কান পেতে রই...
অবসর (বিশেষ) সংখ্যা , ডিসেম্বর ৩০, ২০১৪
আমার ‘বন্ধু, শিক্ষক’
সৌম্য দাশগুপ্ত
আমাদের ছোটবেলায় দুটি মাত্র বন্ধুর হাত ধরেই আমাদের বহির্দর্শন হত। দুঃখ লাগে তাদের মধ্যে একজনের হয়তো আর কিছুদিনের মধ্যেই পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটবে। মুদ্রিত সংবাদপত্রের জীবদ্দশার প্রায় ফুরিয়ে এল। অন্যটি – রেডিও, প্রায় বিলুপ্তির পথে যেতে যতে নতুন প্রযুক্তির (FM / Internet) হাত ধরে আবার পুনর্জীবন লাভ করেছে।
আমাদের বাড়ীতে বাংলাগানের অনুষ্ঠানের চল তো ছিলই, - ‘অনুরোধের আসর’ সময়ে-অসময়ে তখন আমদের মন জুড়ে থাকত। কি অপূর্ব ছিল রেডিওর নাটকগুলি – একবার শুনতে শুরু করলে নড়াচড়ার জো ছিলনা। তবে এছাড়াও আমাদের বাড়ীতে কয়েকটি ইংরেজি অনুষ্ঠান শোনার চল ছিল। সেগুলিও খুব জনপ্রিয় ছিল – যদ্দূর মনে পড়ে রবিবারে একটি অনুষ্ঠান হত –“Musical bandbox”। আর অন্য দিনে থাকত- “Lunchtime Variety”!! আকাশবাণীর মিউজিকাল ব্যান্ডবক্স প্রেজেন্ট করতেন একেবারে কেতাদুরস্ত সাহেবি উচ্চারণের এক প্রেজেন্টার - বি.কে.। পরে জানা গেল আসলে ইনি আগাগোড়া বাঙ্গালি - নাম বরুণ হালদার।
এই দুটি অনুষ্ঠানই ছিল আমাদের বিশ্ব সঙ্গীত জগতের দিগদর্শক। তখন না ছিল স্যাটেলাইট টেলিভিশন, না ইন্টারনেট – এই দুটি বেতার অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়েই আমাদের পরিচয় ঘটত বহির্বিশ্বে ঘটে যাওয়া সঙ্গীতজগতের পট পরিবর্তনের সঙ্গে। এই অনুষ্ঠানে যে গানগুলো শুনতাম, তার রেকর্ড কেনার খুব ইচ্ছে হত, কিন্তু তাদের অধিকাংশই সুলভ ছিলনা। ফ্রী স্কুল স্ট্রীটে একটা ছোট খাটো দোকান ছিল, সেখানে আমরা মাঝে মাঝে গিয়েই হাজির হতাম রেকর্ডের সন্ধানে।
এই প্রোগ্রামগুলোর মধ্যে দিয়েই কিন্তু শুরু হয়েছিল আমাদের সারা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা নানারকম সঙ্গীতের স্বাদ গ্রহণের ‘সহজ পাঠ’। ফোক, রক, জ্যাজ, পপ – আর তাদের মধ্যে ছড়িয়ে থাকা সবকিছু। এমনকি পাশ্চাত্য উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের জন্যেও কিছু সময় নির্দিষ্ট থাকত – তাও আমরা খুব কৌতূহলভরে মন দিয়ে শুনতাম। বিশ্ব সঙ্গীতের সব রথী, মহারথীদের সঙ্গে আমার পরিচয় এই অনুষ্ঠানগুলোর মধ্যে দিয়েই। তাদের কজনের নামগুলি, Simon & Garfunkel (S&G), Beatles, Neil Diamond, Carpenters, ইত্যাদি।
সেই সময়, বিশ্ব সঙ্গীতের যে দিকবদল বা পালাবদল হচ্ছিল তা আমরা এই অনুষ্ঠানগুলোর মাধ্যমেই জানতে পারতাম। আমরা যারা তখন গান-বাজনার চর্চা করতাম, চেষ্টা করতাম এই পালাবদলের সঙ্গে নিজেদের চেতনাগুলোকে মানিয়ে নিতে। আসলে তখন তো আর অন্য কোন উপায় ছিলনা, - তাই এই অনুষ্ঠান গুলোই আমাদের এত কিছু দিয়েছিল আজও তা মনে করলে নিজেদের খুব ভাগ্যবান আর কৃতজ্ঞ লাগে।
ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়, আমার নিজের সঙ্গীত শিক্ষার ক্ষেত্রে, এই আসরগুলির এক অনন্য ভূমিকা ছিল। সেই সময় আমি গীটার শিখতাম। অন্য শিক্ষার্থীর মতই চাইতাম প্রতিষ্ঠিত মিউজিসিয়ানদের সঙ্গে বাজিয়ে নিজেকে পরখ করার বা আরো নিজেকে উন্নত করার। কিন্তু সেটা সম্ভব ছিলনা। সেইখানেই এই অনুষ্ঠানগুলির গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।
রেডিওতে গান বাজত আর সব গানগুলোর সাথে আমিও গীটার বাজাতে শুরু করতাম। সেইসঙ্গে বোঝার চেষ্টা করতাম বিভিন্ন কর্ডের গতি-প্রকৃতি, তার সাথে নিজের কারুকাজ ও জুড়তে থাকতাম। স্বাভাবিক ভাবেই, প্রথম দিকে একেবারেই জুৎ করতে পারতাম না, কিন্তু তাও লেগে থাকতাম। ক্রমশ: জিনিষটা আমার ধাতে এল। আস্তে আস্তে আমার সামনে খুলে যেতে থাকল এক নতুন দিগন্ত। বেশ কয়েক বছর চেষ্টা চালালাম, যেহেতু পরিবারেও সবাই গানের জগতের লোক, খুব উৎসাহ দিতে লাগলেন সকলেই। এরপর একদিন আবিষ্কার করলাম। অধিকাংশ গানের সঙ্গেই আমি বেশ ঠিকঠাক বাজাতে পারছি – ব্যতিক্রম খুব জটিল কোন জ্যাজ মিউজিক। অনেকটাই আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেল, - এরপর অন্যান্য বাজিয়েদের সঙ্গে দিব্যি বাজিয়ে যেতে লাগলাম। আজও আমার মনে হয়, আমার সঙ্গীতশিক্ষার প্রারম্ভে রেডিওর এই ভূমিকার জন্য আমি তার কাছে চির কৃতজ্ঞ থাকব।
রেডিও আজ ও আমার সঙ্গী। আসলে যোগটা এতই আন্তরিক তা আর ছিন্ন হওয়ার নয়। এখন অবশ্য অধিকাংশ সময়ই রেডিও শোনা হয় গাড়ী চালাতে চালাতে,- তাও মনে হয় রেডিও ছাড়া জীবনটা একেবারে অচল!
(ভাষান্তর - ভাস্কর বসু)
লেখক পরিচিতি - – সৌম্য দাশগুপ্ত – পেশায় আর্কিটেক্ট – সঙ্গীত বরাবরের নেশা। বাবা বিখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক, সুধীন দাশগুপ্তের কাছে প্রথম সঙ্গীত শিক্ষার পাঠ। পাশ্চাত্য সঙ্গীতে বিশেষত: যন্ত্রসঙ্গীতে বরাবরের আকর্ষণ। গত দুই দশক ধরে ওমান নিবাসী। বর্তমানে নতুন কিছু মিউজিক নিয়ে পরীক্ষায় ব্যস্ত।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।