁদের দুজনকে মাথায় রেখেও অভিনয়ের বৈচিত্র্যে বিকাশ রায় অতুলনীয়। দু’একটা সিনেমার নাম বলি- ছেলে কার, ৪২, আরোগ্য নিকেতন, শ্রীকান্ত, ইন্দ্রনাথ ও অন্নদা দিদি, ছদ্মবেশী- একবার চকিতে ফ্ল্যাশব্যাকে শুধু এই পাঁচটা ছবির কথাই ভাবলেও একজন অভিনেতার অভিনয় দক্ষতায় ও বৈচিত্র্যে মুগ্ধ না হয়ে পারবে কেউ! রেডিওর সঙ্গে কর্মসূত্রে যুক্ত ছিলেন তিনি কেরিয়ারের শুরুর দিকে। তাঁর অদ্ভুত ব্যতিক্রমী কণ্ঠ আর সেই কণ্ঠের সংযত, সুসংহত ব্যবহারে মুগ্ধ হতাম আমি।
শুনে শুনে শেখার একটা বড় পাঠ আমি পেয়েছি বিকাশ রায়ের কাছে, তাঁর এবং আরো অনেকের অগোচরে। বিবিধ ভারতীতে ‘সিংহ মার্কা নারকোল তেল’-এর অনুষ্ঠানে দীর্ঘদিন ধরে ধারাবাহিক নাটক হয়েছিল শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবী।’ সব্যসাচী আর কেই বা হতে পারেন বিকাশ রায় ছাড়া! রবিবারের দুপুরে সে অভিনয় প্রতি সপ্তাহে গিলতাম, মুগ্ধ হতাম, রোমাঞ্চিত হতাম, শিখতাম। তখনও অবশ্য আমি লিভিং সাউন্ডের স্টুডিওর দরজা পেরিয়ে ঢুকতে পারিনি। সে আমার কল্পনার, স্বপ্নের জাল বোনার দিন। পারব কি কোনদিন এই অঙ্গনে এমন ভাবে কিছু কাজ করতে!
পরবর্তীকালে যখন লিভিং সাউন্ডের সূত্রে আমার একটা আলাদা পরিচিতি তৈরি হচ্ছে রেডিও নাটকের হাত ধরে, সেই সময়কার একদিনের রেকর্ডিং এর একটা মুহূর্ত আজো আমার স্মৃতিতে উজ্জ্বল। একটা বিদেশী কাহিনীর ধারাবাহিক। রেকর্ডিং চলছে। দেয়ালের ধার ঘেঁষে একটা সোফায় বসে বিকাশ রায়। শরীরের কারণে সে বয়সে তিনি বসেই অভিনয় করতেন। সেই দৃশ্যে অনেকটা জায়গা জুড়ে ওঁর অভিনয়, অন্যরাও অভিনয় করছেন। ঐ মুহূর্তে আমি দর্শক। একবার এদিকে তাকাচ্ছি, একবার ওদিকে তাকাচ্ছি, রোমাঞ্চিত হচ্ছি, শিহরিত হচ্ছি আর শিখছি একটু একটু করে। ঐ দৃশ্যের অভিনয় শেষ হল। হঠাৎই কনসোল থেকে বেরিয়ে এলেন শ্রাবন্তীদি। সোজা গিয়ে দাঁড়ালেন বিকাশ রায়ের সামনে।
‘এই যে বাবু..’
বিকাশদা মুখ তুলে চাইলেন।
‘তোমার নাম তো বিকাশ রায়…’
বিকাশদার মুখে হালকা হাসি, চোখে মৃদু বিস্ময়।
‘তুমি তো বিখ্যাত অভিনেতা, বিশাল নামডাক তোমার।’
‘আরে দূর পোড়া! কী বলছিস বল না!’
‘না…বলছি এই যে এত বড় সিনটা হল, তুমি অ্যাক্টিং করলে...যদি বল, যা করেছি এটাই ঠিক, আমি তাই রেখে দেব। বিকাশ রায় বলে কথা! আর যদি বল...’
কথা শেষ করতে দিলেন না বিকাশ রায় -
‘আচ্ছা আচ্ছা; আচ্ছা বাবু, বুঝতে পেরেছি। আর বকিস না। নে নে, সিনটা শুরু থেকে আর একবার নিয়ে নে। চলো ভাই, আর একবার প্লিজ। মাই ফল্ট।’
একগাল হেসে বিকাশদার মাথার বিলীয়মান কেশরাশি একটু ঘেঁটে দিয়ে শ্রাবন্তীদি চলল কনসোলে। আগের বেশ কয়েকটা পাতা উল্টে সিনের শুরুতে ফিরে গেল সবাই। টিপিক্যাল বিকাশ রায়োচিত আকর্ণবিস্তৃত খ্যাক্ খ্যাক্ হাসি হেসে বিকাশদা চোখ টিপে বললেন…
‘বেটির শোনার কানটা একবার দেখলি!’
কনসোল থেকে শ্রাবন্তীদি বলল, 'রানিং!'
চরিত্রের প্রয়োজনে ক্রূর, উদ্ধত, দাম্ভিক, অহংকারী- কী না হতে হয়, কী না হয়েছেন বিকাশ রায়। কিন্তু শিল্পীর প্রকৃত অলংকার যে বিনয় আর সঠিক আত্মমূল্যায়ন - এটা সেদিন শিখেছিলাম অন্তর দিয়ে।
আভিজাত্য আর বনেদীয়ানা প্রায় সবসময়েই পশমিনা আলোয়ানের মত যাঁকে জড়িয়ে থাকত, তিনি বসন্ত চৌধুরী। যেমন সুদর্শন, তেমনি ব্যক্তিত্ব। সেই কোন ছোটবেলায় কালীপুজোর দু’দিন আগেই বাজি পোড়াতে গিয়ে হাত পুড়িয়ে ফেলেছিলাম। সে বছরের মত বাজি পোড়ানোর ইতি। সান্ত্বনা পুরস্কার হিসেবে পুজোর দিন মা ম্যাটিনী শো-তে একটা সিনেমা দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল। ‘রাজা রামমোহন’- নাম ভূমিকায় বসন্ত চৌধুরী। দারুণ! কি অসাধারণ ব্যক্তিত্ব!
সব মাধ্যমেই অভিনয় করেছেন তিনি স্বমহিমায়। এমনকি রেডিওতেও। ব্যক্তিগত জীবনে অসম্ভব শৌখিন মানুষটির কিউরিও সংগ্রহ প্রায় কিংবদন্তী, বিশেষ করে ‘গণেশ।’
অডিশন দিতে গিয়ে সেই যে হাতে পেয়েছিলাম বিড়াল এর স্ক্রিপ্ট, সেখানেও প্রধান যে চরিত্রটি পরিবারের কর্তা - পুব বাংলার ধনবান, আজ ভাগ্যের পরিহাসে উদ্বাস্তু পরিচয়ে সপরিবারে নাস্তানাবুদ- অভিনয়ে বসন্ত চৌধুরী। যে স্বগতোক্তির অংশ অডিশনের সময় পড়ছিলাম আর আমায় থামিয়ে বলা হল, নিজে কি কিছু এনেছেন- সেই স্বগতোক্তি ঐ চরিত্রেরই, অভিনয়ে বসন্ত চৌধুরী। বলা যায় রেডিও নাটকে আমার হাতেখড়ি পর্বেই পেয়েছিলাম তাঁর পরোক্ষ ছোঁয়া।
দুটো নাটকে সরাসরি তাঁর সঙ্গে অভিনয় করার সুযোগ পেয়েছিলাম, দুটোই খুব গুরুত্বপূর্ণ। রবিঠাকুরের ১২৫ বছরের জন্মজয়ন্তীতে ‘চিরকুমার সভা’ আর বেশ কয়েকবছর পরে বনফুলের ‘নিমগাছ।’ আধপাতার গল্প। আহা, বনফুলের এই ছোট গল্পের কি অসাধারণ নাট্যরূপ করেছিলেন সঠিক মূল্যায়ন আর মর্যাদা-বঞ্চিত নাট্যকার অমল রায়! সুভাষ দাশ চিরকুমার সভা নাটকের প্রযোজক। দোতলায় নাট্যবিভাগের ঘরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আমরা বসে। প্রায় সবারই হাতে স্ক্রিপ্ট। সুভাষদা বললেন, ‘রিহার্সালের জন্যে স্টুডিওতে যাবার আগে সবাই কিন্তু কন্ট্র্যাক্ট ফর্মে সইটা করে দেবেন মনে করে; রেকর্ডিং এর পরে পরেই যাতে সবার হাতে হাতে চেকটা দিয়ে দেওয়া যায়।’ প্রচুর শিল্পী, সকলেই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন সই সাবুদ করতে। বসন্ত চৌধুরী 'অক্ষয়'-এর ভূমিকায়। বজ্রনির্ঘোষে ডাকলেন,
-সুভাষবাবু!
-হ্যাঁ, বলুন দাদা।
-আমি তো যতদূর শুনেছি, এ নাটকটা কবিপক্ষে প্রচার করা হবে স্পেশাল প্রোগ্রাম হিসেবে।
-হ্যাঁ দাদা, ঠিক। স্পেশাল প্রোগ্রাম।
-আমি তো জানি স্পেশাল প্রোগ্রাম মানে আকাশবাণীতে ডবল পেমেন্ট।
-হ্যাঁ! না মানে... সেরকম কিছু তো... আমি দাদা...
-জানেন না। আমি জানি। আমার পূর্ব অভিজ্ঞতাপ্রসূত সামান্য জ্ঞান আছে বলেই আমি জানি। স্পেশাল প্রোগ্রাম মানেই ডবল পেমেন্ট। যার যা পাওয়ার কথা, তার দ্বিগুণ পাবে।
-দাদা, এরকম কোন নির্দেশ কিন্তু...
-আপনি পাননি, এই তো? ওপর মহলে খোঁজ নিন, যোগাযোগ করুন। কন্ট্র্যাক্ট ফর্মে পারিশ্রমিক দ্বিগুণ না ছাপা হলে আমি কিন্তু সই করছি না।
-দাদা...মানে..
-না না, আমি অন্য শিল্পীদের প্রভাবিত করতে চাই না। তাঁরা ইচ্ছে হলে করবেন, সে তাঁদের অভিরুচি। আমি আমার কথাটা বললাম। এই রইল আপনার কন্ট্র্যাক্ট ফর্ম।
ততক্ষণে অনেকে সই করে ফেলেছেন, কেউ কেউ জমাও দিয়েছেন, কারো সই থেমে গেল মাঝপথে। ধুতি পাঞ্জাবী পরা সুভাষদা ছুটলেন। এ ঘর...ও ঘর...সে ঘর...একে ফোন...ওকে ফোন...তাকে ফোন...দিল্লিতে এস.টি.ডি.। সুভাষদার হাসিটি ছিল বড় নির্মল। নাটকের ঘরে থমথমে পরিস্থিতি। এদিকে ওদিকে মৃদু গুঞ্জরন। ঘড়ির কাঁটা টিক্ টিক্ টিক্ করে প্রায় ঘন্টা পার। ফিরে এলেন সুভাষদা, মুখে সেই হাসি।
-বসন্তদা, থ্যাঙ্ক ইউ। হয়েছে, আপনি যা বলেছেন, ঠিক তাই। স্পেশাল প্রোগ্রাম মানে সবার ডবল পেমেন্ট। আমরা এক্ষুণি কন্ট্র্যাক্ট ফর্ম সব পাল্টে দিচ্ছি।
মুহূর্তে সব শিল্পীর মুখে ‘হঠাৎ আলোর ঝলকানি লেগে ঝলমল করে চিত্ত।’ বসন্তদা বললেন,
‘চলুন ভাই, ওরা কাগজপত্র রেডি করুক, আমরা রিহার্সাল দিই, যে জন্যে আসা।’
সবাই সিঁড়ি দিয়ে নেমে চললাম ১০ নম্বর স্টুডিওর উদ্দেশে। বসন্ত চৌধুরীর অভিজ্ঞতাপ্রসূত মাস্টারস্ট্রোকে সেবার লাভবান হয়েছিলাম সবাই।
'রঙ বেরঙ্গের আটটা নটা' নাম দিয়ে আকাশবাণীর এফ. এম.-এ একটা নতুন অনুষ্ঠান শুরু হল। বৃহস্পতিবার সকালের দায়িত্ব পেলাম আমি। কেন্দ্র অধিকর্তা অরুণ বিশ্বাসের ঘরে আলোচনা হল।
-এক ঘন্টার অনুষ্ঠান, অন্তত ১২/১৩ টা গান তো বাজাতেই হবে।
আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম। এটা কি অনুরোধের আসর প্রেজেন্ট করছি নাকি! বললাম,
-তাহলে আমাকে ডাকলেন কেন? এটা তো অন্য যে কেউ করতে পারে।
-বেশ তো, বলুন আপনি কীভাবে ভাবছেন?
-প্রত্যেকদিন একটা কোন থিম থাকবে। সেই থিমের ওপর গল্প বা নাটক, কবিতা, ছড়া...প্রয়োজন মনে করলে ঐ থিমের সঙ্গে মিলিয়ে একটা দুটো গান। একটা নতুনত্ব না এলে আর আমার সিগনেচার রইল কোথায়?
-ঠিক আছে করুন। একটু নতুন রকমই হোক। আপনার প্রেজেন্টেশন তো সবাই ভালবাসে।
প্রথম দিন থেকেই শ্রোতাদের উৎফুল্ল উচ্ছ্বাসে প্রায় ভেসে গেলাম। দারুণ সাড়া ফেলল আমার অনুষ্ঠান, যার নাম দিয়েছিলাম ‘৬০ মিনিট ১ ঘণ্টা।’ শ্রোতাদের চিঠি আর ফোনে টগবগ করছে উত্তেজনা। একেবারে নতুনরকমের কিছু পেয়ে তাঁরাও আনন্দে ডগমগ।
কিছু বকবকম্ তারপরই গান- প্রচলিত এই ফর্ম্যাটের পরিবর্তে যেভাবে ‘৬০ মিনিট ১ ঘণ্টা’ সাজিয়েছিলাম আমার এত দিনের অভিজ্ঞতা থেকে, সেটার সাফল্য নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন শ্রোতারাই।
সপ্তাহ দুয়েক পরে অনুষ্ঠানের সূচনাতেই একটা সিগনেচার টিউন ইন্ট্রোডিউস করলাম। ম্যান্ডোলিন সহযোগে ফোক টিউনে সেটা গেয়ে শোনানোমাত্রই ভাললাগার পারা চড়ল চড়াং করে। কিন্তু প্রশাসনের কয়েকজনের ভুরু কুঁচকে হরাইজন্টাল সেকেন্ড ব্র্যাকেট। গড্ডলিকা প্রবাহে গা না ভাসিয়ে, আর সবাই যেমন করছে ঠিক তেমন কার্বন কপি না করায় ফুলল তাঁদের নাকের পাটা। ব্যাপারটা ঠিক পছন্দ হল না আর কি। নির্দেশ হল পত্রপাঠ সিগনেচার টিউন বন্ধ করার। যেদিন প্রথম বন্ধ করলাম, প্রথম ফোনেই প্রশ্ন,
‘দাদা! আজ সিগনেচার টিউন বাজল না যে বড়!’
কী করি! ম্যানেজ তো করতেই হবে-
‘আসলে একটা টেকনিক্যাল প্রবলেম হয়ে গিয়েছিল- তাই...’
‘নো প্রবলেম দাদা! ওটা আমাদের মনে গেঁথে গেছে। দাঁড়ান, আমি শুনিয়ে দিচ্ছি…’
এই না বলে হৈ হৈ করে শ্রোতাবন্ধুই গেয়ে উঠলেন গানটা। আমার চোখে জল।
বাংলা সাহিত্যের সেরা সম্ভার তুলে ধরতাম ৬০ মিনিট ১ ঘণ্টায়। এমনকি উৎপল দত্ত-র 'সন্ন্যাসীর তরবারি,' বীরু মুখোপাধ্যায়ের 'রাহুমুক্ত' - এমন সব নাটকের নির্বাচিত অংশ, 'শনিবারের চিঠি'-র পাতা থেকে অজস্র সরস রচনা, তারাপদ রায়, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় সেইসঙ্গে চিরায়তর পাশাপাশি হাল আমলের কবিতা, ছড়া- এক কথায় এক ঘণ্টার খুশির রংমশাল।
হলে কি হয়, শ্রোতাদের আনন্দ, ভাললাগা, সাদর বরণ এসব সত্ত্বেও আট মাস চলার পরে আচমকাই বন্ধ করে দেওয়া হল ৬০ মিনিট ১ ঘণ্টা। সেই মুহূর্তে আমার ঝুলিতে শ্রোতাদের আনন্দ- উচ্ছ্বাস- আবেগমাখা প্রায় হাজার দুয়েক চিঠি। যে বৃহস্পতিবার আমার অনুষ্ঠানের বদলে প্রথম অন্য কিছু হল- তার প্রতিবাদে এবং হঠাৎ অনুষ্ঠান বন্ধের কারণ জানতে চেয়ে চিঠির বন্যায় ভেসে গেল শ্রোতাদের চিঠিপত্রের আসর ‘সবিনয় নিবেদন।’ তখন সবিনয় নিবেদন উপস্থাপনা করতেন ছন্দা সেন। দেখা হতেই বললেন, ‘কী যে করেছিস সতীনাথ! স্রোতের মত চিঠি- কেন বন্ধ হল, কে বন্ধ করল! কিন্তু ওপরতলার নির্দেশ- সব উত্তর এড়িয়ে যাও!’
রেডিওর প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা অবশ্য তাতে এতটুকুও কমেনি। এই সিদ্ধান্ত যাঁর মস্তিষ্কপ্রসূতই হোক, শ্রোতাবান্ধব ছিল না মোটেই। এ ছিল প্রশাসনের কলমের দর্প।
দুঃখ পেয়েছি খুব। যতটা না নিজের জন্যে, তার চেয়ে অনেক বেশি শ্রোতাদের জন্যে। তাদের কাছ থেকে তো একরকম কেড়েই নেওয়া হল মনের মত একটা অনুষ্ঠান, দুরন্ত বিনোদনের ৬০ মিনিট ১ ঘণ্টা!
তারপরই ভাবলাম আমার কি সৌভাগ্য! প্রশাসনের সুউচ্চ শিখর থেকে একটা ফোনে তো আমাকে অন্তত জানান হয়েছে অনুষ্ঠান বন্ধের কথা। কিন্তু ইতিহাসের পাতায় জ্বলজ্বল করছে এমন আরো কত অবিচার। দীর্ঘ ৪৭ বছর পর কলমের এক খোঁচায় সংগীত শিক্ষার আসর থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল পঙ্কজকুমার মল্লিককে। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রকে একবার আগে থেকে জানাবার সৌজন্যটুকুও না দেখিয়ে ৪০ বছর পর মহালয়ার এক ভোরে মহিষাসুরমর্দিনীর বদলে সম্প্রচার হয়েছিল নতুন অনুষ্ঠান। কয়েকদশক ধরে, এমনকি আমৃত্যু আকাশবাণীতে ব্রাত্য করে রাখা হয়েছিল উস্তাদ বিলায়েত খানের মত সরস্বতীর বরপুত্রকে। শুধুমাত্র কর্তৃপক্ষের ইচ্ছেয়। সেখানে আমি কে ভাই! আজো যখন অনুষ্ঠান করতে এদিকে ওদিকে এমনকি গ্রামেগঞ্জে যাই, এখনো শুনি, ‘ওঃ! '৬০ মিনিট ১ ঘণ্টা' বন্ধ করে দিল দাদা! ঐ অনুষ্ঠান কোনদিন ভুলব না!’ অনেকের কাছে শুনেছি বৃহস্পতিবারের ঐ এক ঘণ্টার অনুষ্ঠান তাঁরা শুরু থেকে শেষ রেকর্ড করে রেখেছেন, এখনো শোনেন। শ্রোতাদের অন্তরের এই ভালবাসাই তো শিল্পী হিসেবে আমার সেরা পুরস্কার।
শিল্পী হিসেবে নানা মাধ্যমে কাজ করেছি ঠিকই, কিন্তু রেডিওর নাটক আমার কাছে সবচেয়ে আপন কোনও সন্দেহ নেই। রেডিওর নাটক থেকেই অভিনয়ের প্রতি আকর্ষণ, ভালবাসা, অভিনয় করার ইচ্ছে, শুনতে শুনতে ঐ চরিত্রগুলোর সঙ্গে মিশে যাওয়া, আমিও পারব, আমিও করব একদিন- এই প্রত্যয় গড়ে ওঠা। প্রত্যক্ষ পরোক্ষ - দুভাবেই যত্নশীল শিক্ষকের মতই সবার অজান্তে রেডিওর নাটক আমার এতটা আপন হয়ে উঠেছিল। আমিও প্রায় নিজেকে সঁপে দিয়েছিলাম। সবসময়েই চেষ্টা করেছি আপ্রাণ, চরিত্রগুলো অভিনয়ের মধ্যে দিয়ে বিশ্বস্ত করে তুলতে।
হঠাৎই একটা যোগাযোগ ঘটে গেল। ২০১১-র শেষ থেকে এফ. এম. রেডিওতে রহস্য রোমাঞ্চ গল্প পড়লাম টানা প্রায় দু’বছর। ‘আসছে সে আসছে’ ভীষণ জনপ্রিয় হল। প্রায় শ’দেড়েক গল্প পড়লাম, কখনো একা, কখনো অনেককে নিয়ে। এবার আর শুধু অভিনয় নয়, গল্প বাছাই থেকে শুরু করে স্টুডিওর ব্যবস্থা করা, অন্য অভিনেতাদের নির্বাচন, রিহার্সাল, রেকর্ডিং এডিটিং, মিক্সিং- ধরে ধরে প্রত্যেকটা পর্যায়ের মধ্যে দিয়ে গিয়ে অবশেষে এফ. এম. রেডিও স্টেশন পৌঁছে দেওয়া- সমস্ত কাজটাই করতে পেরেছি পরম আনন্দে, উপভোগ করেছি প্রতিটি পর্যায়। অনেক বিশিষ্ট অভিনেতা অংশ নিয়েছিলেন আমার এই প্রযোজনায়- বিভাস চক্রবর্তী, বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী, নমিতা চক্রবর্তী, সৌমিত্র বসু, শুভাশিস মুখোপাধ্যায়, কনীনিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, দোলন রায়, দেবদূত ঘোষ, এমনকি গানের জগৎ থেকেও- শুভঙ্কর ভাস্কর আর শ্রীকান্ত আচার্য। আবহ আর সাউন্ড এফেক্ট দিয়ে প্রতিটা পর্বকে সমৃদ্ধ করেছে রাজা সেনগুপ্ত। ‘আসছে সে আসছে’ করে কত মানুষের যে ভালবাসা ও অভিনন্দন পেয়েছি- তার বুঝি কোনও তুলনা হয় না।
'আসছে সে আসছে'-র দুটি নাটকের লিঙ্ক
রক্তমুখী নীলা
ক্যামোফ্লেজিয়া
রেডিওর নাটকের প্রতি আমার যে বিশ্বস্ততা, আনুগত্য, রেডিও-ও যেন দু’হাত ভরিয়ে তা ফিরিয়ে দিয়েছে আমায়। একথার মধ্যে এতটুকুও অতিশয়োক্তি নেই, রেডিও, রেডিও, রেডিওই আমার প্রথম প্রেরণা।
লেখক পরিচিতি - ছোটবেলা থেকে ইচ্ছে ছিল ছবি আঁকাকেই জীবিকা করার। ঘটনাচক্রে তা হয়ে ওঠেনি। রংতুলির প্রতি সেই ভালবাসা ফিরে এল একটু অন্যভাবে। ক্যানভাসে রং বোলানোর বদলে অভিনয়ের মাধ্যমে নানা রঙ্গের চরিত্র রূপায়ন। নেশা থেকে কখন সেটাই হয়ে গেল পেশা।
ঈশ্বরপ্রদত্ত কন্ঠের সুচারু ব্যবহার সকলকেই মুগ্ধ করে। দূরদর্শনে সংবাদপাঠ, মঞ্চে আবৃত্তি, অনুষ্ঠান সঞ্চালনা এবং অভিনয়ের সব কটি মাধ্যমেই সমান স্বচ্ছন্দ। দেশে-বিদেশে অসংখ্য অনুষ্ঠানে শ্রোতাদের মন জয়। সাহিত্যের প্রতি অপরিসীম অনুরাগ। গল্প পড়া এবং শোনানোর প্রতি গভীর ভালবাসা। আর একটা ভালবাসার জায়গা গান। প্রাণের আনন্দে গেয়ে ওঠেন যখনই সময় পান।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।