প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

কান পেতে রই...

অবসর (বিশেষ) সংখ্যা , ডিসেম্বর ৩০, ২০১৪

 

আকাশবাণীর সঙ্গে

শেখর বসু

 

ছয়-সাতের দশকে আকাশবাণীর ‘শ্রবণী’ অনুষ্ঠানটি খুব জনপ্রিয় ছিল । প্রতিষ্ঠিত, তরুণ কবি ও লেখকরা তাঁদের কবিতা ও গল্প পাঠ করতেন এখানে । অনুষ্ঠান প্রচারিত হত সপ্তাহে একদিন, সম্ভবত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় । অনুষ্ঠান চলার সময় বাড়িতে না থাকলে শোনার প্রশ্ন নেই, কিন্তু থাকলে খেয়াল করে শুনতাম । বেতারে কবি-লেখকদের কণ্ঠ শুনতে বেশ লাগত। তাঁদের গলায় তাঁদের লেখা নিঃসন্দেহে নতুন একটি মাত্রা যোগ করত ।

গল্প পড়ার জন্যে সময় নির্ধারিত ছিল তিন বা চার মিনিট । শেষের দিকে সেটি বেড়ে ছ-সাত মিনিটে পৌঁছেছিল । তখন এ-দেশে টেলিভিশন ছিল অনেক দূরের ব্যাপার। মুদ্রিত পত্রপত্রিকার বাইরের বিশাল জায়গাটি সেই সময় দখল করে রেখেছিল আকাশবাণী । নানা ধরনের জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ছিল বেতারে । রেডিও আমাদের জীবনযাত্রার সঙ্গে কেমন যেন মিশে গিয়েছিল।

‘শ্রবণী’ থেকে স্বরচিত গল্প পড়ার আমন্ত্রণ পাই ছয়ের দশকের শেষে । তখন এই বিভাগটির দায়িত্বে ছিলেন বিশিষ্ট কবি ও লেখিকা কবিতা সিংহ । আকাশবাণীর স্টুডিওতে আমার গল্প রেকর্ড করার অভিজ্ঞতা সেই প্রথম ।

সে দিনটির কথা আমার মনে আছে পরিষ্কার। বেশ বড়সড় ঠান্ডা ঘরের স্টুডিও। চেয়ারের সামনে টেবিলের ওপর ঝুলছে মাইক্রোফোন। আমার দু-পাতার ছোট গল্পটি ছিল পিন দিয়ে গাঁথা । কবিতা সিংহ সেই পিন খুলে কাগজের প্রান্ত একটু মুড়ে দিয়ে বললেন, ‘প্রথম পাতাটি পড়া হয়ে গেলে খুব আস্তে আস্তে পাশে সরিয়ে রেখে পরের  পাতাটি পড়বেন । মাইক্রোফোন খুব সেন্সিটিভ। কাগজের শব্দ যাতে না ওঠে সেই জন্যেই এই ভাবে পড়তে বলা হয়।’ 

সামনে চওড়া একফালি কাচের দেওয়াল । দেওয়ালের ওপাশে রেকর্ডিস্ট বসে । তিনি হাত তুলতেই গল্প পড়া শুরু করেছিলাম । পড়তে গিয়ে একবারও হোঁচট খাইনি। একবারের পড়াতেই রেকর্ডিং শেষ। কবিতা সিংহ খুশি হয়ে ওঁর এক সহকর্মীকে বলেছিলেন, ‘জানো তো এটাই শেখরের প্রথম রেকর্ডিং !’

এর পর আরও বেশ কয়েকবার গল্প পাঠ করেছি, কিন্তু আমার পাঠ আর কখনোই বোধ হয় হোঁচটহীন হয়নি। মাঝেমধ্যে শব্দ একটু জড়িয়ে গেলে মাইক্রোফোনে রেকর্ডিস্টের নির্দেশ আসত—আগের লাইনের অমুক শব্দটি  থেকে আবার পড়ুন--। রেকর্ডিস্টদের নিজস্ব কিছু পরিভাষা ছিল । একটি হল ‘খেয়ে যাওয়া’। পড়তে গিয়ে কোনও শব্দের  উচ্চারণের শেষাংশ একটু বেশি ক্ষীণ হয়ে গেলে বলা হতঃ শব্দটা ‘খেয়ে গেছে’, ওই সেনটেন্সটা আবার গোড়া থেকে পড়ুন ।

কবিতা সিংহের পরে বিভিন্ন সময়ে ‘শ্রবণী’র দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছিলেন আরও কয়েকজন। তাঁদের ডাকেও বেশ কয়েকবার গল্প পড়েছি ওই বিভাগে।

অভিনব সাহিত্যের আড্ডা

আকাশবাণীর সাহিত্যবিভাগের আলোচনাতেও অংশ নিয়েছি একাধিকবার। সাহিত্যবিষয়ক নিবন্ধও পড়েছি। একবার অভিনব একটি ‘সাহিত্যের আড্ডা’র ডাক পেয়েছিলাম। প্রযোজকের পরিকল্পনাটি ছিল একটু অন্য ধরনের। তিনি চেয়েছিলেন—আলোচনার কোনও পূর্বনির্দিষ্ট বিষয় থাকবে না। কথাবার্তা গড়াতে গড়াতে পৌঁছে যাবে কোনও এক জায়গায়। আলোচনায় অংশ নেবেন দুজন অগ্রজ, তিনজন অনুজ কবি ও লেখক। অগ্রজদের মধ্যে ছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায় এবং সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত । অনুজদের মধ্যে আমি বাদে ছিলেন মৃণাল দত্ত এবং অভী সেনগুপ্ত।

নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট সময়ে আকাশবাণীর সেই প্রযোজকের ঘরে ঢুকে দেখি তিনি মুখ কালো করে বসে আছেন । কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকার পরে বললেন, ‘শক্তিদা তো টলমল করতে করতে এসেছেন । কী ভাবে ওঁকে নিয়ে এখন রেকর্ড করাব ! আমাদের এক সহকর্মী ওঁকে বাইরে একটু হাঁটাতে নিয়ে গিয়েছে । হাঁটাচলা করে যদি কিছুটা স্বাভাবিক হন--!’ 

কথাটা শেষ হওয়ার আগেই সেই সহকর্মী ফিরে এসে বললেন, ‘শক্তিদা হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎই একটা ফাঁকা  ট্যাক্সিতে উঠে পড়ে বললেন—রেকর্ডিং আজ হল না তো কী হয়েছে,পরে একদিন হয়ে যাবে ঠিক ।’

বাকি সবাই এসে পড়েছিলেন এক এক করে। প্রযোজক বললেন, ‘স্টুডিও তো বুক করা হয়ে গিয়েছে। চলুন, আপনাদের নিয়েই অনুষ্ঠানটা সেরে ফেলি—।’

তাই হল। শক্তিদাকে নিয়ে বকেয়া ওই অনুষ্ঠানটি করার সুযোগ আর আসেনি, তবে বিভিন্ন সময়ে আকাশবাণীর নানা আলোচনা-সভায় অংশ নিয়েছি । কখনও একা, কখনও দু-একজনের সঙ্গে । এই ধরনের অনুষ্ঠান নিয়ে আকাশবাণী মাঝে মাঝে লাইভ প্রোগ্রামও করত। বইমেলা থেকে আকাশবাণীর প্রতিনিধি কয়েকবার আমার প্রতিক্রিয়া নিয়েছেন যা সঙ্গে সঙ্গে প্রচারিত হয়েছিল। বাড়িতেও মাঝে মাঝে ওঁদের ফোন পেতাম। রবীন্দ্রনাথ বা অন্য কোনও সাহিত্য-ব্যক্তিত্ব কিংবা বিশেষ কোনও অনুষ্ঠান সম্পর্কে মতামত জানতে চাইতেন যা তৎক্ষণাৎ সম্প্রচারিত হত। 

ওই সব অনুষ্ঠান  বেশ কিছুটা গুরুত্ব পেত তখন । অনুষ্ঠানগুলির আলোচনাও ছাপা হত বিভিন্ন সংবাদপত্রে।  একবার এক প্রযোজক আমাকে ফোন করে বলেছিলেনঃ আজকের স্টেটসম্যানটা দেখেছেন? আমাদের অনুষ্ঠানটির বেশ প্রশংসা বেরিয়েছে, আপনার নামও আছে, দেখেছেন?

সেই সময় ওই ইংরেজি দৈনিকটি স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত ছিল।

বেতার জগৎ

 আকাশবাণী থেকে তখন ভারী সুন্দর একটি পত্রিকা বার হত। নাম ছিল ‘বেতার জগৎ’। সারা মাসের  আকাশবাণীর সম্পূর্ণ অনুষ্ঠানসূচি থাকত সেই পত্রিকায় । আর থাকত ‘শ্রবণী’ বা অন্যত্র পঠিত নির্বাচিত গল্প,কবিতা, নিবন্ধ ইত্যাদি। বেতার-সম্প্রচারের উপযোগী করার জন্য প্রতিটি রচনাই ছিল আকারে বেশ ছোট । বেতারের সৌজন্যেই তখন অনুগল্পের বেশ প্রসার হয়েছিল। পরে আকাশবাণীর অমিয় চট্টোপাধ্যায় এই নিয়ে বেশ বড় আকারের কাজ করেছিলেন। অমিয়বাবুর অনুগল্প সংকলনে আমার গল্পও ছিল। 

বিজ্ঞাপনদাতাদের আয়োজিত কিছু-কিছু অনুষ্ঠান ছয়-সাতের দশকে বেশ শ্রোতা-সমাদর পেয়েছিল। তবে বোধহয় জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠে এসেছিল ‘বোরোলিনের সংসার’ নামের অনুষ্ঠানটি। এটি পরিচালনা করতেন শ্রাবন্তী মজুমদার । ‘অ্যান্টিসেপটিক সুরভিত ক্রিম বোরোলিন’ ওই অনুষ্ঠানের সুবাদে ব্যবসা কতটা বাড়াতে পেরেছিল আমার জানা নেই, তবে  অনুষ্ঠানটি শ্রোতাদের মন জয় করে ফেলেছিল পুরো মাত্রায়। আকর্ষণীয় ওই অনুষ্ঠানে  অনেককিছুর সঙ্গে থাকত একটি বেতারনাটিকা । বিভিন্ন ছোটগল্প থেকে থেকে নাট্যরূপ দেওয়া হত। আমার একটি গল্পও বেতার-নাটিকা হিসেবে প্রচারিত হয়েছিল এই অনুষ্ঠান থেকে। কোন্‌ গল্প আজ আর মনে নেই,তবে নাটিকাটির কপালে কিছু প্রশংসা জুটেছিল । সেই সময়ের হিসেবে সম্মানদক্ষিণাও খারাপ ছিল না।

বেতারনাটিকা হিসেবে আমার বেশ কয়েকটি গল্প প্রচারিত হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। বিশিষ্ট নির্দেশক ও নট সৌমিত্র বসু যখন আমার ‘বয়েস যখন একশো কুড়ি’ গল্পটি নিয়ে নাটক করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, আমি বেশ অবাকই হয়েছিলাম।

গল্পটিতে বাস্তবজগতের সঙ্গে অতীন্দ্রিয়লোকের একটি বিচিত্র মিশ্রণ আছে । অতিবৃদ্ধ একটি মানুষের স্মৃতিচারণায় সুদূর অতীতের এমন কিছু ঘটনা উঠে আসত যা আজকের বিচারে উজ্জ্বল ইতিহাসের অংশ। এক যুবক শ্রুতিলিখনের  কাজ নিয়ে সেই স্মৃতিকথা লিখতে এসেছিল । ছেলেটি সেই আত্মকথার সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলে বিচিত্র এক বিভ্রমের শিকার হয় । এই নিয়েই গল্প ।

গল্পটির প্রথম প্রকাশ সাপ্তাহিক ‘দেশ’ পত্রিকায়। পরে এটি আমার ‘শ্রেষ্ঠ গল্প’ ও ‘পঞ্চাশটি গল্প’ সংকলনে স্থান  পেয়েছে । বেতারনাটক হিসেবে গল্পটি কতটা কী দাঁড়াবে--আনুষ্ঠানিক অনুমতি  দেওয়ার সময়েও আমার যথেষ্ট সংশয় ছিল। কিন্তু নাটকটি বোদ্ধাদের সন্তুষ্ট করতে পেরেছিল । প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন স্বয়ং নির্দেশক।

আমার ‘বাড়িওয়ালাসমেত বাড়ি বিক্রি’ গল্পটির কথাও মনে পড়ছে । গল্পটির প্রথম প্রকাশ রবিবাসরীয় আনন্দবাজারে,এটি আমার গল্পসংকলনে আছে । বেতার-নাটিকা হিসেবে গল্পটি প্রচারিত হয়েছিল । কার প্রযোজনা, অভিনয়ে কারা ছিলেন আজ আর মনে নেই; তবে নাট্যরূপ দিয়েছিলেন চকিতা চট্টোপাধ্যায় ।

ধারাবাহিক বেতারনাটিকা

আমার দুটি রহস্য-উপন্যাস ধারাবাহিক বেতারনাটিকা হিসেবে প্রচারিত হয়েছিল আকাশবাণী থেকে। প্রথম উপন্যাসটির নাম ‘অপরাধী চিহ্ন রাখেনি’। এটি রবিবাসরীয় আনন্দবাজারে ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়েছিল । পরে গ্রন্থাকারেও প্রকাশিত হয় ।

উপন্যাসটির নাট্যরূপ  দিয়েছিলেন বাসবী চক্রবর্তী । ১৯৯৭ সালের অক্টোবর-নভেম্বরে পর-পর তিন সপ্তাহ ধরে নাটকটি আকাশবাণী থেকে প্রচারিত হয় । তখন বোধহয় প্রতি মঙ্গলবার ছিল নাটকের দিন । চমৎকার প্রযোজনা । নির্দেশক ও অভিনেতা-অভিনেত্রীরাও ছিলেন খ্যাতনামা । কিন্তু তাঁদের নামের কোনও নোট রাখা হয়নি আমার । মনেও নেই।

দ্বিতীয় উপন্যাসটির নাম ‘ব্যবসার নাম শুভবিবাহ’ । এটিরও ধারাবাহিক প্রকাশ রবিবাসরীয় আনন্দবাজারে । এই উপন্যাসটি লেখার সময় পাঠকদের কাছ থেকে প্রচুর চিঠি পেয়েছিলাম । একটি ছিল এইরকমঃ মাননীয়েষু, আপনার এই সংখ্যার কিস্তিটি যদি গত সংখ্যায় প্রকাশিত হত, তাহলে আমরা হয়তো ভয়ংকর এক পারিবারিক দুর্যোগের হাত থেকে বেঁচে যেতাম ! আসলে কিছু সত্য ঘটনার ওপর নির্ভর করে রহস্য-উপন্যাসটি লেখা হয়েছিল। সম্বন্ধ করে বিয়ের ফাঁদ পেতে নারী-পাচারের চক্রান্ত ছিল ছিল উপন্যাসের বিষয়। এইটুকুই ছিল উপন্যাসের বাস্তবভিত্তি, বাকিটুকু কল্পকথা।

গ্রন্থাকারেও বার হয় উপন্যাসটি । তারপরেই আকাশবাণীর সমরেশ ঘোষ এটিকে বেতারনাটক হিসেবে বেছে নেন। বেতার-নাট্যরূপ সম্ভবত সমরেশবাবুরই ছিল । আগেরবারের মতো এবারও নাটকটি তিন পর্বে ভাগ করে তিন সপ্তাহ ধরে প্রচারিত হয়েছিল । প্রথম পর্বের প্রচার হয়েছিল ২০০১ সালের ৩ জুলাই । অভিনয়ে ছিলেন দেবাশিস বসু, বিজয়লক্ষ্মী বর্মণ,তুলসি রায়,অরুণ মিত্র, মনু চৌধুরী,অসিত বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ ।

রেকর্ডিংয়ের আগে সমরেশবাবু ফোন করে বললেন, ‘চলে আসুন না স্টুডিওতে—দেখে যান আমরা কী ভাবে কাজ করি—।’

গিয়েছিলাম। আমার কাছে নতুন অভিজ্ঞতা । রেকর্ডিং-রুমে ঢুকে আমাকে পাশে বসালেন সমরেশবাবু। মাঝখানে মস্ত বড় কাচের জানলা । ওপাশের ঘরে কুশীলবরা হাতে স্ক্রিপ্ট নিয়ে মাইক্রোফোনের সামনে। দু-একজনকে     আগেই চিনতাম, তবু সমরেশবাবু মাইক্রোফোনের সাহায্যে আমার সঙ্গে সবার পরিচয় করিয়ে দিলেন ।  

শুরু হল ‘ব্যবসার নাম শুভবিবাহ’র দ্বিতীয় পর্বের রেকর্ডিং । কোনও কিছুকে নিখুঁত ভাবে গড়ে তুলতে হলে একটু বুঝি বেশি খুঁতখুঁতে হতে হয় । অভিনয় চলার সময় নির্দেশক প্রায়ই এঁকে-তাঁকে থামিয়ে দিয়ে কী চান বুঝিয়ে বলে কাজ তুলে নিচ্ছিলেন ।

রেকর্ডিং শেষ হতে অনেকটা সময় লেগে গিয়েছিল । তারপর ক্যান্টিনে আমাকে চা খাওয়াতে নিয়ে গিয়েছিলেন সমরেশবাবু । চা খেতে খেতে বুঝেছিলাম এই মানুষটি তাঁর কাজকে খুব ভালোবাসেন । চর্চায় নিখুঁত হওয়াই শুধু নয়, উদ্ভাবনী ক্ষমতার ব্যবহারও করে থাকেন পুরো মাত্রায় । বিভিন্ন  বাদ্যযন্ত্রের সাহায্যে কী ভাবে অবিকল  মাছভাজার  শব্দ সৃষ্টি করেছিলেন—সে গল্পও শোনালেন । আমি চলে আসার সময় হাসতে হাসতে বলেছিলেনঃ ‘জানেন তো, আমার এই কাজ করার ধরন দেখে এখানকার সহকর্মীদের কেউ-কেউ মজা করে আমাকে বেতার-নাটকের সত্যজিৎ রায় বলে থাকেন—।’  

নির্বাচিত গান শোনানো

আকাশবাণী-কর্তারা  তখন মাঝে মাঝে বিভিন্ন ক্ষেত্রের নির্বাচিত কাউকে-কাউকে ডেকে এনে তাঁদের পছন্দসই গান শোনাতেন শ্রোতাদের । দু-ঘণ্টার অনুষ্ঠান হত । আমিও একবার ডাক পেয়েছিলাম। ডাক পেয়ে বিব্রত হয়ে বলেছিলাম—গান শুনতে খুব ভালোবাসি, শুনিও। কিন্তু আমার দৌড় ওই পর্যন্তই। গানের ব্যাকরণ-ট্যাকরন কিছুই জানি না। আমার কথা শুনে প্রযোজক আমাকে আশ্বস্ত করে বলেছিলেন—ব্যাকরণের কোনও প্রশ্নই উঠছে না এখানে। আপনার ভাল লাগাটাই আসল। যে-সব গান বিভিন্ন সময়ে আপনার ভালো লেগেছে। শ্রোতাদের সেগুলিই শোনাবেন। কোনও গানের বিশেষ কোনও অনুষঙ্গ যদি আপনার মনে পড়ে-- তাও শোনাবেন । এটি একটি ইন্টার-  অ্যাকটিভ সেশান। শ্রোতারা প্রশ্ন করবেন,আপনি উত্তর দেবেন। প্রশ্নের সূত্রে আপনার লেখালেখি নিয়েও কথা উঠতে পারে--।

নির্দিষ্ট দিন নির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছে গিয়েছিলাম আকাশবাণী ভবনে। স্টুডিওতে গান বাছাই ও  প্রযুক্তিগত অন্যান্য ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করার জন্যে ছিলেন আকাশবাণীর কৌশিক সেন ।  

আমার প্রথম যৌবনে গানের ভক্তদের দুটো দল ছিল আমাদের পাড়ায় । একটি দল সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের ভক্ত, অন্য দলটি শ্যামল মিত্র বলতে অজ্ঞান। দুটি দলের মধ্যে চাপা একটা লড়াই ছিল । আমি ছিলাম সতীনাথের দলে। ওঁর আধুনিক, রাগপ্রধান সব গানই তখন মুখস্থ ছিল আমার । সতীনাথের সেই সময়ের গানের মধ্যে যে গুলি বিশেষ করে মনে পড়ে সেগুলি হল – জীবনে যদি দীপ জ্বালাতে নাহি পার, কোথা হতে তুমি শ্যাম বা সোনার হাতে সোনার কাঁকন কে কার অলংকার (নীচে ক্লিক করে গানটা শুনতে পারেন)।

শ্যামলের গান যে খারাপ লাগত,তা নয় ; তবে প্রকাশ্যে দলবিরোধী হওয়া যেত না। এই নিয়ে কিছু মজার ঘটনাও ঘটেছিল।

সতীনাথ, উৎপলা সেনের সঙ্গে  তখন কথা বলার কিছু সুযোগ হয়েছিল আমার । হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের সঙ্গেও যৎসামান্য পরিচয় ছিল। অনেক পরে কলকাতা প্রেস ক্লাবে ফিরোজা বেগমের একটি একক- অনুষ্ঠানে ওঁর সামনে বসে অনেকগুলি গান শোনার সুযোগ হয়েছিল আমার। সেদিন ওঁর শেষ গানটি ছিল—‘এমনই বরষা ছিল সেদিন/ শিয়রে প্রদীপ ছিল মলিন/ তব হাতে ছিল অলস বীণ/ মনে কি পড়ে প্রিয়...।’ গানটি আমরা এখন শুনতেও পারি –

গানটি শোনাবার পরে গায়িকা কেমন যেন আবেগতাড়িত হয়ে বলেছিলেন,‘ এই গানের পরে আর কোনও গান গাওয়া যায় না ।’ শুনে মনে হয়েছিল—-খুব প্রিয় কোনও স্মৃতি বুঝি গায়িকার খুব কাছে এসে পড়েছে ওই গানটির  সূত্রে ।

সেদিনের সেই দু-ঘণ্টার অনুষ্ঠানে শ্রোতাদের আমি পছন্দসই গান শোনাবার ফাঁকে ফাঁকে আমার ওই সব অভিজ্ঞতার কথা শুনিয়েছিলাম । হেডফোন এঁটে বিভিন্ন শ্রোতার সঙ্গে একটি প্রশ্নোত্তর-পর্বও চালাতে হয়েছিল কিছুক্ষণ।  

রেডিওর সেই স্বর্ণযুগ শেষ হয়ে গিয়েছে কবে! এখন  আমাদের সামনে বিনোদনের হাজারটা রাস্তা । টিভির একগাদা চ্যানেল,  কম্পিউটার, ভিডিও, মোবাইল ইত্যাদি আমাদের  সময় নিয়ে নিয়েছে অনেকটা । আকাশবাণীর সেই সব রমণীয় অনুষ্ঠান এখন শুধুই দূর অতীতের প্রিয় স্মৃতি। কিন্তু সম্প্রতি এফ,এম-এর হাত ধরে রেডিও আবার বুঝি কিছুটা ফিরে এসেছে।

একটি-দুটি অনুষ্ঠান আজও শুনি । একটি হল ‘স্মৃতিমেদুর’। অনুষ্ঠানটিতে পাঁচ-ছয়-সাত দশকের জনপ্রিয় বাংলা গান শোনানো হয় ।  দারুণ লাগে ওই সব গান শুনতে ! পুরনো দিনের কিছু শ্রোতা গানের অনুষঙ্গে  টেলিফোনের মাধ্যমে অল্পস্বল্প স্মৃতিচারণও করে থাকেন। এঁদের কারও-কারও গলাও চিনে ফেলেছি আমি । এই সব মানুষকে  নিয়ে এবারের শারদীয় ‘আজকাল’ পত্রিকায় ‘শুধুমাত্র প্রবীণদের জন্যে’ নামে একটি গল্পও লিখেছি । গল্পে যা থাকে—-অর্থাৎ  সামান্য সত্যির সঙ্গে বিস্তর মিথ্যের মিশেল—এখানেও তাই। দু-মাস হল পুজো পেরিয়ে গেছে, কিন্তু রেডিওর ওই গানের অনুষ্ঠানটি এখনও নিয়মিত শুনে থাকি। কৈশোর ও প্রথম যৌবনের দিনগুলিতে কয়েক মুহূর্তের জন্যে ফিরে যাওয়ার এমন সহজ সুযোগ  বোধহয় রেডিও ছাড়া আর কোথাও পাওয়া যায় না !                                                                          


লেখক পরিচিতি - শেখর বসু (http://sekharbasu.com/) – প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও ছোটগল্পকার। কর্মজীবনে আনন্দবাজার পত্রিকার গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বহু বছর। এখন পুরো সময়টাই লেখালেখির কাজ করছেন। গত চল্লিশ বছরে উনি বহু গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ ও গোয়েন্দাকাহিনী লিখেছেন। এযুগের যুবক সম্প্রদায়ের অনেকেই বড় হয়েছেন ওঁর লেখা ছোটদের বই পড়ে ।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।