কান পেতে রই...
অবসর (বিশেষ) সংখ্যা , ডিসেম্বর ৩০, ২০১৪
প্রত্যন্তে অত্যন্ত প্রিয়
সৌম্যকান্তি জানা
ইয়ে আকাশবানী হ্যায়। আব হাম আপকো ফিরোজ শাহ কোটলা দিল্লি পর লিয়ে চলতে হ্যায় যাঁহাসে ভারত ঔর পাকিস্তানকে বিচ খেলে জানেবালে পহেলা ক্রিকেট টেস্ট ম্যাচ কা পহেলা দিন কা খেল কা আঁখো দেখা হাল হিন্দি ঔর আংরেজিমে বারি বারি শুনায়েঙ্গে। ইস আঁখো দেখা হাল শুনায়েঙ্গে হিন্দিমে ...........
বছর দশেকের ছেলেটা ওই কথাগুলো আপনমনে বিড়বিড় করতে করতে একা আলপথ ধরে হেঁটে চলেছে। গন্তব্য স্কুল। ডান হাতে একটা অ্যালুমিনিয়ামের বাক্স। তাতে বই-খাতা-পেন। মাথার ওপর হেমন্তের মিঠে-কড়া রোদ্দুর। বাড়ি থেকে বেরিয়ে বড়ো মেটে পথটা ডিঙ্গিয়ে আলে নামতে নামতেই আকাশবাণীতে ভারত-পাকিস্তান প্রথম টেস্ট ম্যাচের ধারাবিবরণীর ঘোষণা শেষ।
নমস্কার। ম্যায় সুশীল দোশি ফিরোজ শাহ কোটলা সে বোল রহা হুঁ। মেরা সাথী কমেন্টেটর হ্যায়...
ছেলেটা আলপথ ছেড়ে নেমে পড়েছে মাঠে। সদ্য ধান কাটা হয়েছে। কোথাও কোথাও মাটি একটু নরম। দেহের ভারে নরম মাটিতে পড়ছে চপ্পলের গভীর ছাপ। কোথাও পা একটু আটকেও যাচ্ছে। তাতে অবশ্য ছেলেটার কোনও হুঁশ নেই। চতুষ্কোন মাঠের কর্ণ বরাবর তিন-চার দিনের বাসি দাড়ির মতো খোঁচা খোঁচা ‘নাড়া’ মাড়িয়ে ছেলেটা হেঁটে চলেছে। মাঠ পেরোলেই বড় রাস্তায় গিয়ে উঠবে। ততক্ষণে টস জিতে ভারত ব্যাটিং-এর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। আর ব্যাট হাতে মাঠে নেমে পড়েছে ভারতের দুই ওপেনিং ব্যাটসম্যান সৌম্যকান্তি জানা আর সমর মাইতি।
প্রিয় পাঠক, ঘাবড়াবেন না। ওই ছেলেটা আমি। আর সমর আমার সহপাঠী। আমার কাল্পনিক ভারতীয় ক্রিকেট দলের উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান। আমি অবধারিতভাবে ক্যাপটেন। আমাদের জোরে বোলার হল আমাদের ক্লাসের সবচেয়ে শক্তিশালী অশোক। ও-ই ভাইস ক্যাপটেন। ভারতের এগারোজন প্লেয়ারকেই হতে হবে আমার সহপাঠী- এতটা পক্ষপাতদুষ্ট আমি ছিলাম না। আমাদের ঠিক উপরের ক্লাসের জহরদাকেও জোরে বোলার হিসেবে নিয়েছিলাম। আর আমার স্কুলের বাইরে ভিন্ রাজ্যের তিনজনকে আমি টিমে রাখবই। ওই তিনজন হবে সেই সময়ের সত্যিকারের ক্রিকেটারদের ছেলে। অবশ্য তাদের পদবিটা আসল হলেও নামটা হত আমার কল্পনাপ্রসূত। আর পাকিস্তানের বা অন্য বিদেশি দলের প্লেয়াররা হত সমসাময়িক প্লেয়ারদের ছেলে।
স্কুলে পৌছোতে পৌঁছোতে লাঞ্চের বিরতি করে দিতাম। এজন্য অবশ্য আমার কাল্পনিক ধারাবিবরণীকে ‘ফাস্ট ফরোয়ার্ড’ করে দিতে হত। আমি আর সমর নট আউট ব্যাটসম্যান। স্কুল ছুটির পর বাড়ি ফেরার পথে পোস্ট টি সেশনের ধারাবিবরণী দিতাম। বাড়ি ফিরতে ফিরতে খেলা ঠিক শেষ হবেই। আর আমি সেঞ্চুরি করে অপরাজিত।
সেই ছোট্ট বেলা থেকেই ক্রিকেট ছিল আমার শয়নে-জাগরণে। ছুটির দিন সকাল সকাল পুকুরপাড়ে গাঁক গাঁক করে রেডিও চালিয়ে টেস্ট ম্যাচের ধারাবিবরণী শুনতে শুনতে জাল ফেলে মাছ ধরা দেখতাম আর মাছ কুড়োতাম। পাড়ার সত্যেন কাকু বা সুধীর জেঠু পুকুরের পাশ দিয়ে যাবার সময় জিজ্ঞাসা করত, রেডিওতে কি ‘ত্রিকেট’ খেলা হচ্ছে? আসলে আমি বা বাবা যতই ‘ক্রিকেট’ বলিনা কেন, ওঁরা ‘ত্রিকেট’ বলবেনই। আমাদের বাড়ির পেছনের মাঠে ধান উঠে যাওয়ার পর বাবা জনমজুর লাগিয়ে ‘নাড়া’ তুলে কোদাল দিয়ে এবড়ো-খেবড়ো মাঠ মসৃণ করিয়ে ‘পিচ’ বানাতেন আমাদের জন্য। অনেকদিন আগে যখন ছুতোর মিস্ত্রি বাড়ির কাজ করছিল তখন বাবার নির্দেশমত সে তক্তা দিয়ে সে দুটো ব্যাট বানিয়ে দিয়েছিল। একটা ছোট আর একটা একটু বড়। বড়োটা বাবার, আর ছোটটা আমার জন্য। আর বল মানে টেনিস বল। বাবা কিনে আনত। ছুটির দিনের বিকেলে আমি আর বাবা যখন খেলতাম পাড়ার ছেলেরা একটু দূরে দাঁড়িয়ে খেলাটা বোঝার চেষ্টা করত। কেউ কেউ বল কুড়িয়ে এনে দিত। কিন্তু খেলতে আসতে চাইত না। ডাকলেও না। মনে হয় খেলাটা বুঝত না বলেই। তবে ওরাও কিন্তু বলত ‘ত্রিকেট’!
তা ত্রিকেট হোক বা ক্রিকেট, চৌত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর আগে সুন্দরবন অঞ্চলের প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে ছেলেরা খেলাটা জানতই না। ধান কাটার পর পাড়ায় পাড়ায় মাঠে গাদি খেলার ‘কোর্ট’ তৈরি করা হত। কোথাওবা হাডুডু-কোর্ট। আর বৌ-বাসন্তি, কিতকিত, চোর-পুলিশ, টিকিট খেলা, কাচের বা পাথরের গুলি, ডাংগুলি তো ছিলই। এইসব দেশি খেলার বাইরে প্রায় সব ছেলেই যে খেলাটা জানত তা হল ফুটবল। ধান কাটার পর কিংবা মাঠে প্রথম বর্ষার পর বল নিয়ে দাপায়নি এমন ছেলে খুব কমই পাওয়া যাবে। বলের অভাবে বাতাবি লেবু নিয়ে খেলা হত কিংবা ছেঁড়া কাপড়কে গোল্লা পাকিয়ে বল বানানোও হত। তখন সুন্দরবনের গ্রাম এলাকার একশো শতাংশ মানুষই ছিল ঘটি। ফলে সবাই মোহনবাগানি। ঘটি-বাঙ্গালের লড়াই তাই দেখাই যেত না। আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে হত কলকাতা ফুটবল লিগ। বিকেলে আড়াইটে-তিনটে থেকে কলকাতা-ক কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হত বাংলায় ধারাবিবরণী। মোহনবাগান মাঠ থেকে বলছি অজয় বসু। আহা কী কাব্যসুষমামন্ডিত বাচনভঙ্গী ছিল অজয় বসুর! পুষ্পেন সরকার, রথীন মিত্ররাও নিজস্ব অননুকরণীয় ভঙ্গীতে বলতেন। আলের উপর রাখা রেডিও ফুল-ভলিউমে চালিয়ে ধারাবিবরণী শুনতে শুনতে লাঙ্গল করত বা ধান রুইতো গ্রামের মানুষরা। আর মোহনবাগান গোল করলেই মাঠ থেকে শোনা যেত ওদের চিল চীৎকার- গোওওওওওল!!!!
আমাদের মাঠে যারা কাজ করত তারা কাজ সেরে ফিরে সন্ধ্যেবেলা যে অনুষ্ঠানটা অবশ্যই শুনত তা হল কৃষিকথার আসর ও মজদুর মন্ডলীর আসর। সন্ধ্যে ছ’টা থেকে হত কলকাতা-ক কেন্দ্রে। দাওয়ায় চাটাই বিছিয়ে চানাচুর, পেঁয়াজ ও লংকা দিয়ে মাখানো মুড়ি খেতে খেতে মাখনদা, ভীমদা, মদনদা, কেষ্টদা, বঙ্কিম জেঠু, সত্যেন কাকু, নিতাই কাকুরা মনোযোগ দিয়ে ওই অনুষ্ঠানটা শুনত। বঙ্কিম জেঠু মাঝে মাঝে বিশেষজ্ঞর মতামত দিত। অবশ্য সব বিষয়েই মতামত দেওয়ার প্রয়োজন মনে করতো। এজন্য আড়ালে-আবডালে অন্যরা বঙ্কিম জেঠুকে নিয়ে হাসাহাসি করত। কৃষিকথার আসর ছাড়াও আর একটা খবর এলাকার ছোটো-বড়ো সব চাষি শুনত। তা হল আবহাওয়ার খবর। বিকেল আড়াইটের স্থানীয় সংবাদের আগে প্রচারিত আবহাওয়ার খবর শোনার আগ্রহ ছিল সবচেয়ে বেশি। দ্বিপ্রাহরিক বিশ্রামের পর মাঠে কাজে যাওয়ার আগে আবহাওয়ার খবরটা শোনা চাই-ই।
সেই সময়ে সকালবেলা মাঠে কাজে যাওয়ার সময় অনেকেই হাতে একটা রেডিও ঝুলিয়ে নিয়ে যেত। প্রায় এক ফুট দৈর্ঘ্য আর আধা ফুট প্রস্থওয়ালা কাঠের ফ্রেমের রেডিও। বেশিরভাগ রেডিওর হাতল হয় ভাঙ্গা হত, নয়তো থাকত না। তাই দড়ি দিয়ে হাতল তৈরি করে কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে যেত।
কম বয়সি ছেলে-ছোকরারাই সকালে বিবিধভারতীতে ছায়াছবির বা আধুনিক বাংলা গান শুনত। খুব জনপ্রিয় ছিল ‘বর্নালী’ ও ‘মঞ্জুষা’। তবে লোকগীতিই ছিল আমাদের এলাকার মানুষের কাছে বেশি সমাদৃত। মানুষের মুখে মুখে ফিরত গোষ্ঠগোপাল দাসের ‘ট্যাংরা তবু কাটন যায়’, ‘হাড় মোর জ্বলিয়া গেল’, ‘গুরু না ভজি মুই’ আর ‘চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে’। রুনা লায়লার ‘সাধের লাউ’, ‘ইস্টিশানের রেলগাড়িটা’ আর ‘সুজন মাঝি রে’ এবং স্বপ্না চক্রবর্তীর ‘বলি ও ননদী আর দু’মুঠো’, ‘বড় লোকের বিটি লো’ আর ‘জয় জয় মা মনসা’-ও ছিল সমান জনপ্রিয়। রেডিওতে প্রায়ই গানগুলো হত। বারবার শোনার জন্য আমারও গানগুলো মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। আর আমাদের ঐ গ্রামের পরিবেশে এই লোকগীতি গুলিকে মনে হত বড়ই আপন, আমাদের বাড়ির রাখাল ছেলে বিশুও গোরু চরাতে চরাতে গানগুলো চীৎকার করে গাইত।
প্রতি বুধবার কৃষিকথার আসরে হত যাত্রাগান। সেদিন রেডিওর সামনে জমে যেত ভীড়। বাড়ির কাজের লোক থেকে শুরু করে পাড়ার অনেক পুরুষ ও মহিলা আসত আমাদের বাড়ি যাত্রা শুনতে। রেডিওটা বারান্দায় বের করে ফুল ভলিউমে চালিয়ে দেওয়া হত। সবাই হাঁ করে শুনত। আমার ঠাকুমা, সরলাদি আর বাসন্তী মাসিকে যাত্রায় দুঃখের অংশ শোনার সময় চোখ মুছতে দেখেছি। তবে আমার সবচেয়ে ভালো লাগত যাত্রা শুরুর কনসার্ট। প্যাঁ প্যাঁ প্যাঁ প্যাঁ করে ক্ল্যারিওনেটের শব্দ এখনও আমার কানে বাজে। টাপু, নান্টুদা আর গোপালদাদের সাথে যাত্রা যাত্রা খেলার সময় একটা লম্বা লাঠিকে ক্ল্যারিনেট বানিয়ে আমি বরাবর বাজিয়েছি।
যাত্রার কথা প্রসঙ্গে অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে আমাদের এলাকায় রেডিওতে যাত্রার বিজ্ঞাপন শোনার আগ্রহের কথা। প্রতিদিন দুপুরে বিবিধ ভারতীতে বিজ্ঞাপনদাতা দ্বারা আয়োজিত অনুষ্ঠানে বিভিন্ন অপেরার যাত্রাপালার অংশবিশেষ শোনানো হত। অরুণ দাশগুপ্ত-বীণা দাশগুপ্তা, নির্মল কুমার-মীনা কুমারী, উজ্জ্বল চ্যাটার্জি-মিতা চ্যাটার্জি, গুরুদাস ধাড়া-জ্যোৎস্না দত্ত, ছন্দা চ্যাটার্জি, রাখাল সিংহ, শান্তিগোপাল, তারারানি পাল, শেখর গাঙ্গুলি, দেবগোপাল ব্যানার্জি, বেলা দাশগুপ্তা প্রমুখের অভিনয় রেডিওতে শোনার জন্য মানুষ মুখিয়ে থাকত। যাদের বাড়িতে রেডিও থাকত দুপুর বেলা তাদের বাড়ি থেকে অবশ্যই যাত্রার বিজ্ঞাপন শোনা যেত। রাখাল সিংহের জলদগম্ভীর কন্ঠে সুবিখ্যাত হাসি আজও কানে বাজে। তবে সবচেয়ে আকর্ষণ বেশি ছিল নট্ট কোম্পানির যাত্রাপালার অংশবিশেষ শোনার। প্রতি শনিবার রাত সাড়ে ন’টায় এ জন্য রেডিও খোলা চাই-ই-চাই। বাবা-মা সহ আমি ওই সময় রেডিওর উপর হামলে পড়তাম। খোকন বিশ্বাসের উদাত্ত কন্ঠে কী সুরমাধুর্য!!! নটী বিনোদিনী, অচল পয়সা, মা মাটি মানুষ, গঙ্গা পুত্র ভীষ্ম, গান্ধারী জননী- কী অসাধারণ সব যাত্রাপালা সৃষ্টি করেছিল নট্ট কোম্পানি। এখন যেমন সিনেমার গান মানুষের মুখে মুখে ফেরে, তখন গ্রামের মানুষের মুখে হিট যাত্রাপালার গান মুখে মুখে ফিরত। আকাশবাণী ই আমাদের সেই গন্ডগ্রামে যেন চীৎপুরকে এনে হাজির করতেন। সেই স্মৃতি আজো অমলিন, আজো কানে লেগে আছে রেডিওতে শোনা “নটী বিনোদিনী” তে নাম ভূমিকাতে বীণা দাশগুপ্ত ও গিরিশ ঘোষের ভূমিকাতে অরুণ দাশগুপ্তের চমকপ্রদ অভিনয়।
মাঝে মাঝে হত তরজা গানের লড়াই। আমার কাছে এই জিনিসটা ছিল ভারি বিস্ময়ের। কী সুন্দর ছন্দ মিলিয়ে সুরে সুরে মুখে মুখে পদ রচনা করে দুই কবিয়াল এক একটা বিষয় নিয়ে লড়াই করত! শুরুতে গুরু ও ঈশ্বরবন্দনা থাকবেই। ঈশ্বর মানে সরস্বতী বা গনেশ। এখনও মনে পড়ে অনেক কবিয়াল তাঁদের গুরু হিসেবে বিনয়কৃষ্ণ সরকার ও রমেশ শীলের নাম বলতেন। আমি রমেশ শীলের তরজা গান শুনিনি, তবে বিনয়কৃষ্ণ সরকারের তরজা গান কিছু শুনেছিলাম। বন্দনার পর কবিয়ালরা তাঁদের অনুষ্ঠান শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে নিবেদন করতেন। তারপর শুরু হত রাধাকৃষ্ণের উদ্দেশ্যে গান। তারপর সখীসংবাদ, বিরহ, লহর ও খেউড়। সবশেষে দুই কবিয়ালের আসল লড়াই। একটু বড়ো হয়ে বাবার মুখে শুনে এই ব্যাপারগুলো একটু বুঝেছি। এই তরজা গান আমার এতটাই ভালো লাগত যে মাঝে মাঝে একাই ডাবল রোলে তরজা গানের লড়াই করার চেষ্টা করতাম। কিছুক্ষণ পর খেই হারিয়ে অবশ্য হাল ছেড়ে দিতাম। আমাদের গ্রামে খুব জনপ্রিয় ছিল তরজা গান। গ্রামে কোনো পুজো উপলক্ষে অনুষ্ঠান হলে তরজা গান হতই। আর যাত্রাপালা মঞ্চস্থ হওয়ার আগেও হত তরজা গান। সন্ধ্যেবেলা পাড়ার মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় অনেকের বাড়ি থেকে রেডিওতে তরজা গান শোনা যেত।
তবে আমার শৈশবে ও কৈশোরে রেডিওতে যে কয়েকটা অনুষ্ঠান খুব মনো্যোগ দিয়ে শুনতাম সেগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল শিশুমহল ও রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষার আসর। প্রতি রবিবার সকাল সাড়ে ন’টায় কলকাতা-ক কেন্দ্রে ইন্দিরাদির সেই অননুকরণীয় কন্ঠ “ছোট্টসোনা বন্ধুরা, তোমাদের ইন্দিরাদি বলছি। কী ভালো আছো তো সব?” এখনও কানে বাজে। ছড়া-কবিতা আবৃত্তি, গান, বাজনা, গল্প, নাটিকা- কী না হত! খুব ইচ্ছে করত আমিও যাই- শিশুমহলে অংশগ্রহণ করি। বাবাকে দু’একবার বলেওছিলাম। কিন্তু কোলকাতা থেকে ১০০ কিমি দূরে অপ্রতুল যোগাযোগ ব্যবস্থা সমন্বিত এক প্রত্যন্ত গ্রামে থেকে সে স্বপ্ন সফল হয়নি। খুব মনে পড়ে বিকেল ৪টে থেকে ‘গল্প দাদুর আসর’। ফাইভ-সিক্সে পড়ার সময় থেকে প্রায় নিয়মিত শুনতাম। পার্থ ঘোষ অসাধারণ পরিচালনা করতেন। তাঁর সেই অদ্ভুত এক ভারী অথচ আদুরে গলায় – “ছোট্ট বন্ধুরা --” টি অন্যরকম ছিল । পরে দেবাশিস বসু যখন পরিচালনা করতে শুরু করলেন, কেন জানি না আমার আগ্রহ কমে গিয়েছিল, হয়তো আমিও আর ছোট ছিলাম না।
তবে রবীন্দ্র সঙ্গীত শিক্ষার আসর আমার জীবনে যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছিল। সত্তর-আশির দশকে প্রত্যন্ত সুন্দরবন অঞ্চলে কোনও কিশোর-কিশোরী প্রাইভেট টিউশন বা শিক্ষকের কাছে গান শেখার কথা ভাবতেই পারত না। যাদের বাড়িতে পারিবারিকভাবে গান-বাজনার চল ছিল, কেবল সেই বাড়ির ছেলে-মেয়েরা গান-বাজনা করার সুযোগ পেত। অধিকাংশেরই প্রথাগত সঙ্গীত শিক্ষা ছিল না- দেখে বা শুনেই গান শিখত। আমিও সৌভাগ্যক্রমে এমন এক পরিবারে জন্মেছিলাম যেখানে গান-বাজনার চর্চা ছিল। বাড়িতে হারমোনিয়ম ও তবলা ছিল। বাবা ভালো নজরুলগীতি ও অতুলপ্রসাদের গান গাইতেন। তবলাও ভালো বাজাতেন। আর জ্ঞান পড়া অবধি দেখেছি বাড়িতে একটা ব্যাঞ্জো ছিল। লাল-কালো ছোপওয়ালা কাঠের ফ্রেম। বাবাকে দু’একবার ব্যাঞ্জোতে গানের সুর বাজাতে দেখেছি। ছোটো থেকে বাবার সাথে গলা মিলিয়ে আমিও নজরুলগীতি ও অতুলপ্রসাদের গান গেয়েছি। আর এভাবেই কবে কবে যে হারমোনিয়ম বাজাতে শিখে গিয়েছিলাম মনে পড়ে না। তখন বাবার গাওয়া গানগুলোই হারমোনিয়মে তুলতাম ও বাজাতাম। বাবা মাঝে মাঝে একটু-আধটু ভুল সংশোধন করে দিতেন। তবে কোনো গানের সুর একবার ‘মরমে পশিয়া গেলে’ ঝটপট হারমোনিয়মে তুলে নিতাম। আজও পারি।
যাইহোক, তখন রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইবার চল আমাদের বাড়িতে একটু কম ছিল। বাবা স্বদেশ পর্যায়ের কিছু গান গাইতেন। আর প্রেম পর্যায়ের একটা গান বেশি গাইতেন- “দূরদেশী সেই রাখাল ছেলে”। আমিও গাইতাম। তবে ইচ্ছে করত আরও রবীন্দ্রসংগীত গাই। একই গান একাধিকবার রেডিওতে শুনে আমি সেই গান বেশ ভালোই হারমোনিয়মে বাজাতে পারতাম। সেই সময় প্রতি রবিবার সকাল ন’টা থেকে হত রবীন্দ্রসংগীত শিক্ষার আসর। পরিচালনা করতেন অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায়। কী ভারী কন্ঠস্বর! আমার অদ্ভুত সুন্দর লাগত। কিছুদিন পর এই অনুষ্ঠানটায় আমার নেশা ধরে গেল। রেডিও আর হারমোনিয়ম একসাথে নিয়ে বসতাম। অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পরও অনেকবার গানটা বাজাতাম। এই প্রসঙ্গে বলি, আমি সা-রে-গা-মা সপ্তসুর ছাড়া আর কোনও স্বরলিপি জানতাম না। বাড়িতে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ও নজরুলগীতির তিন-চারটে পুরানো স্বরলিপি ছিল। সেগুলো দেখে হারমোনিয়মের রিডে আঙ্গুল টিপে টিপে খুঁজে জ্ঞা, দা, না, রা, ণা, হ্মা, র্স ইত্যাদি সংকেতের অর্থ উদ্ধার করেছি। তারপর রেডিওতে সঙ্গীত শিক্ষার আসরে অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায় যে স্বরলিপি বলতেন তা খাতায় তুলে অনুশীলন করতাম। আর এভাবেই শিখে নিয়েছিলাম অনেকগুলো গান যেগুলোর মধ্যে আমার খুব পছন্দের ছিল ‘যে ধ্রুবপদ দিয়েছো বাঁধি বিশ্বতানে’, ‘এ কী লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ’ এবং ‘নীল অঞ্জনঘন পুঞ্জছায়ায় সম্বৃত অম্বর হে গম্ভীর’। এই তিনটে গান পুরো তুলে বাবাকে শোনাতে বাবাও চমৎকৃত হয়েছিলেন।
স্কুলের বার্ষিক প্রোগ্রামে ঐ গানগুলো গেয়ে খুব প্রশংসাও পেয়েছিলাম। পরবর্তীকালে সুচিত্রা মিত্র ও কনিকা বন্দ্যোপাধ্যায় কিছুদিন রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষার আসর পরিচালনা করতেন। এর পরে আসেন সুবিনয় রায়। আমার খুব মনে পড়ে, ওঁর শেখানো গান ‘আজি ঝর ঝর মুখর বাদরদিনে’। গানটা যে দুটো সুরে রবীন্দ্রনাথ সুর করেছেন তা সেই প্রথম জেনেছিলাম। ধীর লয়ে সুরটা আমি সেই প্রথম শুনেছিলাম সুবিনয় রায়ের কাছে। উনি দুটো সুরেই গানটা শিখিয়েছিলেন। আমিও তা শিখে নিয়েছিলাম। আজও ভুলিনি।
আরও একটা গানের কথা আমার খুব মনে পড়ে। প্রতি রবিবার সম্ভবতঃ সওয়া আটটার সময় কলকাতা-ক কেন্দ্রে মালয়ালম ভাষায় গান শেখানো হত। প্রায়শই একটা গানই হত। শুনে শুনে আমার গোটা গানটাই মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। আজও প্রথম কলিটা মনে পড়ে- ‘কুডিবিলাইয়াডি পাপা, নি গুইন্ডুল কালাগাডি পাপা’। আজ ভাবি, রেডিও আমাকে শুধু নিজের ভাষা নয়, একটি দূর প্রদেশের ভাষা সম্পর্কেও আগ্রহী করে তুলেছিল।
আজ থেকে তিরিশ-পঁয়ত্রিশ বছর আগে আমাদের এই সব এলাকায় প্রাইভেট টিউশন পড়ার আদৌ চল ছিল না। গ্রামে দু’একজন ম্যাট্রিক পাশ বয়স্ক মানুষ ছিলেন যাঁদের বাড়ির উঠোনে সকাল-সন্ধ্যে বসত ‘পাঠশালা’। প্রাইমারি স্কুলে পাঠরত কিছু বাচ্চা ছেলেমেয়ে বাড়ি থেকে আনা তালপাতার তৈরি আসনে বসে দুলে দুলে সুর করে পড়ত। তবে হাইস্কুলের দু’একজন মাস্টারমশাই তখনও টিউশন পড়াতেন। আর্থিকভাবে সচ্ছ্বল পরিবারের কিছু ছেলেমেয়ে মুলতঃ অঙ্ক ও ইংরেজি এই দুটো বিষয়ই টিউশন পড়ত। তাই ওই সময় অনেক ছাত্রছাত্রী রেডিওতে বিদ্যার্থীদের জন্য অনুষ্ঠান নিয়মিত শুনত। আমিও শুনতাম। নিয়মিত না হলেও প্রায়ই। ইংরেজি গ্রামার আর বাংলা ব্যাকরণটা খুব মন দিয়ে শুনতাম। ইংরেজিতে ফ্রেজ-ইডিয়ম আর ট্রান্সফরমেশন অফ সেন্টেন্স এবং বাংলায় সমাস আর কারক বিভক্তি ভালোভাবে শিখতে খুব সাহায্য করেছিল বিদ্যার্থীদের জন্য অনুষ্ঠান।
আমি ছোটো থেকেই ডিটেকটিভ গল্পের পোকা ছিলাম। ফেলুদা আর কাকাবাবু বলতে এক্কেবারে অজ্ঞান! তবে শার্লক হোমসের সাথে আমার পরিচয় রেডিওর নাটক শুনে। সম্ভবতঃ প্রতি শনিবার রাত পৌনে দশটায় ‘পিথ্রি রহস্য রোমাঞ্চ সিরিজ’ আর রবিবার দুপুর পৌনে দুটোয় ‘হাতুড়ি মার্কা ফিনাইল এক্সের শনিবারের বারবেলা’-তে ডিটেকটিভ নাটক শুনতে মুখিয়ে থাকতাম আমি, এমনকি বাবা ও মা। পিথ্রী র নাটক শুরুর আগে কাজী সব্যসাচীর সেই ভরাট গলায় –“পি মানে পারফেক্ট ফিটিং, ---” শুনেই কেমন যেন রহস্যের আবহাওয়া তৈরী হয়ে যেত।
এই দুটো বিজ্ঞাপনদাতা দ্বারা আয়োজিত অনুষ্ঠানে আর্থার কোনান ডয়েল, জেমস হ্যাডলি চেজ, আগাথা ক্রিস্টি, মারিয়া পুজো প্রমুখের অসাধারণ সব রহস্য-রোমাঞ্চভরা কাহিনির বাংলা নাট্যরূপ শুনেছি। আর্থার কোনান ডয়েলের ‘দ্য সাইন অফ ফোর’ অবলম্বনে ‘চারের সংকেত’ বা ‘দ্য হাউন্ড অফ বাস্কারভিলস’ অবলম্বনে ‘বাস্কারভিলের কুকুর’ এবং মারিও পুজোর জগদ্বিখ্যাত উপন্যাস ‘গডফাদার’-এর পরবর্তী এপিসোড শোনার জন্য তখন সব উন্মুখ হয়ে থাকতাম পুরো সপ্তাহ। ‘দ্য হাউন্ড অফ বাস্কারভিলস’-এ ভয়ানক সেই কুকুরের ডাক আজও ভাবলে গায়ের লোম খাড়া হয়ে ওঠে।
যন্ত্রে যন্ত্রণা থাকবে না, তা কি হয়! রেডিও বিগড়ে যেত মাঝে মাঝে। আমাদের রেডিওটা ছিল প্রায় চোদ্দো ইঞ্চি টিভির সাইজের! নাড়াচাড়া করা ছিল বেশ কষ্ট সাধ্য। রেডিওর ব্যাটারির চার্জ ফুরিয়ে গেলে ভারি সমস্যা হত। কাছেপিঠে কোনও দোকান ছিল না। সেই কাকদ্বীপ শহর থেকে কিনতে হত ব্যাটারি। জরুরি প্রয়োজনে টর্চ লাইটের ব্যাটারি খুলে রেডিওতে ভরা হত। কখনও বা ভেঙ্গে যেত ব্যাটারির বাক্স। তখন আবার এক সমস্যা। রেডিওর ছাদে তোলা থাকত সেই বাক্স। বাক্স ভাঙলে বা যান্ত্রিক গোলযোগ হলে রেডিওর গন্তব্য হত মানিকদার বাড়ি। বাবার চেয়ে মানিকদা ৮-১০ বছরের ছোট হলেও বাবাকে কাকু বলে সম্বোধন করত বলে আমি দাদা বলতাম। আমাদের গ্রামে একা মানিকদাই পারত রেডিও সারাতে। পেশায় স্কুলশিক্ষক মানিকদার এজন্য খুব ডিমান্ড ছিল। মানিকদার মাটির বাড়ির সামনের দিকে একটা ছোট্ট ঘর সবসময় অনেক পুরানো ও খারাপ হওয়া রেডিওতে ভরে থাকতে দেখেছি। রেডিও খারাপ অথচ মোহনবাগান বা ভারতের খেলা আছে- এমন অবস্থা হলে তাগাদা দিতে আমি বহুবার মানিকদার বাড়ি দৌড়োতাম। মোমবাতির আগুনে তাতাল গরম করে রাং দিয়ে রেডিওর তার জোড়া দেওয়া দেখে আমিও বাড়িতে ভাঙ্গা বাক্স নিয়ে রেডিও সারানো খেলা খেলতাম!
সেই সত্তর ও আশির দশকে পশ্চিম দিগন্তে সূর্য মুখ লুকোনোর সাথে সাথে আমার বিদ্যুৎহীন গ্রাম ঢাকা পড়ে যেত ঘন বুনটের অন্ধকারের চাদরে। পথচলতি দু’একজন মানুষের টর্চ লাইটের আলো আর ইতিউতি জোনাকির ওড়াউড়ি ছাড়া আর কোথাও দেখা যেত না আলোর নিশানা। সন্ধ্যের আগেই সব বাড়িতে রাতের খাবার তৈরি হয়ে যেত। আর সাড়ে সাতটায় আকাশবাণীর দিল্লি কেন্দ্র থেকে প্রচারিত সংবাদ শেষ হওয়ার আগেই খাওয়ার পাট চুকে যেত। আটটার মধ্যেই অধিকাংশ বাড়িতে নিভে যেত কেরোসিনের কুপি।
কেটে গেছে প্রায় চার দশক। আমাদের সুন্দরবনের সেই প্রত্যন্ত গ্রামে এখন সত্তর শতাংশ বাড়ি পাকা। পাকা বাড়ির ছাদে আকাশপানে মাথা তুলে হাঁ করে আছে ডিস অ্যানটেনা। গ্রামের মাঝখান দিয়ে চলে গেছে বাস রাস্তা। হয়েছে স্কুল ও ব্যাঙ্ক। আকাশ ছুঁয়ে আছে তিনটে মোবাইল টাওয়ার। বর্ষায় হাঁটলে আর পায়ে কাদা লাগে না। বাড়ির উঠোনে, মাঠে, রাস্তায় সর্বত্র ব্যাট-বল নিয়ে ছেলেদের দাপাদাপি। জমজমাট বাজার সড়কের উপর। বিদ্যুতের আলোয় গ্রাম আলোকিত। প্রতি বাড়িতে রঙ্গিন টিভি। সন্ধ্যে হলে আর কেউ রেডিওতে যাত্রাপালা, তরজা গান বা কৃষিকথার আসর শোনে না, শোনে বাংলা সিরিয়ালের কাঁদুনি। জমিতে আজও চাষের কাজ হয়, কিন্তু রেডিও চালিয়ে কেউ গান শোনে না। চলে মোবাইলে চলতি বাংলা বা হিন্দি সিনেমার গান কিংবা বাংলাদেশের শিল্পীর চটুল বাংলা গান। চার দশক আগে রেডিও ছিল গ্রামের মানুষের কাছে এক দ্রষ্টব্য বস্তু। আজও তাই, তবে বিলুপ্তপ্রায় হিসেবে।
লেখক পরিচিতি - বেড়ে ওঠা, স্কুলের পড়াশুনা কাকদ্বীপে। লেখালেখি,গানবাজনার
চর্চা শৈশব থেকেই। ১৯৯২ সালে উদ্ভিদবিদ্যায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি।
বর্তমানে কাকদ্বীপের কাছে একটি উচ্চমাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক। পাশাপাশি
পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চের একজন সক্রিয় সংগঠক। ছড়া, কবিতা, গল্প,
নাটিকা, প্রবন্ধ নিয়মিত প্রকাশিত প্রথম সারির বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।